মাই এক্স পর্ব-১৫

0
167

মাই এক্স (১৫তম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি

১৫
আজ ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলাম। যাকে বলে ‘ড্রিম কেম ট্রু’ টাইপ ব্যাপার।। ইউনিভার্সিটিতে যেন জয়েন করতে পারি সেজন্য কি খাটনিই না খেটেছিলাম একসময়। একটুর জন্য হয়নি। অনার্সে দুই মার্কের জন্য সেকেন্ড আর মাস্টার্সে থার্ড, এই রেজাল্ট নিয়ে যে ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করতে পারব, কখনও ভাবিনি।
আজকের এই দিনটার জন্য কাকে যে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। সুমন? কিছুটা তো অবশ্যই। ওর কাজ ছিল নিয়মিত স্বপ্ন দেখান, উৎসাহ দেয়া। কি অদ্ভুত ছিল দিনগুলো। আজ যখন আবার ইউনিভার্সিটির করিডোর ধরে হাঁটছিলাম, কানে শুধু সুমনের কথাগুলো বাজছিল, ‘ভালমত পড়, ফার্স্ট হতেই হবে। এরপরে একসাথে চাকরী করব।’ কখন যেন নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, ‘আমি ফার্স্টই হচ্ছি’।
ওর মাস্টার্সের রেজাল্ট তখন হব হব করছে। ওয়ারেস স্যার তখন ডিপার্ট্মেমেন্টাল হেড। একদিন সুমনের সাথে যখন উনার করিডোরে দেখা হয়, তখন উনি সুমনকে ‘কংগ্র্যাচুলেট’ ও করেন। তারপরও, অফিশিয়াল রেজাল্ট না হওয়া পর্যন্ত, কোন ভরসা নেই। সুমন অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, আমার মাস্টার্সের আগে ও বিয়ে করবে না। আমার পরীক্ষা শেষ হবে, এরপরে। শাসনও করে গেছে, ‘পরীক্ষার আগে প্রেম, বিয়ে এসব নিয়ে একদম আলাপ না’। সপ্তাহে একদিন ছিল প্রেমের জন্য বরাদ্দ। লং ড্রাইভ। গাড়ীতে না, রিক্সায়। দেন ঝন্টু রেস্তোরায়, কেবিনে বসে গল্প। অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম দিনটার জন্য।
দেন হঠাৎ আসল সেইদিন, জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। সুমন অ্যারেস্ট হল, ওর রুমে আর্মস পাওয়া গেল। ওর পার্টির এক ছেলে রাজসাক্ষী সাজল। জানাল সুমনই বিরোধী দলের এক কর্মীকে খুন করেছে। পড়াশোনা শিকায় উঠল। সুমনের কি হবে? আমিই বা কি করব? সারাটা ক্ষণ দুশ্চিন্তায় কাটতে লাগল।
সপ্তাহে একদিন, সুমনের সাথে দেখা করতে যেতাম। ও শান্ত স্বরে কেবল একটাই কথা বলত। ‘ফার্স্ট হওয়া চাই।’ঐ একটা কথাতেই কোথা থেকে যেন একরাশ সাহস ফিরে পেতাম। এমন হতাশার মাঝেও, পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
একদিন হঠাৎ সুমন বলে বসল, আর এখানে আসবে না। কারণ জানতে চেয়েছিলাম, কিছু বলেনি। দেখতে দেখতে বছর খানেক কেটে গেল। রিউমার শুরু হল, ওকে আর ছাড়বে না। এদিকে বাবা মা প্রথম দিকে সহানুভূতি দেখালেও পরের দিকে বিয়ে নিয়ে আমাকে অতিষ্ট করে তুললেন। তারপরো হয়তো চেষ্টা করতাম, বিয়ে পেছানোর। কিন্তু পারলাম না। শাহেদ এসে যায় আমার জীবনে। আই মিন শাহেদের সাথে কয়েকদিনের আলাপে ওকে বেশ ভাল লেগে যায়। সময়ও আসলে অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। অ্যান্ড দেন…সুমনকে বিট্রে করলাম।
বিয়েটা হয় মাস্টার্সের মাস ছয়েক আগে। শাহেদকে বলেওছিলাম, পরীক্ষার পরে বিয়ে করতে চাই। ও হেসে বলেছিল, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। বলেছিলাম পড়াশোনাটার বারোটা বাজবে। ও আশ্বাস দিল, তোমার মাস্টার্স শেষ করার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি। এই বিয়ের জন্য, তোমার পড়াশোনায় কোন বিঘ্ন ঘটবে না। প্রমিজ। তবে সেটাই আসল কারণ না, আমি নিজেও ব্যাপারটা চাইছিলাম। শাহেদের জন্য আমার ফিলিং তখন পছন্দ ছাড়িয়ে ভালবাসায় পরিণত হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছি। রিয়েলি নাইস একটা ছেলে।
এরপরে তো সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। নতুন বিয়ে, নতুন সংসার, সব মিলিয়ে পড়াশোনা হল, তবে সেভাবে না। আর ফার্স্ট হওয়া তো পুরোপুরি শিকেয় উঠল। ‘পাশ করতে পারলে হাজার শোকর’ টাইপ অবস্থা আমার তখন। অবশ্য পাশ করার পেছনে শাহেদের উৎসাহও একটা কারণ।
যাই হোক, পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করি আর রেজাল্টও খারাপ হয়নি। বাট ফার্স্ট হতে পারিনি, এবার থার্ড। তাই টিচার হওয়া হয়নি। ওটা অবশ্যে তখন আর আমার ড্রিম ছিলও না। শাহেদের জীবনে প্রবেশ করে যে আধিক্যের মাঝে পড়লাম, তাতে ড্রিম কোথায় যে কখন হারিয়ে গেল, নিজেই জানি না।
দেন দীর্ঘ দেড় বছর বই থেকে একেবারে দূরে। শাহেদ জানতে চেয়েছিল, চাকরী করতে চাই কি না। ওর জিজ্ঞাসায় অবশ্য উৎসাহ কম ফর্মালিটি বেশি ছিল। মনে হল, ও আসলে চায় না আমি চাকরী করি। আর তাছাড়া আমার নিজের ভেতরেও কেমন একটা আলসেমি ভর করেছিল। টিপিক্যাল গৃহিনীর মত, বাসায় টিভি দেখা আর বরের ফিরে আসবার ওয়েট করা, এসবেই কেমন অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।
এরপরে অনেকেই চাকরী করার কথা বললেও, কখনই গা করিনি। পত্রিকায় সার্কুলার দেখে অ্যাপ্লাই করার কথা ভাবিনি। ইচ্ছেও যেমন করেনি, তেমনি কেউ সেভাবে জোরও করেনি। একদিন ওয়ারেস স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল, উনি বলেছিলেন চলে আস ইউনিভার্সিটিতে। উনি আমাকে বেশ আদর করতেন। আমি ‘দেখি’ টাইপ একটা উত্তর দিয়ে চলে আসি। শাহেদকে বললাম। শুনে ও দেখলাম কেমন নাক শিঁটকাল। বলল, ‘টিচারের আর কত বেতন?’ চাকরী করতে চাইলে আমি যোগাড় করে দিচ্ছি। আমার অফিসেই লোক নেবে। ব্যাস, কিসসা খতম। আর ওপথে যাওয়া হয়নি।
সেই ঘটনার প্রায় দেড় বছর পরে আবার যে ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যাব, ভাবিনি। তবে চাকরীটার জন্য কাউকে যদি ক্রেডিট দিতে হয়, সেটা তিথিকে। সে ঘটনাটা ঘটে মাস দুয়েক আগে। ওদের কলেজে তখন দিন পনের হল জয়েন করেছি। সার্কুলারের খবরটা ও ই আমাকে দেয়। তিথি অ্যাপ্লাই করছে। খবরটা পেয়ে দুজনেই সোজা ওয়ারেস স্যারের সাথে দেখা করি। উনি উৎসাহে দিলেন। বললেন, অ্যাপ্লাই কর, দেখা যাক।

ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আসবার সময় উৎসাহে যখন আমি বেশ টগবগ করছি তখন তিথি বাঁকা হাসি দিল বলল ওসব পলিটিক্যাল জব। পার্টির সদস্য দেখে ঢোকাবে। আমাদের কারো হবে না। কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি। তখন তিথি পুরো গল্পটা বলল।

আসলে ওর বরের প্ল্যানিং ছিল, কমার্স ডিপার্টমেন্ট খুলে সেখানে তিথিকে লেকচারার হিসেবে নেবে। নিয়েওছিল। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। সেক্রেটারী সাহেব যখন বেশি ঘুষ চেয়ে বসলেন, তখন ওরা পড়ল সমস্যায়। এমন সময় শেলির বিয়েতে দেখা হয় সুমনের সাথে। কলেজের ফাইলটা ক্লিয়ার হচ্ছে না, কথাটা তখন ওরা সুমনকে বলে। সুমন এক ঝটকায় কাজটা করে দেয়। আর আশ্বাস দেয়, সরকারীও করে দেবে।

এরপরে যখন দেখে সুমন কাজটা না করে খালি ঘোরাচ্ছে, তখন তৃণার বর সুমনের সাথে দেখা করে। সুমন তখন ওকে বলে, টিচার হিসেবে আমাকে নিলে নাকি ও কাজটা করে দেবে। কথাটা জানতে পেরে কলেজ কমিটির সবাই সিদ্ধান্ত নেয়, আমাকে নেবে। যেহেতু পোষ্ট মাত্র একটা, তাই সিদ্ধান্ত হয় তিথি কলেজ থেকে রিজাইন করবে আর সেই ফাঁকা পোস্টে তখন আমাকে নিয়োগ দেয়া হবে। এসব ঘটনা আমাকে আগে জানায়নি। মিথ্যে বলেছিল। তিথি ভাল মতই জানে, একথা জানলে আমি কখনই জয়েন করতাম না। আর না জয়েন করলে সুমন ওদের কাজটা করে দিত না।
যাই হোক জানার পর আমি এক মুহুর্ত দেরী করি না। রিজাইন করি। তিথি আঁতকে ওঠে। আমার হাত চেপে ধরে রিকোয়েস্ট করে,
— আর কটা দিন। প্লিজ।
— কেন?
— সরকারীটা হয়ে যাক।
এই রিকোয়েষ্টের একটা কারণ আছে। সেক্রেটেরিয়েট থেকে লেটেস্ট নিউজ হচ্ছে, ওদের কলেজের ফাইলটা মুভ করা শুরু করেছে। অনেক টেবিল পার হয়ে এখন ফাইলটা প্রাইম মিনিষ্টারের টেবিলে আছে। আর সেটা একবার সই হয়ে গেলে আর কোন সমস্যা নেই। তখন সুমন চাইলেও আর ব্যাপারটা রিভার্স করতে পারবে না। তাই সে পর্যন্ত আমাকে থাকতে বলল। সময়টা কতদিন জানতে চাইলাম। জানাল প্রাইম মিনিষ্টারের সাইন হতে আর গেজেট হতে এখনও মাস তিনেক লাগবে।
ওর কথা শুনিনি। সুমনের কারণে আমার জব হয়েছে, কথাটা শুনেই গা রি রি করছিল। তিথি খুবই কাঁদছিল। হাত ধরে রিকোয়েস্টও করেছিল। কোন কথা শুনিনি। চলে এসেছিলাম।
এরপরে আর কোনদিন ঐ কলেজে যাইনি। বাসায়ই ছিলাম। সার্কুলার দেখে অবশ্য মাঝে মাঝে এদিক ওদিক কয়েকটা কলেজে অ্যাপ্লাইও করি। কাজ হয়নি। এরপরে একদিন আসে ইউনিভার্সিটির ইন্টারভিউ কার্ড। দেখে এক মুহুর্তের জন্য সুমনের কথা মনে হয়েছিল। নিজের ভাগ্যের ওপরই হাসলাম। আমার সেই ড্রিমের কাছেই আবার ফিরে এলাম, বাট অনেক পরে, অনেক পথ ঘুরে, অনেক অসহায় হয়ে।
ইউন্টারভিউতে গেলাম। খারাপ হল না, ভালোই হল। ওয়ারেস স্যারও বেশ ইম্প্রেসড মনে হল। উনি হেড, সর্বেসর্বা। উনি চাইলে, কেউ আর না বলবে না। যদিও বেশ কজন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট আছে। তবে সবাই ছেলে। কেবল আমি আর তিথি মেয়ে। বাট তিথির রেজাল্ট আমার চেয়ে খারাপ। তারপরও আমি আশাবাদী ছিলাম।
রেজাল্ট হল। আমি সিলেক্টেড। কেন হলাম, জানি না। আমার জেন্ডার হয়তো আমাকে হেল্প করেছে। ওয়ারেশ স্যার আমাকে স্নেহ করতেন, এটাও কারণ হতে পারে। কারণ যা ই হোক, সুমন অন্ততঃ না, এটাই সবচেয়ে বড় শান্তির ব্যাপার। মনে হল, নতুন ভাবে জীবন ফিরে পেলাম। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন তিথির কথা মনে হল। ভাবলাম ওকে খবরটা জানাই। ফোন দিলাম।
— কেমন আছিস?
— এই তো?
— কলেজ?
— চলছে।
— তুই জয়েন করেছিস?
— হ্যাঁ।
— গুড। শোন, ইউনিভার্সিটিতে আমার চাকরীটা হয়ে গেছে।
— তাই? কংগ্র্যাটস।
বেশ শুকনো কংগ্র্যাটস। বুঝলাম, এখনও মন খারাপ করে আছে। হয়তো কলেজের কাজটা হয়নি। জানতে চাইলাম
— আর তোদের কলেজের ফাইল?
— এগোচ্ছে। এখনও প্রাইম মিনিষ্টারের সই হয়নি।
গলায় হতাশা। একবার মনে হল, কথাটা বলেই ফেলি। তারপর নিজেকে সংযত করলাম। পুরোটা বলা যাবে না। শুধু জানাই
— ভয় পাস না। কাজটা হয়ে যাবে।
তিথি অবাক হয়ে জানতে চায়
— মানে?
উত্তর দিলাম না। লাইন কেটে দিলাম।
কারণ উত্তরটা শুধু আমি জানি। আর সেটা কাউকে বলা যাবে না। খবরটা হাইলি কনফিডেনশিয়াল।

চলবে