মন নিয়ে পর্ব-০৮

0
169

মন নিয়ে (পর্ব ৮

পরদিন সকালে উঠতে একটু দেরীই হয়ে গেল পারির। ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা বাজে। সর্বনাশ করেছে। একটু পরেই ডাইনিং ক্লোজ করে দিবে। ঝটপট উঠেই বাথরুমের দিকে দৌড় দিল পারি।
হাত মুখ ধুয়ে ডাকাডাকি করতে আরম্ভ করে দিল— জেরিন! জেরিন! গেট আপ।
কোনো উত্তর নাই। জেরিন রুমেই নাই। আশ্চর্য তো। গতরাতে ফিরতে বেশি দেরী করেনি। এসেই শুয়ে পড়েছিল। বলছিল খুব টায়ার্ড লাগছে। এখন গেল কই জেরিন?
অপেক্ষা না করে পারি ডাইনিং এর দিকে রওনা দিল। ততক্ষণে ডাইনিং প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। ঝটপট একটা বেগল টোস্ট করে ক্রিম চিজ লাগিয়ে খেয়ে নিল। চা নিয়ে বসল কিন্তু খেয়ে আরাম হল না। গতরাতের পর মন মেজাজ কেমন খাপ্পা হয়ে আছে। যা দেখছে, যা খাচ্ছে তাই বিরক্ত লাগছে।

উঠে পড়ল পারি। রিসেপশানে গিয়ে পিরামিড ট্যুরের খোঁজ নিতে নিতে জেরিনকে ফোন দিল। জেরিনের ফোন সুইচড অফ। এদিকে রিসেপশান থেকে ওকে জানালো প্রথম ট্যুর বাস কেবলি ছেড়ে দিয়েছে। পরেরটা সেই বারোটায়।
সত্যি, একেকটা দিন যেন কুফা দিয়ে শুরু হয়। বিরক্তি নিয়ে হোটেল থেকে বের হতেই সামনে এক গাড়ি ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল রিক। কালো সানগ্লাস নামিয়ে প্রশ্ন করল

— হাই। হ্যাভ ইউ সিন সাফাত?
— নো।
— আই ক্যাননট ফাইন্ড হিম।
— আই ক্যানট ফাইন্ড জেরিন আইদার। ফোনেও পাচ্ছি না।
— আমিও তো না।
এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। বিরক্ত হল রিক
— তারমানে ওরা দুজনে একসাথে বেরিয়েছে। ফাইন। বলে গেলে কি হয়?
— সেটা তো আমারও কথা।
ওকে ভালোভাবে লক্ষ করল রিক
— ইউ লুক লাইক ইউ আর ইন এ ব্যাড মুড। ইজ এভ্রিথিং ওকে?
— আই নিড টি। দুইদিন ধরে এদের ট্যালটেলে চা খেয়ে মাথা ধরে আছে।

মাথা তো ধরবেই। লুকিয়ে একজন ম্যারিড লোকের সাথে গদগদ হয়ে ডিনার করলে যে অপরাধবোধ হয়, তার ফলাফল হচ্ছে মাথাব্যথা। মুখে বলল
— কাম উইথ মি দেন। টি শপে যাই। ওখানে অনেক ধরণের চা পাওয়া যায়। তোমার পছন্দ হবে।

গাড়িতে গিয়ে উঠল পারি। চা না খেলে ও মাথা ব্যথায় মরে যাবে। দিনটাই মাটি হবে। আজকে তো শেষ দিন। আজকে পিরামিড না দেখলে আর কি দেখা হবে?
লার্জ হানি জিঞ্জার এনার্জাইজিং টি তে চুমুক দিয়ে গভীর তৃপ্তির শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল পারি। কীসব শুকনো হার্ব দিয়েছে চায়ে। চুমুক দেয়ামাত্র শরীর মন চনমনে হয়ে যাচ্ছে। খুব দরকার ছিল এটার।
— গুড?
চোখ খুলে মৃদু হাসল পারি।
— আই রিয়েলি নিডেড দিস। থ্যাঙ্ক ইউ।
— নো প্রবলেম।

কিছুক্ষণ দুজনে চুপ। রিকই একসময়ে নীরবতা ভাঙল।
— কী প্ল্যান ছিল তোমাদের আজ?
মুখ বিকৃত করল পারি।
— প্ল্যান পুরা পানিতে পড়ে যাচ্ছে মনেহয়।
— কেন?
— জেরিনের সাথে চিচেন ইতসার পিরামিড দেখার কথা ছিল। এখন জেরিন নাই। ট্যুরের বাস এইমাত্র ছেড়ে দিল। পরের বাস ১২টার সময়। এখন ১২টা পর্যন্ত বসেবসে আমাকে মাছি মারতে হবে।

রিক এক দৃষ্টিতে পারিকে লক্ষ করতে থাকে। তাহলে গতরাতের ম্যারিড লোকটার সাথে কোনো প্ল্যান নাই যা বোঝা যাচ্ছে। কেন জানি পুরা ঘটনাটা রিককে খুব বিচলিত করছে। কেন করছে সেটার জন্যও রিক মনেমনে বিরক্ত হচ্ছে। পারিজা একটা এডাল্ট মেয়ে। ও কী করল না করল সেনিয়ে ভাববার কোনো দরকার আছে?
— কারণ তুমি মেয়েটার প্রতি আকৃষ্ট, বুদ্ধু! রিকের মন ওকে জানালো।
ভীষণ বিরক্ত হল রিক।
— ইম্পসিবল! আই এম জাস্ট কিউরিয়াস, দ্যাটস অল।
— জাস্ট কিউরিয়াস! এজন্য সকালেই দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এসেছ, না? আর এখন ওর মাথাব্যথা শুনে চায়ের দোকানে নিয়ে এলে! ওর মাথাব্যথা তো তোমার কি?
— লোকের উপকার করব না? আশ্চর্য কথা বলছ তুমি, মিন মাইন্ডেড একটা!
— উপকার করছ? আচ্ছা, করো গে উপকার!
— শাট আপ!

— আমার সাথে যেতে পার। কেউ যেন রিককে দিয়ে বলিয়ে নিল।
পারির চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠল। তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নিল রিক।
— মানে আমি চিচেন ইতজার দিকেই যাচ্ছি। তুমি আসতে পার। সময়ও বাঁচবে তাহলে।
— তোমার সাথে? কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল পারি।
কেন, ওর সাথে গেলে অসুবিধা আছে? নাকি বিবাহিত না বলে ওর কোনো ভ্যালু নাই?
— হ্যাঁ, আমার সাথে। অসুবিধা তো নাই। দুজনে একদিকেই যাচ্ছি যখন। নাকি ভয় পাচ্ছ?
ভ্রূ কুঁচকে গেল পারির।
— ভয় পাব কেন?
— ভাবছ আমি তোমাকে কিডন্যাপ করব!
— কিডন্যাপই বা করবে কেন?
— বলিদান করার জন্য।
— বলিদান? কী আবোল তাবোল বকছ। মাথা ঠিক আছে তোমার?
— মাথা ঠিক থাকবে না কেন? চিচেন ইতজা পিরামিডে একসময়ে নরবলি দেয়া হত, জানো না বুঝি?
— হত নাকি?
— হত তো!
— সে তো অনেক আগের কথা। তুমি হঠাত আমাকে বলি দিতে যাবে কেন?
— আচ্ছা বাদ দাও। আই ওয়াজ জাস্ট জোকিং। এখন ওঠো।
— কই যাব?
— আহ! বললাম না আমার সাথে চলো চিচেন ইতসায়। খামাখাই বারোটা পর্যন্ত বসে থাকবে কেন?

একটু ভাবল পারি। রিক যা বলছে, ঠিকই বলছে। অযথা সময় নষ্ট না করে এখন রওনা দিলে হাতে সময় নিয়ে ঘোরা যাবে।
— আর ইউ শিওর?
— শিওর না তো কি? এমনি এমনি বলছি নাকি? শোনো, তোমার যদি কথা না বলতে ইচ্ছা করে তো বোলো না। কথা বলতেই হবে এমন কোনো কথা নাই।
পারির বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়ছিল।
— কথা বলতেই বা ইচ্ছা করবে না কেন?
— অনেক সময় তো করে না। রিক নিজের ওপরে এত বিরক্ত হচ্ছিল যে বলবার না। এসব কী বলছে ও?
— চল রওনা দেই তাহলে। উঠে দাঁড়াল পারি। এ আজব কথোপকথন আর বাড়িয়ে লাভ নাই। চিচেন ইতজা দেখতে পেলেই হল ওর। গাড়িতে একদম চুপ করে বসে থাকবে নাহয়।

গাড়িতে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল পারি। খুব গরম পড়েছে আজ। শহর পার হতেই কেমন একটা গ্রাম গ্রাম পরিবেশ হয়ে গেল। ছাড়াছাড়াভাবে দুই একটা বাড়ি। চাকচিক্যহীন। হুট করে কয়েকটা ছিরিছাদহীন দোকান। বেশিরভাগ হাতে তৈরী জিনিস বিক্রি করছে। ব্যাগ, কাঠের কাজ করা ডেকোরেশান, আয়না, ড্রিম ক্যাচার, মায়া ক্যালেন্ডার, বাঁশি। আরও রয়েছে নানান আকৃতির ঝুড়ি মতো দেখতে জিনিস যা মূলত ঝুলিয়ে ঘরের শোভাবর্ধন করা হয়। ঝিনুকের তৈরী জিনিসও রয়েছে।
পাশে বসে গাড়ি চালাতে চালাতে রিক এক একবার করে পারিকে আড়চোখে দেখে নিচ্ছিল। কথা না বলতে চাইলে বলার দরকার নাই— এটাকে পারিজা এত সিরিয়াসলি নিবে ভাবেনি। নাকি সে গতরাতের ঐ বিবাহিত লোকটি না, সেজন্য পারিজার মুখে বোল ফুটছে না।
ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামালো রিক। ড্যাশবোর্ড ধরে নিজেকে সামলালো পারি।
— কী হয়েছে?
— একটা হ্যাট কিনব। যে গরম।
— ওহ, এখানে হ্যাট কই পাবে?
— ঐ তো হ্যাট নিয়ে বসে রয়েছে একটা লোক। তুমি নামবে না?
— না, তুমি কেনো।
— ওকে দেন।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রিক। ইচ্ছা করে সময় নিয়ে হ্যাট দেখতে থাকে, দোকানের লোকটার সাথে কথা চালিয়ে যায়।
গাড়ির গরমে সিদ্ধ হতে থাকে পারি। একসময়ে না পারতে বেরিয়ে আসে। হ্যাটের দোকানের পাশেই পরপর তিনটা হ্যান্ডিক্র্যাফটস এর দোকান। একটায় গিয়ে ঢুকল পারি। এটাসেটা দেখতে থাকে। অল্পবয়সী একটা মেয়ে কোলে বাচ্চা নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়।
— ওলা কোমোস্তা।
বুঝল মেয়েটাই দোকান চালাচ্ছে। পারি আসলে কিছু কিনবে বলে ঢোকেনি, স্রেফ সময় কাটাচ্ছিল। কিন্তু এখন কিছু না কিনে বের হয়ে যেতেও খারাপ লাগছে।
হঠাত চোখে পড়ল কাউন্টারের ওপরে জুসের বোতল। আনারসের। তাজা আনারসের জুস কেনা যায়। যে গরম, একটু পরেই পানির পিপাসায় জান বের হয়ে যাবে।
বড়ো সাইজের জুসের বোতল দুইটা তুলে নিল পারি।— হাউ মাচ?
মেয়েটা যা বলল কিছু বুঝতে পারল না পারি।
— নো ইংলিশ?
— সি।

বিপদে পড়ে গেল পারি। আঙুল দিয়ে জুসের বোতল দেখিয়ে আবার প্রশ্ন করল
— হাউ মাচ?
মেয়েটা কী বলল এবারেও বুঝতে পারল না পারি।
— পারিজা।
হাতে হ্যাট নিয়ে রিক দোকানে এসে দাঁড়িয়েছে।
অসহায়ের মতো তাকালো পারি।— আমি এ দুইটা জুসের বোতল কিনতে চাইছি। একটু জিজ্ঞেস করবে কত দাম চায়?
রিকের স্প্যানিশ কাজ চালানোর মতো। সে মেয়েটির সাথে দামদর করে পকেটে হাত ঢুকাতে গেলে পারি বাধা দিয়ে উঠল।
— আই উইল পে।
— অসুবিধা নাই। আমার কাছে চেঞ্জ আছে।
— ওকে। বাট লাঞ্চ ইজ অন মি।
— তুমি লাঞ্চ খাওয়াতে চাও?
— হু। সব জায়গায় তুমি দাম দেবে কেন? লাঞ্চ আমি খাওয়াবো।
— ইফ ইউ উইশ, পারিজা।
— ডোন্ট কল মি পারিজা।
— দেখো, ভুল ডাকার চেয়ে কিছুটা শুদ্ধ ডাকাই ভালো না?

পারি জবাব দিল না। যা খুশি তাই বলুক গে। কেন যেন মনে হচ্ছে আজ না এলেই ভালো হত। কিন্তু এখন টু লেট। ফিরে যেতে চাইলে রিক ওকে বদ্ধ উন্মাদ ভাববে। কিন্তু কেন যেন মন বলছে আজ কিছু একটা গোলমাল হবে।
আধা ঘন্টার মধ্যে ওরা চিচেন ইতজায় পৌঁছে গেল। ঢোকার মুখে টিকিট কাটতে হয়। ভিতরে ঢুকেই রিক প্রশ্ন করল
— আগে কিছু খেয়ে নেবে?
পারি অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিল। কেমন চমকে গেল
— আর ইউ ওকে?
ফ্যাঁকাসে হাসল পারি।
— আই এম পার্ফেক্টলি ফাইন।
— মনে হচ্ছে তুমি কিছু নিয়ে চিন্তিত।
— একেবারেই না। খাবার কথা বলছ? আগে দেখে নিব না?
— অনেক হাঁটতে হবে কিন্তু। এ রোদের মধ্যে অতখানি হাঁটলে আধমরা হয়ে যাবে। বরং খেয়েই নেই আগে, কি বলো?
নিঃস্পৃহস্বরে উত্তর দিল পারি
— তাহলে আগে খাই চল।

একটাই রেস্তোরা। খাবার মেনুও লিমিটেড। পিজ্জা অর্ডার দিল ওরা। অপেক্ষা করতে করতে পারি প্রশ্ন করল
— তুমি কিভাবে জানলে অনেক হাঁটতে হবে?
— আমি গ্র্যাজুয়েশান শেষ করে বন্ধুদের সাথে এখানে এসেছিলাম। তখন দেখেছি।
— তাহলে এটা তোমার সেকেন্ড ভিজিট?
— হু।
— তুমি রিয়েলি সাফাতকে সাপোর্ট করতে এতদূর এসেছ?
— হু।
— ওয়াও। আজকাল কে করে এমন?
অপ্রস্তুত হল রিক
— ইটস নাথিং।
— পিরামিড দেখে কেমন লেগেছিল?

পারির কৌতূহল দেখে রিকের কেন যেন ভালো লাগছে। এতক্ষণ মুখে তালা ঝুলিয়ে ছিল। এখন অন্তত কথা বলছে, ওর সম্বন্ধে জানতে চাইছে।
— সত্যি কথা জানতে চাও?
— মিথ্যা কথা জানতে চাইব কেন? পারি তীর্যকভাবে প্রশ্ন করল।
— নাহ থাক, বলব না।
— আশ্চর্য ব্যপার। বলবে না কেন?
— নিজের চোখে দেখ, তারপর বলব। তোমার সারপ্রাইজ নষ্ট করতে চাই না।
ওদের পিজ্জা চলে এল। এক কামড় দিল পারি।
— পিজ্জা বেশি ভালো না।
— তা না। কিন্তু এটাই এভাইলেবল। কী আর করা যাবে, বলো।
হুট করে একটা কথা মনে এল পারির।
— তুমি অনেক ইজিগোয়িং না?
— খামোখা জীবন জটিল করে লাভ আছে? ইজিগোয়িং হওয়াই কি ভালো না?
একটা ছায়া নেমে এলো পারির মুখে।
— না, লাভ নাই এটা ঠিক।

নিজেকে থাপড়াতে ইচ্ছা করল রিকের। কী সুন্দর কথা বলছিল পারিজা, দিল ওর মুড খারাপ করে। নিশ্চয় ঐ লোকটার কথা মনে পড়ে গেছে ওর। তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল
— এখানেও একটা সিনোটি আছে কিন্তু। তবে অনেক পুরানো।
— সত্যি?
— হুম। সিনোটিতে অনেক কিছু পাওয়া গেছে।
— কী?
— যখন দেখবে তখন বলব। আগে বললে সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যাবে।
— আবার এক কথা? ফিক করে হেসে ফেলল পারি।

মেয়েটার হাসিটা দেখি অসম্ভব সুন্দর, ভাবল রিক। হাসে না কেন ও? যতদূর মনে পড়ছে, এই প্রথম ওকে হাসতে দেখছে। অথচ হাসলে ওর চেহারা ঝলমল করে ওঠে যেন।
(চলবে)