মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-৩৩

0
362

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#তেত্রিশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

-“রণ কোথায় তুই?”
-“কাছাকাছি আছি।”
-“রাই তোকে খুঁজছে।”
-“ওকে বলো আমি হসপিটালেই আছি।অন্য একটা এমার্জেন্সি কাজে বিজি আছি।আসছি কিছুক্ষন পরে।”
-“তুই কেন এত আপসেট হচ্ছিস।হতেও তো পারে এতোটাও টেনশনের কিছু না।আমি টিউমার কিনা শিওর হওয়ার জন্য আর একটা সোনোগ্রাফি করবো।তুই জানিস…”।
-“প্লিজ বাবা আমি কি এসব ব্যাপারে অজ্ঞ যে আমায় এসব বোঝাচ্ছ? কেন বুঝতে পারছ না প্রেগন্যান্সির কোনো চান্স নেই।হ্যাঁ আমিও ভেবেছিলাম বেশি ডিলে না করে বেবি নিয়ে নেব,কিন্তু সেই প্ল্যান…ছাড়ো। আর প্লিজ রাইয়ের মনেও এসব আশা…”।
-“তুই কি জানিস রাইয়ের পিরিয়ড এমাসে এখনো হয়নি বলে তোর মা আমাদের না জানিয়ে রাইয়ের ব্লাড টেস্ট করিয়েছিল,সিরাম বিটা এইচ সি জি (Serum beta HCG)।আর লেভেল যথেষ্টই বেশি,মানে প্রেগনেন্ট হওয়ার চান্স ছিল।তোর মা খুব তাড়াতাড়ি সোনোগ্রাফি করাতো।কিন্তু আমাদের সোনোগ্রাফি থেকে এটা পরিষ্কার প্রেগন্যান্সির চান্স থাকলেও সেটা এক্টোপিক (ectopic) প্রেগন্যান্সি,মানে সেটাও গুড নিউজ কিছু হয়তো না।কিন্তু তুই যা ভাবছিস অতটাও ভয়ের ও তো না।যদিও এক্টোপিক প্রেগন্যান্সিতেও ওভারিতে এভাবে ফেটাস ডেভেলপ করা খুবই রেয়ার, কিন্তু ইম্পসিবল তো না।যদি ওটা হয়,তাহলে এখন একদম প্রথম দিক, এক্ষেত্রে মেডিকেশনে কিওর হওয়া সম্ভব।জয়ি সেটাই বললো।তবে আগে দেখতে হবে…”।
-“বাবা তুমি আমার থেকে বেটার জানো আরো অনেক ক্ষেত্রেই সিরাম বিটা এইচ সি জি বেশি হতে পারে।শুধু আর একবার সোনোগ্রাফি না কালকের মধ্যে টিস্যু বায়োপসিও করাতে হবে।আর কোনো আবেগ না।আমি জানি কেন আমি ভয় পাচ্ছি।একটা স্বপ্ন…”।
গলা ধরে আসে রণর।নিজের প্রিয় মানুষটার স্বপ্ন যদি নিজের হাতে শেষ করতে হয়…আর ভাবতে পারেনা রণ।ও ভাবেনি আবার এত তাড়াতাড়ি ওর দুঃস্বপ্নটা বাস্তবে হানা দেবে।ঘুমিয়ে না জেগে জেগে প্রতি মুহূর্তে যে দুঃস্বপ্নটা ওকে তাড়া করে সেটা এভাবে…।
“আমি আসছি দশ মিনিটে…”,ফোনের লাইন কেটে যায়।

ফোনটা হাতে ধরেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভিজ্ঞ ডাক্তার ঋষি মুখার্জী।জয়ির সাথে কথা বলে মনটা কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছিল,কিন্তু রণর সাথে কথা বলে মনেহল ওরা বেশিই আশা করে ফেলছে।আজকের দিনে প্ল্যান না করে অ্যাকসিডেন্টলি প্রেগনেন্ট কেউ হয়না।বিশেষ করে একজন ডাক্তারের সাথে এটা আশা করাও ছেলেমানুষি।
বয়স হচ্ছে বুঝতে পারে ঋষি।এতদিন ধরে এই রোগটা নিয়ে নাড়া ঘাঁটা করছে কিন্তু আজকাল মনে চাপ পড়ে।আর রাই তো ওর মেয়ে,সেক্ষেত্রে এই চাপে যেন মাথার মধ্যে হাতুড়ি চলছে।
জয় রাইয়ের কেবিনে আছে।একা ঋষি চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চোখ বোজে।আগে রাতের পর রাত জেগেও দিনে কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে এমার্জেন্সি ডিউটি করেছে,কিন্তু আজকাল ঘুম অসমাপ্ত হলে শরীর আনচান করে।
ঘড়িতে সময় বলছে ভোর প্রায় হয়েই এসেছে।উঠে এককাপ চা খেতে চায় শরীর,কিন্তু ক্লান্ত মনের নড়তে ইচ্ছা করেনা।
পুরোনো কথা,পুরোনো দুঃস্মৃতি গুলো মনে ভিড় করে আসতে থাকে।
এই তো সেদিন মেয়েটা লড়ছিলো ওই ভয়ঙ্কর রোগটার সাথে,কত খারাপ দিন কাটিয়ে সবে একটু ভালো সময়ে ফিরেছিল ওরা…।
সেই ছোট রাইকে জয়ির বাড়ি নিয়ে আসার দিনগুলোও মনে ভাসতে থাকে।বন্ধ চোখের কোন দিয়ে যে অঙ্কলজিস্ট ডাক্তার ঋষি মুখার্জীরও জল গড়াতে পারে বিশ্বাস করতে পারেনা ও নিজেই।
আজকাল হয়তো উন্নত চিকিৎসায় প্রানের ঝুঁকি কমেছে কিন্তু সদ্য বিবাহিতা একটা মেয়ের স্বপ্ন গুলো কি বাঁচাতে পারবে ঋষি? রণ কি কোনো রিস্ক নেবে আর?
ওর কাছে রাই যে বড্ড দামি।তাই ভয়ের কোনো কারণ থাকলে রণ যে রিস্ক নেবেনা সেটা ঋষি কে আলাদা করে বলার দরকার নেই।
আগেরবারই রিস্ক লেভেল হাই শুনে ব্রেস্টের সাথে ওভারিও অপারেট করাতে চেয়েছিল রণ ,আটকেছিলো জয়ি সেন্টিমেন্টাল কথায়।কিন্তু এবারে রণকে আটকানো সম্ভব না।
তবে রাইকেও সেক্ষেত্রে ওকেই সামলাতে হবে।ঋষি জানে এরকম ঘটনা একটা মেয়েকে মানসিক অবসাদে নিয়ে যায়।সেখান থেকে বের করতে পারে বিশেষ মানুষই।আজ অবধি এধরণের কেস বিশেষ একটা আসেনি ঋষির,কারণ অবশ্যই এত কম বয়সে এই ক্যান্সার রেয়ার।তবে বেবি ছোট অবস্থায় রোগ ধরা পড়ার ঘটনা অনেক দেখেছে ও ওর কেরিয়ারে।আগে চিকিৎসাও বিশেষ করার সুযোগ পায়নি,কিন্তু এখন রোগটা আয়ত্তে এনে রোগী সুস্থ করা সম্ভব।কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার পড়ে যার ফলস্বরূপ রোগীকে অবসাদ গ্রাস করে।

নাহ,উঠে পড়ে ঋষি চেয়ার ছেড়ে।ভুলভাল চিন্তা থাক,চা দরকার।নিজের চেম্বারের দরজা টেনে কফি ভেন্ডিং মেশিনের সামনে এসে দাঁড়ায় ও।দুকাপ কফি নিয়ে পা বাড়ায় রাইয়ের কেবিনের দিকে।

মেয়ের মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলচ্ছিলো জয়ন্ত।পূবের আকাশে লালচে ছোঁয়া লেগেছে।অন্যদিন এই সময়ই বাড়ি থেকে মর্নিং ওয়াকে বের হয় ও।আর ফুসফুসে জমে থাকা হসপিটালের ওই চেনা গন্ধটা সরিয়ে টাটকা বাতাস ভরে নেয় সারাদিনের জন্যে।
জয় খেয়াল করে দেখেছে ওর সরকারি হসপিটালের গন্ধ,আর যে কোনো প্রাইভেট হসপিটালের গন্ধ এক না।কোথাও একটা ঝাঁঝালো পার্থক্য আছে।এইসব প্রাইভেট হসপিটালের কেবিন গুলো ফাইভ স্টার হোটেলের রুমের সাথে মিল পায় ও,আসলে ফেসিলিটি তো টাকা দিয়েই কিনতে হয় দুজায়গাতেই।
রণর জন্যে চিন্তা করতে করতে রাই কিছুক্ষন হলো ঘুমিয়েছে।ঋষি ঘুমের ওষুধও দিয়েছিল।বয়সের কারণে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া জয়েরও একটু ঢুলুনি আসছে।
কিন্তু ছেলেটা যে কোথায় গেল??
রাইকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সাহস হয়না ওর,সারাদিন কে দেখবে মেয়েটা কে! অতসী কে বললেও সে তো আর নিজের লোকের মত খেয়াল রাখতে পারবে না।বরং ও বাড়িতে রণ ছাড়াও জয়ি আছে,রমা আছে আর ঋষিও।
আজকের দিনটা রাইকে রাখবে এখানে ঋষি,কিছু টেস্ট করার আছে।ডিটেইলস কিছু না বললেও ডাক্তার জয়ন্ত চ্যাটার্জী এটুকু বুঝেছে টেস্টটা কিসের।বড্ড ভয় করছে।যদিও জয়ি একটা অন্য আভাস দিয়েছে।যেটা হলে ভয় কিছুটা কম হবে,কিন্তু এই মুহূর্তে মারাত্মক ভয়টাই মন জুড়ে বেশি ঘোরাফেরা করছে।
প্রেগন্যান্সির কোনো আশা থাকলে রণ কি ওভাবে বেরিয়ে যেত হসপিটাল ছেড়ে? ও তো এতোটাও বোকা না।এই দিকটা কি ও ভেবেও দেখতো না!
চিন্তা গুলোকে সরিয়ে রাইয়ের বিছানা ছেড়ে উঠে আসে জয়ন্ত।
কেবিনের বড় কাঁচের জানলার পর্দা একচিলতে ফাঁক করে বাইরে দেখে জয়,তারপর ঘড়ির দিকে তাকায়,প্রায় পাঁচটা বাজে।শীতের ভোর এখনো সকালে গড়ায়নি।একটু চা টান ধরে এবার।
ছটা নাগাদ অতসী কে ফোন করে আসতে বারণ করবে আজ।আজ কখন ফিরবে ফ্ল্যাটে নিজেও জানেনা।নিজের হাসপাতালেও একবার ফোন করতে হবে।
সবে ভাবছে এখানকার ক্যান্টিনের চায়ের ভেন্ডিং মেশিন থেকে এক কাপ চা নিয়ে আসবে,ঠান্ডাটা বড্ড বেশি বুড়ো হাড়ে কাঁপন ধরাচ্ছে, কেবিনের দরজা ঠেলে শুকনো মুখ আর উস্কোখুস্কো চুলের রণ ঢোকে।
চমকে ওঠে জয় রণর চেহারা দেখে।এক রাত্রিরে কি হাল হয়েছে ছেলেটার? কেন এখনই এভাবে ভেঙে পড়ছে ও!
জয় দ্রুত এগিয়ে যায় ওর দিকে।আর ঠিক সেই মুহূর্তে রণর পিছন পিছন ঋষিও ঢোকে কেবিনের দরজা ঠেলে।

কোথা দিয়ে রাতটা কেটে গেল বুঝতে পারেনা শীর্ষা।সেই মাঝরাতে হসপিটালে এসেছে,তারপর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ-ছ ঘন্টা।শিবরাজের এনগেজমেন্টের ছবি গুলো দেখে যখন ও কান্নায় ভেঙে পড়েছিল,আবারও একবার নিজের স্বপ্নগুলো একটা একটা করে পোড়াচ্ছিলো মনের আগুনে ঠিক সেই মুহূর্তে ওর আইফোনটা কেঁপে উঠেছিল।
প্রথমে ইচ্ছা করেনি হাতে নিতে ফোনটা ঠিক ওই মুহূর্তে।কিন্তু ডাক্তার শীর্ষা ভট্টাচারিয়া সাধারণ মানুষের মত অভিমান করে ফোন অফ করে কাঁদতে পারেনা যে।
কর্তব্যের খাতিরে হাতে নিয়েছিল ফোনটা।আর সঙ্গে সঙ্গে ধক করে উঠেছিল বুকটা।শিবরাজের মেসেজ।একবার ভেবেছিল দেখবে না,নামিয়ে রেখেছিলো ফোনটা।কিন্তু পরমুহূর্তে অদৃশ্য এক টানে তুলে নিয়েছিল ওর আর রাজের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমকে।
ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে লেখা মেসেজটা শীর্ষার মাথায় ঢুকতে সময় নিয়েছিল আরো কয়েক মিনিট।মেসেজ গুলো বাংলা করলে যা অর্থ হয়,”কেমন আছো শীষ? আজ বড্ড বিগত দুবছর মনে উঁকি মারছে আমার। আমার জীবনটা বড্ড ফাঁকা ছিল তুমি তো জানো। তুমি আসার পর থেকে আর সেই ফাঁক, সেই অবসর আমার বিশেষ ছিলোনা।নিজের লেখাকে সময় দেওয়াও কমে গেছিল যেন। পাগলামো পেত আমার তোমার জন্যে।নাহলে কেউ বিদেশ ছোটে শুধু তোমার সংস্পর্শ পেতে!”
“জানিস শীষ ছোট থেকে বন্ধুর বড় অভাব ছিল আমার জীবনে।আর প্রেম! নাহ সে একদমই আসেনি জীবনে।এক তরফের ভালোবাসা কখনও অন্য হৃদয় আগে ছোঁয়েনি।হয়তো আমার ভালোলাগা ভালোবাসা হয়ে হৃদয়কে সেভাবে নাড়ায় নি বলেই আমিও নিজের মনের মধ্যেই সেগুলো আটকে রাখতে পেরেছিলাম।কিন্তু তোকে দেখে যে শিরশিরানী অন্তরে হয়েছিল সেটা পরের কটা দিন কোনো কাজে মন বসাতে দেয়নি।এক অদ্ভুত অস্থিরতা,এক অনন্ত মন খারাপ।জানিস খালি মনে পিন ফুটেছিল যতবার ভেবেছিলাম আর কখনও দেখা হবেনা তোর সাথে।”
“এই কদিন আবার সেই এক অনুভূতি হচ্ছে।তার সাথে যোগ হয়েছে আর এক অদ্ভুত চিন্তা।অনেক চেষ্টা করলাম জানিস,তোর জায়গায় অন্য আর একজন কে বসিয়ে ভাবতে।নিজের ঘরে যেখানে যেখানে তোকে নিয়ে কল্পনা করতাম,তাকে বসালাম।একটা অসহ্য কষ্ট হলেও মানাতে চাইলাম নিজেকে। কিন্তু বিশ্বাস কর যেই ছুঁতে গেলাম ওকে,মুখটা তোর মুখে বদলে গেল।কতবার চোখ খোলা বন্ধ করেও পারলাম না কল্পনায় অন্য কাউকে ছুঁতে।”
পরপর ঢুকছিলো মেসেজ গুলো।এত অবধি পরে শীর্ষার মনে হয়েছিল ওদের রিলেশনটা রিজিউম করতে চায় শিবরাজ।একটা আনন্দের সাথে সাথে ওর মনে ভেসে উঠেছিল ওর এনগেজমেন্টের ছবিটা,মনটা ভরে গিয়েছিল অভিমানে।কিন্তু শেষ মেসেজটা…
“সরি শীষ।সরি ফর এভরিথিং।সরি নিজের বাড়ির মানসিকতা জেনেও তোকে ভালোবাসার জন্যে।সরি তোকে বারবার আদর করার জন্যে।সরি তোর জীবনে জটিলতা তৈরি করার জন্যে।আর ‘আ বিগ সরি’ তোকে দেওয়া কথা রাখতে না পারার জন্যে।
এ’কদিনে আমি এটুকু বুঝেছি বেঁচে থেকে তোর সাথে ব্রেক আপ পসিবল না।আবার ‘মেরা জান কে জান কো খাতরোমে ডালকে’ তোকে কাছে পাওয়াও ‘নেক্সট টু ইম্পসিবল’।তাই তোকে ছাড়া বাঁচতে পারবোনা বুঝে নিজের জীবনটাই বাজি ধরলাম।তুই প্রেসক্রিপশন করে আগের বছর ঘুমের ওষুধ লিখে দিয়েছিলি বাবার জন্যে সেটাকেই কাজে লাগলাম।
আর হয়তো কোনোদিন তোর গলা শুনতে পাবোনা।কিন্তু বিশ্বাস কর বড্ড শুনতে ইচ্ছা করছে…ঘুমও পাচ্ছে…তোকে বুকে নিয়ে…গুড বাই মাই জান…।”
আর এক সেকেন্ড নষ্ট না করেই শীর্ষা রাজের সেলে কল করেছিল,কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি।বুঝেছিলো মেসেজগুলো লেখা হয়েছিল আগেই,শুধু শেষ মেসেজটা ছাড়া।
পাগলের মত আরো বেশ কয়েকবার ওর ফোনে কল করে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল ওর সাথে কথা বলার।শেষে ওর ফোনে তখনও সেভ থাকা শিবরাজের বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কল করে ও, সেখানেও প্রথমবার ফোন ধরেনি কেউ।
অস্বস্তি হলেও অত রাতে এছাড়া আর কোনো অপশনও ছিলোনা ওর হাতে।
দ্বিতীয়বারে ল্যান্ড ফোন ধরেছিল শিবরাজের দাদা।শীর্ষার কাঁপা গলায় বলা এলোমেলো কথা গুলো বুঝতে যেটুকু সময় লেগেছিল ওর,তারপর নিজের ভাইয়ের ঘরে ছুটেছিলি যশরাজ।

রাজের বিপদ এখনো কাটেনি।আইসিইউ তে ওর বেডের পাশের চেয়ারটা তাই শীর্ষা ছেড়ে ওঠেওনি।ওয়াশ করার সময় রাজের কষ্টে ওর চোখ বারবার ঝাপসা হতে চাইলেও রাজের বাবা মার মত চিৎকার করে বা নিঃশব্দে কেঁদে নষ্ট করার মত সময় ওর ছিলোনা।রাত জাগা ক্লান্ত মন বারবার বলছিল,’এত সহজ না আমাকে আবার একা করা।এত সহজ না জীবনে দ্বিতীয় বার নিজের ভালোবাসা কে অন্যের হাতে,মৃত্যুর হাতে তুলে দেওয়া।শেষ চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।, নিজের বাঁচার রসদ ফিরে পেতেই হবে।…’
শিবরাজের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে এখনো ওর চোখ বেয়ে যে জলটা পড়ছিল এই ছেলেটা কোনো ভাবে সেটা ডিসার্ভ করে না।শিবরাজের মত কাপুরুষ কে শুধু কলার ঝাঁকিয়ে একটা কথাই জিজ্ঞেস করতে পারে শীষ,’কেন করলি এটা?কেন?এত সস্তা করে দিলি আমার ভালোবাসাটা।তোর কিছু হলে কেউ আমায় ছেড়ে দেবে? এই অনিশ্চয়তা,ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে নিজের সবচেয়ে প্রিয়জনকে রেখে যাওয়ার ইচ্ছা হল তোর! এই তোর ভালোবাসা? তুই বেঁচে থাকতে যার প্রানের ঝুঁকি রয়ে গিয়েছিল তুই না থাকলে তাকে সবাই ছেড়ে দেবে!…’।
“না এগুলোর জবাব তোকে দিতেই হবে রাজ।আর তাই তোকে ভালো হতেই হবে।এই ভাবে এত সহজে শুকনো সরি দিয়ে আমার কাছে ক্ষমা পাবিনা তুই।অনেক হিসেব বাকি,সেরে ওঠ তুই আগে।…”
শীর্ষার ঝাপসা চোখ শিবরাজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুজে গেলেও ওর একটা হাত রাজের মাথায় বিলি কাটতে থাকলো আর একটা হাত ধরে থাকলো শিবরাজের একটা হাত,আঙুলে আঙ্গুল দিয়ে।
শীর্ষার হাতের পরিচিত ছোঁয়া হয়তো শিবরাজের অবচেতনে অনুভূতি ও তৈরি করেছিল।পরিচিত সেই ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরছিল ওর ফ্যাকাসে মুখে।শীর্ষা নিজের মনে হাহাকার করতে করতেই ওর গোলাপী ঠোঁট নামিয়ে আনলো শিবরাজের বাদামি কিন্তু শুকনো ফ্যাকাসে ঠোঁটে।ডাক্তারের কর্তব্য কিছুক্ষন ভুলে গভীর ভাবে নিজের প্রেমিকের ঠোঁটদুটো সিক্ত করার চেষ্টা করলো ওদের পুরোনো নিয়মে।
হঠাৎ মনেহল রাজ সাড়া দিলো।হয়তো শীর্ষার ভুল হলো,কিন্তু সেই মুহূর্তে রাজের আঙ্গুল গুলোও যেন চাপ দিল ওর আঙুলে।
কিছুক্ষন শিবরাজের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আলতো করে ওর বুকে মাথা ঠেকালো শীর্ষা।আজ হয়তো ও অনুভব করতে পারলো এই সব পেয়েও কিছু না পাওয়া ছেলেটার কাছে ও ঠিক কতখানি। ভালোবাসায় ঠকে যাওয়ার গল্প শুনতে শুনতে ও কয়েক ঘন্টা আগে নিজেকেও তাদের দলেই ফেলেছিল,ভেবেছিল রাইয়ের মত লাকি একজনই হয়।আজ এই মুহূর্তে মনেহল না,ভগবান অতটাও বেহিসাবী না ওর জন্যে।

“বাবা তুমি বলো আজ বায়োপসির জন্যে পাঠালে,দুদিনে রিপোর্ট নিশ্চই এসে যাবে?” রণর গলার স্বর এতটাই পেশাদারের মত শোনায় ঋষি আর জয় দুজনেই চমকে তাকায় ওর দিকে।কিন্তু ছেলের মুখ না চোখের দিকে তাকাতেই ঋষি বুঝে যায় ওর মনের অবস্থা।বড্ড নিষ্প্রাণ লাগে রণর চোখ দুটো।
-“হমম দুদিন তো লাগা উচিত,তবে কখনো কখনো আর একটু বেশি সময়ও লেগে যায়।”
-“না বাবা আমার দুদিনে চাই রিপোর্ট।তারপর আমি বলবো।আর কারোর কথা শুনবো না”।
-“রণ তুই কি করতে চাইছিস কি?”
-“পুরোটাই নির্ভর করছে রিপোর্টের ওপর,সেটা তুমিও ভালো জানো”।
উত্তর করে না আর ঋষি।প্রায় একঘন্টা হলো ওরা তিনজন,ঋষি-জয়-রণ, ঋষির চেম্বারে এসে বসেছে,কিন্তু কেউই এতক্ষন সেভাবে কিছু বলতে পারেনি।আর বলবেই বা কি! কি বলার থাকে এক্ষেত্রে!
“তবে একটা কথা বারবার রাইয়ের শরীরে কাটাছেঁড়া আর হবে না।তাই টিউমার যদি অপারেট করতেই হয়…”,থেমে যায় রণ চরম সত্যিটা বলতে গিয়ে।
-“যদি অপারেট করতেই হয় তাহলে?”,রণর শেষ কথার পুনরাবৃত্তি করে প্রশ্ন করে জয়।
জয়ের মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রণ বলে,”অর্গান বাদ দিয়ে দিতে হবে,মানে ওভারি আর …”,রণ কে শেষ করতে দেয়না ঋষি,”রণ সেসব পরের কথা।আগে টেস্ট হোক।আর সেই ডিসিশন রাইয়ের ডাক্তার হিসেবে আমি নেব।তুই…”।
-“না রাইয়ের হাজব্যান্ড হিসেবে,ওর ফার্স্ট গার্ডিয়ান হিসেবে আমি আর কোনো রিস্ক নেব না।এই ভাবে বারবার…ভুল আমাদের ই ছিল,ওর রিস্ক লেভেল হাই যখন ছিল তখন ই…”।
-“রণ তোর কি মনে হয় তাতে রাই ভালো থাকতো? শরীরের সাথে মনের সম্পর্ক আশা করি একজন ডাক্তার কে বোঝাতে হবেনা।একজন আন ম্যারেড মেয়ের শরীরের গুরুত্ব পূর্ণ অর্গান গুলো শুধু রিস্কের কারণে বাদ দেওয়া এত সহজ না।তার বয়স,ম্যারেটাল স্ট্যাটাস,মেন্টাল স্ট্রেনথ সব কনসিডার করতে হয়।হ্যাঁ যদি একান্তই বাধ্য হতে হয় সেক্ষেত্রে কিছু করার নেই।এখনও যেমন যদি সম্ভব হয় পুরো ওভারি প্রথমেই বাদ না দিয়ে শুধু টিউমার…”।
-“নাহ আর কোনো রিস্ক না।কেন বুঝছো না বাবা রাই…রাই…রাইয়ের জীবনটা আগে আমার কাছে।যদি বেঁচেই না থাকে তাহলে মন,মনের চাপ,বেবি…এগুলোর কথা আসবে কিকরে?এটা ওকেও বুঝতে হবে।”
-“রণ তুই একজন ডাক্তার হয়ে একথা বলতে পারিসনা।একজন পেশেন্টের মেন্টাল হেলথ দেখাও… কত স্বপ্ন জড়িয়ে থাকে… তুই নিজেও তো…”।
-“কিন্তু বাবা স্বপ্ন আর বাস্তব তো এক না।এটা রাইকেও বুঝতে হবে”।
গলা ধরে আসে রণর।ঋষি আর কথা বাড়ায় না।বুঝতে পারে ডাক্তার রণজয় মুখার্জী না রাইয়ের হাজব্যান্ড এর সাথে কথা বলছে ও,যাকে এই মুহূর্তে এসব তত্ত্ব কথা বোঝানো সম্ভব না।ওর কাছে এখন একটাই সত্যি সেটা হলো রাই, রাইয়ের জীবন।রাইকে হারানোর ভয় ওকে মানসিক ভাবে এত অস্থির করে দিয়েছে ও তার বাইরে এই মুহূর্তে কিছু ভাবতে পারছে না।আগে টেস্ট রিপোর্ট আসুক তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে বুঝে।
ঋষির চোখ যায় জয়ন্তর মুখের দিকে,বুকটা হুহু করে ওঠে।কি ভাগ্য বেচারার।সারাজীবন এই একটা রোগ ওকে যেন শান্তি দিলোনা।
‘ধুর,আগে রিপোর্ট তো আসুক।আমিই বা এত নেগেটিভ ভাবছি কেন?’ঋষির ভাবনার মাঝেই রণ উঠে পড়ে চেয়ার ছেড়ে।ঋষি তাকায় ওর মুখের দিকে,কিন্তু অন্য সময় যে ছেলে বাবার চোখের প্রশ্ন পড়ে নিজেই উত্তর দেয়,সে তাকায়ও না ঋষির মুখের দিকে।
“রণ রাইয়ের কেবিনে যাচ্ছিস?” জয়ের প্রশ্নে চমকে দৃষ্টি ওর মুখে রাখে ঋষি।রণ আর জয়ন্তর চিন্তা যে এখন একই রেখায় চলছে বুঝতে পারে ও।
“হমম”,রণর কথা বলতে না চাওয়ার অনীহা ওর মনের ঝড়টা ভালো করে বুঝিয়ে দেয়।রণ ভেঙে পড়বে রাইয়ের সামান্য সমস্যাতেও এটা ওদের অজানা না।কিন্তু টেস্ট হওয়ার আগেই এভাবে ওর রিয়্যাকসন ঋষিকে একটু হলেও ভাবায়।ও মনে মনে ঠিক করে বাড়ি ফিরে রণর সাথে কথা বলবে।

ঘুমটা কিছুতেই যেন কাটছে না।চোখ গুলো ভারী হয়ে আছে,খুলতে ইচ্ছা করছে না।কিন্তু বুঝতে পারছে রাই, ওর মাথায় কেউ আস্তে আস্তে হাত বোলাচ্ছে।আর সেই আরামে চোখ গুলো আরো ভারী লাগছে।আরেকটু ঘুমোতে ইচ্ছা করছে।

“রাই শরীর কেমন লাগছে? শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?পেইন আর হচ্ছে,কি রে?” যেন অস্পষ্ট কথা গুলো ভেসে আসে রাইয়ের কানে।
খুব জোর করে রাই চোখের পাতা ফাঁক করে,আবছা নজরে আসে মুখটা,রণর মুখ।হাত বাড়ায় রাই, রণ হাতটা ধরে।
একটু সময় নিয়ে ভালো করে তাকায় রাই, যদিও মাথাটা বিশেষ কাজ করেনা।কেমন যেন ফাঁকা ভাব।ব্রেস্ট সার্জারির পর জ্ঞান আসতে যেরকম একটা ঘোর ছিল,অনেকটা সেরকম।
“আমি কবে বাড়ি যাবো রণ?” কেবিনের চারদিকে চোখ বুলিয়ে অতিকষ্টে বলে রাই।
“আজকেই নিয়ে যাবো সোনা।আর একটা দুটো টেস্ট আছে…সন্ধের দিকে ফিরে যাব বাড়িতে”,রণর কথা শেষ হওয়ার মুহূর্তে কেবিনের দরজা খুলে জয়ি ঢোকে।
জয়ির চোখে আবছা কষ্টের রেশ নজর এড়ায়না রণর।সুতির গাউন পরা ওর মা কে বড্ড বিষাদগ্রস্ত লাগে ওর।
জয়ি কষ্ট আড়াল করতে মুখে হালকা হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে রাইয়ের দিকে।
“কেমন আছিস রাই?”
রাইয়ের মুখের কষ্টের হাসিটা রণকে যেন সুঁচ ফোটায়।রাইয়ের উত্তর আসে খুব আস্তে,”অনেকটা ভালো মা।আমি বাড়ি যাবো”।
জয়ি এগিয়ে এসে হাসিমুখে হাত রাখে রাইয়ের গালে,”হ্যাঁ মা।আজ বিকেলেই তোকে আঙ্কেল ছেড়ে দেবে”।
কিছুক্ষন রাইয়ের কাছে কাটিয়ে জয়ি ঋষির কেবিনে চলে যাওয়ার পর রাই আবার ক্লান্তি অনুভব করে।যেন মনেহয় রাজ্যের ঘুম নেমে আসতে চাইছে ওর চোখে।

“রণ আমার সোনোগ্রাফি রিপোর্ট কি দেখলে?তুমি তো ছিলে রুমে।তারপর বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিল?” চোখ বুজেই ধীর স্বরে প্রশ্ন করে রাই।
রাইয়ের পেটের দিকে একবার তাকায় রণ।পেটটা ফোলা বিয়ের আগে থেকেই।রণ ভেবেছিল মোটা হচ্ছে তার রাই। ‘বিয়ের পর শরীরে জেল্লা বাড়ে,মেয়েদের চেহারায় একটু পরিবর্তন আসে’,দিদুনের কথা গুলোই বারবার মাথায় আসতো।আজ বুঝতে পারছে টিউমারের সাইজ পেটটা ফুলে থাকার কারণ।
“তেমন কিছুই নেই রে।একটা ছোট সিস্ট আছে।আর তোর অপেন্ডিক্সটা মনেহচ্ছে অপারেট করতে হবে।সিরিয়াস কিছু নেই দেখে তো আমি একটা এমার্জেন্সি এসে গিয়েছিল,সেখানে চলে গেলাম।” রণ গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে উত্তর দেয়।
রাই চুপচাপ শোনে।চোখ বন্ধ থাকায় রণর মুখটাও নজরে আসেনা।নাহলে হয়তো এত সহজে রাই বিশ্বাস করতে পারতোনা রণকে।রণর চোখ ঠিক বলে দিত রণ কিছু লুকোতে চাইছে।
মনে মনে রাই ভয় পায় আবার কাটাছেঁড়ার কথায়।

“রাই তুই আমায় খুব ভালোবাসিস না রে?” রণর আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিনা নোটিশেই।
রণর এধরণের কথা রাইয়ের মনে সন্দেহ জাগায়,চোখ খুলে তাকায় ও রণর দিকে।
ওর চোখের দৃষ্টি রণকে অস্বস্তিতে ফেললেও নিজেকে সামলে নেয় রণ,”তোর কোনো কষ্ট হলেই আমার সেটা অসহ্য লাগে।তুই যন্ত্রনায় কাঁদছিলি আর আমার মধ্যেটা ভেঙে যাচ্ছিল।তোকে ছাড়া আমি আগেও কিছু ভাবতে পারতাম না,আর এখন বাঁচার কথা অবধি ভাবতে পারিনা।তুই আমার অক্সিজেন।তোকে সুস্থ রাখাই আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।তোর খুশি আমার কাছে খুব ইম্পরট্যান্ট,কিন্তু তার আগেও তোর শরীর।তুই বল না,তোর সবচেয়ে বড় আনন্দ তো আমি,তাই না?আমার চেয়ে কাউকে তুই বেশি ভালোবাসিস না আমি জানি,এমনকি নিজেকেও না।…”,রণর স্বর ভাঙতে চায়।
“কি হয়েছে রণ,এসব কেন বলছো?আমার কাছে তুমি কি সেটা তো তুমি বেটার জানো”, উঠে বসার চেষ্টা করে রাই।
রণ তুলে বসায় ওকে।তারপর ওর কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে প্রায় ফিসফিসিয়ে কিন্তু রাই শুনতে পাবে এভাবে বলে,”তোর জন্যে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে তো বল?তোর ওপর আমার অধিকার তোর থেকেও তো বেশি,তাই না?আমি যা ভাববো,যা করবো তোর জন্যে বেস্ট এটা তুই বিশ্বাস করিস তো? পুরো পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে গেলেও তুই আমায় বুঝবি তো বল?”

রাই এবার নিজের হাত দুটোর একটা রণর চুলে,আর একটা গালে রাখে।দুর্বল হাত দিয়ে চুলে বিলি কাটার চেষ্টা করে বলে,”রণ আমার জীবনটাই তোমার জন্যে।আমার জন্যে আমিও অত ভাবিনা,যা তুমি ভাবো।শেষ তিন-চার বছর হাতের তেলোয় করে রেখে দিয়েছো তুমি আমায়।এই রাইটা তো তোমার দান বলো।পুরো ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া রাইকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছ তুমি,স্বপ্ন দেখতেও শিখিয়েছ।এমনকি সেই অবুঝ রাইকে তুমিই তো বুঝিয়েছিলে ব্রেস্ট বাদ দিয়েও পূর্ণ নারী হওয়া যায়।স্ত্রী হওয়া যায়।মা হওয়া যায়।…”,এত গুলো কথা একটানা বলে হাঁফ ধরে যায় রাইয়ের।জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে খেয়াল করেনা ওর কোলে শুয়ে থাকা রণর চোখ ওর কথা শুনতে শুনতে আর্দ্র হয়ে উঠছে।রাইয়ের কোলে মুখটা গুঁজে দেয় রণ,কারণ আবার রাইয়ের কারণে ওর দুচোখ ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।নিজের হাতে নিজের দেখানো স্বপ্ন ভেঙ্গে দেওয়ার ভয় ওকে তাড়া করছে এখন প্রতি মুহূর্তে।

“রণ তুই হসপিটালে আসছিস?” কলটা রিসিভ করে ফোন কানে দিতেই শুনতে পেল রণ ঋষির ভাঙা গলাটা।
ও বুঝতে পারলো গত তিনদিনের উৎকণ্ঠা,বাকবিতণ্ডার অবসান ঘটেছে,রাইয়ের রিপোর্ট নিশ্চই এসে গেছে।

দুদিন আগে যেদিন সন্ধেবেলা রাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল রণ বিস্তর আলাপ আলোচনা করেও ঋষি-জয়ি রণকে ওর পয়েন্ট থেকে সরাতে পারেনি।
রাইকে স্টু আর অল্প ভাত খাওয়ানোর পর ওষুধ দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল রণ।এরপর ফোনে মায়ের মেসেজ পেয়ে নেমে এসেছিল নিচের ড্রয়িং রুমে।
ঋষি আর জয়ির মুখ বলে দিচ্ছিল ওরা কিছু বলার জন্যে তৈরি হয়ে আছে।বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয়নি,প্রথম মুখ খুলেছিল ঋষি।
“বোস রণ,কথা আছে তোর সাথে”,ঋষি সোফায় নিজের পাশে বসার জন্য ডেকেছিল রণ কে।
কথা না বাড়িয়ে রণ সেখানে গিয়েই বসেছিল।জয়ি চুপ থাকলেও ওরও নজর যে রণর দিকে ছিল বুঝতে পারছিল ও।
“রণ তুই জানিস রাই আমায় কিছুদিন আগে কি বলেছে? ওর জীবনে কোন স্বপ্নকে ও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়?” জয়ির প্রশ্নের উত্তরও যে ও নিজেই দেবে বুঝতে পেরে চুপ করে থাকে রণ।
“ওর মা হওয়ার স্বপ্ন।ওর আর ওর মায়ের অসম্পূর্ণ সম্পর্কটা ও সম্পূর্ণ করতে চায় নিজের সন্তানের মধ্যে দিয়ে।আর তাই খুব বেশি করে ও একটা মেয়ের মা হতে চায়।ও তো পিওর আর্টসের স্টুডেন্ট,শরীরের রহস্য ওর বিশেষ জানা নেই।একসিডেন্ট ঘটলেও ঘটতে পারে এই বিশ্বাসে পিরিয়ডের অনিয়ম ওর মনেও আশা জাগিয়েছিল।আসলে বড্ড সরল মেয়েটা।আর ভগবান বারবার ওরই পরীক্ষা নেয়।” জয়ি রণর মনে রাইয়ের স্বপ্নের বীজ পোঁতার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
পাত্তা দেয়না রণ।ও জানে এটা আসলে ভূমিকা।
“তোর বাবা তোকে কিছু বলতে চায় রণ,প্লিজ পুরোটা শোন আগে।তারপর কথা বলিস।” জয়ি এবার দায়িত্ব দেয় ঋষির হাতে।
“রণ প্লিজ রাইয়ের ট্রিটমেন্টের দায়িত্ব যখন আমার,ডিসিশন টাও আমার থাক। আমরা সেকেন্ড সোনোগ্রাফিতে সিওর হয়ে গেছি যখন প্রেগনেন্সি নেগেটিভ।সার্জারি করতে হবে এটা টিউমারের সাইজ দেখে মনে হচ্ছে।কিন্তু…”,ঋষি হেসিটেট করলেও জয়ি চুপ করে থাকেনা,”রাইয়ের এই মুহূর্তে ওভারি বাদ দেওয়ার দরকার আছে কিনা…”,রণ জয়িকে বাধা দেয়।

“এটা কেন বলছো মম!! আমাদের ফিউচার বেবির কথা ভেবে,রাই মা হতে পারবে না ভেবে? কিন্তু রাই যদি তারপরও মা হতে না পারে,যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়।আমরা ওপেন না করলে এই মুহূর্তে বুঝবো কিকরে যদি আবার ম্যালিগন্যান্সি ফিরে আসে তা কতটা কি ছড়িয়েছে।আর যদি নাও ছড়ায়,ফার্স্ট বা সেকেন্ড স্টেজও হয় তাহলেও রিস্ক নেব কেন? একবার ভাবো প্লিজ,একটা পঁচিশ বছরের মেয়ে একটা বড় অপারেশন হয়ে গেছে।আবার একবার হওয়ার পর তার শরীরে কি ক্ষমতা থাকে?তোমার কথা মেনে ওভারি অপারেট হলোনা,গ্যারান্টি কই আবার কয়েক মাসে রোগটা ফিরে আসবে না।তাহলে কেন রিস্ক নেব আমি! এখন জাস্ট টিউমার বাদ দিলে,আবার কয়েকমাস মাস পর সেই ওভারি বাদ দিতেই অপারেশন করতে হবেনা তার গ্যারান্টি কই?” একটানা নিজের মনের মধ্যে চলতে থাকা কথাগুলো ওগড়াতে পেরে যেন শান্তি পায়।কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারেনা ঋষি-জয়ি কেউই।
ঋষি তাও অনেকবার চেষ্টা করে রণকে এক্সট্রিম ডিসিশন নেওয়া থেকে আটকাতে, কিন্তু নাছোড় রণ কারোর মন রাখতেও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না।
ঋষি আর জয়ির চেষ্টা ব্যর্থ হয় রাইয়ের মনটা রণকে বোঝাতে।রণ মোটামুটি এটা সেদিনই শিওর করে দেয় টিউমার ম্যালিগনেন্ট হোক বা না হোক ও কোনো রিস্ক নিতে আর পারবেনা।

রণ আজ ঋষির গলার আওয়াজে বুঝে যায় খবর খুব একটা ভালো না।রণ এটাও ভেবে নেয় এখন ওর কি করণীয়।
সেদিন ঋষি আর জয়ির কাছে রণ আর একটা জিনিস ক্লিয়ার করে নিয়েছিল যদি একান্তই রণর সিদ্ধান্তই কায়েম থাকে তাহলেও রাই কোনো কিছুই জানবে না অপারেশনের আগে।পরে রাইকে সামলানোর পুরো দায়িত্ব রণজয় নিজে নেয়।
“মা আমি এটুকু বলতে পারি রাই মা ডাক শুনবে,কিন্তু বাকিটা সময় বলবে।আমি আর কিছু বলবো না।আর রাইয়ের জীবনের দাম আমার কাছে ঠিক কি সবাই সেটা জানে।শুধু মানসিক ভাবে না,শারীরিক ভাবেও ওর পক্ষে সারভাইভ করতে গেলে আমাদের সবার সাপোর্ট লাগবে।কিন্তু কোনোভাবে সার্জারির আগে ও কিছু যেন না জানে এটা তোমরা খেয়াল রেখো। ওকে আমরা বলবো ওর অপেন্ডিক্স অপারেশন করা দরকার।বাকিটা আমি সামলে নেব।”
রণর ভালোবাসা,ওর অসহায়তা বোঝার পরও জয়ি বা ঋষি খুশি হতে পারেনা ওর সিদ্ধান্তে।রাইকে রণ কিকরে সামলাবে কিছুই মাথায় আসেনা ওদের।
কিন্তু রণ শান্ত স্বভাবের পিছনে ওর জেদি মনটার কথা শুধু জয়ি আর ঋষি জানে,রাই ছাড়া।তাই কথা বিশেষ বাড়ায় না।তবে অপারেশন থিয়েটারে এবার রণকে এড়ানো সম্ভব না রাজ বুঝেই যায়।

ঋষির ফোন কেটে রণ যখন রেডি হতে ওয়াশরুমে ঢুকতে যাবে রাইয়ের কথায় থমকে দাঁড়ায়।যতই সামনে নিজেকে স্ট্রং দেখাক না বাস্তবে ও কতটা ভেঙে গেছে ওই শুধু জানে।ঋষির ফোন ওর বুকে এমনি কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল,এখন রাইয়ের ডাকে ভয় হয় ধরা পড়ে যাওয়ার।

-“তুমি হসপিটাল যাবে?”
-“হ্যাঁ।একটা এমার্জেন্সি এসেছে বাবা ফোন করেছিল”।
-“কখন ফিরবে?”
এতক্ষন পিছন ফিরে কথা বলছিল রণ,এবার ফিরে তাকায় রাইয়ের মুখের দিকে ওর করুন গলা শুনে।তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে ওর দিকে।
রাইয়ের একরাশ পিঠ ছাপানো চুল আগের কেমোর পর সব ঝরে গেছিল।আবার কিছুটা হলেও ছোট চুলের ঘনত্ব অল্প বাড়ছিল।সেগুলোর দিকে তাকিয়ে রণর বুক মুচড়ে ওঠে।কপালে এসে পরা সরু চুলের গোছা সরিয়ে রণ ঠোঁট ছোঁয়ায় রাইয়ের কপালে।
স্নেহের চিহ্ন গভীরভাবে এঁকে দুহাতে রাইয়ের মুখটা ধরে গাঢ় স্বরে বলে,”এই তো বাবু যাবো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবো।তুমি বেশি অত্যাচার করবে না।রেস্ট নিও।রমা পিসিকে দরকার হলেই ডাকবে,মম কিছুক্ষনের মধ্যেই এসে যাবে।তোমার তো পেইন তেমন নেই,জ্বর ও না।ইচ্ছা হলে নিচে ডাইনিং হলে গিয়ে টিভি দেখো।এখানেও তোমার ল্যাপটপ,আইপ্যাড সব আছে।শুধু হাসিখুশি থেকো,আমি ঠিক চলে আসব।”
রাই রণর হাতটা ধরে তাতে ঠোঁট ঠেকায়।এই দুদিন রণ ওকে ছেড়ে যাবেনা বলে ছুটি নিয়েছিল।আজ হসপিটাল যাওয়ার কথায় তাই রাইয়ের মন খারাপ হয়েছিল।কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়।মুখে হাসি এনে ঘাড় নেড়ে আশ্বস্ত করে রণ কে।
রণ রাইয়ের গালে আলতো হাত ছুঁইয়ে পিছন ঘুরে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢোকে।ওয়াশরুম লক করে দরজায় পিঠ ঠেকায়।চোখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া জলটা আর জোর করে আটকায় না,নিঃশব্দে ঝরে যায় দু ফোঁটা নোনতা জল।
নিজেকে শক্ত রাখার প্রানপন চেষ্টা করতে থাকা রণ জানুয়ারির ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে পরে শাওয়ারের ঠান্ডা জলের নীচে,মনের মধ্যে জ্বলতে থাকা কষ্টের আগুনটা ঠান্ডা করার ব্যর্থ চেষ্টা করে।

ক্রমশ…