মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-২৪

0
418

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#চতুর্বিংশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“বল ঋষি কি খবর জানাবি?আজকাল সত্যি বলতে তোর ফোন এলে বড্ড ভয় করে রে”,বিগত রবিবার জয়ন্তর জীবনে দ্বিতীয়বার জীবন ওলটপালট করা যে ঝড় এনেছে তা পুরোপুরি ভাবে ভেঙে দিয়েছে ওকে।এখনো শুধু ও দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ের মুখ চেয়ে।তাই আবার একটা রোববারের সকালে যখন ঋষির ফোন এলো ওর ফোনে আতঙ্কে সত্যিটা বেরিয়েই এলো ওর মুখ থেকে।
“জয় কাল রাইকে নিয়ে চলে আসিস দশটা নাগাদ,কিছুদিনের জন্য এডমিট করতে হবে ওকে।এবার শুরু করতে হবে ওর ট্রিটমেন্ট।আর দেরি করা যাবেনা।আচ্ছা রণর সাথে রাইয়ের কোনো কথা হয়েছে কিনা কিছু জানিস?” ঋষি ভেবেছিল আজ যাবে জয়দের ফ্ল্যাটে,বুঝিয়ে বলতে রাইকে।শেষ অবধি আর সাহসে কুলোয়না।ভাবে আগে এডমিট করে ট্রিটমেন্ট শুরু করে কথা বলবে এ বিষয়ে।
সেই হসপিটালে রোজ যাতায়াত,সেই দিনের শেষে প্রিয়জনকে অপ্রিয় জায়গায় ছেড়ে চলে আসা,সেই সবসময়ের উৎকণ্ঠা…জয়ন্তর মনে যেন আরো বেশি ওজনের পাথর চাপিয়ে দেয় কেউ।ওর মনে ফিরে ফিরে আসে দশবছর আগের সেই দুঃসহ দিনগুলো।
ক্লান্ত গলায় উত্তর দেয় জয়,”নিয়মিত যদি নিয়ে যাই হবে না?এডমিট করতেই হবে?”
“জয় তুই কিন্তু একজন ডাক্তার।তোর কাছে এরকম কথা আশা করিনা”,ঋষি নিজেও কতটা ভাঙা মনে কথাগুলো বলছে শুধু ওই জানে।রেশমা ওর দায়িত্ব হলেও প্রকৃত অর্থে দায় ছিল শুধু জয়ের,কিন্তু রাইয়ের সাথে যে ওরা সবাই জড়িয়ে গেছে।রাই এখন জয়ের মত ঋষির কাছেও নিজের মেয়ের থেকে কম না।তাই ওর ক্ষেত্রে আর কোনো রিস্ক ঋষি নেবে না।
“ঋষি ভগবান কেন ভাবেনা বলতো আমি ডাক্তার হলেও মানুষ।আমার সাথেই কেন একই খেলা বারবার খেলে?রেশমার ওপর অভিমান করে মেয়েটা কে সময় থাকতে ইগনোর করেছি,আর এখন…”,গলা বুজে আসে জয়ের।

“নিজেকে সামলা জয়।আমি জানি তোর লড়াইয়ের কোনো তুলনা হয়না,কল্পনাতেও হয়তো পৌঁছতে পারবো না তোর লড়াইয়ের আশেপাশে।তোর জীবনটা কতটা না পাওয়াতে ভরা।তাও বলবো এই মুহূর্তে তোর শক্ত থাকাটা খুব দরকার।কাল আমি রণকে সব বললাম।জানিনা ও কি রিয়াক্ট করবে।রেশমা যাওয়ার পর তোর অবর্তমানে রাইকে সবচেয়ে বেশি সামলেছে ও।কিন্তু তখন সেটা ছিল রাইয়ের শুন্যতা।আজ রাইয়ের জায়গায় রণ দাঁড়িয়ে,তাই রাইকে ও নিজে কতটা সাপোর্ট দিতে পারবে জানিনা।” ঋষির গলাই জয়কে বুঝিয়ে দেয় রণর অবস্থা।
টুকটাক কথা বলে ঋষি যখন ফোন রাখে তখন ঘড়িতে সকাল ন’টা।একটু লিকার চা করে দুটো বিস্কুট নিয়ে রাইয়ের দরজায় গিয়ে নক করে।রাতে রাইকে দরজা বন্ধ করতে না দিলেও এতদিনের দূরত্ব ওকে ওর প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ের ঘরে নক না করে ঢুকতে বাধা দেয়।নক করার সাথে সাথেই রাইয়ের ঘর থেকে ডাক আসে।
দরজা ঠেলে ঢোকে জয়ন্ত মুখে হাসি টেনে,ও জানে এটাই সবচেয়ে বড় মেডিসিন ওর মেয়ের জন্য।
বাবার মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ে মেয়ের শুকনো মুখেও আর জয়ন্তর আগেই রাই তার বাবাকে বলে,”গুড মর্নিং বাবা।কখন উঠেছ?”
অবাক চোখে তাকায় জয়ন্ত মেয়ের দিকে।মুখে হাসিটা আলগা করে ধরে রেখে রাই বলে,”কাল রণদা ফোন করেছিল রাতে।আমার বোকামির জন্যে রাগারাগি বা অভিমান করেনি।উল্টে সেই আগের মত যেন আমার পাশে এসে বসেছিল।রণদা অদ্ভুত কথা বললো কাল।বললো আমার রোগ নিয়ে ও সারাক্ষন টেনশনে থাকতো যেদিন থেকে আমার প্রথম স্ক্রিনিং এর কথা বলে আঙ্কেল।রণদা সাইক্রিয়াটিস্ট হতে চেয়েছিল,কিন্তু আমার স্ক্রিনিং ওর মনে অঙ্কলজিস্ট হওয়ার ভাবনা ঢুকিয়েছিলো।কাল ওর কথায় বুঝতে পারলাম কেন ও বদলে গেছিলো শেষ কবছর।একটা ভয় থেকে।সেই ভয় সত্যি হয়ে এসে সামনে দাঁড়াতে…জানো বাবা আমি জানি খুব ভেঙে পড়েছে ও মানসিক ভাবে।একটা কথাই বুঝিয়ে দিলো।বলছিল,কেন আমি ওকে আর একটু সময় দিলাম না।অল্প কথা বলে আস্তে আস্তে কথার জালে আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিলো।রণদা যতদিন না জানছিল অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছিল মনে।আসলে ওকে কিছু লুকোয়নি প্রায় শেষ দশবছর।আমার ফ্রেন্ড,ফিলোসফার এন্ড গাইড সব তো ওই।ওর কথা গুলো মনে জোর দিলো।আমায় লড়তে হবে বাবা।আমি শেষ দিন অবধি হাল ছাড়বোনা”।
চায়ের কাপটা রাইয়ের বেডসাইড টেবিলে রেখে ওর পাশে গিয়ে বসে জয়ন্ত।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”রণ কে বড্ড ভালোবাসিস না রে রাই? অনেক বছর পর তোর জন্যে কলকাতায় ফিরে আমি রণকে দেখেই বুঝেছিলাম ছেলেটাও তোকে চোখে হারায়।কিন্তু তুই নিজে কিছু বলিসনি এই দুবছর।আজ অনেক বছর পর যখন সব ঠিক হচ্ছিল তোদের দুজনকে ঘিরে…”,চুপ করে যায় জয়।তারপর তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।আমরা আবার সবাই মিলে খুব আনন্দ করবো।রণ শুধু না তোর বাবার ও যে তোর জন্যেই বেঁচে থাকা রাই।আমাদের সবার জন্য এই যুদ্ধটা জেতা খুব দরকার।তুই মনে জোরটা রাখবি।”

রাই বাবার কথায় একটু যেন কি ভাবে।তারপর মুখ খোলে,”মা চলে যাওয়ার পর আমার সবচেয়ে দরকার ছিল তোমায়।কিন্তু তখন না বুঝলেও এখন বুঝি তোমার তখন একটু সময়ের দরকার ছিল।সেই সময় আমার মন খারাপ হলেই রণদা ঠিক বুঝতে পারতো।জানো বাবা রণদা মুখের কথা বলতো,আর আমি মনে মনে বিশ্বাস করতাম আমরা শুধুই বন্ধু।কিন্তু তারপর আমার জীবনে অন্য একজন এলো,রণদা কে শুধুমাত্র জানালাম।বুঝিনি তখন কতবড় আঘাত দিচ্ছি ছেলেটা কে”,রাইয়ের গলা ধরে আসে।

“কি বলছিস রাই,রণ তো কিছু বলেনি?” প্রকৃত অর্থে চমকে যায় জয়ন্ত।

“না কাউকে বলেনি।ছমাস রেখেছিলাম সেই সম্পর্ক।কেন ভেঙেছিল জানো?আমি ভেঙেছিলাম।আমায় মুখে কিছু বলতে পারেনি রণদা।কিন্তু আমার সম্পর্ক ওকে বদলে দিচ্ছিলো।সরে যাচ্ছিল ও আমার থেকে।আমি সেটা মানতে পারিনি।কোনো কিছুর বিনিময়ে ওকে হারাতে পারবো না সেদিন বুঝেছিলাম।কিন্তু রণদা কে বলতে পারিনি আর ভাঙার কথাটা।দিন কাটছিল।…আচ্ছা বাবা রণদা কে জানাতে আমার কি বড্ড দেরি হয়ে গেল?সময় কি আর পাবোনা ওর সাথে জীবনটা কাটানোর?” মৃত্যুর ডাক আজকাল রাইকে জয়ন্তর সাথেও অনেক সহজ করে দিয়েছে কথাবার্তায়।
জয় রাইয়ের কাঁধ খামচে ধরে,”এই না তুই বললি ভেঙ্গে পড়বি না।আমার জীবন তো শেষের দিকে রাই,যদিও তোকে কষ্ট পেতে দেখার ক্ষমতা আমারও নেই আর।আমি ভালোবাসার প্রকাশেও বড্ড আনাড়ি,তোর মা হয়তো চেয়েছিল এই প্রকাশ টা অনুভব করতে।কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে বলতে পারি সারাজীবনের সঙ্গীকে শেষ বিদায় জানানোর ক্ষমতা সবার হয়না।আমি পেরেছিলাম হয়তো তোর মুখ চেয়ে,কিন্তু রণ…পারবে না রাই।সুস্থ তোকে হতেই হবে নাহলে ওই ছেলেটার জীবনও…”,জয়ন্ত বাবা হয়েও আজ রণর ভালোবাসাকেই আশ্রয় করে মেয়ের মনের জোর বাড়াতে।

মুখে কিছু বলেনা রাই,হঠাৎ রণর জন্যে মনটা হুহু করে ওঠে।বিগত সাত বছর প্রতিটা দুঃখ কষ্টতে বাবার অনুপস্থিতিতে যাকে আশ্রয় করেছে আজ তার অভাবে বাবার বুকে মুখ গুঁজে একটু আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করে।রাই একটা সহজ সরল সাধাসিধে মেয়েটা এতদিনে এটা অন্তত বুঝেছে জীবনসঙ্গী মানে শুধু সেবা,ভোগ বা সংসারের প্রতিশব্দ না।জীবনসঙ্গী মানে বন্ধুও,জীবনসঙ্গী মানে আশ্রয়ও।আবার জীবনসঙ্গী ভালোবাসা ছাড়াও স্নেহের স্পর্শ।জীবনসঙ্গী যেমন আদর করে,তেমনি দরকারে ঠিক ভুল শুধরে দেয়,আবার বাবার মত দরকারে শাসনও করে,নিজের ছোট বাচ্চার মত শাসন-আদর চায়।একটা অদ্ভুত পরিপূর্ণ সম্পর্ক এই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক,যা সুন্দর হয় পারস্পরিক বিশ্বাস,সম্মান আর ভালোবাসায়।সব সম্পর্ক সামলেও এই সম্পর্কের গাছে নিয়মিত ভালোবাসার জল সিঞ্চন করতে হয়,দিতে হয় বিশ্বাসের সার।তবেই তা সুন্দর হয়।একে অপরের প্রতি কর্তব্য যেমন প্রয়োজন তেমন দরকার একে ওপরের কাছে আত্মসমর্পণ ও।রাগারাগি,অভিমান যাইহোক সম্পর্কের গোড়া মজবুত থাকলে শত কম্পনেও ফাটল ধরা মুশকিল,আর সেটাই ওর আর রণর সম্পর্কে ও অনুভব করে।আর তাই ফিরে আসতে ওকে হবেই,নাহলে ও বিশ্বাস ভাঙবে রণর।ভালোবাসার ওপর বিশ্বাসই হারিয়ে ফেলবে ছেলেটা।

এয়ারপোর্টের বাইরে ক্যাবে উঠে চোখ থেকে রোদচশমাটা খুলে হাতে নেয় রণ।কাল ঋষির ফোন পাওয়ার পর যখন জীবনে বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছিল,প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল রাইয়ের ওপর।ওর মনে ভেসে উঠেছিল সেই প্রথমদিনের অসহায় মেয়ের মুখটা।প্রথমদিন যাকে দেখে ও আর অন্য কারোর কথা কখনো ভাবার সময় পায়নি,সেই মেয়েটাকে এত সহজে হারিয়ে যেতে দিতে ও পারবে না।শারীরিক ভাবে রাই অসম্পূর্ণ হলে যদি ওদের দুজনের ভালোবাসা সম্পূর্ণ হয় ক্ষতি কি তাতে?আগে তো রণর সাথে রাই,তারপর তৃতীয় কারোর কথা ভাবা যাবে।ওকে বাঁচাতেই হবে নিজের জীবনকে।
দেরি করেনি রণ।দরকারি কটা ফোন করে জোগাড় করে ফেলে দিন তিনেকের ছুটি,আর রাতে রাইকে ফোন করে ঘুম পারানোর পর নিজের সঙ্গী ব্যাগপ্যাকে কয়েকদিনের প্রয়োজনীও জিনিস ভরে বেরিয়ে পড়ে হোস্টেল ছেড়ে।
ক্যাবে বেশিক্ষন লাগবে না তাও চোখটা বুজে ঘাড়টা হেলিয়ে দেয় পেছনের দিকে।

“রণদা খুব মেঘ করেছে আজ।তুমি আজ সন্ধ্যেবেলা আসবে বলেছিলে,এসো না।এমনিও বাবা বাড়িতে নেই।সামনের ফ্ল্যাটের আন্টি আগের দিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উল্টোপাল্টা বলছিল।ঠিক খেয়াল রাখে কখন আমি ফ্ল্যাটে একা থাকি।আজ বাইরেও বেরোতে পারবো না,সেই ফ্ল্যাটে আটকে….”,শেষ করতে পারেনা রাই নিজের কথা,ফোনের ওপাশে রণর গম্ভীর গলা ভেসে আসে।
“ঠিক আছে যাবোনা।” ফোন কেটে দেয় রণ,বুঝতে পারে রাই কিছু বলার চেষ্টা করছিল পাত্তা দেয়না। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে এসে রমাকে জাস্ট জানিয়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।
সেদিনও বাড়িতে গাড়ি ছিলোনা,প্রাইভেট ক্যাবে করে পৌঁছে গেছিলো ও যথাসময়ে রাইদের কম্পাউন্ডে।
যখন ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে বেল টিপছে বুঝতে পেরেছিল সামনের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়িয়ে আছেন ওঁদের মেইন দরজার পেছনে।হয়তো ‘আইহোল’এ চোখ রেখে এই ফ্ল্যাটের আগুন্তুককে দেখছেনও।মাথা ঠান্ডা রণর মাথাটা দপ করে উঠেছিল হঠাৎ করেই।
এপাশে রাই দরজা খুলে কিছু প্রশ্ন করার আগেই দেখেছিল রণ বেল দিচ্ছে উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে।ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি ও।বুঝেছিল যখন রণ মুখ খুলেছিল আন্টি সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে এসে সামনে দাঁড়াতে,”নমস্কার,আপনি মনেহয় এই ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়া এসেছেন?”
“না তো।প্রায় বছর খানেক হলো আছি।”অবাক ভদ্রমহিলা উত্তর দিয়েছিলেন।
“আচ্ছা।এই যে সামনের ফ্ল্যাটটা দেখছেন এটা আমার নিজের দাদু দিদার।দিদার মৃত্যুর পর এখানে থাকেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু।তাই আমি প্রায় এখানে আসি।রাইয়ের কাছে শুনছিলাম আপনি ওঁর খেয়াল রাখেন যখন আঙ্কেল থাকেন না।শুনে ভালো লাগলো।কিন্তু যদি কখনো দেখেন আমি এসেছি ওই ফ্ল্যাটে আপনিও ততটাই নিশ্চিন্ত হবেন,কারণ আমি ওর বন্ধু শুধু না ওর ফিয়ান্সে ও।তাই…”,হাত তুলে নমস্কার করে রণ মুখ ঘুরিয়ে রাইয়ের দিকে চলে আসে।
রণর ব্যবহার রাইকে শুধু হতভম্ব করেনি প্রচন্ড রেগেও গেছিলো মেয়েটা সেদিন।

“স্যার”। ক্যাব ড্রাইভারের ডাকে চোখ মেলে তাকায় রণ।
এসে গেছে রাইদের সোসাইটি।

জয়ন্ত কিচেনে মাংসের পাতলা ঝোল বানাচ্ছিলো।চিকেন রাইয়ের হট ফেভারিট।মেয়েটা এমনি কদিন কিছু খেতে চাইছে না,একটু মাংসের ঝোল হলে দুটো ভাত খাবে।অতসী ডাল তরকারি করে রেখে গেছে,কিন্তু আজ আর সেগুলো বের করেনি ও ফ্রিজ থেকে।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে চমকে উঠলো জয়ন্ত।একে তাড়াহুড়ো করছে,বেলা হলো,মেয়েটার খেতে দেরি হয়ে যাবে।কিন্তু কিছু করার নেই।গ্যাস কমিয়ে হাতটা ধোয়, কিচেন থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায় ফ্ল্যাটের দরজার দিকে।
একটু আগে মুখ বাড়িয়ে দেখেছে রাই ঘুমোচ্ছে,কে জানে বেলের আওয়াজে উঠে পড়লো কিনা!

“তুই!!!তুই কবে ফিরলি?আজই তো ঋষি ফোন করেছিল,কিছু বললো না তো?” বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে মনে হলো জয়ন্ত কে দেখে।
“আঙ্কেল চিকেন করছো?ভাত হয়ে গেছে?” হালকা মেজাজে বললেও রণর স্বরের ক্লান্তি কান এড়ালো না জয়ন্তর।
-“আয়, ভেতরে আয় তুই।সম্ভবত সোজা এয়ারপোর্ট থেকে আসছিস?” একবার ওর ব্যাকপ্যাকটা দেখে নিয়ে বলে জয়।
-“হমম।রাই কেমন আছে?”
-“ঘুমোচ্ছিলো।এই রান্না শেষ করে ডাকবো বলে তাড়াতাড়ি করছিলাম।ভাত বেশি করেছি,তুই যা আমার ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে”,জয়ন্তর কথায় ওর মুখের দিকে করুন ভাবে তাকায় রণ।একটা হট বাথ সত্যি দরকার ওর।’এই অসময়ে রাই ঘুমোচ্ছে,তাহলে শরীরটা কি একদম খারাপ?’ এই চিন্তা মাথায় নিয়ে কথা না বাড়িয়ে জয়ন্তর রুমেই ঢুকে যায় ও।
ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়।’ছেলেটা কি সব ছেড়েছুড়ে চলেই এলো!’
কি ভেবে নিজের ফোনটা নিয়ে কিচেনে চলে যায়।ঝোলের কড়াইতে একটা নজর দিয়ে জয়ির নম্বরে কল বাটনটা টিপে দেয়।

চান করতে করতে ক্যাবের স্মৃতিচারণ আবার ফিরে আসে রণর মনে।রণ চেয়েছিল ফ্ল্যাটে ঢুকেই ছুটে গিয়ে রাইকে একবার অন্তত দেখে আসতে ওর রুমে ঢুকে,সেদিন যেমন গেছিল ক্রুদ্ধ রাইয়ের পিছন পিছন ওর ঘরে।
“এটা কি হলো?এখনো নিজেদের মা বাবারা ঠিক করে জানেনা বাইরের লোক জেনে গেল আমরা কাপল! তাছাড়া ওভাবে বলার কোনো দরকার ছিল কি?” যথেষ্ট ঝাঁজ ছিল সেদিন রাইয়ের কথায়।

“বাবা মা সব বোঝে নাহলে নবমীর দিন আমাদের দুজনকে রেখে ঠাকুর দেখতে বের হতো না।আর ওই ভদ্রমহিলা আড়ি পাতছিলেন বুঝতে পেরেই ওই কথা গুলো বললাম।” অজুহাত দেয় রণ।

“তাই বলে অত রুডলি?তুমি তো এরকম কখনও ছিলেনা রণদা?এখন মাঝে মাঝে তোমায় চিনতে বড় কষ্ট হয়”,রাই লক্ষ্য করেছে ওর সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারেই এভাবে রিয়াক্ট বেশি করে রণ।

এতক্ষন ব্যালকনির দরজার দিকে মুখ করে কথা বলছিল রণ।রাইয়ের কথায় ওর দিকে ঘুরে দুহাত দিয়ে ওর দুটো কনুই একটু জোরে চেপে ধরে রণ সেদিন বলেছিল,”সাত বছর অপেক্ষা করার পর নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার উৎকণ্ঠা জানিস তুই?জানিস চোখের সামনে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে বললে হাসি মুখে মেনে নেওয়ার কষ্ট?প্রতি মুহূর্তে দেখতে ইচ্ছে করলে সেই ইচ্ছেকে চেপে দমিয়ে দেওয়ার আঘাত?আর একদম না পারলে চোরের মত এসে লুকিয়ে দেখে যাওয়া?জানিসনা তুই।আমি জানি।তাই আমার আর তার মধ্যে এখন কিছু বা কেউ এলে পাগল হয়ে যাই আমি।সবার কাছে ম্যাচিউর,বুঝদার ছেলেটা একজনের কাছেই এখনো আবদার করে ছেলেমানুষি করে।এখন আর দেখার ইচ্ছে দমন করতে হয়না তাকে।তাহলে সে কেন একজন বাইরের লোককে অযথা গুরুত্ব দেবে?যা করেছি বেশ করেছি।আমার আর আমার রাইয়ের দেখা করার মাঝে যে কেউ এলে আমি এটাই করবো।”
“রণদা লাগছে”,শান্ত ভাবে বলা রাইয়ের কথাগুলো রণর মাথায় প্রথমে ঠিক ঢোকেন।ও যে তখন রাইতে হারিয়ে গেছে তা বুঝতে রাইয়ের অসুবিধা হয়না।ঠিক সেই মুহূর্তে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে আকাশ কাঁপিয়ে বাজ পরে কাছে পিঠে কোথাও।রাই সেই ছোটবেলার মত কেঁপে উঠে রণকে দুহাতের মধ্যে ভালো করে আঁকড়ে ধরে।

রণ দুস্টু হাসি হেসে রাইয়ের পিঠ দিয়ে বের দিয়ে নেয় নিজের দুটো হাত।সেই প্রথমবার রাইকে অস্বস্তিতে ফেলে মজা দেখার লোভ সামলাতে পারেনা ও।মুখটা গুঁজে দেয় রাইয়ের গলার বুকের মাঝখানটায়।তারপর হয়তো রাইয়ের মুখ দেখার অবস্থায় ও নিজেই ছিলোনা।
হেসে ফেলে রণ নিজের মনে।আরো অনেক এরকম দুস্টু মিষ্টি সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হতে চায় ও।রাইকে রাগিয়ে ওর লাল হয়ে যাওয়া নাকে নাক ঘষতে চায়।ওর গোলাপি গালে নিজের দাড়ি ভর্তি গাল ঘষে লাল করে দিতে চায় গালদুটো।ওর গোলাপি ঠোঁটে কামড়ে রক্ত বের করতে না পারলেও নীল করে দিয়ে দেখতে চায় কতটা লজ্জা পায় ও।
আর এসব কিছুর জন্য রাইয়ের সম্পূর্ণ নারী শরীরের দরকার নেই,দরকার শুধু ওর সুন্দর সতেজ মনটার।যেটা বারবার ভিজবে,উত্তেজিত হবে রণর আহ্বানে।
ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে জয়ন্তর ঘরে নিজের ফোন,আর বাকি সব কিছু রেখে রণ রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।

“আঙ্কেল রাইয়ের খাবারটা দেবে প্লিজ,আমি খাইয়ে আসবো?” রণর গলার উত্তেজনা জয়ন্তর কান এড়ায়না।ভেবেছিল ডাইনিং টেবিলে খেতে দেবে মেয়েকে,কিন্তু ছেলেটা একা মেয়ের কাছে যেতে চায় বুঝে রাইয়ের জন্যে প্লেট রেডি করে তুলে দেয় রণর হাতে।
মৃদু হেসে রণ প্লেটটা নিয়ে রাইয়ের রুমের দরজা ঠেলে ঢোকে।

নিজের মাথায় পরিচিত হাতের স্পর্শে চোখ মেলে রণকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসতে যায় রাই।
“রণদা তুমি?তুমি সব ছেড়ে চলে এলে?” রাইয়ের চোখে হেরে যাওয়ার যন্ত্রনা আরো বেশি অস্থির করে রণকে।
“নারে বোকা মেয়ে।দুদিন স্পেশাল ছুটি নিয়ে এসেছি আমার হার্টবিট কে দেখতে”,রাইকে ভালোবেসে হার্টবিট রণ প্রায়ই বলে।
রাইয়ের পিঠে বালিশ দিয়ে ভালো করে বসায় ও।তারপর ভাতের প্লেটটা হাতে নিয়ে রাইয়ের মুখোমুখি চেয়ার নিয়ে বসে।
ভাত মেখে যেই রাইয়ের মুখে তুলে দিতে যাবে,রণর হাতটা ধরে কেঁদে ফেলে রাই,”আবার বোকার মত কাঁদছিস।আগে খা,তারপর অনেক কথা আছে তোর সাথে।” নিজেকে সামলানো যে এত কঠিন রণ আগে হয়তো কখনো বোঝেনি।
কথা বলেনা রাই,রণর হাতটা ঠেলে আগে ওর মুখেই ফিরিয়ে দেয়।ওর কষ্টে ছেলেটা যে আগের রাতেও খায়নি রণর শুকনো মুখটা দেখে ওর বুঝতে অসুবিধা হয়না।
“নিজেকে এতোটাও দুর্বল করবি না রাই।আমার হাতে এক বছর এক্সট্রা সময় একদমই নেই তাই সব ছেড়ে আগেরবারের মত তোকে শুধু সামলানোর জন্যে থাকতে পারবো না।তোকে নিজেকে নিজে সামলে রাখতে হবে আমার জন্যে।বুঝলি?” রণর কথা বুঝে ঘাড় নাড়ে রাই।

একই থালা থেকে দুজনে খাবার ভাগ করে খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে,রাইকেও মুখ পরিষ্কার করে দিয়ে ওর পাশে এসে বসে রণ।এবার সেই কঠিন কাজটা ওকে করতে হবে যেকারণে এইভাবে ছুটে এসেছে ও,কারণ ও জানে এই কথাটা অন্যের কাছ থেকে শুনলে কিছুতেই মানবে না রাই।তাই রাইকে নিজের করে পেতে রণ সব ছেড়ে ছুটে এসেছে এত তাড়াতাড়ি।
রাইয়ের পাশে বসে ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নেয় রণ।তারপর রাইয়ের চোখে চোখ রাখে।
“রাই তোকে কিছু কথা বলবো।মন দিয়ে শুনবি আগে সবটা।তার আগে আমায় কতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিবি প্লিজ”,রণ নিজেকে বারবার তৈরি করেছে মনে মনে।

“বলো।আমি আজ তোমার সব কথা শুনবো।তারপর নিজের কথা বলবো।কিন্তু প্রমিস করো তোমাকেও শুনতে হবে আর মেনে নিতে হবে কিন্তু”।রাইয়ের গলার দৃঢ়তা অবাক করে রণকে।

চুপ করে থাকে রণ রাইয়ের কথার সামনে।কি বলবে,কিকরে বলবে নিজের কথাগুলো গুছিয়ে উঠতে পারেনা কিছুতেই।
“রাই তুই আমার আগে বল তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস এই পৃথিবীতে?নিজেকে বেশি না আমাকে?” অনেক ভেবে অদ্ভুত এক প্রশ্ন দিয়ে শুরু করে রণ নিজের কথা।

“জানিনা রণদা।শুধু জানি আমার খুশিতে তোমার আনন্দ।আর আমার খুশি তোমার ভালো থাকায়।” রাই আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে নেটে পড়ার চেষ্টা করেছে নিজের রোগ নিয়ে।আর তাতেই ওর মনের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে শুধু রণর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গেছে।
“আর আমার ভালো থাকা তোর সুস্থ ভাবে আমার সাথে আজীবন বেঁচে থাকায়।শুধু তোর ওই মিষ্টি মুখটা হাতে নিয়ে,ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে বাকি জীবন কাটাতে চাওয়ার মধ্যে আমার ভালো থাকা।আমার ফাঁকা বিছানায়,তোর জায়গাটায় তুই শুয়ে থাকবি আর আমি তোর হাত হাতে নিয়ে সারারাত ঘুমোব,মাঝে মাঝে আমার বুকে তোকে টেনে নেব,আমার হাতে শুয়ে তুই ঘুমোবি এতেই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো থাকা।তুই শুধু আমার সাথে সারাজীবন থাকলেই আমি ভালো থাকবো।শুধু তোকে সারাজীবন জড়িয়ে ধরতে পারলে,তোর কাঁধে মুখ গুঁজে দিতে পারলেই আমি ভালো থাকবো এটা মনেহয় আমার থেকে তুই বেটার জানিস রাই।…”,স্বপ্নগুলো ভাষায় প্রকাশ করতে পেরে গলা বুজে আসে রণর।কিন্তু পরমুহূর্তে রাইয়ের একটা কথায় ছিটকে ওঠে ও।

“কিন্তু আমার শরীরের যে অংশে তুমি পুরোপুরি আমায় পেতে সেই অংশে কাঁটাছেঁড়ার পর মুখ গুঁজে সেই শান্তি পাবে তো রণদা?মনে হবে না তো কোথায় যেন আগের রাইকে পুরোটা পাচ্ছো না?” রাই মুখ নিচু করে আন্দাজে কিছুটা বলে রণ কে।কিন্তু ভয়ঙ্কর বাস্তব না জেনেই ঠিক জায়গায় আঘাত করে ও।

কোনো কথা না বলে বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকা রাইয়ের কামিজটা তুলে ওর নরম পেটে নিজের ঠোঁটটা চেপে ধরে রণ হঠাৎ করেই।শিউরে ওঠে রাই আবেশে।মুহূর্তে মুখ সরিয়ে উঠে বসে রণ।
“আমি মানি রাই কখনো কখনো দুটো শরীরের সম্পর্ক দরকার মনের সম্পর্ক ফ্রেশ করতে।যারা শরীর বাদ দিয়ে ভালোবাসার কথা বলে তারা বোকা।আমি যেদিন থেকে তোকে ভালোবেসেছি শারীরিক ভাবে তোকে চাইনি,কিন্তু যেদিন তুইও স্বীকার করেছিস আমার জন্যে তোর ভালোবাসা আমার শরীর চেয়েছে তোর শরীরে আশ্রয় পেতে।এতে কোনো দোষ আছে বলে আমি মনে করিনা।কিন্তু শরীরের সম্পর্ক মানেই কিন্তু কিছু অঙ্গ ছুঁয়ে উত্তেজনা না আমার কাছে।শরীরের সম্পর্ক মানে আমার কাছে একে অপরকে আরো ভালোভাবে জানা,সমস্ত দ্বিধা ভেঙে যাওয়া একে অপরের কাছে।সবচেয়ে কাছের জন হয়ে ওঠা একে অপরের জন্যে।দুটো মনের মত দুটো শরীর মিলে যাওয়া।তার জন্যে ব্রেস্টের কোনো বিশেষ দরকার আছে বলে আমি মনে করিনা।সেটা শরীর থেকে ভালো থাকার দরকারে বাদ দিলে শান্ত মনে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকলে তবে না কেউ নিজের ভবিষ্যৎ সংসার সাজাতে পারবে নিজের স্বামী আর ‘সন্তান’কে নিয়ে “,দাঁতে দাঁত চিপে বলেই দেয় রণ কথাটা।

বিস্ফারিত চোখে অনেক কিছু না বুঝে রাই তাকায় রণর দিকে।যে অঙ্গের কাঁটাছেঁড়া ওদের সম্পর্কে প্রভাব কতটা ফেলবে ভেবে সারা হচ্ছিল ও,সেই অঙ্গ,মেয়েদের অহংকার,আত্মমর্যাদা,আত্মবিশ্বাস যার ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করে সেটা বাদ দেওয়ার কথা কি বলছে রণদা?
“রাই তোর জন্যে যেটা বেস্ট হবে আমি সেটা করাবো।এক্ষেত্রে আমার কথাই শেষ কথা।আমার রাইয়ের জীবন নিয়ে কোনো রিস্ক আমি নেব না।এন্ড দ্যাটস ফাইনাল।” রণ ঘুরিয়ে রাইকে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে একটুও অস্বস্তি বা দ্বিধা বোধ করেনা।
রাইয়ের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিপে রণ শুধু বলে,”এই মুহূর্তে না হলেও ভবিষ্যতে দরকারে ওভারি দুটোও আমি নিজের হাতে বাদ দিতে দুবার ভাববো না।আমার পক্ষে রাইকে ছাড়া একটা দিন নিঃশ্বাস নেওয়াও সম্ভব না।আর আশা করি সে সেটা জানে। ” রাইয়ের হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে অজানা ভয়ে আঁকড়ে ধরে থাকে রণ।
“তুমি সিওর এভাবে তুমি আমায় ধরে রাখতে পারবে?প্রথম দেখে যে মেয়েটা কে ভালোবেসেছিলে কয়েকমাস পর তাকে তো কোথাও খুঁজে পাবে না।কেমো নিলে চুল উঠে যাবে,রে জ্বালিয়ে দেবে আমার স্কীনটা।তারপরও তুমি আমায় ভালোবাসতে পারবে রণদা?আমার মধ্যে কোথাও তো পুরোনো রাইকে খুঁজে পাবেনা।তারওপর তুমি যা বলছো তাতে বেঁচে থাকা আর মৃত্যু যে দুটোই সমান হয়ে যাবে আমার কাছে।কি লাভ হবে ওভাবে বেঁচে?…”,রাইয়ের কথা পুরোপুরি বাতাসে মেশার আগে হিংস্র ভঙ্গিতে রণ রাইয়ের মুখ চেপে ধরে।

“অনেক স্বার্থপরতা করেছিস রাই,আর না।আর তোকে নিজের স্বার্থ দেখতে দেবনা আমি।আমায় না জানিয়ে স্ক্রিনিং বন্ধ করেছিলি কিছু বলিনি,লাম্পস বুঝতে পেরেও আমায় লুকিয়ে রেখে দিল্লিতে পাঠিয়াছিস কিছু বলিনি,রোগ ডিটেক্ট হওয়ার পর পাঁচদিন আমায় লুকিয়ে রেখেছিলি তাও মেনে নিয়েছি।আর না।এবার আমার সিদ্ধান্ত।আর কোনো রিস্ক আমি তোকে নিতে দেব না।তুই জেদ করলে আমি কি করবো সেটা আমিই জানি।তুই নিজেকে তিলে তিলে শেষ করার আগে আমি নিজেকে শেষ করে দেব খুব সহজে,হ্যাঁ আমি এটুকু স্বার্থপরতা অনায়াসে করতে পারবো।একটা ডাক্তারের প্রানের দাম কতটা তুই বেটার জানিস।আর ডাক্তারের থেকেও বড় রাইয়ের কাছে রণর দাম কতটা সেটা আমিও জানি।এবার তোর চয়েস।আমি পারবোনা তোকে ছাড়া বাঁচতে,ব্যাস এটাই আমার শেষ কথা।”
রাইয়ের দুর্বল শরীর আর উত্তেজনা নিতে পারেনা।বালিশে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে।
ঘরের মধ্যে কথাকাটাকাটি বাইরে জয়ন্ত কেও আর চুপ বসতে দেয়না।রণর কথাগুলো ওর মাথায় কিছু ঢোকেনা।ঋষি তো বলেছিল লাম্পেক্টোমি করলেই হবে,কিন্তু রণ তো অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে।ও কি রেশমার স্মৃতির ভয় থেকে একথা বলছে নাকি সত্যি উদ্বেগের কোনো কারণ আছে!
রাইয়ের ঘরের দরজায় নক করে জয়।
রণ ভেবেছিল ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করবে পুরো ব্যাপারটা।কিন্তু রাইয়ের শেষ কথাগুলো ওর মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়।দরজায় নক শুনে ও চেঁচিয়ে বলে,”আঙ্কেল দশমিনিট”।

তারপর আবার ঘোরে রাইয়ের দিকে।ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আলতো করে,চোখ মেলে রাই।রণর চোখে চোখ রেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায় ও।রণর চোখের আগুন জল হয়ে গেছে।কাঁদছে রণ নিঃশব্দে।
রণর গলাটা নিজের দুর্বল দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ওকে নিজের আরো কাছে টেনে আনে রাই।সেই প্রথম স্বীকারোক্তি দিনের মত খুব কাছাকাছি দুটো মুখ এসে স্থির হয়।অনুভব করে রাই রণর কথাগুলো।সম্পর্কের সমীকরণ সত্যি অদ্ভুত হয়,যতদিন যায় তত কত কিছু স্বাভাবিক হতে থাকে সম্পর্কে।প্রথমদিনের মত চোখ বুজে ফেলে না রাই,উল্টে নিজের ঠোঁট জোড়া এগিয়ে দেয় রণর ঠোঁটের দিকে।নিজের চঞ্চল ভীত মনটা আশ্রয় পেতে চায় রণর কাছে,আর রণকে অনুভব করাতে চায় নিজের অস্তিত্ব।দুটো ঠোঁট একে অপরের সাথে মিশতে থাকে আর মনের আবেগ,অবচেতনে লুকিয়ে রাখা ভয় বেরিয়ে আসতে থাকে চোখের জল হয়ে।রাই শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রণকে।কতটা ভরসা,কতটা বিশ্বাস,কতটা ভালোবাসা রাইয়ের মনে আছে রণর জন্যে শুধু ওই জানে।বড্ড লোভ হয় এই ছেলেটার সাথে দীর্ঘ জীবন কাটাতে।তাই সব হারিয়ে,রণর কথা মেনে বাঁচার কারণটা অবধি ও জিজ্ঞেস করেনা রণকে।ও জানে ওর জন্যে বেস্ট ভাববে এই ছেলেটা,আর সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো হতাশাও দেখতে পাবে না ও ছেলেটার মধ্যে।নিজের ভেতরটা ভেঙে যেতে থাকলেও,প্রশ্নের আঘাতে মন ক্ষতবিক্ষত হলেও রাই চুপ করে থাকে,রণর আর ওর ভবিষ্যৎ পুরোটা ছেড়ে দেয় ওর ওপর।

রাই রণর কোলের কাছে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর রণ আস্তে আস্তে উঠে আসে বাইরে।ও এটাই আশা করেছিল,বাইরের ঘরে বসে আছে জয়ন্তর সাথে ঋষি আর জয়ি।জয়ন্ত কে নতুন করে কিছু বলার দরকার পড়েনা রণর,ঋষিদের কাছে ও এতক্ষনে জানতে পেরে গেছে রণর কথাগুলোর অর্থ।ওর চোখ,মুখ সেই কথা বুঝিয়ে দেয় রণকে।
“সবাই বসো,আমি একটু চা করে আনি”,জয়ি উঠতে যায় নিজের জায়গা ছেড়ে।
“আঙ্কেল মনেহয় ভাত খায়নি”,রণর কথায় থমকে দাঁড়ায় ওর মা।
“তুইও তো খাসনি কিছু।চ দুজনে অল্প খেয়ে নি কিছু”,ভাঙা গলায় বলে জয়ন্ত।
“না আঙ্কেল,তোমার মেয়ে বুঝতে পেরেছিল আমি খায়নি।তাই কিছুতেই একা খায়নি,আমার মুখে জোর করে…”,রণর কথা বাধা পায়।
“তাহলে বাদ দে।জয়ি,তুই একটু চা ই কর।এই অবেলায় ভাত খেতে ইচ্ছাও করছে না”,জয়ন্ত জানে কিভাবে কদিন ভাত গুলো গলা দিয়ে নামাচ্ছে ও।আজ আর এত বড় খবরের পর গলা দিয়ে খাবার নামবে বলে মনে হয়না।জয়ি উঠে যায় রান্নাঘরের দিকে।

“রণ তুই এরকম হঠাৎ করে চলে আসবি,আমরা ভাবতেও পারিনি।জয়ের ফোনে রীতিমত চমকে গেছিলাম আমরা”,ঋষি রণর বছর নষ্ট করার উদ্বেগ থেকে বলে।রাই সবচেয়ে কষ্ট পাবে রণর এই সিদ্ধান্তে সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
“বাবা কবে থেকে শুরু হবে রাইয়ের ট্রিটমেন্ট?আমি দুদিন স্পেশাল ছুটি পেয়েছি আমার ফিয়ান্সে অসুস্থ জানিয়ে”,শরীরের মনের ক্লান্তি চোখ মুখ ছাড়িয়ে গলার স্বরে ফুটে ওঠে রণর।
“কাল রাই কে এডমিশন করানো হবে তোর বাবার হসপিটালে”,চায়ের জল চাপিয়ে ফিরে এসেছিল জয়ি,এতক্ষন পর ও কথা বলে রণর সাথে।জয়ের কাছে খবর পেয়ে বারবার চেষ্টাতেও যখন রণ ফোন ধরেনা,ঋষিকে ফোন করে দুজনে ছুটে এসেছে এই ফ্ল্যাটে।

“আমি দুদিন ওর কাছে থাকতে চাই।আমি নিজের স্টাইপেন্ডের টাকা এই কমাস রেগুলার যাতায়াতে খরচ করেও ওখানে একটা সেট আপ বানাবো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।দরকারে রাইকে অন্য স্টেটে বা অন্য দেশেও নিয়ে যেতে পারি আমি,তখন বাবা তোমার ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট লাগবে।আর রাই এর ট্রিটমেন্ট শেষ হলে দরকারে কোর্ট ম্যারেজ করেও আমি ওকে নিজের কাছে নিয়ে যাবো।আঙ্কেল চাইলে তুমিও যেতে পারো সাথে।আর রাই সব রকম ভাবে ট্রিটমেন্টে কোঅপারেট করবে,আমি কথা বলেছি ওর সাথে।তুমি সার্জারি কবে করবে বলে ভেবেছো?” রণ যেন বড্ড তাড়ায় আছে মনে হয় জয়ের।

ঋষি চুপ করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে,”রাইকে তুই খুলে সবটা বলেছিস?আমিও চাই তোদের বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।তুই যদি চাস,মানে জয়ন্তকেও বলছি,আমি এখন শুধু টিউমারটা অপারেট করে পার্সিয়াল ম্যাসটেক্টমি করে…”,জয়ন্ত মুখ খোলার আগেই রণ চাপা গলায় প্রায় চিৎকার করে বলে,”কেন?”

হতচকিত ঋষি কি বলবে বুঝতে না পেরে বলে,”রাইয়ের রিস্ক ফ্যাক্টর হাই,কিন্তু ম্যালিগনেন্সি তো ছড়ায়নি এখনো।তাই আমরা এই মুহূর্তে ডবল ম্যাসটেক্টমি না করে তোদের বেবি নেওয়া অবধি অপেক্ষা করতেই পারি।ভবিষ্যতে বাচ্ছা বড়…”,জয়ন্তর চোখে একটা ভয় দেখে ঋষি কথা মাঝপথে বন্ধ করলেও উত্তর আসে রণর দিক থেকে।
“তোমায় কে বললো বাবা আমি সেই কারণে বিয়ে করতে চাইছি?তুমি কি তাই করতে আমার জায়গায় থাকলে?আর হ্যাঁ আমি বায়োলজিক্যাল বেবি নেব না এডপ্ট করবো না দুজনেই জীবনটা আনন্দে কাটাবো সে সব ভাবার অবস্থায় নেই।আমি সবার আগে রাইকে রিস্ক ফ্রি করতে চাই,তার জন্যে দরকার হলে…”,রণ রাইকে যা বলেছে কিছুক্ষন আগে নিজের মা বাবার সামনে বলতে একটু থমকায়।তারপর মনে জোর এনে ধরা গলায় বলে,”…দরকার হলে ওর অন্য কোনো অর্গান বাদ দিতেও আমি দুবার ভাববো না।আমার হাতে সময় কম,তাই বছর নষ্ট করা সম্ভব না।আর ওকে ছেড়ে এভাবে আমি শান্তিতে পড়া কমপ্লিট করতে পারবো না বলেই বিয়ের তাড়া এত আমার।আমি,আমি পারছিনা বাবা…প্রতি মুহূর্তে রাইয়ের জন্যে উদ্বেগ…আমার দিকটা একটু…”,নিজের ছেলেকে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে কোনোদিন দেখেনি ঋষি।ওর কান্না ঋষিকে আরো ভাঙতে থাকে।
জয়ি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে রণকে।মা কে জড়িয়ে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনা রণ।বাইরের ঘরের কান্নার আওয়াজ যাতে রাইয়ের কানে না পৌঁছতে পারে নিজের মুখটা চেপে ধরে মায়ের পেটে।কান্নার দমক সামলে কাটা কাটা স্বরে শুধু বলে,”তুমি তো জানো মা…রাই আমার কাছে কি?কি ভাবে বাঁচবো আমি ওকে ছাড়া!আমি আর কিছু চাইনা,কাউকে নতুন করেও না।শুধু চাই আমার রাই আমায় ছেড়ে কোথাও না যাক।চব্বিশ ঘন্টা ওকে চোখের মধ্যে দেখতে চাই…ওকে ছেড়ে,ওর থেকে দূরে…আমার বুকের মধ্যেটা…”,চেপে ধরে জয়ি ছেলেকে নিজের বুকে,”চুপ কর রণ,প্লিজ চুপ কর।কিছু হবেনা আমাদের রাইয়ের…তোর ভালোবাসা,আমাদের ভালোবাসা বিফলে যেতে পারেনা।তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি রাইকে বুঝিয়ে আমাদের কোনো কিছু বলার থাকবে না তাতে।শুধু রাইকে সামলিয়ে সবটা করতে হবে।যেন কোনো আঘাত আর না লাগে ওর মনে।তোর ওপর পুরো ভরসা আছে আমার।তুই পারবি ওকে ঠিক সামলাতে।তোর এই ভালোবাসা উপেক্ষা করার ক্ষমতা ওর কখনো হবেনা রণ।শুধু তুই শক্ত থাক।…”

ঘরের বাইরে ছেলেটার কান্নার আওয়াজ হয়তো ঘরের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটার কানে পৌঁছয়না।কিন্তু ঘুমের মধ্যেও রণর ভালোবাসা ছুঁয়ে থাকে রাইকে।প্রচন্ড নির্ভরতায় আর শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকে রাই রণর কোলের মধ্যে ঢুকে ঘুমিয়ে থাকার আবেশে।শুরু হয় এক লড়াই,জেতা হারার লড়াই।নিজের জীবনের ধ্রুবতারা রাইকে বাঁচিয়ে রাখতে মনে মনে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে রণ।জয়ন্তর চোখটা চিকচিক করতে থাকে।না মেয়ের কষ্টে না,তার ভাগ্যে।রণর মত জীবনসঙ্গী যদি সবাই পেত,যদি রণর এই বিশ্বাস যা রাইকে পরিপূর্ণ রাখছে জয়ন্তও রেশমার মনে ছুঁয়ে রাখতে পারতো,হয়তো এত তাড়াতাড়ি মাতৃহারা হতনা মেয়েটা।
নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে যায় জয়,গিয়ে দাঁড়ায় রণর পাশে।একটা হাত রাখে ওর মাথায় নিজের সবটুকু আশীর্বাদ নিয়ে।মনে মনে ভাবে যুদ্ধ তো একা রাইয়ের না,এ যুদ্ধে আসল সৈনিক তো এই ছেলেটা।তাই রণর যুদ্ধ জেতাটা বেশি দরকার যে,তাহলেই ওর রাইও জিতে যাবে নিজের যুদ্ধ।এত ভালোবাসা,নির্ভরতা ব্যর্থ হতে পারেনা।রণ নিজেও বুঝতে পারে যেন জয়ন্তর মনের কথা, চোখ বুজে গ্রহন করে জয় আঙ্কেলের আশীর্বাদটা ওদের দুজনের জন্যে।

ক্রমশ…