মায়ার বাঁধন পর্ব-০৭

0
328

#মায়ার_বাঁধন🍂
০৭.
বকুল তলার যে স্থানটায় তুরান বসে ছিল ঠিক সে স্থানে গিয়ে প্রশান্তিময় ভঙ্গিতে ধপ করে বসে পড়ল এক অতশী।চোখ জোড়া বন্ধ করে হাত দুটো প্রসারিত করে বলল,

-“আহা! মেরি জানেমান এতক্ষণ এখানেই ছিল। ইস এখনো লেগে আছে তার পারফিউমের স্মেল। মনে হচ্ছে আমি তার কোলে চেপে আছি।”

নিজের বলা শেষোক্ত বাক্যে নিজেই লজ্জা পেয়ে বসল সে। দু-হাতে চেপে আড়াল করতে চাইল নিজের লালিত মুখশ্রী। কিন্তু তা হতে দিল না তার সঙ্গীরা। দু’জন দুপাশে এসে বসে পড়ল। একজন তো তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিতে দিতে বলল,

-“স্বর্গ থেকে নেমে আয় বইন আমার। নয়তো কখন দেখবি পা পিছলে পড়ে গেছিস।”

অপর পার্শের তরুণীটিও সহমত পোষণ করল। বলল,

-“হ্যাঁ ঠিকই তো। বেশি আঘাত পাবার আগে ফিরে আসাই ভালো।”

দুই বান্ধবীর কথায় চটে গেল অতশী। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,

-“একদম বাজে বকবি না তোরা। সে আমার একান্তই আমার। একদিন দেখবি আমার এই স্বপ্ন ঠিক বাস্তবায়ন হবে। হবেই।”

অপরদিকে সীমা, রুহি দুজনেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তাদের মনে একটাই চিন্তা, “কী জানি কী আছে মেয়েটার কপালে?”

——-🍂
জোরপূর্বক বিয়ে হওয়ায় দরুন নিজের বিয়ের কথা বেমালুম চেপে গেছে তুরান। কাউকেই এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি। যে বিয়ে সে নিজেই মানতে পারছে না তা অন্যদের বলে কী হবে?

পুরো ভার্সিটির প্রতিটি ডিসিপ্লিনে গিয়ে প্রত্যেকের থেকে মতামত জেনে এসেছে তুরান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। অতঃপর চলে গেছে ক্লাবে। বাকি কাজ গুলো সেখান থেকেই সম্পূর্ণ করতে হবে। তারপর প্রিন্সিপালের নিকট একেবারে পুরো প্রস্তুতি সমেত পৌঁছবে।

এদিকে তুরান যখন ক্লাবে রিফাত,রাহান, অয়ন ও ফয়সাল কে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত তখনই সেখানে উপস্থিত হয় আরেক আপদ। মেয়েটির নাম জেরিনা। সংক্ষিপ্ত করে জেরি। থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট সে। তুরান বলতে অ’জ্ঞা’ন। বাবা-মায়ের আদরের দুলালী। বাবা পুলিশ কমিশনার তাই দাপট টা একটু বেশিই দেখায়। সেই সঙ্গে চি’বি’য়ে খা’য় তুরানের মাথা। জেরিকে দেখেই তুরানের মেজাজ সপ্তম আকাশ ছুলো। দাঁতে দাঁত পিষতে শুরু করল। বাকিরাও বিরক্ত। মিটমিটিয়ে হাসছে শুধু অয়ন আর রিফাত। জেরির তুরানকে জ্বা’লাতন ওরা বেশ ভালোই ইনজয় করে। ওদের এনজয়মেন্টকে দ্বিগুণ করে তুলতে সহায়তা করল জেরি। ছুট্ট এসে তুরানের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। ন্যাকা কন্ঠে বলল,

-“তুমি এই দুটো দিন কোথায় ছিলে বেইবি। আমি কতটা মিস করেছি তোমায় জানো?”

তুরান এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল জেরিকে। খিটিমিটি উত্তর দিল,
-“জা’হা’ন্না’মে ছিলাম।”

জেরি গাল ফোলাল। অভিমানী কন্ঠে বলল,
-“এমন করে বলছ কেন বেইবি। আমি কিন্তু এবার কেঁদে ফেলব।”

রাগে তুরানের মাথা ফেটে যাওয়ার জোগার। একহাতে চুল খামচে ধরে বলল,
-“এভাবে সমানে বেইবি বেইবি করে কী প্রমাণ করতে চাইছ তুমি আমার আম্মা আর আমি ফিডার খাওয়া বাচ্চা?”

তুরানের কথায় উপস্থিত সকলে উচ্চ লেভেলে হেসে উঠল। জেরি কাচুমাচু ভঙ্গিতে বিড়বিড় করল, “নাউজুবিল্লাহ।” কিন্তু প্রকাশ্যে বলল,

-“রেগে যাচ্ছ কেন এটা ট্রেন্ড।”

-“ট্রেন্ড-ফ্রেন্ড যাই হোক এসব ন্যাকামি আমার সঙ্গে করবে না। আর খব’র্দার বলছি এভাবে হুটহাট গায়ে পড়বে না৷ তাহলে কিন্তু মে’রে বু’ড়িগ’ঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আসব। দেখব তোমার কমিশনার বাপ কী করে তখন।”

তুরান চেয়ারে এক লাথি মে’রে ক্লাব ছেড়ে চলে গেল। ওদের চারজনকে বলে গেল বিকেলে সকলে উপস্থিত হওয়ার পর ওকে কল করতে। জেরি তখনও দাড়িয়ে। কিঞ্চিৎ ভিত মুখে। তুরানের কথা গুলো তার মনে প্রভাব ফেলেছে। হয়তো ভয় পাচ্ছে নয়তো অভিমান।

——-🍂
শুভ্র রঙা সুতির সালোয়ার কামিজে নিজেকে আবৃত করে নিল নীরা। বিয়ের পর আজকেই প্রথম সালোয়ার কামিজ পড়েছে। এবারে একটু স্বস্তি বোধ করছে। শাড়ি পড়ায় অভ্যস্ত না হওয়ায় এই দুদিন বেশ হিমশিম অবস্থা ছিল। আজ জাহানারা চৌধুরী বলে দিয়েছে ওর যদি শাড়িতে অসুবিধে হয় তবে সালোয়ার কামিজ পড়তে। এভাবেই এখনকার বউরা সালোয়ার কামিজই বেশি পরে। নীরা খুব শান্তি পেয়েছে এই সিদ্ধান্তে। তাই তো ঝটপট সাদা সালোয়ার কামিজ পড়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছে। এরপরই আলহাম চৌধুরীর সঙ্গে ভার্সিটিতে এডমিশন নিতে যাবে।

মায়াবী চক্ষু জোড়ায় সূক্ষ্ম কাজলের টান। গোলাপ রাঙা ওষ্ঠ জোড়ায় হালকা লিপস্টিকের ছোঁয়া। কোমর অব্ধি চুলগুলো বিনুনিতে গাঁথা। হাতের কব্জিতে লেডিস ঘড়ি। অন্যটাতে ব্রেসলেট। কানে স্টোনের ছোট্ট দুল। নাকে ছোট্ট নাকফুল। পারফেক্ট মায়াবিনী। ডাগর ডাগর অক্ষি পালক ঝাপটে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যে।

জাহানারা চৌধুরী শুরুতেই বললেন,”মাশাল্লাহ। একেবারে অপ্সরা লাগছে।” নীরা লজ্জা পেল। মাথা নুয়িয়ে ফেলল। জাহানারা চৌধুরী মুচকি হাসলেন। আলহাম চৌধুরীও প্রশংসা করলেন। অতঃপর নীরাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

——🍂
ভার্সিটির পাশেই এক উন্নত মানের চায়ের দোকানে চা পান করছে তুরান। চোখে মুখে তার বিষন্নতা। জেরির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় ভীষণ ভাবে আপসেট সে। এর আগেও তো জেরি এমন পাগলামো করেছে কই তখন তো সে এতটা রিয়েক্ট করেনি। ধমকে বুঝিয়েছে। কিন্তু আজ জেরি গায়ে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরে চরম অস্বস্তি ভর করেছিল। কে এমম হলো? সে এখন বিবাহিত বলে? জেরির ছোঁয়ায় তার সর্বাঙ্গে কাটা দেয়৷ মনে হয় শরীরটা বোধহয় অপবিত্র হয়ে গেল। আসল কথা জেরি ছুতেই তুরানের মানসপটে নীরার সুশ্রী, সুদর্শনা মুখশ্রীটি ভেসে উঠল। ভেতর থেকে কেমন নড়বড়ে হয়ে পড়ল সে।

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে সে। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় অযাচিত মুখ। নেহাল আহমেদ। যে কীনা এবারের ভিপি নির্বাচনে তুরানের বিপক্ষের আসনটি গ্রহণ করে নিয়েছে। অথচ এই নেহালই একটা সময় তুরানের সবথেকে নিকটস্থ বন্ধু ছিল। ছিল অন্তরের মানুষ। তুরান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নেহালই দেখা মাত্রই উঠে পড়ে সেখান থেকে। চোয়াল শক্ত করে বেড়তে নেয়। তখনই ভেসে আসে নেহালের তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠ,

-“ওই মফিজ চা দে! এখন চা খাওয়া এরপর মিষ্টি খাওয়াব মিষ্টি। প্রয়োজনে পেট পুড়ে বিরিয়ানি খাওয়াব সকলকে। এবারের নির্বাচনে জয় আমারই হবে। বাকিদের হারতে হবে দেখে নিস।”

তুরান থমকে দাড়ায়। ঘাঁড় কাত করে একটু পাশ ফিরে চায়। পরপরই আবার সামনে তাকিয়ে চলে যায়। যাওয়ার
আগে বিড়বিড়িয়ে বলে,

-“সময় কথা বলবে।”

——-🍂
এতবড় ভার্সিটি। এত সুন্দর স্পেস। নীরার বেশ ভালো লাগল। ভার্সিটিতে পড়ার খুব শখ ছিল তার। কিন্তু কখনো ভাবতে পারেনি সে চান্স পেয়ে যাবে। বিয়ের কিছুদিন আগেই খবর পেয়েছে কিন্তু এসব ঝামেলায় ভর্তি হওয়া হয়ে উঠেনি। শ্বশুর বাড়ি থেকে কাছে হওয়ায় তার জন্য দ্বিগুণ সুবিধা হয়েছে। নয়তো বেশ ঝামেলায় পড়তে হতো। হয়তো তখন শেষ অবলম্বন হতো হোস্টেল।

আলহাম চৌধুরীর সঙ্গে খুব সুন্দর ভাবে ভর্তির কার্যক্রম শেষ করে বাড়ি ফিরে গেল নীরা। আজ ভর্তির কার্যাবলি শেষ করতেই প্রচুর লেট হয়ে গেছে। তাই আগামীকাল থেকে ক্লাস করা শুরু করবে।

.
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি