মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-৩৪

0
430

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#চৌত্রিশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“রণ”,ছেলের কাঁধে হাত রেখে আলতো করে নাম করে ডাকে ঋষি।
চোখ বুজে ফেলে রণ।পরনে অপারেশন থিয়েটারের পোশাক,হাতে অপারেশন চলাকালীন যন্ত্রপাতি।
চোখের দুদিক দিয়ে জল গড়িয়ে নামে,সার্জারি মাস্ক শুষে নেয় জলটা।
“আই’ম সরি রাই।ক্ষমা করে দিস।পারলাম না তোর স্বপ্নটা বাঁচাতে।ভেবেছিলাম একটা অন্তত…”,রণর ফিসফিসানি কানে পৌঁছয়না ঋষি বা অন্য কোনো স্টাফের।শুধু তারা দেখে কয়েক মুহূর্ত তারপর চোখ খুলে তাকায় ডক্টর রণজয় মুখার্জী। সাপোর্টিং স্টাফ চশমা খুলে চোখটা মুছিয়ে চশমা পরিয়ে দেয়,মনের মতোই চোখ মুখ কঠিন করে নিজের কাজে মনোনিবেশ করে ডক্টর।যন্ত্রপাতি চলতে শুরু করে,বাদ যায় একটা মেয়ের শরীরের সবচেয়ে দামি অঙ্গ।ডাক্তার নিজের হাতে নিজের স্ত্রীর শরীর থেকে আলাদা করে দেয় দুটো ওভারি আর ফ্যালোপিয়ান নালি,আর… ইউট্রাসটাও।রাইয়ের শরীরের আবার ফিরে আসা মারণ রোগ সবে বিস্তার শুরু করেছিল।রণ নিজের হাতে তার নিষ্পত্তি করে।ফার্স্ট স্টেজ ওভারিয়ান ক্যান্সারে রাইয়ের দুটো ওভারি সবে আক্রান্ত হয়েছিল।কিন্তু সেটা বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছিল বাইরে থেকে,ডিসিশন নিতে হলো তাই রাইয়ের শরীর ওপেন করেই।হয়তো ওভারি পুরোপুরি বাদ না দিলেও হত,কিন্তু রাইয়ের রিস্ক ফ্যাক্টর হাই বলে রণ কোনো রিস্ক নিতে রাজি না। এই সিদ্ধান্ত নিতে যত কষ্টই হোক রণ অন্য কিছু ভাবার আগেই নিজের দায়িত্ব সেরে ফেললো।হয়তো সেই জন্যে রণ সার্জন হিসেবে থাকতে চেয়েছিল ঋষির সাথে।বাবার নির্দেশ মত বাবাকে সাহায্য করলো মনের কষ্ট মনের মধ্যে রেখেই।আর এটাও অনুভব করলো আসল লড়াইটা শুরু হবে ঠিক এরপর থেকে,লড়াইটা রাইকে সামলানোর।

“রাই…রাই।শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?” উৎকণ্ঠায় গলা একটু তিরতির করে জয়ির।ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জয়ন্ত ও উৎকণ্ঠার সাথে তাকিয়ে আছে তখন মেয়ের মুখের দিকে।ভ্রু টা একটু কুঁচকোয় রাই।
“জয় রণকে ডাক”,জয়ি গলা নামিয়ে বলে।
জয়ন্ত জানলার কাছে সরে গিয়ে রণর মোবাইল নম্বরে কল করে।অপারেশন থিয়েটার থেকে রাইকে বের করে স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে দেওয়ার পর রণ একবার এসেছিল ওর কাছে।দশ মিনিট থেকে চলে গিয়েছিল।জয়ি তখন ছিলোনা।কিন্তু জয়ন্ত দেখেছিল বিধস্ত রণকে।চোখ গুলো লাল,হালকা দাড়ি আর উস্কোখুস্ক চুলের রণকে বড্ড ক্লান্ত লাগছিলো।চোখের কোলে কালি বুঝিয়ে দিচ্ছিলো অনেকদিন ঘুমোয়নি ও ভালো করে।জয়ন্তর চোখটাও ঝাপসা হয়ে এসেছিল।ও যেন রণর মধ্যে দেখতে পাচ্ছিল প্রায় পনেরো বছর আগের নিজেকে।কিন্তু ওর বিশ্বাস ছিল,ও সেদিন হেরে গেলেও আজ রণ হারবে না।ওর জেতার আকাঙ্ক্ষাই ওকে আজ এত বড় সিদ্ধান্ত এত সহজে নিতে দিয়েছে।তাই নিজে হাতে রাইয়ের অঙ্গগুলো বাদ দিয়ে মানসিক ভাবে নিজেকে তৈরি করছে রাইকে সত্যের মুখোমুখি করতে।রণ ওর মত দুর্বল না,তাই কখনো পালাবে সব ছেড়ে।

রণ যখন কেবিনে এসে পৌঁছলো রাই তখন চোখ খুলে তাকিয়েছে,কিন্তু ঘোর যে আছে সেটা ওর ঘোলাটে দৃষ্টিই বুঝিয়ে দিচ্ছে।ওর আধবোঝা চোখে তখনও যেন ঘুম জড়িয়ে।কোমর থেকে নিচের অংশটা অসাড় হয়ে থাকায় এত বড় অপারেশনের কষ্ট এখনো অনুভূত হচ্ছে না।শুধু শরীরের নিম্ন অংশে এক অদ্ভুত অস্বস্তি জড়িয়ে আছে।
ওটিতে অ্যানাস্থেসিয়া স্পেশালিস্ট ডক্টর গুপ্ত রাইয়ের প্রাথমিক জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিলেন গালে হালকা চাপড় মেরে।তখন ও অবাক চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল,নজর করেছিল সেটা রণ।
জয়ি হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো রাইয়ের মাথায়।রণ আসতে জয়ি উঠে রণকে বসতে দিলো রাইয়ের বিছানার পাশে।
চেয়ারে না বসে রণ দাঁড়িয়ে থেকেই একটু ঝুঁকে রাইয়ের মাথায় হাত রাখলো।
চোখটা জোর করে পুরোটা খুললো রাইমা।রণকে দেখে হালকা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলো ঠোঁটে।পাল্টা একটা হাসি রণর ঠোঁটে ফুটলেও চোখের কষ্ট তাতে আড়াল হলো না।রাই ইশারায় জল চাইলো,গলা শুকিয়ে গেছে বুঝিয়ে।
“স্যালাইন চলছে রাই।জল দিতে পারবো না সোনা”,কি মনে করে রাইয়ের বেডের পাশে রাখা টেবিল হাতড়ে ‘সার্জিক্যাল কটন রোল’ থেকে একটু তুলো ছিঁড়ে জলে ভিজিয়ে রাইয়ের শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে দিল একটু।মনেহল একটু হলেও আরাম হল ওর।
“চল জয় আমরা একটু চা খেয়ে আসি”, রণ-রাইকে একটু স্পেস দিতে জয়ি বললো।হালকা ঘাড় নেড়ে কেবিনের সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জয়ন্ত।পা গুলো যেন বড্ড দুর্বল লাগছে ওর।নিজের মেয়েকে কিছুতেই নিজের স্ত্রীর জায়গায় দেখবে না তাই মনের জোরে যেন দাঁড়িয়ে আছে ও।

জয়িরা রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে রণ রাইয়ের বেডে বসে পড়লো।মনে পড়ে গেল আগের বারের কথা।একই ভাবে হালকা করে রাইয়ের কাঁধে হাত রেখে ওর কাঁধে মুখটা ঠেকালো নিচু হয়ে।রণর গায়ের পরিচিত গন্ধে রাইয়ের চেতনা যেন সজাগ হল।ও ওর ডানহাত দিয়ে,যাতে স্যালাইনের সুঁচ নেই,জড়িয়ে ধরলো রণকে।ঘাড় ঘুরিয়ে রণ হালকা করে নিজের ঠোঁটটা রাইয়ের গালে ছোঁয়ালো।
শান্তিতে চোখটা বুজে ফেলে মেয়েটা।ওর পরিচিত আশ্রয়ে ওকে শান্ত করে অনেক বেশি।কিন্তু চেতনা ফিরে আসার সাথেই ফিরে আসে প্রথম জ্ঞান ফেরার সময় একটা খটকা।খুব ধীর স্বরে রাই কেটে কেটে বলে,”রণ…অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন করতে দু ঘন্টার ওপর লাগলো?!!”
রাইয়ের প্রশ্নে ছিটকে উঠে মাথা সোজা করে উঠে বসে রণ।ওর অবাক দৃষ্টি পড়ে রাই একই স্বরে বলে,”যখন আমায় অজ্ঞান করে…ওটির ঘড়িতে বেজেছিলো, প্রায় আটটা।ছোট অপারেশন তুমি বলেছিলে…বলেছিলে আধ ঘন্টা লাগবে ম্যাক্সিমাম।কিন্তু…জ্ঞান ফিরলো তখন ঘড়িতে…বারোটা পনেরো…এখন বাজে দুপুর তিনটে।”
রণ বুঝতে পারে জ্ঞান আসার পর রাইয়ের চোখের ওই অবাক ভাবের কারণ।আজ নাহলে কাল সত্যিটা বলতেই হবে কিন্তু এটা সেই মুহূর্ত না।নিজের বুকের ঝড়টা বাইরে কোনোভাবে প্রকাশ না করে মুখে শুধু একটা জোর করে ফুটিয়ে তোলা বড় হাসিকে সঙ্গী করে রণ বলে,”দূর বোকা অত হিসেব করে সব হয় নাকি? এইটুকু ছোট্ট মাথায় অত বড় বড় চিন্তা,তাও এই দুর্বল শরীরে কিসের দরকার বুঝিনা আমি।তুই ওসব মাথা থেকে বের করে শুধু রেস্ট নে।আমি প্রতিটা মুহূর্তে তোর সাথে আছি।”
রাইকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর চোখের ওপর হাত বুলিয়ে চোখটা বন্ধ করে দেয় রণ।আবার আগের মত জড়িয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চায়।রণর স্নেহ-আদর-ভালোবাসায় শান্ত হয়ে রাই ঘুমিয়েও পড়ে তাড়াতাড়ি।রাইয়ের শ্রান্ত মুখটা আদর করতে করতে চোখের জল আটকে রাখতে পারেনা রণ।চশমাটা ঝাপসা হয়ে যায় ওর।নিজের কেবিনে যেতে ইচ্ছা করেনা রাইকে ছেড়ে।ওর রুমেই রাতে বাড়ির লোক থাকার জন্যে রাখা ছোট বিছানাতেই শরীর ছেড়ে দেয় ডক্টর রণজয় মুখার্জী।চশমা খুলে রেখে চোখের ওপর হাত রেখে আড়াআড়ি চোখটা ঢেকে দেয়।
বুকের মধ্যে অসহ্য একটা কষ্ট যেন কুরে কুরে খাচ্ছে।রাইয়ের বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট,রাইয়ের স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট আর তার সাথে মিশেছে রাইকে হারিয়ে ফেলার ভয়।
এই রোগটা কি পুরোপুরি রাইকে ছেড়ে যাবে,না কি আবার ফিরে আসবে? প্রতিবার এই ভাবে বাদ দিয়ে দিয়ে কতদিন আগলে রাখতে পারবে ও ওর রাইকে? এবারে বাবা বলেছে কেমো দিতে হবে হয়তো কয়েকটা।কিন্তু এবার সেই এক কষ্ট,একই দুঃখের পুনরাবৃত্তি।রাই কি পারবে মানসিক ভাবে এত বড় ধাক্কা সামলে,শারীরিক ভাবে আবার ওই লড়াইটা লড়তে?
প্রতি মুহূর্তে বড্ড মনটা ভয় দেখাচ্ছে রণ কে।হয়তো ও নিজেও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে বলে এরকম মনে হচ্ছে।বারবার মনে হচ্ছে মিথ্যে বলে ও রাইকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে ওর অনুমতি ছাড়া ওর স্বপ্নকে খুন করেছে জানার পর কি আদৌ রাই ওকে ক্ষমা করবে কখনো? ও কি পারবে এত বড় খারাপটা মেনে নিতে? রণ কি পারবে অসহায়তাটা ওকে বোঝাতে??
উফফ মাথা জবাব দিচ্ছে।আজ একমাস ধরে মনের মধ্যে,মাথার মধ্যে কথার পাহাড় জমেছে।ওর কথা বলার,মন হালকা করার একমাত্র সঙ্গীকে ও তারপরও অন্ধকারে রেখে গেছে আজকের দিনটার জন্যে। এক সময় মম বাবাও চাইছিল রাইকে জানিয়ে ওর মত নিয়ে এত বড় ঘটনা ঘটাতে।কিন্তু রণ নিজের জেদ ছাড়েনি।রাইকে ভরসা করে আগেই সব বলে রিস্ক নিতে চায়নি ও। রাইয়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাই রণ একাই নিয়েছে।অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের নাম করে ওটিতে নিয়ে গেছে,আর নিজের প্ল্যান মত সাকসেসফুল অপারেশন ও করেছে।কিন্তু রাই ওকে ক্ষমা করবে কি সেটা ও আজও ভেবে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।
রাইয়ের জীবনের থেকে বড় কখনো কিছু ওর কাছে ছিলোনা।হয়তো ওভারি দুটোর এফেক্টেড অংশগুলো বাদ দিয়ে বাকিটা রাখা যেত,ইউট্রাস তো এখনো ঠিক ছিল।কিন্তু গ্যারান্টি কোথায় ছিল যে ওগুলো ঠিক থাকতে থাকতে রাই মা হতে পারতো।সবাই বলবে ও চান্স নিতে পারতো,কিন্তু রাইয়ের জীবনের রিস্কও তো বাড়তো।কেন রণ সেটা নেবে? রাইয়ের জীবন যে ওর নিজের জীবনের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ক্লান্তিতে রণর তন্দ্রা মত এসে গেছিল।তার মধ্যে জয়ি আস্তে করে রুমের দরজা ঠেলে কখন ঢুকেছে বুঝতেই পারেনি।যখন নিজের মাথায় চেনা হাতের ছোঁয়া পেল,তখন অবচেতন কিছু অনুভব করলো সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুললো না ওর।
জয়ি মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ডাকলো,”রণ…বাবু।”
চোখের ওপর রাখা হাতটা সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায় রণ।তারপর পাশে রাখা চশমাটা চোখে দিয়ে বলে,”ও মম?”
“কিছু খেয়ে আসবি চল বাবা।রাই তো ঘুমোচ্ছে।সেই সকাল থেকে কিছু খাসনি”,ফিসফিসিয়ে বলে জয়িতা।
কিছু ভাবে রণজয়,তারপর উঠে বসে।জয়ির মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,”চল”।

“রাজ খাবার ঢাকা দেওয়া থাকলো,খেয়ে নিস সময় করে।আর প্লিজ লেখায় ডুবে গিয়ে আগেরদিনের মত খেতে ভুলে যাসনা যেন”,শীর্ষা শাসনের সুরে কথাগুলো বলে ফ্ল্যাটের মেইন দরজার হ্যাজবলে হাত রাখে।বেরোবার আগে একবার মুখ ঘোরায় কিন্তু শিবরাজ তাকিয়ে দেখেনা আগের মত।বুকে একটা কষ্ট হলেও সেটা চেপে ফ্ল্যাটের বাইরে পা রাখে ও।জানে লেখায় ডুবে না,নিজের মনে চুপচাপ বসেই দিন কাটিয়ে দেবে ছেলেটা,খাওয়ার কথাও খেয়াল থাকবে না।
সময় যেন ঝড়ের গতিতে ছুটছে।আর মানুষ? তাল রাখতে তারাও তো ছুটছে অবিরত।শীর্ষা আজকাল সেই গতিতে তাল রাখতে পারেনা,হাঁফিয়ে ওঠে বেশিরভাগ সময়।কিন্তু ওই যে, যে একবার সময়ের সাথে আপস করে ছুটতে শুরু করেছে সে পরে চাইলেও তো সময় তাকে ছাড়েনা।ফলে অনিচ্ছার দৌড়ে ক্লান্তি আসেই।মানুষ তখন বসার একটা আশ্রয় খোঁজে,সেই আশ্রয় হয়ে ওঠে তার আপনজন।পরে কোনো কারণে সেটা ছাড়ার প্রশ্ন এলেই সে অত্যধিক অসহায় বোধ করে,সেই আশ্রয়ের কাছে পুরোপুরি নিজেকে সমর্পণ করার শান্তি হারাবার ভয়ে ভীত হয়ে।
শীর্ষার তাই হয় আজকাল।ওর আশ্রয় এখন ওকে আশ্রয় করে দিন কাটাচ্ছে।হসপিটালে জ্ঞান আসার পর থেকে আজ অবধি ওর খেয়াল শীর্ষা রেখে চলেছে।নিজের বাবা মা কে এককথায় পর করে ব্যবসার দায়িত্ব ছেড়ে সেদিন শিবরাজ চলে এসেছিল ওর সাথে।শীর্ষা বারণ করতে পারেনি।আবার যদি হারিয়ে ফেলে রাজকে সেই ভয় ওর মনকে ঘিরে রেখেছিলো।তাই রাজ যখন সবার বিপরীতে গিয়ে ওকে আঁকড়ে ধরলো শীর্ষা নিজের পরিবার পরিজন কি ভাববে ভাবার সময় পায়নি।সেইদিন থেকে শিবরাজ ওর দুকামরার ফ্ল্যাটে আছে।
তবে ওর মধ্যে আগের উচ্ছ্বল সহজ সরল স্বাভাবিক শিবরাজকে খুঁজে পায়না শীর্ষা।সারাক্ষন চুপচাপ,যেন কি চিন্তা করছে।আগে তো শীর্ষা বাইরে থাকলে বারবার ফোন করতো,প্রচন্ড অস্থির হত।শেষ এক সপ্তাহ সেটা কমেছে।এখন সারাক্ষন চুপচাপ বসে থাকে,শীর্ষার সাথেও কথা বলেনা বিশেষ।
একদিন শীর্ষা জিজ্ঞেস করেছিল,উত্তর পাইনি পরিষ্কার।তবে বুঝেছিলো প্রচন্ড ব্যস্ততা থেকে হঠাৎ বেকার হয়ে যাওয়া মানতে পারছে না ও।শীর্ষা ওকে ওর লেখার মধ্যে এনগেজ করতে চেয়েছিল,কিন্তু এড়িয়ে গেছে শিবরাজ।
এসব মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল শীর্ষা,হঠাৎ ড্যাশবোর্ড রাখা ফোনের ভাইব্রেশন কিছুটা চমকেই দিল।
আজকাল ও নিজেও বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে থাকে,ভয় করে কোনোদিন অ্যাকসিডেন্ট না ঘটিয়ে ফেলে।আজকাল দিল্লির রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে ফোনে কথা বললেই ফাইন করে।তাই ফাঁকা দেখে গাড়ি পার্ক করে ফোনটা ধরে ও।

“বল রুদ্র কি খবর?কেমন আছিস?” পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে আজকাল রুদ্রর সাথেই যোগাযোগ রাখে ও।রণর শিবরাজের বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়া ওর কাছে প্রচন্ড স্বার্থপরের মত লেগেছিল তাই ওর সাথে যোগাযোগ রাখেনি শেষ দুমাস।এমনকি রাজের সুইসাইড আটেম্পট এর কথাও ও জানেনা, যদি না রুদ্র জানিয়ে থাকে।
“খবর ভালো না রে।রণর ওয়াইফের আবার ক্যান্সার ফিরে এসেছে।তবে ফার্স্ট স্টেজ।কিন্তু শুনলাম সার্জারি করতে হয়েছে।ডিটেইলস জানিনা।রণ বলেনি,আমিও খোঁচাইনি”,এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে রুদ্র।
শুনতে শুনতে শীর্ষার মাথাটা হঠাৎ হালকা হয়ে যায়,দাঁড়িয়ে থাকলে যেন মাথা ঘুরে পড়ে যাবে মনে হয়।
অনেক কষ্টে শুধু বলে,”তোকে রণ ফোন করেছিল?কবে হলো সার্জারি?”
-“না আমিই ফোন করেছিলাম একটা দরকারে।বাচ্ছাটার একটু শরীর খারাপ হয়েছিল,ওকে যাঁকে দেখাই তিনি ‘আউট অফ স্টেশন’ ছিলেন।তাই অন্য কাকে দেখানো যায় জিজ্ঞেস করতে ফোন করি,তুই তখন শিবরাজকে নিয়ে বিজি ছিলি।”
-“এখন কেমন আছে রাই?”
-“সপ্তাহ দুয়েক হয়েছে সার্জারির।আমি ফোন করেছিলাম দিন বারো আগে।রণ কথা বলার অবস্থায় ছিলোনা।শুধু আমার ফোন বলেই ধরেছিল মনেহয়।তারপর কাজের চাপে তোকেও জানানো হয়নি,রণকেও ফোন করা হয়নি”।
শীর্ষা বুঝতে পারেনা কি বলবে রুদ্রকে? এই রুদ্রর কেরিয়ারটাই রণর তৈরি করে দেওয়া।কেরিয়ার তৈরির আগেই হঠাৎ বিয়ে করে যখন অথৈ জলে পড়েছিল রণ ওর পাশে থেকে ওর জীবনটা সেটল করে দেয়।আর আজ এত বড় কথা শোনার পর বারো দিনে ওর সময় হয়নি রণর খোঁজ নেওয়ার!!ওর চিন্তার মাঝেই রুদ্র যেন ওর মনটা পড়ে উত্তর দিয়ে দেয়,”আমার নিজেরও এতো খারাপ দিন গেল ওই সময়।ছেলেটাও এত ভুগলো। রণর বলে দেওয়া ডক্টরের ওষুধে কমছিলো না,শেষে ওর ডাক্তার ফিরতে দেখালাম দুদিন আগে।এখন একটু বেটার।নিজেরই খারাপ লাগছিল,কিন্তু একদম সময় পাইনি কদিন।আজ মনে পড়তে তোকে ফোন করলাম,জানি তোর সাথে রণর যোগাযোগ অল্প,তাও যদি জানিস কিছু।ওকে এতদিন পর ফোন করতে লজ্জাই করছে বলতে পারিস,কিন্তু সংসার আমাদের বড় স্বার্থ সংকীর্ণ বানিয়ে দেয় রে।”
শীর্ষা রুদ্রর মতের সাথে সহমত হয়।রণ ওকে শিবরাজের ব্যাপারে এড়িয়ে গেছে বলে ও রণকে স্বার্থপর ভেবেছে।কিন্তু রণ যে ওকে ফোন করতো বারবার রাইয়ের ট্রিটমেন্টের জন্যে।ইউএস বা ইউকে যেতে চেয়েছিল রাইয়ের জন্যে,শীর্ষা সেখানে কতটুকু হেল্প করেছে ওকে? এখনও রুদ্রর অবস্থা না জেনেই নিজের মতো একটা ভেবে নিলো।
আজকাল শীর্ষার নিজের ওপর বিরক্তি বেশি হয়।বিরক্তির কারণ অনেক সময় নিজেও বুঝতে পারেনা।হয়তো ঘেঁটে যাওয়া জীবনটাই সবচেয়ে বড় কারণ।কি অদ্ভুত না একসাথে ওদের তিনবন্ধুর জীবনেই খারাপ সময় এসেছিল।
রুদ্র আরো কিছু বলতে থাকে,কিন্তু শীর্ষার কানে আর বিশেষ কিছু ঢোকেনা।ও ঠিক করে রণকে ফোন করবে আজকালের মধ্যে,আর পারলে একবার ঘুরে আসবে ওদের বাড়ি থেকে।রাইয়ের সাথে একবার দেখা করা দরকার? কিন্তু এবার রোগটা কোথায় বাসা বেঁধেছিল ওর শরীরে? তবে কি রণ যে ভয়টা পেত সেটাই হলো?
“মাই গড”,অস্ফুটে শুধু এই দুটো শব্দই বের হয় শীর্ষার মুখ থেকে।

“রাই এখনো বসে আছিস কেন?বলেছি না এতক্ষন টানা বসবি না এইমুহূর্তে।আরো কিছুদিন যাক তারপর…”,ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা রাইকে খাটে বসে থাকতে দেখে বলে রণ।আজ রাই বাড়ি এসেছে সপ্তাহ খানেক হলো।প্রথম কদিন ওর ব্যবহার স্বাভাবিক ছিল,রণ যা বলছিল সব শুনছিলো।কিন্ত রণ লক্ষ্য করছে দিন পাঁচেক হলো ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে।একটু যেন বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে,খাওয়া তো আগেই কমেছিলো,ইদানিন ঘুমটাও ঠিক করে করেনা।
রণর কথায় রাই ওর মুখের দিকে তাকায় এবার।রণ ওয়ার্ডরোব থেকে নিজের বাড়িতে পরার ট্রাউসার আর টিশার্ট বের করতে করতে না তাকিয়েও বুঝতে পারে রাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
“রণ আমার কি অপারেশন হয়েছে?” রাইয়ের নিষ্পাপ চাহনির সামনে ওর প্রশ্ন ভেতরে ভেতরে কাঁপিয়ে দেয় রণকে।ও জানতো চিকিৎসার জন্যে রাইকে খুব তাড়াতাড়ি সত্যিটা জানাতে হবে,কিন্তু হঠাৎ এরকম প্রশ্নের জন্যে ও তৈরি ছিলোনা একদমই।তাই প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতেই ও বলে,”কি খেয়েছিস তুই বিকেলে? এখন একটু চা হবে নাকি দুধ ছাড়া?”

উত্তর না দিয়ে রাই একই ভাবে তাকিয়ে থাকে রণর দিকে।
রণ অস্বস্তি বোধ করলেও সত্যিটা কিছুতেই মুখে আনতে পারেনা।আসলে ও জানেও না কিকরে বলবে রাইমা কে সত্যি কথাটা,কিন্তু এবার কেমো শুরু করতেই হবে।তার আগে আবার কিছু টেস্ট করতে হবে।ও বুঝতে পারছে রাইকে ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখা সম্ভব না।কিন্তু ও একা কী পারবে ওকে সামলাতে?এই মুহূর্তে ও বলার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ও না।তাই এড়িয়ে যেতে চায় বিষয় টা।
কিন্তু রাইকে নাছোড়বান্দা মনে হয় ওর ঠিক পরের কথাটা শুনেই।
“রণ আমি কি প্রেগনেন্ট? তাহলে সেই অবস্থায় অপারেশন!!!”
রণ তাও চুপ করে আছে দেখে এবার অধৈর্য্য হয় রাই,”কিছু বলছো না কেন? আমার পিরিয়ড হয়নি আগের মাস থেকে।তুমি বলেছিলে অপারেশন হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু আজ পনেরদিন হয়ে গেল আমার সার্জারির তাও তো…”,রাই নিজের চিন্তা লুকোতে পারেনা।
রণ আর চাপ নিতে পারেনা,কিংবা বলে দিতে চায় এবার সবটা রাইকে।আবার একবার থমকায় ও।সবে পনেরো দিন হয়েছে এত বড় অপারেশনের।এইমুহূর্তে হঠকারিতার পরিচয় দিয়ে হুট করে সবটা বলা বুদ্ধিমানের কাজ না,বিশেষ করে বাবা মা কেউ যখন ওর সাথে উপস্থিত নেই।কথাটা ওকে বলতে হবে,আর সামলাতেও হবে ওকেই কিন্তু মম থাকাটা খুব দরকার।
“রাই তুই এইসব চিন্তা না করে আগে রেস্ট নে।আমি আছি তো?” রণ রাইয়ের পাশে গিয়ে বসে ওর হাতে হাত রাখে।
রাই এবার সরাসরি তাকায় রণর দিকে।চোখ দুটো একটু যেন ছলছল করছে মনে হয়।
“আমার সত্যি কি হয়েছে বলোনা প্লিজ।আমি সায়েন্সের স্টুডেন্ট না তাও নিজের শরীর অনুভব করে বলছি আমার অপারেশনটা ছোট কিছু হয়নি।এখনো পনেরদিন পর বাথরুমে গেলে কষ্ট হচ্ছে,খাওয়াদাওয়ার এত নিয়ম,এত ওষুধ,হাঁটা চলায় বাধা।এমনকি আমি সেই যে ওপরে উঠেছি নিচে মানতেও দাওনি তোমরা।মা আজ বললো অন্তত মাস খানেক আরো আমি সিঁড়ি ভাঙবো না।রান্নার সময় টুকু বাদে রমা পিসি বেশিরভাগ আমার কাছে থাকে মা না থাকলে।কেন এত সাবধানতা রণ?কি হয়েছে আমার?মা আরও বলেছে…”,রাইয়ের কথা বাধা পায়।
“রাই, রাই, রাই… প্লিজ বাবু কদিন এগুলো একটু মেনে চল।তোর জন্যে সবাই কেয়ার করে বলেই না বলেছে।প্লিজ রাই।তোর সুস্থ হয়ে ওঠা দরকার আমাদের সবার জন্যে।সেই জন্যে এই মাস দুই একটু সাবধানে থাক”,রণ আসল প্রসঙ্গ এই মুহূর্তে এড়িয়ে যেতে চায়।
সেই মুহূর্তে রণর ফোনে হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ টোনের আওয়াজ করে মেসেজ ঢোকে,আর রাইয়ের পাশে রাখা ফোনে আলো জ্বলে নাম ভেসে ওঠে ‘শীর্ষা’।
ফোনের দিক থেকে চোখ রণর মুখে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়ে রাই দেখে রণর কুঁচকোনো ভ্রু তে জিজ্ঞাসা,মানে শীর্ষার মেসেজ ওর কাছে এক্সপেক্টেড না।
রাই কোনোদিনও যা করেনা,ঠিক সেটা করে। রণর ফোনটা তুলে নিতে যাওয়ার আগেই রণ সেটা নিয়ে নেয়।অবাক হয় রাই রণর এরকম ব্যবহারে।ওর বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে রণ অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে বলে,”এবার শুয়ে পর রাই, অনেক্ষন বসে আছিস।পেইন হবে।”
“পেইন তো সারাক্ষন হচ্ছে রণ।কিন্তু কেন? কেন পিরিয়ড হচ্ছেনা? আজ চিটি ফোন করেছিল আমার শরীরের খোঁজ নিতে।ও বললো ওর ক্লাস নাইনে পড়তে অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন হয়।এত বছর আগে ওর সুস্থ হতে সময় লেগেছিল ম্যাক্সিমাম পনেরো দিন।আর অপারেশনের কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক পিরিয়ড হয়েছিল।আর আগেও কখনও অ্যাপেন্ডিক্স এর কারণে ওই সমস্যা হয়নি।খাওয়াদাওয়ার রেস্ট্রিকশন ছাড়া ওর কোনো বারণ কিছু ছিলোনা,তাও দিন পনেরো।এমনকি স্কুলেও যেত পনেরো দিন পর থেকে।আমার এই পেইন আগেও ছিল,এখনো আছে।এত হালকা খেয়ে,এন্টাসিড খেয়েও হজমে সমস্যা রোজ হচ্ছে।মোশান, টয়লেট সবেতে সমস্যা।যেন পেট নীচে টেনে ধরে।পেটটা ফুলে আছে,অথচ মনে হয় পেটের মধ্যেটা যেন কত ফাঁকা হয়ে গেছে”,দুর্বল শরীরের রাই এতটা একটানা কথা বলে হাঁফিয়ে যায়।
“প্লিজ রাই রেস্ট নে।আর প্লিজ এক্সাইটেড হোস না।আমায় একটু সময় দে, আমি তোকে সব বলবো।প্লিজ”,রণর আকুতি রাইকে আরও উত্তেজিত করে।ও শান্ত হওয়ার বদলে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে,”না…এক্ষুনি বলো।আমি জানতে চাই।তোমার ফোনেই বা কি এমন আছে,আমায় হাত দিতে দিলে না।শীর্ষাদির মেসেজ আমায় দেখতে কখনো তো বাধা দাওনা।তাহলে আজ কেন…”,রাই থেমে যায় রণর চিৎকারে।হঠাৎ রণ নিজের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে চিৎকার করে ওঠে।ওর এতদিনের মানসিক চাপ ওকে বাধ্য করে এটা করতে।ও পারেনা শান্ত ভাব বজায় রেখে পুরো ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে।
“প্লি… জ রাই, উইল য়্যূ প্লি-জ স্টপ।আমি আর পারছিনা।কিসের এত প্রশ্ন তোর।বলছি তো সময় আসলে বলবো।কেন এত জেদ তোর? আমি তো একটু সময় চাইছি।বুঝতে পারছিস না,আমি এইমুহূর্তে বলার অবস্থায় নেই।আর শীর্ষা আমার বন্ধু,ওর সাথে পার্সোনাল কথা থাকতেই পারে।সব তোকে বলতে হবে তার কি মানে আছে।আমার কি পার্সোনাল স্পেস থাকবে না কিছু?”
শীতের সন্ধের রণর এই চিৎকার নিচের ডাইনিং স্পেসেও পৌঁছয়,যেখানে জয়ি রণর চা নিয়ে বসে ছিল দরকারি কথা বলবে বলে।রাইয়ের ওপর কেন,কারোর ওপর আজ অবধি এভাবে চেঁচায়নি যে ছেলে,সে অসুস্থ রাইয়ের ওপর কেন চেঁচাচ্ছে জানতে দৌড়ে উঠে আসে ওপরে।পারমিশন না নিয়েই ওদের ঘরে ঢুকে ছুটে যায় রাইয়ের দিকে।রণর চিৎকারে ভয়ে ফোঁপাতে শুরু করা রাই, দুর্বল শরীরে জয়িকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পরে কান্নায়।কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে জয়ির বুক থেকে মুখ সরিয়ে অবাক হয়ে দেখে রণ দুহাতের মধ্যে মাথাটা চেপে ধরে বিছানার অন্য প্রান্তে বসে পড়েছে,আর হাতের আড়াল থেকে শোনা যাচ্ছে ওর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ।অনেকদিন ধরে চেপে রাখা কোনো কষ্ট যেন বুক ঠেলে বেরিয়ে আসছে।সেই ফোঁপানোর বেগ কমার বদলে বাড়ছে।রণর কান্না রাইয়ের কান্নাকে থামিয়ে দিলেও বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর হৃদস্পন্দন।রণকে এভাবে ভেঙে পড়তে রাই দেখেছিল অনেক বছর আগে,দিদুনের মৃত্যুর দিন।তারপর জীবনে অনেক ঝড় এসেছে,রণর অসহায়তা,বিরক্তি,কষ্ট,ভেঙে পড়া সব দেখলেও কান্নায় এভাবে ওর সামনে ভাঙেনি রণ।রাইয়ের নিঃশ্বাস ভয়েতে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
ফ্যালফ্যাল করে জয়ির মুখের দিকে তাকিয়ে রাই দেখতে পায় এক অসহায় মা’কে।রাইকে ছেড়ে ছেলের কাছে যেতে চাইলেও যেতে পারছে না যেন।রাই সেই দৃষ্টিতেও একটা ভয় দেখে ফেলে,বুঝে যায় ওর জীবনে আর একবার কোনো সুনামী এসেছে,যা ওলটপালট করে দিয়েছে ওর কাছের মানুষগুলোর জীবনকে।কিন্তু তারা আপ্রাণ আটকে রাখতে চাইছে সেই ঢেউ ওর কাছে আসা থেকে,যা সম্ভব না।
রাই জয়িকে ছেড়ে সরে আসে,চায় জয়ি গিয়ে রণকে আশ্রয় দিক।কিন্তু তারপরও জয়িতা স্থির ভাবে নিজের জায়গায় বসে আছে দেখে নিজেই বিছানা ঘষে এগিয়ে যায় রণর দিকে।রণর গায়ে হাত দিয়েই বুঝে যায় নিজেকে শক্ত করে বসে আছে ছেলেটা।বার দুই দুর্বল শরীরে চেষ্টা করে রণকে নাড়াতে না পেরে হাল ছেড়ে যখন সরে যেতে যাবে রণ আচম্বিতে ঘুরে রাইকে চেপে ধরে।নিজের বুকে আঁকড়ে ফোঁপানো বন্ধ করে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মুহূর্তের মধ্যে।রণর কষ্ট ছড়িয়ে যায় ঘরের কোণে কোণে।
রাই বুঝতে পারে জয়ি সামলাতে পারবে না এই কান্না বুঝেই চুপ করে বসেছিল।রাই-রণকে একে অপরের আশ্রয়ে দেখে জয়ি উঠে পরে বিছানা ছেড়ে।পায়ে পায়ে ওদের ঘরের দরজার কাছে চলে গিয়েও কি মনে করে ফিরে এসে রণর পাশে দাঁড়ায়।
ইতস্তত করছে জয়ি এমন সময় রণ বলে,”মম কি বলবো রাই কে!তুমি বলো মম।বলবো যে ওর স্বপ্ন…”,রণ থেমে যায় জয়ির হাত এসে ওর কাঁধে চাপ দিতে।হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পায় ও।রাইকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে,তারপর রাইয়ের বিস্মিত মুখের দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।
“রাই”,রণ প্রথমে কিছুই বলতে পারেনা।
“হমম”,অন্যমনস্ক রাই যেন অপেক্ষা করছে মনেহয়।
আবার নীরবতা ঘিরে ধরে রণকে।
এতক্ষন পর মুখ খোলে জয়ি,”রাই,আমি জানি ছোট থেকেই তোর মনের জোর খুব।সব পরিস্থিতিতে তুই সেই জোরটা দেখিয়েছিস।আজও তুই পারবি।রণ যা করেছে তোর ভালোর জন্যে,আর তুই অন্তত সেটা জানিস। আমি ভরসা রাখি তোর ওপর তুই বুঝবি ।”
রাই কিছু না বলে জয়ির মুখের দিকে শুধু অবাক হয়ে তাকায়।
রণ চুপ করে বসে আছে দেখে জয়ি ওর পিঠে হালকা চাপ দেয়।মুখ তুলে রাইকে দেখে একবার দেখে রণ বলতে শুরু করে,হয়তো আর একটু সময় পেলে ভালো হতো,কিন্তু বলতে তো হতোই একদিন।
“রাই তোর ওভারিদুটোতে আবার ক্যান্সার ফিরে এসেছিল”।প্রথম বাক্য শুনেই কেঁপে ওঠে রাই।রণ নিজের হাতটা ওর দুটো হাতের মধ্যে গুঁজে দেয়।তারপর আবার বলতে শুরু করে,”কতটা কি বাড়াবাড়ি হয়েছে যতক্ষন না ওটি হয় বুঝতে পারছিলাম না আমরা।কিন্তু…”।
“কিন্তু কি রণ?আমার কোন স্বপ্ন তুমি শেষ হওয়ার কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলে বলো?” রাই আবার উত্তেজিত হচ্ছে বুঝতে পারে ওরা দুজন।জয়ি এসে রাইয়ের পাশে বসে ওকে জড়িয়ে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে।
“রাই স্বপ্নের আগেও বাস্তব।বাস্তব বলে বেঁচে থাকা সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট আমাদের সবার জন্য।তোর রিস্ক ফ্যাক্টর এমনি হাই ছিল,তাই… সরি রাই আমি আর কোনো রিস্ক নিতে পারতাম না তোর সাথে।আমি নিজে তাই তোর ওভারি,ইউট্রাস অপারেট করতে বাধ্য হয়েছি।হ্যাঁ তোকে না জানিয়েই।” রণ রাইয়ের চোখে চোখ রেখে পুরোটা বলার পর আশা করে রাই কান্নায় ভেঙে পড়বে।কিন্তু রাইয়ের চোখ থেকে নিঃশব্দে শুধু জল পড়তে থাকে।ওর মুখ থেকে না কোনো কথা বের হয়,না ওর অন্তর থেকে হাহাকার।
রণ রাইকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে বুঝতে পারে কিছুক্ষন আগে ও যেমন শক্ত হয়ে বসেছিল,রাই সেভাবেই বসে আছে।
জয়ি কিছু না বলে উঠে বেরিয়ে যায় দরজা খুলে,যাওয়ার আগে রাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“রাই প্লিজ ভুল বুঝিসনা আমায়।আমার কাছে আর কোনো রাস্তা খোলা ছিলোনা।প্লিজ বোঝ।তোকে বলে কি হতো বল।হ্যাঁ ওটিতে যাওয়ার আগে সত্যিটা হয়তো তোকে বলতে পারতাম,কিন্তু ডিসিশন তো আমাকেই নিতে হত।রাই…”।
রণর কথার মধ্যেই রাই শুয়ে পড়ে,রণর দিকে পেছন করে।এতদিনের দোলাচল সবটা শেষ হওয়ার পর ওর বুকের মধ্যেটা আজ শুধুই শূন্য।রণ ওকে না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শুধু না,ওর জীবনের একটা আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য আজ শেষ।
ভালো মেয়ে না,স্ত্রী না,বৌমা না… ও সেই ওর মা চলে যাওয়ার দিন থেকে চেয়েছিল ‘মায়ের মত’ একজন মা হতে।ওর জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাকে প্রয়োগ করতে,কিন্তু আজ সবটাই অর্থহীন হয়ে গেল।কি লাভ এভাবে বেঁচে।
ওর মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কাছে রণ,ওর ভালোবাসা,সবার জন্য বেঁচে থাকার দরকার,ওর নিজের প্রানের গুরুত্ব সব ম্লান হয়ে গেল এক মুহূর্তে।রণর সাথে কথা বলতে ওর আর মন চাইলো না,মন চাইলো না অভিযোগ করতে বা রণকে বুঝতে।চুপ করে শুয়ে ও চোখটা বুজে ফেললো,হয়তো এটা ওর দুঃস্বপ্ন।হয়তো বাস্তবে সব ঠিক আছে।চোখ খুলে দেখবে রণ ই হয়তো কোনো ‘গুড নিউজ’ নিয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।

ক্রমশ…