মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-১৯

0
398

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#উনবিংশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“তোকে কি মিষ্টি লাগছে রাই”,দুর্গা প্রতিমার দিকে না তাকিয়ে রাইয়ের দিকে অপলকে তাকিয়ে তাকিয়ে রণ বলে।
“রণদা, ঠাকুর দেখো।আমার দিকে কি দেখছো তখন থেকে!” লজ্জা পাওয়া গলায় বলে রাই।
রণর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাই কথা বলছিল,এমন সময় পিছন থেকে কেউ ওর কাঁধে হাত রাখে।অবাক হয়ে পিছন ফেরে ও।
“অনিকেত স্যার!!” রাইয়ের মুখে টেনশনের ছাপ পড়ে।
“চলো রাইমা।আমার মা তোমায় দেখতে চাইছে।” রাইয়ের হাত ধরে টান দেয় অনিকেত।
“ছাড়ুন স্যার আমার হাতে লাগছে”,রাই প্রায় আর্ত চিৎকার করে ওঠে,ও রণ ডাকতে যায়।কিন্তু রণকে খুঁজে পায়না ওর চোখ।
ভয়েতে ও ঘামতে ঘামতে ঘুরে দেখে অনিকেত না ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওর…মা।
রেশমা রাই কে বলে,”আমাকে ভুলে গেলি রাই?আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম।এখন ওই রণ কে পেয়ে…মায়ের জায়গা কেউ নিতে পারেনা রাই।মায়ের মত কেউ পাশে থাকেনা।চল তুই আমার সাথে নাহলে ওই ছেলেটা তোকে কষ্ট দেবে,চল”,রেশমা এবার রাইয়ের হাত ধরে টানে।

“মা কোথায় যাবো আমি তোমার সাথে?একটু দাঁড়াও রণকে বলে যাই, নাহলে ও খুঁজবে”,রাই কেমন যেন ভয় পায় রেশমা কে।হাতটা ছাড়াতে চায় রেশমার হাত থেকে।

মাথা ঘুরিয়ে খুঁজতে চায় রণকে।প্যান্ডেলের ভিড়ে রণকে খুঁজে পায়না।এদিকে রেশমা কথা বলেনা কিছু,শুধু রাইকে টানতে থাকে।সে এক ভীষণ টান,যেন রাই এড়াতে পারেনা।
“রণদা…রণ-দা…”,ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকতে চায় রাই রণকে।কিন্তু খুঁজে পায়না কোথায়।হঠাৎ হাতটা আলগা লাগে।সামনে তাকিয়ে দেখে রেশমা নেই।
“মা…মা…ম-আ-আ-আ…”,কিছুতেই গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয়না।…’মা-মা-মা কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি আবার?’ ভেতর থেকে কেউ বলতে থাকে কথাগুলো।
একদিকে রেশমা,অন্যদিকে রণ দুজনকে এলোমেলো খুঁজতে খুঁজতে প্রচন্ড টেনশনে ঘুম ভেঙে যায় রাইয়ের।অদ্ভুত গোঁ গোঁ শব্দে দম বন্ধ অবস্থায় চোখ মেলে প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনা ও।অপেক্ষা করে ধাতস্থ হতে।

বাইরে তখন আলো ফুটে পাখি ডাকছে,মানে ভোর হয়ে গেছে।ওদের কমপ্লেক্সের পুজো প্যান্ডেল থেকে খুব হালকা শব্দে ভেসে আসছে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলা।তাহলে তো পাঁচটা বেজে গেছে।ভোরের স্বপ্ন কেন যে খারাপ হয়!সারাদিন মন খিঁচখিচ করে।
আজ নবমী,রোজ সকালে এরা পাঁচটার সময় বক্সে মহিষাসুরমর্দিনীর রেকর্ড চালায়।রাইদের চারতলার ফ্ল্যাটে খুব আস্তে এসে পৌঁছয় সে আওয়াজ।একরাশ মন খারাপ নিয়ে শুরু হয় নবমীর সকাল।

সেদিন রণকে অনেক কেটে ছেঁটে বললেও কিছুতেই এড়াতে পারেনি রাই আসল ঘটনাটা।রণ কিছু বলেনি রাইকে,শুধু এক দৃষ্টে তাকিয়েছিল ওর মুখের দিকে।রাই বুঝতে পারেনি রণ কি ভাবছে।রাইয়ের কথা শেষ হতে ডান হাত দিয়ে দেয়ালে ঘুঁষি মেরেছিলো ও,ওর অভ্যেস মত।কিন্তু দাঁড়ায়নি আর এক মুহূর্ত,বেরিয়ে গিয়েছিল রাইদের ভাড়ার ফ্ল্যাট থেকে।
কিছুক্ষন রাই হতভম্ব হয়ে বসেছিল নিজের জায়গাতে।কেন করলো রণ এরকম ব্যবহার!স্পষ্ট রাগ দেখালো রাইয়ের ওপরে,কিন্তু এখানে ওর দোষ কি? ও তো অনিকেত কে বলেছিল ওর জীবনের সত্যিটা।তাও রণর এরকম অদ্ভুত ব্যবহারের কোনো কারণ রাই সেদিন খুঁজে পায়নি।আজও ভেবে পায়না।
রাইয়ের মনের ধোঁয়াশা দূর করার বদলে রণ সেদিন রাতে ফোন ধরেনি,আর এই কদিনে ঘুরিয়ে কোনো ফোনও করেনি রাইকে।
এতদিন রাইমা নিজে মনোকষ্টে ভুগলেও চেষ্টা করেছে রণর অভিমান কমাতে।বারবার ফোন বেজে গেছে,তাও ফোন করা বন্ধ করেনি ও ঘন্টায় ঘন্টায়।ওদের ভালোবাসার প্রথম পুজো জীবনের সেরা পুজো কাটাবে ভেবেছিল ও,কিন্তু এত খারাপ পুজো কোনোদিনও কাটায়নি এর আগে।

বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে যায় রাই, মোবাইলে সময় দেখে প্রায় ছ’টা।কমোডে বসেও স্বপ্নটা ফিরে ফিরে আসতে থাকে।তাহলে কি মায়ের রণকে পছন্দ হয়নি?নিজের চিন্তায় নিজেই উতলা হয় ও।তবে কি ওর রণর সম্পর্কটা টিকবে না?নবমীর ভোরে এ স্বপ্ন কি তারই ইঙ্গিত ছিল?
ও নিজেও ভাবেনি রণ এবছর অঞ্জলি দিতে আসবে না!কিন্তু আঙ্কেল এসে যখন বললো,”রণ ওর লাস্ট মিনিট প্রিপারেশন নিয়ে এত বিজি যে পুজোয় দোতলা থেকে একতলায় ও নামেনা।আজও শেষ মুহূর্তে বললো আসবে না”,খুব রাগ হয়েছিল রাইয়ের।কাল সকাল থেকে আর ফোনে চেষ্টাও করেনি ও।এবছর অঞ্জলি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্নটা অধরা থাকায় রাইয়েরও অভিমানের পারদ চড়তে বেশি সময় লাগেনি।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে রাই।সুলেখা মাসি এবার বাড়ি গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে,জ্বর এসেছে।কবে ঠিক হয়ে আবার কাজে আসবে কিছু ঠিক নেই,এমনকি আর আসতে পারবে কিনা সেটা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
বাবার আর ওর চা বানিয়ে বাবার দরজায় গিয়ে যখন টোকা দেয় ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে ছটা।মহালয়ার অডিও বন্ধ হয়ে গিয়ে শুরু হয়েছে নবমী পুজোর ঘোষণা।

“জয়ি বল আমি কি হেল্প করবো তোকে?আজ কি রান্না হবে স্পেশাল?রাতে কিন্তু আজ বাইরে খাবো সবাই মিলে।” সকালের গ্রীন টি তে প্রথম চুমুক দিয়ে ঋষি বলে।

“পাগল হয়েছিস নাকি?নবমীর রাতে বাইরে খেতে বেরোবো?লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খিদে মরে যাবে।আজ রমা কে বলেছি নারকেল কুড়তে, বড় বাগদা গুলো দিয়ে মালাইকারি করবো,রণ ভালোবাসে।আর করবো ইলিশ ভাপা রাইয়ের পছন্দের।এবেলা সাদা ভাত,মুগের ডাল আর কিছু একটা ভাজবো।আর রাই বলেছে ওবেলা মাটনের কি একটা প্রিপারেশন করবে।সারপ্রাইজ।পারলে পোলাও বা রাইস হোম ডেলিভারী করিয়ে নিস”,জয়ি নিজের কফির মাগে চুমুক দেয় এবার।
“হ্যাঁ রে ঠাকুর দেখতে যাবো কখন?রেঁধে খেয়ে যেতে রাত ভোর হয়ে যাবে।” ঋষি ছেলে মানুষের মত বলে।
“আমরা ওই ভিড়ে কোথাও যাবোনা।দুপুরে খেয়ে বেরোবো,আশেপাশে যা আছে দেখে ফিরে আসবো।এমনিও ভাস্কর ছুটিতে,ছেলেটা পড়াশোনায় ব্যস্ত,আজকাল আর ঠাকুর দেখার হুল্লোড়ে মাততে মন চায়না।করোনা ওই কবছরে অভ্যেস বদলে দিয়েছে”,খবরের কাগজের প্রথম পাতায় চোখ রেখে বলে জয়ি।
“আর তাছাড়া ওরা রাতে থাকে কি দেখ।জয় তো সিওর কিছু বলেনি।রাতে খেয়ে ফিরে যেতে পারে বলেছিল”,কথা বলতে বলতে জয়ি সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”গুড মর্নিং ডিয়ার।আজ এত সকালে উঠে পড়লি!রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে গেছিলি?”
রণ এসে যোগ দেয় ডাইনিং টেবিলে।টেবিলে রাখা একমুঠো ছোলা তুলে আখের গুড় দিয়ে খেয়ে জয়ি কে প্রত্যুত্তর করে,”মর্নিং মম।মর্নিং বাবা।”
চেয়ার টেনে বসে একটা চায়ের কাপে টি পট থেকে গরম জল ঢালতে ঢালতে বলে,”না মম শুতে রাত হয়েছিল।কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙে গেল।তাই উঠে এলাম।এ’কদিন সব কি আর রুটিন মেনে হয় বলো?” গরম জলে গ্রীন টি ব্যাগ ডোবাতে ডোবাতে বলে ও।
আসলে রাইয়ের ওপর প্রচন্ড রাগ ওকে আটকে রেখেছিল ওর ফোন ধরতে।রাগ আসলে হয়েছিল অনিকেতের ওপর,এমন রাগ ও সেই মুহূর্তে ওর হাতটা গিয়ে ভেঙে দিয়ে আসতে পারতো।কিন্তু রাই নিজের মাথায় হাত দিয়ে প্রমিস করিয়ে নিয়েছিল তাই অনিকেতের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগটাই পায়নি ও।সিনেমার হিরোর মত মারপিট সত্যি হয়তো করতে পারতো না।কিন্তু রাইয়ের লাইফপার্টনার ওর চেয়ে কোন দিক দিয়ে বেটার অন্তত ফোন করেও বুঝিয়ে দিত।
কিন্তু রাই সেই রাস্তা বন্ধ করায় মাথা কাজ করেনি।ওর স্বভাব অনুযায়ী দেয়ালে ঘুসি মেরে হতাশা প্রকাশ করেই বেরিয়ে এসেছিল সেদিন।
কিন্তু রাইয়ের ফোন না ধরে,কথা না বলে ওকে কদিন বোঝাচ্ছিলো কতটা রাগ ওর মনে পুষে রেখেছে ও,এমনকি ওর স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে মান অভিমান টেনে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে মমদের সাথে দিদুনের কমপ্লেক্স এও যায়নি।

এত কিছুর পরেও অন্য সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল রণর।কাল থেকে রাই একবারও ফোন করার চেষ্টা না করায় সব গন্ডগোল হয়ে গেছে।কাল রাতে অনেকবার মনে হয়েছে একবার নিজে ফোন করি,বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে এবার।কিন্তু ফোন হাতে নিয়েও এই প্রথম রাইয়ের নম্বরে কল করতে পারেনি ও।রাতের পড়া ঘুম নষ্ট করে অপেক্ষা করেছে সকাল হওয়ার।আজ রাই আসবে,কিন্তু রাতে থাকবে এটা জানা নেই রণর।

“রণ দুপুরের দিকে সময় হবে তোর?এই কাছাকাছি ঠাকুর গুলো দেখে আসবো সবাই মিলে”,জয়ি ছেলেকে একটু অন্যমনস্ক দেখে প্রশ্ন করে।

“হমম।হবে”,মনে পড়ে রাই বলেছিল এবছর পুজোটা ওর কাছে খুব স্পেশাল।হঠাৎ খুব রাগ হয় রণর নিজের ওপর।আজ অবধি কোনোদিনও তো ও কারোর ওপর রাগ টেনে থাকেনি।তাহলে এবারে কেন করলো ও এটা?
নাহ,আজ ই সব মিটিয়ে নেবে ও।কিছুতেই রাইকে আর কষ্ট দেবে না বলেও আবার কষ্ট দিলো,কি মনে করে তাড়াতাড়ি চা টা শেষ করে টেবিল থেকে উঠে পড়ে ও।খবরের কাগজের পাতায় চোখ বোলাতে থাকা ঋষিকে একবার দেখে নিয়ে জয়ি কে বলে,”মম জয় আঙ্কেল এলে ডেকো।এই দুদিন একটু ব্রেক নেব।সারা পুজো তো পড়লাম।”
জয়ি হেসে ঘাড় নাড়লেও ঋষি কাগজ থেকে চোখ না সরিয়ে বলে,”হ্যাঁ ও তো জয়ন্তর অপেক্ষা তেই আছে।বেচারা কাল ও যেতে পারেনি বলে জয় কি মন খারাপ করেছিল।লুচিও মাত্র তিনটে খেলো”,ঋষির মুখে কোনো ভাবান্তর না হলেও ও যে রণকে লেগ পুল করছে বুঝতে অসুবিধা হয়না ওর।জয়ির মুখে হাসি দেখে ও নিজেও লজ্জার হাসি হেসে চেয়ার ঠেলে বেরিয়ে আসে।
ওপরে এসে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে আগে ফোন করে রাইকে।ও জানে ওর জন্যে আলাদা রিংটোন সেট আছে সেই প্রথম দিন থেকে,আর কখনো সাইলেন্ট থাকেনা রাইয়ের ফোন।কিন্তু ওকে অবাক করে ফোন ধরেনা রাই।রণর কল এইপ্রথম মিসড কল হয় রাইয়ের ফোনে।

প্লেনের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল শীর্ষা।আজ নবমী আর ও মা দুর্গা থাকতে থাকতেই শহর ছেড়ে যাচ্ছে।এখন দিল্লি উড়ে যাচ্ছে ও,আর কাল ওখান থেকে স্টেটসে উড়ে যাবে ভোর রাতে।
আজ সাতদিন রণর সাথে আর দেখা করেনি ও,ইচ্ছা করেনি।রণ আর ওর রাস্তা এখন আলাদা হয়ে গেছে পার্মানেন্টলি।রণ ওর জীবনের ভালোবাসা পেয়ে আজ পাওয়া দের দলে,শীর্ষার মত হতাশা ওকে আর তাড়িয়ে বেড়ায় না।ভুল হলো শীর্ষাও আর হতাশ হয়না,কারণ আশা করলে তবেই যে হতাশা আসে।আজ শীর্ষার জীবনে আশা টুকুও নেই।
রণ যেদিন ওকে মিট করে ‘সুখবর’টা দিলো,শীর্ষা বুঝতে পারেনি খুশি হবে না,কষ্ট পাবে!
কিন্তু রণর মুখ দেখে সেই মুহূর্তে দুঃখরা আসেনি।এক গাল হাসি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়াছিলো রণকে।বড্ড খুশি ছিল ছেলেটা।ও যেন আশাতীত কিছু পেয়েছে জীবনে ওর কথা বারবার সেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।ও চেয়েছিল রাইকে একবার দেখা করাতে শীর্ষার সাথে,শীর্ষা ই এড়িয়ে গেছে।
আচ্ছা রাইমা কি জানে শীর্ষার মনের কথা?জানলে কি ওকে এড়িয়ে থাকবে?রণকে ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে দেবে না?
অনেক গুলো প্রশ্ন এ’কদিন মনে ভিড় করেছে।আর রাইয়ের ওপর ওদের বন্ধুত্বের ভবিষ্যৎ ছাড়তে চায়নি শীষ,তাই নিজেই ঠিক করেছে রণ নামক আশীর্বাদ কে নিজের জীবন থেকে কেটে ফেলতে।
না রণ অভিশাপ না,ও তো আশীর্বাদ ওর জীবনে।বন্ধুত্ব কি রণজয় মুখার্জী তো ওকে শিখিয়েছে।শীর্ষা ভট্টাচারিয়া নাক উঁচু না হলেও সহজে তো ক্লাসের সবার সাথে মিশতে পারতো না আগে,এখন অনায়াসে রোগীদের কাছে বন্ধু হয়ে উঠতে পারে।এর জন্যে রণ পুরো ক্রেডিট পায়।

“এক্সকিউজ মি ম্যাম,ইজ ইট য়্যূর ব্যাগ?” উইন্ডো সিটে বসা শীর্ষার কানে কথা গুলো যেতে নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে প্রশ্নকর্তার উদ্দেশে তাকায় ও।
“ওহ! আই’ম এক্সট্রিমলি সরি”,বলে মিডিল সিটে রাখা ওর হ্যান্ডব্যাগ টা নিজের কোলে তুলে নেয়।
ছেলেটা নিজের ল্যাপটপ ব্যাগ সিটের ওপরের লাগেজ লকারে রেখে মিডিল সিটে বসে।
শীর্ষা আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে নিজের জগতে।কিন্তু ভাবনা গুলো আর ফিরে আসেনা।
ঘড়ি দেখে শীর্ষা।এখনো মিনিট পনেরো বাকি টেক অফ এর।ফোনটা বের করে বাবাকে প্লেনে ওঠার খবর দিতে গিয়ে দেখে রণর মিসড কল।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও।যার থেকে পালাচ্ছে ও,সে ফোন করছে শেষ মুহূর্তে।কিন্তু এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না ওর।কি বলবে!শুকনো গুড বাই।তার জন্যে শেষ মুহূর্তে মনে পড়লো?কাল রাতে শীর্ষা ফোন করেছিলো,ধরেনি রণ।এমনকি কল ব্যাক ও করেনি।নাহ এখন ও এই গলাটা শুনতে চায়না।ও হয়তো লুকিয়ে রাখতে পারবে না অভিমানটা।ওর কষ্ট,ওর মনখারাপ ও লুকোতে চাইলেও গলাটা বিট্রেই করতে পারে।থাক দিল্লি পৌঁছে সন্ধ্যেবেলা হোটেল থেকে ফোন করবে।
নিজের বাবার নম্বরে গিয়ে ভিডিও কল বাটন টেপে ও।কানের হেডফোনে কিছুক্ষনের রিং শোনার পর ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে বাবার মুখ।মা’ও পাশে এসে দাঁড়ায়।আজ অনেকবার এয়ারপোর্ট আসতে চেয়েছিল ওরা,শীর্ষা আনেনি।কোনো দুর্বলতা যাতে ওকে শেষ মুহূর্তে কাঁদাতে না পারে সেই সব রকম চেষ্টা করেছে ও।এখন মা বাবার মুখ থেকে বুকটা আর একবার মুচড়ে উঠলেও মুখে হাসি ধরে রেখে কলকাতার মাটিতে থেকে বাবা মা কে বিদায় জানায় ও।কিন্তু ফোনটা কাটার পর আর সামলাতে পারেনা নিজেকে।হেডফোন খুলে ফেলে বাঁ হাতের আড়ালে নিজের চোখ জোড়া ঢেকে ফেলে।দাঁত দিয়ে ঠোঁট টিপে আবেগের উছলে ওঠা আটকানোর প্রানপন চেষ্টা করা সত্ত্বেও দু চোখ শেষ অবধি ছাপিয়েই যায়,গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।

এতক্ষন পাশে বসা ছেলেটা উসখুস করছিল,কিন্তু কথা বলতে পারছিল না অচেনা ভদ্রমহিলার সাথে।যদিও ওর উসখুসনি বলে দিচ্ছিল ট্রাভেল করার সময় চুপ থাকা ওর স্বভাবে নেই।এবার শীর্ষা কে ওভাবে আবেগ প্রবন হয়ে পড়তে দেখে আটকে রাখতে পারেনা নিজেকে।
“এনিথিং রং ম্যাম?সরি আপ কো দেখকে ঠিক নেহি লাগা ইসলিয়ে…মাতলাব…”,ছেলেটার কথায় মুখ থেকে হাত সরিয়ে মৃদু হাসে শীর্ষা,নিজের কোলে রাখা ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখের কোনে আলতো ঠেকায়।
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আরো একবার হেসে লজ্জিত গলায় বলে,”সরি।অ্যাকচুয়ালী প্যারেন্টস আর অন দ্য আদার সাইড,সো কান্ট কন্ট্রোল দ্য ইমোশন”,ছেলেটার মুখের সারল্য ভালো লাগে ওর।

“আর য়্যূ বেঙ্গলি?আই’ম ফ্রম দেল্লি।শিবরাজ নাম হ্যায় মেরা,শিবরাজ আগারওয়াল।সাউথ দেল্লি মে ঘার।উও বিজনেস কে চক্কর মে কাভি কাভি কালকাত্তা আনা পারতা হ্যায়”,নিজেই গড়গড় করে নিজের কথা বলে দেয় কালো মাঝারি হাইটের মিষ্টি মুখের ছেলেটা।খারাপ লাগার বদলে ভালোই লাগে শীষের।ও যেন সত্যি একটা কথা বলার কাউকে খুঁজছিল।হিন্দিভাষী মিশুকে ছেলেটার সান্নিধ্য মনটা ভালোই করে ওর।
“আপ ইয়ে দুর্গা মা কে পূজা কে টাইম বেঙ্গল ছোড় কে কাঁহা যা রেহি হ্যায়?সাল কে ইস টাইম সাব বাঙ্গালী উধার সে ইধার আতি হ্যায়”,ওর কথায় বেশ মজাই পায় শীর্ষা।
ওর উত্তরে শিবরাজের মুখে যে সম্ভ্রম দেখে শীর্ষার ভালো লাগে।শিবরাজ ব্যবসায়ী,গার্মেন্টের বিশাল ব্যবসা ওর বাবার।শিবরাজ ছোট ছেলে।
শীর্ষা হায়ার স্টাডিসের জন্যে বিদেশ যাচ্ছে শুনে রীতিমত শ্রদ্ধার গলায় ও বলে,”ডাক্তার ম্যাম আপ কো ক্যা বলু।হামারে ইধার পায়সে কে কামি নাহি হ্যায়, লেকিন হামারা সাবকুছ হ্যায় ও বিজনেস।মে ইধার কা মাল উধার,উধার কা মাল ইধার কার রাহা হুঁ আজ দাশ সাল কে আশপাশ।ফ্লাইট মে বহত লোগো সে মিলতা হুঁ লেকিন ডক্টরনী ফার্স্ট টাইম।মে চুপ নাহি ব্যাঠা সকতা ইসলিয়ে সাবকে সাথ বাতে কারতা রেহতা হুঁ।ফার্স্ট টাইম কোই লাডকি সে মিলা জো ইটনে দূর আপনি স্বপনো কে পিছে দউর রেহী হ্যায়।নেহি, মুঝে মালুম হ্যায়, আজকাল লেডি লোক জ্যাদা আগে বার রাহী হ্যায়। লেকিন ও সাব লাডকি হাম জ্যসা অনপাড গাওয়ার কে সাথ বাতে নেহি কারতি আপ জ্যাসি।ইসলিয়ে উন লোগো কে বাড়ে মে মুঝে বহত কুচ জাননে কো নেহি মিলতা”,একটু থামে শিবরাজ।শীর্ষা একটানা ওর কথা মুখে হাসি নিয়ে শুনে কিছু বলতে যায়,,তার আগেই শিবরাজ আবার বলে,”অ্যাকচুয়ালী আপ বহত অচ্ছে হো।লেডি ডক্টর সে ফার্স্ট টাইম মিলা মে।আব তাক যাব ভি ডক্টর কে পাস গায়ে মেল ডক্টর কো দিখায়ে।অপনে মেরা আঁখে খোল দিয়া।আপ সে এক বাত বলু?”
এতক্ষন পর কথা বলার সুযোগ পেয়ে শীর্ষা ঘাড় নেড়ে বলে,”শিওর প্লিজ”,ছেলেটার কথাবার্তা ওকে বুঝিয়ে দেয় উচ্চশিক্ষা না থাকলেও সংস্কার আছে ওর মধ্যে।
“মে শখ সে থোড়া লিখতা হুঁ, মাতলাব হিন্দি রাইটার হুঁ।ইসলিয়ে ইয়ে কাভি কাভি ট্রেইন মে ভি ট্রাভেল কারতা হুঁ।উন সাব লোগো কে কাহিনী শুনকে মেরা কাহিনী বানতে হ্যায়। এক ব্লগ হ্যায় মেরা সিউডো নেম সে”,লজ্জার হাসি হেসে একটু থামে ও।কিন্তু আবার পরের মুহূর্তেই শুরু করে বলতে,”অপকে কাহিনী ভি আগার লিখু উধার কই প্রবলেম তো নেহি হ্যায় না? উধার ছাপনে সে পেহলে আপ কো দিখা লুঙ্গা জারুর।অব আপ বোলো,”আবার একটা সুযোগ পায় শীর্ষা।মনে মনে ভাবে,’আমার কাহিনী যে ইনকমপ্লিট শিবরাজ।’
মুখে বলে,”উস কে লিয়ে আপ কো তো মেরি পুরা কাহিনী তো শুননা পডেগা।”
উত্তর না দিয়ে এই প্রথম শিবরাজ অপেক্ষা করে শীর্ষার পরের কথার জন্যে।শীর্ষার নিজের ব্যাগ থেকে নিজের কার্ড বের করে এগিয়ে দেয় ওর দিকে।
শিবরাজ কার্ডটা নেয়,পার্স খুলে বের করে নিজের কার্ড।
শিবরাজের কথা শীর্ষার মনে জমে থাকা অভিমানকে ভুলিয়ে দিতে থাকে আস্তে আস্তে।ব্যবসায়ী হলেও শিক্ষিত রুচিসম্পন্ন শিবরাজ কে বড্ড আপন লাগে শীর্ষার।মাঝ আকাশের আলাপ কে তাই মাটিতে নামিয়ে আনতে চায় শীর্ষা নিজের মনের তাগিদে।কার্ড বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে কি সূচনা হয় শীর্ষার জীবন কাহিনীর নতুন কোন অধ্যায়ের?

“রাই তোর আর কি কি জোগাড় লাগবে বল।বললাম রাতে এসে করিস,শুনলি না আমার কথা।একটু ঠাকুর দেখতে বেরোতাম সবাই মিলে।পিরিয়ডের সাথে ঠাকুর দেখার কি সম্পর্ক বলতো?” জয়ি বুঝতে পারে রাইয়ের অজুহাত এর কারণ অন্য।সকাল থেকে এসে চুপচাপ ওর কাছে রান্নাঘরে ঢুকে বসে আছে।রণর সাথে কথা বলতেও দেখেনি।কি যে হয় এখনকার ছেলেমেয়েদের।কথাটা মনে আসতেই নিজের মনে হাসে ও,ওরাও কি আলাদা ছিল?!অভিমানের ভাষা তো সেই আগেও যা ছিল এখনো তাই আছে।
কাল অষ্টমীতে রণ রাইদের কমপ্লেক্সে যখন অঞ্জলি দিতে গেলোনা তখনই একটা চোরা সন্দেহ মনে উঁকি দিয়েছিল।তারপর আজ রাইয়ের হাবভাব শিওর করলো ওকে।
কিন্তু এ আবার কি! সম্পর্ক শুরু হতে না হতেই ঝগড়া!আর ওর ছেলে মেয়ে দুটো তো অবুঝ প্রকৃতির না,তাহলে কি এমন হলো? সামান্য হলেও চিন্তার ভাঁজ পরে জয়ির কপালে।
জয়ন্তরা আজ তাড়াতাড়িই চলে এসেছিল,রমা আর ও রান্নাঘরে তখন সবে ডাল, ভাত আর ভাজা করে মাছ রান্নার তোড়জোড় করছে।রাই এসে দাঁড়িয়েছিল দরজায় চুপচাপ।
জয়ি নিজেই ডেকে নিয়েছিল ওকে রান্নাঘরের মধ্যে,রমা আর জয়ি নিজে থাকলেও রাই নিজের উৎসাহে রান্না করেছিল মালাইকারি।কিন্তু কাউকে জানাতে বারণ করেছিল বারবার।জয়ি আঁচ করেছিল তখনই কিছু একটা হয়েছে রাইয়ের।কিন্তু জিজ্ঞেস করেনি রমার উপস্থিতির কারণে।

রণ খাবার টেবিলে চুপচাপ খেলেও মালাইকারীর প্রশংসা করেছিল নিজের অজান্তেই।
“মম আজকের মালাইকারিটা তো ফাটাফাটি হয়েছে।তোমার মালাইকারির টেস্ট ই আলাদা,সবার মধ্যেও আমি ঠিক আলাদা করে ফেলবো।” রণর উচ্ছ্বাসে একজনের চোখমুখ উজ্জ্বল হলেও জয়ি তার চোখের ইশারায় চুপ থাকে।বলা হয়ে ওঠেনা,’রাই আমার থেকে জেনে জেনে আজ তোর জন্যে মালাইকারি রেঁধেছে”।
“আন্টি তোমরা যাও বলছি।রমা পিসি আছে,আমার কোনো অসুবিধা হবে না।আসলে আমার এই সময় ঘুরতে বেশি ভালো লাগেনা।আর আজ রান্না করতে খুব মন করছে।প্লিজ আন্টি আমি কোনো কিছুতে না করি বলো?আজ আসলে…”,রাই শেষ করতে পারেনা কথা।
রান্নাঘরের দরজায় মুখ বাড়িয়ে রণ বলে,”মম কখন বেরোবে? রেডি হয়ে নাও।বেশি দেরি করলে ফেরার সময় জ্যাম ফেস করতে হবে”।
কথাগুলো মা কে বললেও নজর ঘোরে রাইয়ের ওপর,ওর রাগের ওপর টেক্কা দিয়ে গেছে মেয়েটার অভিমান।ওর করা কাজগুলো ওকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। সকাল থেকে বার দশেক ফোন করেছিল রণ,কোনো রেসপন্স তো করেইনি।উল্টে এসে থেকে মুখ ঘুরিয়ে আছে।পড়াশোনা মাথায় উঠেছে ওর।খালি মনে হচ্ছে রাই কি করছে দেখে আসি।তাই নিজেই এসেছে ঠাকুর দেখতে বেরোনোর তাগাদা দিতে।আগে কোনোদিন রাইকে অভিমান করে কথা বন্ধ করে থাকতে দেখেনি,বরং উল্টোটা হয়েছে বেশ কয়েকবার,বিশেষ করে অনিকেতের সম্পর্কে জানার পর পর রণ ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে রাইয়ের সাথে অভিমান করে থেকেছে কতদিন।
রাইয়ের এই রূপ প্রথম দেখছে বলে একটু চাপেই পরে গেছে রণ,কিকরে কি সামলাবে মাথায় আসছে না।
“দূর ঠাকুর দেখতে যাবোনা। তুই পড়তে বোস যা”,রাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে জয়ি,যদিও রাইমা তখন অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের কাজ করছে।
“মানে?যাবেনা কেন?” রণ মুখে একথা বললেও মনে মনে বলে,’বলে কি এরা।সব প্ল্যান চৌপাট হয়ে যাবে তাহলে।রাইকে মানানোর আর সুযোগ পাওয়া যাবে না আজকালের মধ্যে’।
“না রাই যাবেনা।ও না গেলে আমরা বুড়োবুড়ি কি ঠাকুর দেখতে যাবো,দরকার নেই”,জয়ির কৃত্রিম রাগে হেসে ফেলে রাই নিঃশব্দে।রণর দিকে পিছন করেই জয়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”আন্টি তুমি কিন্তু ব্ল্যাক মেইল করছো।বিশ্বাস করো আমি তো কাল সারাদিন আমাদের পুজো মণ্ডপে ছিলাম তোমরা চলে আসার পর থেকে।আজ আর ভালো লাগছে না।” সকালে স্নান করতে গিয়ে যখন রাই বুঝেছিল মাসের বিশেষ দিনটা ছ’দিন এগিয়ে এসেছে,সকালের মন খারাপটা আবার ফিরে এসেছিল।একবার ভেবেছিল বাবা কে পাঠিয়ে দিয়ে ও থেকে যাবে বাড়ি,কিন্তু শেষ অবধি রণকে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে চলেই এসেছে বাবার সাথে।আর তাছাড়া এবাড়িতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো কাটানোর পর এধরণের অসুবিধা এখানে ওর হয়না।আজও আন্টি ওই ঘরটা ওর নামেই রেখে দিয়েছে,যেখানে আজ রাতে ও শোবে জয়ি আন্টির সাথে।
“মম ফালতু কথা বন্ধ করে সবাই রেডি হয়ে নাও যত তাড়াতাড়ি হয়।পিসি তুমিও রেডি হও”,রমাকে বছরের এই বিশেষ দিন ওরা বাড়ি রেখে যায়না।কিন্তু রমা নিজেই আপত্তি জানিয়ে বলে,”না রণদাদা আমি যাবুনি।আমি এ বৎসর বাড়িতেই থাকি।ওই করোনা অভ্যেস নষ্ট করে দেছে।”
“আমিও যাবোনা।প্লিজ আন্টি তুমি তো জানো আমি তাদের দলে পড়িনা যারা অহেতুক এড়িয়ে গিয়ে নিজের দর বাড়ায়।কিন্তু তোমরা কেউ না গেলে খুব মন খারাপ হবে আমার।তখন কষ্ট হলেও যেতে হবে তোমাদের সঙ্গ দিতে”,রাইয়ের গলায় আকুতি ঝরে।
জয়ি ঠোঁট উল্টে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,”তোকে রেখে আমরা ড্যাং ড্যাং করে চলে যেতে পারি বল?তুই এখানে রান্না করবি আর আমরা ঘুরতে যাবো?”
“প্লিজ আন্টি।আমি তোমার গেস্ট না,মেয়ে।তাহলে কেন এভাবে বলছো?আমি আর রমা পিসি ভালো থাকবো।তোমরা চট করে ঘুরে এস।আমি ততক্ষণ রান্নাটা করে ফেলি।তারপর সন্ধ্যেবেলা আড্ডা হবে।” বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে রাই।
এতক্ষন চুপচাপ রণ সব শোনে, তারপর সরাসরি বলে,”কাউকে যেতে হবেনা।সবাই টিভি খুলে ঠাকুর দেখে নাও।আমার অতো ফালতু সময় নেই,শুধু তোমরা বলেছিলে তাই নিয়ে যেতে রাজি হয়েছিলাম।এখন আমি চললাম পড়তে।”আর দাঁড়িয়ে জয়ির উত্তর ও শোনে না ও।রাই বাড়ি থাকবে আর ও মা বাবাদের সাথে ঠাকুর দেখতে যাবে এতোটাও উদার ও না।যে যা ভাবে ভাবুক।
কিন্তু রণ বুঝতেও পারেনা জয়ি রণর কথায় মনে মনে বলে,’ইয়েস’।
এটাই তো চাইছিল ও,দুটিকে একা ছেড়ে মান অভিমান মেটানোর সুযোগ দিতে।সঙ্গে সঙ্গে বলে ও,”ছাড় তোদের কাউকে যেতে হবেনা।আমরা তিন বন্ধুই যথেষ্ট হুল্লোড় করতে।তোরা বুড়ো বুড়ির মত বাড়িতে থাক।আমরা ঘুরে ফুচকা রোল খেয়ে ঠাকুর দেখে আসি”,রাইকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও বেরিয়ে যায় রণর প্রায় পিছু পিছু।
মমের কথাগুলো রণরও কানে ঢোকে,সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান বি রেডি হয়ে যায় মনে মনে,মুখে এক চিলতে হাসি নিয়েও চলে যায় নিজের ঘরে।

আধ ঘন্টা পর বেরোনোর আগে জয়ি নিঃশব্দে এসে ঢোকে রান্নাঘরে।ও দেখে এসেছে রাই ওপরে নিজের বরাদ্দ ঘরে গেছে চেঞ্জ করতে।রান্নাঘরে থাকা রমার একদম কাছে চলে আসে জয়ি,তারপর ফিসফিস করে কিছু বলে রমাকে।কথা গুলো শুনতে শুনতে একগাল হাসি ফোটে রমার মুখে।রণকে কোলে পিঠে করে প্রায় মানুষ করেছে ও,তাই এ খবর ওকে আনন্দ দেবে না তাও কি হয়!
উচ্ছ্বাস চাপতে পারেনা ও,একগাল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে,”তুমি চিন্তা কোরোনি বৌদিমনি।আমি আছি,সব সামলে নেব”,রমার কথায় ভরসা করে হাসির প্রত্যুত্তরে হাসি ছুঁড়ে জয়ি ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে।

বাবা মা বেরিয়ে যেতে উসখুসনি শুরু হয় রণর।কোনোভাবে রাইয়ের সাথে কথা বলতে মরিয়া হয়ে ও।দূর শালা কোথাকার কে অনিকেতের বাচ্ছা,হাতের কাছে পেলে রণ দেখিয়ে দিত ওর রাইকে আঘাত করার ফল।কিন্তু শালা উল্টে ওর মাথা গরম করিয়ে ওদের প্রথম পুজোটা দিল মাটি করে।একবার নিজের ওপর ও রাগ হয়।অনেক চিন্তাভাবনা করে আরো আধ ঘন্টা সময় কাটিয়ে লোকলজ্জা দূরে সরিয়ে রেখে দোতলা থেকে মুখ বাড়িয়ে চেঁচায় রণ, পিসি রাইকে দিয়ে প্লিজ এক কাপ ব্ল্যাক কফি পাঠাও তো”,ইচ্ছা করে উল্লেখ করে রাইয়ের কথা।তারপর ঘরে গিয়ে নিজের প্রিয় মিউজিক সিস্টেমে রিপিড মোডে কাল রাত থেকে চলতে থাকা প্রায় মুখস্থ হয়ে যাওয়া গানটা আবার চালিয়ে দেয় যাতে রাই একতলা থেকে শুনতে পায়।গানটা প্রথম শুনছিলো রাই এবাড়ি থাকতে ওর ঘরে,ফোনে প্রায়ই চলতো। এই গানটা।কাল রণর রাইয়ের জন্যে মন খারাপের সময় বারবার সুরটা মাথায় ফিরে ফিরে আসছিল।রাই একটা কি সিরিয়াল দেখতো তাতে এটা প্রায় থিম সং ছিল,ভীষণ প্রিয় ছিল ওর ওই সিরিয়ালটা।

রাই এই ভয়টাই পাচ্ছিল।ও সবে রমাকে বলতে যাবে কিছু তার আগেই রমা জয়ির শেখানো অনুসারে বলে,”যাও গো রাই দিদি দে এস ওই কালো কফি।আমার বাবা ঢের কাজ পরে,তুমি যাও।আমি একবার আবার বড় বাথরুম যাবো”,রাইয়ের কথা আর মুখ থেকে বের হয়না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কানে আসে রণর ঘরে নিয়ম ভেঙে হিন্দি গান চলছে,আজ অবধি রাই যা কোনোদিন শুনেছে বলে মনে পড়েনা।কিন্তু গানটা প্রায় দশ বছরের ওপর পুরোনো হলেও ওর খুব প্রিয় গান।

“…খাইসে মিলনে কি তুমসে,খাইসে মিলনে কি তুমসে রোজ হোতি হ্যায় নেহি,
মেরি দিল কি জিদ মেরি মৎ বান গায়ি…”

গানের কথা গুলোয় অবস করে দেয় ওকে রণর ঘরে যাওয়ার আগে।ও বুঝতে পারে ওকে শোনাতেই গানটা এত জোরে চালিয়েছে রণ।কিন্তু এটা ওর ‘হট ফেভারিট’ রণ কি সেটাও জানে!
অন্যমনস্ক ভাবে পায়ে পায়ে রাই রণর ঘরে এসে ঢোকে।
নিজের টেবিলে মন দিয়ে পড়ছে রণ,দেখে ঠিক কি অনুভূতি হয় রাইমা নিজেও বুঝতে পারেনা।খুশি না খারাপ লাগা বুঝতে বুঝতে পৌঁছে যায় টেবিলের কাছে।
“তোমার কফি”,কাপটা টেবিলের এক ধারে রেখে ঘুরে চলে আসতে যাবে রণর বাঁ হাতটা রাইয়ের ডানহাতকে আঁকড়ে ধরে।
নিজের হার্টবিট নিজে শুনতে শুনতে রাই বলে,”ছাড়ো নীচে পিসি আছে”।

“…স্বাপ্নে তেরি চাহতো কে,স্বাপ্নে তেরি চাহতো কে দেখতি হুঁ অব কেহী…”

উঠে দাঁড়ায় রণ রাইয়ের পাশাপাশি,”কি হয়েছে তোর?শরীর ভালো না তো রান্নাঘরে ঢুকে আছিস কেন?”তারপর একটু থেমে ফিসফিসিয়ে বলে,”মালাইকারিটা ওয়ান রুম হয়েছিল।আমার জন্যে তুই বানিয়েছিলি তাই তো?” রণর ঠোঁটে দুস্টু হাসি খেলা করে।

অবাক চোখে রাই একবার তাকিয়ে আবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়,কিন্তু উত্তর দেয়না।
পাওয়ার আশা নেই জেনেও দুবছর আগে মা দুর্গার কাছে করা মানত টা মনে পড়ে যায়…প্রথম দুর্গা অষ্টমীতে একসাথে অঞ্জলি দেওয়ার মানত।কাল তাই অনেকবার ফোন করেছিল সকাল থেকে,একবারও ধরেনি ছেলেটা।মনের কোণে রণকে হারিয়ে ফেলার ভয়ই রাতে তাই স্বপ্নে ফিরে আসে।

“কিরে বলবি তো?” রণ হাতটা ছাড়েনা,বুঝতে পারে অভিমানের গভীর মেঘ জমেছে মনে।
“পিরিয়ড হয়েছে।কষ্ট হয় প্রথম দিন,অল্প জ্বর আসে।আর সেরকম কিছু না”,রাই অন্যদিকে মুখ এইটুকুই বলে,এড়িয়ে যায় মালাইকারি প্রসঙ্গ।
কিছু ভাবে রণ,তারপর ডানহাত দিয়ে রাইয়ের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আলতো স্বরে বলে,”সরি”।
উত্তর দেয়না রাই, চোখ নামিয়ে রাখে।কি করবে অবাধ্য চোখটা যে অভিমানে বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে।
বুঝতে পারে রণ রাইয়ের অবস্থা,নিজের মুখটা নামিয়ে আলতো করে রাইয়ের কাঁপতে থাকা গোলাপি ঠোঁটটা ছুঁয়ে দেয়।
আর নিজেকে সামলাতে পারেনা রাই।কিল ঘুঁষি মারতে মারতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রণর বুকে।কান্না ভেঙে আসে চোখে মুখে।
মুখে প্রশ্রয়ের হাসি নিয়ে জড়িয়ে ধরে রণ ওর প্রাণপাখিকে।বুকের মধ্যে চেপে জড়িয়ে মাথার চুলে ঠোঁট চুইয়ে বলে,”পাগলী আমার”।

“…পায়া ম্যায়নে, পায়া তুমহে, রাবসে মিলাইয়া তুমহে,
হোঁঠ পে সাজায়া তুমহে,নাগমে সাগয়া তুমহে,
পায়া ম্যায়নে,পায়া তুমহে,সাবসে ছুপায়া তুমহে,
স্বাপ্নে বানায়া তুমহে,নিদমে বুলায়া তুমহে

তুম জো আয়ে জিন্দেগী মেইন,বাত বান গায়ি
ইসক মাজহাব,ইসক মেরি যাত বান গায়ি…”

মিউজিক সিস্টেমে রিপিট মোডে আবার শুরু হয়ে যায় রণ রাইয়ের প্রিয় গান।রাই আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে রণকে,আর রণ নিজের মুখটা গুঁজে দেয় রাইয়ের কাঁধে,ওর চুলের মিষ্টি গন্ধটা ওকে যে খালি পাগল করে।

ক্রমশ…