মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-১৭

0
432

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#সপ্তদশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

বেশিক্ষন রাইয়ের দৃষ্টি সহ্য করতে পারলোনা রণ।ধীরে ধীরে নিজের মাথাটা নামিয়ে আনলো রাইয়ের কাঁধে। তারপর ওর হাতদুটো ছেড়ে নিজের দুহাত দিয়ে ওর পিঠ জড়িয়ে ওকে টেনে আনলো নিজের বুকে,মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে।
রাই বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে,শুধু অনুভব করতে পারছিল রণ আর নিজের হার্টবিট,দুটোই যেন পাল্লা দিয়ে দৌড়ছে।
দরজার ধারে ওভাবে কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল ওরা নিজেরাও জানেনা।দুজনের মনের মধ্যেটা এত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল যে ওই অবস্থা থেকে সরতে মন চাইছিল না কারোর ই।
রাই রণর কথা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এটা অনুমান করতে পারছিল রণ জেনে গেছে ওর আর অনিকেতের সম্পর্ক ভাঙার কথা।
ওর অনুমান কে সঠিক প্রমান করে রণই আগে কথা বললো,”অনিকেতের সাথে কি হয়েছিল তোর?কেন ভেঙে গেল সম্পর্কটা?তুই তো খুব খুশি ছিলি ওর সাথে,তাহলে?”

রাই চোখ বুজে রণর বুকে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকলো,কি বলবে ভেবে পেলোনা।ওর খালি মনে হচ্ছিল এটা স্বপ্ন।নাহলে শীর্ষা দির ঘটনাটার পর ও তো সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিল।

ওকে চুপ থাকতে দেখে রণর কেমন সন্দেহ হল,নিজে মাথা সোজা করে রাইকে টেনে বের করলো নিজের বুক থেকে।কিন্তু ওর মুখ দেখে অবাক হয়ে গেল।চোখ বোজা,মুখে স্মিত হাসি,আর পুরো মুখ জুড়ে অপার এক শান্তি।
রণ ধীরে ধীরে ডানহাত দিয়ে রাইয়ের মুখের ওপর এসে পড়া চুলের সরু গোছা সরিয়ে দিল।চোখ মেলে তাকালো রাই।রণর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, যেন রণ যেটা করেছে সেটা হওয়ার ছিল।রণও হাসি ফিরিয়ে দিলো ।তারপর রাইকে আস্তে করে বললো,”তোর কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে,বলার আছে আরও বেশি।চল তোর ঘরে গিয়ে বসি।”
রাইকে ছেড়ে রণ নিজেই এগিয়ে গেলো রাইয়ের রুমের দিকে। আজ অবধি এই ফ্ল্যাটে রাইরা আসার পর থেকে রাইয়ের ঘরে ঢোকেনি রণ,আজ ওর পারমিশন না নিয়েই এগিয়ে গেলো ওই ঘরটার দিকে।মেইন গেট লক করে রাইও রণর পিছন পিছন এল,ওর হার্টবিট তখনও স্বাভাবিক হয়নি।

রণ রুমে কোথাও না বসে সোজা ব্যালকনির কাঁচের দরজা ঠেলে ব্যালকনিতে গিয়ে রেলিংয়ে দুহাত দিয়ে দাঁড়ালো।বুঝতে পারলো রাই এসে দাঁড়ালো ওর পেছনে।রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুরে রাইয়ের মুখোমুখি হলো ও।

“তুই অনিকেত গাঙ্গুলীর সাথে সম্পর্ক ভেঙেছিলি না ও ভেঙেছিল?” ভূমিকা ছাড়াই সরাসরি প্রশ্নে ঢুকলো রণ।

মুখ নিচু করে কিছুক্ষন চুপ থেকে ধীরে ধীরে উত্তর দিলো রাই,”আমি।আজ না বছর দুই আগে।”

অন্ধকারে মুখ দেখতে না পেলেও রাই বুঝলো চমকালো রণ।নিজেকে সামলে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”কারণ?”

এবার রাই একদমই মুখ খুলতে পারলো না।কি বলবে ও!রণকে ভালোবাসে বুঝতে পেরে অনিকেতের সাথের ভুল সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছিল,নাকি অন্যকিছু।
আজ থেকেই মাস খানেক আগেও তো এই দিনটার অপেক্ষায় থাকতো ও। কিন্তু আজ ওর মনে শীর্ষা কে নিয়ে যে বিশ্বাস জন্মেছে সেটা ওকে বাধা দিচ্ছে সত্যিটা বলতে।

“কিরে বল,কি কারণে তুই সম্পর্ক ভেঙেছিলি? আমার জানাটা খুব দরকার।কোনো সমস্যা হলে আমায় বলতে পারতিস।আমি কথা বলতাম ওর সাথে।
অনিকেত গাঙ্গুলীর বিয়ে হয়ে গেছে?”

“না।এখনও বিয়ে করেননি।তবে এনগেজ কিনা জানিনা।আর জেনেও কোনো দরকার নেই।আমি ওঁকে বিয়ে করতে পারবো না।” রাইয়ের গলার জোর রণকে অবাক করে।

“রাই আমি আমাদের বন্ধুত্বের জোরে জানতে চাইছি কারণটা।প্লিজ বল”,রণ ভেঙে পড়ে।ওকে জানতেই হবে রাইয়ের সম্পর্ক ভাঙ্গার কারণ।যদি কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়,তাহলে মেটানোর চেষ্টা করতে পারবে ও।অনিকেতকে ভালোবাসে রাই, তাই আর কারোর সাথেই ওর পক্ষে খুশি হওয়া সম্ভব না।সেই কারণেই অনিকেত গাঙ্গুলীকে রণ মানলেও মানতে পারবে। কিন্তু একজন অজানা অচেনার হাতে রাইকে ও তুলে দিতে পারবে না কখনও।আর সত্যি বলতে দেবেই বা কেন?নিজের কথা কেন তখনও বলবে না ও!
“কিরে বল”,অধৈর্য্য হয়ে ওঠে রণ।

“আমি অন্য একজনকে ভালবাসি রণদা।সেটা বুঝতে পারি অনিকেত স্যারের সাথে সম্পর্কে আসার পর।সেই অনুভূতিটা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিলোনা।তারপরও স্যারের সাথে সম্পর্কে থাকলে তাঁকে ঠকাতাম।তাই…”,রাই যতটা পারে আড়াল করার চেষ্টা করে।
কিন্তু বোকা মেয়েটা বুঝতে পারেনা সামনের ছেলেটা ওই কথাটা শুনেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে,ওর হৃদস্পন্দন ঘোড়া ছোটায় রাইয়ের কথা শোনার সাথে সাথে।

“আমি বিশ্বাস করিনা।সত্যি যদি হবে আমাকে বলিসনি কেন এতদিন।আমায় তো তুই সব বলিস”,রণ রাইয়ের কথা বিশ্বাস করতে চায়না।অন্য কোনো ছেলে রাইয়ের জীবনে এসেছে আর ও জানেনা,এটা ওর বিশ্বাস হয়না।

“ভুল করছো রণদা,বলতাম,এখন বলিনা।কারণ…তোমার আর আমার কথা শোনার সময় নেই।তোমার মনেও নেই রাই বলে তোমার একটা বন্ধু আছে।গত আড়াই বছরে তুমি আবার তাকে একা করে মা হারানোর দিনগুলোতে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়েছো।মনে করে দেখো তো কবে আমার সাথে শেষ আড্ডা দিয়েছিলে?এমনকি শীর্ষাদির ঘটনাটাও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করনি তুমি”,আজ যেন রাইয়ের অভিমানের বাঁধ ভেঙে যায়।মুখ নিচু করে অনেকদিন পর চোখের জল লুকোবার চেষ্টা করে ও।

অবাক হয়ে রণ আরেকটু কাছে এগিয়ে আসে রাইয়ের।আধো অন্ধকার ব্যালকনিতে কোনো চিন্তা না করে রাইয়ের চিবুকে হাত রাখে ও, মুখটা তুলে ধরে।আবার দুটো চোখ ভীষণ কাছাকাছি এসে স্থির হয়।
“ছেলেটা কে রাই?” রণ করুন মুখে জিজ্ঞেস করে।মনের কোথায় কি একটা ছোট আশা উঁকি মারে ওর?!!

চুপ করে থাকে রাই।কিকরে বলবে ও?কিকরে রণকে ঠেলে দেবে একটা কঠিন পরিস্থিতিতে।এটা ও তো নিজেও জানে শীর্ষাদি রণদার গার্লফ্রেন্ড হলেও রাইয়ের একটা আলাদা জায়গা আছে ওর মনে,সেই দুর্বলতার কারণ যদিও রাই নিজেও জানেনা।আর তাই ও বলতে এত চিন্তা করছে,ওর একটা কথা যদি ওদের সম্পর্কটা অনিশ্চিত করে দেয়!

রণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রাইয়ের মুখের দিকে,ওর অস্থির চোখ হয়তো কিছু ইঙ্গিত দেয় মনের মধ্যে।
চিবুক থেকে হাত সরিয়ে ওর দু কাঁধে দুটো হাত রাখে রণ।
“রাই, শীর্ষা আমায় ভালোবাসে এটা সত্যি।আজ থেকে না,ও জানিয়াছিলো অনেকদিন।কিন্তু আমি অ্যাকসেপ্ট করতে পারিনি।”রণ একটু থামে, আর রাই অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় রণর চোখের দিকে।
সেই চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রণ আবার বলতে শুরু করে,”আমি তার অনেক আগে থেকে অন্য একজনকে নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসি।তাই শীর্ষা আমায় ওর মনের কথা বলার সাথে সাথে আমি ওকে খুলে বলে দিয়েছিলাম সত্যিটা।কিন্তু শীর্ষা তারপরও বন্ধুত্ব ভাঙেনি,বরং বন্ধু হয়েই আমার অনেক কঠিন সময়ে আমার সাথে থেকেছে।ও জানে আমি যাকে ভালোবাসি সে কখনো আমায় ভালো না বাসলেও আমি তাকেই সারাজীবন মনে মনে ভালোবেসে যাবো,আর অন্য কেউ আমার জীবনে,আমার মনে বা…আমার বেডে কোনোদিনও জায়গা পাবে না”।রণর কথা শোনার সময় রাইয়ের চোখের পাতাও পড়েনা।রণ দেখতে পায় রাইয়ের গলার ওঠানামা,উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে গেছে মেয়েটার।তাও বহুকষ্টে শুধু বলে,”কে সে রণদা?”

উত্তর দেয়না রণ,করুন চোখে তাকিয়ে থাকে রাইয়ের দিকে।সেই চোখের ভাষা রাই পড়তে পারলেও বিশ্বাস করতে পারেনা। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারলে রাইয়ের অনেক প্রশ্নের উত্তর হয়তো মিলে যাবে।রণ বাঁহাত দিয়ে রাইয়ের চুলের গোছা ওর কানের পাশে গুঁজে দেয়।তারপর সেই হাত রাখে ওর বাঁগালে।
রণর আবেগ যেন অনেক কিছু বলে যায়।রাইয়ের জীবনের ছেলেটা কে না জেনেই রণ একটা কাজ করে বসে। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের ঠোঁটটা আলতো করে ঠেকায় রাইয়ের ডান গালে।উত্তেজনায় শিউরে ওঠে চোখ বুজে ফেলে রাই।
সেই অবস্থায় কানে আসে রণর ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো,”আমার হার্টবিট,আমার বেস্ট ফ্রেন্ড,আমার পুরো জীবন শুধু তুই।আমার বেঁচে থাকা তোকে ঘিরে,আমার ভালো থাকা তোর জন্য।সেই তুই ভালো না থাকলে আমি ভালো থাকবো কিকরে বল!আমার জন্যে প্লিজ সত্যিটা বল। কি হয়েছিল অনিকেতের সঙ্গে?”

চোখ ধীরে ধীরে খোলে রাই,মুখে ফোটে শান্তির হাসি।ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকা রণর বুকে মাথাটা গুঁজে দেয় ধীরে ধীরে,দুটো হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রণর গলা,জীবনে প্রথম।বুঝতে পারে রাই রণর বুকেও ঘোড়া ছুটছে।
অন্ধকারে রণর শার্টের ওপর দিয়ে ওর বুকের বাঁদিকে ঠোঁট ঠেকায় একটু জোরেই।
কেঁপে ওঠে রণ।
নিজের দুহাতের মধ্যে রাইকে নিয়ে বুকে সজোরে জড়িয়ে ধরে।রাইও দুহাত দিয়ে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে রণকে।

“রাই…”,অস্ফুটে বলা রণর ডাক চাপা পড়ে যায় রাইয়ের কথার মধ্যে,”আমি সবাইকে ছাড়তে পারবো।কিন্তু তুমি দূরে সরিয়ে দিলে বাঁচতে পারবো না রণদা।শেষ ক’বছর অনেক কষ্ট দিয়েছো তুমি আমায়।আমি চুপচাপ সহ্য করেছি।মেনে নিয়েছি।আজ তুমি তার শাস্তি পাবে। আমি চলে যাবো দূরে,দেখবো তুমি কত ভালো থাকো।…”

রণর মুখ নেমে এসে রাইয়ের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দেয়।আবেগের ছোঁয়া নয়,যেন রাইয়ের ওপর সমস্ত রাগ অভিমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে থাকে রণ।রাইয়ের নিশ্বাস বন্ধ করে ওর ঠোঁটটা শুষে নিতে চায় প্রানপনে।
রাইও বাধা দেয়না,অনুভব করে রণর আবেগ।নিঃশর্ত আত্মসমর্থন করে ও,যেন এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিল।দুটো ফুসফুস যখন সত্যিই শ্বাস বায়ুর অভাবে হাঁফিয়ে যায় রণ রাইয়ের ঠোঁটটা ছেড়ে চোখ বুজে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়,যেন অনুভব করতে চায় রাইয়ের অস্তিত্বকে।
আর রাই?চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে তার ভালোবাসার দিকে।আজ ছোট রাই বড় হয়ে যায় যেন,বুঝতে পারে রণর ভালোবাসা ঠিক কতটা গভীর।রণর তৃপ্ত মুখ,শান্তিতে চোখ বুজে রাইকে জড়িয়ে নিজের মধ্যে নিয়ে নেওয়া রাইকেও অদ্ভুত আরাম দেয়।জড়সড় হয়ে রণর বুকেতে ঢুকে পড়ে ও,এক শান্তির আশ্রয়,একবুক ভালোবাসায় ডুবে যেতে থাকে।

“কেন এতদিন অপেক্ষা করালি রাই?কেন আমায় বুঝতে পারলি না প্রথমেই।মায়ের কথা না শুনে যেদিন প্রতিবাদ করেছিলাম রাখি পড়তে সেদিন তুই বুঝবি না ভাবিনি।যেদিন তোকে প্রথম দেখি,সেদিন থেকে শুধু তোকেই ভালোবেসেছি। তোকে ছাড়া আর কাউকে আমার পাশে কল্পনা অবধি করতে পারতাম না,আজও পারিনা।তুই ছিলি,তুই আছিস আর তুই থাকবি।তোর কষ্ট বুকে আগুন ধরিয়ে দেয়,তোর খুশিতে আমি বাঁচি।তাই অনিকেতের সাথে খুশি হবি ভেবে কষ্টটা চেপে সরে গিয়েছিলাম।বিশ্বাস কর ভাবিনি তুই কোনোদিন আমায় সেই ভালবাসা ফিরিয়ে দিবি,ভাবিনি তুই কখনো ফিরবি আমার কাছে”,রাইয়ের চুলে মুখ গুঁজে খুব ধীরে স্বরে কথা গুলো বলে রণ।মনেহয় ওর কথা শেষ হবেনা কখনো।

রাই শুধু চুপ করে রণর বুকে ঢুকে ওর কথাগুলো শুনে যায়।
কতক্ষন ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা নিজেরাও জানেনা।ঘোর কাটে রণর ফোনের রিংয়ে।রাইকে জড়িয়ে ধরেই পকেট হাতড়ে ফোন বের করে রিসিভ করে রণ।

“রণ ব্যস্ত আছিস?কাল একবার দেখা করতে পারবি?” শীর্ষার গলা।
“কোনো আর্জেন্ট দরকার?” রাইকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেই কথাটা বলে ও,যদিও গলা তখনও পুরো স্বাভাবিক হয়নি।
একটু থমকায় শীর্ষা,”ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি রণ?গলাটা এরকম ঘোর ঘোর কেন রে?”

“কিছু না তুই বল,কাল কোনো আর্জেন্ট দরকার আছে?” রাইয়ের চুলে গাল ঠেকিয়ে বলে ও।

চুপ করে যায় শীর্ষা।এই রণ কোথায় যেন আলাদা।কথা বলতে এক অদ্ভুত অস্বস্তি হয় ওর।
“না সেরকম কিছু না।নেক্সট উইক চলে যাবো তাই দেখা করতে চাইছিলাম কদিন।ওখানে গেলে আমিও ব্যস্ত হয়ে যাবো,আর তুইও হয়তো ভুলে যাবি আমায়।”

রণ একটু নাড়া খায়।রাইকে জড়িয়ে বুকে চেপে রেখেও গলা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বলে,”আমরা তাহলে পরশু মিট করি?আসলে কাল একজনকে সময় দেওয়া আছে।সারাদিন লেগে যাবে।”

“ওকে।নো প্রবস।পরশু মিট করি তাহলে?”শীর্ষা মেনে নেয়।
“একদম”, রণ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।

“বাই” বলে কেটে যায় দুদিকের লাইন।ফোনটা পকেটে রেখে আবার দুহাতে জড়িয়ে ধরে রণ রাইকে।

নিজের মনে হাসে রণ,কিন্তু রাইমা অনুভব করতে পারে সেই হাসি।অবাক হয়ে ঘাড় তুলে তাকায় রণর দিকে।
রাইয়ের নাকটা আলতো করে টিপে রণ বলে,”কত প্ল্যান করেছিলাম তোকে প্রপোজ করার।তখন সদ্য স্কুল পাস করেছি।আর আজ কিভাবে তোকে বললাম দেখ।”

রাই মুখে হাসি এনে বলে,”এটাই যে আমার কাছে কতোটা ভালোলাগা,তুমি নিজেও জানোনা।হয়তো এখন অবধি আমার জীবনের সেরা দিন এটা।আজ রাতে ঘুমই হবেনা আমার।সব মেয়ে যে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখে,আমি সেটা সত্যি পেলাম।আর কিছুই চাওয়ার নেই আমার জীবনের কাছে।” আবেগ আজ মুখচোরা মেয়েটার মুখে বাধা মানতে চায়না।
রণ আবার পরম মমতায় রাইয়ের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে ওর কপালে ঠোঁট ঠেকায় আলতো করে,চোখ বুজে ফেলে রাই।

“কাল তো ব্যস্ত থাকবে।ফ্রি হয়ে ফোন করো”,রাই শীর্ষা কে বলা কথা শুনে বলে।
“হমম একটা পাগলীকে নিয়ে সারাদিন শহর ঘুরবো।অনেক মজা করবো।বেশ কয়েকদিনের অক্সিজেন ভরে নেব।পরশু থেকে শুরু হবে পড়াশোনা।আমার ছোট পরিটা কে নিজের কাছে নিয়ে যেতে তাড়াতাড়ি মাস্টার্স ডিগ্রি করতে হবে।তারপর সুপার স্পেশালাইজেশন করার আগেই বিয়ে করে নেব।স্টাইপেন্ড যা পাবো ঠিক চলে যাবে।” হাসতে হাসতে বলে রণ।
রাই চোখ বড় বড় করে রণকে দেখতে দেখতে শুধু বলে,”কি দুস্টু তুমি”।
ফিচেল হেসে রণ আরো জোরে জড়িয়ে রাইকে বুকে মিশিয়ে নিয়ে বলে,”আই লাভ য়্যূ।লাভ য়্যূ সো মাচ জান।কখনো ছেড়ে যাসনা আমায়।আমি এতদিন ভাবতাম আমি খুব শক্ত মনের,তুই জীবনে এসে বুঝিয়ে দিয়েছিস আসলে আমি খুব দুর্বল।তোর সামান্যতম কষ্টে আমি পাগল হয়ে যাই।আর কোনো কষ্ট তোকে পেতে দেবনা আমি।শুধু তোকে আমার এই বুকের মধ্যে সারাজীবন আগলে রাখবো আমি।তুই শুধু আমায় ভালো বেসে যাবি।অনেক অনেক অনেক ভালোবাসা।”
রাই রণর চওড়া বুকে নিজের ছোট মুখটা আরো ঢুকিয়ে দিয়ে রণর নিজস্ব ব্রান্ডের মাতাল করা ডিওর গন্ধে ওকে অনুভব করে হারিয়ে যেতে চায় ওর মধ্যে।রণ ওর জীবনে কি সেটা শুধু ওই জানে।ওর অভিভাবক,বন্ধু,আশ্রয়,ভালোবাসা সব ওই একটা ছেলে।ওর পুরো অস্তিত্ব শুধু ওকে ঘিরে,এটা বুঝতে ওর বড্ড দেরি হয়ে গেল।

চুপ করে নিজের ঘরের জানলার ধারে বসেছিল শীর্ষা।বাইরের অন্ধকারের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিল নিজের মনখারাপের রঙটা।ওদের বাড়ির আলো মিশে বাইরেটা যেমন গাঢ় অন্ধকারের বদলে ধূসর হয়ে আছে,ওর মনের মধ্যেটাও ওরকম ধূসর থাকে আজকাল।নিজেও বুঝতে পারেনা কি চায় ওর মন।
মাঝে মাঝে মনে হয় রণ ছাড়া ও জীবন কাটাবে কিকরে,তারপরই মনে পড়ে ওর কথা গুলো,’রাই ছাড়া আর কাউকে পারবো না আমি আমার জীবনে জায়গা দিতে।রাইকে অন্যের হতে দেখলে হয়তো সেদিনই মনটা মরে যাবে।কিন্তু তুই বল শীর্ষা তোকে বা অন্য কাউকে তো আমি ভালোবাসতে পারবোনা,তাহলে কেন বিয়ের নামে ঠকাবো বল।তুই জীবনে সেটেল কর আমি চাই,কিন্তু নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারি তোর কষ্ট,তাই জোর করতে পারিনা।” মন্দারমনির সমুদ্রের ধারে বসে রণ যখন ড্রিংক করে উগরে দিচ্ছিল মনের কষ্ট,ওর হাহাকারের সাথে নিজেরটা মিশিয়ে দিচ্ছিল শীর্ষা।
রণর মুখে রাইয়ের জন্যে তীব্র হাহাকার শুনতে ওর কতটা কষ্ট হচ্ছিল ও নিজেও পাচ্ছিল না সেটা উপলব্ধি করতে।শুধু বুঝতে পারছিল প্রচন্ড চাপ হচ্ছে ওর বুকে,সেটা রণর জন্যে না নিজের জন্যে সেই মুহূর্তে বুঝতে পারেনি শীর্ষা।

আজ রণকে একটু অন্যমনস্ক লাগলো ফোনে,কিন্তু সেই অন্যমনস্কতা মন খারাপ বা উদাসীনতার নয় যেন,কোনো একটা প্রিয় কাজ মন দিয়ে করলে মানুষ যেরকম আনমনা থাকে অন্য বিষয়ে এ যেন অনেকটা তাই।
শীর্ষা বুঝতে পারছিল ফোনটা কাটতে চাইছে রণ।

রণর কাছাকাছি থাকলে ওর ভালোবাসা থেকে শীর্ষা কখনো বেরোতে পারবে না।চোখের সামনে থাকলে উপরে ফেলতে পারবে না মন থেকে,আর চাইলেও অন্য কাউকে জায়গা দিতে পারবে না মনে।মুখে বলবে ‘হ্যাঁ মুভ অন করে গেছি আমি’।কিন্তু মনটা পরে থাকবে সেই আশ্চর্য্য কিছু ঘটার অপেক্ষাতে।
আজকাল ওর মনে একটা ভাবনা ঢুকেছে হয়তো ওর কারণেই রণ ওর রাইকে পেলোনা।ওর রণর প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা ওদের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।
সেই সব কিছু ভেবেই ওর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
দূরে গেলে যদি ও পারে রণর ভালোবাসার নেশা কাটাতে।

কিন্তু যবে থেকে যাওয়ার দিন ফাইনাল হয়েছে বুকের মধ্যেটা কি যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এক অদ্ভুত মন খারাপে মনটা ভার হয়ে আছে।খালি মনে হচ্ছে আর কদিন তারপর তো রণর থেকে সারাজীবনের মত দূরে চলে যেতে হবে,এ’কদিন রোজ দেখা করে ওর সাথে।এই কদিনের জমানো স্মৃতি হয়তো বাকি জীবনটা কাটাতে সাহায্য করবে।
আচ্ছা রণ কি শেষ মুহূর্তে ওকে আটকে দেবে? বলবে, ‘যাসনা শীর্ষা।বন্ধু হয়েই থেকে যা আমার কাছাকাছি’।

দূর কি সব ভাবছে ও! না না,রণ ওর ভালোবাসা ফিরে পাক।এই না পাওয়ায় বড্ড কষ্ট।ওর নরম মন সেটা সহ্য করতে পারবে না সারাজীবন,বিশেষ করে নিজের ভালোবাসা কে অন্যের হাতে দেখার ক্ষমতা সবার হয়না।শীর্ষাও ও সেই অনিশ্চয়তা থেকেই পালাচ্ছে।পালাচ্ছে রণকে ছেড়ে অনেক দূরে,যদি রাই ফিরে আসে এই ভয় থেকে।
আজকাল রণর কথা ভাবলেই মাথাটা ভার হয়ে যায়।ওর জীবনের একটা অসমাপ্ত অধ্যায় হয়ে থাকলো ওর প্রথম ভালোবাসা এটা মানতে মন চায়না।আর তখনই বদ অভ্যাসটা মাথা ছাড়া দেয়।
নিজের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন শীর্ষাও কিছুতেই পারেনা মাথাটা স্থির করতে,তখন ওই একটা ক্লোভ সিগারেট ই ভরসা।দামি ব্রান্ডের ওই হালকা ধোঁয়া ওকে একটু শান্ত করে,তারপর নিজেই আবার নিজেকে গুছিয়ে নেয়।যেখানে যাচ্ছে সেখানে অবশ্য এই সুযোগ টাও থাকবে না।
না,পালাতে শীর্ষা কে হবেই,শুধুমাত্র নিজের জন্যেই পালাতে হবে শহর ছেড়ে অনেকে দূরে,আপাতত।

“আরে আরে কি হলো?এত উচ্ছ্বাস কিসের?” ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজেদের বেডরুমে আধ শোয়া হয়ে একটি মেডিকেল জার্নাল নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছিলো ঋষি।হঠাৎ জয়ি ঘরে ঢুকে ওর পাশে এসে বসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
ওর কাঁধে রাখা জয়ির মুখটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে ঋষি দেখলো ওর চোখের কোনে জল।জার্নালটা সরিয়ে রেখে জয়ির মুখোমুখি হল ও।
“কি ব্যাপার ম্যাডাম।একই মুখে দুটো আবেগ কেন?মুখে উচ্ছ্বাস, অথচ চোখে জল?কি হয়েছে খুলে বলবি প্লিজ?”

আলতো করে চোখের জলটা হাত দিয়ে মুছে জয়ি হাসিমুখে তাকালো ঋষির দিকে,”আজ কত বছর বাদে আমাদের ছেলেটাকে হাসতে দেখলাম ঋষি।সেই হারিয়ে যাওয়া রণকে আজ প্রায় আড়াই তিনবছর পর খুঁজে পেলাম আমি।এত খুশি হয়েছি কি বলবো?! আমি সত্যি টেনশনে ছিলাম কি ভাবে ফিরবে ছেলেটা,এখন খুব শান্তি।ভগবান ওদের দুটোকে সুখে রাখুক”,জয়ির কথার মধ্যে দিয়ে শুধুমাত্র একজন মা ধরা দেয় ঋষির চোখে।

চোখে হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে তাকায় ঋষি জয়ির দিকে,”একটু খুলে বলবি প্লিজ।”

“কি বলবো বল।তুই তো জানিস রণ রাই কত ভালো বন্ধু ছিল।ছেলেটা আমার বড্ড কষ্ট পাচ্ছিল শেষ দু-তিন বছর।কারণটা শিওর না জানলেও,বুঝতে পেরেছিলাম অন্য কেউ এসেছিল রাইয়ের জীবনে,তাও বছর দুই আগে।সেদিন তো তোকে জয়ন্তর কথাও সব বললাম,ওর ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।রণ ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ফেরত পেয়েছে।রাইয়ের মনের কথা জানতে পেরেছে ও।জয়ন্তর অনুমান ঠিক ছিল,রাইয়ের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের কথা শুনেই রণ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।আমার পারমিশন নিয়ে ছুটে গেছিল মায়ের ফ্ল্যাটে।যখন ফিরলো চোখে মুখে আলাদা আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছিল।খুলে বলেনি,কিন্তু হাবেভাবে বুঝে গেছি ওর এতদিনের অপেক্ষা সফল হয়েছে।সত্যি বলতে কি রণর জন্যে রাইয়ের চেয়ে ভালো মেয়ে আর হবেনা,যে সবচেয়ে ভালো বুঝবে ওকে”,একটানা বলে থামলেও জয়ির আনন্দ ওর চোখে মুখে প্রকাশ পেতে থাকে।

ঋষিও আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় জয়ির কথা শুনে।বিছানা ছেড়ে নেমে পায়ে স্লিপার গলাতে যায়।
“আরে আরে কোথায় যাচ্ছিস তুই?” ঋষির হাবভাব দেখে জয়ি হৈহৈ করে ওঠে।
“আরে এতো বড় একটা খবর ছেলেকে কংগ্রাচুলেশন জানিয়ে আসবো না?ছেলে আমার এইবার প্রকৃত এডাল্ট হয়েছে।উপরি পাওনা আবার রাই।না না একবার যেতেই হয় রণর কাছে।” ঋষির কথা শেষ হওয়ার আগেই জয়ি ওর হাত টেনে ধরে।

“পাগল হলি নাকি! বললাম না রণ ভেঙে কিছু বলেনি।আর ওদের প্লিজ একটু সময় দে,ঠিক সময়ে ও নিজেই তোকে এসে বলবে। বললো কাল সারাদিন থাকবে না।ও আর রাই একটু বেরোবে।ওদের একটু নিজেদের বুঝতে দে।আমি জয়ন্ত কেও কিছু বলিনি।নিজেদের কথা মনে নেই তোর?একটু কাটাক ওরা সময় নিজেদের মত।তারপর আমরা তো আছি”, জয়ির কথা গুলো মন দিয়ে শোনে ঋষি,তারপর ঘাড় নেড়ে ওকে সমর্থণ করে আবার বিছানায় বসে পড়ে।

“ঠিকই বলেছিস।যতই রণর বন্ধু হই, এই জায়গাটা ওর একদম নিজের।যাইহোক এত দিন পর ছেলেটা স্বাভাবিক হয়েছে এটাই বিশাল পাওনা।আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম রণ আর স্বাভাবিক হবে না।পুরো ক্রেডিট তোর আর জয়ের।ওকেও পরে একবার ফোন করবো ” ঋষির কথায় জয়ি সাপোর্ট করে ওর হাতটা রাখে ঋষির হাতের উপর।

“আমাদের সেই ছেলেটা এবার সংসার করবে।বিশ্বাস হয় বল?আমি কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করবোনা।তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেব দুটোর।আরে রাই চলে যাওয়ার পর বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে বাড়িটা।একটা মেয়ে থাকলে বাড়ি যেন ভরে থাকে।রেশমা একবার প্রকৃত অর্থে শান্তি পাবে।আমার ছেলে বলে বলছি না রণ রাইকে কিভাবে রাখবে আমিই জানি।রাইকে যে কি ভীষণ ভালোবাসে।…উফফ কি আনন্দ যে হচ্ছে।” জয়িকে আনন্দের চোটে জড়িয়ে ধরে ঋষি এবার।হাহা করে হেসে ফেলে রণর মা,আজ যে বড্ড শান্তি লাগছে।ওর সেন্টিমেন্টাল নরম মনের ছেলের জন্যে,এবাড়ির জন্যে রাই একদম উপযুক্ত মেয়ে।আর রাই তো ওর নিজেরও দুর্বলতা।খুব খুশি হয় জয়ি অনেক দিন পরে।

“ঘুমোলি রাই?” ছোট একটা মেসেজ এসে ঢোকে রাইয়ের হোয়াটস অ্যাপে রাত সাড়ে এগারোটায়।
চোখ বুজে শুলেও কিছুতেই ঘুম আসছে না আজ রাইমারও।
ফোনটা বালিশের পাশ থেকে তুলে হাতে নেয় ও,মনে মনে জানতো আজ এই নম্বর থেকে মেসেজ হয়তো আসবে।অপেক্ষা করছিল ও।
-“না এখন ঘুম আসেনি আজ।তুমি ঘুমোউনি এখনো?”

রণ ফোনটা হাতে নিয়েই বসেছিল।মেসেজটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গে টাইপ করে,”তোকে ছেড়ে থাকবো কিকরে রাই এখনো তিন বছর?এতদিন জানতাম তুই অন্য কারোর।আজ তোর ভালোবাসার কথা জানার পর আর যে ধৈর্য্য ধরতে পারছি না।তোকে বুকে জড়িয়ে ধরার পর থেকে তোকে ছাড়া বুকটা ফাঁকা লাগছে।কিকরে থাকবো বল?”

রাই মেসেজটা পড়ে।একবার না,দুবার তিনবার বারবার।অজান্তেই ওর চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়।মনে মনে বলে,’প্লিজ ঠাকুর এবার এই ভালোবাসা যেন আমার ভাগ্যে চিরস্থায়ী হয়।বড্ড ভয় করে নিজের খুশি দেখলে’।
অলক্ষ্যে হাসে ভগবান।মনে মনে হয়তো মায়া হয় বেচারি মেয়েটার ওপর।
ওদিকে রাই কয়েক মুহূর্ত ভেবে মেসেজ করা বন্ধ রেখে ফোন করে রণকে,বড্ড গলা শুনতে ইচ্ছে করছে রণদার।

‘এত রাতে ফোন বিজি!’ ভ্রু কুঁচকোয় রাইয়ের,পরমুহূর্তে হাসি পায় ওর,দূর এখন থেকেই বড্ড পজেসিভ হচ্ছে ও।আর তাছাড়া নিজের চেয়েও বেশি যাকে বিশ্বাস করে…আবার মেসেজ ঢোকে ফোন ভাইব্রেট করে জানায়।
“রাই এত রাতে তোর ফোন বিজি!!এত রাতে কার সাথে কথা বলছিস তুই?” সাথে রাগের স্মাইলি।

নিজের মনেই আওয়াজ করে এবার হেসে ফেলে শান্ত মেয়েটা।’ও হরি একসাথে দুজনে দুজনকে ফোন করছিলাম।দাঁড়াও একটু মজা করা যাক’।

“তোমায় কেন বলবো?এসব ও কি তুমি বলে দেবে নাকি?” ইচ্ছা করে বাঁকা মেসেজ পাঠায় রাই।
কিছুক্ষন অপেক্ষা করে একটা রাগের মেসেজের কিন্তু দশ মিনিট কেটে যায় কোনো রিপ্লাই আসেনা।একটু টেনশন হয় এবার রাইমার,’সিরিয়াসলি নিয়ে নিল নাকি?’
সঙ্গে সঙ্গে নিজের কল লিস্টের একটা স্ক্রিনশট নিয়ে পাঠিয়ে লেখে,”দেখো তুমি যে সময়ে ফোন করেছিলে, আমি কাকে ফোন করছিলাম।কিন্তু তার ফোনও বিজি আসছিল।”

তাও কোনো রিপ্লাই আসেনা,কিন্তু রাই নীল টিক দেখে বুঝতে পারে মেসেজটা দেখেছে রণ।
আর অপেক্ষা করতে পারেনা রাই।আজ এত সুন্দর দিনে আবার মান অভিমান ভুল বোঝাবুঝির ভয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে ও।রণর নম্বরে কল করে ফোনটা কানে চেপে ধরে জোরে।পুরো রিং হয়ে ফোন কেটে যায়।
আবার ফোন করে রাই, এবার একটা রিং হওয়ার আগেই ফোনটা রিসিভ হয়।কিন্তু ফোন ধরে কোনো কথা বলেনা রণ।রাই যাহোক করে আবেগ সামলে বলে,”রণদা বিশ্বাস করো মজা করছিলাম।তুমি তো আগে কত মজা করতে। প্লিজ এতোটাও সিরিয়াসলি নিওনা।”
তাও উত্তর দেয় না রণ।এবার রাইয়ের গলা ধরে আসে,”তোমায়ই তো ফোন করছিলাম আমি।দেখো স্ক্রিন শট পাঠিয়েছি।…আজকের দিনটা যে খুব স্পেশাল রণদা।প্লিজ ভুল বুঝো না।…”,আর সামলাতে পারেনা নিজেকে।

“এই পাগলী…রাই… ওই আরে আমিও তো মজা করছি।আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম তুইও আমাকেই ফোন করছিলি।ওই বোকার মত কাঁদছিস কেন?এই মেয়েটা?…”,রণর এবার নিজেকে অসহায় লাগে।ও ভাবতেই পারেনি এত অল্পতেই রাই কেঁদে ফেলবে।ভয় ও পায় মনে মনে, কি অবস্থা হয়েছে ওর রাইয়ের এই ক’বছরে!সত্যি ও রাইকে সেই আগের অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে,নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় রণর।
“দেখ রাই তুই এবার চুপ না করলে আমি এখুনি বাইক নিয়ে তোর বাড়ি চলে যাবো। সেটা কি তুই চাস?নাহলে আগে কান্না থামা।এত বড় হতে চললি এখনো বাচ্ছাদের মত একটা ছোট ব্যাপারে কাঁদছিস?!” রণর মনে হয় সত্যি ছুটে চলে যায় রাইয়ের কাছে।
“তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমাকেই ফোন করছিলাম…এত রাতে আমি কোনদিন…”,রাই চুপ করে যায় রণর ধমকে।
“উইল য়্যূ প্লিজ স্টপ রাই?তোকে ক্ল্যারিফিকেশন দিতে বলিনি আমি।তুই আজ একটা কথা শুনে রাখ আমি তোকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।কেন ভুলে যাচ্ছিস তুই আমাদের সম্পর্ক একদিনের না।আজ আমি তোকে বলতে পেরেছি সেটা যেমন সত্যি তোকে আমি সাত বছর আগে থেকে ভালোবাসি সেটাও সত্যি,তোকে চিনি সেই সাত বছর ধরে সেটাও সত্যি।তাই প্লিজ আমার ভালোবাসাটা এতো ঠুনকো ভাববি না।আর বিশ্বাস?স্বয়ং ভগবান এসে তোর বিরূদ্ধে বললেও যতক্ষন না তুই নিজে কিছু বলছিস আমায় কেউ তোর বিরুদ্ধে কিছু বিশ্বাস করাতে পারবে না।এটা জেনে রাখ।আর কিছু শুনবি?”
পুরোপুরি চুপ করে যায় রাই।আজ ও নিজেও জানেনা কেন হঠাৎ এইটুকু তে ও এতটা দিশেহারা হয়ে গেল।তবে রণ বুঝতে পারলো।অবুঝ হয়ে যাওয়া ছেলেটা আবার রাইয়ের চেয়ে বড় হয়ে অনুভব করলো রাইয়ের কাছে ও কি!
এতদিন ধরে একটা অনিশ্চয়তায় ভুগে মেয়েটার প্রতি মুহূর্তে ওকে হারানোর ভয় তাড়া করছে।অনেক কষ্টে যাকে মানসিক ভাবে দৃঢ় করে আত্মবিশ্বাসী করেছিল আজ আবার সে অসহায় হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।এর একটাই কারণ রণর ওর থেকে দূরে সরে যাওয়া।এতে রাই হয়তো রণর প্রকৃত মর্ম বুঝে অনিকেতের মোহ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল,কিন্তু রণর সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ওকে আজ এতটা দুর্বল করে দিয়েছে।
“রাই… শুনতে পাচ্ছিস?কিরে?” রণ এবার গলাটা নরম করে।রাইয়ের কান্না শুনেই ও টেনশনে সিগারেট হাতে ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসেছিল।এবার ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে বলে।
“হুঁ।শুনছি,বলো”,অনেক্ষন পর ধরা গলায় বলে রাই।
“তুই কি আজ বুঝতে পারিসনি কতটা ভালোবাসি আমি তোকে?তুই আমার কাছে ঠিক কি?আমি শুধুই ভালোবাসি বলার জন্য বলিনি।ভালোবাসি মানে সবসময় তোর পাশে আছি,সাথে আছি আমি।তোকে আগলে রাখবো পাগলী।আগেও তো রাখতাম,তখন বলার উপযুক্ত ছিলাম না বলে শুধুই বন্ধু ছিলাম।আজও বন্ধু আছি,সাথে তোর একনিষ্ঠ প্রেমিক।বুঝলি?” শেষের লাইনটা দুস্টুমি করে বলে রণ।

এবার লজ্জায় রাঙা হয় রাই, কান গরম হয় একটু।শরীর জানান দেয় রাই আর কিশোরী নেই।

“কিরে বল কিছু।কাল তৈরি থাকবি ন’টার মধ্যে।আমি ঠিক পৌঁছে যাবো।”রণ বুঝতে পারে রাই এর লজ্জা।ও জানে এভাবেই ভাঙতে হবে ওকে লজ্জার আবরণ।বন্ধু হয়ে মেশা সহজ,কিন্তু প্রেমিক হলে ওকেই স্বাভাবিক করতে হবে রাইকে।
-“ন’টা?অতো সকালে কোথায় যাবো আমরা?”
-“পুজোর মার্কেটে আবার যাওয়ার জায়গার অভাব?আর হ্যাঁ আঙ্কেলকে বলে দিবি ফিরতে রাত হবে?” রণ মুচকি হাসে।
-“রাত?সকাল ন’টায় বেরিয়ে ফিরতে রাত?কোথায় যাবো বলবো?” রাইয়ের গলা শুনে আবার হাসে রণ।
-“বলবি রণর সাথে যাচ্ছি।কোথায় যাবো জানিনা।আর হ্যাঁ এবার প্লিজ এই রণ-দা বলাটা বন্ধ কর।আমার ভালো লাগেনা”,রণ জানে এটা মানাতে রাইকে সময় লাগবে।
-“আচ্ছা রণদা ফোন রাখছি।ঘুমিয়ে পড়ো।নাহলে উঠতে পারবে না”,রাই এমন ভাব করে যেন রণর শেষ কথাটা শুনতে পায়নি।রণ আগেও এটা নিয়ে কম চেষ্টা করেনি,এখন বুঝতে পারছে কারণটা।তখন রাজি না হলেও এখন হয়তো হবে,তবে এই মুহূর্তে অসম্ভব।কয়েকদিন সময় লাগবে।কিন্তু ও যে রণ কে চেনে সে এক্ষুনি বলানোর জন্যে পাগল করে ছাড়বে।তার থেকে ফোন কেটে ঘুমিয়ে পড়াই ভালো।তার ওপর চিন্তা বাবা কে কাল কিভাবে কি বলবে? সুলেখা মাসিও সকালে এসে যাবে।

“ঠিক আছে গুড নাইট রাই। কাল দেখা হবে”,রণ অপেক্ষা করে রাইয়ের প্রত্যুত্তরের।

“গুড নাইট রণ-দা।ঘুমিয়ে পড়ো”,অন্যমনস্ক রাই জবাব দেয়।
-“কি বললি?”
-“বললাম গুড নাইট”।
-“তারপর?”
চুপ করে থাকে রাই।ও এই ভয়টাই পাচ্ছিল।এই ছেলেকে ও খুব ভালো করে চেনে, আর রণও জানে রাই ওর জোর করাকে উপেক্ষা করতে পারেনা।
হঠাৎ আওয়াজ করে হেসে ওঠে রণ,”কিরে পাগলি মন ভালো হলো? ছিঁচকাদুনির মত কাঁদছিলি।বোকা একটা।যা ঘুমো।তবে রণ বলিস এবার,জোর করবো না,শুধু বলবো আমার ভালো লাগবে।তবে যেদিন মন থেকে চাইবি বলিস।” রণ রাইয়ের মন কয়েক মুহুর্তে ভালো করার ক্ষমতা আজও রাখে।
“ঘুমিয়ে পড়ো রণদা।তুমি এখন ডাক্তার হয়ে গেছ বাইরের মানুষদের কাছে।কিন্তু এখনো একই আছো।মাঝে শুধু কদিন বদলে গেছিলে,চিনতে পারতাম না।তুমি যত বড় ডাক্তারই হও,আমার কাছে প্লিজ এরকম থেকো সারাজীবন।আই লাভ য়্যূ”,প্রথমবার রাই রণকে ম্যাজিক ওয়ার্ড তিনটে বললো।রণর মনে হল এতদিনের অপেক্ষা সার্থক হলো।খুব ইচ্ছে করলে রাইকে ঠিক সেই মুহূর্তে একটু জড়িয়ে ধরতে।কবে যে রাই ওর কাছে আসবে? আরও কতদিন যে অপেক্ষা করতে হবে?

যখন দুজনে ফাইনালি ফোন কেটে ঘুমোতে গেল তখন রাত তিনটে।কিন্তু দুজনের চোখ তখনও ক্লান্তিহীন।
রাই সন্ধ্যের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ বুজলো, আর রণ অনুভব করতে চাইল রাইকে।কল্পনায় রাইকে জড়িয়ে ওকে বুকে নিয়ে পরম শান্তিতে চোখ বুজলো ও।
রাত জাগা পাখি জানিয়ে গেল রাত প্রায় শেষের পথে।
একটা নতুন দিন নতুন শুরুর সংকেত নিয়ে হাজির হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো।
শীর্ষার আশার শেষ থেকে শুরু হলো রাই-রণর পথ চলা।এটাই জীবন।কোথাও শুরু সংকেত দেয় কোথাও শেষের।

ক্রমশ…