মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-২২

0
366

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#দ্বাবিংশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

ডাইনিং হলে বসে টিভিতে চ্যানেল সার্ফ করছিল জয়ন্ত।ঘড়ির কাঁটা নটার ঘর ছাড়িয়েছে।সবে ভাবছে রাইয়ের নম্বরে একটা ফোন করে দেখবে কলিং বেল বেজে উঠলো।
দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালো রাইয়ের বাবা।
-“কিরে ফ্লাইট টাইমে ছিল?”
-“হমম।ল্যান্ড করে ফোন করবে বলেছে।”
রাইয়ের ক্লান্ত স্বর,অবসন্ন মুখটা বড্ড চোখে লাগে জয়ের।
“তুই ফ্রেস হয়ে আয় খাবার রেডি করছি।খেয়ে শুয়ে পর।”

কথা বাড়ায় না রাই, ক্লান্ত পায়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।কাঁধের ব্যাগটা ওর পড়ার টেবিলে রেখে বাড়িতে পরার একটা কুর্তি পাজামা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়।
শীতের রাতে গিজার অন করে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।বেসিনের আয়না দিয়ে তাকায় নিজের দিকে।
চোখের কোলে কালি মুখটার রূপই বদলে দিয়েছে।আয়না দিয়ে দেখে পুরো মুখে হাত বোলায় ও।হঠাৎ নিজেকে বড় একা লাগে।মা চলে যাওয়ার পর মাঝের দুটো বছর বাদে যে ছায়াসঙ্গীর মত সবসময় ওর সাথে থাকতো সে আজ অনেকটা দূরে চলে গেল।এয়ারপোর্টের মধ্যে যখন হাত নাড়তে নাড়তে ঢুকে গেলো রাই জানে সেই মুহূর্ত অবধি তার চোখটা ওর মুখেই নিবদ্ধ ছিল।তাই বুকের অসহ্য কষ্ট আবেগকে সহ্য করেও চোখের জল আটকে রেখেছিলো দাঁত চেপে।
রণ,ওকে নতুন করে জন্ম দিয়েছিল।রণ,ওকে বাঁচতে শিখিয়েছিল।রণ,ওকে হাসতে শিখিয়েছিল।রণ,শিখিয়েছে প্রকৃত ভালোবাসা কি।
প্রেম কথাটা বললে,কোথাও পড়লে বা কারোর মুখে শুনলে আজকাল রাইয়ের মনে রণর মুখটা ভাসে।একই ভাবে বেস্ট ফ্রেন্ড শুনেও অবচেতনে ভাসে রণর মুখ।
রাই আর পারলো না।হঠাৎ মনে হলো যতই কয়েক ঘণ্টার দূরত্ব হোক ও আর চাইলেই রণর বুকে মুখ রেখে ওর দুই হাতের মধ্যে ঢুকে ওকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না।
বেসিন ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো।নিজের হাত দিয়ে নিজের মুখটা চেপে ধরেও আবেগটা আর আটকাতে পারলো না।আওয়াজ আটকালেও কান্নার দমকে পুরো শরীর কেঁপে উঠতে লাগলো।হাত বাড়িয়ে ঠান্ডা জলের ট্যাপটা খুলে দিল জোরে।যাতে জল পড়ার আওয়াজে কান্নার আওয়াজ হারিয়ে যায়।
বেসিন ধরে বাথরুমের শুকনো মেঝেতে বসে পড়লো।
মা কে পুরোপুরি হারিয়ে এভাবেই বাথরুমে বসে পড়েছিল ও,সেদিন ওর জীবনে রণ ছিলোনা।কিন্তু সঙ্গে জয়ি ছিল।সেই বোকা ভীতু বাচ্ছা মেয়েটা সেদিন মা ছাড়া জীবনের দ্বিতীয় কোনো অর্থ বুঝতো না।মায়ের কোলটা হারিয়ে যাওয়ায় প্রচন্ড অসহায় হয়ে পরেছিলো।
আজও রণর রাই বড্ড অসহায় অনুভব করছে নিজেকে।
প্রথম যেদিন রণকে দেখে, প্রচন্ড হ্যান্ডসম মেধার দিক দিয়ে অসামান্য আর ব্যবহারে পরিণত ছেলেটা কে খুব দূরের কেউ মনে হয়েছিল।জয়ি আন্টির ছেলে কোনোদিন ওর বন্ধু হবে সেটাই ও ভাবেনি।আর আজ ও জানে শুধু শরীরটাই আলাদা,আসলে ওর মনের পুরো অধিকার নিয়ে বসে আছে রণ।ওকে ওর থেকেও বেশি বোঝে,বেশি ভালোবাসে ওই ছেলেটা।
পরিণত ওই ছেলেটার মধ্যে এতটা অবুঝ একটা বাচ্ছা মন ছিল রাই জানতেও পারেনি নতুন সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগে।মান অভিমান যে কখনো রণকে ছুঁতে পারে ওকে দেখে কেউ বুঝবে না।আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবার কাছে রণ প্রচন্ড বুঝদার বাস্তববাদী ছেলে।আর রাইয়ের কাছে ওর আজকাল সব ছেলেমানুষি আবদার,কথায় কথায় ঠোঁট ফোলানো।প্রচন্ড অভিমানী রণ আসলে।আর রাইয়ের সেই অভিমানকেই ভয়।যদি সত্যি খারাপ কিছু হয়…রণর অভিমান কে কিকরে সামলাবে ও?
আজ এয়ারপোর্টে রণ ওর সামনেই আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করছিল কবে লাস্ট স্কিনিং টেস্ট হয়েছে রাইয়ের,আঙ্কেল কথাটা ঘুরিয়ে দিলো।কিন্তু সত্যিটা জানলে রণ ওর সাথে সাথে নিজের বাবাকেও ভুল বুঝবে।
“রাই হলো রে?” ওর ঘরের দরজায় নক করছে জয়ন্ত।
তাড়াতাড়ি জলের ট্যাপটা হাত বাড়িয়ে বন্ধ করে রাই মেঝেতে বসা অবস্থাতেই।
“হ্যাঁ আসছি”,যাহোক করে গলা পরিষ্কার করে বলে।

শরীরটা আজকাল এত ক্লান্ত লাগে।তারওপর মনের কষ্ট।সবমিলিয়ে টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায় ও।
শীতের রাতে গরম জলে হাত পা ধুয়ে বেরিয়ে আসে।
“আমি খুব ক্লান্ত রণ।কাল টেস্টের আগের দিন বড্ড তোমায় মিস করছি।বড্ড ইচ্ছে করছে তোমার বুকে মুখ গুঁজে বুকের মধ্যে ঢুকে যেতে।প্রচন্ড ভয় পেলে এখন শুধু না গত পাঁচ বছর ধরে এটাই মন করে।এক এক সময় মনে হচ্ছে কেন তোমায় যেতে দিলাম।আমার যে বড্ড ভয় করছে।আর ভয় পেলেই শুধু তোমার কথাই মনে পড়ে।মা চলে যাওয়ার পর থেকে যে মানুষটা আমায় সবচেয়ে বেশি আগলে রেখেছে,যার কাছে আমি সবচেয়ে বেশি সেফ মনে করি নিজেকে সে আজ আমার থেকে দূরে।পারছিনা বিশ্বাস করো এটা এখন মানতে।বুঝতেও পারিনি এতটা কষ্ট হবে তোমার অন্য শহরে চলে যাওয়ায়।কেন এত ভালোবাসো তুমি আমায়।আজ আমার পায়ে সবচেয়ে বড় বেড়ি তোমার ভালোবাসা।হয়তো কাল রিপোর্ট খারাপ আসবে।কিন্তু বিশ্বাস করো রণ আমি বাঁচতে চাই।আমি চাইনা আমার বাবার মত জীবন তোমার হোক।আমি জানি বাবার জন্যে আমি ছিলাম,তাই সময়ের সাথে নিজেকে সামলাতে পেরেছে।কিন্তু তুমি পারবে না।তোমার ভালোবাসার যে প্রকাশ আমি দেখেছি সেটাই আমার সবচেয়ে ভয়ের।আমার সামান্য কিছু আঘাত তুমি সহ্য করতে পারোনা।ওই কদিন বারবার দেখেছি আমি আর আগের ঘটনা তখন না বুঝলেও পরে রিলেট করতে পেরেছি।রণ দূরে থাকলে হয়তো আমায় ছেড়ে থাকতে শিখবে,আর আমি সেটাই চাই”,নিজের মনের কথা গুলো বিড়বিড় করতে করতে আবার ফুঁপিয়ে ওঠে রাই।

এ’কদিন রণর যাওয়ার কথায় মন খারাপ হয়েছে।কিন্তু ভাবতে পারেনি এতটা ভেঙে পড়বে ও নিজে।আরো কিছুক্ষন চেষ্টা করে নিজেকে সামলে আর একবার ওয়াসরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দেয় ও।তারপর বাইরে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখে ওর অপেক্ষা করে করে জয়ন্ত খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।
জয়ন্ত রাইয়ের চোখমুখ দেখে অবাক হলেও মুখে বলে,”কিরে খাবার গরম করেছিলাম,ঠান্ডা হয়ে গেল তো।বোস তাড়াতাড়ি,খেয়েনে”।
বসে পড়ে রাই চেয়ার টেনে।ওর ফেভারিট পনির কিছুতেই যেন নামতে চায়না আজ গলা দিয়ে।ভাতের থেকেও রুটি যার বেশি প্রিয় তার আজ রুটি যেন গলায় আটকে যেতে থাকে।এমনিতেই আজকাল খিদে হয়না,জোর করেও খেতে পারেনা ও।
জয়ন্ত লক্ষ্য করে রাই খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে,যেন খাবার কোনো ইচ্ছেই নেই।
উঠে আসে জয়ন্ত নিজের চেয়ার ছেড়ে।রাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাত রাখে ওর মাথায়,”কিরে মন খারাপ করছে?তুই তো মনের জোর দেখিয়ে রণকে দূরে পাঠালি।তাহলে আজ মন খারাপ করছিস কেন?তিন বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে।আর তোর কি মনে হয় সুযোগ পেলে ও আসবে না কলকাতা?ছুটি পেলেই দেখবি চলে আসবে।তুই মন খারাপ করছিস জানলে ও আবার ভেঙে যাবে।আমি জানি রণ তোকে খুব ভালোবাসে,আর আমার কোনো চিন্তা নেই তোকে নিয়ে”,জয়ন্ত রাইয়ের মাথায় হাত রাখলেও জানলার কাঁচ দিয়ে দূরে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে থাকে।খেয়াল করেনা রাইয়ের পিঠটা খুব হালকা কাঁপছে।দাঁতে দাঁত চিপে চেষ্টা করছে ও চোখের জল আটকাতে।কিন্তু জয়ন্তর পরের কথায় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা ও।
“আমি খুব খারাপ বাবা রাই।তোর মায়ের চলে যাওয়া মানতে পারিনি।এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম তোকে নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা ছিলোনা।রেশম আমার ব্যাকবোন ছিল,আমার শক্তি।তাই ওকে ছাড়া সারভাইভ করতে পারবো তাই ভাবিনি।তুই বড় হয়েছিস,বলতে হেসিটেশন নেই,তোর মা কে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম আমি।হয়তো প্রকাশ ছিলোনা,কিন্তু জানতাম ও আছে মানে আমি আছি।কিন্তু তাও ও না থাকতেও আমি এতদিন থেকে তো গেলাম।তার কারণ হয়তো তুই।কিন্তু যে সময় পাশে থাকার থাকিনি আমি।আমার অসম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিল রণ।ছেলেটা তোকে বড্ড ভালোবাসে।আমি জানি যে ভালোবাসা অনেক পুরোনো।আর ওর তোকে …রাই,এই রাই।বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেন?…”,জয়ন্ত যখন রাইয়ের মনের অব্যক্ত আনন্দ,খুশি বা ভয়টা মুখ ফুটে বলে দিল সামলাতে পারলোনা রাই নিজেকে।পাশে দাঁড়ানো বাবার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো।
জয়ন্তর জায়গায় রণকে বসিয়ে আঁতকে উঠলো ও।যে ভয়টা অবচেতনে আটকে রেখেছিল জয়ের মুখ দিয়ে ভগবান সেটাই সামনে এনে দিল যেন,যেন একটা আয়না ধরলো রাইয়ের সামনে।
নিজের বাবার অবস্থা কি হবে সেটা তো চিন্তা ছিলই,রণর চিন্তা অবচেতনে লুকিয়ে রেখে,রণকে দূরে সরিয়ে দিয়েও শেষ অবধি লুকোতে পারলো না ভয়টা,অবজ্ঞা করতে পারলোনা না রণর ভবিষ্যৎ অবস্থাকে।
“বা-ব-ব-বা,সরি।সরি বাবা।আমিও ভুল করে ফেললাম।কিন্তু আমি রণকে,তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবো না।আমি বাঁচতে চাই।”
রাইয়ের কথা গুলো জয়ন্তকে যেন শক মারলো।ছিটকে রাইয়ের মুখ টেনে তুলে বললো,”কি-কি-কি বলছিস রাই।এসব কথার মানে কি?”
কোনো উত্তর দেয়না জয়ন্তর একমাত্র অবলম্বন তার বাইশ বছরের মেয়ে।শুধু আরো জোরে আঁকড়ে ধরতে চায় তার বাবাকে।

হোটেল রুমের দরজা লক করে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে রণ।কাল সকালে হোস্টেলে যাবে,আজ এয়ারপোর্টের কাছে এই হোটেলেই রাত কাটাবে ভেবে রেখেছিলো।
চুপ করে কিচ্ছুক্ষন বসে থাকে।প্লেন কলকাতার মাটি ছাড়ার পর বুকের কষ্টটা অসহ্য হয়ে গেছে।কিকরে ও তিনবছর এভাবে কাটাবে ও জানেনা।
ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছাড়িয়েছে অনেক্ষন।ল্যান্ড করেই বাবাকে আর রাইকে আলাদা ফোন করেছিল যদিও তাও আবার রাইয়ের নম্বরে ফোন করে রণ।জানে ও ঠিক জেগে থাকবে।কারণ মুখে যতই হাসি টেনে রাখুক রাইয়ের চোখ এয়ারপোর্টে নিজের কষ্টটা যে কিছুতেই আড়াল করতে পারছিল না।
-“ঘুমিয়ে পড়েছিলি?”
-“না।শুয়ে আছি চুপ করে।”
-“খাওয়া দাওয়া করলি?”
-“হমম।রুটি আর পনির।তুমি কি খেলে?”
কিছুক্ষন চুপ থেকে রণ উত্তর দেয়,”নান পেলাম না এত রাতে।তাই রুটি আর বাটার চিকেন।”
রাই কিছু বলতে পারেনা।আবার একটা কষ্ট দলা পাকায় গলাতে।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রণকে প্রশ্ন করে ও।
-“রণদা একটা কথা রাখবে?”
-“না।কারণ আমি জানি তোর কথা রাখা মানে এমন কিছু করা,যেখানে তুই ছাড়া আমি।আমি সেটা বেঁচে থাকতে পারবোনা।তোকে মনে না করে জীবনের একটা সেকেন্ড কাটানোও আমার পক্ষে সম্ভব না।তুই যখন আমার ছিলি না তখন পারিনি।আজ তো অসম্ভব।”
-“তুমি না শুনেই ভেবে নিচ্ছো।আমি সেভাবে কিছু বলিনি।আমি চাই তুমি এই তিনবছর নিজের ভালোলাগা,পছন্দ,ভালোবাসা এগুলো কেও একটু গুরুত্ব দাও।বিয়ের পর শুনেছি মানুষ চাইলেও একার পছন্দকে প্রশয় দিতে পারেনা।তাই…।” ঘুরিয়ে বলে রাই।
-“তুই ভুল করছিস রাই।আমি গত প্রায় আট বছর ধরে সেটাই করছি।শুধুই নিজের ভালোলাগা কেই গুরুত্ব দিয়ে আসছি।তোকে নিয়ে থাকতে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি আমি।তোর প্রিয় জিনিস বা তোর জন্যে কিছু কিনলে তোকেই অনুভব করি।তোর প্রিয় খাবার খাওয়ার সময় অনুভব করি তোর অনুভূতিটা।তুই আজও বুঝিসনি তোকে ভালোবেসে,তোর পছন্দকে ভালোলেগে আমি সবচেয়ে ভালো থাকি।তোকে ছাড়া জীবনটা শুধুই অসম্পূর্ণ না,শূন্য।যেদিন এটা বুঝবি আমায় তোর থেকে দূরে পাঠাতে চাইবি না।” অভিমান যে মরেনি বুঝিয়ে দেয় রণ।
“দেখ রাই আমি জানি একজন ডাক্তারের প্রফেশন কি?সেখানে ব্যক্তিগত ভালোলাগা,জীবন এগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই।এই আমি আজ তোকে ছেড়ে এতদূর আসতে চাইনি কেন জানিস এরপর আমার জীবনে নিজের জন্যেই কিছু থাকবে না,তো তোর কথা বাদ দে।এই মাস্টার্স ডিগ্রির সময় আমরা স্টাইপেন্ড পাই,তাই এখানে জীবন অনেক ব্যস্ত।কোনোভাবে আমরা এটা ছাড়তে বা নিজেদের ইচ্ছায় কিছু করতে পারবোনা।কিন্তু যতই মানসিক ভাবে নিজেকে তৈরি রাখি এক একসময় নিজেকে সামলানো খুব মুশকিল হয়।মনেহয় তোকে সেই মুহূর্তে না দেখলে বাঁচবো না।হয়তো সাময়িক ইচ্ছা,তাও সেই মুহূর্তে অসহনীয় হয়।আসলে কি বলতো তোকে ঠিক বোঝাতে পারবো না।সপ্তাহে একদিন তোকে দেখা আর বছরে একবার কি দুবার অনেক পার্থক্য।তুই বুঝবি না।”
চুপ করে যায় রণ।

“আচ্ছা রণদা কেন এত ভালোবাসো তুমি আমায়?আজ যদি আমি না থাকি তোমার জীবনে তোমায় কি জীবনটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে না?…হ্যালো,হ্যালো রণদা।হ্যালো শুনতে পাচ্ছো?” ফোনটা কেটে গেছে বুঝতে পারে রাই,শুধু বুঝতে পারেনা নেটওয়ার্ক প্রবলেম না ইচ্ছাকৃত।
কি ভেবে ও রণর নম্বরে আবার কল করে।কিন্তু রণ ফোন ধরেনা।যা বোঝার বুঝে যায় রাই,শেষ কথাটা শুনেই গোঁসা হলো বাবুর।কিন্তু রাইকে এগুলো বলতেই হবে এবার।ও জানেনা ওর কি হয়েছে কিন্তু রণকে মানসিক ভাবে শক্তিশালী এখন থেকেই বানাতে হবে।
কি ভেবে আর কল করেন রাই।ওই তো রণর স্বভাব খারাপ করেছে বারবার মান ভাঙিয়ে।প্রচন্ড বাস্তববাদী ছেলেটা তো ওর কাছেই আদর চায়,ছেলেমানুষী করে।কিন্তু না আর ছেলেমানুষীকে পাত্তা দেওয়া সম্ভব না রাইয়ের পক্ষে।ওকে পারতেই হবে।ছেলেটা কে বাঁচাতে হবে ওকেই।

আজ আর রাই পারেনি একা দুশ্চিন্তার বোঝা বইতে।শেষ অবধি বাবার কাছে ভেঙেই পড়েছিল।জয়ন্ত নিজেও খুব ভেঙে পড়েছে খবরটায়, কিন্তু আজ প্রথম রাই অনুভব করলো বাবার ছায়া কি।
রণ নেই,তাই হয়তো জয় নিজেকে সামলে রাইয়ের ভরসা হয়ে উঠতে পারলো এত সহজে।
বাবার বলা ওই কথাটা রাইকে হঠাৎ মানসিক ভাবে শক্তিশালী করে দিলো।
“রাই কেন এত ভেঙে পরছিস মা।আমি জানি এত পাপও করিনি যে ভগবান একই শাস্তি বারবার দেবে।কিছু হবে না তোর।কাল আমি যাব তোকে নিয়ে ঋষির হসপিটালে।শুধু তুই নিজে মনের জোর রাখ,যে মনের জোরে রণর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ওকে দূরে পাঠাতে পেরেছিস,সেই জোর হারাসনা।তোর বাবা আছে,কোনো খারাপ কিছুকে তোকে অন্তত ছুঁতে দেবে না।”
বাবার ওই গলার জোড়টা মনে নিয়ে চোখ বোজে রাই।আর। অন্যদিকে রণ অবাক হয়,রাই আর ফোন করলো না দেখে।ওর অভিমান,ওর রাগ এত তাড়াতাড়ি ক্লিশে হয়ে গেল ওর কাছে!রুমের আলো আর নেভাতে ইচ্ছা করলো না।বাইরের জামা কাপড় চেঞ্জ না করেই কম্বলটা গায়ে টেনে শুয়ে পড়লো ও,কিন্তু চোখটা আর কানটা রয়ে গেল ফোনের দিকেই।

“আসবো”,ঋষির হসপিটাল রুমের দরজায় মুখ বাড়ায় রাই।
“আয়, আয়”,রাইয়ের জন্যেই অপেক্ষা করছিল ঋষি।সকালে রাইকে ফোন করে পিক করে নিজের সাথেই আনতে চেয়েছিল ও,কিন্তু রাই একটু সময় লাগবে বলায় একাই হাসপাতাল চলে এসে অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে।
রাইয়ের পেছন পেছন জয়ন্ত ঢুকছে দেখে একটু বেশি অবাক হলো ঋষি,বুকটাও কেঁপে উঠলো।’মেয়েটার কিছু হলো নাকি?নাহলে রুটিন চেক আপে বাবাকে এনেছে?’

“কিরে বাবাকে সঙ্গে করে আনবি বলে বুঝি আমার সাথে এলিনা? শুধু শুধু বাবাকে ব্যস্ত না করে আঙ্কেলের সাথেই তো চলে আসা যেত রুটিন চেক আপে!” ঋষি নিজের চিন্তা এড়াতে ইচ্ছা করে বললো।কিন্তু সেই মুহূর্তে লক্ষ্য করলো বাবা মেয়ে চোখাচোখি করলো,যদিও মুখে দুজনের কেউই কিছু বললো না।অত্যধিক টেন্সড লাগছে যেন দুজন কে।

ঋষির টেবিলের উল্টো দিকে বসে মাথা নিচু করে ফেললো রাই, সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্ত হাত রাখলো ওর কাঁধে।এবার ঋষি মনে মনে আর একটু চিন্তায় পড়লো।
“ঋষি রাই তোকে কিছু বলবে আগে।আমি না ফিরতাম না রাইকে এসবের মুখোমুখি হতে হত।বাবাকে মানসিক চাপ মুক্ত করতে গিয়ে…”,জয় লুকোতে পারেনা আর নিজেকে।সারারাত শুধু এটাই ঘুরেছে ওর মাথায়।
“প্লিজ বাবা।”রাই জয়ের হাতটা চেপে ধরে ওকে থামায়।
“হেঁয়ালি না করে কি হয়েছে আমায় কেউ বলবে প্লিজ?” এবার অধৈর্য্য হয় ঋষি।
“আঙ্কেল তুমি টেস্ট শুরু করো।” রাই জানে ঋষি ম্যানুয়াল টেস্টে বুঝে যাবে।তাহলে ওর পক্ষে সহজ হবে ওর সমস্যা বলা।
ভ্রু কুঁচকে তাকায় ঋষি রাইয়ের দিকে।কিছু একটা ঘটেছে,কিন্তু মুখে বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে না মেয়েটা।ঋষি কথা বাড়ায় না,জয়ন্ত কে বসিয়ে রেখে নিজের জুনিয়র ডাক্তার রূপসা কে নিয়ে রাইয়ের পরীক্ষা করতে উঠে যায় ওর ঘরের পর্দা ঘেরা অংশে।
রূপসা রাইয়ের ব্রেস্ট টেস্ট করার সাথে সাথে বুঝে যায় রাইয়ের সমস্যা।চমকে তাকায় ঋষির দিকে,”স্যার রাইট ব্রেস্ট আর আর্মপিটে লাম্পস গ্রো করেছে স্যার।খুব একটা ছোট না।”
ঋষি আগেই অনুমান করেছিল কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস রাই আর জয়ন্তর মুখে।কিন্তু নিজের হতাশা ওকে ভেঙে দিলো।নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না ও।প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো নিজের আর রাইয়ের ওপর।
“আর কি প্রবলেম হচ্ছে বল।” ঋষির এরকম কঠিন গলা আগে কখনো শুনেছে বলে মনে করতে পারলো না রাই।চমকে তাকালো ওর দিকে।তারপর মুখটা নামিয়ে যাতে ঋষিরা শুনতে পায় বাকি সিম্পটম গুলো বললো।
ঋষির পা গুলো দুর্বল লাগছিলো,বয়স হয়েছে বুঝতে পারছিল ও।
“বাইরে আয়”,পর্দা সরিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসলো ঋষি।
নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে রাইও বেরিয়ে এলো ওর পিছু পিছু,আর সাথে রূপসা।
“রূপসা দেখ তো মামোগ্রাফির ওখানে ফাঁকা আছে কিনা।সুব্রত কে বলবি আমি ইমার্জেন্সী পারপাসে এখুনি রিপোর্ট দেখবো।ফাঁকা থাকলে আমায় ফোন করবি”,আর একটা সেকেন্ড নষ্ট করতে রাজি নয় ঋষি।
ও লক্ষ্য করে ওর কথায় জয়ন্তর মুখ শুকিয়ে গেছে।কষ্ট হয়,খুব কষ্ট হয় ওর জন্যে।মাত্র দশ বছর আগের একই দৃশ্য ভেসে ওঠে ঋষির চোখে।নিজেকে সামলে রাইয়ের দিকে এবার মনোযোগ দেয় ও,”কবে থেকে সিম্পটম গুলো ডেভেলপ করেছে আর কবে লাম্পস লক্ষ্য করেছিস?”
“সিম্পটম মানে চিনচিনে পেইন মাস দুয়েক মত হচ্ছে।আর লাম্পস খেয়াল করেছি রণর যেদিন রেজাল্ট বের হলো ওইদিন”,ভাঙা স্বরে সংক্ষেপে বলে রাই।
রণর কথায় ঋষি একটু চমকায়।কি হবে রণর কেরিয়ারের!খারাপ কিছু শুনলে ওকে কি ধরে রাখা যাবে দিল্লি তে!হঠাৎ স্বার্থপর বাবা মনে ঝিলিক দিয়ে যায়।পরমুহূর্তে ঋষি ভাবে,’কি বোকার মত ভাবছে ও।ছেলেকে কিকরে বোঝাবে সামলাবে সেটাই জানেনা,রাইয়ের সামান্য কিছু হলে রণর কি অবস্থা হবে সেটাই বরঞ্চ চিন্তার বিষয়।’
“দু-মাস।আশা করি রণ কিছু জানেনা।জানলে এই দুমাস সময় তুই পেতিস না নিজের অবস্থা এতটা জটিল করার”,আর নিজেকে সামলাতে পারেনা ঋষি।রেশমাকে কিছু বলতে পারেনি ওর মানসিক অবস্থা ভেবে,কিন্তু বয়সের কারণে ধৈর্য্য কমে যাওয়া ঋষি রাইকে শুনিয়েই দেয় দু কথা।
জল ভরা চোখ তুলে তাকায় রাই এবার।
“আমি এখানে ডাক্তার,তাও না জিজ্ঞেস করে পারছিনা।রণকে সঙ্গে সঙ্গে বললি না কেন।কেন দিল্লি না পাঠিয়ে এখানে পড়তে বললিনা” আবেগের বশে কথা গুলো বলে চুপ করে যায় ঋষি।মনে পড়ে এখনো টিউমারের প্রকৃতি বোঝা যায়নি।সব টেস্ট কমপ্লিট হলে এসব ভাববে।সেই মুহূর্তে ওর টেবিলের এক্সটেনশন ফোনটা বেজে ওঠে।
“ঠিক আছে রেডি কর সব।আমি পেশেন্ট নিয়ে যাচ্ছি” ফোন ধরে অপর প্রান্তকে বলে ঋষি।
নিজের জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে রাইকে বলে,”চ আমার সঙ্গে।তুই বাইরে গিয়ে দাঁড়া,আমি আসছি।”
কোনো প্রশ্ন না করে রাই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়।
সেই মুহূর্তে চাপা গলায় ঋষি বলে,”জয়ন্ত তুই এখানে বোস।টেনশন করিস না।এবারে যদি খারাপ কিছু হয়ও এত সহজে আমি হেরে যাবোনা।শুধু রাই বা তোর জন্যে না,রণর জন্যেও আমায় জিততে হবে”।
আর দাঁড়ায় না ফ্যাকাসে মুখের জয় কে নিজের রুমে রেখে ও বেরিয়ে যায় সত্যের মুখোমুখি হতে।

আজ জয়ির ডে অফ।অন্য রবিবার তাও রান্নাঘরে যায়,নিজে টুকটাক রান্না করে।আজ সকাল থেকে মনটা এত অস্থির কিছু ভালো লাগছে না।ঋষি বেরিয়ে গেছে ব্রেকফাস্ট করেই,তারপর রণর ঘরে গিয়ে ঢুকেছিলো ও।ঘরটা পরিপাটি করে গুছিয়েছে।যদিও রাইয়ের কোনো চিহ্ন ওর ছেলে এখানে ছেড়ে যায়নি,তাও ওর ডেস্কটপে যে কেন পাসওয়ার্ড দেওয়া থাকে শেষ কমাস,ভালোই বোঝে জয়িতা।
উফ ঋষি কেন ফোন করছেনা।রাই এর স্ক্রিনিং হলো কি না কে জানে?
ঘড়ির দিকে তাকায় জয়ি,বারোটা বাজতে চললো।ঋষিকে নিজেই একটা ফোন করবে কি না ভাবছে এমন সময় কানে এলো ঋষির গাড়ির আওয়াজ,মেইন গেট দিয়ে ঢুকছে।
অপেক্ষা না করে ছুটে নীচে নেমে এলো জয়ি,ঋষি বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো ওর দিকে।মুখ নামিয়ে নিলো ঋষি।বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছে কেউ,কি হলো ঋষির!মুখটা ওরকম থমথমে কেন?রাইয়ের চিন্তায় কাল সারারাত ওদের দুজনেরই ভালো ঘুম হয়নি।মেয়েটার মুখটা বড্ড শুকনো লাগছিলো,আর সেটাই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল ওদের।
“ঋষি?” জয়ি এবার চোখের প্রশ্ন মুখে আনে।
“ওপরে চল।” এখানে রমার সামনে কিছু বলতে চায়না ঋষি।
জয়ি আড়চোখে একবার রান্নাঘরের দিকে দেখে ঋষি কে ওপরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে গলা তুলে রমাকে বলে,”রমা টেবিলে খাবার দাও।আমরা কুড়ি মিনিটে আসছি”।

ওপরে ঘরে এসে দেখে ঋষি বাইরের জামা না ছেড়েই বেডরুমে রাখা চেয়ারটা টেনে বসে পড়েছে,চোখে মুখে ক্লান্তি স্পষ্ট।ঋষির হাবভাব দেখে জয়ির টেনসন আরো বাড়তে থাকে।
-“বল ঋষি রাইয়ের স্ক্রিনিং হলো?সব নরমাল তো?”
-“কিছুই আর নরমাল নেই।রাইও রেশমার মতোই বোকা।ও রণর যাওয়ার অপেক্ষা করে ব্যাপারটা আরো পনেরদিন ডিলেই করলো।ও এতই বোকা ও বুঝতেও পারছেনা রণ নিজের প্রফেশনে যতই লয়াল হোক,ওর জীবনের আগে দায়িত্ব কে কিকরে গুরুত্ব দেবে ও!রাইয়ের কিছু হলে ও স্বাভাবিক জীবন বাঁচতে পারবে নাকি?…”।
-“কি বলতে চাইছিস প্লিজ খুলে বল”,জয়ির এই গলা অনেকদিন বাদে শোনে ঋষি।শেষ শুনেছিল জয়ন্তর কোয়ার্টারে,রাইকে হোস্টেল পাঠানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
কিন্তু আজ ঋষিও জানেনা কিভাবে বলবে সত্যিটা!জয়ি তো রাইয়ের এক মা,কিভাবে সহ্য করবে ও এতো বড় খবর।কিন্তু জয়ির চোখের কৌতূহল ওকে মুখ খুলতে বাধ্য করে,”রাইট ব্রেস্ট,আরমপিটে লাম্পস,ইচিং,ইরিটেশন,ফ্লুইড বেরোনো সব আছে।আজ মামোগ্রাফি হয়ে বায়োপসি তে গেছে।তবে এফএনএসি(fnac) হয়েছে,মানে নিডিল বায়োপসি।ইমার্জেন্সি আর পার্সোনাল কারণ দেখিয়ে কাল রিপোর্ট পেয়ে যাবো।আর জিনের মিউটেশন হয়েছে কিনা,মানে রিস্ক ফ্যাক্টর বুঝতে ব্লাড ও পাঠানো হয়েছে টেস্টে।অন্তত দুদিন তো লাগবেই।তারপর বাকি চিন্তা”।
জয়ি কিছু বলার অবস্থায় নেই বুঝতে পারে ঋষি।হসপিটাল থেকে ফিরে চান করেনি বলে ওকে জড়িয়ে ধরতেও পারেনা।উল্টে তোয়ালে টেনে নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে।গিজার অন ছিল গরম জলের সাথে ঠান্ডা জল দুটো ট্যাপই খুলে দেয়।
ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই,তাহলে জয়ন্ত এত সহজে কাঁদে কিকরে?ঋষির বুকে যে কি হচ্ছে ওই জানে।দুটো জীবনের দায়িত্ব ভগবান আজ ওর হাতে তুলে দিল,যে দুজনই ওদের প্রাণাধিক প্রিয়।এ যে বড় বোঝা।রণকে কি বলবে তাই জানেনা ও।সবমিলিয়ে জীবনে এরকম কঠিন সময় ওর আগে এসেছে কিনা মনে পড়েনা।খুব অসহায় লাগে।রণকে কখনো জয়ন্তর জায়গায় ও দেখতেও পারবে না।আজ রণ যদি জানে রাইয়ের স্ক্রিনিং দুবছর বন্ধ ছিল কিভাবে রিয়াক্ট করবে ঋষি ভেবেও পাচ্ছে না।কেন যে সেদিন মেয়েটার কথায় রাজি হয়েছিল।এয়ারপোর্টেও রণর প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল সেদিন।ঋষির মনে হলো কোথায় পালিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।।
আসলে রাইয়ের এত অল্প বয়সেই রোগটা থাবা বসাবে ভাবেনি ঋষি।
ওতো জানে রণ ওর স্ট্রিমটা এত অপছন্দ করলেও রাইয়ের স্ক্রিনিং শুরু হওয়ার পরই কেন অঙ্কলজিতে স্পেশালাইজেশন করবে ঠিক করেছিল।
ভগবান আমি জানিনা সত্যি তুমি আছো কিনা,থাকলে প্লিজ এই দুঃস্বপ্নটা দূর করো।

ট্যাপ দুটো বন্ধ করে সবে বাইরের জামা প্যান্ট ছেড়ে গা’য় জল ঢালতে যাবে,এমন সময় শুনতে পায় জয়ির ফোনের রিংটোন।

“রণ,রণ,সরি রে…”,তীর বেগে ছুটে বেরিয়ে আসে ঋষি ওয়াশরুম থেকে।ছোঁ মেরে জয়ির হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়।চমকে ওঠে জয়িতা।চোখের ইশারায় ঋষি বারণ করে এই মুহূর্তে কিছু বলতে,সঙ্গে সঙ্গে সামলে নেয় রণর মা নিজেকে।হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেয় ঋষির থেকে।

-“…হ্যালো মম।মম কি হয়েছে তোমার গলাটা ওরকম লাগছে কেন?”
-“ওই তোর জন্যে খুব মন কেমন করছে।সানডে তুই নেই এরকম হয়তো খুব কম দিন এসেছে।সরি রে সকাল থেকে ফোন করতে পারিনি।আসলে ভাবলাম তুই বিজি তাই…”।
-“মম আমায় একটা হেল্প করবে প্লিজ?রাইকে ফোন করে বলবে আমার ফোনটা রিসিভ করতে।কাল একটু রাগ দেখিয়ে ফোন কেটেছিলাম আমি।আজ সকাল থেকে ওর ফোন অফ করে রেখেছে।তুমি প্লিজ জয়ন্ত আঙ্কেলের নাম্বারে ফোন করে ওকে বলো।” রণর গলার আকুতি জয়িকে আবার অস্থির করে তোলে।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ও বলে,”করিস কেন ঝগড়া রণ?তুই তো জানিস মেয়েটার তুই সব।তাহলে কেন কষ্ট দিস।দূরে থেকে এমন কোনো ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করবি না যা পরে তোকে নিজেকে কষ্ট দেবে।তুই যথেষ্ট ম্যাচিউর আমি জানি।শুধু রাইয়ের ব্যাপারে বড্ড ছেলেমানুষি করিস।কেন ভুলে যাস ওর অতীতটা!কিভাবে ওকে সাপোর্ট দিয়ে তুই স্বাভাবিক করেছিলি?মিটিয়ে নে সব ঝামেলা।আমি ওকে বলছি দাঁড়া।”
অবাক হয় রণ তার মায়ের ব্যবহারে।ও ভেবেছিল মা মজা করবে,কিন্তু এত সিরিয়াস কেন তার হাসিখুশি মা।
“কি হয়েছে মম তোমার?”

ফোনটা লাউডস্পিকারে ছিল,তাই রণর কথা শুনে ঋষি ভরসার হাত রাখে স্ত্রীর কাঁধে।
ইশারায় বলে নিজেকে সামলাতে,এই মুহূর্তে রণকে কিছু না বলতে।
“কি হবে রণ,তোর জন্যে মন খারাপ।রাইয়ের ও নিশ্চই এরকম মন খারাপ।তুই তো নতুন পরিবেশে নতুন করে শুরু করবি, কিন্তু আমাদের সব এক থেকে শুধু তুই কাছে নেই।বোঝার চেষ্টা কর।তোর নতুন বন্ধু হবে,কিন্তু রাইয়ের। একমাত্র বন্ধুটাই দূরে।সে যদি ওখান থেকেও ঝগড়া করে…।রণ একটা কথা বলি তোকে।সম্পর্কের সংজ্ঞা বদলালে,অধিকার এলেই নিজেকে বদলাবি না।তুই কারোর ভরসা ছিলি,আজও আছিস।রাই কে মানসিক চাপ দিসনা কারণে,অকারণে।আগের মত বোঝাবি, বুঝবি,সাথে থাকবি সবসময়,মানসিক ভাবে অন্তত।”
জয়ির কথা শেষ হতেই রণ এবার মুখ খোলে,”আরে মম ও ভুলভাল বকছিলো।কাল একেই ওকে,সবাইকে ছেড়ে এসে আমি নিজে ডিপ্রেসড ছিলাম তারওপর ‘আমি না থাকলে তোমায় জীবন চালাতে হবে’ টাইপ বাজে বকছিলো তাই…।আমায় যেমন বললে ওকেও বুঝিয়ে বলবে আমি দূরে আছি এসব কিছু আমায় না বলতে…”। রণর কথা বাধা পায়।

“ওর মুখে কোনোদিন এসব শুনেছিস?কাল হয়তো ওর মন খারাপ ছিল।আগে তুই বন্ধু যখন ছিলি এসব কথায় রেগে গেলেও ফোন কাটতিস না ওকে বোঝাতিস?রণ রাইকে তোর চেয়ে ভালো কেউ বোঝেনা,বোঝাতেও পারেনা।আমার কথা শোন মেয়েটা কে তুই অন্তত…মানে… তুই পারিস ওকে সামলাতে।”কোনোভাবে জয়ি নিজের মনটা লুকোতে পারেনা।
অসম্ভব ভালোবাসে ও রাইকে।তাই ঋষি রাইয়ের খারাপ সময়ে রণর চিন্তা করলেও জয়ির মন জুড়ে শুধুই ঘোরাফেরা করছে রাইয়ের মুখ।ও জানে এখন ও যতই ভাঙুক,রাইকে মনের জোর ওকেই দিতে হবে।আর রণ রাইয়ের দুর্বলতা না হয়ে শক্তি হলে রাই হোক বা জয়ি ওদের লড়াই অনেক সহজ হয়ে যাবে।

জয়ির কথার উত্তরে রণ এবার চুপ থাকে।ও জানে ওর মা ঠিকই বলছে।আজকাল ওর ইচ্ছা করে রাইকে আশ্রয় করতে,আর তা না পারলেই অভিমান দেখায়।
“আচ্ছা মনে রাখবো।আমি হোস্টেলে পৌছেছি একটু আগে।এবার খেতে যাবো।তুমি রাইকে বলো দুপুরে ফোন করলে যেন ধরে।আমি নাহয় ‘সরি’ বলে দেব তখন”,হালকা হাসি ফোটে জয়ির ঠোঁটে।বুঝতে পারে তার ছেলে বুঝেছে।
“ঠিক আছে বলে দিচ্ছি।যা তুই খেয়ে আয়।রাতে ভিডিও কল করবো।এখন রাখছি।”
রণর ফোন কেটে এতক্ষনে দমিয়ে রাখা আবেগ আর আটকে রাখতে পারেনা জয়ি।হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে অদূর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায়।
চমকে যায় ঋষি।এত কঠিন মনের মেয়ে জয়িতাকে নিজের মায়ের মৃত্যুতে এত ভাঙতে দেখেনি ও।বুঝতে পারে মুখে শুধু বলেনি জয়ি রাইকে নিজের মেয়ের ভালোবাসাই দিয়ে এসেছে এতদিন।আর বেশি কিছু না ভেবে জয়িকে জড়িয়ে নেয় নিজের বুকে,”প্লিজ সোনা চুপ কর।বিশ্বাস রাখ আমার ওপর,সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি কিছুতেই আর হারবোনা।শুধু বায়োপসি রিপোর্টটা আসতে দে।তুই আমার শক্তি জয়ি,তুই ভাঙ্গিস না প্লিজ।প্লিজ সোনা”,বুকের মধ্যে চেপে ধরে কথা গুলো বলতে বলতে জয়িকে আরো বুকে ঢুকিয়ে নেয় ঋষি।দুজন দুজনকে প্রানপনে আঁকড়ে ধরে।

নিজের রুমের ব্যালকনিতে একটা চেয়ার নিয়ে বসেছিল রাই।আজ খাবার অর্ডার করে দিয়েছিল ওর বাবা।সেই মুহূর্তে ওদের কারোর ই রান্না করার মানসিকতা ছিল না।
বাড়ি ফেরার রাস্তায় জয়ন্ত একটাও কথা বলেনি।ফিরেও নিজের ঘরে না ঢুকে ড্রইং রুমের সোফায় বসে পড়েছিল।
রাই নিজের রুমের ওয়াশরুম থেকে যখন ফ্রেস হয়ে বাইরে এলো ওর বাবা একই ভাবে বসেছিল সোফায়।

-“বাবা কি খাবে বলো?অনেক বেলা হলো।” রাইয়ের প্রশ্নে ঘোর কেটেছিল জয়ন্তর।
“আমি খাবার অর্ডার করে দিচ্ছি।বেশি রিচ কিছু করছি না।এত বেলায় এই শরীরে তোকে রান্নার ঝামেলা নিতে হবে না।আমি ঐ নিয়েই ভাবছিলাম।সুলেখার আশা আর না করাই ভালো।অন্য কাউকে দেখতে হবে”,চেষ্টা করেও গলায় হতাশা লুকোতে পারেনা জয়।
চুপ করে থাকে রাই।সত্যি বলতে ওর চিন্তা শক্তি যেন লোপ পেয়েছে,ভাবার মত মাথার ক্ষমতা আর নেই।
খাবার অর্ডার দিয়ে জয়ন্ত চানে চলে যাওয়ার পর নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে ও দেখেছিল রণর প্রায় দশটা মিসড কল সকাল থেকে।কিন্তু সেই মুহূর্তে ইচ্ছা করেনি কল ব্যাক করার।ওর গলার স্বর সেই মুহূর্তে স্বাভাবিক ব্যবহার করবে না,আর ধরা পড়ে যাবে ও ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুরা কাছে।

সবচেয়ে যেটা অবাক করেছে রাইকে,ওর বাবার অকপটে স্বীকারোক্তি এত বছর পর,যেটা আরো বেশি অসহায় করে দিয়েছে ওকে।
স্নান সেরে যখন ওর বাবা বেরিয়ে এলো চোখগুলো লাল টকটক করছিল।বুঝতে ভুল হয়নি রাইয়ের কারণটা।কিন্তু কিছু বলার মত মনের জোর ছিলোনা বলে চুপ করে ছিলো ও।কথা শুরু করে জয় নিজেই,”খাবার এখুনি এসে যাবো রে।খুব খিদে পেয়েছে?” ওর মাথায় আলতো হাত রেখেছিলো ওর বাবা।ঘাড় নেড়ে না বলেছিল রাই।জয়ন্ত চেয়ার টেনে বসেছিল ওর পাশে।
“জানিস রাই তোর মা ছিল ঠিক তোর উল্টো।অসম্ভব মনের সাহস ছিল ওর সেই প্রথম থেকে,বরঞ্চ আমি ছিলাম ভীতু।সেই রেশমা চলে যাওয়ার পর আমার মেরুদণ্ডটাই ভেঙে গেছিল।সংসারের কিছু না জানা আমি খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম।মনে হয়েছিল জীবন শেষ,কোনো দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার।তোর দায়িত্ব যেন বোঝা লাগছিলো।মানসিক ভাবে ক্লান্ত আমি সেদিন তাই পালিয়েছিলাম চেনা পরিসর ছেড়ে।” এতটা বলে চুপ করে রাইয়ের বাবা সাময়িক।
কিন্তু রাইয়ের তরফে কোনো সাড়া না পেয়ে আবার শুরু করে কথা বলতে নিজের মনেই,”আমি ভুল করেছিলাম সেদিন রাই।আমি জানি সেদিন তোর হয়তো আমাকে বেশি দরকার ছিল।তোর মা হয়তো আমায় ক্ষমাও করেনি তার জন্যে।তাই শাস্তি দিতে চাইছে এত বছর পর।কিন্তু বিশ্বাস কর রাই সেদিন আমি দুর্বল ছিলাম।কিন্তু আজ নই, তাই আমি ভয় পাচ্ছিনা একটুও।আমি জানি আমি তোকে ঠিক সুস্থ করে তুলবো।এবারে আমি জিতবো।শুধু তুই আমার সাথে থাকিস।কোনো মুহূর্তে হেরে যাওয়ার ভয় পাসনা।রাই কিরে কিছু বলছিস না?”
“জানো বাবা মা পুজোর সময় স্বপ্নে এসেছিল।রণর থেকে আমায় জোর করে টেনে নিজের সাথে নিয়ে যাচ্ছিল।আমি যাবোনা বলে কাঁদছিলাম।তারপর স্বপ্নটা ভেঙে গেল।নবমীর ভোরের স্বপ্ন।” কাল থেকে স্বপ্নটাই খালি মাথায় ঘুরছে ওর।
“রা-ই।মাথা থেকে বের করে এসব চিন্তা।এখন যুগ এগিয়ে গেছে,তোরা অনেক অ্যাডভান্স।আগে রোগীকে রোগ জানানো হতনা,এখন তারা নিজেরা ঠিক বুঝে যায়।আর তোর তো সেই কবে থেকে স্ক্রিনিং হচ্ছে।আমি জানিনা বায়োপসি রিপোর্ট কি আসবে।কিন্তু তোর মনের জোর আসল।তোর মা অত অ্যাডভান্স স্টেজেও মনের জোর হারায়নি।আর তুই তার মেয়ে।”জয়ন্ত রাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
আর কোনো কথা বলেনি রাই।জয়ন্ত যখন নিজের মনে বলছিল,”আমার তুই ছাড়া কে আছে বল।রণ তার মনের জোরে,সাহসে, পরিবারের সাহায্যে নিজেকে সামলাতে পারবে কিন্তু আমি শেষ হয়ে যাবো।আমার জন্যে অন্তত তোকেও মনের জোরে লড়তে হবে”,রাই বলতে চেয়েছিল, ‘সেদিনও তুমি ছাড়া আমার কেউ ছিলোনা।তুমি নিজের শোক নিয়ে ব্যস্ত ছিলে।তোমার ওই অবস্থা আজ আমায় রণকে নিয়ে ভাবাচ্ছে।আমি তোমার কষ্ট বুঝছি।কিন্তু বাঁচার তাগিদ যে আমার অন্য কেউ বাবা।সেদিন থেকে যে সঙ্গে আছে,তার একটাই ভরসা আমার ভালোবাসা।রক্তের সম্পর্কের জোর অনেক,কিন্তু ভালোবাসার ভরসা যে শুধু বিশ্বাস।আমি তোমায় ভালোবাসি,কিন্তু রণ এখন আমার দায়িত্ব।আমায় তাই বাঁচতে হবে’।
দশ বছর আগের লুকোনো অভিমানই হয়তো রাইয়ের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।মা-বাবার মধ্যে মনের কাছাকাছি থাকা মা চলে যাওয়ার পর যে সেই জায়গাটা নিয়েছিল তাকেই গুরুত্ব দেয় ও বেশি।

ব্যালকনির হালকা রোদে ঘুমের ঘোর এসে গিয়েছিল ওর।হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে কোলের মধ্যে রাখা ফোনে চমকে ওঠে রাই।তাকিয়ে দেখে রণ ফোন করছে।কতক্ষন আর পালাবে ওর থেকে!আঙ্কেলকে বলেছে রিপোর্ট না আসলে ওকে কিছু না বলতে,তাই যতটা সম্ভব গলাটা স্বাভাবিক করে ফোন ধরে ও।
রাই কিছু বলার আগেই ওপাশের মানুষটা বলে ওঠে,”সরি,সরি সোনু।এতটা রাগ করবি বুঝতে পারিনি।প্লিজ ক্ষমা।”
অবাক রাই কিছু বলতে পারেনা।ও ভেবেছিল ফোন ধরে রণই হয়তো অভিমান দেখাবে আর রাইও সেটাকে টেনে কাটিয়ে দেবে আজকের দিনটা,কাল রিপোর্ট আসার আগে অবধি এড়িয়ে থাকবে রণকে।কিন্তু রণর এই গলার স্বর ওকে হঠাৎ দুর্বল করে দেয়।শেষ দশদিন মনের মধ্যে যে সহ্য ক্ষমতার প্রাচীর তৈরি করেছিল ও,রণর ভালোবাসার উষ্ণতায় গলে যায় তা একমুহূর্তে।
শেষ দশবছর যার ওপর মানসিকভাবে নির্ভর করে থেকেছে সেই রণর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে।আর পারেনা রাই নিজেকে সামলাতে,যার কাছে ওর মন খোলা খাতা তার কাছে এই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত চাপতে কষ্ট হয় ওর।
“রণ…”,ফুঁপিয়ে ওঠে রাই।

ক্রমশ…