মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-২১

0
372

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#একবিংশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“রণ এবার উঠি রে।তুই তো এয়ারপোর্টে যেতে বারণ করছিস।তবে কাকু তোর সঙ্গে যাবেন বলছিলেন বারণ না করলে পারতিস।আগে তো কোনোদিন দিল্লি যাসনি।অচেনা শহর।” রুদ্র রণর বেরোনোর দিন সকালে এসেছিল দেখা করতে।
জয়ি চেয়েছিল রবিবার সকালের ফ্লাইটে যাক ছেলে কিন্তু শনিবার সন্ধ্যের প্লেনের টিকিট আগেই কেটে নিয়েছিল রণ।অভিমান এখনো মনে জায়গা ছাড়েনি ওর,তাই বাবা মা বলার আগেই যাওয়ার ব্যবস্থা নিজেই করে ফেলেছিল।ঋষি চেয়েছিল সাথে যেতে,কিন্তু সেখানেও আপত্তি জানিয়েছিল ও।

রুদ্র আজকাল রণর সব খবরই রাখে।এখন জায়গা বদল হয়েছে,রুদ্র সম্পর্কের আগুনে পুড়ে পরিণত হয়েছে।তাই অত্যধিক অভিমান রণকে অবুঝ করলেও রুদ্র দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়েছে এই কদিন।

“না রে হোস্টেলে অ্যাকোমোডেশন পেয়ে গেছি আর চিন্তা কি?এমনিও শেষ কবছর কোভিডের জেরে সেশন কয়েকমাস পিছিয়ে গেছে।ফলে শুরুর দিন থেকেই শুরু হয় চাপ।মানডে থেকে হয়তো পুরো শিডিউলে ক্লাস শুরু হবে,তাছাড়া আমি স্টাইপেন্ড পেতে সার্ভিস দেব,ওটা এক্সপেরিয়েন্স বাড়ায়।সব মিলিয়ে আমি খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়বো।তাই বাবা কদিনের জন্যে এখানকার কাজ ছেড়ে যাওয়ার মানে হয়না।আই’ল ম্যানেজ।” রণ এটা মন থেকেই বলে।

রুদ্র ঘাড় নেড়ে সমর্থনের ভঙ্গি করে এগিয়ে আসে বন্ধুর দিকে।রণ উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বন্ধুকে।একে অপরের পিঠ চাপড়ে দেওয়ার সময় রণ কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেলে,”রাইয়ের একটু খেয়াল রাখিস রুদ্র।আমি থাকবোনা এখানে,ওর দরকারে তোকেই ফোন করবো ওই দূর থেকে কিন্তু”,রণর গলা অসহায় শোনায়।

“আরে এটা আবার বলার মত কথা।চিন্তা করিসনা এখানে আমরা সবাই আছি।তুই তোর খেয়াল রাখিস।” শেষবার রণর সাথে হাত মিলিয়ে বেরিয়ে যায় রুদ্র।
রণ নিজের সিঙ্গল বেডে গিয়ে শোয়,একটু গড়িয়ে নেওয়ার অছিলায় চোখ বোজে।কিন্তু ঘুমের বদলে টুকরো কথা,টুকরো স্মৃতি ভিড় করে আসতে থাকে মনরাজ্যে।

জন্ম থেকে না হলেও জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মা কে হসপিটাল যেতে দেখেছে ও।তাই ছোট থেকেই স্বাবলম্বী,মম কিছুটা সেই ভাবেই মানুষও করেছে ওকে।তাও ওর মনে কোনো অভিমান জন্মায়নি মমের ওর প্রতি কেয়ার নিয়ে।ওকে স্কুল পৌঁছে দেওয়া বা সন্ধ্যেবেলা হোমটাস্ক করানোর স্মৃতি গুলোও আজ মনে জ্বালা ধরাচ্ছে।ওর মম ‘মা’ কম,’বন্ধু’ বরাবর বেশি,আর সেটাই সারাজীবন রণর ভরসা।
এমবিবিএস পড়তে হোস্টেল গেলেও সেটা বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার অনুভব ছিলোনা।কিন্তু আজ বড্ড মন খারাপ করছে।একটা চব্বিশ বছরের ছেলে,তার ওপর ডাক্তারি পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের মধ্যেই অন্য শহরে যাচ্ছে মাত্র,তার এই ‘হোমসিকনেজ’ বড্ডই বেমানান রণ নিজেও বুঝছে।তাও সামলাতে পারছে না নিজেকে।
রাই কাউন্সিলিং এর আগে যতটা ওকে বুঝিয়েছিলো,গত কদিন ওরও উৎসাহ বিশেষ দেখছে না রণ।যেন একটু বেশিই চুপচাপ।রণ বুঝেছে এই বিষাদের কারণ,কিন্তু ওই যে ওর প্রতিও একটুকরো অভিমান মনের কোথাও এখনো আছে,তাই ওর মন ভালো করার চেষ্টা করেনি।
কাল রাইদের ফ্ল্যাটে গেছিল জয়ন্ত আঙ্কেল কে ‘বাই’ করে আসতে।আঙ্কেলের ডিউটি আবার সন্ধ্যের শিফটে হয়ে গেছে,তাই দেখা হলেও কথা বিশেষ হয়নি।ওর পিঠ চাপড়ে ভালো থাকার পরামর্শ দিয়ে বেরিয়ে গেছিল আঙ্কেল।এখনো সুলেখা মাসি ফেরেনি ওখানে।তবে মাসি বলেছে আসবে।

আঙ্কেল বেরিয়ে যেতে রাই ওদের মেইন গেট লক করে এসে বসেছিল রণর পাশে।
রণ জানেনা কেন বড্ড চোখ মুখ শুকনো লাগছিলো রাইয়ের,এমনকি ফর্সা মুখে চোখের নিচের কালির পোঁচটাও চোখে পড়ছিল বেশি।
“কিরে ডার্ক সার্কেল কেন চোখে?” নিজেকে আটকাতে পারেনি রণ,যতই এড়িয়ে যেতে চায় না কেন!
চুপ করে ছিল রাই, আজ কদিন বড্ড ক্লান্ত লাগছে।সেটা রণ দূরে চলে যাচ্ছে সেই মানসিক অস্থিরতার জন্যে না শারীরিক কিছু কারণে বেশি ভাবেনি ও।
রণর আর ওই নিয়ে কিছু বলেনা।সেদিন ওর ঘরে রাইকে ছোঁয়ার পর থেকেই ওর মন খারাপ বেশি বেড়েছে।বয়সের কারণে নিজের জনের শরীর কে ছোঁয়ার ইচ্ছে তো থাকেই, কিন্তু রণ রাইকে অনুভব করতে চায় ওর সাথে লেপ্টে থেকে।সারাজীবন রাইকে আগলে আশ্রয় দেওয়া রণ এখন রাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে আশ্রয় পেতে চায়।ওই জায়গাটা আজকাল বড্ড প্রিয় লাগে ওর,যদিও এরপর সেভাবে ওর কাছাকাছি যেতে পারেনি রণ।
সেই মুহূর্তের একই ইচ্ছেকে দমিয়ে ও বলে,”কাল যাবি তো এয়ারপোর্টে রাই?শহর ছাড়ার শেষ মুহূর্ত অবধি তোকে দেখতে চাই আমি”।
“যাবো”,ক্লান্ত গলায় উত্তর আসে।কিন্তু সেই ক্লান্তি মনের কষ্টের প্রকাশ বলে রণ উপেক্ষা করে।রাইয়ের এই কষ্ট যে ওকে শান্তি দেয়।যে মনের দহনে ও পুড়ছে প্রতিনিয়ত রাইও সেটা অনুভব করুক সেটাই তো চেয়েছিল রণ।
আসার সময় রাইকে জড়িয়ে ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতে চেয়েছিল রণ,কিন্তু রাইয়ের অন্যমনস্কতা ওকে বিরত করে।বড্ড যেন অচেনা লাগে শেষ দুমাসে দেখা রাইয়ের থেকে।
“আসছি”,বলে বেরিয়ে এসেছিল রণ।সম্পর্কে আসার পর এই নিয়ে দ্বিতীয় বার ওর বাড়ি থেকে ওকে একটুও আদর না করেই চলে এসেছিল ও।

“কিরে শুয়ে আছিস?” জয়ি দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ করে ছেলের ঘরে উঁকি মারতে আসে।এই প্রথম রণ ওকে ছেড়ে অত দূরে যাচ্ছে।যতই ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মুখ চেয়ে নিজের স্বামীকে সমর্থন করুক না কেন যেদিন ফাইনাল হয়েছে সব কিছু সেদিন থেকে জয়ির বুকের ভেতর টা খাঁ খাঁ করছে।
আজকের এই সময়ে দিল্লি মোটেই খুব দূরে না,চাইলেই রণ ওদের কাছে বা ওরা রণর কাছে অনায়াসে ছুটে যেতেই পারে,তাও মায়ের মন কি সহজে মানে!!
এমবিবিএস পড়তে প্রতি সপ্তাহান্তে আসতো, তাও কোনো উইকেন্ডে আসতে না পারলে মন খারাপ হত জয়ির।আর এবারে তো অভিমান করে খালি বলছে,’চাপ থাকবে তিন বছর আসবো না’।
রণ এতটা ছেলেমানুষি করবে জয়ি হয়তো ভাবেনি,তবে ওর এই ছেলেমানুষি আশ্বস্ত করেছে জয়িকে।রেশমার মেয়ে অন্তত জীবনে এবার অনেক ভালোবাসা আর যত্ন পাবে।
“মন খারাপ করিসনা রণ।ছোট থেকে তুই অনেক বুঝদার,আর সেটাই আমার অহংকার ছিল।আমি তোকে ভুল বুঝছি না।কিন্তু যে সুযোগ কেউ পায়না,তুই পেয়ে ছেড়ে দিবি?আমার কষ্ট হচ্ছে না বল!তুই এখন ডাক্তার,তোর এখন অনেক দায়িত্ব।আমার বিশ্বাস তুই জানিস আমরা কেন তোকে ফোর্স করেছিলাম”,জয়ি রণর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে।
“হমম”,রণর সংক্ষিপ্ত জবাবে জয়ি বোঝে ছেলের অভিমান এখনও আছে।
“রণ রাই এর দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম রেশমা মারা যেতে।কিন্তু আমি জানি সেই দায়িত্ব এতদিন তুই পালন করেছিস।একটা সময় আমি ভয় পেয়েছিলাম,যদি জয়ন্ত ভুল বোঝে।যদি তুই মেয়েটা কে ভালো না রাখিস,কেরিয়ার গোছাতে গিয়ে অবজ্ঞা করিস সব মিলিয়ে প্রথমে মন মানেনি।তুই আজ আমার মাথা উঁচু করেছিস।আমি জানি তোর থেকে বেশি ভালো রাইকে আর কেউ বাসতে পারবে না।আমি তোকে কথা দিলাম এই তিন বছর রাই আমার দায়িত্ব।তুই প্লিজ ভালোমনে হাসিখুশি এই শহর ছেড়ে যা।প্লিজ”,জয়ি ছেলের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল ,সেই জায়গা থেকে বলে রণকে।রণর মানসিক টানাপোড়েনের কারণ ভালো বুঝতে পারে তার মা।
রণ নিজের মায়ের মুখের দিকে এবার সরাসরি তাকায়।তারপর ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে মাথাটা মায়ের কোলে তুলে দেয়।
জয়ি আর কিছু না বলে ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
“জানিস রণ রেশমা নিজে বাবা মার ভালোবাসা পায়নি বলে রাইয়ের ব্যাপারে খুব সচেতন থাকতো।ও কোনোদিনও রাইয়ের বিয়ে সংসার এসব নিয়ে ভাবতো না,কিন্তু নিজে স্বাধীনচেতা,পরোপকারী মেয়ে ছিল বলে চাইতো রাইও নিজের পায়ে দাঁড়াক।একটা সময় জয়ন্তর সাথে আমাদের যোগাযোগ বিশেষ ছিলনা।কিন্তু রেশমার সাথে ছিল।রাই খুব শান্ত ছিল ছোট থেকে,তাই রেশমা ওকে নিয়ে সবসময় ভাবতো। তুই রাই কে এবাড়ি নিয়ে আসার বিপক্ষে ছিলিস,সেই তুই যখন ওর ব্যাপারে বেশি খবর রাখতিস,ওর খেয়াল রাখতিস আমি সত্যি ভয় পেয়েছিলাম।ভয় পেয়েছিলাম রাইয়ের জন্যে।সত্যি বলছি তোর মা হয়েও ভয় করেছিল।তোরা এখনকার ছেলে,জীবনের গতিতে ছুটতে গিয়ে যদি মেয়েটা কে ফেলে এগিয়ে যাস।তোকে হাতের তালুর মত চিনলেও পরের মেয়েটা তো দায়িত্ব ছিল আমার।তাই…কিন্তু বিশ্বাস কর এখন আমার থেকে খুশি আর কেউ নেই।ওকে নিয়ে ভাববি না।আমি আছি তো।” জয়ি ছেলের সাথে এই প্রথম এত খোলাখুলি কথা বলে।

“মম।রাইকে আমি শুধু ভালবাসিনা,প্রচন্ড আগলে রাখতে চেয়েছি সেই প্রথম থেকে।আমাদের বাড়ি আসার পরও ও খালি কাঁদতো,একা থাকলেই কাঁদতো।তোমাদের সামনে বুঝতে দিত না।কিন্তু আমি বেশ কয়েকবার দেখে ফেলেছিলাম।প্রচন্ড ইনসিকিউরিটি তে ভুগতো ও।নিজের প্রতি ভালোবাসা ছিলোনা।সেই সময় আঙ্কেলের ব্যবহার ওকে কষ্ট দিয়েছিল।তোমায় বিশ্বাস করতো, ভরসা করতো কিন্তু তোমার কাছেও পুরো খুলতো না নিজেকে।কেন জানিনা আমার খুব কষ্ট হত।যেদিন ও হোস্টেল যাওয়ার ভয়ে ছাদে একা একা কাঁদছিলো ভীষণ বিবেক দংশন হয়েছিল আমার।যে আমি চেয়েছিলাম ও না থাকুক,সেদিন সেই আমি ওকে বুঝিয়ে ছিলাম এখানে থাকতে।ওর চোখ,ওর ম্লান হাসি,ওর চুপচাপ থাকা আমায় খুব মন খারাপ করাতো।ওর বন্ধু হতে,ওর মনের কাছে যেতে,ওকে বিশ্বাস করাতে আমার সময় লেগেছিল।আর তখনই শুধু ভালোবাসা না একটা মায়া,একটা মমতা জন্ম নিয়েছিল ওর প্রতি।ওর জন্যে সব ভালো করতে চাইতাম ওর মুখে একটু হাসি দেখার জন্যে।ওর জন্যে কারোর ওপর ভরসা করতে পারতাম না,লোকে শুনলে বাড়াবাড়ি বলবে,কিন্তু জয়ন্ত আঙ্কেলকেও ভরসা করতে পারিনা।শুধু তোমায় ছাড়া।ও ভীষণ চাপা মম।তুমি ওর খেয়াল রেখো।আর স্ক্রিনিং টেস্ট তা যেন রেগুলার করে দেখো।” রণ আজও জানেনা রাই মাঝে দু-তিনবছর স্ক্রিনিং টেস্ট করায়নি।
জয়ি মুখ খুলেও চেপে যায়।এমনি বুঝতে পারে রাইয়ের জন্যে রণর চিন্তা,কিন্তু এই সময়ে আর ছেলের উদ্বেগ বাড়াতে ইচ্ছা করেনা।মনে মনে ভাবে জয়ন্ত বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাইয়ের স্ক্রিনিং টেস্ট আবার শুরু করে আগের মত রেগুলার ছ’মাস অন্তর করাবে।
রণর কথা গুলো জয়ি শোনে,কিন্তু কেন কে জানে আজ ছেলে বাইরে যাওয়ার দিন শুধুই রাইয়ের জন্যে ভাবছে এটা মানতে একটু হলেও কষ্ট হয়।রণকে মানুষ করতে জয়ি কোথাও কোনো কার্পণ্য করেনি,নিজের কেরিয়ার আরো উজ্জ্বল হত যদি রণকে পুরোপুরি আয়ার হাতে ছাড়তে পারতো,কিন্তু ছেলে বরাবর ওর ‘ফার্স্ট প্রায়োরিটি’ থেকে এসেছে।
যতই রাইকে প্রচন্ড ভালোবাসুক, রাইয়ের জন্যে নিজের ছেলের ভালোবাসা মানসিক শান্তি দিক।তাও আজকের দিনে জয়ি চেয়েছিল ছেলের মনখারাপের একটুকরো অংশ হতে।কিন্তু রাইয়ের কথাতেই আলোচনা আটকে থেকে মন খারাপ যখন জয়ি বা ঋষি অবধি পৌঁছলো না সন্তানের আনন্দে উচ্ছ্বসিত মা কোথাও একটু কষ্ট পেল।
কিছুক্ষন পর রণকে বিশ্রাম নিতে দিয়ে জয়ি উঠে পড়ে।রণর কাছে জানতে পারে, রাই ওদের বাড়ি এসে ওদের সাথে রণকে ‘সি অফ’ করতে এয়ারপোর্ট যাবে।অবাক হয়না জয়িতা,ও তো জানতো রাই এবার অধিকারে ভাগ বসাবে।রাইকে মেয়ের মত ভালোবাসা জয়ি হঠাৎ ছেলের বিরহে একটু যেন স্বার্থপর হয়ে যায়।
পরমুহূর্তে নিজের মনের চিন্তায় চমকে ওঠে ও।ছি ছি এ আবার কি! রাই রণ তো ওর দুটো অস্তিত্ব।রাইকে কোনোদিনও নিজের মেয়ের থেকে আলাদা ভাবেনি!তাহলে আজ এসব কি ভাবছে ও! রণর এই উদ্বেগ তো স্বাভাবিক।রাই তো সত্যি সেই কবে থেকে ওর ওপর নির্ভরশীল।আর এটা জয়ি কে তো এতদিন শান্তি দিয়েছে।মা মরা মেয়েটাকে ওর ছেলে বাকি জীবন সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে জেনে সবচেয়ে বেশি খুশি তো ওই হয়েছিল।রাইয়ের দায়িত্ব ও নিয়েছিল নিজে থেকে,রণ আজ সেই দায়িত্ব পূরণ করেনি শুধু,সম্পূর্ণ করেছে।জয়ি নিজেও ঋষির কাছে সারাজীবন এরকম ভালোবাসাই পেয়েছে,তাই রণকে বুঝতে ভুল করা ওর ভুল।

নিজের চিন্তায় নিজেই লজ্জা পায় জয়ি।রণকে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিতে বলে,ওর চুলটা ঘেঁটে আদর করে বেরিয়ে আসে জয়ি ওর ঘর ছেড়ে।নিজের আত্মবিশ্লেষণ করতে পেরে অনেকটা হালকা লাগছে ওর।

“রাই রেডি হচ্ছিস না কি রে?” জয়ন্ত রাইয়ের ঘরের দরজায় বাইরে থেকে হাঁক দেয়।ও এয়ারপোর্ট যাবেনা,কিন্তু রাইকে রণদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওর সাথে দেখা করে আসবে।আজ যদিও জয়ন্তর ডে অফ।তাও রণ-রাইয়ের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে এয়ারপোর্টে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।
“না বাবা একটু শুয়ে ছিলাম,এবার রেডি হবো।ওরা তো পাঁচটা নাগাদ বেরোবে বলেছিল,তাই…”,ক্লান্ত স্বরে উত্তর দেয় রাই।কানে লাগে জয়ন্তর।
কদিনই একটু চুপচাপ আছে মেয়েটা।রণর বাইরে যাওয়ার কারণে ভেবে বিশেষ খোঁচায়নি জয়ন্ত,কিন্তু আজ গলাটা বড্ড যেন ক্লান্ত লাগছে।
ও ভেবেছিল রাই হয়তো দুপুরেই চলে যাবে রণর বাড়িতে,সেটাই স্বাভাবিক ছিল।কিন্তু ওকে অবাক করে মেয়ে বললো,’ওরা তো সন্ধ্যে নাগাদ বেরোবে,আমায় বিকেলে পৌঁছে দিও’,অবাক লাগলেও মুখে কিছু বলেনি জয়।
হঠাৎ জয়ের চিন্তা হয়ে যায়,কিছু লুকোচ্ছে না তো মেয়েটা।শেষ এক সপ্তাহ বড্ড চুপচাপ আছে,যেন নিজের মধ্যে কোনো চিন্তায় ডুবে আছে কি!কি এত ভাবছে রাই?নাকি মুখে যাই বলুক রণ দূরে চলে যাওয়ায় ইনসিকিউরিটি তে ভুগছে!

কদিন আগে জয় ইনডিরেক্ট রাই কে স্ক্রিনিং টেস্ট এর কথা বলেছিল,তবে এটা বলেনি ও জানে রাই ওর জন্যে বন্ধ করে দিয়েছিল ছমাস অন্তর এই রেগুলার চেক আপ।
জয়ন্ত কে অবাক করে শান্ত গলায় রাই বলেছিল,”নেক্সট উইকে যাবো ঋষি আঙ্কেলের হসপিটালে,রণ চলে যাক”।
যদিও জয়ন্ত বোঝেনি রণর যাওয়ার সাথে রুটিন চেক আপের কি সম্পর্ক!তাও বিশেষ কিছু বলেনি।কিন্তু মনে মনে ভেবে রেখেছে এই সপ্তাহে রাই না গেলে ও নিজে নেক্সট উইকেন্ডে সঙ্গে করে ওকে নিয়ে যাবে।

রাই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নিজের কাবার্ডের দিকে এগোয়,আজ ঠান্ডা ভালোই আছে।তাই জিন্স আর জ্যাকেট পরবে ভাবে।পরমুহূর্তে কি ভেবে কুর্তি আর লম্বা কার্ডিগানটাই বের করে।ইদানিন ঢিলেঢালা পোশাক বেশি আরাম লাগছে।একটা অদ্ভুত ভয় ঢুকেছে ওর মনে,রণর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়।রণর পড়তে যাওয়া আটকে যাওয়ার ভয়।
বেশ কিছুমাস ধরেই ডান দিকে ব্রেস্টের নিপলে একটা চিনচিনে কষ্ট হত।একটা ক্লান্তি ভাবও ছিল শরীরে।কিন্তু রণর সাথে সম্পর্কের শুরুর ওই দিনগুলোয় এইসব নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি ও।কিন্তু রণর রেজাল্টের দিন চান করার সময় সাবান মাখতে গিয়ে ডান দিকের আর্মপিটে যখন উঁচু শক্ত অংশ হাতে ঠেকলো বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল ওর,মনে পড়েছিল ঋষি আঙ্কেলের কথাগুলো।তারপর ভালো করে পুরো ব্রেস্টটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আরো বেশ কতকগুলো শক্ত অংশ হাতে ঠেকেছিলো।মুহূর্তে ভেসে উঠেছিল মায়ের মুখটা আর তার সাথে সেই ভোরবেলার স্বপ্নটা ও।তারপর মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল যখন নিপল চেক করে দেখেছিল হালকা একটা রস মত বেরোচ্ছে।আর ভাবতে পারেনি রাই।
সেই মুহূর্তে ভেবেছিল রণ কে সবটা খুলে বলবে,কিন্তু ও ফোন করার আগেই রণর ফোন এসেছিল।গলাটা ভারী করে ও নিজের ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট জানিয়াছিলো রাই কে।

“তুমি এরকম গলায় এত ভালো খবর দিচ্ছ?মজা করছো নাকি?” নিজের চিন্তা ভুলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল ও।

কিছুক্ষন চুপ থেকে রণ বলেছিল কারণটা,”বাবা মা চাইছে এই রেজাল্টে আমি ইন্ডিয়ার টপ কলেজে এডমিশন নি।প্রথম দিকের সব টপ কলেজ কলকাতার বাইরে।আমি রাজি হয়নি,তাই একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে।”

যা বোঝার বুঝে যায় রাই।আর এটাও বোঝে ঋষি আঙ্কেল উপযুক্ত বুঝেছে বলেই রণকে এরকম কথা বলেছে।তবে রণর রাজি না হওয়ার কারণ বুঝতেও অসুবিধা হয়নি রাইয়ের।
“তুমি আগে থেকেই নিশ্চই ঠিক করে রেখেছিলে কলকাতায় পড়বে,তাহলে আঙ্কেল এখন বাইরে যেতে বলছে কেন?আমি যতদূর জানি আঙ্কেল তো কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয় না।” রাই নিজের মনের দ্বন্দ্ব কাটাতে বলে।

উত্তর দেয়না রণ,চুপ করে থাকে।কিকরে বলবে তিনমাস আগে ও নিজেই উৎসাহ নিয়ে বাবাকে বলেছিল প্রথম দিকে যদি র্যাংক থাকে সুযোগ পাবে দিল্লির টপ কলেজে আর অনেক নতুন কিছু শিখতে পারবে।
কিন্তু তখন তো রাই ছিলোনা জীবনে,আর রাই কে অন্যের হতে দেখতে পারবে না বলে পালাতে চেয়েছিল ও।কিন্তু আজ…
“আমি এখন পারবো না কলকাতা ছাড়তে,আগে নিজেই চেয়েছিলাম…”,এটুকু বলেই চুপ করে যায় রণ।
“রণদা…”,রাই বুঝতে পারে রণর এখন সমস্যা কোথায় !
“না তুই কিছু বলবি না।তুইও জানিস তিন বছরের জন্য কলকাতা ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে এখন সম্ভব না।আর আমি কারোর কথা শুনবোও না”।

রণর সেদিনের কথা রাইকে নিজের কথা বলতে দেয়না।ও বুঝে যায় রণকে বাইরে যাওয়ার জন্যে রাজি ওকেই করাতে হবে আর যতদিন না রণ এডমিশন নেয় ওকে চেপে থাকতে হবে ওর উদ্বেগ।

নিজেকে হালকা সাজে সাজিয়ে আয়নার সামনে থেকে সরে আসতে গিয়ে নজর যায় নিজের মুখে।কিছু ভেবে চোখের নিচে ক্লান্তি আর চিন্তায় যে ডার্ক সার্কেল তৈরি হয়েছে তাতে একটু ফাউন্ডেশন লাগিয়ে চেষ্টা করে হালকা করতে।রণর চোখকে ফাঁকি দিতে ও কোনোদিনই পারে না,শুধু নিজের মন খারাপ আর অভিমানে ডুবে থাকায় ওকে খেয়াল কম করছে কদিন এই যা ভরসা।
ঘরের বাইরে এসে রাই দেখে জয়ন্ত রেডি হয়ে বসে আছে।ও নিজে বলেছিল জয়ন্ত কে এয়ারপোর্টে যেতে,রাজি হয়নি ও।
রাইকে দেখে উঠে দাঁড়ায় জয়।”চল রাই, এরপর দেরি হয়ে যাবে”,এগিয়ে যায় রাইয়ের বাবা দরজার দিকে।

আজকাল ছাদটা বড্ড আপন লাগে রুদ্রর,ওর মতোই যেন বড্ড একা।আসলে একটা বয়সের পর বাবা মা ভাই বোন বন্ধুর পরও একাকীত্ব ঘোচাতে একদম নিজের কাউকে লাগে।বিশেষ করে অনেকদিন ধরে কেউ সেই জায়গাটা জুড়ে থাকার পর চলে গেলে একাকিত্বে তৈরি হয় একটা শূন্যস্থান,যেটা সহজে পূরণ হয়না।
ঐশি কে এই জীবনে কিকরে ভুলবে ও জানেনা!তবে প্রতি নিয়ত চেষ্টা করছে।এমবিএ এন্ট্রান্স দিয়ে ফুল টাইম পড়া সম্ভব না ওর পক্ষে,তাই ডিস্ট্যান্স লার্নিং কোর্সে ভর্তি হবে ঠিক করেছে।
রণ কতগুলো লিড দিয়েছে,আর ঋষি আঙ্কেল ও সাহায্য করেছে।কোনো না কোনো কোম্পানি তে চাকরি ও একটা ঠিক পেয়েই যাবে।
রোজ ছাদে এসে পায়চারি করতে করতে ঐশির নম্বরে একবার ডায়াল করে রুদ্র।আজ অবধি রোজ ফোন বেজে যায়,ঐশি রিসিভ করেনা।প্রতিদিন ফোন কেটে ও ভাবে কাল থেকে আর ট্রাই করবে না।কিন্তু পরের দিন আবার হাত আর মন নিশপিশ করতে থাকে ছাদে এলেই।

একটু অবাক ও লাগে রুদ্রর,এখনো কেন ওর নম্বর ব্লক করেনি ঐশি?
আজ ও ভেবেই রেখেছে কোনোভাবে ওই নম্বরটায় কল করবে না।এভাবে তাহলে ও কোনোদিনও বেরোতে পারবেনা ঐশির অতীত থেকে।প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে একটা অপেক্ষা ওকে টেনে রাখবে পিছনে।ও চাইলেও অতিক্রম করে যেতে পারবে না ওর ফেলে আসা সময়টা।
ঐশিকা কে ওর মা’ও ভালোই চেনে।কিন্তু আজকাল মা ও রুদ্রকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়না।মেডিকেলে চান্স না পেলেও ছেলে ভবিষ্যতে বড় কোনো পোস্টে অফিসারের চাকরি করবে এই স্বপ্ন এই ক’বছর ঐশিকার মত ওর মা’ও দেখতো।কিন্তু কয়েকমাস চেষ্টাতেই হাল ছেড়ে ও যখন প্রাইভেট চাকরির দিকে ঝুঁকলো মা’ও মুখ ফেরাল ওর বান্ধবীর মতোই।কষ্ট করে কনভেন্টে পড়িয়ে ছেলে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হবে মা’র পক্ষে মেনে নেওয়াও সম্ভব হয়নি।
হঠাৎ রুদ্রর শীর্ষার কথা মনে পড়লো।সেদিন আসলে রণ বলছিল ওর কথা,তাই হয়তো অবচেতনে ছিল।
শীর্ষা ওর ফেসবুকে অনেক বছর থেকেই অ্যাডেড।কিছু না ভেবেই রুদ্র মেসেঞ্জারে কল করলো শীর্ষা কে।
ফোন বেজে গেল,শীর্ষা ধরলো না।ফোনটা কেটে একটা করুন হাসি হাসলো রুদ্র।বিদেশে এমডি করতে যাওয়া বন্ধুটা কি আর রুদ্রর মত বন্ধুকে কে মনে রেখেছে! নিজের চিন্তা,হতাশা মধ্যে থেকে হেরে যাওয়া মানসিকতার রুদ্র ভেবেই দেখলো না শীর্ষার ওখানে সবে ভোর হয়েছে।আর ‘লেট রাইজার’ শীর্ষা এখনও ঘুমের জগতে স্বপ্ন দেখছে।নিজের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম নেওয়া হীনমন্যতা ওকে আজ আবার কষ্ট দিলো।
গায়ের জোরে ফোনটা অফ করে ট্রাউজারের পকেটে ভরে রাখলো রুদ্র,আর সেই মুহূর্তে ঐশিকা কল সুইচে ক্লিক করলো রুদ্র কে কল ব্যাক করতে।
আজ ওর পাকা দেখা ছিল,ছেলেরা এক দেখায় পছন্দ করে গেছে ঐশি কে।হাই প্রোফাইল ছেলেটার কথাবার্তাও যথেষ্ট মার্জিত।এক কথায় বিয়ের বাজারে টপ ছেলে।
কিন্তু ঐশি খুশি হওয়ার বদলে বড্ড কষ্ট পাচ্ছে আজ।হ্যান্ডসাম,সরকারি গেজেটেড অফিসারকে কেন যে ওই বোকা ছেলেটা হারিয়ে দিলো?!যতবার নিজের হবু বরের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেতে চেষ্টা করলো ততবার মনের মধ্যে উঁকি মেরে গেল রুদ্রর করুন মুখ,আর কানে বাজতে লাগলো শেষবার ফোনে কথা বলা গলাটা।
ঐশি অসহায়ের মত সাজগোজ করা অবস্থাতেই ঘরের দরজা বন্ধ করে ছুটে গেছে তাই ফোনের দিকে।
অবাক হয় ঐশি, কোনো মিসড কল নেই ওর ফোনে।বিগত পাঁচ বছরের সম্পর্কে এই প্রথম ওই নির্দিষ্ট নম্বর থেকে কল এলোনা ঐশির ফোনে।সম্পর্ক কাটার কথা বলার পরও প্রতি বিকেলে একটা অন্তত কল এসেছে বোকা ছেলেটার ফোন থেকে।
ফোন বুকে চেপে নিজের খাটে বসে পড়ে ঐশিকা।আর চিন্তা না করে নিজেই কল করে রুদ্রর নম্বরে।রিঙের বদলে কানে আসে যান্ত্রিক ধাতব আওয়াজ,’যে নম্বরে আপনি এখন কল করছেন সেটি সুইচড অফ আছে,অনুগ্রহ করে পরে চেষ্টা করুন/দ্য নম্বর য়্যূ আর কলিং কারেন্টলি সুইচড অফ,প্লিজ ট্রাই লেটার।’
হতাশায় ফোনটা নিজের বেডেই ছুঁড়ে ফেলে ঐশিকা,মুখ ঢেকে ফেলে দুহাতে।নাহ হেরে যাচ্ছে ও,হেরে যাচ্ছে ওই ছেলেটার ভালোবাসার কাছে।কাছের জন,আপনজন সরে যাচ্ছে,আর উজ্জ্বল হচ্ছে ওই মুখটা।বড্ড ইচ্ছে করছে ওই গলাটা শুনতে,ওই ছেলেটা কে একবার চোখের দেখা দেখতে।

কিছুমাস আগে শীর্ষা যে জায়গায় ছিল,যে মানসিক টানাপোড়েন কষ্ট নিয়ে শহর ছেড়েছিল আজ রণজয় সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে।সেই প্লেনের উইন্ডো সিট,সেই কাঁচের মধ্যে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনের ঝড় সামলানোর চেষ্টা,পার্থক্য এটাই রণর কানের হেডফোন দিয়ে যে গলার আওয়াজ কানের মাধ্যমে অন্তরে ঢুকছে সেটা একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি দিচ্ছে…’আমি সাথে আছি’।হ্যাঁ রণ রাইয়ের গলার আওয়াজ ফোনে বন্দি করেছে শেষ সাতদিন ধরে।

আজ রাইকে জড়িয়ে ধরে বুকে মিশিয়ে নিতে দুবার চিন্তা করেনি রণ,তাও এখনো সেই বুকের হু হু ভাবটা ওকে স্থির হতে দিচ্ছে কই!
রাই ওদের বাড়ি যখন পৌঁছল এয়ারপোর্টে বেরোনোর সময় প্রায় হয়ে গেছে।কিন্তু রাইকে কিছু বলবে বলে নিজের ঘরেই বসেছিল রণ,জানতো ও ঠিক একবার ওপরে আসবে রণর কাছে।
কিন্তু যখন ও বাড়ি ঢুকেও ওপরে ওর ঘরে এলোনা, উল্টে বাবা নীচে নামার ডাক দিলো বাধ্য হল রণ নিজে রাইকে ওপরে ডাকতে।

“বলো রণদা কি বলবে?নীচে সবাই তোমার অপেক্ষা করছে।এরপর বেরোলে দেরি হয়ে যাবে তোমার?” দরজার কাছে দাঁড়িয়েই রণকে বলেছিল রাই।
নিজের প্রিয় খাটে বসে অপেক্ষা করছিল ও রাইয়ের জন্যে,হাঁটুতে কনুই ভর দিয়ে মুখ নামিয়ে বসে থাকা অবস্থায় চোখ তুলে রণ তাকিয়েছিল ওর প্রিয় বন্ধুটার দিকে,কেন হঠাৎ ওকে মেয়েটা এতটা এড়িয়ে চলছে!ও যাতে যাওয়ার সময় ওর অবজ্ঞা পেয়ে কষ্ট কম নিয়ে যেতে পারে সেটা ভেবে!কিন্তু সেটা কি সম্ভব!
খোলা চুলের মিষ্টি রাইকে একটু রোগা আর ক্লান্ত লাগলেও ওর চোখ গুলোর বিষণ্ণতা সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছিল।রণর পড়তে ভুল হয়নি চোখের ওই কষ্টটা।রাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে মুখে কোনো কথা না বলে রণ উঠে গিয়ে নিজের বুকে সজোরে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে।
আতঙ্কিত রাই এই ভয়টাই পাচ্ছিল,সাময়িক সিঁটিয়ে গিয়েছিল ধরা পড়ার ভয়ে।কিন্তু বোকা মেয়েটা বুঝতে পারেনি এভাবে ওর কষ্ট রণ কেন কেউ অনুভব করতে পারবে না,যেমন মায়ের ক্ষেত্রেও পারেনি ওর বাবাও, যতক্ষন না রেশমা নিজে মুখ খুলেছিল।
রণ অনুভব করেছিল রাইয়ের মন ঠিক নেই,কিন্তু শুধু ওর সাময়িক দূরে যাওয়াটাই যে একমাত্র কারণ না সেটা বোঝেনি ও।
“চলো রণদা নীচে চলো।এবার দেরি হয়ে যাবে।আমি তো রইলাম তোমার জন্যে।দেখবে তিন বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে।আমার শিব ঠাকুর তোমার রাইকে ভালো রাখবে,শুধু তোমায় ভালো থাকতে হবে।আমি জানি আমি কিভাবে মনে জোর রেখেছি।কিন্তু প্লিজ শেষ মুহূর্তে আমায় দুর্বল করে দিওনা।তুমি তো নিজে এত দুর্বল ছিলে না।” ধীরে ধীরে রণর মুখটা নিজের কাঁধ থেকে টেনে তোলে ও।তখনও ওর দুটো হাত বেড় দিয়ে রাইয়ের কোমরটা জড়ানো।
চমকে ওঠে রাই রণর মুখের দিকে তাকিয়ে।ঠেলে দরজা থেকে সরিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে আনে ওকে।
“রণ প্লিজ। এরকম পাগলামি কোরোনা।” এতদিন পর রণর কান যা শুনতে চেয়েছিল রাই সচেতন ভাবে সেটাই বলে।
ওর কান্নাভেজা মুখটা দুহাতের মধ্যে নিয়ে করুন গলায় বলে,”আমি তো দুর্বল ছিলাম।তুমি সামলাতে।আজ এইটুকুতে কেন এমন ভেঙে পড়ছো!কার ভরসায় বাকি জীবনের লড়াই লড়বো বলো?সামান্য তিন বছরের দূরত্ব,তাও যখন সুযোগ হবে চলে আসবে,তাতেই এরকম করলে আমি যে পুরো ভেঙে পড়বো।আমার যে লড়ার শক্তি থাকবে না রণ!” রাইয়ের গলার হাহাকারে চমকে ওর চোখের দিকে তাকায় রণ।
সত্যি তো এতদিন রাইকে সামলে রেখেছিলো ও,দুর্বল রাইকে মানসিক ভাবে শক্ত করতে গিয়ে ও নিজে কখন দুর্বল হয়ে পড়লো এতটা নিজেও বুঝতে পারলো না।কিন্তু এক অসহ্য চিনচিনে কষ্ট যে ও আজ সহ্য করতে পারছে না।যতই মনকে বোঝাচ্ছে একটা অজানা মন খারাপ ছেয়ে যাচ্ছে মন জুড়ে।আর সেটাই শেষ মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এসেছে চোখের জল হয়ে।
নিজেকে সামলায় রণ।এবার ও একহাতে রাইকে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতটা রাইয়ের কাঁধের ওপর দিয়ে বাড়িয়ে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দেয় ও।হালকা খট আওয়াজ করে অটো লক হয়ে যায় দরজা।
রণ হাতটা এবার রাইয়ের মাথার পিছনে দিয়ে ওর ঠোঁটটা টেনে আনে নিজের ঠোঁটে।

“লেডিস এন্ড জেন্টেলমেন,গুড ইভিনিং…”,রণর ফোনের রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাইলটের ওয়েলকাম স্পিচে ঘোর কেটে যায়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসে রণ।ছোট থেকে অনেক কিছু পেয়ে মানুষ হয়েছে ও।প্রকৃত অর্থে অভাব বা শূন্যতা কিছুই কোনোদিন বোঝেনি জীবনে।যতদিন না রাইকে দেখেছে ওর কাছে প্রেমের আলাদা কোনো আকর্ষণ ছিলোনা।ছোট থেকে মা বাবার সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক ওকে আনন্দ দিত।খুব ছোটবেলায় বাবাকে মায়ের কাছাকাছি দেখলো বাচ্ছা সুলভ আচরণে রেগেও যেত।কিন্তু কখনো বোঝেনি মা বাবার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।ওই ভালোবাসা,ওই টান চোখে দেখে অনুভব করা যায়না যতদিন না নিজের জীবনে ঘটে।
ওর জ্ঞান হওয়া থেকে কখনো বাবা মা কে আলাদা থাকতে দেখেনি ও,এমনকি মা দিদুনের কাছে গেলেও দুদিনের বেশি থাকেনি।এখন ও সবটা বুঝতে পারছে।এখন ও অনুভব করতে পারে শরীরের টান হয়তো একটা কারণ,কিন্তু ওই একসাথে থাকা সেটার অন্য অর্থ।একটু কথা,একটু খুনসুটি,একসাথে খেতে বসা,বা রাতে ফোনে ব্যস্ত থেকেও অনুভব করা পাশে আমার জন্যে আর একজন আছে।
একটা ভরসা,একটা আশ্রয়,একটা মনের কথা বলার কেউ।যে না থাকলে কিছু ভালো লাগেনা,ফাঁকা লাগে সবটা।ভীষণ ব্যস্ততাও একঘেয়ে হয়।
রাই এখন রণর কাছে সেই বিশেষ একজন।সেই একদম নিজের জন।কাজের শেষে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে যার জন্যে।যার কোলে মাথা দিয়ে শুলে ঘুমে চোখ বুজে যায়।
“তোকে বড্ড দরকার রাই,বড্ড বেশি।কিছুতেই পারবো না তিনবছর এভাবে অপেক্ষা করতে।ফিরে আসবো,খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো তোর কাছে।”

“রাই আমরা আর ওপরে উঠছি না।রাতও হয়েছে আর মনটাও ভালো লাগছে না।জয়ন্ত কে বলিস ফোনে কথা বলে নেব।” ড্রাইভিং সিটে বসে মুখ বাড়িয়ে বলে ঋষি।জয়িতা ওর পাশে বসেছিল আর রাই পিছনে বসলেও নেমেছে জয়িতার দিকের দরজা দিয়ে।
-“আঙ্কেল।” হাত নেড়ে গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়েও থেমে যায় ঋষি।
-“হ্যাঁ বল”,রাইয়ের ডাকে উত্তর দেয়।
-“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।ভেবেছিলাম ওপরে যাবে,বলবো।”
-“কি কথা রাই?এখানে বলা খুব অসুবিধে?” রণর জন্যে মনটা বড্ড খারাপ করছে,একদম ইচ্ছা করেনা ঋষির এই সময়ে রাইদের ফ্ল্যাটে যেতে।কতক্ষণে গিয়ে চুপচাপ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাবে সেটা ও ভাবছে।
-“কাল একবার তোমার হসপিটালে যাবো আগের মত রুটিন চেকআপ করাতে”,রাই একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে ধীর স্বরে বলে।
ঋষি নিজেই যদিও জয়ন্ত কে বলেছিল তাও কেমন একটা খটকা লাগে।
-“খুব ভালো ডিসিশন রাই।আমরাও সেটাই চাই।” এবারে উত্তর দেয় জয়িতা।
রাই মুখে একটা হাসি টানার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।ঠোঁটে ঠোঁট চিপে মুখে হাসির আভাস এনে বলে,”কাল দশটা নাগাদ পৌঁছে যাবো?”
-“তোকে কি জয়ন্ত নিয়ে যাবে?” রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেশি কথা বলা ঠিক না যদিও তাও কৌতূহল চাপতে পারেনা ঋষি।
-“না আঙ্কেল বাবা কিছু জানেনা।আমি একাই যাবো।আর্জেন্ট”,চমকে ওঠে ঋষি রাইয়ের উত্তরে।
-“দাঁড়া রাই আমরা ওপরে যাবো।কথা আছে তোর সাথে”,ঋষির রাইয়ের গলা ঠিক লাগেনা।
-“না আঙ্কেল আজ এই নিয়ে বাবার সামনে কিছু বলতে হবেনা।আমিও চাইছিলাম না বাবা কে জানাতে।কাল দেখা হবে।গুড নাইট”,তারপর জয়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”গুড নাইট আন্টি”।
আর দাঁড়ায় না রাই।হাত নেড়ে বাই করে লিফটের দিকে এগিয়ে যায়।ইদানিন সিঁড়ি ভাঙতে হাঁফিয়ে যায়।আজ রাতে এমনি ওদের মন খারাপ,আর চাপ বাড়াতে মন চায়না।আবার একটা ঝড় ওর জীবনের সাথে ওদেরকেও হয়তো নাড়িয়ে দেবে।আর রণ!!!ভাবতে চায়না রাই।

ঋষি আর জয়ি ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।একটা কিছু খারাপ আন্দাজ করে দুজনের মুখ শুকিয়ে যায়।জয়ির মনে ভেসে ওঠে রণর মুখটা।আর ঋষি?ভাবতেও চায়না এই মুহূর্তে খারাপ কিছু।ও যে সেই প্রথম দিন থেকে জানে রণর মনের কথাটা।
গাড়িতে স্টার্ট দেয় ঋষি,আর সেই মুহূর্তে রণর প্লেন কলকাতার মাটি ছেড়ে আকাশে ওড়ার জন্যে ছুটতে শুরু করে।

ক্রমশ…