মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
1137

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#অন্তিম_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“আয় আয় রণ,রাই এখানে বোস মা”,লনে সকালের চায়ের আসরে রণ রাইয়ের হাত ধরে নিয়ে আসছে দেখে সবার মন খুশিতে ভরে ওঠে।জয়ি উঠে দাঁড়িয়ে রাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে কথাগুলো বললেও একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে ঋষি।মনে মনে ভাবে আরো আগে ওর কথাগুলো বলা হয়তো দরকার ছিল।আসলে ও ভেবেছিল রণ বুঝিয়ে নিতে পারবে রাইকে,কিন্তু যখন বুঝলো হেরে যাচ্ছে ওর ছেলে রাইকে বোঝাতে,নিজেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল অভিজ্ঞ ঋষি।সত্যিটা সহজ ভাষায় বলে এসেছিল রাইকে।
“রণ কাল কখন ফিরলি তুই?” রণ ফেরার আগেই কাল জয়ন্ত শুতে চলে গিয়েছিল শরীরটা ভালো লাগছিল না বলে।
“ওই তো পৌনে নটা নাগাদ”,চায়ের কাপে চুমুক দেয় রণ।
“রাই ব্রেকফাস্টে কি খাবি বল?”জয়ি রাইয়ের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে।
রাই কিছু বলার আগেই রণ বলে,”মম আমি ওকে নিয়ে একটু বেরোচ্ছি,সমুদ্রের ধারে নিয়ে যাবো।আজ ম্যাডামের একটু ঘোরার ইচ্ছে হয়েছে।কোনো রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করবো ভাবছি।তোমরাও চলো না প্লিজ”,রণ মুখে বললেও জয়ি,ঋষি বা জয়ন্তর বুঝতে অসুবিধা হয়না দুজনে একটু সময় কাটাতে চায় ওরা।তাই জয়ি কিছু বলার আগেই উত্তর দেয় ঋষি,”না রে রণ,আজ তোর মম একটু মন্দিরে যাবে বলেছিল।আর আমি একা কেন ‘বলির পাঁঠা’ হবো,তাই জয়কেও দলে ভিড়িয়েছি”।
ঋষির কথা শেষ হতে রাই অবাক চোখে তাকায় জয়ন্তর দিকে,’বাবা সত্যি মন্দিরে যাবে?’
রাইয়ের চোখে চোখ পড়তে মৃদু হাসে জয়ন্ত।উঠে এসে বসে রাইয়ের পাশের ফাঁকা চেয়ারে,তারপর হালকা হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“মা কেমন লাগছে শরীরটা এখানে এসে? যা একটু ঘুরে আয়।কাল শরীর ঠিক থাকলে একবার মন্দিরে ঘুরিয়ে আনবো”, জয়ন্তর কথার ধরণ বয়সের সাথে সাথে যে বদলেছে আজকাল রাই অনুভব করে।কোথায় যেন আগের ডাক্তার জয়ন্ত চ্যাটার্জী কে একেবারেই খুঁজে পায়না রাই।বিশেষ করে ওর এই দ্বিতীয়বার অসুস্থ হওয়ার পর থেকে জয়ন্তর মধ্যে একজন অসহায় বাবা কেই দেখতে পায় খালি।
রণ রাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠে একবার পিছনের কাঁচ দিয়ে তিনজন বয়স্ক মানুষকে দেখে।
মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে দেখে রাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।লাল স্কার্ফে মাথাটা মুড়ে বেরিয়েছে আজ ও।কিন্তু চোখ দুটোতে আজ আর অতটা বিষণ্ণতা বা ক্লান্তি কোনোটাই তেমন নেই।গতকাল রাতে দুজনে আগের মত ভেসে যেতে পারেনি,হয়তো এই মুহূর্তে সেটা সম্ভবও না।কিন্তু গত চারমাসের পুরোপুরি দূরে থাকাটা কাল আর হয়নি।দুজনে দুজনের মধ্যে সাময়িক হলেও হারিয়েছে,একে অপরকে জড়িয়ে থেকেছে সারারাত।কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি,অভিমানের প্রকাশ বা নিজের হয়ে সাফাই কিছুই ছিলোনা ওদের মাঝে।শুধুই ছিল শান্তির ঘুম।রণর বুকে মাথা রেখে রাই ঘুমিয়েছে অকাতরে,আর রাইকে জড়িয়ে শেষ চারমাসের মধ্যে প্রথম রণ ঘুমিয়েছে নিশ্চিন্তে।ওর বুকের ওপর রাইয়ের বুকের ওঠানামা ওকে চিন্তামুক্ত রেখেছিল,রাতে বারবার উঠে রাইকে পর্যবেক্ষণ করার দরকার পড়েনি,খেয়াল করতে হয়নি ওর স্বাভাবিক শ্বাস পড়ছে কিনা! রণ তাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে অনেক মাস পর।
কাল সমুদ্রের ধারে বসে রণ কিকরে এতটা সময় কাটিয়ে ফেললো নিজেও জানেনা।ফোনটা সাইলেন্ট করতে পারেনি শুধু রাইয়ের চিন্তায়,কিন্তু বেশিরভাগ কলই বেজে বেজে কেটে গেছে।কাল মনেহয় শীর্ষাও একবার কল করেছিল।আজ সময় পেলে একবার ফোন করে নেবে নাহয়।
রাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো রণ,’কি হলো?’

“কি দেখলে মুখ ঘুরিয়ে?” সহজ গলায় প্রশ্ন করলো রাই।
একটা মায়াময় হাসি হাসলো রণ,এই হাসিতে করুন রস থাকলেও একটা মন ভালো করার ছোঁয়াও আছে।হাসি ঠোঁটে নিয়ে বললো,”অনেকদিন পর মানুষগুলোকে একটু নিশ্চিন্ত দেখলাম।খুশি দেখলাম চোখে।তাই আরেকবার কনফার্ম হচ্ছিলাম ঠিক দেখলাম তো?”
“আজকাল সাহিত্য চর্চা করছো নাকি?” অনেকদিন পর রাইয়ের মুখও সরল হাসিতে ভরে গেল।সেই হাসি পৌঁছে গেল ওর চোখের তারা অবধি।
রণর হাসিও চওড়া হলো,”পরিবেশের দোষ।ঘরের মধ্যে একজন সারাক্ষন সাহিত্যে ডুবে থাকলে ছোঁয়া লাগা তো স্বাভাবিক।”
“মজা করছো?” রাই ছদ্ম গাম্ভীর্য দেখালো।
হাসিটা আরো ছড়িয়ে রণ উত্তর দিলো,”সত্যি বলছি।” তারপর ভাস্করের চোখ এড়িয়ে রাইয়ের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললো,”খুব ভালো লাগছে রে রাই।তোকে তোর জগতে ব্যস্ত দেখতে খুব ভালো লাগে আমার”।
চুপ করে রাই মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে তাকায়।আজ ওর রণকে অনেক কথা বলার আছে,তবে ভাস্করদার সামনে না।অপেক্ষা করতে থাকে রাই সমুদ্র সৈকতের জন্যে।

কলকাতায় নিজের মেয়েবেলার ঘরের ঢাকা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল শীর্ষা।সারাদিনের রোদের তেজে প্রকৃতি পোড়ার পর এখন সন্ধ্যের মুখে যে হাওয়া টা বইছে তাতে আরাম নাহলেও কষ্ট বিশেষ হচ্ছেনা।এসময় রণদের ছাদের মত বড় ছাদে হেঁটে বেড়াতে মন করে ওর আজও।প্রথম যখন ওই ছাদে উঠেছিল,অবচেতনে এক গভীর স্বপ্ন ছিল,আর সেই স্বপ্ন আর একটা স্বপ্ন তৈরি করেছিল কল্পনায়…ওই ছাদটা কোনো অদূর ভবিষ্যতে ওর নিজের ছাদ হবে।
দুটো স্বপ্নের কোনোটাই পূরণ হয়নি।একটা সরল চোখের মেয়ে ওর স্বপ্নটা আগেই নিজের করে রেখেছিল।না ঠিক ওই মেয়েটা করেনি,ছেলেটা স্বপ্নটা দিয়ে রেখেছিলো ওকে।
রাইকে শীষ কোনোদিন অপছন্দ করেনি,আবার ভালোবাসতে পারেনি এটাও সত্যি। ওর রোগের কথায় মন খারাপ হলেও দুঃখে কাতর ও হতে পারেনি।বরঞ্চ রণর মন খারাপ ভেবে খারাপ লাগাটা বেশি ছিল।
আজও রাইয়ের চেয়ে রণর জন্যে কষ্ট বেশি হয় ওর। নিজের প্রাপ্য টুকুও জীবনে পেলোনা বেচারা।
তবে ভালোবাসা এরকমই হয় হয়তো।ওর আর শিবরাজের সম্পর্কটা ভালোবাসার থেকেও বেশি ছিল প্রয়োজনের।রণকে রাইয়ের হতে দেখার পর ওর ফাঁকা মনের জন্যে দরকার ছিল রাজের মত কাউকে,আবার নিজের পরিবারে ব্যবহার হয়েও গুরুত্ব না পাওয়া রাজের দরকার ছিল ওর মত কোন মেয়েকে।কিন্তু ওদের মধ্যবিত্ত মানসিকতায় শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাওয়া সম্পর্ক থেকে বেরোতে পারছিল না ওরা কিছুতে।তাই পরিবার ছেড়ে চলেও এসেছিল রাজ ওর সাথে।কিন্তু কোথায় গিয়ে যেন ঠিক শান্তি পাচ্ছিল না ও,আর সেটা বুঝতে পারছিল শীর্ষা।তাই হয়তো…দিনটা স্পষ্ট মনে আছে শীষের,যেদিন শিবরাজকে কথাটা সরাসরি বলেছিল ও।

“চলে যা রাজ তুই তোর পরিবারের কাছে”,ঝগড়া করার সময় কোনো কমন ভাষা ওরা ব্যবহার করতো না।দুজনেই যে যার মাতৃভাষায় বলতো,তবে অপরজন বুঝতে পারতো একে অপরের ভাষা।
-“আচ্ছা!! মেরে চালে জানে কে বাদ তু ক্যা কারেগি? ফির রিলেশন বানায়েগি,শাদি কারেগি।বোল?”
-“আমার কথা তোকে ভাবতে হবে না।তুই নিজের টুকু ভাব।ভালো তো তুই নেই,দেখতেই পাই আমি।এভাবে জীবন কাটানো সম্ভব না।ফিরে যা তুই”।
ওর এই কথাটার পর চুপ করে ছিলো রাজ।কোনো উত্তর দেয়নি।তখনই শীর্ষা বুঝেছিলো ও এতদিন বুঝেও যেটা বুঝতে চায়নি আসলে সেটাই সত্যি,ভালো নেই রাজ ওর সাথে।চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইলেও দাঁতে দাঁত চিপে আটকে রেখেছিলো সেটা।
শিবরাজও কথা না বাড়িয়ে ওই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল।

শিবরাজ শীর্ষার কথা শুনে গুম মেরে ছিল একদিন।তারপর পরের দিন হসপিটাল থেকে ফিরে শীর্ষা ফ্ল্যাটের দরজা লক পেয়েছিল।নিজের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ফ্ল্যাট খুলে ভেতরে ঢুকে একটু হতাশাই ঘিরে ধরেছিল ওকে,সঙ্গে একটা অজানা ভয়,আবার প্রিয় কাউকে হারাবার ভয়।আর ওর ভয় সত্যি হয়েছিল যখন ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় স্টিকি পেপার নোট পেয়েছিল।
নোটটা হিন্দিতে লেখা,যার বাংলা করলে দাঁড়ায়,”তুই ঠিক বলেছিলিস শীর্ষা।আমি ভালো নেই,প্রতি মুহূর্তে বিবেকের কামড় খেয়ে খেয়ে ক্লান্ত আমি।নিজের মা বাবাকে এই বয়সে ত্যাগ করে আসার যন্ত্রনায় প্রতি নিয়ত ক্ষতবিক্ষত হই আমি।আমি তাই কদিন সময় নিলাম।সাতদিনের মধ্যে না ফিরলে ভুলে যাস তুই আমায়।তোর রাজ”।
চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করেছিল শীর্ষার কিন্তু পারেনি।কান্নাটা কে গিলতেও পারেনি এই ফাঁকা ফ্ল্যাটে।দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল জল।

“শীষ কিরে চা খাবি আয়।তুই না গেলে ছেলেটা খাবে না জানিস তো।তোর বাবাও বসে আছে”,ঘরের দরজা খুলে মুখ বাড়ায় শীর্ষার মা,হঠাৎ মায়ের গলার স্বরে ঘোর কেটে চমকে ওঠে শীর্ষা।
“আর হ্যাঁ সাতটা নাগাদ ক্যাটারারের লোক আসবে।ফ্রি রাখবি ওই সময়টা।কোনো কল নিসনা যেন পেশেন্টের”।
মায়ের কথা শুনে হেসে ঘাড় নেড়ে শীর্ষা বলে,”তুমি চলো।আমি পাঁচ মিনিটে আসছি”।
হাসি ফেরত দিয়ে দরজা টেনে বেরিয়ে যায় ওর মা।

শীর্ষার বিয়ে একমাসের মধ্যেই।দিল্লি পুরোপুরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসেছে ও শিবরাজ চলে যাওয়ার সাতদিনের মধ্যে।কিছু না ভেবেই,কোনো চাকরি জোগাড় না করেই দিল্লির হসপিটালে রেজিগনেশন লেটার দিয়েছিল ও দুদিনের মধ্যেই,হারিয়ে যেতে চেয়েছিল ও ওই শহর থেকে।

এখানকার এক নামকরা হসপিটালের সাথে কথা চলছে,যদি ওই চাকরিটা শেষ অবধি পছন্দ নাহয় নিজের বাবার সাথে মিলে নার্সিং হোম শুরু করবে ও,সাথে থাকবে ওই ছেলেটা যার সাথে ওর বিয়ে।এই ছেলেটার ভালোবাসা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই শীর্ষার মনে।আগুনে পোড়া খাঁটি সোনা যে।
“আবে শীষ চায়ে ঠান্ডি হো রাহি হ্যায়, আ না জালদি”,নিচ থেকে শিবরাজের গলার আওয়াজ শুনতে পায় শীর্ষা।নিজের মনে একটা শান্তির হাসি হেসে সাড়া দেয়,”আ রেহি হুঁ”।
ফিরে এসেছিল শিবরাজ যেদিন শীর্ষা দিল্লি ছাড়বে।ওর বাড়ি পুরোপুরি ছেড়ে,মন থেকে সব কিছু ভুলে, মা বাবাকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে,আর তাদের অবজ্ঞা অবহেলা নিয়ে ফিরে এসেছিল ও।
ও একটা মেয়ের ফ্ল্যাটে এক ছাদের তলায় এক ঘরে থেকেছে…মেনে নেয়নি ওর বাড়ি।ওকে অনেক ছোট বড় কথা শুনিয়েছিলো।সব শুনেও কিছুদিন থেকে ও চেষ্টা করেছিল ওর বাড়ির লোকের মন পেতে।তাদের বোঝাতে চেয়েছিল শীর্ষা ওর জীবনে কি,কিন্তু পারেনি।

“চলে এলি এখন জেদ করে, পরে আবার হতাশায় ভুগবি।ডিপ্রেসড থাকবি দিনের পর দিন”,শীর্ষা ঠান্ডা গলায় বলেছিল,নিজের মনের খুশি আড়ালে রেখেই।
চুপ করে ছিলো শিবরাজ কিছুক্ষন।তারপর সামনের সোফা সেট ছেড়ে উঠে এসে শীর্ষার সোফায় ওর পাশে বসেছিল।ওর কোমরটা এক হাতে জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রেখেছিলো আস্তে আস্তে।
“এ যো প্যার তুজসে মুঝে মিলতা হ্যায়, অর কিসিসে মিলেগি ক্য? মেরে ঘরওয়ালে কে পাস পইসে বহুত হ্যা, লেকিন দিল নেহি।নেহি রেহ পায়ুঙ্গা ম্য তেরে বিনা”।
আর কিছু বলেনি ও,শীর্ষাও কিছু বলতে পারেনি।শিবরাজ কলকাতা ফেরার প্রশ্নে শুধু মজা করে বলেছিল,”কিছু জামা কাপড় কিনে দিস আমায়”।
হেসে ফেলেছিল শীর্ষা।
দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দূর থেকে তাকিয়েছিল শীষ ওর বাবা মা আর শিবরাজের দিকে।
একজীবনে হয়তো সবকিছু একসাথে পাওয়া হয়না।ওর সংস্কার ওকে প্রথম প্রথম অস্বস্তিতে রাখতো ওদের বাড়িতে রাজ কিভাবে থাকবে,ওর অসুবিধা হবে কিনা।কিন্তু সারাজীবন একটা পরিবারের ভালোবাসা চাওয়া শিবরাজ খুব ভালোভাবে মিশে গেছিল ওর বাবা মার সাথে,যারা নিজেরাও আত্মীয় বা সমাজের কথা চিন্তা না করে খুব বেশি আপন করে নিয়েছিল শিবরাজ কে।
ওর বাবার পরামর্শেই শীর্ষা কিছুটা দূরে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে,বিয়ের পর দুজনে থাকবে বলে,আর নার্সিং হোমের কথাও ভাবছে শিবরাজের জন্যে।ও জানে এই দায়িত্বটা ওই ছেলেটা খুব দক্ষতার সাথেই সামলাতে পারবে।

“দেখ রাই সমুদ্রের ঢেউ গুলো কেমন পারে এসে আছড়ে পড়ছে।জানিস কাল যখন এখানে বসেছিলাম দেখি জেলে বস্তির একটা বাচ্ছা একদম জলের ধারে চলে গেছে।একটা ঢেউ আছড়ে পড়লে হয়তো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।আমি উঠে দৌড়তো যাবো দেখি আমার চেয়ে অল্প বয়সী একটা ছেলে চোখের পলকে ছুটে গিয়ে সরিয়ে নিলো।নিজের মনের মধ্যে আমার কাল একটা ঝড় বইছিল,মনে হচ্ছিল আর কোনোদিন তোকে বোঝাতে পারবো না…অসহ্য লাগছিলো সব কিছু।মনটা ডাইভার্ট করতে উঠে ছেলেটার কাছে গিয়ে যেচে আলাপ করলাম।হয়তো ভগবান পাঠিয়ে দিয়েছিল ওকে আমার কাছে।ছেলেটার নাম অর্ণব,অর্ণব সেনাপতি।ও একটা এনজিও র সাথে যুক্ত।তাদের মেইন অফিস কলকাতায় হলেও এই পুরীতে একটা ব্রাঞ্চ আছে।এদের পুরীর ব্রাঞ্চ দেখাশোনা করে একটা অনাথ আশ্রমের”,এতটা বলে রণ থামে।ভালো করে তাকায় রাইয়ের দিকে।বুঝতে চেষ্টা করে ওর অনুভূতিটা।কিন্তু কিছুই বোধগম্য হয়না।
এই মেয়েটাই একটু আগে ফোনে শীর্ষা আর শিবরাজের বিয়ের কথা শুনে বাচ্ছা মেয়ের মত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল, আর এখন নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় একদম নিশ্চুপ।
রণ কিছু বুঝতে না পেরে কিছুক্ষন চুপ থাকে।কিন্তু রাই যেচে উৎসাহ দেখাচ্ছে না দেখে সাহস করে বলে ফেলে,”যাবি রাই আজ সেই আশ্রমে?”
কিছু যেন ভাবে রাইমা।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”কাল রাতে আমার কথাটা সিরিয়াসলি নাওনি না?”
“কোন কথাটা?” অবাক হয় রণ।
“আবার নতুন করে তোমার জীবন শুরুর কথা”,ক্লান্ত গলায় বলে রাই।
চুপ করে যায় রণ।যেন নিজের গলা ফাটিয়ে বলতে চাওয়ার ইচ্ছাটা সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজে চেপে দিতে চায়।
রাই মুখ ঘোরায় রণর দিকে,দেখে উল্টো দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা।বাঁ হাত আস্তে করে তুলে রণর মুখটা কিছুটা জোর দিয়ে নিজের দিকে ঘোরায়।তারপর মৃদু হেসে বলে,”চলো যাই”।
রণর নিভে যাওয়া চোখটা জ্বলে ওঠে আবার।দুহাত দিয়ে রাইয়ের গালদুটো একটু জোরে চেপে ধরে।
রণর চোখ কথা বলতে থাকে,আর তা নির্দ্বিধায় পড়তে পারে রাইমা।
ওই চোখদুটো রাইয়ের অনেক বড় ভরসার জায়গা।চোখের দৃষ্টি কত খারাপ সময়ে ওকে শক্তি জুগিয়েছে।এই চোখদুটো প্রথম রাইকে রণর ভালোবাসার উপলব্ধি করিয়েছিল।এই চোখের অভিমান,কষ্ট সবটা তো রাই কবে থেকে চেনে।
ভগবান হয়তো সত্যি ওপর থেকে সব ঠিক করে পাঠান,নাহলে রণর সাথে রাইয়ের আলাপই হতনা।রাই জানতেও পারতোনা এইরকম নিঃস্বার্থভাবে কেউ আজীবন কাউকে ভালোবাসতে পারে! রাই ওর বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্ক বেশিরভাগ ভাঙতে দেখেছে।যেগুলো বিয়ে অবধি গেছে বেশিরভাগ শুনেছে বিয়ের পর বদলে গেছে ছেলেটা।আর কিছু তো বিয়ের পরও ভেঙেছে।
রণর মাথাটা নিজের কাঁধে টেনে নেয় রাই।ওর কোমর জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রাখে ওর জন্ম মৃত্যুর সাথী।
সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ বাঁচিয়ে রাই শুধু বলে,”এভাবেই ভালোবাসবে তো,যতদিন বাঁচবো?”
রণ রাইয়ের মুখটা দেখতে না পেলেও বুঝতে পারে ওর চোখটা জলে ভরে গেছে।উত্তর দেয়না রণ,উল্টে সব ভুলে রাইকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে।নিজের প্রানের প্রিয় মানুষটা কে সর্বশক্তি দিয়ে আগলে রাখতে চায় পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ থেকে।

“ঠাকুর ভালো রেখো আমার ছেলে মেয়ে দুটোকে।সমস্ত লড়াই ওদের জিতিয়ে দিও ঠাকুর।বড্ড ভালোবাসে আমার ছেলেটা মেয়েটাকে।রক্ষা করো ওদের ভালোবাসা।সুখে রেখো ওদের”,জয়িতার বিড়বিড়ানি শুনতে পায় পাশে যাহোক করে দাঁড়ানো ঋষি।ভিড়ের মধ্যে পা রাখাই দায়।
ওর মধ্যেই জয়ির কাঁধে হাত রাখে ঋষি।
মন্দিরে বাইরে এসে তখনও জয়ির চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।সারাজীবন কঠিন মনের মনের মেয়ে হিসেবে পরিচিত জয়িতা আজ বড্ড অসহায়।বংশধর বা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে ভাবেনি ও কখনো।এমনকি নিজেরও বড্ড মেয়ের শখ ছিল বলে রাইকে এনে রেখেছিলো নিজের কাছে,কিন্তু নিজের আত্মজ কে কষ্ট পেতে দেখতে কোনো মা বাবাই পারেনা।তখন দূর্বলতার প্রকাশ হয়তো লুকোনো যায়না।
শুধু জয়ি কেন সেই দূর্বলতা তো প্রকাশ পাচ্ছে ঋষি আর জয়ের মুখেও। ঠাকুরকে বিশ্বাস করত না যে জয় সে আজ মন্দিরে এসেছে মেয়ের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে।
“আজ বুঝলাম মা বাবা জীবনে কতটা আশ্রয়”,জয়ন্তর কথায় অবাক হয়ে তাকায় ঋষি ওর দিকে।
ওর মুখের বিস্ময় পড়ে নিয়ে জয়ন্ত আবার বলে,”ভগবান তো আসলে সেই বাবা মার পরিপূরক।বিপদে পড়লে আমরা বাবা মাকে খুঁজি,একটু শান্তি পেতে,একটু আশ্রয় পেতে।তাই ভগবানের কাছে ছুটি।আমি আজ এখানে এসে সেটাই উপলব্ধি করলাম।বাবা মা র কাছে প্রচন্ড মন খারাপে যে শান্তি পেতাম,সেটাই কিছুটা পেলাম এখানে।”
জয়িতাও অবাক দৃষ্টিতে তাকায় জয়ন্তর দিকে।
‘ভুল তো কিছু বলেনি জয়।আগে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেই ও ছুটতো মায়ের কাছে,এখন মন্দিরে বা ঠাকুরঘরে গিয়ে সময় কাটায়।’
জয়ির মনে পড়ে ওর এক বান্ধবী ছিল ছোট থেকেই প্রচন্ড ঠাকুর ভক্ত।বাকি বান্ধবীরা হাসাহাসি করতো তাকে নিয়ে।
সেই অনিমা একদিন ওকে বলেছিল,ওর বাবা মা খুব দুর্বল প্রকৃতির মানুষ,সহজ সরল নরম মনের।কেউ কষ্ট দিক,বিপদ আসুক কখনো কোথাও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।সেই কারণে ওই বান্ধবীর মনে ছোট থেকে জন্ম নিয়েছিল ইনসিকিউরিটি।ও কখনো ভয় পেলে,দুঃখ পেলে,সমস্যায় পড়লে ঠাকুরকে সব বলতো।ভরসা করতো ভগবানকে।এরকম করতে করতে ও নির্ভরশীল হয়ে গেছে ঠাকুরের ওপর।
তার মানে জয়ন্তর কথাই ঠিক।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়িতা,”ভগবানের কাছে এলে একটা শক্তি পাই,সেটাই হয়তো বিপদে সাহায্য করে।আত্মসমর্পণ করে নিজেকে হালকা লাগে।যেটা হওয়ার সেটা তো হবেই,কিন্তু তাও…”।
ঋষিও চুপ করে যায়।বাবা মার দায়িত্ব যে বড্ড বেশি।সন্তান যে বাবা মার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।তাদের কাছে শুধুই দিয়ে যেতে হয়,পরিবর্তে কিছুই পাওয়ার আশা না করে।ওদের সন্তান ওদের কথা ভাবে,কিন্তু কজনের সেই সৌভাগ্য হয় আজকের দিনে।কিন্তু সন্তান যেমনই হোক তার কষ্ট কোনো বাবা মা’ই সহ্য করতে পারেনা।
রণ ওর বড্ড ভালো ছেলে,ভগবান ওকে শেষ ক’বছর খালি দুঃখই দিয়ে যাচ্ছে।অন্য বাবা মা হলে মেয়েটাকে আড়ালে হলেও দায়ী করতো, কিন্তু রাই যে ওদের কাছে রণর থেকে কোনো ভাবে কম না।
আর রাইয়ের মত যেসব মেয়ে আছে তারা কেউ ই অন্যের খারাপ থাকার দায় বহন করে না।যারা এটা করে তাদের মনুষ্যত্ব নিয়ে সন্দেহ হয় ঋষির।
তিন বন্ধু মিলে মন্দির থেকে বেরিয়ে একটু সমুদ্র সৈকতের দিকে যাবে ঠিক করে।হয়তো রণ-রাইয়ের সাথে দেখা হলেও হতে পারে।
সেই কবে শুরু হয়েছিল তিনজনের বন্ধুত্ব,আজও সেটা অমলিন।জয়ন্ত,জয়ি,ঋষি কলেজ বেলার মত আজও জয়িকে মাঝে রেখে তিন বন্ধু হাঁটতে থাকে।সেদিনের সেই কথার স্রোতে হয়তো আজ হারিয়ে যেতে পারেনা অত সহজে,কিন্তু মনের চিন্তা গুলো একে অপরের সাথে আজও সংযোগ তৈরি করতে পারে সহজেই।জীবনে জয় হারিয়েছে বেশি,তেমনই পেয়েছেও কম না।রাই-রণ ওর জীবনে সবচেয়ে বড় পাওনা।আজকের এই সম্পর্ক ভাঙার যুগে রণর রাইকে আগলে রাখা জয়কে অদ্ভুত শান্তি দেয়।অনেকে বলে রণর মত ছেলে বাস্তবে পাওয়া মুশকিল,কিন্তু জয়ন্ত মনে করে প্রকৃত ভালোবাসা সবসময় কোথাও না কোথাও ছিল,আছে আর থাকবে।খারাপটা জানতে জানতে আমরা ভালো ভুলতে বসেছি।আর ভালোটা মানুষ কমই খোঁজে,খারাপ খুঁজতে খুঁজতে জীবন কাটিয়ে দেয়।
জয়ি আজও কলেজ বেলার মতোই জয়ন্ত পাশে থাকলেও অভ্যাসবসত ঋষির হাতটা আঁকড়ে হাঁটে।এই হাতের ভরসায় এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলো।রাইয়ের চিন্তায় আজকাল ওর নিজের শরীরও ভেঙেছে কিছুটা।হাঁটাহাঁটি বেশি করতে গেলে হাঁটুতে লাগে।তাই হাঁটতে গেলে কাউকে ধরতে হয়।বড্ড শখ ছিল ওর,বয়েসকালে সঙ্গী হবে ছেলের বউ।ওর এই শখ নিশ্চই পূরণ হবে।রাই পুরো সুস্থ হয়ে একদিন ওর ভরসা হবে,এই আশায় ও আজকাল দিন কাটায়। রণ ওর দূর্বলতা,ওর দুঃখে বুক ফাটে।কিন্তু রাইও ওর বুকের অন্যদিকটা জুড়ে আছে কবে থেকে।তাই কখনোই ছেলের বউ না,রাইকে নিজের মেয়ের জায়গায় বসিয়েই মায়ের মত কষ্ট পেয়েছে ওর জন্যে।রণ বড় ভরসা রাইয়ের জন্যে।রণর ভালোবাসা রাইকে একদিন ঠিক স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবে।চিন্তাটা মনে আসতেই উত্তেজনায় ঋষির হাত খামচে ধরে জয়ি।
“কি হলো?”,ঋষির অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে হাসে জয়ি।ঋষির ঘাড় নাড়তে নাড়তে হেসে ফেলে।বদলালো না মেয়েটা।সেই কলেজ জীবনের জয়িকে ঋষি আজও খুঁজে পায় পঞ্চাশের জয়ির মধ্যে।তবে মাঝে মাঝে চিন্তাও হয় এই মেয়েটার জন্যে।রাইকে খুব ভালোবাসে বলে মাত্র পঞ্চাশেই যেন বুড়িয়ে যেতে চাইছে জয়ি।সেই ফিটফাট লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কাজ করা ওর চেনা জয়িতা একটু জবুথবু হয়ে গেছে যেন।নিজের পেশাকেও এবার গুটিয়ে আনতে চাইছে।হসপিটালে যেটুকু যায় ঋষির তাড়া খেয়ে,কারণ ঋষি চায়না এত তাড়াতাড়ি জয়ির মত ডাক্তার প্র্যাক্টিস ছেড়ে দিক।দরকারে চ্যারিটেবল হসপিটালে কাজ করুক,তাও বাইরে বের হোক।
জয়ির হাতটা ভালো করে চেপে ধরে ঋষি।আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে ওদের।ওর জীবনের ধ্রুবতারা কে সঙ্গিনী করে আজ এতগুলো বছর কাটিয়ে এসে,আজ হতাশ হলে চলবে নাকি! রাইও যে রণর জীবনে ধ্রুবতারা,মরীচিকা না এটা ওদের সবাইকেই দেখতে হবে।এগিয়ে চলে তিনজন আরো অনেক পথ চলার আশায়।এতটা পথ হেঁটে এসে সুখকে মরীচিকা হতে দেবে না ওরা।

একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখটা নিজের অজান্তেই ঝাপসা হয়ে আসে রণর।রাইকে ঘিরে বাচ্ছা গুলোর হৈচৈ,আর তার মধ্যে ওর চোখের তারার আনন্দটা…এটাই তো দেখতে চেয়েছিল রণ।রাইয়ের হাসিতেই তো ওর বেঁচে থাকা।ওর জীবনটা যে ধ্রুবতারাকে দেখে রোজ পথ হাঁটে সেটা উজ্জ্বল হয়ে না জ্বললে ও যে দিক হারাবে।চশমার ঝাপসা কাঁচ দিয়ে ওর প্রাণভোমরা কে ভালো করে দেখতে না পেয়ে চশমা খুলে চোখ মোছে,আর ঠিক সেই সময়ে একটা হাত এসে ওর কাঁধ ছোঁয়,অর্ণব।এই ছেলেটা এতটা সুন্দর একটা অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত ভাবতেও পারেনি রণ।সত্যি সুন্দর,বাচ্ছা গুলোকে এত যত্ন করে রেখেছে এরা।এদের মধ্যে হাতে গোনা কজনের বাবা মা দুই নেই।আর বেশিরভাগের বাবা নেই,মা রা অক্ষম সন্তানের দায়িত্ব নিতে।
অর্ণব হাসতে হাসতে বলে,”আমাদের ঠিক কলকাতায় না,হুগলির দিকে একটা আশ্রমের জন্যে বাড়ি বা জমি দরকার।খোঁজ চলছে।ওটা তৈরি হতে হতে রাইমা সুস্থ হয়ে যাবে,ওখানে ওকে দায়িত্ব দিয়ে জুড়ে নেব তোমাদের আমাদের সাথে।কি সাথে থাকবে তো তখন?”
“হুগলির কোথায়?” রণ কৌতূহলী হয়।
“একটু গ্রামের দিকে কোথাও ইচ্ছা আছে।শহরে তো এসব আছে,গ্রামের অনাথ শিশুগুলোর জন্যে একটু যত্নের দরকার”,অর্ণবের চোখে যেন স্বপ্ন দেখে রণ।
“আমি তোমায় একটা বাড়ির খোঁজ দিতে পারি।আগে বাবার সাথে কথা বলি।আমার গ্রামের বাড়ি।যদি ওটা হয় আমাদের জুড়তে হবে না।আমরাই পুরো দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করবো।আমার স্ত্রীর একটা এনগেজমেন্ট দরকার।আমি তাড়াতাড়ি জানাবো তোমায়”,রণর কথা শেষ হয়না লাফিয়ে উঠে অর্ণব।
“ওয়াও! তুমি কি বলছো তুমি নিজেই জানোনা।জানিনা তুমি কতদূর কি করতে পারবে,কিন্তু এই যে এতবড় আশ্বাস দিলে এটাই বিশাল আমার কাছে”,অর্ণবের মুখ উজ্জ্বল হয়।
“পারবো অর্ণব।ওই যে মেয়েটার মুখে এতদিন পর যে হাসিটা দেখছো,ওটা দেখার জন্যে আমি সব পারবো।আমি ভগবান না,তাই চাইলেও ওর সব শখ পূরণ করতে পারিনি।কিন্তু এটা পেলে ওর জীবনের না পাওয়ার কষ্টগুলো হয়তো কমবে।ও মা হতে পারবে না কোনোদিন তোমায় তো বলেছি,কিন্তু এতগুলো নিঃসন্তান বাচ্ছার মা হওয়াও তো সহজ পাওয়া নয় বলো! আমি পারবো।এই মেয়েটাকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে করেও বারবার হেরেছি আমি।আর না।আমি ওকে একটা সুন্দর সুস্থ ভবিষ্যৎ ঠিক দেব”,রণর গলা বুজে আসে।
“আমি সত্যি অবাক এরকম ভালোবাসার সাক্ষী হতে পেরে।তুমি পারবে।আমি কোনদিন এই ভালোবাসার বাঁধনে জড়াইনি,তাও তোমার ভালোবাসার জোর দেখে বলছি সমস্ত খারাপ কেটে যাবে দেখো তোমাদের জীবন থেকে।তুমি এই সবে বললে না,এতগুলো সন্তানের মা হওয়া,ঠিক এই কারণে সংসার করার ইচ্ছা হয়নি আমার।এরা আমার জীবনের ধ্রুবতারা,বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য,এদের কোনো কিছুর বিনিময়ে ছাড়তে পারবো না আমি।তাই জড়াইনি সংসার জীবনে।তোমাদের মত করে সবাই তো ভাববে না”,অর্ণব হাসি ধরে রেখে বলে।
“ভুল করলে অর্ণব।তোমার মত অত ভালো মানুষ আমরা না।আমরা স্বার্থপর সাংসারিক মানুষ।আজ কিছু না পেয়ে তবেই না এসেছি এদের কাছে।তোমার সাথে আমাদের কোনো তুলনাই চলে না।আমরা শূন্যতা ভরতে এদের আঁকড়াচ্ছি,আর তুমি এদের শূন্যতা ভরে এদের আগলে রেখেছো”,রণর কথায় মুগ্ধ হয়ে যায় অর্ণব।
“সত্যি তুমি খাঁটি মানুষ ভাই।তোমরা এদের কয়েকজনের দায়িত্ব নিলে এরা মানুষ হয়ে যাবে”,অর্ণব রণর হাত চেপে বলে।
“নিশ্চই নেব অর্ণব।আমার রাই অনেক মাতৃহীন বাচ্ছার মা হবে,ওর স্নেহ ওকে দিয়ে ঠিক দায়িত্ব পালন করিয়ে নেবে।একজন অনাথ শিশুকে ও দত্তক নিয়ে মানুষ করুক আমি তা চাইনি।আমি চাই ও অনেকগুলো বাচ্ছা কে মাতৃস্নেহে মানুষ করুক।দত্তক বাচ্ছার মা হওয়ার অনিশ্চয়তা না,মাতৃত্বের আনন্দ উপভোগ করুক ও এদের সবার সাথে।তাতে ভবিষ্যতে হারাবার ভয়,দুঃখ পাওয়ার ভয় থাকবে না”,রণ নিজের মনের লুকোনো ভয়টাও আজ উগরে দেয় অচেনা এক ছেলের কাছে।পিঠ চাপড়ে দেয় অর্ণব।হেসে ওর সাথে হাত মিলিয়ে রণ সবে রাইয়ের দিকে এগোতে যাবে হাতে ধরা সেল ফোন নড়তে থাকে।স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রণ দেখে ঋষি ফোন করছে।
-“হ্যালো বাবা।”
-“কোথায় রে তোরা?আমরা সি বিচে এসে তোদের দেখতে পাচ্ছি না।”
-“একটা ঠিকানা দিচ্ছি বাবা,চলে এসো।মন ভালো হয়ে যাবে দৃশ্য দেখে।”
-“কোথায় রে?”
-“আসলেই দেখতে পাবে।বেশি দূরে না।”
-“ঠিক আছে পাঠা।”
ফোন কেটে ঋষিকে আশ্রমের ঠিকানা পাঠিয়ে রণ এগিয়ে যায় রাইয়ের দিকে।
রাইয়ের পাশে ওর জন্যে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসে।বাচ্ছা গুলো ওকে ঘিরে একটু দূরে বসে।ভালোবাসার কাছে হার মেনেছে ভাষা।রাই ওদের ভাষা বুঝে নিচ্ছে খুব সহজে।তবে বাচ্ছা গুলোর মধ্যে কয়েকজন বাঙালিও আছে।
রণর মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে রাই,”থ্যাংক য়্যূ”।
রণ স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় রাইয়ের মাথায়,”তুই খুশি তো?তুই এখানে যখন খুশি আসবি।আর আমি ব্যবস্থা করছি যাতে তুই এরকম একটা উপহার নিজের জন্যে পাস।”
“মানে?”,রাই প্রশ্ন চোখে তাকায়।
“মানে অর্ণব একটা বাড়ি খুঁজছে গ্রামের দিকে,হুগলি তে।আমরা নেব ওই দায়িত্ব।কিরে পারবি না?দেশের বাড়ি না হোক অন্য কোনো গ্রামে আমি একটা বাড়ি খুঁজে নেবই।চল চেষ্টা করি আরেকবার ভালো করে জীবনটা বাঁচি”,রণ রাইয়ের হাতে হাত রাখে।
“রণ…’,গলা বুজে আসতে চায় রাইয়ের।
রণ একহাতে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে রাইকে।হৈহৈ করে ওঠে বাচ্ছা গুলো।চেঁচিয়ে ওঠে অর্ণব খুশির আওয়াজে।হেসে ওঠে রণ রাই দুজনেই।

একটা নতুন জীবনের হাতছানিতে আবার অক্সিজেন ভরে আসে রণর ফুসফুসে।রাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় জগন্নাথ দেব কে।একজন মানুষের জীবনে বাঁচার উদ্দেশ্য খুব বেশি দরকার,সেটাই তাকে সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখে অনেক অনেক বছর।
রাইকে জীবনের সাথে বাঁধতে হবে এরকম বাঁচার উদ্দেশ্য দিয়েই।
এতদিন পর প্রকৃত ওষুধ পেয়েছে রণ।অনেকদিন পর ভালো করে নিশ্বাস নেয় ও। ও জানে ওরা ঠিক জিতবে।সব প্রতিকূলতা কে হারিয়ে কোনো একদিন জিতে যাবে রণ-রাইয়ের গল্প।
শুরু হয় আরেকটা গল্প,নতুন জীবনের গল্প।রণ রাই রা এভাবেই নতুন নতুন গল্পের মধ্যে দিয়ে বাস্তব সঙ্গে নিয়ে,লড়াইয়ের মন্ত্র শেখাতে ফিরে আসে আমাদের জীবনে।ছাপ রেখে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে,নতুন কিছু শেখানোর চেষ্টা করে।বাস্তব থেকে উঠে আসে রণরা রাইয়ের হাত ধরে।তাই বারবার নাম বদলে ফিরে আসতে হয় তাদের।

সমাপ্ত।

***অনাথ আশ্রমের বর্ণনা ও ঘটনা এবং স্থান সম্পূর্ণ রূপে লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।