মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-৩৫

0
392

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#পঁয়ত্রিশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“রণজয় তুমি একটু বাইরে যাও,আমি রাইমার সাথে একটু একা কথা বলবো”,সাইকোলজিস্ট মিসেস মৃন্ময়ী চৌধুরীর কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রণ।
আজ মাস খানেক হলো রাইয়ের শরীরের ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছে,কিন্তু ওর মনটা কেউ ছুঁতে পারছে না সেভাবে।নিজেকে নিজের মধ্যে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছে মেয়েটা।যেন বেঁচে থাকার জন্যে শুধু বেঁচে আছে।তাও রণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।কিন্তু গতকালের ঘটনা ওকে একটু ভয় পাইয়ে দিয়েছে,তাই ও কোনো নামি সাইকিয়াট্রিস্ট এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেয়ে জয়ির বান্ধবী মৃন্ময়ী চৌধুরীর কাছেই নিয়ে এসেছে রাইকে।

মৃন্ময়ী আন্টির কথায় নিজের ফরমাল প্যান্টের পকেটে বাঁহাত গুঁজে উঠে দাঁড়ায় রণ,রাইয়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে আসে ওই ঘরটা ছেড়ে,আর অবাক হয়ে দেখে রাইয়ের মুখে তাতে কোনো উদ্বেগের ছাপ অবধি পরেনা।যে রাই রণকে ছাড়া এতদিন একপা এগোতে দশবার ভাবতো, বিশেষ করে শেষ পাঁচ বছর,সে আজকাল রণর ব্যাপারে এতটাই উদাস হয়ে গেছে রণর থাকা না থাকা ওর কাছে কোনো গুরুত্ব পায়না।
রণর আজকাল বড্ড পুরোনো কথা মনে পড়ে,সেই প্রথম বছর গুলোর কথা,যখন ও শুধুই রাইয়ের রণদা ছিল।রণকে বিশ্বাস করতে রাই প্রথম ছ’মাস নিয়েছিল।কিন্তু তারপর আর ওকে ছাড়া নিজে কিছু ভাবতো না যেন।
রণ চোখ বুজে হারিয়ে যেতে চায় সেই কিশোর রণ-রাই এর স্কুলবেলায়।ফিরে পেতে চায় ওর ওপর বিশ্বাস করতে চাওয়া, নির্ভর করতে চাওয়া রাইকে।
একবার মম আর রাইয়ের কথা হচ্ছিল ছাদে,তখন রাই সদ্য ওদের বাড়ি এসেছে বেড়াতে কদিনের জন্যে।রণর সাথে কথাও সেভাবে শুরু হয়নি।রণ কোচিং সেরে এসে ওর মমকে দেখতে না পেয়ে উঠে গিয়েছিল চিলেকোঠার ঘরে।সিঁড়ির দরজা দিয়ে উঠে ছাদে বেরোতে যাওয়ার মুখে থমকে গেছিল ও জয়ি আর রাইয়ের কথার টুকরো কানে আসায়।
-“কেন রে রাই রণকে ভয় করে কেন তোর?ও কিন্তু খুব ভালো ছেলে আর খুব মিশুকে।হ্যাঁ তোর সাথে সেভাবে আলাপ হয়নি…”।
-“রণদা মনেহয় আমায় পছন্দ করেনা আন্টি।রণদা চায়না না আমি এখানে এসে থাকি?”
-“দূর বোকা মেয়ে,এসব কে বললো তোকে?” জয়ির গলা সেদিন একটু হলেও কেঁপেছিলো।হয়তো মনে পড়েছিল রাইকে নিয়ে আসা নিয়ে রণর আপত্তির কথা।
রণ বুঝতে পেরেছিল ওর চুপচাপ হয়ে থাকা মেয়েটাকে নাড়া দিয়েছে।ও বলতে পারেনি রাই যা ভাবছে সেটা আগে রণর মত ছিল,কিন্তু এখন রণ রাইকে এড়িয়ে চলে অন্য কারণে।রণ যে রাইকে প্রথম দেখার দিনই বুকে শিরশিরানী অনুভব করেছিলো।ওর ষোলো বছরের জীবনে ওই অনুভূতি হয়েছিল প্রথমবার।রাইকে সারাদিন ওর চোখ খুঁজতো, কিন্তু সামনে এলেই কথা হারিয়ে যেত।হার্টবিট প্রথম দিকে খুব বেশি ফার্স্ট থাকতো রাই সামনে থাকলে।
ওর মত বইপোকা প্রথম কদিন পড়ার বইতে মন বসাতেই পারেনি।
কিন্তু সেদিন রাইয়ের গলার মধ্যে একটা মন খারাপ অনুভব করেছিল ও।
নেমে এসেছিল চিলেকোঠা থেকে চুপচাপ।নিজের ঘরের জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষন,আজ যেখানে রাই মনখারাপ হলেই বসে থাকে।
নিজের দুর্বলতাকে আস্তে আস্তে কন্ট্রোল করে ঠিক করেছিল বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে ওর ‘প্রথম ভালোলাগা-ভালোবাসা’র দিকে।প্রথম দেখাতে ভালোবেসে ফেলার যে বোকামি রণ করেছিল,আজও সেই ভালোবাসার দায়িত্ব ও বয়ে চলেছে,আর আজন্ম চলবেও।
ওর জীবনে রাই এর অস্তিত্ব সব কিছুর ওপরে।ও সমস্ত স্বপ্ন,শখ,আনন্দ এক কথায় ছেড়ে দিতে পারে রাইয়ের জন্যে।সেই কারণেই রাইয়ের আনন্দ দেখতে তো ও রাইকেও ভুলেছিলো ওর জীবনে যখন অনিকেত আসে।কিন্তু হয়তো ভগবানও বুঝেছিলো রাইকে ওর থেকে ভালো কেউ বাসতে পারবে না,তাই ফিরিয়ে দিয়েছিল ওর কাছেই।
কিন্তু সেদিন রণ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সেই ঈশ্বর ওর ভালোবাসার এত পরীক্ষা নেবে এত দীর্ঘ সময় ধরে।
রাই ওর সাথে কথা বলছে না,এড়িয়ে থাকছে,ওকে উপেক্ষা করছে এর থেকে বড় শাস্তি রণর কাছে আর কিছু হতে পারেনা।এমনকি এবারে ওর প্রথম কেমোর পর যখন দু-তিনদিন অসুস্থ ছিল রণর কোনো হেল্প নিতেও অস্বীকার করেছিল রাই বদ্ধ দরজার আড়ালে।
রণ প্রথমদিকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, তারপর ইদানীং হাল ছেড়ে আর বিশেষ কিছু বলেনা।একই ঘরে রাইয়ের সাথে ও অচেনা মানুষের মত বাস করে।ওর এটাই সবচেয়ে কষ্ট হয়।
রণ চুপ করে একটা চেয়ারে বসে থাকে।মৃন্ময়ী আন্টির চেম্বার তার সাবেকি আমলের বাড়ির নিচের একটা ঘরে।বাড়িটাও শহর থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে।রাইরা নাকি এখানে থাকতো কাছাকাছি কোথাও।রণ খেয়াল করেছিল গাড়িতে আসার সময় অনেকদিন পর রাইয়ের বসে যাওয়া চোখে মুখে একটা উত্তেজনা।
এই সাবেকি বাড়ির টানা বারান্দায় কতকগুলো পাতা চেয়ারের একটায় বসে অপেক্ষা করতে থাকে রণ।
ওর রেজাল্ট বেরিয়েছে,কিছুদিনের মধ্যে অন্য শহরে যেতে হবে ওকে।কিন্তু রাইকে ফেলে আর না।রাইয়ের জন্যে অঙ্কলজিস্ট হতে চেয়েছিল ও।কিন্তু রাই তো ওকে সময় দিলোনা।তাই আর তাড়া নেই।ভবিষ্যতেও রাই ওকে নিজের চিকিৎসা করতে দেবেনা যদি দরকার পড়ে,বিশ্বাস করে না রাই ওকে,ওকে এই কথা দুটোই শুধু বলেছে ও গতকাল।কাল রণর বারবার নিজের কথা বলতে চাওয়ার উত্তরে রাই শুধু এই কথাগুলোই বলে।রণকে বিস্মিত বিমূঢ় করে দিয়ে রাইমা কাটাকাটা স্বরে জানিয়েছিল,”কোন বিশ্বাসে তোমায় ভরসা করবো?আমার প্রাণ টুকু রেখে সমস্ত শরীরটাই তো অসম্পূর্ণ করে দিয়েছো?শুধু প্রাণ নিয়ে কি কেউ বেঁচে থাকতে পারে,না বেঁচে থাকতে চায়? আমি না বাঁচলে তুমি বাঁচবে না এই স্বার্থপর চিন্তায় আমায় অর্ধমৃত বানিয়ে দিলে। বেঁচে আছি, কিন্তু উদ্দেশ্য ছাড়া,লক্ষ্য ছাড়া।কি হবে এরকম বেঁচে?আমি না নারী,না মা কোনোটাই না।অসম্পূর্ণ, অসুস্থ এক মানুষ হয়ে আগামী কিছু বছর বেঁচে থাকবো।যে বেঁচে থাকা আসলে অর্থহীন”।
উত্তর দিতে পারেনি রণ,সেই মুহূর্তে ও বুঝেছিল কোনো স্পেশালিস্ট ছাড়া ওর পক্ষে রাইকে বোঝানো হয়তো সম্ভব না।

জীবন শুরু হলোনা,তার আগেই সব চাওয়া পাওয়ার হিসেব মিটিয়ে দিলো ভগবান।একটা সন্তান বাবা মার জীবনে সেতু,তাদের জীবন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ,নতুন কিছু করার অনুপ্রেরণা।কিন্তু সন্তান ছাড়াও তো কত দম্পতি সুখে থাকে,যদি তাদের মধ্যে বিশ্বাস-ভালোবাসা সর্বোপরি একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা বেঁচে থাকে।দুজন মানুষ মিলে একটা শূন্যতা কে উপেক্ষা করেও বাঁচা যায় আনন্দে,অন্য অনুপ্রেরণা-উদ্যোগ কে অবলম্বন করে।যদি উভয়ের কষ্টটা একে ওপরে উপলব্ধি করে।
মা হতে না পারা জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট,কিন্তু বাবা হতে না পারা? ছেলেটার কি কষ্ট হয়না।তাহলে যদি রণ রাইয়ের জীবনের বিনিময়ে সেই কষ্টটা স্বীকার করে নিতে পারে,তাহলে রাই কেন ওর আনন্দের জন্যে এটা পারছে না!
এই তো সেদিন বাবা বললো একটা বছর খানেকের বাচ্ছার মায়ের ওভারিয়ান ক্যান্সারে চলে যাওয়ার গল্প। কি দোষ ওই দুধের শিশুটার!কয়েকদিন ‘মা’ ডাক শুনে সারাজীবন মা ডাকার অধিকার কেড়ে নিয়ে চলে গেল ওর মা।
ভাগ্য সবাইকে সবটা দেয়না।রণকে রাই দিয়েছে,আর রণ কোনো কিছুর বিনিময়ে রিস্ক নিতে পারবে না রাইয়ের সাথে।এটা এত বছরেও রাই বুঝলো না,এটা সবচেয়ে বড় কষ্ট।
রণর কি কোনো গুরুত্বই নেই ওর জীবনে! আজ রাই না থাকলে রণ কিকরে বাঁচবে সেটা একবারও ভেবে দেখেনি।রণ কি করতো এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া?রাই কি কোনোদিনও অনুভব করবে না ওকে?
হঠাৎ এই শান্ত পরিবেশে অনেকদিন ধরে সামলে রাখা আবেগটা বেরিয়ে আসতে চাইলো যেন। রাইয়ের প্রতি অভিমানে বুকের মধ্যে ওঠা ঝড়টা সামলাতে পারলো না রণ।দুহাতে মুখ ঢাকলো নিজের। সবার সামনে নিজের কাঠিন্য ধরে রাখতে রাখতে ও ক্লান্ত। ওর নরম মনও ভাঙে,ভাঙতে চায়। ও চায় নিজের কান্নাটা বের করে হালকা হতে। কিন্তু কে শুনবে ওর কান্না! কে বুঝবে ওর একাকীত্ব। মম বুঝলেও একটা বয়সের পর হয়তো মা বাবার সামনে কাঁদা যায়না,যার বুকে মাথা রেখে অথবা কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে চায় সে আজ ওকে না বুঝে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ডক্টর রণজয় মুখার্জী নিজের মনের ঘরে,আবেগের দরজায় যে তালা দিয়েছিল ভেঙে যায় সেই তালা। নিজের কাছে নিজেই ভেঙে পরে সে সবার আড়ালে।

“বল রাইমা,তোমার মনের কষ্ট,হতাশা,মন খারাপ সবটা খুলে বলো আমায়।তুমি হয়তো অনেক কথা জমিয়ে রেখেছো মনের মধ্যে,শেয়ার করতে চাইছো না।প্লিজ শেয়ার করো”,অনেক্ষন থেকেই চেষ্টা করছেন ডক্টর মিসেস চৌধুরী।কিন্তু রাই শেষ একমাসের মত এখনো চুপ করেই বসে আছে।ও যে বরাবরই চুপ করে থাকতে অভ্যস্ত।ওকে কথা বলতে শিখিয়েছিল যে মানুষটা,আজ ওর ভাবনায় সেই ওর সব কথা কেড়ে নিয়েছে।রণর দেওয়া কষ্ট ও কাকে বলবে?
কাকে বলবে রণ ওর বিশ্বাস ভেঙেছে,ওর শরীরটা বাঁচাতে গিয়ে ওর মনটা খুন করেছে।কেন ওকে একবারও জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো না ওরা কেউ,এমনকি বাবাও! কেন রণ দুটো ওভারি,ইউট্রাস ওকে না জানিয়ে বাদ দিয়ে দিল? ও তো স্বজ্ঞানে ওটিতে গিয়েছিল,তাহলে কেন ওকে আগে কিছু বললো না ও? একটা হিন্টস অন্তত দিতে পারতো।ওর ওপর রণর যতই সমস্ত অধিকার থাকুক,ওর নারীত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ওর অনুমতি ছাড়াই… না না না,রণ কেন নিজের বাবা-মা ও এটা করতে পারেনা।রাই এটা বিশ্বাস করে। আর তাই ওর মনের এই ক্ষোভ ও ভুলতে পারছে না,পারছে না রণকে ক্ষমা করে দিতে।
না রাইয়ের মনের মধ্যে চলা এই কথাগুলো ডক্টর কেন কারোর সাথেই শেয়ার করতে পারবে না ও।এগুলো একান্তই ওর নিজের অভিমান,রণর বিরুদ্ধে সেই অভিমান ও কাউকেই বলতে পারবে না।
রণ যাওয়ার পর রাইকে চেম্বারে রাখা আরাম কেদারায় বসিয়ে ঘরের লাইট কমিয়ে দেন মৃন্ময়ী,একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে রাইয়ের মনের মধ্যে ঢোকার যে চেষ্টা উনি করে যাচ্ছেন তা প্রথম দিনেই হয়তো সফল হবে না,এটা উনিও জানেন।কিন্ত কোনো না কোনো ভাবে এই মেয়ের মনে ঢুকতে না পারলে সেটা খুব খারাপ হবে। একে শরীরের এই অবস্থা,তার সাথে জুড়েছে ডিপ্রেশন।নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে ফেলবে এই মেয়ে।
“রাইমা তোমার জীবনে অনেক ট্রাজেডি,কিন্তু জীবনটাই তো একটা লড়াই ক্ষেত্র মা।ট্রাজেডি আমাদের সবার জীবনের পার্ট,কারোর বেশি,কারোর কম। তুমি তো লাকি তোমার একজন সহযোদ্ধা আছে। তোমার স্বামী তোমার লড়াইটা পাশে থেকে লড়ছে।কত মেয়ে…”,মৃন্ময়ী বাধা পান,প্রথম মুখ খোলে রাই,”লড়াই করা আর স্বামীর অধিকারে একা সিদ্ধান্ত নেওয়া কি এক জিনিস?একজন স্ত্রীর অধিকারে একই কাজ করলে সেই পুরুষকে সবাই লাকি বলতো,নাকি মেয়েটা কে উদ্ধত?”
চুপ করে যান মৃন্ময়ী সাময়িক। বুঝতে পারেন অভিমানের শিকড় কোথায়।
“তোমায় একটা গল্প বলি রাই।আমার এই পেশাতে এরকম অসংখ্য গল্পের মধ্যে তোমার জীবনের সাথে মিলে যাবে এমন একটা গল্পই বলবো।উমমম…প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা,আমাদের হসপিটাল ‘দিশা’ তে এক অল্প বয়সী মেয়ে আসে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে।আমার হাজব্যান্ড তাকে ট্রিটমেন্ট করা শুরু করেন।কিন্তু কাউন্সিলিংয়ের ক্ষেত্রে উনি বরাবর আমার ওপর নির্ভর করেন।মেয়েটার শরীরে কোনো রোগ ছিলোনা।অপরূপ সুন্দরী।কিন্তু বিয়ের পাঁচ বছরেও সন্তান না হওয়ায় শ্বশুর বাড়ি থেকে ত্যাগ করেছে।এমনকি মেয়েটার স্বামী বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উঁচু পোস্টে থাকা অফিসার,সেও বাড়ির মতে মত দিয়েছিল।কোনো এক বিয়েবাড়িতে দেখে মেয়েটার রূপে পাগল হয়ে তার স্বামী তাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু খুঁত ওয়ালা মেয়েকে আর ভালোবাসা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।মেয়েটা অনাথ ছিল,স্বামীকে পাগলের মত ভালোবাসতো।এরকম অনেক কেস থাকে দরকারি অর্গান থেকেও মা হতে পারছে না।আর তখন পাশে পাচ্ছে না কাউকে।আরও একটা কথা তুমি একটা কথা ভেবে দেখো,তুমি নিজে না বাঁচলে বেবি থাকলেও মা ডাক শোনা কি সম্ভব হত?”
রাই আর কোনো জবাব দেয় না।ও নিজেও হয়তো সব জানে,কিন্তু ওর অজ্ঞাতসারে রণ নিজের সিদ্ধান্তে এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছে এটা মানতেই ওর কষ্ট হচ্ছে।
রাইয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন মৃন্ময়ী।বুঝতে পারেন সব বুঝেও মেয়েটা বুঝতে চাইছেনা সত্যিটা।হয়তো ইগো, হয়তো অনেক বড় স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার আর্তনাদ,হয়তো জীবনের বাঁচার লক্ষ্য হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট বা বিশ্বাস ভাঙার অভিমান।
নিজের স্বামীর ওপর প্রচন্ড অভিমান বাস্তব চিন্তা করতে বাধা দিচ্ছে।আর ওকে স্বাভাবিক হয়তো মেডিকেল সায়েন্স করতে পারবে থেরাপি,মেডিসিন,কাউন্সিলিং দিয়ে কিন্তু ওর ভালোবাসাই পারবে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি ওকে ভালো করে তুলতে।
রণর প্রতি ব্যবহার ওর অভিমানের প্রকাশ,তাই মনের ডাক্তার বুঝে যান কোন ওষুধ বেস্ট হবে রাইমার জন্যে।তাই নিজের মেডিকেল ট্রিটমেন্ট শুরুর আগে উনি অন্যভাবে একবার চেষ্টা করবেন ভাবেন,যাতে রণজয়ের হেল্প খুব বেশি দরকার।
“ঠিক আছে রাইমা তুমি এখানে বোস আমি একটু আসছি”,আধো অন্ধকার ঘরে রাইকে রিলাক্স করতে দিয়ে মৃন্ময়ী বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে।রণকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন,কোথায় যে গেল ছেলেটা!
নিজের বাড়ির বারান্দা ধরে একটু এগিয়ে দেখতে পান পুরোনো বাড়ির রেলিংয়ে হাতের ভর দিয়ে বাইরে বাগানের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রণজয়।ছেলেটার জন্যে মায়া হয়।মায়া হয় অন্য কোনো কারণে নয়,মায়া হয় ভালোবাসার মানুষটা অকারণে ভুল বুঝে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে,আর ওকেও কষ্ট দিচ্ছে ভেবে।
“রণজয়”,দূর থেকে মৃন্ময়ীর গলা পেয়ে ঘুরে তাকায় রণ,চশমায় ঢাকা চোখ লালচে।
অভিজ্ঞ সাইকলজিস্ট মৃন্ময়ী চৌধুরীর বুঝতে অসুবিধা হয়না কারণটা।দ্রুত পা চালিয়ে রণর কাছে এসে রণর পিঠে হাত রাখেন মৃন্ময়ী।
রণ একা মৃন্ময়ী দেখে অবাক হয়,রাই কই!
ওর মনের ভাষা বুঝে মৃন্ময়ী বলেন,”রাইমাকে রুমে রেস্ট করতে দিয়ে আমি বেরিয়ে এসেছে,তোমার সাথে কিছু কথা বলবো বলে।তোমার সাহায্য ছাড়া রাইমা কে সুস্থ করা মুশকিল।আমার মনেহয় শুধু তুমি না,ও নিজেও তোমাকে অতিরিক্ত ভালোবাসে,আর সেখান থেকেই জন্মেছে অভিমান।তুমিই পারবে ওর ভুল ভাঙিয়ে আবার নতুন করে বিশ্বাসের জন্ম দিতে,তোমার প্রতি ওর অভিমান ভেঙে আবার আস্থার জন্ম দিতে।আর আমি এব্যাপারে সমস্ত সাহায্য তোমায় করবো।”
এতক্ষন মৃন্ময়ী আন্টির দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকা রণ মুখ নামিয়ে নেয়।ওর এই সাতাশ বছরের জীবনে কখনো ও এতো অসহায় বোধ করেনি,বা ভেঙে পড়েনি,আজ ওর যা অবস্থা। সদ্য পরিচিত মায়ের বান্ধবীর থেকে নিজেকে লুকোতে মুখ নামিয়ে চোখের জল আটকাতে চায় ও।
সময় দেন মিসেস চৌধুরী।
কয়েক সেকেন্ড,চশমা খুলে হালকা হাতে চোখদুটো চেপে নিয়ে চশমাটা আবার পরে মুখ তুলে তাকায় রণ।
“বলুন আন্টি”,উজ্জ্বল আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকায় রণ মৃন্ময়ীর দিকে।

“নে খেয়ে নে”,ফলের প্লেটটা এগিয়ে দেয় রণ রাইয়ের দিকে।কাল রাতে ওরা দুজন,জয়ন্ত আর জয়ি-ঋষি এসে পৌঁছেছে পুরীতে।রণ রাইকে নিয়ে আসতে চায় শুনে ঋষি জয়ি একা ওদের ছাড়তে চায়নি,কারণ কেমো এখনো কমপ্লিট হয়নি রাইয়ের,ও সুস্থ নয়।কেমোর ছটা সাইকেলের মধ্যে সবে তিনটে দেওয়া গেছে।
মৃন্ময়ীর কথা মত কিছুদিন অপেক্ষা করে রাইকে আরও কদিন সময় দিয়ে তারপর ডাক্তারের পরামর্শেই জায়গা বদলাবার সিদ্ধান্ত নেয় রণ,কদিনের জন্যে পরিবেশ বদলে রাইকে নিয়ে চলে আসে এই সমুদ্রের ধারে।
রণ পুরো রাস্তা ড্রাইভ করে আসতে চাইলেও ঋষি ভাস্করকে গাড়ির দায়িত্ব দিয়ে নিয়ে এসেছে সাথে।জয়ন্ত প্রথমে রাজি ছিলনা,শেষে সবার চাপে পড়ে এসেছে।
সমুদ্রের ধারের এই গেস্ট হাউসে নিজেদের ঘর লাগোয়া দোতলার বারান্দায় বসে দূরের সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল রাই।রণর কথায় ফিরে তাকায় রাই ওর মুখের দিকে।সমুদ্রের হাওয়ায় ওর গলায় জড়ানো ওড়না হাওয়ায় উড়লেও মাথার যৎসামান্য চুল উড়ে মুখ অবধি পৌঁছছে না।চোখের ক্লান্ত দৃষ্টি বুঝিয়ে দিচ্ছে ওর শারীরিক অসুস্থতা থাবা বসিয়েছে ওর মনেও।মৃতপ্রায় চোখের ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে ওর মনের অবসাদ।
না,ও আসতে চায়নি রণর অনুরোধেও ওর সাথে।এমনকি জয়ি ঋষি সাথে আসবে শুনেও ও প্রস্তুত ছিলোনা রণর আবদার মানতে।কিন্তু সারাজীবন ভাগ্যের অভিশাপ কুড়োনো নিজের বাবার কথা ফেলতে পারেনি ও।জয়ন্তও সঙ্গে আসবে শুনে নিমরাজী হয় রাই শেষ অবধি।
“রাই প্লিজ এভাবে আমার চোখের সামনে নিজেকে শেষ করে দিসনা।আমার কথাটা অন্তত একটু ভাব।প্লিজ কো-অপারেট কর রণর সাথে।ঋষি তোকে তখনই সম্পূর্ণ সুস্থ করতে পারবে যখন তুই ওর কথাগুলো মানবি,যখন রণকে তোর মনটা সুস্থ করার সুযোগ দিবি,আমার কথা শোন।চল দুদিন সবাই মিলে ঘুরে আসি।ভগবান আমি কখনো মানিনি তুই জানিস,কিন্তু এখন এই বয়সে এসে আর মানসিক চাপ নিতে পারিনা।খুব ইচ্ছা করে কোনো অদেখা শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দি,আমার সমস্যা গুলো সঁপে দি তাকে,”রাইয়ের বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিয়ে বলেছিল জয়ন্ত।
আর জেদ ধরে রাখতে পারেনি রাই।শুধু এই মানুষটার ওপর ও চেয়েও অভিমান করতে পারেনি,একটা মায়া আটকে দিয়েছিল ওকে।
বাবার কথা রেখে এই চেঞ্জ -ট্যুরে এলেও রণর সাথে দূরত্ব মুছতে পারেনি রাই এখনো,অপারেশনের তিনমাস পরেও রণ ওর কাছে বিনা দোষে দোষী হয়েই রয়ে গেছে।ওর মনেও পরেনি রণর রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে এতদিনে,কিন্তু ও রাইকে ছেড়ে যাবেনা বলে ছেড়ে দিয়েছে ওর এবছরের ভালো কলেজে চান্স পাওয়ার সুযোগটা।
রাই কথা না বলে ফলের প্লেটটা নিয়ে চুপচাপ ফল খেতে থাকে।রণ বুঝতে পারে এখানে এসেও রাই ওকে দূরে ঠেলেই রাখবে,কথা বলার আশা নেই বুঝে ও চুপচাপ সরে যায়।
“আমি একটু বেরোচ্ছি”,মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রণ বেরিয়ে যায় ওদের ঘর ছেড়ে।রাই ফিরে না তাকালেও দরজা টানার আওয়াজে বুঝতে পারে সত্যি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে রণ।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রাইয়ের ভেতর থেকে।

রণ আজকাল রাইয়ের মতোই চুপচাপ হয়ে গেছে।রাইয়ের অপারেশনের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় তিনমাস,রণ হসপিটালে যতক্ষন থাকে রাইয়ের আজও মন খারাপ করে রণর জন্যে।ও আবার নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পড়াশোনা শুরু করেছে।এই শরীরে খুব বেশি পড়তে পারেনা,তাও যতক্ষন শরীর টানে ব্যস্ত রাখে নিজেকে নিজের জগতে।
রণ বেরিয়ে যেতে রাই এর নিজেকে খুব একা লাগে।তাড়াতাড়ি ফল খাওয়া শেষ করে ধীরেধীরে উঠে গিয়ে একটা বই এনে বসে আগের জায়গায়।এলোমেলো মনটা গুছিয়ে নিয়ে বইতে ডুবিয়ে দিতে আজ একটু বেশিই সময় লাগে।কিন্তু দুর্বল শরীর বেশিক্ষন সহযোগিতা করে না বইয়ের জগতে ডুবে থাকতে।ক্লান্ত হয়ে আরাম কেদারায় এক সময় শরীর এলিয়ে দেয় রাই,তলিয়ে যায় ঘুমের জগতে।
ঘুম ভাঙে এক ঠান্ডা হাতের স্পর্শে।আস্তে আস্তে চোখ মেলে যখন হাতের মানুষটার মুখ স্পষ্ট হয় ঘোরের মধ্যেই মৃদু হাসে রাই।
“আঙ্কেল তুমি?” ঋষির হাসিমুখের জবাবে রাই মৃদু স্বরে প্রশ্ন করে।
“হমম।গল্প করতে এসে দেখি অসময়ে ঘুমোচ্ছিস তুই।তাই ডেকে দিলাম।শরীর খারাপ লাগছে নাকি রে?” ঋষি হালকা চালেই বলে কথাটা।
-“না আঙ্কেল,আসলে ক্লান্তি তো সারাক্ষণ সঙ্গী।বসো না।” রাই ওর পাশের চেয়ারটা দেখায়।
-“রণ কোথায় রে?” ঘরে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন কিরে ঋষি।
-“ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে অনেক্ষন।” অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিলো রাই ভাবে ‘আমি তো ভেবেছিলাম তোমাদের সাথেই হয়তো আছে’।
-“হমম।তোকে কটা কথা বলতে এসেছিলাম মা।জানি না তুই কিভাবে নিবি?” মাথা নিচু করে ঋষি কিন্তু কিন্তু করে কথা দুটো বলে।
-“আঙ্কেল রণ তোমাদের সাথেই আছে তো?” ঋষির কথা শুনেও সেটার উত্তর দেওয়ার আগে রণর জন্যে উৎকণ্ঠা লুকোতে পারেনা রাই।
ঋষির মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে।রাইয়ের সাথে যে কথাগুলো বলতে এসেছিল,যথেষ্ট টেনশনে ছিল ও,হঠাৎ কথাগুলো বলাটা খুব সহজ মনে হয়।
মুখ তুলে হাসি মুখে তাকায় রাইয়ের দিকে,”এত যখন ভালোবাসিস তাহলে কেন ওকে বুঝতে চাইছিস না রাই?”ঋষির মুখে এরকম কথা আশা করেনি আপাত শান্ত মুখচোরা মেয়েটা,তাই সেই মুহূর্তে কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে চুপ করে নখ খুটতে থাকে।
“জানিস রাই অঙ্কলজিস্টদের জীবন খুব ট্র্যাজিক।আমাদের জীবন অন্য ডাক্তারদের জীবন থেকে অনেকটা আলাদা। আমাদের দেশে আজও এই রোগে সুস্থ হওয়ার হার কম,তাই প্রচুর প্রচুর মৃত্যু দেখি আমরা।জানিস আমাদের ওপর পেশেন্টের বাড়ির লোককে খুব বেশি নির্ভর করতে হয়,কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেশেন্টের হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমাদের,অপারেশন থিয়েটারেই।…শরীরে ছুরি কাঁচি চালানোর পর প্রকৃত সত্য জানা যায়।অনেক সময় এমন কন্ডিশন হয়,সার্জারি করে লাভ হবেনা বুঝে ওপেন করেও শরীরের ভিতরে ছুরি কাঁচি ঠেকাইনা আর।আর যদি অপারেট করা পসিবল হয়,তাহলে কতটা কি করবো সেটাও নিজেদেরই ডিসিশন নিতে হয় সেই মুহূর্তে।পেশেন্ট কেন,তার বাড়ির লোকও জানতে পারেনা কতটা কি বাদ যাবে শরীর থেকে”,এতটা বলে চুপ করে ঢোঁক গেলে ঋষি।চোখ বুলিয়ে দেখে দূরে বেড সাইট টেবিলে জলের জগ আর গ্লাস রাখা।রাইকে,”দাঁড়া আসছি”,বলে উঠে গিয়ে গ্লাসে জল নিয়ে ফিরে এসে আগের জায়গায় বসে ঋষি।
দু ঢোঁক জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে আবার শুরু করে,”রণর জায়গায় আমি থাকলে হয়তো…হয়তো ওভারি ইউট্রাস রেখে অপারেট করতাম,তোর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে।কিন্তু আমার ছেলে তোর ছাড়া আর কারোর কথা ভাবেনি।কেন বলতো?”
রাই বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে ঋষির মুখে রাখে,চোখে ওর তখন জল প্রায় ভরে এসেছে।
“কারণ তোর বেবির অপেক্ষায় রোগটা ছড়িয়ে পড়তে পারতো,এই শরীরের অবস্থায় বাচ্ছা ক্যারি করা এই মুহূর্তে সম্ভব হতনা,বদলে রোগটা ছড়ালে নতুন করে আবার তোর শরীরে কাঁটা ছেঁড়া করতে হত।এখন রণ যে কাজটা করেছে,সেটা তখন করতে হত।এবার বল তাতে কি লাভ হত?” ঋষি পুরোটা বলে একটা জোরে শ্বাস টেনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,কিন্তু চোখ রাইয়ের মুখ থেকে সরেনা।
চোখ নামিয়ে দেয় রাই,তারপর খুব ক্ষীণ স্বরে বলে,”হয়তো আমি সময় পেতাম আঙ্কেল।রোগটা ফেরার আগেই কনসিভ করতাম,বেবি হত।”
“রাই অতই কি সোজা সবটা?তোর শরীর কনসিভ করার জন্যে রেডি হতে একবছরের বেশি লাগতো।আর এই রোগের ক্ষেত্রে কোনো সময়ের নির্দিষ্ট গ্যাপ নেই,তাই ফিরে আসবে ধরে নিতেই হত তোকে”।
চুপ করে থাকে রাই,কিন্তু ওর মুখ দেখে বুঝতে পারে ঋষি, মানতে পারছে না ও ঋষির যুক্তিটা।
“রাই আমি একজন বাবা হয়ে,একজন পুরুষ হয়ে আজ তোকে একটা কথা বলি,একজন মেয়ের কাছে মা হওয়াটা যতটা আনন্দের,একজন ছেলের কাছেও তাই।আর…হতে না পারার দুঃখও দুজনের সমান।রণর কষ্টটা হয়তো আর পাঁচজন দেখতে পায়না,কিন্তু তুইও কি বুঝতে পারছিস না ওর মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কষ্টটা?সেই কষ্ট যত না নিজের জন্যে,তার চেয়েও বেশি তোর জন্যে।অপারেশন থিয়েটারে ওর কান্নাটা সবার থেকে লুকোলেও নিজের বাবাকে কি লুকোতে পারে বল! তারওপর তোর অবজ্ঞা শেষ করে দিচ্ছে ওকে”।
রাই কিছু বলতে পারেনা।ও নিজেও জানে,রণকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে ও।কিন্তু নিজের কষ্টের কাছে ওরটা এতোদিন তুচ্ছ মনে হয়েছে আসলে।
হঠাৎ চোখ থেকে অজানা কারণে জল গড়িয়ে পড়ে। মুছতে ইচ্ছা না করলেও স্বাভাবিক অভ্যাসে হাত উঠে যায় গালে।নিজের চোখের জল মোছার বদলে হঠাৎ হুহু করে ওঠে বুকটা। রণকে জড়িয়ে কান্নার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে মনের মধ্যে।
ঋষি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে হাত রাখে রাইয়ের মাথায়,চুপচাপ হাত বুলিয়ে দেয়।নিজের বাবার কোমর জড়িয়ে যেমন কাঁদে রাইমা অন্য সময়ে,সেরকম ঋষির কোমরটা জড়িয়ে বুকে মুখ গুঁজে ডুগরে ওঠে।
ঋষি কিছু বলেনা,ধীরে ধীরে রাইয়ের প্রায় চুলহীন মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে মেয়েটাকে।

নিজেদের বেডরুমে জিরো পাওয়ারের আলোটা জ্বেলে চুপ করে শুয়েছিল রাই, ঘড়ির কাঁটা রাত ন’টা।
রণ সেই বিকেলে বেরিয়েছে এখনো ফেরেনি,ফোন ধরেছিল জয়ির,বলেছিল ফিরতে দেরি হবে।
রাইয়ের অভিমানটা আবার যখন গাঢ় হচ্ছে তখনই বুঝতে পারলো ঘরের দরজা খুলে কেউ ঢুকেছে,সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করলো ও।
রণ ঘরে ঢুকে সোজা ওর বিছানার সামনে এসে দাঁড়ালো।রাই ঘুমোচ্ছে দেখে ওর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল।জেগে থাকলে আজকাল কাছে আসতে দেয়না তো,তাই ঘুমলে একটু আদর করে রণ ওর ডল কে।মনে মনে ভাবে,’জানিনা কবে বুঝবি আমায়,কবে ক্ষমা করবি?’
ঘুরে কাবার্ডের দিকে এগোতে যাবে,হাতে টান পরে ওর।চকিতে ঘুরে তাকায়।
দেখে রাই হাতটা ধরে চোখ বুজে আছে।থমকে যায় রণ।ঠিক দেখছে তো?বসে পরে রাইয়ের বিছানার একপাশে,অপলকে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।বুঝতে পারে কিছু বলে চায় মেয়েটা,হয়তো শুনতেও চায় ওর কথা।উত্তেজনায় হার্টবিট দ্রুত হয়ে যায় রণর।এই একজনের জন্যেই তো ওর পুরো দুনিয়া চলে,এ মুখ ঘুরিয়ে নিলে বাকি দুনিয়াও যেন থেমে যায় ওর কাছে।
“কোথায় ছিলে এতক্ষন?” চোখ বুজেই জানতে চায় রাইমা,স্বর খুবই ক্ষীণ।
“সমুদ্রের ধারে বসেছিলাম চুপ করে”,রণ ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বলে।সারাজীবন তাকিয়েও যে এই দেখার আশ মেটেনা ওর।
এবার চোখ খুলে তাকায় রাইমা,এত বছর পরও ওই দুটো চোখে দেখতে পায় পাগল করা ভালোবাসা।কি করে এত ভালোবাসতে পারে ছেলেটা,কি আছে আর ওর ভালোবাসার মত।আবার হতাশা ফিরে আসতে চায় ওর মনে।ওর জন্যেই তো ছেলেটার জীবনও বরবাদ হয়ে গেল,কত সোজা হতে পারতো জীবনটা।কি পেলো জীবনে ও!
আবার চোখ বুজে ফেলে রাই, বন্ধ চোখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে জল,চোখের কোন দিয়ে গড়িয়ে পড়ে।
“রাই প্লিজ আর আমায় তোর এই কান্নাভেজা মুখটা দেখাসনা।আমি ভুল করেছি,কিন্তু আর আমায় শাস্তি দিসনা”,ককিয়ে ওঠে রণ রাইকে আবার কাঁদতে দেখে।
আবার জল ভরা চোখে তাকায় রাইমা,”ভুল করেছো! নাহলে কি করতে? কি করার ছিল তোমার বলো?”
আবার থমকায় রণ,সত্যি তো ওর করার তো কিছুই ছিলোনা।রাই বুঝেছে তাহলে?
“তাহলে কেন মুখ ঘুরিয়ে আছিস বল? কেন নিজে কষ্ট পাচ্ছিস আর আমাকেও তার কয়েকগুণ বেশি কষ্ট দিচ্ছিস বল?”রণ আকুল ভাবে বলে।আর কেউই হয়তো শোনেনি এতটা আকুল হতে পারে ডাক্তার রণজয় মুখার্জীর গলা।

চুপ করে নিজের হাতের মুঠোয় ধরে থাকা রণর হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকে রাই কয়েক সেকেন্ড।তারপর হাতটা জোরে চেপে ধরে,আঙুলে আঙুল শক্ত করে ভরে দিয়ে খুব ক্লান্ত স্বরে কেটে কেটে বলে,”আমার একটা কথা রাখবে রণ?আমি তাহলে আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবো।হাসবো, ভালো থাকবো, রাখবে বলো?”
“বলনা রাই? তোর কোন কথা আমি ফেলেছি বল? তোকে হ্যাপি দেখতে আমি সব করতে পারি।শুধু তুই ভালো থাক, তোর হাসিটা ফিরিয়ে দে আমায়”,রণ আর একটা হাত দিয়ে ওদের দুজনের হাত চেপে ধরে।
চুপ করে কিছু ভাবে রাই।তারপর দাঁতে দাঁত চিপে বলে,”আবার নতুন করে জীবনটা শুরু করো রণ।আমি জানি আমি মরবো না।তুমি আমাকে মরতে দেবেনা।তাই আমি বেঁচে থাকতেই নতুন করে জীবনটা শুরু করো।পরিপূর্ণ দেখতে চাই আমি তোমায়।আমার থেকে তো কিছুই পাওয়ার নেই আর।কিন্তু তোমার জীবনটা ভরে গেলে আমি অন্তত একটু শান্তি পাবো।সারাক্ষন তিলে তিলে মরতে হবে না আমায়”।
তাকিয়ে থাকে রণ রাইয়ের মুখের দিকে।রাতে ফিরে রাইয়ের খাওয়া হয়ে গেছে শুনে একেবারে ডিনার করেই ঢুকেছিলো ও ঘরে।বাইরের জামা প্যান্ট টা শুধু ছাড়া হয়নি,যা ও সচরাচর রাইয়ের কাছে আসার সময় করেনা।আজ রাইকে একবার দেখে ওয়াশরুমে গিয়েই ঢুকবে ভেবেছিল,কিন্তু…
“ঠিক আছে তাই হবে।তুই খুশি থাকলে আমি তাই করবো”,কথাগুলো মুখে বললেও নিজের চোখ রাইয়ের চোখ থেকে সরায় না ও।
“আমি খুশি হবো কিনা জানিনা।তবে শান্তি পাবো।শান্তি পাবো এই ভেবে আমার জন্যে তোমার জীবনটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল না অন্তত।আমার জন্যে তুমিও বঞ্চিত হলে না সবকিছু থেকে”,রাই চোখটা সরিয়ে নেয় রণর চোখ থেকে।
রাই চোখ সরিয়ে নিতেই হেসে ফেলে রণ।
“হাসছো যে?” রাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে।

“কিছু না।তুই একটু শুয়ে রেস্ট নে।আমি ফ্রেস হয়ে চেঞ্জ করে আসছি”,রাইয়ের হাত থেকে নিজের হাতটা আলতো করে ছাড়িয়ে নিজের মনেই হাসতে হাসতে উঠে যায় রণজয়।
কাবার্ড খুলে ট্রলি বের করে রাতে পরার টিশার্ট আর শর্টস বের করে একবার ফিরে তাকায় রাইয়ের দিকে।ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে মেয়েটা,চেষ্টা করছে ওর মনটা পড়ার,আবার দুষ্টু হাসি ঠোঁটে মেখে চলে যায় রণ ওয়াশরুমে।
হঠাৎ রাইয়ের মনটা অকারণে খারাপ হয়ে যায়।কেন বুঝেও বুঝতে চায়না ও।রণর হাসিটা বড্ড বিরক্তিকর লাগে,কি ভাবে ও ওকে!!হাসির পাত্রী নাকি ও!
গায়ের চাদরটা টেনে মাথা ঢেকে নেয় রাই।
রণর প্রতি অভিমান বিরোক্তিতে বদলে যায় কয়েকমুহূর্তেই। চোখবুজে ঘুমিয়ে পড়তে চায়,এড়িয়ে যেতে চায় রণকে।

মিনিট দশেক পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রণ বুঝতে পারে রাই ঘুমিয়ে পরেছে, বা ভান করে আছে ঘুমোনোর।চাদরের আড়াল থেকে শুধু বেরিয়ে আছে কপালের ওপরের অংশটা।
রাই আবার রেগেছে, কিন্তু এই রাগ সেই পুরোনো রাইয়ের রাগের মতই বুঝতে অসুবিধা হয়না ওর।উল্টে নিজের রাইকে ফিরে পেয়ে মনটা ভালো হয়ে যায়।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা ঠিক করে নিয়ে বিছানায় এসে বসে ও।রাইয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে আবার নিজের মনে হাসে একবার,কপালে আলতো করে ঠোঁট ঠেকায় আর অস্ফুটে বলে, “পাগলী আমার”।
ঠিক সেই মুহূর্তে রাই নিজের শরীরের সব জোর এক করে রণর দিকে ঘুরে নিজের দুটো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রণর গলা,ওর বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ওঠে।
আর পারেনা রণ নিজেকে সামলাতে,রাইয়ের শরীরের কারণে সমস্ত বাধা নিষেধ দূরে সরিয়ে রেখে ওর মুখটা তুলে ধরে চোখের সামনে,নিজের ঠোঁট দিয়ে প্রবল আশ্লেষে কামড়ে ধরে রাইয়ের ঠোঁটটা।ভিজতে থাকে দুটো ঠোঁট একে অপরের মধ্যে।

ক্রমশ…