মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-২০

0
405

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#বিংশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“এত ভালো রেজাল্ট করেও কেন তুই দেশের এক নম্বর মেডিকেল কলেজে পড়তে যেতে চাইছিস না রণ?তোর বাবা মা ও চাইছে এত বড় সুযোগ হাতছাড়া না করে বাইরের স্টেটে পড়তে যাওয়াই বেস্ট হবে,কিন্তু তুই নাকি রাজি হচ্ছিস না?” জয়ন্তর কথায় রণ কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
রণর রেজাল্ট বেরিয়েছে দুদিন হলো,তারপর থেকেই চলছে এই মতপার্থক্য।এই মতের অমিল হয়তো হতই না যদি রাই ওর জীবনে না আসতো।অল ইন্ডিয়া র্যাঙ্ক প্রথম পাঁচজনে থাকা মানে ওর জীবনে আর পিছন ফিরে তাকানোর কোনো দরকার নেই।অনায়াসে ও সুযোগ পাবে যে কোনো টপ মেডিকেল কলেজে,কিন্তু প্রথম দিকের সব টপ কলেজ গুলো এখন দিল্লি অথবা দক্ষিণের দিকে।আর সমস্যা সেখানেই।
রণর রেজাল্ট ভালো হবে সবাই জানতো, কিন্তু এতটা ফাটাফাটি হবে কেউ আশা করেনি।হয়তো জীবনে সত্যি একটা সময়ের পর অনুপ্রেরণার দরকার হয়,যা জীবনে কিছু করে দেখানোর তাগিদ তৈরি করে।রাইয়ের জুড়ে যাওয়া রণকে সেই মোটিভেশনই দিয়েছিল।কিন্তু ও ভাবেনি এই ভালো ওকে ওর রাইয়ের থেকেই দূরে নিয়ে যেতে পারে।
রাই নিজেও পারেনা রণকে বেশিদিন না দেখে থাকতে,তাও ও বুঝিয়েছে রণকে বাইরের কলেজে এডমিশন নেওয়ার জন্য।কিন্তু রণজয় কোনোভাবেই পারছে না মন কে মানাতে।ও নিজে অবাক কম হয়নি,কারণ ও নিজেও জানে ও কতটা বাস্তববাদী।কলকাতায় পড়লে ওর কেরিয়ারের হয়তো ক্ষতি খুব হবে না।কিন্তু টপ কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়ে ছেড়ে দেওয়াটা যে বোকামি ও নিজেও বুঝতে পারছে।বর্তমান যুগে যেখানে এই দূরত্ব আসলে কোন ব্যাপারই না।
রাই এতক্ষন রান্নাঘরে খুটখাট করছিল,যদিও ওর কানটা ছিল ড্রইং রুমে রণ আর বাবার কথার দিকে।ও নিজেও ভাবছিল রণকে এবার একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।এখন দুপুর গড়িয়ে দিন প্রায় বিকেলের পথে।রণ এসেছে ঘন্টা খানেক হলো।রাই তিনজনের জন্যে একটু নুডলস বানিয়ে নিয়ে ড্রইং রুমে এল।

“এই নাও রণদা”,স্বাভাবিক গলায় রণর দিকে একটা প্লেট বাড়িয়ে অন্যটা এগিয়ে দিল জয়ন্তর দিকে।ওদের সম্পর্ক বদলেছে এটা সবাই অনুমান করলেও নিজেরা এখনো সরাসরি কেউ বাবা মাকে বলেনি।তাই কথাবার্তাও চলে আগের নিয়মেই।অন্যমনস্ক রণ কাঁটা চামচে পাকিয়ে নুডলস মুখে পুরে আড়চোখে তাকালো রাইয়ের দিকে।
ওর পরীক্ষার আর রেজাল্টের মাঝের দিনগুলো প্রায় প্রতিদিনই ও কোনো না কোনো ভাবে রাইয়ের সাথে কিছুক্ষন কাটিয়েছে।কখনো ও এসেছে এই ফ্ল্যাটে,কখনো রাইকে টেনে নিয়ে গেছে নিজেদের বাড়িতে।তবে বেশিরভাগ দিনই রাইয়ের ইউনিভার্সিটির বাইরে গেট থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছে নিজের দুচাকা নিয়ে।
হয়তো এই কটা দিনই ওকে বেশি করে টেনে ধরছে পেছনের দিকে।

“আমায় তুই বল তোর সমস্যা ঠিক কোথায়?এত ভালো অপরচুনিটি।” জয়ন্ত আবার বলে।
আসলে ঋষি আগের দিন রাতে ওকে ফোন করে দায়িত্ব দিয়েছে রণকে বোঝাতে।সবাই হয়তো বুঝতে পারছে রণর আপত্তির কারণ,কিন্তু ও সরাসরি কিছু না বললে ওকে আস্বস্ত করতে পারছে না কেউ।জয়ন্ত তাই দায়িত্ব নিয়েছে রণকে বুঝিয়ে রাজি করানোর।

“আঙ্কেল তোমরা কেন ভাবছো এখানে পড়ে আমি কেরিয়ারের ক্ষতি করবো?হ্যাঁ এই শহরে টপ পাঁচটা মেডিকেল কলেজের কোনটা নেই হয়তো।কিন্তু এমবিবিএস তো এখানেই করলাম।আর তার জোরেই আজকের রেজাল্ট।তাহলে সমস্যা কোথায়?” রণ নিজের যুক্তি দেয়।
“সমস্যা না,ব্যাপারটা হলো বেটারমেন্ট।আমাদের প্রফেশনটাই তো এরকম।এখানে বইয়ের শিক্ষার থেকেও প্রাক্টিকালের দাম অনেক বেশি।এই শহরে এমবিবিএস করেছিস,এখানের পরিবেশে শিখেছিস যা শেখার।এবার বাইরে পড়তে গেলে ওখানকার কালচারে আরো বেশি কিছু শিখতে পাবি।সিলেবাস সব জায়গায় এক,কিন্তু সিলেবাসের বাইরে শেখাটা জায়গা ভেদে আলাদা।তুই নিজেও সেটা একদিন রিয়ালাইজ করবি।তুই নিজে ভাব আমি ভুল কিছু বলছি কি?তোর বাবাও তো সুপার স্পেসালাইজসন করতে গেছিলো বাইরে।” জয়ন্ত চেষ্টা করে রণকে বোঝাতে।
আবার চুপ করে যায় রণ,আড়চোখে দেখে যার কারণে ওর এই মানসিক দোলাচল সে নুডলসের বাটিতে কাঁটা চামচ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের খাওয়া শেষ করে মনোনিবেশ করতে যাবে মুখ খোলে রাই,”রণদা চা খাবে?বাবা হসপিটাল থেকে ফিরে চা খায়নি,বানাবো।”
দুধ চা রণ একদমই পছন্দ করেনা,তাই ঘাড় নেড়ে না বলে দেয়।রাই উঠতে যাবে রণর কথায় দাঁড়িয়ে পরে,”রাই তুইও চাস আমি বাইরে পড়তে চলে যাই তিন বছরের জন্যে?”

অবাক রাই রণর দিকে একবার তাকিয়েই নিজের বাবার দিকে তাকায়।আজ দুদিন ধরে ও নিজেও কি কম বোঝাচ্ছে রণকে।রণ তো জানে ওর মতটা।আর নিজেও জানে ও একবার নিজের মনের কথা শুনে রণকে থাকতে বললেই ও কারোর মতের তোয়াক্কা না করে এই শহরেই থেকে যাবে।কিন্তু রাই যে পারছে না আঙ্কেল আন্টি সবাইকে উপেক্ষা করে রণর সঙ্গ শুধু দিতে।আর ওরা বা ওর নিজের বাবা কেউ তো ভুল কিছু বলছে না।
ওকে চুপ থাকতে দেখে রণ আবার অধৈর্য্যের সাথে বলে,”বল রাই।তুই জানিস তোর মতটা সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট আমার কাছে”।
রণর কথা রাইমা কে অস্বস্তিতে ফেললেও জয়ন্ত চুপচাপ শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করে।ওরা তো চাইছে ছেলে মেয়ে দুটো ওদের বলুক নিজেদের কথা,যাতে রাই-রণর অনিশ্চয়তা দূর করার ব্যবস্থা ওরা করতে পারে।
রাই বুঝতে পারে দুটো মানুষ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ওর মুখের দিকে,কিন্তু এভাবে রণ কেন প্রশ্ন করছে কিছুই বুঝতে পারেনা ও।তাই কি উত্তর দেবে নিজের কাছেই অস্পষ্ট হয়ে যায়।

“বল রাই রণ যখন জানতে চাইছে ,হয়তো কোনো কারণ আছে।তুই কি চাস সেটাই বল।আমি জানি তুই যা বলবি ভেবেই বলবি”,জয়ন্তর কথা আর বিপাকে ফেলে রাইকে।সবার আড়ালে রণকে বোঝানো একরকম,কিন্তু বাবার সামনে বাবাকে সমর্থন করা আদপে রণর বিরোধিতার সামিল।সেটা তো ও করতে পারবে না,সেটা রণ ভালো জানে।
“রণ দা যথেষ্ট বুঝদার আর বাস্তববাদী আমি জানি।তাই আমার বিশ্বাস ও কখনোই বড়দের মতকে উড়িয়ে দেবে না।তবে ও যা সিদ্ধান্তই নিক নিশ্চই চিন্তা ভাবনা করেই নেবে।তিন বছর কাছের মানুষদের থেকে দূরে থাকলে যদি ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়,তাতে তো সবার ভালো”,রাই অনেক ভেবে,কেটে কেটে কথা গুলো বলে সবার অলক্ষ্যে হাঁফ ছাড়ে।
হেসে ফেলে রণ।শুধু রাই না,জয়ন্তও অবাক চোখে এবার ওর মুখের দিকে তাকায়।
“আঙ্কেল আপনার মেয়ে সত্যি বড় হয়ে গেছে।ও কিন্তু আসলে আপনাদের দলেই।আমায় আজ দুদিন ধরে বুঝিয়ে বুঝিয়ে মাথা খারাপ করে দিয়েছে।তাই আজ বাধ্য হয়ে আমি ছুটে এসেছি আপনার কাছে।আপনি যদি আমার একটা সমস্যার সমাধান করে দেন আমি তাহলে আপনাদের কথা মেনে যেখানে বলবেন যেতে রেডি”,রণ সরাসরি জয়ন্তর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলে।
বরাবরের মত টেনসনে রাইয়ের হার্টবিট দৌড় শুরু করে দেয়,’এই ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে।সকালে অত করে বোঝালাম তাও সেই নিজের জেদ ধরে বাবার কাছে চলে এসেছে!’
রাইয়ের ইচ্ছে করে ছুটে বেরিয়ে যায় ফ্ল্যাট থেকে,তার বদলে ও মুখ ঘুরিয়ে কিচেনে ফিরে যেতে উদ্যত হয়।
আটকায় না রণ,যদিও ও চেয়েছিল রাই থাকুক ওর কথাটা বলার সময়।যুগ এগোচ্ছে,তাও যে কেন আজও মেয়েরা নিজেদের জীবনের এত বড় সিদ্ধান্তের সময় সেখান থেকে পালাতে চায়!সম্পর্ক তৈরি করে দুজনে মিলে,আর বলার সময় এলে সব দায়িত্ব এসে পড়ে একা ছেলেটার ওপর।
রাইয়ের দিক থেকে মুখ সরিয়ে জয়ন্তর সপ্রশ্ন দৃষ্টির দিকে নজর ফেরায় রণ,”আঙ্কেল তুমি জানো আমি রাইয়ের সাথে নিজের জীবন শুরু করতে চাই?আর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।” রণর কথায় জয়ন্ত চোখ গোল করে ফেলে।
সত্যিটা তো ওরা সবাই জানে,কিন্তু ভাবেনি রণ সরাসরি বিয়ের কথা বলবে।ওর হিসেব অনুযায়ী ও ভেবেছিল রণ অন্তত আরো বছর পাঁচেক সময় চাইবে ওর কাছে।আর সেটাই ঋষি আর জয়িও বলেছিল।
রণ আবার শুরু করে কথা বলতে,”আমি ভেবেছিলাম মাস্টার্স কমপ্লিট করে সুপার স্পেশালাইজেশন করার আগে বিয়ের কথা বলবো।কিন্তু…।আমি ভালোই স্টাইপেন্ড পাবো ওইসব কলেজে তাই প্লিজ তুমি মত দাও।তুমি রাজি থাকলে আমি মম বাবার সাথে কথা বলবো।”
“রণ রাইয়ের এখনো পড়া কমপ্লিট হয়নি।তারপর ও নেটের প্রিপারেশন নেবে বলেছে।তোর আর রাইয়ের সম্পর্ক নিয়ে আমার কোনো আপত্তি থাকার প্রশ্নই ওঠেনা।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বিয়ে!রাইয়ের ও কি তাই ইচ্ছা?” জয়ন্তকে বিহ্বল লাগে।
রাইয়ের কানগুলো চায়ের জল ফোটাতে ফোটাতে গরম হয়ে ওঠে।রণ টা যে কি করেনা!এত করে বোঝালো রাই সকালে।কাল রাত অবধি ওকে ছেড়ে দূরে যেতে রাজি ছিলোনা,আজ সকালে উঠে অন্য কথা।রাই যখন কিছুতেই এত তাড়াতাড়ি মা-বাবাদের বলতে দিতে চাইছিল না ওর মুখের ওপর বলে কিনা,”আমায় আসলে তোর বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।আমি দূরে গেলে আঙ্কেলের পছন্দে বিয়ে করবি তুই।বিশ্বাস করিনা তোকে।”
রাই প্রথমে কোনো উত্তর দিতে পারেনি কথাটার,পাগল নাকি!যা মনে আসছে বলছে।শেষে কিছুতেই যখন বোঝাতে পারেনি,”তোমার যা খুশি করো”,বলে ফোন কেটে দিয়েছিল।ও ভাবতেও পারেনি রণ সত্যি সত্যি দুপুরে চলে আসবে বাবা কে এসব পাগলের প্রলাপ শোনাতে।সত্যি কি ছেলের পাল্লায় পড়েছে।ও কোনোদিন ভাবেওনি রণদা এরকম করবে।
ভালো তো ও ও বাসে রণ কে,নিজের থেকেও বেশি।কিন্তু রণ!জানেনা রাই কেন রণ দিনদিন এতটা পজেসিভ হয়ে উঠছে ওর বিষয়ে।তাহলে কি অনিকেতের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াটাই একমাত্র কারণ?

মিনিট দশেক পর চায়ের কাপটা পাশের ঘরে পৌঁছতে যেতেও লজ্জা করছিল রাইয়ের।কিন্তু বাবার গরম চা খাওয়ার অভ্যেস তাই লজ্জার মাথা খেয়ে যখন কাপটা দিতে গেল বাবাকে দেখলো দুজনেই মুখোমুখি চুপ করে বসে।
“রাই আয়।বোস এখানে।আমার কিছু কথা আছে তোর সাথে”,জয়ন্ত স্বাভাবিক স্বরে কথাগুলো বললেও রাইমা লজ্জায় মুখ তুলতে পারলো না।এত রাগ হচ্ছে ওর রণর ওপরে।

-“বাবা আমি এব্যাপারে যা বলার রণদা কে আগেই বলেছি।তুমি ওর থেকে জেনে নিও।”

-“আমিও তোকে যা বলার বলেছি।এবার তুই ঠিক কর কি করবি?” রণ সাথে সাথে উত্তর দেয়।

রাই আর ধৈর্য্য রাখতে পারেনা।ওর শান্ত গলা আজ প্রথম উঠে যায় সবার সামনে,যা রণকে যথেষ্ট অবাক আর আহত করে,”তুমি কেন আমার দিকটা ভাবছো না?আমার স্বপ্ন তো তুমি জানো?তাহলে কিকরে ভাবছো আমি নিজের পড়া ইনকমপ্লিট রেখে তোমার সাথে চলে যাবো?আমি যা বলার তোমায় বলে দিয়েছি।আমি বারবার বলেছি আমি তিনবছর কেন দরকারে আরো অপেক্ষা করবো।তাও কেন তুমি জেদ ধরে আছো আমি বুঝতে পারছিনা।…”,হঠাৎ রণর চোখ গুলো নজরে আসে রাইয়ের আর হঠাৎ উত্তেজিত হওয়ার মতো হঠাৎ চুপ করেও যায় ও।
উঠে পড়ে জয়ন্ত সোফা ছেড়ে,”রাই আমি একটু ঘরে যাচ্ছি।তুই ঠান্ডা মাথায় রণর সাথে কথা বল।আমি জানি তোরা দুজনেই যথেষ্ট বুঝদার আর বুদ্ধিমান।তাই সামনাসামনি কথা বলে ডিসিশন নে।দুজনের মত মিললে আমাদের জানাস”।
নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে দেয় জয়।
রাই বসে পড়ে জয়ন্তর ছেড়ে যাওয়া জায়গায়।রণর দিকে তাকিয়ে দেখে ওর মুখ থমথমে আর দৃষ্টি ড্রইং রুমে জানলা দিয়ে বাইরে।রাইমা বুঝতে পারেনা নতুন করে কি বলবে রণকে।এতদিন ধরে দেখে আসা ম্যাচিউর,ওকে সামলে রাখা ছেলেটাকে আজ বড় অচেনা লাগে।কেন করছে ও এরকম!কিসের এত ইনসিকিউরিটি ওর?কিছু না বলে রাই শুধু তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।

“প্লিজ ঐশি আমায় দুটো মাস সময় দে তুই।আমি যে লাইনে এগোচ্ছি, শুধু মাত্র তোকে পাবো বলে।খুব তাড়াতাড়ি তোর সমস্যা মিটিয়ে তোকে নিয়ে আসতে পারবো সোনা।তুই তো জানিস আমার বাবা মার অবস্থা,ওদের ভরসায় তোকে বিয়ে করা সম্ভব না জানু।প্লিজ বোঝ”,ছেলেটা অসহায়ের মত অনুরোধ করতে থাকে ঐশিকা কে।কিন্তু বাবা মার একমাত্র সন্তান ঐশিকা কোনোভাবেই আর পারবে না রুদ্র কে সময় দিতে।হ্যাঁ ঐশিকা রুদ্রর বর্তমান গার্লফ্রেন্ড। কলেজের আলাপ ধরলে প্রায় পাঁচ বছরের সম্পর্ক।কিন্তু রুদ্রর এই অস্থিরমতিতে এক প্রকার বিরক্ত মেয়েটা।ও চেয়েছিল মন দিয়ে পড়ে সরকারি চাকরি একটা গেঁথে দিক রুদ্র,কিন্তু ওর এই এমবিএ করা বা প্রাইভেটে ভবিষ্যৎ তৈরির ইচ্ছা কোনোভাবেই মানতে পারছেনা ঐশি।ফলস্বরূপ দিন দিন তিক্ততা বাড়ছে সম্পর্কে।
“দেখ রুদ্র তুই যে লাইনেই যা আমার বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া তোকে অ্যাকসেপ্ট করবে না,আগেই বলেছিলাম আমি।তারপরও তুই প্রাইভেট জবের দিকে এগোচ্ছিস।তুই দুমাসে চাকরি জোগাড় করলেও আমার বাবা সে চাকরি ধর্তব্যের মধ্যেও আনবে না আমি জানি।তাই শুধু শুধু আমার জন্যে আর সময় নষ্ট করিসনা।তুই ধীরে সুস্থে তোর পছন্দ মত কেরিয়ার বানা।আমায় মুক্তি দে।আমি অনেক গুলো বছর তোকে দিয়েছি,আর না।তুই এক পাও এগোতে পারিসনি, আমার অপেক্ষার গুরুত্ব অবধি দিসনি।আজ আমার চলে যাওয়ার মুহূর্তে তোর অসহায়তা দেখিয়ে মেন্টাল ব্ল্যাকমেল করতে চাইলে আমি তো ভুলবো না।যাইহোক আমি জানি কোন পথে এগোচ্ছিস তুই।তাই বলছি ভুলে যা আমায়,কোনো স্ট্রাগল করা মেডিকেল রিপ্রেসেন্টটিভ এর সাথে আমার বিয়ে কখনো বাবা নামবে না।তুই গভরমেন্ট জবের এক্সাম দিলেও আমি বোঝাতাম বাবা কে।কিন্তু তুই কোনো গুরুত্ব দিলিনা সেদিন আমায়।তাই গুড বাই।আর কখনো ফোন করিসনা আমায়”,দরকারের থেকেও বেশি জোর দিয়ে ফোনটা কেটে দেয় মেয়েটা।
কদিন ধরেই রাগে ফুঁসছিলো ও,যেদিন থেকে রুদ্র রণর পরামর্শে মেডিকেল রিপ্রেসেন্টটিভ এর চাকরি খুঁজছে।প্রাইভেটে মার্কেটিং এ এমবিএ করার চিন্তা থাকলেও রণর সাহায্য পেতে এই রাস্তা বেচেছে ও,ঐশিকার সাথে কথা না বলেই।
রুদ্র ফোনটা কানে প্রানপনে চেপে প্রায় চেঁচায় কিছুক্ষন,”হ্যালো,হ্যালো ঐশি।ঐশি…”,তারপর যখন বোঝে যে ফোনের ওপারে কেউ নেই হতাশায় ফোনটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে সামলে নেয়।
আজ প্রায় পাঁচ বছর ওদের সম্পর্ক,ঐশি শুধু ওর গার্লফ্রেন্ড না বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল এতদিন,সে এভাবে সব শেষ করে দেবে দুঃস্বপ্নেও কখনো ভাবেনি রুদ্র।
রণ আর শীর্ষার বন্ধুত্বের ছায়া থেকে বেড়িয়ে যখন ও কলেজে ভর্তি হলো প্রথম দিকে খুব একা লাগতো।স্কুলের তিক্ত কিছু স্মৃতি এগিয়ে গিয়ে কথা বলতেও বাধা দিত ওকে।সেরকম সময়ে প্রাক্টিক্যাল ল্যাবে পরিচয় হয়েছিল ঐশিকার সাথে।
ঐশিকা রণর জায়গাটা অনেকটাই দখল করেছিল ওকে আগলে,এমনকি রুদ্রকে নিজে এগিয়ে গিয়ে প্রপোজ করেছিল ঐশি।
বরাবর একজনকে গুরুত্বপূর্ণ পেলেই রুদ্র বাকিদের নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়না।তাই রণ বা শীর্ষার মত বন্ধুরাও অনেকদিন ওর যোগাযোগে ছিলোনা।
বছর খানেক আগে রণ নিজে ওকে ফোন করতে আবার যোগাযোগ নিয়মিত হলেও ঐশির সাথে রণর আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়নি।এমনকি রণ যে ডাক্তার আর ওর ভবিষ্যতের কান্ডারি সেটাও বলবো বলবো করে বাকি থেকে গেছিল।
রুদ্রর জীবন থেকে সিগারেট ঐশির জেদেই বিদায় নিয়েছিল,আজ অনেক বছর পর সেই নেশার টান ধরলো।আর বারবার মনে পড়তে লাগলো রণ কে।
ঐশিকা চৌধুরী বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে হলেও বরাবর একটু ফ্যাশন প্রিয়।তাই বাবার অমতে গিয়ে নিজের প্যাশন কে গুরুত্ব দেয়।কলেজের পর নামি জায়গা থেকে কোর্স করে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে ও,আর সেটাই ছিল রুদ্রর সবচেয়ে বড় ভরসা।স্বাবলম্বী মেয়েটা যে ওর ক্ষেত্রে নিজের বাবার মতকে এত বেশি গুরুত্ব দেবে ভাবেনি ও।আজ নিজেকে প্রচন্ড একা লাগে।

“হ্যালো রণ ফ্রি আছিস?একটু দেখা করা যাবে আজ?” শেষ অবধি ফোনটা করেই ফেলে ও সন্ধ্যের দিকে।
“হ্যাঁ বল কোথায় মিট করবি?” অবাক হয় রুদ্র রণর গলা শুনে,বড্ড ক্লান্ত লাগছে ওর বন্ধুর গলাটা।
“তুই বাড়ি থাকলে আমি চলে যাচ্ছি।অনেকদিন যায়নি তোর ওখানে।আন্টির সাথেও দেখা হয়ে যেত”,নিজের স্কুল বেলাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে রুদ্র।
“না রে রুদ্র বাড়ি না।আমারও একটু খোলা হাওয়া দরকার।তোদের বাড়ির সামনে সেই পার্কটা আছে না,ওখানে আসছি।”রণর মনেও পুরোনো স্মৃতি চাপ দেয়।

রুদ্রর ফোন কেটে অনেকদিন পর রণ নিজের প্রিয় একটা সাইকেলের চাবি পকেটে ভরে।সাইক্লিংয়ের ড্রেস গায়ে চাপিয়ে সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছে অবাক চোখে একবার জয়ি দেখে ওকে,কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করেনা।
“আমি একটু ঘুরে আসছি”,পুরোনো দিনের মত বলে বেরিয়ে যায় ও।
রাইদের ওখান থেকে ফিরে থেকে কারোর সাথে কথা বিশেষ বলেনি রণ,ঘরবন্দি রেখেছিলো নিজেকে এই ঘন্টাখানেক।
কাল থেকে অনলাইন কাউন্সিলিং শুরু হবে।দিল্লির কলেজটা ফার্স্ট প্রায়োরিটি ওর আর ওর যা রেজাল্ট ওটা হয়ে যাবে শিওর।
রাই কোনোদিনও ওর বিপক্ষে বসে কথা বলবে ভাবেনি রণ।যদিও ভুল হয়তো কিছু বলেনি।কিন্তু প্রচন্ড ভাবে ওর সাপোর্ট চেয়েছিল রণ আজ।
লোকে শুনলে বলবে বাড়াবাড়ি,বলবে কেন রাই নিজেই তো বললো,কিন্তু রণ সম্পর্কের শুরুতেই রাইয়ের থেকে ওতো দূরে যেতে চায়নি।
এরা কেন বুঝছে না আজকাল দূরত্ব কোনো ব্যাপার না হলেও ওর ব্যস্ততা ওকে শহরে ফিরতে দেবে না মাসের পর মাস।আর এটা কয়েকমাসের না তিন বছরের ব্যাপার।

আচ্ছা কাউকে এরকম অবোধের মত,পাগলের মত ভালোবাসা কি অপরাধ?এতদিন রাই মনে ছিল তাই ওকে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা মাঝে মাঝে অসহ্য হলে শেষ অবধি সামলানোর ক্ষমতা ওর ছিল।তাছাড়া এই উপলব্ধি টা ছিল, না দেখলেও কাছাকাছি আছে সেই মেয়েটা।

রাই… রাই… রাই এই একটা নাম সারাক্ষন মনে-হৃদয়ে-মাথায়-অবচেতনে ঘোরে, ও কি করবে?সবাই বলবে ওর লজ্জা গেছে,ও বদলে গেছে। কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশ করাতে এত দোষ?আজ বাবা মম কে ছেড়ে থাকতে পারেনা ও জানে,এমনকি চেন্নাই যখন গিয়েছিল বিয়ে করে তাহলে ওর ক্ষেত্রে ভুল কোথায়?
যার জন্যে ওর এত অস্থিরতা,এত বিরোধিতা সে ও বুঝলো না।দরকার নেই রণর কাউকে।চলে যাবে ও দিল্লি বা অন্য কোনো স্টেটে।আর তিন বছরে ওকে সাধলেও ফিরবে না।যতদিন না রাই ওর ভুল বুঝবে,দেখার জন্যে আকুতি করবে আসবে না ও এই শহরে।দেখা যাক কে পারে?ও তো রাইয়ের মত মহান দেখাচ্ছে না নিজেকে।ওর বোঝা উচিত কষ্টটা।যে কষ্টটা রণ আগেই অনুভব করছে রাইও একদিন ঠিক করবে।

সাইকেল চালিয়ে নিজেকে ক্লান্ত করে দিতে চায় রণ যাতে ‘টায়ার্ড ব্রেইন’ ওই মেয়েটার কথা মনেতেও না আনতে পারে।কাল কাউন্সিলিং এর আগে অবধি রণ ভাববে না ওর কথা,যাতে মন দুর্বল না হয়।চলে যাবে ও দূরে।রাই কে ওর অভাব ও অনুভব করাবেই করাবে।
ও সিওর তিন বছরের আগেই রাই নিজে যেচে ওকে বিয়ের কথা বলবে,নাহলে যে ওর ভালোবাসাই মিথ্যে হয়ে যাবে।

সাইকেল চালাতে চালাতে মাথায় রাইয়ের বিকেলের কথাগুলো আবার ধাক্কা মারে,”রণদা প্লিজ একটু ভাবো,এই মুহূর্তে আমরা দুজনেই কি বিয়ের জন্যে পরিণত?আর আমাদের দু বাড়িতেই এই অনুষ্ঠানটা নিয়ে তাদের অনেক পরিকল্পনা আছে।এভাবে হঠাৎ করে সেটা হয়না।আর তুমি যেখানেই যাও এখন বাড়ি ফিরতে একবেলাও লাগবে না তোমার”,তারপর কিছুটা থেমে বলে,”আর কিছু না ভাবো অন্তত আমার পড়ার কথাটা ভাবো প্লিজ।আমার বাংলা নিয়ে পড়ে শিক্ষকতা করার ইচ্ছে আমি বাদও দিলাম কিন্তু অন্তত শেষ তো করবো পড়াটা?আমি জানি তুমি আমায় স্বাবলম্বী দেখতে চাও,তাহলে কি হলো তোমার হঠাৎ করে?তোমার চরিত্রের সাথে এধরণের ছেলেমানুষি একদম মানায় না।সবাই কি ভাবছে বলো তো?বড্ড লজ্জা করছে আমার”,রাইয়ের এই একটা কথা রণকে প্রকৃত অর্থে ধাক্কা মারে।
রণর ভালোবাসা ওকে লজ্জায় ফেলছে!!
ওর চরিত্রে তার মানে খালি নিজের আবেগ কে দমন করে ভালো ছেলের মুখোশ পরে ঘোরা স্বাভাবিক।ওর ভালোবাসা,ওর এতদিনের অপেক্ষা সব মিথ্যে।

“দেখ রণ আমি সেই স্কুল লাইফ থেকে জানি তুই রাইকে ভালোবাসিস।ওর প্রতি তোর কেয়ার কখনোই স্বাভাবিক ছিলোনা।জানিনা রাই কেন বুঝতে এতদিন সময় নিল! কিন্তু তাও আমি বলবো এত তাড়াতাড়ি সংসারে জড়ানোটা ঠিক হবে না।বড় জটিল জায়গা এই সংসার।সবে তো মাত্র মাস দুই হলো তোরা একে অপরের কাছে সবটা স্বীকার করেছিস,আরো কিছুদিন সময় দে সম্পর্কটা কে।এই বিয়ের আগের সময়ের এরও আলাদা একটা চাৰ্ম আছে।এটাও কিন্তু দরকার।এই অস্থিরতা,এই দূরত্ব তোদের ভালোবাসার টান মজবুত করবে।প্লিজ সময় দে কিছুদিন রাইকে”,রুদ্রর কথা রণকে অবাক করে।এই ছেলেটাই বেশি বকতো,যার বেশিরভাগ ভুলভাল!এত পরিণত কবে হলো ও?

“তুইও তো চাকরির কথা ভাবছিলি বিয়ের জন্য?তাহলে তুই কেন এত তাড়াতাড়ি সংসারে জড়াতে চাইছিস?” রণ এতক্ষন ধরে রুদ্রর গল্প শুনছিলো।

প্রথমে যেন একটু ভাবে রুদ্র,তারপর একটা করুন হাসি হাসে,”কি জানিস রণ তোর ভালোবাসা যত বছরের হোক না কেন তোর সম্পর্ক এখনো নতুন।আমার সাথে সেইখানেই তোর পার্থক্য।এই যে তোকে বললাম না বিয়ের আগের সম্পর্কের চাৰ্ম এটা আর আমাদের সম্পর্কে ছিলোনা।ওতে হিসেব নিকেশের গন্ধ লাগতে শুরু করেছিল।আর একটা বিষয় কি জানিস সমবয়স্ক সম্পর্কে চাপ কিন্তু আসে মেয়ের দিক থেকে, যেটা তোর নেই।আমার মনে হয় বিয়ে মানে ঠিক সব শেষ না,কিন্তু নতুন শুরুর একটা প্রিপারেশন থাকে।আমার আবার সেটা নেই।আমি হতে চেয়েছিলাম ইংলিশের লেকচারার।জীবন অন্য পথে নিয়ে গেল।বাবার কথায় সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা শুরু করে বুঝলাম আমার দ্বারা এটা হবেনা।।তুই বল সব কিছু কি সবার জন্যে?আমি বুঝেছিলাম বলে সময় নষ্ট না করে…ছাড়।যাকে ভালোবাসি সেই যখন বুঝলো না।” হতাশা ঝরে পড়ে রুদ্রর গলায়।
আর রণ এত বছর পর শুধু বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুদ্রর দিকে।এই ছেলেটা সত্যি কি সেই পাঁচবছর আগের ওর সেই বন্ধু! বুঝতে পারে রুদ্রর এই হতাশা কতটা বাস্তব।এই বদলে যাওয়া রুদ্র যে ঐশিকার তৈরি।নিজের বন্ধুর জন্যে মন থেকে খারাপ লাগে রণর।
সত্যি ভালোবাসার জন কে বাদ দিয়ে জীবন বাঁচার চিন্তা কতটা কষ্টের ও নিজে খুব ভালো করেই জানে।তিন বছর অনিয়মিত দেখা হবে ভেবেই ওর সব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে।সেখানে রুদ্র…রণ একটা হাত রাখে রুদ্রর কাঁধে,”ভাবিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।তুইও সময় দে, আর যে ভাবে জীবনটা দাঁড় করাতে চাইছিস সেই চেষ্টা করে যা।যদি তোর ভালোবাসা সত্যি হয়,ঐশিকা ঠিক ফিরে আসবে,মিলিয়ে নিস।আমি নিজে কোনোদিনও ভেবেছিলাম রাই আমার কাছে ফিরবে?তুই দেখিস সত্যি ভালোবাসা কে কেউ উপেক্ষা করতে পারেনা”।
রুদ্র রণর মুখের দিকে তাকায়।পার্কের আবছা অন্ধকারে দুজন দুজনের দিকে দেখে।রণ রুদ্রর পিঠ চাপড়ে চোখের ইশারায় বোঝায় ও একদম ঠিক বলছে।একটা হালকা হাসি ফোটে দুজনের ঠোঁটে।
ঘন্টা খানেক আগের যে চাপা কষ্ট দুজনে বয়ে নিয়ে এসেছিল মনে অনেকটা কম লাগে।একজন বন্ধু অন্যের সংসর্গে এসে মানসিক শান্তি পায়,বিশ্বাস ফিরে পায় নতুন করে।আর অন্যজন রণ রুদ্রর মুখ দিয়ে বুঝতে পারে নিজের ভুলটা।উপলব্ধি করে সময় সত্যি আর একটু দরকার।
বন্ধুরা হয়তো এভাবেই স্বার্থ ছাড়া বারবার একে অপরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।যখন জীবনে কেউ থাকেনা পাশে একজন প্রকৃত বন্ধু ঠিক থাকে।যে কোনো কিছু আশা করেনা।স্বার্থহীন যে একমাত্র সম্পর্ক দেওয়া নেওয়ার হিসেব ছাড়া প্রতিটা মানুষের জীবনে অপরিহার্য হয়।প্রকৃত বন্ধুত্ব জন্ম দেয় প্রকৃত বিশ্বাসের যে বিশ্বাস হয়তো কখনো নতুন ভাবে বাঁচতেও শেখায়।

একটা বড় শ্বাস ছেড়ে কান থেকে হেডফোনটা খুলে ফেলে রণ।একটা যুদ্ধের শেষ হল,হেরে গেল ও সবার ইচ্ছের কাছে।দিল্লির এক নম্বর মেডিকেল কলেজে পাওয়া সুযোগটা আর হাতছাড়া করলো না।আজ রণ খুশি হবে না দুঃখ পাবে নিজেও বুঝতে পারছে না।ও কাউকে বোঝাতে পারলো না ওর মনের অবস্থাটা।এমনকি রাইও কেন বুঝলো না ওর থেকে অত দূরে প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে রণ কিকরে ভালো থাকবে?এখানে তাও সপ্তাহান্তে একবার অন্তত দেখতে পেত।
রণ ওই হসপিটালে সার্ভিস দিয়ে যা স্টাইপেন্ড পাবে ও সংসার চালাতে পারতো,কিন্তু রাইয়ের কেরিয়ার এলোমেলো হয়ে যেত।সত্যি বলতে কি রাই নিজেই তৈরি না বিয়ের জন্য।কিন্তু ও কিকরে পারবে দিনের পর দিন রণকে ছেড়ে থাকতে!ভিডিও কলে কি ছোঁয়া যায় একে অপরকে,ঠোঁট গুলো কি মুক্তি পেতে পারে একে অপরের কাছে!
আজকাল রাইকে খালি আদর করতে ইচ্ছে করে রণর,ইচ্ছে করে শুধু ওর ঠোঁটটা নিজের ঠোঁটে অনুভব করতে।এক একসময় রাইকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে এত প্রবল হয়,যতক্ষন না ওকে বুকে নিচ্ছে অদ্ভুত এক অস্থিরতা কোনো কাজ করতে দেয়না।
কেউ না জানুক,রাই তো এগুলো জানে।শেষ একমাস এই ইচ্ছেটা বাঁধনছাড়া হয়ে গেছে।একটা ছেলে মেয়ের শারীরিক টান এখনো দুজনে সেভাবে অনুভব করতে পারেনা,কারণ প্রচন্ড ভালোবাসা ওকে রাইয়ের অনুমতি বা ইচ্ছে ছাড়া নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে রাইকে ছুঁতে বাধা দিয়েছে।ও শুধু এই একমাস ওকে অনুভব করতে চেয়েছে বারবার নিজের বুকে আর ঠোঁটে।তাই ঠোঁট বা হাতের সাহসী হওয়ার ইচ্ছে এখনো সেরকম হয়নি।

না আবার সেই অস্থিরতা টা ফিরে আসছে,পাত্তা দিলে হবেনা।আজ সামলাতে না পারলে ওখানে গিয়ে তো ও কোনোকিছুতে মন বসাতে পারবে না।
বাবা আর মম এখন বাড়ি নেই,দুজনেই যার যার হসপিটালে।দুজনকেই মেসেজে খবরটা জানিয়ে ল্যাপটপ স্লিপিং মোডে দিয়ে রণ নিজের সিঙ্গেল খাটে গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে।মনে মনে বলতে থাকে,”তোর কথা ভাববো না।চাইনা তোকে আমার।ছোঁবনা তোকে আমি বিয়ের আগে।থাক তুই তোর বাংলার ওপর ভালোবাসা নিয়ে”।
কিন্তু ছটফটানি কমে না।রাইকে একবার জড়িয়ে ধরার,একবার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরার ইচ্ছা মনে নিয়ে একসময় তড়পাতে তড়পাতে ঘুমিয়ে পড়ে ও।
ঘুম ভাঙে নরম হাতের স্পর্শে।কেউ যেন ওর মুখটা আদর করছে,মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।
‘মম ফিরে এলো?’অবচেতনের ভাবনায় চোখ খুলে চমকে যায় রণ।

“তুই?এইসময়?”ওর মাথা থেকে হাতটা ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে রণ।

রাই উত্তর দেয়না।আবার হাতটা চুলে ছোঁয়ায়।মুখে একটা যেন মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে মনেহয়।মুখে হাসিটা না থাকলেও একটা আভা দেখতে পায় রণ,কিন্তু চোখে যেন কষ্টের ছোঁয়া।
হাতটা আর সরায় না,উপুড় হয়ে শোয়া অবস্থায় মুখটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শোয়।রাই জোর করে মুখটা এদিকে ঘোরাবার চেষ্টা করে,কিন্তু মুখে কিছু বলেনা।বেশ কিছুক্ষণ বাধা দেওয়ার পর আর পারেনা রণ।মুখটা ঘুরিয়ে ওর বিছানায় বসে থাকা রাইয়ের কোলে গুঁজে দুটো হাত ওর কোমর আর পিঠ জড়িয়ে ধরে।

পরমুহূর্তেই রাইকে ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দরজার কাছে চলে যায় ও।বাড়িতে রমা পিসি আছে জেনেও নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে আবার ফিরে আসে রাইয়ের কাছে।যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে রণ,সেই ভাবে রাইকে ওর বিছানায় হালকা ঠেলে শুইয়ে দেয়। রাই চোখ বুজে ফেলে রণর বিছানায় প্রথমবার পিঠ ঠেকিয়ে।
কোনদিকে না তাকিয়ে রাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে রণ ওকে জড়িয়ে।আর পারছে না ও নিজের ইচ্ছে গুলো আটকে রাখতে।কিছু না,শুধু ওর শরীরের গন্ধ ফুসফুসে ভরতে ভরতে রাইয়ের টপের তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ওর পেটে হাত রাখে।উত্তেজনা কাঁপিয়ে দেয় রাইকে।আর ঠিক সেই মুহূর্তে রণর অবাধ্য ঠোঁট রাইয়ের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে।
আপাত শান্ত,কারোর ওপর রাগ না করা ছেলেটা এই নিয়ে দ্বিতীয় দিন রাইয়ের ঠোঁটে নিজের অভিমানের বহিঃপ্রকাশ করে।রাইয়ের ওপর দুদিন ধরে জমে থাকা অভিমানের ফল ভুগতে থাকে ওর নরম দুটো ঠোঁট।আর রণর হাতটাও আজ সাহসী হয়ে পেট ছড়িয়ে আরেকটু ওপরে উঠে আসে।রাই বুঝতে পারে রণর মাথা কাজ করছে না ওই মুহূর্তে।কিন্তু কিছুতেই কোনো বাধা দেয়না ও।ও জানে কি লড়াই চলছে ওই ছেলেটার মনে।আজ রাই তো এসেইছিল রণর মনের অনিশ্চয়তা দূর করতে,শহর ছাড়ার আগে ওকে ওর বিশ্বাস,মনের শান্তি ফিরিয়ে দিতে।
কিন্তু হঠাৎ রণর যেন সেন্স ফিরে আসে,চমকে উঠে ও হাত সরিয়ে নিতে চায় রাইয়ের বুক থেকে।কিন্তু রণর ডান হাতটা রাই ওখানেই চেপে ধরে নিজের বাঁ হাত দিয়ে।জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় রণ রাইয়ের দিকে।
“রাই হয়তো ভুল করেছিল রণ দা।কিন্তু আর কোনো ভুল করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনা।আমি জানি আমার ক্ষমতা,তোমাকে ছাড়া কিছুই না আমি।আমার শরীর মন সব জুড়েই তো তুমি আছো রণ দা।তাহলে কেন ভয় পাও!জানোনা আমার কত কষ্ট হচ্ছে।কত দুর্বল আমি তোমায় ছাড়া।শুধু আমাদের দুজনের ভালোর জন্যে,তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তোমাকে বেস্ট সুযোগটা নিতে বলেছি।” ওর মুখের একদম কাছে মুখ রেখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা রণর ঠোঁটে আবার একবার আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায় রাই।
রণ আর পারেনা।মুখটা রাইয়ের কাঁধে গুঁজে রাইয়ের হাত থেকে নিজের ডান হাত ছাড়িয়ে ওটা টপের মধ্যে দিয়েই পিঠ অবধি নিয়ে গিয়ে ওকে আঁকড়ে ধরে।পাগল মত ওর গলায় ঘাড়ে বুকের ওপরে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে,”কেন করলি রাই?কেন ঠেলে দিলি আমাকে তোর থেকে!আমি যে পারিনা দীর্ঘদিন তোর গায়ের এই মিষ্টি গন্ধটা থেকে দূরে থাকতে?আমি তোকে আজ সাত বছর একা ছাড়িনি।প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করেছি আগলানোর।মাঝের দুটো বছর জানতাম অনিকেত আছে,তাও খোঁজ রাখতাম।যখনই মনে হয়েছে তোর আমাকে দরকার সমস্ত ইম্পরট্যান্ট কাজ ফেলে ছুটে গেছি তোর কাছে।বিশ্বাস কর দুমাস আগেও আমি ভাবতাম ভালো কলেজ যেখানে পাবো চলে যাবো।কিন্তু তুই যেদিন আমার কাছে ফিরে এলি মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলাম তোকে ছেড়ে কিছুতেই যাবোনা অন্য সিটিতে।কিন্তু তুই আমায় কেন বাধ্য করলি,বাধ্য করলি আমায় শেষ অবধি।কেন বুঝলি না পারবো না আমি তোকে ছেড়ে থাকতে আর,বিশেষ করে শেষ একমাস তোর সাথে লেপ্টে থাকার পর।তুইও চল আমার সাথে,প্লিজ চল।” রণকে আর সামলাতে পারেনা রাই।এভাবে ও পাগলামো করতে পারে,নিজেকে প্রকাশ করতে পারে কোনো দিন ভাবেনি রাইমা।ওর চোখটা আনন্দে ঝাপসা হয়ে যায়।দুহাত দিয়ে রণর মুখটা ধরে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে।সেখানেও ছটফট করতে করতে একসময় শান্ত হয় রণ।রাই দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওকে,আর রণ ওর শরীর ছুঁয়ে একই ভাবে দুহাতের বেড়ে জড়িয়ে ধরে রাইকে।শুয়ে থাকে চুপচাপ।

কিছুক্ষন পর রাই আলতো করে ডাকে রণকে,”ওঠো এবার রণদা।পিসি আছে নীচে।যদি কোনো কারণে উঠে আসে খুব খারাপ ব্যাপার হবে।” রাইয়ের কথায় রণ আরো চেপে ধরে ওকে,মুখটা চেপে দেয় ওর বুকের খাঁজে।আরও একবার কেঁপে উঠে রণকে নিজের থেকে আস্তে আস্তে আলাদা করার চেষ্টা করে রাই।কিন্তু রণ যেন কিছুতেই ছাড়বে না ভেবে ছেলেমানুষের মত জড়িয়ে থাকে।
রাই আবার প্রমান করে একটা ছেলের থেকে হয়তো একটা মেয়ে অনেক পরিণত হয়।শত কষ্ট বুকে চেপেও সে এগোতে সাহায্য করে ছেলেটাকে।যাকে ছাড়া নিজে অসহায় বোধ করে তাকেও ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে তার স্বার্থে।
দূরে ঠেলে না, ভালোবাসা দিয়েই সম্ভব কাউকে বোঝানো।ভালোবাসা পারে শক্তি জোগাতে।হয়তো একটা মেয়ে যেমন পারে সাথে কেউ আছে জানলে অসাধ্য সাধন করতে,তেমন একই অনুভূতিতে ছেলেটা পারে নিজের মনের প্রতিকূলতা জয় করে চ্যালেঞ্জ নিতে।
রণর ভালোবাসা রাইয়ের রক্ষা কবজ,আর রাইয়ের ভালোবাসা রণর শক্তি।
সেই ভালোবাসার জোরেই রাই নিজের কষ্ট চেপে রণকে পাঠাতে চাইছে অন্য শহরে।ওর যে বিশেষ দরকার রণর থেকে কিছুদিনের জন্য হলেও দূরে থাকার।রণকে বুকে নিয়েই ও নিজের ডানদিকের ব্রেস্টের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় হাত রাখে, ‘না আর দেরি করা যাবেনা।খুব তাড়াতাড়ি রণ শহর ছাড়লেই ওকেও যেতে হবে ঋষি আঙ্কেলের হসপিটালে।অনেক দিন পর আবার নিজের দরকারে স্ক্রিনিং টেস্ট করাতে’।

ক্রমশ…