মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-২৩

0
416

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#ত্রয়োবিংশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

ঘুম চোখে একবার ফোনটা দেখে শীর্ষা,আটটা বাজে সবে।এখানে উইন্টারে আটটা মানে ভোর,সূর্য এখনো ভালো করে চোখ মেলেনি।
শিবরাজ এখন ফোন করছে কেন,এত সকালে?দূর পরে কল ব্যাক করে নেবে ভেবে ফোনটা সাইলেন্ট করে পাশ ফিরে শোয় ও।
শিবরাজ,দিল্লির ব্যবসায়ী ছেলেটা শীর্ষার সাথে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক এই ক’মাস ঠিক বয়ে বেড়াচ্ছে।কারণটা কি শীর্ষা নিজেও জানেনা।ওর মানসিকতা,সংস্কার বা জাতের কোনোটাই শীর্ষার সাথে মেলে না।তাও শীর্ষা ওকে এড়াতে চায়না।বরং সারাদিনে একবারও ওর সাথে কথা না হলে ফাঁকা লাগে আজকাল।হিন্দি শীর্ষার ভালো আসেনা,আর শিবরাজ ইংরেজিতেও বিশেষ স্বচ্ছন্দ না,তাও মিলিয়ে মিশিয়ে কথা ভালোই চলে।দুটো দেশের সময়ের ব্যবধানে রাজ যখন ফ্রি হয়,শীষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আবার ওর যখন ছুটি মেলে ভারতে তখন গভীর রাত।তাও কথা বলা আটকায় না।
কিন্তু শিবরাজ এই কমাসে কখনো ওকে অসময়ে উত্যক্ত করেনি।বরং ওর সময়ের হিসেব শীর্ষার থেকে বেশি থাকে।এই নিয়ে ও একদিন প্রশ্ন করতে শিবরাজ হাসতে হাসতে বলেছিল ওর দুটো মোবাইলের একটাতে শীর্ষার শহরের সময় সেট করে রেখেছে।অবাক হয়েছিল শীর্ষা।
শিবরাজ বাড়ির ছোট ছেলে,ওর দাদা ব্যবসায় আসেনি,পড়াশোনা জগতের মানুষ তিনি।শিবরাজও পড়াশোনায় খারাপ ছিলোনা।কিন্তু বাবার বয়সের কারণে কলেজের পড়াও শেষ করতে পারেনি ও।দিল্লিতে ঘর না,মহল আছে ওদের।নামকরা গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ওরা।কিন্তু ছেলেটার মনটা একদম শিশুসুলভ।তবে কখনো রেগে গেলে চন্ডাল হয়ে যায়,তার প্রমাণও শীর্ষা পেয়েছে।
শীর্ষা না চেয়েও নিজের মনে মাঝে মাঝে তুলনা করে ফেলে রণর সাথে রাজের।একজন ব্যবহারে,আদব কায়দায়,স্বভাবে সব দিক দিয়ে অন্য এক আভিজাত্য বহন করে,আর শিবরাজ খোলামেলা,উন্মুক্ত কথায়, ব্যবহারে।কিন্তু শীর্ষার খারাপ লাগেনা।ও নিজের মনে অনেক ভেবেছে।ওর মনে নিজের জীবনসঙ্গীর যে ছায়া ছিল রণ সেখানে অবয়ব তৈরি করেছিল।সব দিক দিয়ে ওর উপযুক্ত ছেলেটা পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে একটা দাগ কেটেছিল ওর মনে।তাই রাইয়ের প্রতি রণর ভালোবাসার তুলনায় রণর প্রতি শীর্ষার ভালোলাগার বয়স খুব একটা কম না।
দূর ঘুমটাই চটকে দিলো।আজ সপ্তাহান্তে ভেবেছিল অনেক্ষন ঘুমোবে! মনে মনে শিবরাজের সাথে একচোট ঝগড়া করে নেয় ও।
উঠে বসে বেডে, হাত বাড়িয়ে রুম হিটারের সুইচটা অফ করে ও,জানে এখুনি ঘরের মধ্যেও কেঁপে যাবে কিন্তু সারাক্ষন এই ইলেকট্রিক হিটারের উষ্ণতাও ভালো লাগে না।
হাত বাড়িয়ে হালকা ওয়ার্মারটা গায়ে জড়িয়ে খাট থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে যায়।
প্রথম কদিন হোটেলে থাকলেও এখন ও সিঙ্গল রুম নিয়েছে রেন্টে।খুব বড় কিছু না,একটা ছোট কিচেন আর রুমের সাথে ওয়াশরুম,এই ওর সেট আপ।শেয়ারের তুলোনায় রেন্ট বেশি হলেও প্রাইভেসি পুরো আছে।
এখানে শীর্ষাও পড়াশোনার সাথেসাথে সার্ভিস করছে একই হসপিটালে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফোনটা হাতে নেয় শিবরাজকে কল ব্যাক করবে বলে।
‘ও মাই গড!নাইন মিসড কলস’,ভয় পেয়ে যায় শীর্ষা।শিবরাজ অকারণে তো ফোন করবে না।যথেষ্ট ম্যাচিউর ছেলে ও।ফোনটা সাইলেন্ট করার জন্যে নিজের ওপর নিজের রাগ হয়।তাড়াতাড়ি কলব্যাক করে ফোন লাউডস্পিকারে দেয় ও।
“হ্যালো রাজ।হোয়াট হ্যাপেন্ড ইয়ার?ইতনে মিসড কল!!সাব বরাবর হ্যায় না?” শীর্ষা শিবরাজকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই আগে প্রশ্ন করে।
-“আরে ইয়ার ক্যাসে লাড়কি হ্যা তু?ফোন কিঁউ নেহি উঠারাহি থি ?” ওদের সম্পর্ক এখন বন্ধুত্বের হাত ধরে ফেলেছে সম্বোধন দিয়ে।
-“মাতলাব?তু ইতনে সুবা ফোন কারে কিঁউ?তুঝে পাতা নেহি হ্যায় কিয়া ইধার আভি ঠিক সে সুবা তাক নেহি হুয়া?”
-“আরে মুঝে দিখাই ভি পার রেহি হ্যায়।মৌসম ঠিক নেহি হ্যায় ইধার,জলদি সে তু আপনা আড্ড্রেস হোয়াটস অ্যাপ কার মুঝে।”

শীর্ষা রাজের কোনো কথাই বুঝে উঠতে পারেনা।কি বলছে কি ছেলেটা?রুদ্রর ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে,”দাবি কি তোর?” কিন্তু তার আগেই শিবরাজ যা বলে শুনে চোখ গোল হয়ে যায় ওর।
শীর্ষা সপ্তাহ তিন আগে কথায় কথায় শিবরাজকে বলেছিল আগামী মাসে ওর জন্মদিন,যা ওকে জীবনে প্রথমবার পরিবার থেকে দূরে একা কাটাতে হবে।তাই রাজ ওকে না বলে সমস্ত ব্যবস্থা করে ছুটে এসেছে শীর্ষার বর্তমান শহরে।এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে এতক্ষন এতবার ফোন করছে ওর আড্ড্রেস জানে না বলে।

“বাওলা হো গ্যায়ে হ্যা ক্য?মুঝে পুছে বিনা ইধার চলা আয়া তু?মেরি ইধার সিঙ্গেল রুম,তু ঠ্যারেগা কাঁহা?” শীর্ষার আর কোনো কথা মাথায় আসেনা।
“উও বাদ মে সোচুঙ্গা।আভি প্লিজ তেরি রুম কা পাতা দে ইয়ার,নেহি তো ম্যা পুরা জম যায়ুঙ্গা।সর্দি ইতনে তেজ হো গায়ি হ্যায় ইধার আন্দাজ নেহি হুয়া।অব তো বিমার পাড় জায়ুঙ্গা।”
“শিবরাজ তু ইতনা জ্যদা ইমম্যাচিওর হ্যা ম্য সওচি ভি নেহি থি।রুক উধার লাউঞ্জে মে।ম্য আধা ঘন্টে মে পৌহচতি হুঁ”।
আর রাজকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেয় ও।এয়ারপোর্ট ভালোই চেনে।নিজের ঘরটা একটু গুছিয়ে একটা ব্যাচেলর ছেলের আসার উপযুক্ত করে গরম পোশাকে নিজেকে মুড়ে বেরিয়ে যায় ও এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।আর কদিনের মধ্যে নাকি এখানে বরফপড়া শুরু হবে। প্রকৃতি যেন তারই জানান দিচ্ছে।শিবরাজের ওপর রাগ করবে না ওর ছেলেমানুষি তে খুশি হবে শীর্ষা নিজেই বুঝতে পারেনা।

নিজের চেম্বারে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে বসেছিল ঋষি।আজ এক সপ্তাহ ধরে যে ঝড় চলছে মনের সাথে সাথে তাই শরীরও জবাব দিচ্ছিল।রাইয়ের বায়োপসি এফএনএসি (FNAC) রিপোর্টে যখন ম্যালিগনেন্সি এলো জয়ন্ত শুধু না ভেঙে পড়েছিল জয়িও।কিন্তু ক্যান্সার এখনো সেকেন্ড স্টেজ বলে ঋষি অতটাও ভাঙেনি।রাই বারবার প্রশ্ন করলেও ওকে খারাপ খবরটা ওরা মা-বাবারা এখনো দেয়নি।
বায়োপসি রিপোর্ট আসার সাথে সাথে ‘টিউমার মার্কার’ টেস্টে পাঠিয়েছিল ঋষি,রেশমার মতো রাইয়ের অন্য অর্গানে ম্যালিগনেন্সি ছড়িয়েছে কিনা জানতে।সেই রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছিল ও।
জয় কে আশ্বাস দিয়ে বলেছিল,”লাম্পেক্টোমি করলেই হবে বুঝলি?শুধু টিউমার দুটো আর আশেপাশের টিস্যু বাদ দিলেই ভয় থাকবে না।”
“রে দিতে হবে না তো?”জয়ন্ত ভয়ার্ত চোখে তাকিয়েছিল।ওর পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতো ব্রেস্টে রে দেওয়ার সাইড এফেক্ট।
“তুই ডাক্তার হয়ে এ কথা বলছিস জয়।কেমো আর রে তো এ ক্ষেত্রে মাস্ট বল।যাদের ম্যাসটেক্টমি হয় তাদের ক্ষেত্রে রে তাও এভয়েড করা যায়।কিন্তু আমি রাইয়ের ক্ষেত্রে সেটা চাইছি না।” কিছুটা থেমে ঋষি আবার বলে,”দেখ রাইয়ের বিয়ে বা ভবিষ্যতে কে কি বললো সেই নিয়ে তো আমাদের সমস্যা নেই।সমস্যা হলো ওর মেন্টাল হেল্থ।যতই ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করা হোক না কেন একটা মেয়ের জীবনে এই ঘটনা খুব খারাপ এফেক্ট ফেলে।বিশেষ করে রাইয়ের মত চুপচাপ শান্ত অথচ নরম মনের মেয়ের ক্ষেত্রে।আমরা যতই ওকে বোঝাইনা কেন ওর মতো মেয়েদের মানসিক সমস্যা এসে যায় আমি আগেও দেখেছি।ক্যান্সার যখন স্টেজ টু এই মুহূর্তে আর লেফট ব্রেস্টে ছড়ায়নি তখন…।”
চুপ করে থাকে জয়ন্ত।তারপর ভাঙ্গা গলায় বলে,”তাহলে তো রাইকে জানাতেই হবে।আর রণ?”
ঋষি উত্তর দেয় না চট করে।রাইয়ের জেদের কাছে হার মেনে রণকে এখনও অবধি রাইয়ের বিষয়ে কিছু বলেনি জয়ি-ঋষি।কিন্তু রাই যতই জেদ করুক ঋষি জানে নিজের ছেলেকে,তাই বলতে যে ওকে হবে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।এমনকি খবরটা পেলে রণ যে ফিরে আসবে না সেটা নিয়েও ও শিওর না।আর ও জানে,রাই সেই ভয় থেকেই রণ কে জানাতে বাধা দিচ্ছে।
“রণকে তো জানাতে হবেই জয়,সেটা তুইও জানিস।রণকে না জানিয়ে রাইকে ওটিতে ঢোকানোর ক্ষমতা আমার নেই।কিন্তু কি করে জানাবো সেটাই জানিনা”,ঋষি কথাটা শেষ করে জয়ের দিকে তাকিয়েছিল অসহায় ভাবে।

সব রিপোর্ট আসার পরও এই কদিন শুধু ব্লাড টেস্ট রিপোর্টের অপেক্ষায় ছিল ঋষি।ওর আশা ছিল রাইয়ের বয়সের কারণে ওর রিস্ক ফ্যাক্টর বেশি হাই হবে না।কিন্তু আড়ালে যিনি সমস্ত নাটক পরিচালনা করছেন তাঁর উদ্দেশ্য হয়তো আলাদা কিছু ছিল।রণ-রাইয়ের ভালোবাসা কে বড় পরীক্ষার সামনে ফেলে দেখতে চেয়েছিলেন ভালোবাসার গভীরতা।তাই ঋষির সব আশা ব্যর্থ করে আজকে যখন রিপোর্ট এলো চমকে উঠলো ঋষি।রিস্ক ফ্যাক্টর প্রচন্ড বেশি,মানে টিউমার রিমুভ করে এখনকার মত রাইকে বিপদ মুক্ত করলেও ভবিষ্যতে ক্যান্সার ফিরে আসার চান্স খুব বেশি।আর সেই ক্যান্সার যে ছড়িয়ে যাবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই।আর তাই উপায় একটাই,যেটা ঋষি রাইয়ের এই বয়সে,তার মা হওয়ার আগে করতে চায়নি।
আজকের রিপোর্ট ঋষিকেও ভেঙে দেয় পুরোপুরি।
এই মুহূর্তে ম্যাসটেক্টমি না করলেও ভবিষ্যতে ভয় থেকেই যাবে।হয়তো নিজের মায়ের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে রাইয়ের জীবনেও,যে টা কোনো ভাবেই হতে দেবে না ঋষি।
ও ঠিক করে জয়ি কে পাঠাবে রাইকে বোঝাতে,আর রণ কে জানাবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব,আর দেরি করবে না।
কি ভেবে ফোনটা তুলে জয়ির নম্বরে কল করে ঋষি।এই বিকেলের দিকটা ও বাড়িতেই থাকে আজকাল।রণ পড়তে যাওয়ার আগে ও বলতো,” রণ পড়তে চলে গেলে আমার তো অখন্ড অবসর মিলবে তখন ওই তিন বছর আবার বিকেলে কাজ শুরু করবো।একটা সেবাশ্রম বলছে ফ্রি তে রোগী দেখার জন্যে,শুরু করবো ভাবছি।”
কিন্তু রাইয়ের ঘটনা ওকেও যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে।আজকাল বড্ড চুপ থাকে ঋষির জয়ি।এ কদিন রাতে ঘুমের মধ্যে উঠে বসে থাকতে দেখেছে ও।যেন একটা অদৃশ্য ঝড় ওদের জীবন গুলো ওলটপালট করতে ধেয়ে আসছে।ঋষি জানে ঝড় একটা আসবেই,হয়তো পুরো ধ্বংস না করতে পারলেও বিশাল একটা প্রভাব রেখে যাবে জীবনে।রেশমার ক্ষতি ওরা কিছুটা পূরণ করে উঠছিল সময়ের মলমে,রাই রণর সম্পর্ক ওদের জীবনে আবার খুশির ছোঁয়া আনছিলো। ঠিক সেই সময় এক ধোঁয়ার কুন্ডলি সেই খুশির আলো আবছা করে দিচ্ছে।

“জয়ি কিছু দরকার ছিল তোর সাথে।আমি বাড়ি যাচ্ছি,তুই রেডি হয়ে থাকিস।ফিরে একবার জয়ন্তর ওখানে যাবো।তার আগে আলোচনা করার আছে তোর সাথে”,ঋষি এক নিঃশ্বাসে বলে থামে।
“কি রিপোর্ট এলো ঋষি?প্লিজ বলিস না এই বয়সে রাইয়ের রিস্ক লেভেল হাই?” একটা যেন আকুতি ভেসে আসে ঋষির ফোনে।জয়ির ভেঙে পড়া ওকে আরো অসহায় করে দিয়েছে।
“প্লিজ জয়ি সামলা নিজেকে।আমি আসছি আধ ঘন্টায়”,ফোনে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল ডিসকানেক্ট করে দেয় ও।
এভাবে এই খবর জয়িতা কে দেওয়া সম্ভব না বুঝে উঠে পড়ে ঋষি নিজের চেয়ার ছেড়ে।অনেকদিন যুক্ত আছে ও ওর হসপিটালের সাথে,তাই এখন সিনিয়র ডাক্তারের সম্মান পায় ও।ওর কাজের সময় ঘন্টার হিসেবে এখানে কেউ দেখেনা।তাই এই কদিন ওর অনিয়মিত যাতায়াত নিয়ে জমা খরচ দেওয়ার দরকার পড়েনি কাউকে।তাও ওর চেম্বারের বাইরে বসে থাকা মেয়েটা কে জানিয়ে ও বেরিয়ে আসে হসপিটাল ছেড়ে।

“রাই এই নে স্যুপ করেছি,একটু গরম গরম খা”,মেয়ে কে কিছু খোলাখুলি না বললেও আজকাল বিশেষ কোনো কাজ করতে দেয় না জয়ন্ত।সুলেখা আর কাজ করার ক্ষমতায় নেই,কিন্তু দাদাবাবু দিদিমনির ওপর একটা অপত্য স্নেহ ওকে যেন বেঁধে দিয়েছে রাইদের সাথে।
জয়ন্তর ফোনে রাই অসুস্থ শুনে সাড়ে আট বছরের নাতির দায়িত্ব নিজে নিয়ে বৌমা অতসী কে পাঠিয়ে দিয়েছে জয়ন্ত দের সংসারে।
শুধু সপ্তাহান্তে শনিবার সকালে শনিবার-রবিবারের রান্না করে অতসী বাড়ি চলে যায়,ফেরে সোমবার সকালে।এই সপ্তাহের মাঝখান থেকে কাজ শুরু করলেও জয়ন্ত এই শনিবারও ওকে ছেড়েই দিয়েছে বাড়িতে।
“ভালো লাগছে না বাবা”,রাই চোখ বুজেই বলে।
“চিকেন স্যুপ তোর প্রিয় তো।খা একটু।ভালো লাগবে দেখ”,নিজেই চামচে করে স্যুপ নিয়ে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করতে থাকে জয়।
চোখ খুলে রাই এই দৃশ্যটা দেখে অপলকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে,তারপর ওর চোখটা আবার জ্বালা করে ওঠে।

হঠাৎ ওর মনে হয় ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যেন বড্ড অসহায়।জীবন প্রায় কিছুই দিলোনা তাঁকে।দশবছর আগে একটা ব্যর্থ কিন্তু মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছিল নিচের প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রী কে বাঁচাতে,পারেনি।
আজ ভগবান আবার একই পরীক্ষায় এনে ফেলেছে তাকে,শুধু মাত্র এবার উল্টো দিকে শুয়ে জীবনের একমাত্র অবলম্বন তার মেয়ে।বড্ড কষ্ট হয় রাইয়ের।বন্ধ চোখের দুধার দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
কেউ ওকে কিছুতেই স্পষ্ট ভাবে কিছু বলেনি কি আছে ওর রিপোর্টে।কিন্তু ও জানে রিপোর্ট পজেটিভ।নাহলে সত্যিটা কেউ এড়িয়ে যেত না।
জয়ন্ত এক মনে স্যুপ ঠান্ডা করছিল বলে নজর যায়না রাইয়ের দিকে,সেই ফাঁকে ও চোখটা মুছে নেয়।
“এই যে মা খেয়ে নে”,রাই চমকে ওঠে ওর বাবার সম্বোধনে।ওর জ্ঞান হওয়ার পর এই প্রথম এরকম ডাক শুনলো ওর বাবার মুখে।
মাথায় হাত বুলিয়ে জয়ন্ত স্যুপের বাটিটা এগিয়ে দেয় মেয়ের দিকে।
“বাবা তুমি খাইয়ে দেবে?” প্রচন্ড ইচ্ছাকে দমাতে পারেনা রাই।
এক অদ্ভুত করুন মুখে জয়ন্ত হাসি টেনে বাটিটা হাতে ধরে রাইয়ের পাশে এসে বসে।তারপর এক চামচ স্যুপ এগিয়ে দেয় ওর মুখে।
মুখটা শুকিয়ে,চোখের কোলে কালি পরে এক সপ্তাহে শীর্ণ হয়ে যাওয়া রাইয়ের মুখে ফুটে ওঠে অদ্ভুত এক তৃপ্তি।ওর মনেহয় বাবা আজ ছাপিয়ে যেতে চাইছে ওর মা কে।ছাপিয়ে যেতে চাইছে রাইয়ের প্রতি ভালোবাসায়,যত্নে,কর্তব্যে,যাতে বাবার ভালোবাসার কাছে হেরে মা রাইকে নিয়ে যেতে না পারে।হঠাৎ এই অদ্ভুত চিন্তায় ওর বুকটা হুহু করে ওঠে,এক অজানা ভয় ওকে অস্থির করে দেয়।বাবার সাথে সাথে মনের মধ্যে ভেসে ওঠে সেই অভিমানী ছেলের মুখটা,যে গত দুদিন অভিমানে ফোন করেনি রাইকে।

দুদিন আগে রণ এরকমই সন্ধ্যেবেলা ভিডিও কল করেছিল রাইকে,অনেক ভেবে সেই কল ধরেনি রাই।যতই ওকে সবাই সবটা এড়াবার চেষ্টা করুক,ওর মন সত্যিটা বুঝেছিল।আর সেই শারীরিক মানসিক কষ্টের প্রভাব পড়েছিল মুখে।রাই সিওর ছিল ভিডিও তে ওকে দেখলে রণ বুঝে যেত কোনো একটা গন্ডগোল ঘটেছে রাইয়ের জীবনে।তাই ভিডিও কল প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল ও।
কিন্তু সেদিন রণ কিছুতেই শুনছিলো না।ফলস্বরূপ কথা কাটাকাটি,আর এখন কথা বন্ধ।রাই জানে খুব খারাপ আছে রণ এই দুদিন,উল্টোপাল্টা ভেবে অভিমান করে আছে,আর অপেক্ষা করে আছে রাইয়ের ফোনের।
কিন্তু রাই চাইছে যেন চলতে থাকে এই ঝগড়া,রণ কোনোদিনও ওর কাছে আর না আসে।রাইয়ের এখন সারাক্ষনের চিন্তাই তো ওই ছেলেটা।
“কি ভাবছিস রাই চুপ করে?একটু কথা বল আমার সাথে।সারাক্ষন চুপ করে ঘরে শুয়ে বসে আছিস।আজকাল বইও পড়িস না।রণর সাথে কথা বলতেও দেখিনা।কি এত চিন্তা করিস রাতদিন।আরে তোর বাবা আছে এখনো,সেরে যাবি তুই।কিছু হবে না”,শত চেষ্টা করেও নিজেকে থামাতে পারেনা রাইয়ের বাবা,গলাটা অল্প হলেও কেঁপে যায়।
বুঝে যায় রাই জয়ন্তর মনে কি ঝড় চলছে।ও কিছুক্ষন বাবার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে জয়কে,বাচ্ছা মেয়ের মত মুখ গুঁজে দেয় বাবার বুকে।বড্ড বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে বাবার কথাগুলো।
বেডসাইড টেবিলে স্যুপের বাটিটা নামিয়ে রেখে জয়ন্ত ও দুহাতে আগলে নেয় মেয়েকে।বাবা মেয়ে দুজনের চোখই সিক্ত হয়ে ওঠে মুহূর্তে।
রাই মনে মনে বলে,’ক্ষমা করো বাবা।আমায় রক্ষা করো।আমি তোমার এই আদরটা আরো অনেক অনেক দিনধরে পেতে চাই’।
আর জয়ন্ত অস্ফুটে বিড়বিড় করে,”আমি আর হারবো না রাই,কিছুতেই তোকে হারিয়ে যেতে দেবনা।এবারে তোর মা হারবে,জিতবো আমি।আমাদের ভালোবাসা কিছুতেই বিফলে যাবেনা।এত পাপ করিনি শেষ বয়সে মেয়ের মুখাগ্নি করার অভিশাপ ভগবান দেবে।আমি জিতবো,তুই জিতবি,রণ-ঋষি-জয়ি জিতবে।শুধু বিশ্বাস রাখ”।

“কিন্তু রাইকে না জানিয়ে ওকে না বলে রণকে জানিয়ে দেব! ও যে এত করে বারণ করলো?” জয়ির ভাবনাটা ধরতে পারেনা ঋষি।
“রাই কতটা কি জানবে সেটা নাহয় রণর ওপর ছেড়ে দি আমরা?রণ রাইকে কি চোখে দেখে আমি মা হয়ে হয়তো একটু বেশি জানি তোদের থেকে।সামাজিক ভাবে রাইয়ের সাথে এই মুহূর্তে নিজেকে জুড়তে চেয়েছিল যে ছেলে সে মনের দিক দিয়ে কতটা এগিয়ে গেছে সেটা কি তোকে বলতে হবে ঋষি? রাইকে রণ এখন আর গার্লফ্রেন্ড না নিজের স্ত্রী ভাবে,ঠিক সেরকম অধিকার ও দেখায়।ওর অভিমান,ওর মন খারাপে ও এখন রাইকে খোঁজে,যেমন তুই আমায়।তোর মনে আছে রেশমার মৃত্যুর দিন রাতে তুই কি বলেছিলি,আমায় ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারবি না।রণর অবস্থা এখন ঠিক তাই।আর সেই কারণে রাইয়ের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত টুকু ওর থাক।জয় বাবা হিসেবে যতই ডিসিশন নিক,রণর কথা যে রাইয়ের কাছে শেষ কথা এটা আমি জানি।আর এরকম অবস্থায় রাইকেও রাজি করাতে পারবে একমাত্র রণ।শুধু চেষ্টা করতে হবে যাতে ও কলকাতায় ফিরে না আসে।ও বছর নষ্ট করলে রাই সেই কষ্টটা নিতে পারবে না।কিন্তু এবার রণকে জানানোর সময় এসেছে”,জয়ি নিজেদের বেডরুমের বেডে বসে জানলা দিয়ে দূরে দেখতে দেখতে বলে।
“কিন্তু আমি রণকে কি বলবো?কেন দুবছর স্ক্রিনিং হয়নি তার জন্যে আমাকে ও ভুল বুঝবে আমি জানি”,জয়ির পাশে বসে পরে এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা ঋষি।
হসপিটাল থেকে ফিরে ও ভেবেছিল চেঞ্জ করেই জয়িকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে জয়ের ফ্ল্যাটের জন্যে।কিন্তু জয়িকে রেডি না দেখে একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে ও।
কিন্তু জয়ির কথা ওকে অবাক করে। ও চায় রণকে আগে জানাতে,রণ রাইকে জানাতে চাইলে জানাবে।

“আজ তো এক সপ্তাহ হলো রণ গেছে।রাইয়ের সাথে নিশ্চই ফোনে কথাও হয়।এখন সব বলবি,এ’কদিন কিছু বলিসনি কেন সেটা বোঝাতে পারবি তো তোর ছেলেকে?ও ডাক্তার কিন্তু রাইয়ের ক্ষেত্রে আজকাল বড্ড পজেসিভ হয়ে গেছে।তাই ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে আর রাইকে কোনোভাবে মানসিক চাপ যেন না দেয় সেটাও বলবি”,ঋষি চিন্তিত স্বরে বলে।রণকে ফেস করা এখন ওর কাছে সবচেয়ে কঠিন কাজ।
“তুই থাকবি তো সঙ্গে?আর আমি বলার পর তুই রাইয়ের কন্ডিশনটা বুঝিয়ে বলিস।আর কি করলে ভালো হবে সেটাও”,শেষের কথাটা বলার সময় জয়ির গলা দুর্বল হয়ে যায়।
রণ ওর হাতে গড়া,কিন্তু বিয়ের আগে এধরণের ঘটনা ওর ছেলে কিভাবে নেবে সেই চিন্তাও কাজ করে।সবচেয়ে বড় কথা,রাই কে কিভাবে বোঝাবে ওরা! মানসিক ভাবে ভেঙে পড়তে দিলে হবে না।রণকে বোঝাতে হবে সেই পুরোনো বুঝদার রণকে এখন রাইয়ের দরকার।
“ঠিক আছে আমি ফ্রেশ হয়ে আসি,তারপর ফোন করবো”,ওয়াশরুমে ঢুকে যায় ঋষি।

নিজের বেডে চুপচাপ শুয়েছিল রণ।প্রায় একসপ্তাহ হল এসেছে এখানে।নতুন শহর,নতুন মানুষজন,নতুন পরিবেশ কোনোটাই খারাপ লাগেনি ওর।তাও যেন কোথায় একটা অস্থিরতা ওর মনকে এখানে বসাতে দিচ্ছে না।যে মেয়েটা কে ও এতো ভালো করে চেনে বলে ওর বিশ্বাস ছিল,ও এখানে আসার পর থেকে তার ব্যবহার বড় অচেনা ঠেকছে।মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে ও কি ভুল করলো!
কিন্তু রাই, রাইকে নিয়ে ও ভুল করবে কিকরে!তাহলে রাই কেন হঠাৎ বদলে যাচ্ছে।ও অভিমানী শুধু রাইয়ের জন্যে সেটা কি ও বোঝেনা?আজ পাঁচদিন হলো ও একবার দেখেনি অবধি মেয়েটা কে।ওখানে থাকতে যেদিন দেখা হতনা রাতে ভিডিও কলে কথা হত,এখানে আসার আগেও রাই বলেছিল রোজ একে অপরকে দেখতে তো পাবো।তাহলে কেন এখানে আসার পরপরই ওর মনোভাব বদলে গেল!
আজ দুদিন রণ অভিমানে ফোন করেনি বলে ও ও খোঁজ নেয়নি রণর!আজদিনটা দেখবে রণ,কাল নাহলে ফোন করে প্রচন্ড ঝগড়া করবে।রাই ভুল করছে,ও যাই করুক রণ আর ওকে কোনোভাবেই মুক্তি দেবেনা।
কেন রাই বোঝেনা ওকে ছাড়া রণ বাঁচতে অবধি পারবে না।অনিকেতের ঘটনার সময় রাইকে নিজের মনের কথা,অনুভূতির কথা জানানোর সুযোগ পায়নি তাই অনেক কষ্ট হলেও মানিয়ে নিয়েছিল মন কে।কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব না।
নিজের অদ্ভুত চিন্তায় ডুবে থাকতে থাকতে অসময়ে একটু চোখ লেগে এসেছিল রণর।
হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে ঘোর কেটে যেতে ধড়মড় করে উঠে বসলো ও।কিসব আজব স্বপ্ন আসছিল ঘোরের মধ্যে,রাই কোথায় যেন চলে যাচ্ছে ট্রেনে করে।
তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে,মম মিসড কল।

নিজেকে গুছিয়ে ভিডিও কল করে ও।বাবা মার সাথেও কদিন ভালো করে কথা হয়নি।এখানে সবার আলাদা সিঙ্গেল রুম,তাই আজ ভালো করে কথা বলবে।

“কিরে ফোন ধরলি না?” জয়ি ভিডিও কলে কথাগুলো বলতে না চেয়েও ছেলেকে দেখার লোভে ফোনটা শেষ অবধি রিসিভ করেই নেয়।

“হমম একটু চোখ লেগে গেছিল।ধরতে ধরতে কেটে গেল।কিন্তু তোমার মুখ চোখ এরকম কেন?শরীর ঠিক নেই নাকি?” মা কে চোখের জল বিশেষ ফেলতে দেখেনি রণ,তাই কাঁদার পর কেমন লাগে ঠিক জানে না ও।কঠিন মনের মম সবাইকে আগলে রাখে এটা দেখেই বড় হয়েছে ও।

“না রে শরীর ঠিক আছে।আসলে তুই নেই,বাড়ি ফাঁকা,মনটাও ভালো নেই কদিন…”,ইচ্ছা করেই প্রসঙ্গে ঢুকতে চায় জয়ি।

“মন খারাপ হবে জানতেই যদি আমায় দূরে পাঠাতে উঠে পড়ে লেগেছিলে কেন?যাইহোক আমি ভালোই আছি।বাবা কি হসপিটালে?” ফোনের হেডবারে সময়টা একবার দেখে নেয় ও,সন্ধ্যে প্রায় সাতটা।

“না এইতো তোর বাবা”,জয়ি ক্যামেরা ঘোরায় ঋষির দিকে,মৃদু হেসে হাত নাড়ে রণর বাবা।এবার সত্যি ধাক্কা খায় রণ,একি মুখচোখের চেহারা হয়েছে বাবার!

-“কি হয়েছে বলতো তোমাদের?এত পেল লাগছে কেন তোমাদের?”

-“তোর মমের সাথে আগে কথা বল।তারপর আমি বলছি”,শুকনো স্বরে বলে ঋষি।
রণ একটু চিন্তায় পড়লেও বাবা মার দুশ্চিন্তার প্রকৃত কারণ ও কোনোভাবেই আন্দাজ করতে পারেনা।হয়তো কখনো দুঃস্বপ্নেও এটা ওর চিন্তায় আসেনি বলে রাইকে নিয়ে অন্য নানাভাবে দুশ্চিন্তায় নিজে পুড়লেও এত ভয়ঙ্কর বাস্তব এত তাড়াতাড়ি ওর জীবনে আসতে চলেছে মনেও আসেনা ওর।

“রণ,আমি তোকে ফোনে কথাগুলো কিভাবে বোঝাবো জানিনা।কিন্তু, তোকে তার আগে কথা দিতে হবে..কোনো ভাবে তুই উত্তেজিত হবি না,ভুল বুঝবি না।আজ আমার সেই বুঝদার ম্যাচিউর ছেলেটা কে খুব প্রয়োজন বাবা।বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি আমি।বুঝতে পারছি বয়স হচ্ছে”,গলা ধরে আসে জয়ির।রণকে কিভাবে সত্যিটা বলবে ও কিছুতেই ঠিক করতে না পেরে নিজের মনের কষ্ট,চাপ বলে আত্মসমর্পণ করে দেয় ছেলের কাছে।

“মম প্লিজ আমি আছি।বলো কি প্রবলেম হচ্ছে তোমাদের।আমি টেনশন নিতে পারছিনা এতদূর থেকে।কিন্তু প্রমিস আমি রিয়াক্ট না করে শুনবো তোমার কথা”,রণ ভাবে মা-বাবার কোনো সমস্যা।ছেলে হিসেবে বরাবর ও ম্যাচুরিটি দেখিয়েছে,আজও তাই অনায়াসে কথা দিয়ে দেয়।

“রণ…”,কেঁদে ফেলে জয়ি ছেলেকে ছুঁতে না পেরে।মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে,ওকে বুকে টেনে কথা গুলো বলা অনেক সহজ হত আজ উপলব্ধি করে ও।
“মম প্লিজ,বলো।আমি আছি মম”,রণ ঠান্ডা গলায় সাপোর্ট দেওয়ার সুরে বললেও নিজে মনে মনে টেনশন করে ফেলে ওর কঠিন মনের মা কে কাঁদতে দেখে।
ঋষি একটা হাত এবার রাখে জয়ির কাঁধে।কিছুটা সামলে ধরা গলায় বলতে শুরু করে জয়িতা।

-“রণ,রাই…”।
-“রাই??…কি করেছে রাই?” একটা নাম রণর গলার আওয়াজ আপনা থেকেই বাড়িয়ে দেয়।
-“রাইয়ের সেকেন্ড স্টেজ ব্রেস্ট ক্যান্সার ডায়াগনোসিস হয়েছে রণ।”

হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিত কোনো খবর হয়তো ব্রেইনের গ্রহণ করতে সময় লাগে।আজ রণর মুখের ভাব দেখে জয়ির পাশে বসা ঋষির সেটাই মনে হয়।কোনো অনুভূতিই সেই মুহূর্তে খেলা করেনা ওর মুখে।যেন কথাটা কানে ঢুকেও মাথায় পৌঁছায়নি মনে হয়।জয়ি অপেক্ষায় থাকে ছেলের প্রতিক্রিয়ার।

“আর একবার বলো মা,রাইয়ের কি হয়েছে?” যেন ঝড়ের একটা পূর্বাভাস ধরা পড়ে রণর গলায়।
জয়ির হাত থেকে ঋষি এবার ফোনটা নেয়,”রণ লাস্ট সানডে স্ক্রিনিং এর সময় রাইয়ের রাইট ব্রেস্ট আর আরমপিটে লাম্পস ডিটেক্ট হয়।ওইদিন ই বায়োপসি করতে পাঠানো হয়।রিপোর্ট আসে ম্যালিগনেন্সি পজিটিভ,সেকেন্ড স্টেজ।তবে আপাতত মেটাস্টাটিক না।রণ কি ভাবছিস তুই?” ঋষি খেয়াল করে রণ যেন ওর কথা ঠিক করে শুনছে না।
“বাবা কার ডিসিশন ছিল আমায় না জানানোর?” রণ ঋষির চোখে চোখ রাখে।ওর বুকের মধ্যে অসম্ভব এক তোলপাড় হচ্ছে।মনে হচ্ছে ও যেন তলিয়ে যাচ্ছে এক ঘূর্ণির মধ্যে।ওর কথা বলার ক্ষমতাও নেই,অতি কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে যে প্রশ্নটা করে ওর মাথায় ওটাই ধাক্কা মারে আগে।
“দেখ রণ,রাই আমায় স্ক্রিনিং এর জন্যে বলে তোকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে ফেরার পথে ।আমিও ভেবেছিলাম রুটিন চেকআপ এর জন্যে বলছে।কিন্তু টেস্ট করতে গিয়ে…তোকে রিপোর্ট না পেয়ে কি বলতাম বল”,রাইয়ের জেদের কথা এড়িয়ে যায় ঋষি।
“রাই বারণ করেছিল,তাই তো?আর সেই জন্যে ও নিজেও আমায় কদিন এভয়েড করার চেষ্টা করছে,আমি অভিমান করলে যে কান্নাকাটি করে সে দুদিন হয়ে গেল যেচে ফোনও করেনি।আর ঝগড়ার কারণ যে ভিডিও কল,সেটাও এড়িয়ে যাওয়ার কারণটা…ঠিক আছে আমায় জানানোর দরকার…”,রণ থেমে যায় ঋষির প্রায় চিৎকারে।
“রণ প্লিজ।তোর কি মনেহয় এখন মান অভিমানের সময় এটা? রাইয়ের কোনো রকম মেন্টাল স্ট্রেস যেন না পড়ে।তুই দুদিন কথা বলিসনি ওর সাথে,আমি জানলে তোকে আগেই…”,এবার থামতে হয় ঋষিকে।

“কি আগে বাবা?তোমরা প্ল্যান করে বলোনি আমায়।রাই আগেই বুঝেছিল নিশ্চই।আর সেদিন এয়ারপোর্টে তোমায় আমি জিজ্ঞেস ও করেছিলাম লাস্ট চেকআপ কবে হয়েছে,তুমি এড়িয়ে গেলে।তুমি কতদিন আগে টেস্ট করেছ,তখন ইউএসজি (USG) করোনি,তাহলেও বুঝতে পারনি কিছু? আমার কেরিয়ারটাই তোমাদের কাছে ইম্পরট্যান্ট,আমার জীবন না।…”,এবার জয়ি থামায় রণকে।

“রণ প্লিজ আগে পুরো কথা শান্ত ভাবে শোন।আমরা তোকে জানায়নি কারণ আমরা ভাবিনি এই বয়সে রাইয়ের ভয়ের কিছু আছে।অস্বীকার করবো না টেনসন হয়েছিল।কিন্তু তুই সেই মুহূর্তে গিয়ে পৌছেছিস…কিন্তু এবার তোকে জানাতেই হত।আমি জানি তুচ্ছ মান অভিমান করার মত বোকা তুই নোস।যে ঝড় এসেছে আমাদের সবার জীবনে,এখন সবাই মিলে সেটা সামলানোই আসল কথা।রাইয়ের ট্রিটমেন্ট নিয়ে আলোচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে রোগমুক্ত করাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”

-“কিসের চ্যালেঞ্জ মা।কিছু হবে না রাইয়ের।ভগবানেরও ক্ষমতা নেই আর ওকে আমার থেকে সরিয়ে নেওয়ার।আমি শেষ অবধি লড়াই পৌঁছতেই দেবনা।দরকারে আমার ক্ষমতার বাইরে গিয়েও ওকে স্টেটস এ নিয়ে যাবো।শীর্ষা আছে ওখানে।”

-“রণ আমার কথা শেষ হয়নি।এসব কথা ফোনে আলোচনা করা চাপ কিন্তু আর তো উপায় নেই।”ঋষি দম নিয়ে আবার বলে,”বায়োপসি রিপোর্ট রাই ক্লিয়ার জানেনা।কিন্তু আজকের যুগের মেয়ে ও বুঝে যাবে আমি জানি।কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় রণ…”।

-“বলো বাবা শুনছি আমি।এরপরেও আর বড় কি সমস্যা থাকতে পারে বলো”,ক্লান্ত ভেঙে পড়া গলায় কথাটা বলে রণ।এতক্ষন বসে বসে কথা বলছিল,এবার খাটের রেলিংয়ে রাখা বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে গা এলিয়ে দেয় ও।কোনো কিছুই যেন চিন্তা করার ক্ষমতা নেই ওর,খালি মনে হচ্ছে কখন রাইয়ের কাছে যেতে পারবে।জড়িয়ে ধরবে ওকে,কারোর ক্ষমতা হবে না ওর কোনো ক্ষতি করার।বড্ড ফাঁকা লাগছে বুকটা।

“রণ প্লিজ তুই ভেঙে পড়ল রাইকে বোঝাবে কে বল?” জয়ি পাশ থেকে বলে।কিন্তু কোনো উত্তর দেয়না রণ,আরো কঠিন কোনো সমস্যা শোনার শক্তি সঞ্চয় করতে চোখটা বোজে ও,আর এতক্ষন ধরে চোখে জমে থাকা জলটা গাল দিয়ে গড়িয়ে আসে।

“রণ আমি ভেবেছিলাম রাইয়ের লাম্পেক্টোমি করে জাস্ট ওই টিউমার দুটো আর ওর আশেপাশের টিস্যু রিমুভ করে দেন রে আর কেমো দেব।টিউমার দুটো খুব বেশি বড় তো না।কিন্তু আজ ব্লাড টেস্ট রিপোর্ট পেলাম রাইয়ের,মিউটেশন রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে,ওর BRCA1 মিউটেশন হয়েছে।” ঋষির গলাওকেঁপে যায়।

উফফ দাঁতে দাঁত চিপে কষ্টটা আটকানো…আর পারছে না রণ।মাথাটা ফেটে যাচ্ছে,একটা বিশাল হাতুড়ি পিটছে কেউ মাথায়।কানের মধ্যে থেকে আগুন বেরোচ্ছে।
কয়েক বছর আগেও রণ ভাবতো ও জীবন সত্যি ভগবানের আশীর্বাদ,সমস্যাহীন উদ্বেগহীন।ভগবানের বরপুত্র ভাবতো নিজেকে।
রাই যেদিন অনিকেতের কথা বললো প্রথম বুঝলো জীবনে না পাওয়ার কষ্ট কি! এরপর নিজেকে সামলাতে সামলাতে কবে যেন ওর কোমল স্বভাবে কাঠিন্যের আবরণ পড়লো।এখন ওর ধৈর্য্য কমেছে।ও নিজেও জানেনা কবে থেকে রাইকে ভালোবাসার সাথে একটা অভিমানও জুড়েছে ওর অনুভূতিতে।অল্প বয়সে পরিণত রণ আজকাল বড্ড অস্থির হয়ে যাচ্ছে স্বভাবে।
কেউ জানেনা যে ভয় রণকে স্বভাবে অল্প হলেও উগ্র অস্থির করেছিল সেই ভয়টাই বাস্তব হয়ে আজ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।যে রোগ রাইকে ওর কাছে এনেছিল,সেই রোগ আজ রাইকে…”না,না,না”।

“রণ কি হলো তোর?কিরে শরীর খারাপ করছে?” ফোনের ওপারের উৎকণ্ঠাভরা কণ্ঠ দুটো হঠাৎ ধাক্কা দেয় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা রণর মাথায়।

চোখ খোলে ও।এখানে আসার আগে রাইকে যাতে ভালো দেখতে পায় নতুন আইপ্যাড কিনেছিল ও।সেটাই স্ট্যান্ডে রেখে কথা বলছিল বাড়িতে।
চোখ খুলে তাকায় ফোনের দিকে,”বাবা গিম মি সাম টাইম প্লিজ। আই’ল কল য়্যূ আসাপ।” ঋষি বা জয়ির উত্তরের অপেক্ষা করেনা রণ,কল কেটে দেয়।

হাত বাড়িয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে রণ বের করে সিগারেটের প্যাকেট।কাঁপা হাতে একটা সিগারেট মুখে পুরে দু তিনবারের চেষ্টায় লাইটারটা জ্বালাতে পারে।শুধু দুটান, ব্যাস তারপর আস্ট্রেতে গুঁজে দেয় জ্বলন্ত সিগারেট।দুমাস খায়নি একটাও,কিন্তু এখানে এসে যখন রাইয়ের জন্যে বড্ড কষ্ট হয় একটা সিগারেট ধরিয়ে হাফ শেষ করার আগেই ফেলে দেয় ছুঁড়ে।রাইকে কোনো কারণ দেবেনা রোগটা আপন করার এই পণ যে ওর বহু বছরের।সেই কারণে অঙ্কলজিস্ট হওয়ার ইচ্ছা।সব শেষ,আজকের পর কিছু লক্ষ্য নেই আর ওর জীবনে।শুধুই অন্ধকার।ওর জীবনের আলোর শিখা এত তাড়াতাড়ি কেঁপে যাবে ভাবেনি ও।কিন্তু না,ওর বাবা মা ওর নাম রাখার সময় হয়তো দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিল।যুদ্ধটা ওর,রাইয়েরও না,তাই ও ঠিক জিতবে।
প্রতি মুহূর্তে ও যেমন ভাবতো প্রতিটা দুঃখ,কষ্ট,কান্না কে ওকে পেরিয়ে যেতে হবে রাইয়ের কাছে,আজও ও জানে মৃত্যু আর রাইয়ের মাঝে ও থাকবে।চোখটা বোজে রণ,ওই তো ওর পেছনে রাই দাঁড়িয়ে।আর রাইয়ের সামনে ঢাল হয়ে ও দাঁড়িয়ে।এই দৃশ্যটা সেই কবে থেকে ওকে শক্তি দেয়,আজও অনেকটা সাহস দিলো।একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ খুলে তাকালো রণ।
হাত বাড়িয়ে আইপ্যাড নিয়ে স্ক্রিনটা ছুঁলো, ভেসে উঠলো ওর বুকের মধ্যে ঢুকে দাঁড়িয়ে রাইয়ের ছবি।বুকে চেপে ধরলো রণ ফটোটা,হয়তো আলো নিভে গিয়ে লকস্ক্রিন ওয়ালপেপারটা অন্ধকারে ঢেকে যাবে,কিন্তু রণর মনে ছবিটা জ্বলে থাকবে অনেক্ষন।

আজকাল বাবা একটা হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ দিচ্ছে রোজ রাতে,ঋষি আঙ্কেলের পরামর্শেই,আর রাই তাই রাতে বিশেষ জাগতে পারছে না।যন্ত্রনা হয় আজকাল অল্প,সাথে জ্বালা জ্বালা।ওষুধ খেলে ঘুমোলে অনেকটা ভালো থাকে ও।অন্যদিন অতসী দি শোয় ওর ঘরেই মেঝে বিছানা করে,আজ ও বাড়ি গেছে সপ্তাহের শেষে।বাবা বলেছিল শোবে, রাই শুতে দেয়নি।দরজা লক না করে ভিজিয়ে রেখেছে, আর অসুবিধা হলে ফোন করে ডাকবে জয়ন্ত কে, কথা দিয়েছে।
ঘুমের মধ্যে হঠাৎ কানে এলো ফোনটা যেন রিং হচ্ছে।খুব কষ্ট করে চোখটা অল্প ফাঁক করে দেখল রণর ফোন,সময় রাত একটা।নেশার ঘোরে যাহোক করে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিলো।
“র-ণ…”,রাই প্রথম কথা বলে।কিন্তু উত্তর আসেনা।একটু ভয় পায় রাই, আবার ঝগড়া করবে নাকি?আজকাল কথাকাটাকাটি ভালো লাগেনা।

“রা-ই।আমার রাই।আমার রাই মিথ্যে বলেনা।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রণ।কিছুক্ষন চুপ থেকে বলতে শুরু করে কথা,সেই কথা যা এতদিন ভয় হয়ে চেপেছিলো ওর মনে।আজ রাইকে বোঝাতে হবে ওর জীবনে রাই কি!তাই শুরু করে সেই ভয় দিয়েই।

ক্রমশ…