মায়া পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
721

#মায়া
পর্ব অন্তিম
লেখা- #Alisia_Amber
[কপি করা নিষেধ]
.
সাইন দিয়ে কলমটা বা পাশে রাখলাম। আমি ফিল করলাম আমার তেমন একটা কষ্ট হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে এই বিয়ে নামক বোঝাটা এতদিন যাবত বয়ে বেড়িয়ে বড্ড ভুল করেছি।
অয়ন কাছে এসে হাতে হাত রাখলো।
‘এই আশ্রয়, বিশ্বাস, ভরসার হাত কখনো ছাড়বে না’

অয়নের চোখে জল। সে আলতু আমার কপালে চুমু একে দেয়। জাপটে ধরি তাকে। আর কোনো বাধা নেই। মনে মনে জপি, ‘ভালোবাসা কারে কয় জানি না প্রিয়, তবু তোমাতে মন দিয়াছি অজান্তে অবেলায়’

সেদিন একটুর জন্য আমি বড় ট্রাকের নিচে পরি না। অয়ন টেনে নিয়ে আসে। মানুষটা একটাদিনের জন্যও আমাকে একা ছাড়ে নি।
শুদ্ধ এর পরের দিনই অয়নদের বাড়িতে এসে চিল্লাপাল্লা করলে অয়ন পুলিশকে খবর দেয়। শুদ্ধর মাকে খবর দেয়া হলে জানা যায়। শুদ্ধর মা নেই। তিনি আরো দু বছর আগেই মারা গেছেন। আর এর পর থেকেই শুদ্ধ মানসিক ভাবে অসুস্থ। শুদ্ধকে পুলিশি হেফাজতে রেখেই চিকিৎসা চালানো হচ্ছে। আর এর মধ্যে আমাদের ডিভোর্সের ঝামেলাও শেষ। সব কিছু অয়নই মেনেজ করেছে।

ডিভোর্সের পর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। ছোট খাটো ঘরোয়া আয়োজনে আমার আর অয়নের বিয়ে সম্পন্ন হয়। মায়া বুটিকস নামে ছোট্ট একটা অনলাইন বিজনেস শুরু করেছিলাম বিয়ের কিছুদিন আগে। আজ নিজের রুজগারে একটা শোরুম খুললাম। আমার আন্ডারে আরো তিনজন মহিলা কাজ করবেন। আমার পরিশ্রম আর চেষ্টার পেছনের সাহসে দুটো মানুষ। এক অয়ন দুই মনিমা। নিজের মায়ের আগে আমার মনিমার স্থান। তিনি মানুষরুপী ফেরেস্তা। যে মায়ার দুঃসময়ে সাপোর্ট হয়ে এসেছেন। এসেছেন মায়ার দুঃখে ভরা বাগানে সুখের ফুল ফোটাটে।

অয়ন আর শুদ্ধ ক্লাসমেট ছিলো। অয়নের সাথে তিথির রিলেশন থাকা অবস্থায় তিথি শুদ্ধর পেছনে পরে যায়। পরে শুদ্ধ আর তিথির রিলেশন হয়। এই নিয়ে শুদ্ধর মনে ক্ষোভ। তার ধারণা এই কারণেই অয়ন আমাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। শুদ্ধর সাথে হাসপাতালে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন ক্ষুদার্থ বাঘের মত শুদ্ধ এসে অয়নের উপর আক্রমন করে। সে ক্ষুদ্ধ হয়ে আছে। আমি দোয়া করি শুদ্ধ অতি দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। মা মারা যাওয়ার পর থেকে সে একা একা কষ্ট সহ্য করতে না পেরেই আজ মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছেন। আজ বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি প্রকৃতি তার শোধ নিয়েই ছাড়ে।

আজ আমাদের বিয়ের আড়াই মাস হলো। অয়ন অফিস থেকে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে মুখ এনে বললো, ‘শোনো মেয়ে, ভালোবাসি না। একটুও না।’

আমি খিলখিলিয়ে হাসলাম। হাসতে হাসতে চোখের কোনে পানি চলে আসলো। তার দুগালে হাত রেখে নাকে নাক ঘষে বললাম। ‘শুনো প্রিয়। আমিও বাসি না একটুও না।’

অয়ন হেসে আমাকে জাপটে ধরে বললো, ‘তাহলে শাস্তি পেতে হবে। বিরাট শাস্তি।’

আর কোনো শব্দ হলো না। ভালো না বাসার আড়ালের ভীষণ ভালোবাসি শব্দটা দেয়ালে দেয়ালে নিরব প্রতিধ্বনি দিলো। আমিও মিশে গেলাম তার সাথে খুব গভীর ভাবে।

খবর আসলো বাবা হার্ট এটাক করেছেন।

বাবা হার্ট এটাক করেছেন খবরটা শুনার পর আর বসে থাকতে পারলাম না। অয়নকে নিয়ে ছুটলাম বাড়ির পথে। হস্পিটালে সারাদিন কাটিয়ে বাসায় এসেই চিৎকার চেচামেচির শব্দ কানে বাজতেই দেখলাম মামনি কায়াকে মারছেন।

‘কার পাপ পেটে নিয়ে বসে বেড়াচ্ছিস বল? কার?’

মামনির কথা শুনে বাবার দিকে তাকালে বাবা মাথা নিচু করে ফেলেন। আমার এই বাবা তো আগে ছিলো না! তার ছিলো শক্তি, ছিলো কথার জোড়। আজ সে নিরব কেনো? সব রাগ ক্ষোভ কি আমার উপরই বিদ্যমান ছিলো কেবল?

আমি কায়ার কাছে গিয়ে তাকে মাটি থেকে তুললাম। বললাম, ‘কিভাবে হলো?’

সে হুহু করে কেদে দিলো। সেই প্রাণোচ্ছল কায়াকে আমি পেলাম না। সে আমাকে জড়িয়ে বললো, ‘ভুল করেছি। ভালোবেসে ভুল করেছি। আমি শেষ আপা শেষ!’

‘সে কি জোর করে! ‘ কথাটা জিজ্ঞেসা করতে ইস্তত বোধ করলাম।

কায়া মাথা নাড়িয়ে বুঝালো। জোর করে। আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। এর মাঝেই মামনি শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘অপয়া এখনো বসে আছিস! যা এক্ষুনি বেড়িয়ে যা!’

আমি ঝাঝালো কন্ঠে মামনি বলে ফেললাম, ‘চলে যাবে। হ্যা চলে যাবে। কিছু হলেই বাড়িতে জায়গা নেই। অথছ একটা বার চিন্তায় আসে না একা একটা মেয়ে কোথায় যাবে! আরে মা’য়েরা হয় সাপোর্ট। একটা বাচ্চার উজ্জ্বল ভবিষ্যত গঠনে তার মায়ের ভূমিকা থাকে সব চেয়ে বেশি। একটা বার যদি আমাকে বাড়ি থেকে বের করার উদ্দেশ্যে বিয়াটা না দিতেন তবে আজ আমার এই হাল হত না!

কায়া চলে যাবে তাই না! দুদিন পর পত্রিকায় বড় নিউজ হয়ে আসবে আত্মহত্যার করেছে কিশোরী এক মেয়ে। এর অপেক্ষায় এসব?

আরে মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। তাকে বুঝান। কিভাবে হয়েছে জানুন। ভয় নয় সাহস হয়ে উঠুন। ‘

মামনি তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি কায়াকে উঠিয়ে বললাম, ‘কে সে?’

‘চেয়ারম্যানের ছেলে আপা!’

আমি আর দেরী করলাম না। থানায় গিয়ে জিডি করলাম ছেলের নামে। সন্ধায়ই বাপ ছেলে বাড়িতে এসে হাজির। সাথে পুলিশ। এক ঘর ভর্তি লোকের সামনে বিয়ের কথা স্বীকার করে সে। সাথে বাচ্চার দায়িত্ব নেয়। সবমিটমাট করতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। আমার সব কাজে ছায়ার মত সংগী হিসেবে ছিলো অয়ন। মামনি বিদায় নেয়ার আগে বলে, ‘সুখী হবি মা। তুই খুব সুখী হবি।’

আমার হাসি পায়। আমি বেড়িয়ে আসি। মামনি কাদে। খুব কাদে। তার চোখে মুখে অপরাধবোধ। আর আমার ভেতরে জয়ের হাসি।

___________

বেশ ঠান্ডা পরেছে। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। একপা দুপা করে বাহিরে বেড়িয়ে যাবো এমন সময় ফোন আসে।
আমার শো রুমের দায়িত্ব রত ফাতিমা। বলে, ‘আপা ১২০ সেটের অর্ডার কনফার্ম’

‘আলহামদুলিল্লাহ’ – মুখে আমার তৃপ্তির হাসি। বাহিরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি সাথে দমকা হাওয়া। আমাকে আটকায় কে! বেড়িয়ে পরি। হঠাৎ পেটে কারো স্পর্শ পাই৷ এক টানে সে আমাকে তার দিকে ঘুড়িয়ে নেয়। ঠোটে গভীর চুমু খায়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে, ‘শুনো মেয়ে তোমাকে ভালো টালো বাসি না তবে’

‘তবে কি?’

আমার ঠোট কামড়ে প্রশ্ন। ‘তবে আমার মেয়েকে ভালোবাসি’

আমার চোখের কোণ ঘেষে পানি গড়িয়ে পরে। আজ সকালেই জানতে পেরেছি আমার আর অয়নের অস্তিত্ব আসছে খুব শীঘ্রই আসছে। তার অপেক্ষায় আমার দিন গুণা শুরু হবে আজি এই বৃষ্টির দিনে।রুমে এসে জামা পালটে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরি অয়নকে। সে আমার পিঠে হাত রেখে রাগী স্বরে বলে, ‘এমন আর করলে মাইর দিবো। এখন একা নউ যে!’

আমি ছাড়ি না তাকে। শক্ত করে ধরে রাখি। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে শুধাই, ‘শুনো হে বালক, কিশোরী এক মেয়ের দুঃখের ভেলায় নাউ হারিয়ে একা পথ চলার সঙ্গী হয়েছিলে তুমি। খাটিয়া বেধে মাটির তলায়ও গাথিয়া দিবে তুমি’

অয়ন আরো জোড়ে চেপে ধরে। আমার নিশ্বাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। আমি উপলব্দি করি জীবনের চূড়ায় উঠার মূলধারা থাকতে হয়। একা পথ চলা সঙ্গী বিহীন ভীষণ দূষ্কর।

‘কিশোরী বয়সে প্রেমে পরেছিলাম তার। যে আমায় কখনো চায়নি এতটুকু। সদ্য প্রেমে পরেই বিরহের আগুণে জ্বলেছি কত মাস কত বছর। তুমি এসে অন্ধকারে দিয়েছো বাতি জেলে। মায়ার জীবনে আলো হয়ে তুমিই এসেছিলে। শুনো প্রিয় বলছি আমি ভালোবাসি তোমাকে। আজ এই আধার রাতের জোৎস্না বিলাসে ভরাট গলায় অধর ছোয়ালে যেমন শিহরণ আনে বৃদ্ধ বয়সে আদরে আদরে তোমাকেই চাই আমার আবরণে।’

পরিশিষ্টঃ

মায়া আর অয়নের একটা মিষ্টি মেয়ে হয়েছে। তাদের মেয়ের নাম রেখেছে ‘অমি’

দেখতে হুবহু মায়ার মত। এ যেনো আরেক মায়া। সারা ঘর মাতিয়ে রাখে যেনো।

ঢাকায় এখন মায়ার তিনটে বুটিকস এর আউটলেট। ব্যাবসায় সে একজন সফল উদ্দোক্তা।

সব কিছুর পেছনে একজন ব্যাক্তি আছে তার পাশে ছায়ার মত। যে আড়ালে আবডালে পূরণ করে যাচ্ছে বিনা পারিশ্রমিকে সকল প্রয়োজন।

*বাস্তবতা বরই কঠিন। একা একটা মেয়ে স্টাগল করে চলা ক্যারিয়ার গঠন খুব কঠিন। জীবনে চলার পথে প্রয়োজন একজন জীবন সাথী। একজন পথ প্রদর্শক। মায়া সুখী। মায়ার জীবনে আছে অয়ন। পৃথিবীর সব মায়ার জীবন হয়ে উঠুক উজ্জ্বল।

[গল্পটি আমার লেখা প্রথম গল্প। খুব সাহস হয়ে লেখা লেখি শুরু করেছি। আমি জানি না আপনাদের আমি ঠিক কতটুকু দিতে পেরেছি। তবে আমি যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম ঠিক সে ভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়তো পারি নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। পরবর্তী গল্প নিয়ে আসছি শ্রীঘ্রই। ভালোবাসা রইলো। ভালোবাসবেন। আর অবশ্যই মন্তব্য করতে ভুলবেন না]