মানহা পর্ব-০২

0
225

#মানহা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_২
আমি আমার সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি আমার সন্তান কাউকে নিয়ে যেতে দিবোনা।
এই কথা শুনে আমি ঘুরে তাকাতেই আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে,বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে শুধু বলি,
কল্প!

কল্প এগিয়ে আসে আমাদের দিকে।
সবাই কল্পের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

_আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ওর মেয়ে যদি আপনার মেয়ে হয়,তাহলে আপনি আর মেঘা কি… (পাত্র)
_না না আপনি যা ভাবছেন তা নয়।
ও শুধু আমার মেয়ে।
আর ওর পালিত মেয়ে।

_মানহা আপনার মেয়ে মানে?
কি বলতে চাইছেন আপনি?(মেঘা)
_হ্যাঁ,ও আমারই মেয়ে।
আমিই ওকে সেদিন তোমাদের বাসায় রেখে গিয়েছিলাম।
_মানে কি এসবের?
_যা শুনছো,সত্যি এটাই।
মানহা আমারই মেয়ে।
আর আমি ওকে নিয়ে যেতে এসেছি।
ওকে ডাকো,আমি ওকে নিয়ে যাবো আমার সঙ্গে করে।
_এই যে মিঃ শুনুন,মানহাকে আমি কোথাও যেতে দিবোনা।
ওকে আমি বড় করেছি মায়ের আদর দিয়ে।
আজ এত দিন পর হুট করে এসে আবদার করলেই মানহা আপনার মেয়ে হয়ে যাবে?
তাছাড়া যদি আপনার মেয়ে হয়েও থাকে,তবে সেদিন অব্দিই ছিলো।
যেইদিন আপনি ওকে আমাদের গেইটের সামনে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন।

সেদিনের পর থেকে আপনার কোন হক নেই মানহার উপর।

_ভাইয়া এসব কি হচ্ছে?আমরা কি কোন সিনেমা দেখতে এসেছি এখানে?(পাত্রের ছোট ভাই)

_মেঘা,বসো তুমি এখানে।
যেহেতু মানহার বাবা এসে গেছে ওকে নিতে,তাহলে তো আর তোমার সাধ্য নেই ওকে আটকানোর।বা ওকে বিয়ে করে সাথে নিয়ে যাবার।
বিয়েটা হয়ে যাক,তারপর যা করার করছি। (আব্বু)

_এখন তো তোমার আর কোন সমস্যা নেই তাইনা?আর আমারো কোন সমস্যা নেই।
যার মেয়ে সে নিয়ে যাবে।
সো আমাদের ঝামেলা করে লাভ নেই।
বসো।কাজী সাহেব বিয়ের কার্যক্রম শুরু করুন আপনি।(পাত্র)

_আপনি কি সত্যি সত্যি মানহার জন্মদাতা পিতা?
_হ্যাঁ।
_আপনি কি সত্যি সত্যি ওকে নিয়ে যেতে এসেছেন?
_হ্যাঁ।
_কিন্তু আমি যে ওকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।
_তোমার বিয়ে মেঘা।আর তোমার হবু বর ও মানহাকে নিবেনা তোমাদের সাথে।
আর আমিও ওকে দিবোনা তার কাছে।
তাই ঝামেলা বাড়িওনা,বিয়ে টা করে নাও।
সামনে তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

এত ক্ষণে আম্মুও মানহাকে নিয়ে স্টেজের এখানে চলে আসে।
মানহা আম্মুর কোল থেকে নেমে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসে।আর আমাকে জড়িয়ে ধরে।

কল্প মানহার কাছে এসে ওর হাত ধরে বসে মানহাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।চু মু খায়।

আম্মু আমাকে বলে,কি হচ্ছে এখানে?
আমি উত্তর দিলাম,
_আম্মু উনি মানহার বাবা।
মানহাকে নিয়ে যেতে এসেছেন।

কল্প মানহাকে কোলে তুলে নেয়।

_আপনাদের কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
আপনারা আমার মা ম রা মেয়েটাকে অনেক আদর যত্নে রেখেছেন,বড় করে তুলেছেন।
_মা মরা মেয়ে মানে?
_হ্যাঁ ওর মা ওর জন্মের সময় এই পৃথিবী ছে ড়ে চলে গেছে।
আর আমার পক্ষে অবুঝ বাচ্চাটাকে একা একা লালন পালন করা সম্ভব হচ্ছিলোনা।
তাছাড়া আমার বাইরে যাবার সময়ও হয়ে গিয়েছিলো।তাই আমি ওকে তোমাদের কাছে রেখে যাই।
আমি জানি তোমরা ওকে পরম মায়ায় আদর যত্নে রাখবে।বিশেষ করে তুমি।

যাইহোক, আমি মানহাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি একবারে চলে এসেছি দেশে।এবার আমার মেয়েকে নিয়ে আমি আমার সংসার সাজাবো।
সুখী হও তুমি।
আমার দোয়া থাকবে।

_কিন্তু আমি যে মানহাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।
_তাহলে চলো আমার সাথে।
যাবা?

তখনই আমার বুকের ভেতর আচমকা এক ঝ ড় বয়ে যায়।
আমি ফিরে যাই আমার সেই অতীতে।

কলেজের প্রথম দিন কলেজের গেইট দিয়ে কলেজ মাঠে ঢুকতেই দেখি একটা ছেলে দৌড়ে এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ছেলেটার দিকে।

কি অদ্ভুত সুন্দর চোখ।
কি সুন্দর হাসি মাশাআল্লাহ!

ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ছেলেটা একটা গোলাপ ফুল আমার সামনে ধরে বলে,

তুমি কি আমার সাথে এক সাথে বসে সারাজীবন গোপাল ভাড় দেখবে?আমার কিন্তু সি রিয়াল একদম পছন্দ না।
রাজি থাকলে ফুল টা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করো।

_পাগ ল নাকি আপনি ধ্যাত।

এই কথা বলেই আমি সেখান থেকে হাসতে হাসতে চলে আসি।

আর তখনই ছেলেটার বন্ধু বান্ধব সবাই হাসতে হাসতে দৌড়ে ওর কাছে চলে আসে।

আর বলতে থাকে,
_হেরে গেলি তো।
কথা ছিলো,যেই মেয়ে এবার গেইট দিয়ে ঢু কবে তাকে প্রোপোজ করতে হবে।
আর যদি সে এক্সেপ্ট করে,তাহলে তোকে আমরা খাওয়াবো।
আর যদি এক্সেপ্ট না করে,তাহলে তুই আমাদের খাওয়াবি।
হেরে গেছিস,এবার চল রেস্টুরেন্টে, খাওয়াবি আমাদের।

_মেয়েটাকে তোদের কথায় প্রোপোজ করলেও,মেয়েটাকে সত্যি সত্যি আমার ভালো লেগেছে রে।
চল আমি সেই খুশিতেই খাওয়াবো তোদের।

এরপর থেকে ছেলেটা আমাকে ফলো করতে শুরু করে।
সে আমার ক্লাসমেট,নাম কল্প।
ক্লাসে যত ক্ষণ সময় থাকতো,চোখ যেন তার আমার দিকেই থাকতো।

এভাবেই চোখাচোখিতে চলে যায় প্রায় ছয় মাস।
যদিও আমারও বিষয় টা ভালোই লাগে।
হঠাৎ অনেক গুলো দিন হয়ে যায়,কল্প কলেজে আসেনা।
তখন আমার কেমন যেন অনুভব হয় ওর জন্য।
আমি ওর বন্ধুদের জিজ্ঞেস করি কল্প আসেনা কেন কলেজে।

ওরা বলে,কল্পের খুব জ্বর।
তাই আসেনা।
আমি ওদের একজনের কাছ থেকে কল্পর ফোন নাম্বার নিয়ে ওকে কল দেই।

_হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
কে বলছেন?
_আ আ আমি বলছি।
_আমি কে?
_আমি মেঘা।
_ওহ তুমিই?
_হুম।
কেমন আছো?
_এই তো আলহামদুলিল্লাহ।
_জ্বর কি কমেছে?ডাক্তার দেখিয়েছো?
_হুম।
_ওষুধ গুলো খেও ঠিক মত।
_আচ্ছা।
_কাল একটু আসবে কলেজে?
_কেন?
_কাল আসলেই বলবো।
_আচ্ছা আসবো।
_রাখছি তাহলে।
_ভালো থেকো।
_তুমিও।

পরের দিন কল্প কলেজে আসে।
_কেমন আছো?
জ্বর কমেছে?
_হুম একটু।
এবার বলো,কি জন্য আসতে বলেছো।
_ক্লাসের বাইরে গিয়ে বলি?
_চলো।

কল্প আর আমি ক্লাস থেকে বেড়িয়ে আসি।
কলেজ মাঠে গিয়ে একটা গাছের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।

তারপর আমার ব্যাগ থেকে কত্ত গুলো ফুল বের করে ওর সামনে ধরে বলি,

_আমার তোমাকে না দেখলে ভালো লাগেনা।
তোমাকে ছাড়া কেমন যেন বুকের ভেতর টা শূন্য শূন্য লাগে।
তুমি কি সারাজীবন আমার চোখের সামনে থাকবে?

_কল্প ফুল গুলো হাতে নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলে,থাকবো।

সেদিন থেকেই শুরু হয় আমাদের ভালবাসার নতুন অধ্যায়।
ক্লাসের ফাঁকেফাঁকে চলছে আমাদের ভালবাসা।

দেখতে দেখতে চলে যায় আমাদের ভালবাসার তিন তিন টা বছর।

আমরা ডিসিশন নেই অনার্স টা কমপ্লিট করেই আমরা পরিবারকে জানিয়ে বিয়ে করে নেবো।

মাস্টার্স টা না হয় বিয়ের পরে এক সাথেই করবো।

এই তিন বছরে আমরা দু চোখ ভরে স্বপ্ন দেখি।
কল্প আমাকে ভীষণ রকম ভালবাসে।
আর আমিও কল্পকে।
দুজন দুজকে ছাড়া কিছুই কল্পনা করতে পারিনা।

হঠাৎ একদিন কল্প আমাকে ফোন দিয়ে বলে,
মেঘা আমি গ্রামে যাচ্ছি।
আব্বু নাকি অসুস্থ।
আর জানোই তো এই দুনিয়ায় বাবা ছাড়া আমার কেউ নেই।

_মন খারাপ করোনা।
আব্বু সুস্থ হলে চলে এসো কেমন?
_তুমি নিজের খেয়াল নিও।
ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করো।আর আমার জন্য কোন চিন্তা করোনা।জানোই তো গ্রামে গেলে ঠিকমত তেমন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না।
আমিই তোমাকে সময় করে ফোন দিবো।
রাখছি তাহলে।

_আচ্ছা,সাবধানে যেও তুমি।
আর শোনো,
ভালবাসি।
_ভালবাসি।

কল্প গ্রামে চলে যায়.

এক দিন দুই দিন তিন দিন কল্পর কোন ফোন আসেনা।
আমি ট্রাই করি,ওর নাম্বারে কল যায়না।
আমি চিন্তায় পা গল হয়ে যাই।
হঠাৎ একদিন ফোন করে বলে,
মেঘা বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।
উনার বন্ধুর মেয়ে।
এই মেয়েকে বিয়ে না করলে তিনি নাকি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিবেন।
কি যে এক প্যা রায় আছি।

_কল্প!কি বলছো তুমি এসব?
মাথা ঠিক আছে তোমার?
তুমি আমার কথা তোমার বাবাকে জানাওনি?

_জানিয়েছি,কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
সে তার কথায় অটল।
সে নাকি তার বন্ধুকে কথা দিয়েছেন।
এখন সে দুদিন হয় না খেয়ে বসে আছেন।

_কল্প আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।
আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।

_আমিও পারবোনা।
_এখন কি করবো তাহলে আমরা?
_জানিনা।
_আমি কি আমার বাসায় তোমার কথা জানাবো?
_জানিয়েই বা কি হবে?
আমার বাবাই তো রাজি না।
_তাহলে তুমি আমায় তোমার বাসায় নিয়ে যাও।
_মানে?
_মানে আবার কি,আমি তোমার বাসায় গিয়ে উঠলে বাবা আর আমাকে বাসা থেকে বের করে দিতে পারবেন না।
_আচ্ছা ঠিক আছে।
আজ বিকেলে তুমি তাহলে রেডি হয়ে বাস স্ট্যান্ডে থেকো।
আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।
_আচ্ছা ঠিক আছে।

আমি সেদিন বাসায় একটা চিরকুট রেখে চলে যাই বাস স্ট্যান্ডে।

চিরকুটে লিখে রেখে যাই,

আম্মু আমি একটা ছেলেকে ভালবাসি।
আমি ওদের বাসায় ওর কাছে যাচ্ছি।
তোমরা আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করোনা।

আমি সেদিন সব চেয়ে বড় ভুল করি আমার পরিবারকে সামনাসামনি সব কিছু খুলে না বলে।
তবে আমি বললেও আমার ধারণা তারা আমাকে কখনোই যেতে দিতেন না।

আমি বিকেলে পৌঁছে গিয়ে ওখানে অপেক্ষা করতে থাকি।
ঘন্টার পর ঘন্টা।কল্প আসেনা।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে,কল্পর কোন খবর নেই।
আমি ওর নাম্বারে বার বার ট্রাই করি।
কল যায়না।
রাত হয়ে যায়।বিকেল থেকে সন্ধ্যা,সন্ধ্যা থেকে রাত।কল্পর কোন খবর নেই।আমি একা অ সহায় একটা মেয়ে সেই বিকেল থেকে দাঁড়িয়েই আছি।
রাত তখন প্রায় ১ টা।কল্প আমাকে ফোন দিয়ে বলে,মেঘা আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।আমি বিয়ে করে ফেলেছি।
ওর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিলো,কেউ আমার বুক থেকে আমার প্রাণটা টেনে বের করে নিয়ে গেলো।

আমি শুধু কল্পকে বললাম,সুখী হও।
আল্লাহ হাফেজ।

আমি বাসায় ফিরে যাই।
কিন্তু ততক্ষণে আমার বাড়ীর আশেপাশে জানাজানি হয়ে গেছে আমি পালিয়ে গেছি কোন এক ছেলের সাথে।
আর এই কথা সবার কাছে প্রচার করেছে আমাদের বাসার কাজের লোক।
আম্মু চিরকুট পেয়ে কান্না করতে করতে আব্বুকে বলে,আর সেই কথা শুনে এলাকা রটিয়ে দেয় সেই কাজের মেয়ে।
এরপর থেকে আমি আর এলাকায় মুখ দেখাতে পারতাম না।
কলেজে যেতে পারতাম না।
লোকের নানান বি ষাক্ত কথায়,
কেউ বলতো,কিরে তুই নাকি পাবলিয়ে গিয়েছিলি?
তো চলে আসলি কেন?

কেউ বলতো,কিরে তোকে কি রাখেনি?
আবার কেউ বলতো,কিরে তোকে কি খে য়ে ছেড়ে দিয়েছে?

আবার কেউ আবড় চোখে তাকিয়ে টি টকারি দিয়ে বলতো,জানিস এই মেয়ে না কার সাথে যেন ভে গে গিয়েছিলো।
পরে আবার বাসায় ফেরত এসেছে।
কাজ শেষে রাখেনি আর,বুঝিস নি।

এগুলো শুনতে শুনতে আমি যেন পা গল হয়ে যাচ্ছিলাম।
একেতো প্রিয় মানুষ হারানোর শো ক।
অন্য দিকে মানুষের নানান কটু কথা।
কি করবো আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না।
ম রতেও পারছিলাম না,কারণ আম্মু আব্বু সব সময় আমার পাশে ছিলো।

এত গুলো বছর পর আমি আবার সেই মানুষটার সামনে,
যেই মানুষ টা একদিন মাঝ রাস্তায় আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলো।আমার কথা একটুও ভাবেনি।

আমার কল্পনায় ছেদ পড়লো পাত্রের ডাকে,

_মেঘা,দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
বসো,কাজী সাহেব চলে যাবেন।

একদিকে আম্মু আব্বু আর পাত্র পক্ষ।
অন্য দিকে কল্প আর মানহা।
আমি এখন কোন দিকে যাবো?

চলবে,