মায়ার বাঁধন পর্ব-০৬

0
328

#মায়ার_বাঁধন🍂
০৬.
মুখমন্ডল জুড়ে ঠান্ডা পানির সংস্পর্শ পেয়ে ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠল তুরান। সারা মুখে হাত বুলিয়ে হাতটা সামনে এনে ধরল। হাতে স্পষ্ট পানি লেগে আছে। কৌতুহলে চোখ ওপরে তুলতেই সম্মুখে নীরাকে গ্লাস হাতে আবিষ্কার করল। ঘটনা কী ঘটেছে বুঝতে দেড়ি হলো না তার। মুহূর্তে তার কৌতুহল কেটে তেজ বেড়িয়ে এলো। ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলল,

-“এসবের মানে কী? তুমি আমার মুখে পানি মে’রে’ছ কেন?”

নীরার সাবলীল উত্তর,
-“তো কী করতাম? যেভাবে ম’রা’র মতো পড়ে ছিলেন মাইক এনাউন্স করেও তো জাগানো যেত না। তাই এই পন্থা।”

তুরান নিজের চুল দু-হাতে খামচে ধরে। পরপরই ছেড়ে দিয়ে দাঁতে দাত চেপে নীরার দিকে তেড়ে আসতে আসতেই বলে,
-“তবে রে…. ”

নীরা কফির মগটা কোনো রকমে টি-টেবিলের ওপর রেখে দেয় দৌড়। ব্যস,ওকে আর পায় কে। তুরান দরজা অব্দি ছুটে এসে থেমে যায়। আর বেড়লে চলবে না। নীরা এতক্ষণে মায়ের রুমে ঢুকে গেছে। এখন গেলে বকাটা নির্ঘাত তুরানই খাবে। অগত্যা খিটমিট করতে করতে তুরান কফির মগ হাতে নিল। বিড়বিড়িয়ে বলল,

-“একবার সুযোগ পাই মজা দেখিয়ে তবে ছাড়ব।”

——–🍂
ঠিক সাড়ে ন’টায় নাস্তার টেবিলে সকলের উপস্থিতি বিদ্যমান। শুধুমাত্র রিনা ছাড়া। বর্তমানে তরিকও এখানে নেই। সে দু বছর যাবৎ ব্যবসায়িক কাজে ডুবাইতে আছে। দেশে ফিরতে আরও এক বছর লাগবে। মূলত তরিক নেই বলেই রিনার এত অবাধ্যতা।

রোজকার মতো আলহাম চৌধুরী শুরুতে ডাইনিংয়ে আসে। তাকে নাস্তা সার্ভ করে দেয় নীরা। তিনি বেশ খুশি হন। পরপরই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে তুরান। তার চোখে মুখে ক্রোধ স্পষ্ট। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীরার পানে চেয়ে। নীরা তুরানকে দেখা মাত্র অন্য দিক ফিরে মুখ টিপে হাসল। পরপরই স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়ে গেল যেন সে কিছুই জানে না এমন। তুরান একেবারে ফিটফাট হয়ে এসেছে। পড়নে নেভি ব্লু কালার শার্ট, কালো প্যান্ট। শার্টের হাতা কনুই অব্দি ফ্লোড করা। চুলগুলো গোছানো। বা হাতের কব্জিতে ঝুলছে সিলভার কালার ঘড়ি। শরীর থেকে ভেসে আসছে মোহনীয় পারফিউম স্মেল। নীরা কিঞ্চিৎ থমকায় তবে তা একান্তে। ততক্ষণে জাহানারা চৌধুরী নীরাকে বলে ওঠেন,

-“তুই ও বসে পড়। একসঙ্গে খেয়ে নে।”

-“না মা থাক। আমি তোমার সঙ্গে খাব।”

জাহানারা চৌধুরী শুনতে নারাজ। তিনি জোর করে বসিয়ে দিলেন নীরাকে। নীরাও কম কিসে সে ও শ্বাশুড়ি মাকে টেনে বসিয়ে নিল। ব্যস সকলে একত্রে নাস্তাটা শেষ করল। আলহাম চৌধুরী অর্ধাঙ্গিনী আর ছেলের বউয়ের কান্ড দেখে মনে মনে শান্তি অনুভব করলেন। প্রশান্ত হলো তার হৃদয়।

তুরান খুব ব্যস্ত ভঙ্গিমায় খেয়ে নিল। পরপরই উঠে চলে যেতে নিলে আলহাম চৌধুরী মুখ খুলেন। বলেন,

-“এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? এ্যানি প্রবলেম?”

তুরান পায়ে স্নিকার্স পড়তে পড়তে উত্তরে বলল,
-“একমাস বাদে নির্বাচন শুরু। আমার প্রতিপক্ষ কে জানোই তো। খুব একটা সহজ হবে না সফলতা অর্জন করা। ভীষণ চাপ। আগে আগে পৌঁছতে হবে।”

আলহাম চৌধুরীর কন্ঠ গম্ভীর হলো। বলল,
-“কী পাও এসব করে?”

-“শান্তি।”

তুরান দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেল। হাঁটল নাকি ছুটল বোঝা দায়। আলহাম চৌধুরী দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। এসব রাজনীতি তার পছন্দ নয়। অহেতুক ঝুট-ঝামেলা। কিন্তু তার কপাল খারাপ। বড় ছেলেটা তার মতো হলেও ছোট ছেলেটা হয়েছে একেবারে ভিন্ন। তার চিন্তাধারা, আচার -আচরণ সবকিছুতেই ভিন্নতা। জাহানারা চৌধুরী কিছু বলতে নিয়েছিল কিন্তু তার আগেই তুরান উধাও। তুরান চলে যেতেই নীরা প্রশ্ন করল,

-“কীসের নির্বাচন?”

জাহানারা চৌধুরী উত্তরে বললেন,
-“ভার্সিটিতে ভিপি নির্বাচন।”

-“ওহ,আচ্ছা।”

জাহানারা চৌধুরী সহসা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আলহাম চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বললেন,
-“নীরার ভর্তির ডেট তো শেষ হতে চলল। ভেবেছিলাম তুরানের সঙ্গেই ওকে পাঠিয়ে দিব কিন্তু দেখো তোমার বাঁ’দ’র ছেলের অবস্থা। কোনো কথাই বলতে দিল না।”

আলহাম চৌধুরী আস্বস্ত করলেন। বললেন,
-“আহা,তুমি চিন্তা করো না। নীরাকে আমি সঙ্গে করে ভার্সিটিতে ভর্তির কার্যক্রম শেষ করে আসব।”

নীরার চোখে মুখে ছড়াল আনন্দ। মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবতীদের কাতারে ফেলল। এমন একটা পরিবার পাওয়ার আনন্দে। তবে আফসোস একটা তুরানটা যদি একটু বুঝত তাকে……।

——–🍂
দাপটের সঙ্গে বাইক হাঁকিয়ে ভার্সিটির গেইট দিয়ে প্রবেশ করল তুরান৷ গেইটের মধ্যে দিয়ে ঢুকে ডান সাইড বরাবর পার্কিং লট। সেখানে বাইক পার্ক করে আঙুলের ফাঁকে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে ভেতরে ঢুকতে লাগল সে। সচরাচর গাড়ি করে ভার্সিটিতে আসে না সে। সর্বদা এই বাইকটি সঙ্গে থাকে।

তুরানকে নজরে পড়তেই ছুটে এলো একদল তরুণ প্রজন্ম। ভাই ভাই করে হা’ম’লে পড়ল। সকলের চেঁচামেচিতে তুরান ঠিকভাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই হাত উঁচিয়ে সকলের উদ্দেশ্য বলল,

-“স্টপ,স্টপ, স্টপ…. সকলে একসঙ্গে চেঁচালে আমি বুঝব কী করে সমস্যাটা কী? একেকজন করে বলো। তার আগে ক্যান্টিনের পেছন বরাবর চলো সবাই। ওখানেই আলোচনা হবে।”

তুরানের সঙ্গে সহমত সবাই। সকলে হইহই করে এগিয়ে গেল ক্যান্টিনের পেছনে। সুবিশাল বকুল তলা। তার নিচে জড়ো হয়ে আছে প্রায় শতাধিক তরুণ। তাদের মধ্য মণি তুরান। এরা সবাই তুরানের দলের ছেলেপেলে। বকুল তলার ঘেরাও করা সিমেন্টের স্তুপ বিশিষ্ট স্থানে আয়েশী ভঙ্গিতে বসল তুরান। সামনে থাকা একটি ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,

-“অয়ন,তুই শুরু কর। ডিটেইলসে বল। বাকিরা চুপ থাকবে একদম।”

অয়ন ছেলেটা তুরানের একেবারে কাছের একজন। অয়নের থেকে জুনিয়র তবে সবসময় ছায়ার মতো লেগে থাকে। এক কথায় ছায়াসঙ্গী বলা চলে। তুরানের অনুমতি পেয়ে অয়ন প্রস্তুত হয়ে নিল৷ গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করল,

-“নতুন বছরের একমাস পেড়িয়ে গেছে। এখন অব্দি ফ্রেশার’স পার্টির কোনো নাম গন্ধ নেই। এটা কিন্তু আমাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।”

তুরান বিচক্ষণের ন্যায় বলল,
-“ঝেরে কাশ।”

অয়ন এবারে নড়েচড়ে উঠল। আশেপাশে সকলকে একপল দেখে নিল। সকলে ওর দিকে অধির আগ্রহে তাকিয়ে। চোখ দিয়ে ইশারা করছে কথাটা ক্লিয়ার করতে।

-“আসলে ভাই, আমরা যদি এই কথাটা নিয়ে প্রিন্সিপালের নিকট যাই। আর সকল উদ্যোগ এবং দ্বায়িত্ব আমাদের কাঁধে তুলে নেই তাহলে আমাদের জন্য এটা অনেকটা ক্রেডিট বয়ে আনবে। নির্বাচনের আগে এটা একটা মোক্ষম সুযোগ বিপক্ষীয় দলকে কাবু করার। এতে করে প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে নবীন ছাত্র-ছাত্রীদের ঝোঁক আমাদের ওপরেই পড়বে।”

অয়নের সঙ্গে একে একে সকলে সায় দিল। হৈ হৈ করে জানাতে লাগল তাদের মতামত। তুরান সকলের কথাই শুনল। বিজ্ঞদের মতো মাথা দুলিয়ে বলল,

-“হুম, এটা নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা হবে ক্লাবে। ভার্সিটি শেষে সকলে ক্লাবে উপস্থিত থাকবে।”

কথা শেষে তুরান তার নিত্য সঙ্গী অয়ন,ফয়সাল,রাহান ও রিফাতকে নিয়ে চলে গেল ফার্স্ট ইয়ার ডিসিপ্লিনে। কিছু করার আগে শিক্ষার্থীদের মতামত জেনে নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। যাওয়ার আগে বাকি সকলকে বলে গেল নিজ নিজ ডিসিপ্লিনে চলে যেতে। একে একে ওরা প্রত্যেকটা ডিসিপ্লিনে যাবে মতামত চাইতে।

সকলে চলে গেল। সদা জনগণে পরিপূর্ণ স্থানটি শূন্য হয়ে গেল। তখনই বকুল গাছের পেছনে আড়াল হতে বেড়িয়ে এলো তিনজন তরুণী।

চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি