মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-৩০

0
365

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#ত্রিশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“হ্যালো।ডক্টর রণজয় মুখার্জী বলছি”,অচেনা নম্বরে মানেই কোনো রোগী,তাই ফোন ধরে এটাই প্রথমে বললো রণ।
“কেমন আছিস রণ?” মেয়েলি গলায় প্রত্যুত্তর আসে।
“শীর্ষা!!”,গলা চিনতে এক মুহূর্ত সময় লাগেনা রণর।
“ওয়াও! ভাবিনি এত বছর পর এত সহজে চিনে যাবি গলা”,শীর্ষার স্বরে খুশি ঝিলিক দেয়।”শুনলাম বিয়ে করেছিস? রাই কেমন আছে?” শেষের বাক্য দুটোতে শীর্ষার গলায় উচ্ছ্বাসের অভাব বড়ই স্পষ্ট বুঝতে পারে রণ,অস্বস্তি ছুঁয়ে যায় মনে।
“ওই আছে একরকম।তোর খবর বল”,কথা ঘোরাতে চায় ও।সেই পুরোনো ভয়,কেন ও নিজেও জানেনা ।ওর কুসংস্কার মুক্ত মন এই একটা বিষয় বড্ড খুঁতখুঁত করে আজও।

“আমারও তাই দিন কেটে যাচ্ছে।কলকাতা ফিরেছি লাস্ট উইকে।আজ তোর পুরোনো নম্বরটা ট্রাই করলাম,আর তোকে পেয়েও গেলাম।সারপ্রাইসিংলি তুই এখনো সেম নম্বর ইউজ করছিস তো,দারুন।তারপর বল বাকি খবর কি?কোন হসপিটালে আছিস?” শীর্ষা কলকাতায় শুনে রণর মনটা ভালোই হয়ে যায়।যতই হোক শীর্ষার মত ভালো বন্ধু ওর জীবনে কমই এসেছে।

রণ নিজের হসপিটালের নাম বলে বললো,”তারপর তুই কবে বিয়ে থা করছিস?শিবরাজের খবর কি? তুই কি সোজা স্টেটস থেকে কলকাতা ফিরলি না দিল্লি হয়ে এলি?”

প্রথমে উত্তর দেয়না শীর্ষা।চুপ করে থেকে ভাবে কথা ঘুরিয়ে দেবে।তারপর কি চিন্তা করে বলে,”রণ একবার মিট করতে পারবি আজ।তোকে অনেক কথা বলার আছে”,শীর্ষার স্বরের যন্ত্রনা রণ উপলব্ধি করে খুব ভালো করে।
আজ রাই ওবাড়ি গেছে,ওখানেই থাকবে কদিন।রণ যাতে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে পারে তাই ওর এই মহানুভবতা।
মনে মনে খুব রাগ হলেও মুখে কিছুই বলেনি রণ।বিয়ের একমাসও হয়নি বউ বাপের বাড়ি চলে গেল এক সপ্তাহের জন্য।
“আজ তোর সময় হবে?এখন তো দুটো বাজে।এই ঘন্টা খানেক পর,আমাদের পুরোনো কফি শপে?” রণর আজ ডে অফ।
“শিওর।আমি তো বাড়িতেই আছি।তাহলে তিনটে মিট করছি।তোর আজ হসপিটালে যাওয়ার নেই?” হঠাৎ শীর্ষার গলায় উত্তেজনা ফিরে আসে।
“না রে আজ অফ।চল এখন তাহলে ফোন রাখছি।সিয়া”,রণ স্টাডি টেবিল ছেড়ে উঠে পরে রেডি হওয়ার জন্য।
এই একমাস এই ঘরটাও রাইতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।বিয়ের পর যেন আরো অনেক স্বতঃস্ফূর্ত হয়েছে রাই।সারাক্ষন বকবক ও কোনোদিনই করতো না,কিন্তু আজকাল রণ ফ্রি থাকলেই নিজের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে ও।তাই ছুটির দিনে রাই নেই,এটা ভাবতে সমস্যা হয় রণর।
প্রায়ই নিজের আংটিটা একবার দেখে ও,সত্যি ওর বিয়ে হয়ে গেছে!!!!রাই ওর সাথে ওর ঘরে একমাসের ওপর আছে,মাঝে মাঝে স্বপ্ন মনে হয়।কিন্তু এখন ওকে ছাড়া ও এই ঘরে একমুহূর্ত থাকতে পারেনা,হাঁফিয়ে ওঠে সহজেই।কান ওই বিশেষ গলাটা শুনতে চায়,সেটা শুনতে না পেলে পড়া কেন কোনো কিছুতেই মন বসেনা ওর।
না,রেডি হয়ে নেয় ও।তারপর গাড়ির চাবিটা স্টাডি টেবল থেকে তুলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

“বল শীর্ষা কি খাবি?তোকে দেখে বুঝতেই পারছি খাওয়াদাওয়া কন্ট্রোল করিস।তো বল এখন কি অর্ডার করবো?” রণ পৌঁছনোর আগেই শীর্ষা পৌঁছে টেবিল বুক করে বসেছিল।রণর বুঝতে অসুবিধা হয়নি ও খুব উৎকণ্ঠায় আছে কিছু নিয়ে।

“কর না তোর পছন্দ মত।আমি সব কিছু খাই”,শীর্ষা দায়সারা উত্তর দিয়ে রণর ওপর সবটা ছেড়ে দেয়।ওর মুখ,ওর ব্যবহার রণর কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়।যে শীর্ষা সবসময় মেনু কার্ড দেখে নিজের পছন্দে সমস্তটা অর্ডার করতে চাইতো,আজ তার এসব তুচ্ছ ব্যাপারে কোনো মন আছে বলে রণর মনে হয় না।
নিজের পছন্দ মত অর্ডার করে রণ শীর্ষার মুখোমুখি হয় অবশেষে।

“বল কেমন আছিস?কিসের এত জরুরি ডাক এবার বল।তোকে কখনো এত আপসেট,এত অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড দেখিনি।” রণ সরাসরি প্রসঙ্গে ঢুকে যায়।
কিন্তু শীর্ষার জবাব সঙ্গে সঙ্গে আসেনা।ওর মুখ দেখে মনেহয় যেন ও মনে মনে কথা গুছচ্ছে।রণ আবার কিছু বলতে যাবে তার আগে ও বলে,”আমি ভালো নেই রে রণ।একদম ভালো নেই।আমি মাস ছয়েক আগে দেশে ফিরেছি,কিন্তু কলকাতায় না দিল্লি তে।ওখানে বিখ্যাত প্রাইভেট হসপিটালে জব নিয়েছিলাম।…আসলে শিবরাজ অনুরোধ করেছিল…জোর করেনি কিন্তু।…”,কাউন্টার থেকে আওয়াজ আসায় রণ “এক সেকেন্ড”বলে উঠে যাওয়ায় শীর্ষার কথা থামাতে হয়।
রণ ট্রেই নিয়ে ফিরে টেবিলে বসে নিজে এক্সপ্রেসো নিয়ে শীর্ষার দিকে কোল্ড কফিটা এগিয়ে দেয়।নিজের কোল্ড কফিতে এক সিপ দিয়ে শীর্ষা আবার শুরু করে,”হ্যাঁ যা বলছিলাম,প্রবলেম শুরু তারপর থেকেই।শিবরাজ লিভিং শুরু করে আমার সাথে,দুজনের ইচ্ছাতেই,আগেও স্টেটস এ গিয়ে ও আমার রুমেই থেকে এসেছে।কিন্তু ওর বাড়িতে না জানিয়ে।ওর বাড়ি প্রচন্ড অর্থোডক্স।কিন্তু হার্ডলাক, এনিহাউ ওর বাবা ব্যাপারটা জেনে যা, রাজ ওর ফ্যামিলি তে আমায় অফিসিয়াল ইন্ট্রো করানোর আগেই।জানিস রণ জীবন যে কতটা কমপ্লিকেটেড তার পর বুঝেছি আমি।কি না করেছে ওর বাবা,বাড়ির লোক আমার সাথে!ফোন করে অপমানজনক কথাও বলেছে,লোক লাগিয়ে ভয় দেখিয়েছে।শুধু শিবরাজের মুখ চেয়ে সব শুনেছি,সব টলারেট করেছি।কিন্তু…”,হঠাৎ থেমে যায় শীর্ষা।
“কিন্তু কি শীর্ষা?” রণ ভাবেনি এরকম একটা গল্প ও শুনবে শীর্ষার কাছে।
একটা মলিন হাসি ফোটে শীর্ষার ঠোঁটে,”কিন্তু লাস্ট উইক শিবরাজ যখন ব্রেক আপ করতে চাইলো,মুক্তি চাইলো রিলেশনটা থেকে আমি আর নিতে পারিনি।যে ছেলে স্টেটস এ নিয়মিত গেছে,নাইট স্টেই করেছে,দিল্লিতে লিভিং করে করেছে টানা তিনমাস সে বাবার ভয়ে অস্বীকার করতে চাইছে সবটা।বাড়ির পছন্দে বিয়ে করে সংসার করতে চাইছে”,বরাবর বাস্তববাদী,কঠিন মনের মেয়েটার গলার স্বর স্বাভাবিক অবস্থায় চোখ উপচে দু ফোঁটা চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।রণ বুঝতে পারে বরাবরের কঠিন মেয়েটা ভেতর থেকে ভেঙে গেছে,প্রচন্ড রাগ হতে থাকে ওর শিবরাজের ওপর।কিন্তু ও কি বা করবে বুঝতে পারেনা।হটাৎ একটা কথা মনে আসে ওর,”আচ্ছা শীর্ষা তোর কি মনেহয় শিবরাজ তোকে এখনো ভালোবাসে,মানে ওর ভালোবাসা টা কি সত্যি ছিল?”
চোখের কোলে রুমাল বোলাচ্ছিলো শীর্ষা,রণর কথায় অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়,সেই দৃষ্টিতে অবাক হওয়ার সাথে ছিল প্রশ্নও।
“দেখ শিবরাজের তোর প্রতি ভালোবাসাটা কি পিওর ছিল?সেটা তো তুই বলতে পারবি?” রাজ রিপিট করে।
কিছু যেন চিন্তা করে শীর্ষা,তারপর রণর চোখে চোখ রেখে বলে,”ও খুব ওপেন মাইন্ডেড ছিল।কোনোদিনও আমার ব্যাপারে কোনো ইন্টারফেয়ার করতো না। মাঝে মাঝে আমার অবাক লাগতো,ওর সামনে বসে আমি অন্য কারোর সাথে কথা বললেও ও ফিরে দেখতো না।তবে কখনো কখনো আমায় উল্টে জিজ্ঞেস করতো আমি ওকে ছেড়ে চলে যাবো না তো! আমার মনেহতো ও ইনসিকিওর ছিল।একবার বলেছিল ওর জীবনে একমাত্র প্রাপ্তি বলতে আমার ভালোবাসা। আসলে কি বলতো রণ আমি কখনো ওর বাড়ি নিয়ে যেচে কিছু জানতে চাইতাম না।কিন্তু ও ফ্যামিলির জন্যে,ফ্যামিলি বিজনেসের জন্যে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করেছে আমি জানতাম।বিশেষ করে ও আরো পড়তে চেয়েছিল।জানিস রণ ওর হিন্দিতে নভেল লেখে,বইও আছে,কিন্তু সিউদোনেম ইউজ করে।”

“তুই আমার প্রশ্নের উত্তর টা কিন্তু দিলিনা।তোকে কেউ জিজ্ঞেস করে যদি রণ রাইকে সত্যি ভালোবাসে কিনা,সেটা তুই বলতে পারবি, অথচ শিবরাজ তোকে ভালোবাসে কিনা বলতে ভাবছিস?” রণ যেন সেই কলেজ জীবনে ফিরে যায় নিজের কথাবার্তায়।

“ভালোবাসতো।কিন্তু এখন সেই ভালবাসা হয়তো নেই।যে রাজ ইন্টিমেট মুহূর্তে বলেছিল বাঁচবে না আমায় ছাড়া,আমার জন্যে সব করতে পারবে,সে হয়তো আলাদা কেউ।কিন্তু আমি যে লাইফে সেকেন্ড টাইম আবার ভালোবাসার সাহস দেখিয়েছিলাম রণ,আর হয়তো কোনোদিনও সেটা পারবো না।ও তো নিজের জীবন নতুন করে শুরু করবে,কিন্তু আমি?…”,শূন্য দৃষ্টিতে শীর্ষা তাকিয়ে থাকে রণর দিকে।কিন্তু ওর কথাগুলো রণকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।শীর্ষার প্রথম ভালোবাসা অসহায় হয়ে যায় এই কথাগুলো শুনে।
“শীর্ষা তোর একবার শিবরাজের সাথে ফেস টু ফেস কথা বলা উচিত।আমার মনে হয় ও নিজেও ভালো নেই।ও ওর ফ্যামিলির চাপে তোর সেফটি চেয়ে ব্রেক আপ করতে চেয়েছে।আচ্ছা শীর্ষা ও তো ওর ফ্যামিলি কে পার্মানেন্ট ছাড়তে পারবে না।কিন্তু যদি বিয়ে হয় তুই কি পারবি ওই ফ্যামিলি তে গিয়ে এডজাস্ট করতে?শিবরাজ যখন জানতো ওর ফ্যামিলি এতটা অর্থোডক্স ওর উচিত ছিল ডিরেক্ট বিয়ের কথা বলা।…”,রণর স্বরে যেন রাইয়ের কথা শোনা গেল।
শীর্ষা মানতে পারলো না রণর কথাটা,”রণ তুই এটা বলছিস?তোর মত হাই এডুকেটেড,মডার্ন ছেলের মুখে এই কথাটা মানায় না।তুই অনেক বদলে গেছিস।”
চুপ করে যায় রণ।রিলেশন মানেই বিয়ে,আর বিয়ের আগে লিভ ইন করা নিয়ে ছুৎমার্গ ওর কোনোদিন ছিলোনা,আর ও যেরকম পরিবেশে মানুষ সেটাই স্বাভাবিক।কিন্তু শীর্ষার সিচুয়েশন অনুযায়ী ও কথাটা বলেছিল।হয়তো রাইয়ের চিন্তা এখন ওকেও প্রভাবিত করে,ওর মত করে অবস্থা অনুযায়ী রণ চিন্তা করে।
“শীর্ষা তুই ভুল বুঝছিস।শিবরাজ তোকে যদি বিয়ে করবে ভেবেই ছিল তাহলে ওর ফ্যামিলির কাছে তোর ইমেজ ক্লিন রাখা উচিত ছিল।তবে আমি এখনো বলবো ওই ফ্যামিলি তে গিয়ে তুই এডজাস্ট করতে পারতিস না।দিল্লিতে তিন বছর থাকার এক্সপেরিয়েন্স থেকে বলছি ওখানে অনেকদিন ধরে থাকা বনেদি ফ্যামিলিগুলো এখনো শাড়ি, মেয়েদের বাইরে গিয়ে জব না করা এগুলো আঁকড়ে বাঁচে।ওখানে তুই এডজাস্ট করেও থাকতে পারতিস বলে আমার মনে হয় না।”রণ একই কথা রিপিট করে শীর্ষা কে বোঝানোর চেষ্টা করে।

চুপ করে থাকে শীর্ষা।বাইরে থাকতে একটা ব্যালান্স লাইফ কাটাতো ও,যেখানে শিবরাজের জন্যে সময় অনেকটাই বরাদ্দ ছিল ওর।কিন্তু দেশে ফিরে দিল্লির ব্যস্ত প্রাইভেট হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর থেকে সারাদিন ছুটতে হত এত বেশি যে ক্লান্ত ও রাজকে বরাদ্দ সময় বেশিরভাগ দিতে পারছিল না।ব্যবসায়ী শিবরাজ নিজের শত ব্যস্ততার মাঝেও ফোন করতে ভুল করতো না,কিন্তু শীর্ষা বেশিরভাগ সময় সেই ফোন রিসিভ করে উঠতে পারতো না।আর রাতে কখনো নাইট শিফট থাকলে রাজের সাথে সারাদিন দেখা তো হতইনা,আর রুমে থাকলেও ক্লান্ত শীর্ষা কোনো কোনোদিন ঘুমিয়ে পড়তো রাজ ফেরার আগেই।তাই ওদের নিজেদের মধ্যেও অভিমান,ভুল বোঝাবুঝি বাড়ছিল।
ঠিক সেই সময় রাজের ফ্যামিলির ইন্টারফেয়ারেন্স ওদের নড়বড়ে সম্পর্কে হাতুড়ির ঘা দিলো।শিবরাজ ও বিশ্বাস করতে শুরু করলো ডাক্টরনি ওকে বা সংসার কে সময় দিতে পারবে না।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো শীর্ষা।আসলে রণর অভাব শুধু রাজ পূরণ করেনি,ওর বন্ধুত্বও শীর্ষা কে অনেক কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল।ওই বন্ধুত্বটা এই কদিন বড্ড মিস করেছে ও।রাজ ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল শেষ তিন বছরে।

“রণ আমার সারাদিনের বিজি শিডিউল দিল্লি তে শিবরাজের অভাব বোধ করতে দেবেনা।কিন্তু ও জীবন থেকে পুরো হারিয়ে গেছে এটাও আমি মানতে পারছিনা।বিশেষ করে কলকাতার অলস সময় বড্ড ওকে মিস করাচ্ছে।ওকে ছাড়া ভাবতে পারছিনা নিজের জীবনটা।তুই শুধু বল ওকে ফোন করাটা কি খুব বড় ভুল হবে?” সেই শীর্ষা যে রণকে ফ্রি করতে দুবার ভাবেনি আজ রাজকে হারিয়ে বড্ড বেশি অস্থির হয়ে পড়েছে যেন।
রণ কি বলবে বুঝতে পারেনা।
চুপচাপ মুখোমুখি বসে থাকে দুই বন্ধু।বাইরের প্রকৃতির অন্ধকার যেন ওদের মনে ছড়িয়ে যায় ধীরে ধীরে।
সেই একই অন্ধকারে নিজের মেয়েবেলার ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রণর নম্বরে কল করে রাইমা,কিন্তু ফোন বেজে যায়।নিজের পকেটে সাইলেন্ট মোডে রাখা ফোনে যে রাইয়ের ডাক আসছে বুঝতেও পারেনা সদাব্যস্ত ডাক্তার রণজয় মুখার্জী,বন্ধুকে কিছুটা একান্ত ব্যক্তিগত সময় দিতে গিয়ে যে ফোনটা নীরব করেছিল কফি শপে ঢোকার আগে।

ঋষি একটু অবাকই হয়,হসপিটাল থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে নিচে এসেও যখন জয়িতা কে দেখতে পায় না।রমা ডাইনিং টেবিলে চা পৌঁছে দিতে এলে ওকেই জিজ্ঞেস করে,”রমা, জয়ি বাড়ি নেই?”
রমার অবাক হয়ে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে ঋষি জয়ি বাড়িতেই আছে।
“বৌদিদি তো ওপরে গেল ঘন্টা খানেক আগে,তারপর তো…”,রমার অবাক হওয়ার কারণ বুঝতে পারলো ঋষি।

“তাহলে অন্য কোনো ঘরে আছে,আমি আমাদের বেডরুমে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম”,ব্যাপারটা ওখানেই ইতি করতে কথাগুলো বলে ঋষি।
কম কথা বলা রমা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের জায়গায় ফিরে যায়।
তাড়াতাড়ি চা শেষ করে আবার ওপরে উঠে যায় ও,ওপরের ঘরগুলোতে উঁকি মেরে কি ভেবে ছাদে উঠে যায়।’ওই তো মহারানী দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে খুব গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছে’।
“কি রে এই ঠান্ডায় ছাদে কি করছিস?” ছাদে পাতা চেয়ারে চুপ করে জয়িতাকে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে ঋষি।
-“কখন এলে তুমি? গাড়ির আওয়াজ পাইনি তো?”
-“আর বলিসনা গাড়িটা হঠাৎ স্টার্ট নিতে প্রবলেম করছে।সকালেই ঝামেলায় পড়েছিলাম।আসার সময় গ্যারেজে দিয়ে ক্যাবে ফিরলাম।কিন্তু তুই এখানে বসে কেন?”
-“নিচের তলাটা বড্ড ফাঁকা লাগছে।হসপিটাল থেকে ফেরার পর মেয়েটা পায়ে পায়ে ঘোরে সন্ধে অবধি।নেই, ভালো লাগছিলো না।কাল জয়ের ওখান থেকে ঘুরে আসবো ভাবছি।”
-“অতই যখন মন খারাপ যেতে দিলি কেন? যার জন্য গেল সে বুঝি খুব মন দিয়ে পড়ছে!বউ না থাকলে কোনো কাজে মন বসে যেন?যত অদ্ভুত ভাবনা।রাইও যেমন,তুইও।কাল গিয়ে নিয়ে চলে আয়”।”
-“তুমি সবাইকে নিজের মত ভাবো।রণ কিছু বলেছে তোমায়?”
-“বলবে কেন আমিও তো ওই বয়স পেরিয়ে এসেছি নাকি?বিয়ের একমাস হয়েছে সবে।”
-“ঋষি তুই এখন শ্বশুর,এবার অন্তত ভেবে কথা বল।হসপিটালে তোকে দেখলে কে বলবে দুটো একই মানুষ।”
চুপচাপ হাসতে থাকে ঋষি।আসলে ওর এই রূপটা বেশি করে জয়ি ই জানে,ঘরোয়া আড্ডায় ও দিলখোলা ঠিকই,কিন্তু এতটা মুখখোলা শুধুমাত্র ও জয়ির কাছেই।ও বুঝতে পারছিল জয়ির মন ভালো নেই,তাই ওর মুড ঠিক করতেই…নিজের মনেই হাসতে থাকে ঋষি।

“দেখো হেসেই যাচ্ছে।আমি বলছি মন ভালো লাগছে না,আর ও হাসছে”, জয়ি ভ্রু কুঁচকে তাকায় ঋষির দিকে।

“দেখ জয়ের ও তো ইচ্ছা করে বল মেয়েটা কে একটু কাছে পেতে।তাই আমি আর কিছু বলিনি।কিন্তু সত্যি বলতে কি রণ রাইকে ছেড়ে পড়াশোনা করবে এতোটাও অনুভূতিহীন কাঠখোট্টা ছেলে না।দেখিস ও নিজেও পালাবে ওখানে।আমার ছেলে কে আমি তো চিনি।ছাড় ওদের কথা,তুই বল এরকম উদাস হয়ে এই ঠান্ডায় ছাদে বসে কার ধ্যান করছিস?আর সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট কথা বল… এবার শীতে কোথায় বেড়াতে যাবি?এবার তো ছেলের বউ এসে গেছে সংসার সামলাতে,এবছর আমি তুই ঘুরতে বেরোবো।দিন দশকের মধ্যে বেরোবো”। ঋষি প্রসঙ্গ পাল্টায়।
“হ্যাঁ সেটাই তো বাকি আছে।ছেলে মেয়ে দুটো বিয়ের পর কোথাও গেলোনা,ওদের রেখে আমরা ঘুরতে যাবো না!!নিজে তো বিয়ের পরই হানিমুনে ছুটেছিলি, আর ওদের বিয়ের একমাসের বেশি হয়ে গেল”,জয়ি অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দেয়।
“আরে আমি হানিমুনের উদ্যোগ নিজে নিয়েছিলাম,আমার বাবা আমায় পাঠায়নি।তোর ছেলে নিজে যদি না ভাবে আমার ভাবতে বয়ে গেছে।তার থেকে বেটার আমি নিজের সেকেন্ড হানিমুনের প্ল্যান করি।ও ওর ভাবুক,আমি আমার”, ঋষি নিজের ফোনে একটা ট্রাভেল এজেন্সির ওয়েবসাইটে চোখ বোলাতে বোলাতে বলে।
জয়ি এবার মুখে কিছু না বলে ঋষির পিঠে একটা কিল মারে।
ঋষি ওর পাকানো চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই।রণর মুখের আদল ওর বাবার মত,ফলে ঋষি রণর মতোই সুপুরুষ।তার ওপর বয়সের কারণে ঋষির মুখের পরিণত ভারিক্কি ভাবের জন্যে আরো যেন আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে ও জয়ির চোখে।
জয়ির মুখের দিকে কিছুক্ষন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর ঋষি চেয়ারটা আরেকটু টেনে জয়ির একদম পাশে গিয়ে বসে নিজের বাঁহাত টা ওর বাঁ কাঁধে রেখে ওকে বুকের কাছে টেনে আনে।ডানহাত দিয়ে ওর এলোমেলো চুল গুলো কপালের ওপর থেকে সরাতে সরাতে বলে,”কি হয়েছে সোনা,আমায় বল প্লিজ।তোর মন খারাপ কিন্তু কারণটা অন্য কিছু ,কি সেটা?তোর চোখ বলছে শুধু রাইকে মিস করে তোর মন এতটা খারাপ না।আরো কিছু কারণও আছে” ,ঋষি গলায় আদর ঢেলে বলে।
কিছুক্ষন চুপ করে থাকে জয়ি।তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ একজন পঁচিশ বছরের মেয়েকে তোদের হসপিটালে রেফার করলাম। মেয়েটার ‘পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম’ ছিল,ফলে বেবি আসছিল না।ট্রিটমেন্ট শুরু করতে গিয়ে দেখলাম সেকেন্ড স্টেজ এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার।মেয়েটা জানেনা,কিন্তু ওর হাজব্যান্ড রিপোর্ট নিয়ে এসেছিল।কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারলো না,আমার সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়লো।আমি অনেক বোঝালাম এখন অনেক উন্নত ট্রিটমেন্ট এসেছে…এত খারাপ লাগছিল।ছেলেটা অনাথ,মেয়েটার বাড়িতে থাকে।স্কুল মাস্টার।ওর ভেঙে পড়াটা বারবার রণর মুখ মনে করিয়ে দিচ্ছিলো।রণও যে রাইকে বড্ড ভালোবাসে।আচ্ছা ঋষি আমরা রাইয়ের ব্লাড টেস্ট আর আল্ট্রাসাউন্ড ছমাস অন্তর তো করাতে পারি?” বড্ড অস্থির লাগে জয়ি কে।
“রিলাক্স জয়ি।তুই তো জানিস ওতে কিছুই বোঝা যায়না।তাও আমরা করতে পারি,যদি বলিস।আসলে তুই যে জন্যে বলছিস এখনো তার কোনো পারফেক্ট স্ক্রিনিং টেস্ট তো বের হয়নি।তাও আমি একদিন রাইকে নিয়ে যাবো ক্লিনিকে,টেস্ট এর জন্যে”,ঋষি জয়ির মনের অবস্থাটা বুঝতে পারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জয়ি ঋষির কাঁধে মাথা রাখে।আজ সত্যি ওর মনটা বড্ড অস্থির।রাইয়ের ক্ষেত্রে ‘হাই রিস্ক’ কথাটা জুড়ে গিয়ে জয়ি সবসময় বড্ড টেনশনে থাকে।এই রোগটা যে বড্ড নাছোড় রোগ,তাড়ালেও যায় না।আবার যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো সময় ফিরে আসতে পারে।আর ব্রেস্ট ক্যান্সারের সময় রিস্ক লেভেল বেশি থাকলে পরবর্তী কালে ওভারিয়ান ক্যান্সার হওয়ার চান্স থাকে,কিন্তু ওভারিয়ান ক্যান্সারের এখনো অবধি নির্দিষ্ট কোনো স্ক্রিনিং টেস্ট নেই,কিন্তু এই ক্যান্সার বড়ই সাংঘাতিক,তাই তো ডাক্তারদের কাছে এটা ‘সাইলেন্ট কিলার’ হিসেবে পরিচিত।কবে কিভাবে এই ক্যান্সার পেটের মধ্যে ছড়িয়ে যায় ডক্টরও বুঝতে পারেনা।আর জয়ির ভয়টা ঠিক এখানেই।
হঠাৎ চমকে ঘাড় তুলে জয়ি তাকায় ঋষির দিকে।ওর চোখে এক অসহায় ভয় দেখে ঋষি।
“কিরে আবার কি হলো?বললাম তো ওকে নিয়ে যাবো।

” না না আমিও যাবো তোর সাথে।চল না কাল নিয়ে যাই”,জয়ির কথায় উৎকণ্ঠা ফুটে বের হয়।
“না জয়ি আগে রণকে বলতে হবে।ওর সাথে আলোচনা করে তবেই দিন ফাইনাল করবো।জানিস তো রাইয়ের ব্যাপারে ওর পজেসিভনেস। ওকে না বলে রাইয়ের ক্ষেত্রে…।” চুপ করে যায় ঋষি।
জয়িও জানে রণর অধিকারবোধ রাইয়ের প্রতি ঠিক কতটা মারাত্বক! তবে রাইয়ের স্বার্থেই বেশি দেরি করা ঠিক না এটাও বোঝে ও,তাই ঋষির সাথে তর্ক না করে মনে মনে রণ কে বোঝানোর প্ল্যান করে ও।
হঠাৎ কি মনে হতে বাঁহাতটা চোখের কাছে তুলে ঘড়ি দেখে,’বাব্বা সাতটা বাজতে চললো।গেল কোথায় রণ?সেই দুপুর তিনটে তে বেরিয়েছে,তবে কি ঋষির অনুমান ঠিক! রণ ওবাড়ি পালিয়েছে সুযোগ খুঁজে!
কথাটা মনে আসতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো ওর,নিজেদের ওই বয়সের কথা ভেসে উঠলো মনে।শুধু ওই বয়স কেন এখনো তো ঋষি বাড়ি ফিরে ওকে দেখতে না পেলে অস্থির হয়ে ওঠে।আজই তো ওকে নীচে না দেখতে পেয়ে ছাদে উঠে এসেছে?
মাথাটা আবার ঋষির কাঁধে ঠেকিয়ে নিজের ডানহাতটা বের দিয়ে ঋষির কোমর জড়িয়ে ধরে ও।জয়ির শরীরের ওমে আজও ঋষির শরীর পোড়ে,সেই ভাবেই পুড়তে পুড়তে ঋষি ঠোঁট ছোঁয়ায় জয়ির কপালে।জয়ি নিজের মুখটা গুঁজে দেয় ঋষির গলার কাছে।প্রায় ত্রিশ বছর বিবাহিত জীবন কাটিয়েও আজও ঋষি জয়ি একই রকম ভালোবাসার আবেশ অনুভব একে অপরের সংস্পর্শে।দুজন দুজনকে জড়িয়ে অন্ধকার ছাদে বসে থাকে,শীতের সন্ধের শীতলতা ওদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়,কিন্তু ওদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ উষ্ণতা কমাতে পারেনা।

‘উফফ এইভাবে বেল তো একজনই বাজায়।কিন্তু সে তো আজ কোনোভাবেই আসতে পারবে না বলেছিল।তাহলে এই সন্ধেবেলা কে এলো আবার!বাবা তো…’,নিজের মনে বকতে বকতে ডাইনিং হল পেরিয়ে ফ্ল্যাটের মেইন দরজার কাছে পৌঁছে ‘আইহোল’এ চোখ রাখলো রাইমা।
মুখটা গম্ভীর করে সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো,”তুমি!!”
“হ্যাঁ চলে এলাম”,কিছুটা গম্ভীর মুখেই উত্তর দিলো রণ।
ভ্রু কুঁচকে গেল রাইয়ের,’বাব্বা এতো উল্টে ভাও নিচ্ছে!’
“এসময়!!সকালে যে বললে সাতদিনে একবারও সময় হবে না!”,রাই সকালের কথায় একটু মনে মনে রেগেছিলো,সুযোগ পেয়ে শুনিয়ে দেয় কথাটা।
কোনো উত্তর দেয় না রণ,উল্টে চশমার ওপার থেকে চোখ ছোট করে একটা ভ্রু সামান্য তুলে বলে,”দরজা থেকে সরবে,না কি সব কথা এখানে দাঁড়িয়েই বলবো?”
মুখ কুঁচকে সরে আসে রাই দরজা ছেড়ে।রণ কোনো কথা না বলে জুতো খোলার ঘরে জুতো ছেড়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসে।
রাই মুখটা রাগ রাগ রেখেই ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।রণ রাইকে প্রায় উপেক্ষা করেই হাঁক দেয়,”অতসী দি এক কাপ কফি”।
“হ্যাঁ এই বাড়ি পৌঁছে কফি করে নিয়ে আসবে তো অতসী দি”,কটাক্ষ করে রাই।আসলে সকালে এবাড়ি আসা নিয়ে দুজনের একটা হালকা লড়াই হয়েছিল,তারই জের চালু রাখে দুজনে। রণ চায়নি রাই ওকে ছেড়ে এতদিনের জন্যে যাক আর রাই চেয়েছিল রণ মুখে সেটা বলুক।ফলে একই কারণে দুজনের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই হয়ে রাই এবাড়িতে চলে আসে।মুখে যাই বলুক ও জানতো রণ আজ না হোক সাতদিনে একবার আসবেই।

“মানে?” রণ অবাক হয়ে তাকায় রাইয়ের দিকে,আর নজরে আসে রাইয়ের লাল নাক,তার মানে বউ তার ভালোই রেগেছে।মনে মনে একটু হেসে বলে,”ওহ অতসীদি তো এখন রাতে আর থাকেনা।তা এককাপ কফি কি পাওয়া যাবে?”
রাই কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে কিচেনে চলে যায়।রাই কিচেনে ঢুকতে রণ ও আওয়াজ না করে চেয়ার থেকে উঠে কিচেনের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়,আর যে টা শুনতে চাইছিল সেটাই খুব আস্তে কানে আসে,রাই নিজের মনে বকবক করছে,’হম্ম সকালে তো খুব বড় বড় ডায়লগ দিলো…আমি একদিনও যেতে পারবো না,তোমার যেতে ইচ্ছা হয়ে যাও…আমি যেন শখ করে এসেছি,নিজেই বলবে আমি থাকলে পড়া হয়না আর চলে আসতে চাইলে নাটক করবে।আমি যেন বুঝিনা কিছু!সকালে একবার তো বললেই হত,”যাসনা রাই এতদিনের জন্যে,আমি থাকতে পারবো না”,সে বাবু মুখে বলবে না,সব বুঝে নিতে হবে।আমিও ফিরবো না সাতদিনের আগে,নিজে যতক্ষন বাড়ি থাকবে লেপ্টে থাকবে আর পরে বলবে আমার জন্যে পড়া হয়না।কেন শুনবো আমি বদনাম।…’,রাইয়ের কথায় রণ নিজের মনে হাসতে হাসতে কিচেনে উঁকি দেয়।পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে ইন্ডাকশনে কফি করছে মহারানী।এটাই তো চাইছিল ও।পা টিপে টিপে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রণ রাইকে।কিছু বলার আগেই নিজের মুখটা গুঁজে দেয় রাইয়ের কাঁধে।
এতদিনে রাই অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে রণর এধরণের ব্যবহারের সাথে,তাই চমকায় না।কিন্তু মুখটা গম্ভীর করে কফি বানাতে থাকে।
কিন্তু রণ বেশিক্ষন রাইকে স্থির হয়ে ওর কাজ করতে দেয়না।কাঁধে গলায় হালকা করে গাল বুলিয়ে বিরক্ত করতে থাকে।
“দূর এরকম করে কফি করা যায়”,নিজেকে অনেক কষ্টে আটকে রেখে শেষে রাই বলেই ফেলে।
ঘোরমাখা গলায় রণ বলে,”কে বলেছে কফি করতে!” কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে রাইকে নিজের মুখোমুখি আনে এবার ও।হাত বাড়িয়ে ইন্ডাকশন অফ করে দুহাত রাইয়ের দুটো গালে হাত রাখে রণ।
গভীর স্বরে বলে,”কেন আমায় বারবার পরীক্ষা করিস রাই? তুই জানিস না তোকে একদিনও না দেখে আমি থাকতে পারিনা?রাতে ঘুমের ঘোরে তোর ছোঁড়া হাত এসে মুখে না পড়লে ঘুম আসতে চায়না এখন আর আমার? খাবার নিয়ে তুই জোর না করলে খেতে ইচ্ছাও করে না,সে যতই মা প্লেটে বেশি করে খাবার দিক!ঘুমের ঘোরে প্রতিরাতে চোখ খুলে তোর মুখটা দেখে নিশ্চিন্তে চোখ বুজি,তুই না থাকলে ঘুম ভেঙে যে আবার ঘুম আসবে না।নিজের মনে পড়তে পড়তে হঠাৎ তোর পা টা পিঠে অনুভব না করলে মন বসবে না পড়ায়।বলনা রাই তুই এগুলোর কোনটা জানিসনা? এই একমাসে তুই আরো বেশি করে আমার অভ্যেস হয়ে গেছিস।পারবো না আমি তোকে ছেড়ে থাকতে।তাই তুই যেখানে,আমিও সেখানেই থাকবো।এন্ড দ্যাটস ফাইনাল”,ঠোঁট ছোঁয়ায় রণ রাইয়ের কপালে।
রাই বড় বড় চোখ করে এতক্ষন সব সব শুনছিলো রণর মুখের দিকে তাকিয়ে।রণর কথা শেষ হতে ও রণর পায়ের পাতার ওপর উঠে দাঁড়ায়,তারপর রণর দুটো গালে নিজে আলতো করে ঠোঁট ঠেকিয়ে ওর বলিষ্ঠ বুকে মুখটা ঢুকিয়ে প্রাণ ভরে ওর পুরুষালী গন্ধটা ভরে নেয় নিজের মধ্যে।তারপর দুহাতে রণ কে আঁকড়ে ধরে।রণও জাপটে নেয় রাইকে নিজের মধ্যে।
“কিন্তু সমস্যা হলো রাতে কি পরবে তুমি?” দুস্টুমি করে বলে রাই।
“ওই যে তোর ট্রলিতে যে আমার বাড়িতে পরার সেট গুলো এনেছিস তার একটা”,উত্তর দিয়ে রণ রাইয়ের গাল টিপে দেয়,আর ওর নিজের মুখের হাসি চওড়া হয়।
শুধু মুখটা তুলে বড় বড় চোখ করে রণর মুখটা একবার দেখে হেসে ফেলে ও,”জানতাম তো আজ নয় কাল ঠিক আসবে।কিন্তু থাকবে সেটা সিওর ছিলামনা,তাও নিয়ে নিয়েছিলাম দু সেট বাড়িতে পড়ার টি শার্ট আর ট্রাউজার।দুস্টু ঠিক খেয়াল করেছে”।
রণর মুচকি হাসি অট্টহাসিতে পরিণত হয়।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর রাই ওর নিজের মেয়েবেলার ঘরে গিয়ে উঁকি দেয়।রণ সঙ্গে করে ল্যাপটপ আর দুটো বই এনেছে।প্রথমে গাড়িতে রেখে এসেছিল রাইয়ের ভয়ে,কতটা কি ঝাড় খাবে আন্দাজ করতে না পেরে,পরে গিয়ে নিয়ে আসে।
“চলো ডিনার করে নেবে চলো।বাবার ফিরতে প্রায় এগারোটা হবে।তোমার ন’টায় খাবার অভ্যেস,খেয়ে নাও”,রাই তাড়া লাগায় রণ কে আর ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ যায় রণর ল্যাপটপে।
“এসব কি খুলে বসে আছো তুমি? আমি ভাবলাম কত পড়ছো,কিন্তু এটা কি?” রাই রণর বেডের কাছে এসে দাঁড়ায়।
“বলো পাহাড় না সমুদ্র?তোমার এই শরীরে দেশের মধ্যেই কোথাও যাবো।কিন্তু কোথায় সেটা তুমি বলবে?” স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলে রণ।আজকাল মাঝে মধ্যে রাইকে ‘তুমি’ বলতে ভালো লাগে ওর,আর রাইয়ের তো খুবই পছন্দ হয় এই ডাকটা।
“এই তোমার পরীক্ষার প্রিপারেশন হচ্ছে?” রাই ভ্রু কুঁচকে বলে।
রণ চশমাটা চোখ থেকে খুলে পাশে বিছানার উপর রেখে এক হাত বাড়িয়ে রাইকে টেনে কোলে এনে বসায়,”এই যে ম্যাডাম এই সব কিছুই জীবনে একবারই আসবে,তাই এগুলোর দরকার ও কিছু কম না।আর হ্যাঁ সব কিছুই পরীক্ষার পর হবে।এবার আপনি বলুন পাহাড় আপনার ফেভারিট হলেও আমরা কি প্রথমবার একসাথে সমুদ্র দেখতে যেতে পারি?” রাইয়ের নাকে নিজের নাকটা ঘষে দেয় ও।
“কেন পাহাড় নয় কেন? আমরা যে ঠিক করেছিলাম প্রথম সিমলা বা দার্জিলিং যাবো?” আদুরে স্বর শোনে রণ রাইয়ের গলায়।
উফফ এই মেয়েটা ওকে মেরেই ফেলবে।এভাবে কথা বললে কি আদর না করে থাকা যায়?
নিজেকে মনে মনে শাসন করে রণ বলে,”এই ঠান্ডায় পাহাড়ে গেলে তোর শরীরে সমস্যা হতে পারে।গোয়া বেস্ট।”
মুখ কথা বললেও হাত বেপরোয়া হওয়ার চেষ্টা করে ওর।
“এই একদম না।এই অসময়ে একদম জ্বালাবে না কিন্তু”,রাই উঠে পড়তে চায় রণর কোল ছেড়ে,কিন্তু বুঝতে পারে রণ উঠতে দেবেনা।
“তুমি খেতে যাবে?আর হ্যাঁ পরীক্ষা হোক তারপর বেড়ানোর প্ল্যান হবে।আচ্ছা আমরা একটা ফ্যামিলি ট্যুর করতে পারি তো?” রাইয়ের কথা শুনে রণ চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজে থেকে ঠেলে কোল থেকে নামিয়ে দেয়।
“কোথা থেকে এসে তুই আমার গলায় ঝুললি বলতো!! বিয়ের পর হানিমুনে ফ্যামিলি নিয়ে যাবি বলছিস!!যা তো তুই এখান থেকে”,রণ স্পষ্টত বিরক্ত হয়।
রাই কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে এসে রণর গলাটা জড়িয়ে ধরে,”রাগ করছো কেন?আমি তো জাস্ট জিজ্ঞেস করেছিলাম”।
“আচ্ছা রাই এটা জিজ্ঞেস করার বিষয়!!আমি তোর সাথে কদিন একদম একা কাটাতে চাই।সেখানে ফ্যামিলি না,কেউ না।শুধু কদিন আমরা দুজন।ঘুম থেকে ওঠার সময় থাকবে না,থাকবে না খাওয়ার তাড়া।আমরা ঘুরবো বেড়াবো আর একে অপরে বুঁদ হয়ে থাকবো যখন খুশি যতক্ষন খুশি।একসাথে স্নান করবো,আমি তোকে ভালো করে সাবান মাখিয়ে দেব।…”,রণ আবার কথার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে।
“রণ মার খাবে।কন্ট্রোল ইওরসেলফ।হানিমুনের জন্যেও কিছু থাকবে তো নাকি?” রাই রণকে ছেড়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে।
রণ সেই মুহূর্তে রাইয়ের হাত ধরে নিজের কাছে এনে কোমরটা বের দিয়ে জড়িয়ে ওর পেটে গাল ঠেকায়।
“আমাদের হানিমুন হবে শুধু কেয়ারিং এর হানিমুন,ভালোবাসার হানিমুন।শরীর মিলবে শরীর চাইলে কিন্তু ওটা কোনো ম্যান্ডেটরি ব্যাপার হবে না।আমরা দুজনে দুজনকে পুরোপুরি ভাবে যেটুকু চেনার বাকি চিনবো।তবে হ্যাঁ ওখানে সারাদিন কিন্তু ইচ্ছা হলেই আমি কিস করবো,যতখুশি।ওটা মেনে নিতে হবে”,রণর ঠোঁট নেড়ে এই মৃদু হাসিটাই পাগল করে রাইকে।ও নিজেও রণকে জড়িয়ে ধরে ওর চুলে মুখ ডোবায়।
রাইয়ের মাঝে মাঝে সব কিছু স্বপ্ন লাগে।এই তো সেদিন মা চলে গেল।এক অচেনা বাড়িতে কিছু না ভেবেই চলে এসেছিল ও,জয়ি আন্টিকে ছাড়তে পারবে না বলে।তারপর রণ এলো,এসে দখল করে নিল পুরো ওকে,ছোট রাই সেটা বোঝেনি,শুধু আঁকড়ে ধরেছিল বন্ধু রণকে।
সেই স্মার্ট,ইন্টেলিজেন্ট রণজয় মুখার্জী ওকে ভালোবাসবে কখনো ভাবেইনি মুখচোরা রাই।কিন্তু সেই ভালবাসা এলো ওর কাছে,শুধু ভালোবাসা না পাগলামো।
আজ রণর মানেই জীবন,রণর জন্যে বেঁচে থাকা।জীবনে একজন এমন কেউ থাকাটা খারাপ না যাকে নিজের পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায়।রাই জানে ওর থেকে ওর জন্যে রণ বেস্ট ভাববে।
রাইমা আজ নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে। ও জানে মরণ রোগটা আবার হয়তো ফিরতে পারে ওর জীবনে,কিন্তু ও আজ সতর্ক,পরিণত।আজ ও জানে পালাবার উপায় নেই,অন্তত এই পাগল ছেলেটা কে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ওকেও বেঁচে থাকতে হবে।

ক্রমশ…