মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব-৪+৫

0
536

#মিষ্টিমধুর_প্রতিশোধ
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ইভানা নিজের ঘরেই বসে আছে। মন মেজাজ বেশি একটা ভালো নেই তার৷ আজ সকাল থেকেই বাড়িতে অনেক অশান্তি চলছে। হাশেম আলী ক্ষুব্ধ হয়েছেন তারিকুল ইসলামের উপর। মূল কারণ কেন তিনি ইভানার বিয়ের ব্যাপারে হাশেম আলীকে কিছু জানিয়ে বিয়েটা ঠিক করলেন। নিজের নাতনীর উপর কি তার কোন অধিকার নেই?

ইভানার জন্য বিয়েটা করা অনেক
জরুরি। নাহলে সে ফারহানের উপর কিভাবে প্রতিশোধ নেবে? সেই কারণেই ইভানা সিদ্ধান্ত নিলো হাশেম আলীকে বোঝানোর উদ্দ্যেশ্যে তার ঘরের দিকে রওনা দিলো। নিজের দাদার রুমে গিয়ে সে দেখল তার দাদা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ইভানা দাদার রুমে ঢুকে মিষ্টি হেসে বললো,
‘তুই কি মন খারাপ করেছ দাদাজান?’

হাশেম আলী কোন উত্তর দিলেন না। ইভানা এসে তার পাশে বসে পড়ল। অতঃপর তার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
‘আমি জানি তোমার মন খারাপ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমি তোমার একমাত্র নাতনী,আমাকে নিয়ে তোমার কত স্বপ্ন সেখানে আব্বু তোমার অনুমতি না নিয়ে আমার বিয়ের কথা ফাইনাল করে ফেললো। কিন্তু দাদাজান এই বিয়েটা আমি করতে চাই।’

‘তুই যদি এই বিয়েতে রাজি থাকিস তাহলে আমার অমত করার কিছু নেই। তুই তো জানিস তানজিলা তোর সুখেই আমি সুখ খুজে পাই।’

ইভানা মৃদু হাসল। তার দাদাজানের এরপর আর আপত্তি করার কোন আশংকা নেই। হাশেম আলী কিছু সময় চুপ থেকে বললেন,
‘যা সিদ্ধান্ত নিবি ভেবে চিন্তে নিস। বিয়ে কিন্তু কোন ছেলেখেলা নয়, এটা জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।’

ইভানা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। অতঃপর দাদাকে বিদায় জানিয়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে আসে রান্নাঘরে। যেখানে ইশরাত খাতুন রান্নাবান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। ইভানা ইশরাত খাতুনের গা ঘেষে দাড়ায়। ইশরাত খাতুন ইভানার মনোভাব ঠাহর করতে পারলেন না। তাই ইভানাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুই কি কিছু বলবি আমায়?’

‘আম্মু আমি রান্না শিখতে চাই।’

‘তুই রান্না শিখে কি করবি?’

‘ওহ আম্মু তুমি বুঝতে পারছ না। দুদিন পর আমার বিয়ে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির সবাইকে রেধে খাওয়াতে হবে না?’

‘তুই কি রান্না করতে পারবি?’

‘চেষ্টা করে দেখি।’

ইশরাত খাতুন মানা করলেন না। ইভানাও খুন্তি হাতে নিয়ে রান্না করার প্রস্তুতি নিলো। কিছু সময় চেষ্টা করেই হাফিয়ে উঠল সে। রান্না করা তো আর এত সহজ ব্যাপার না। গ্যাসের তাপ তার একদম সহ্য হচ্ছিল না। তার উপর ডাল নাড়াচাড়া করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা হয়ে গেল। ইভানা বিরক্ততি ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে বলল,
‘ধুর, আমার দ্বারা এসব রান্নাবান্না হবে না। আমি চললাম।’

কথাটা বলে এক মুহুর্ত রান্নাঘরে দাড়ালো না ইভানা। দ্রুত পায়ে হেটে বেরিয়ে এলো৷ ইশরাত খাতুন মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
‘এই মেয়ে যে বিয়ের পর কি করবে আল্লাহ মালুম।’

৭.
আকাশে কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সকাল থেকে ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজমান। আজকের দিনটা পুরোই বৃষ্টিমুখর। এই বাদলা দিনে ইভানা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। ইশরাত খাতুন নিজের মেয়েকে ডাকতে এসে বিরক্ত হয়ে গেলেন। সকাল ১০ টা বেজে গেছে অথচ মেয়েটা এখনো ঘুমোচ্ছে! এই মেয়ের নাকি ক’দিন পর বিয়ে! ইভানাকে বেশ কয়েকবার ডাক দিলেন তিনি। কিন্তু ইভানার ঘুম থেকে ওঠার কোন নামই নেই। তাই বাধ্য হয়ে একপ্রকার টেনে ঘুম থেকে তুললেন।

ইভানা বিরক্ত হলো প্রচুর। নিজের মায়ের উপর রাগ দেখিয়ে বললো,
‘আরেকটু ঘুমালে কি অসুবিধা হতো আম্মু? আজকের আবহাওয়া কত সুন্দর।’

‘আবহাওয়া সুন্দর জন্য কি সারাদিন ঘুমাবি নাকি? আজ বাদে কাল তোর বিয়ে। এখন একটু নিজের বদভ্যাস গুলো বদলানোর চেষ্টা কর। আমি তোর মা জন্য এসব সহ্য করি। সবাই তো আর করবে না।’

ইভানা চুপচাপ বিছানা থেকে উঠে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ থাকল। অতঃপর আবেগপ্রবণ হয়ে বললো,
‘আমি এখন থেকেই তোমার মূল্য বুঝতে পারছি আম্মু। আমি জানি আমি মেয়ে হিসেবে একদম ভালো নই। খুব খারাপ মেয়ে আমি। কিন্তু আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া যে তোমার মতো মা পেয়েছি আমি। মা হিসেবে তুমি একদম পার্ফেক্ট।’

ইশরাত খাতুনের চোখে জল চলে এলো। তবে তিনি খুব সন্তপর্ণে সেই জল মুছে ফেললেন। ইভানার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
‘এখন ছাড়া আমাকে। রান্না বসিয়ে এসেছি।’

ইভানা ছেড়ে দিতেই ইশরাত খাতুন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। একজন মায়ের কাছে সবথেকে আপন হয় তার সন্তান। কত আদর যত্নে সেই সন্তানকে মানুষ করে তারা। সেই সন্তানকে যখন চিরকালের মতো অন্য কারো বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়, সেই কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
__________________________
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে লাঞ্চের জন্য বসেছে সবাই। শুরুর দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও খাওয়ার মাঝখানে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়। তারিকুল ইসলাম পরিবারের সবাইকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
‘ফারহানের মায়ের সাথে আজ কথা হলো। তিনি বললেন এই সপ্তাহের মধ্যেই বিয়েটা দিতে চান।’

হাশেম আলী তেতে উঠে বলেন,
‘এটা কি ধরণের কথা? এক সপ্তাহের মধ্যে কিভাবে সম্ভব? আমার আদরের নাতনীর বিয়ে বলে কথা। আমার কত সাধ যে বড় অনুষ্ঠান করে, ধুমধাম করে বিয়ে দেবো।’

‘উনি বলেছেন খুব সাদামাটা ভাবেই বিয়েটা দিতে চান৷ খুব কাছের খুব আত্মীয় স্বজন ছাড়া কেউ আমন্ত্রিত থাকবে না।’

‘এটা আমি মানবো না। এত সাধারণভাবে আমার নাতনির বিয়ে হবে না। তুই এই শহরের একজন নামীদামী ডাক্তার। তোর কত চেনা জানা লোক আছে। তাছাড়া আমাদের কত আত্মীয় স্বজন আছে। আমার নাতনীর বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত দিবো। সবাই আসবে, হই হুল্লোড় করে বিয়ে হবে। সেখানে এসব কি বলছিস তুই?’

‘আমি কিছু বলছি না আব্বু, যা বলার পাত্রর মা বলেছেন।’

‘এমন হলে এই বিয়েটা দিতে হবে না। আমার নাতনী এতটা ফেলনা হয়ে যায় নি যে ওকে যেন তেন ভাবে বিয়ে দেবো।’

‘তোমার নাতনী যা রেজাল্ট করেছে তাতে ওর জন্য যে এত ভালো পাত্র পাওয়া গেছে সেটাই অনেক। তাই এই বিয়েটা আমি ভাঙ্গতে চাইছি না।’

হাশেম আলী ভাতে পানি ঢেলে দিয়ে বললেন,
‘তোদের যা ইচ্ছা কর। আমার মতামতের তো আজকাল কোন দামই নেই। আমি যে একজন মুরুব্বি মানুষ আসি সেটা তোদের খেয়ালই নেই। যা পারিস কর। আমি আর কিছু বলব না।’

ইভানা বলে উঠল,
‘তুমি কোন চিন্তা করো না দাদাজান। আমার বিয়েটা তুমি যেমন করে চাও তেমন করেই হবে। প্রয়োজনে আমি কথা বলবো ওনাদের সাথে।’

তারিকুল ইসলাম গর্জন করে বললেন,
‘তুমি এসব ব্যাপারে একদম নাক গলিও না। তোমার বাড়াবাড়ির জন্য না এত ভালো সম্মন্ধটা ভেঙে যায়।’

ইভানা প্রতিবাদ করতে চেয়েও করলো না। নিজেকে বোঝালো ঠান্ডা মাথায় সবকিছুর সমাধান করতে হবে। নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

৮.
ইভানা খুব চতুরতার সাথে তার আম্মুর থেকে ফারহানদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে নেয়। উদ্দ্যেশ্য সেখানে গিয়ে ফারহানের মায়ের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলা।

তারিকুল ইসলাম হাসপাতালে চলে যাওয়ার পরই ইভানাও বেরিয়ে পড়লো। এখন তার গন্তব্য ফারহানের বাড়ি। ইভানাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটি ক্যাব বুক করে নিলো। অতঃপর সেই ক্যাবে করেই রওনা দিলো ফারহানের বাড়ির দিকে।

কিছু সময় এভাবেই কা’টল। একপর্যায়ে ইভানা পৌছে গেল তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। ইভানা ক্যাব থেকে নেমেই ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো বাড়িটা। দুতলা বিশিষ্ট একটা বাড়ি। দেখে মনে হয় নতুন তৈরি হয়েছে বাড়িটা।

ইভানা বেশিক্ষণ দাড়ালো না বাইরে। যদিও তার বুক থেকে ধকধক আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। হাত পা রীতিমতো কাপছিল। বিয়ের আগে প্রথমবারের মতো নিজের হবু শ্বশুর বাড়িতে ঢুকতে চলেছে সে। তাই বেশ উত্তেজিত সে।

কাপা কাপা হাতে কলিং বেলে চাপ দিলো। এক বার, দুইবার করে মোট তিন-চারবার কলিং বেলে চাপ দেওয়ার পরে কেউ একজন এসে দরজাটা খুলে দিলো।

ইভানা একপলক তাকালো সামনের দিকে। তার সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে সে ঠিক চিনতে পারলো না। ফর্সা,লম্বা, সুঠামদেহী একজন ছেলে দাড়িয়ে আছে তার সামনে। ইভানা খেয়াল করে দেখলো ফারহানের সাথে চেহারার অনেকটাই মিল। তবে পার্থক্য হলো ফারহানের গায়ের রং শ্যামলা আর এই ছেলেটা অনেক ফর্সা। ইভানা বুঝে নিলো এটা হয়তো ফারহানের ভাই হতে পারে।

এদিকে ফাহিম ইভানার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ছিল। যেহেতু সে ইভানাকে চেনে না তাই বললো,
‘তুমি কে? আর কাকে চাই এখানে?’

‘সেটার কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাবো কেন? আর আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? অচেনা কাউকে তুমি করে কেউ বলে নাকি? আপনি করে বলতে হয় জানেন না?’

‘এটুকু একটা পুচকে মেয়েকে নাকি আপনি বলে ডাকতে হবে।’

হয়তো এই তর্ক আরো কিছুক্ষণ চলতো কিন্তু তার মাঝেই আগমন ঘটলো ফারহানের। ফারহান এসে ইভানাকে দেখে অবাক হলো প্রচুর। সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি এখানে?’

ফাহিম ফারহানকে বললো,
‘তুই চিনিস এই মেয়েটাকে? দেখ না এটুকু একটা মেয়ে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে যে ওকে আমার আপনি করে বলতে হবে।’

ফারহান কিছু বলে না। নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে ইভানার দিকে। ইভানা তো চুপ থাকার মেয়ে নয়। সে বলে,
‘এই যে শুনুন আমার পরিচয় কি জানেন? আমি এই লোকটার(ফারহানের দিকে ইশারা করে) হবু বউ। আর আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে আপমি হলেন ওনার ভাই তাই না? তার মানে আমি আপনার হবু ভাবি। সো, আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন।’

ফাহিম তাচ্ছিল্য করে বললো,
‘ওহ তাহলে তুমি সেই মেট্রিক ফেইল মেয়ে।’

ইভানার গায়ে লাগলো খুব। সে প্রতিবাদী সুরে বললো,
‘এভাবে কথা বলবেন না আমার সাথে।’

‘এভাবে বলবো না তো কিভাবে বলবো? যা সত্যি তাই বলছি। ছোট থেকে একটা প্রবাদ শুনে আসছি বাদরের গলায় মুক্তোর মালা। এখন তো সেটা বাস্তবেও দেখছি।’

‘মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?’

‘এই যে তুমি বাদর আর আমার ভাইয়া মুক্তোর মালা।’

‘মুখ সামলে কথা বলুন।’

‘মুখ সামলানোর কিছু নেই। তুমি যে আমার ভাইয়ার নখের যোগ্য নও সেই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই আমি ভুল কিছু বলছি না।’

ইভানার চোখে জল চলে এলো। এত অপমানিত জীবনে সে কোনদিনই হয়নি। ইচ্ছা করছে গলা ফাটিয়ে কাদতে। ইভানার অবচেতন মন বারবার চাইছিল ফারহান তার হয়ে কিছু বলুক। প্রতিবাদ করুক তার জন্য, কিন্তু সেসব কিছু হচ্ছিল না। ফারহান নীরব দর্শক হয়ে সবকিছু দেখছিল। ইভানা আর থাকতে না পেরে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনার ভাই আমাকে এত কিছু বলছে আর আপনি কিছু বলবেন না? আমি হবু স্ত্রী হই আপনার। আমার হয়ে কিছু তো আপনার বলা উচিৎ।’

ফারহান ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
‘আমার ভাই তো ভুল কিছু বলে নি।’

এই কথাটা ইভানার মনকে আরো বিষিয়ে দিলো। সে একপ্রকার দৌড়ে ফারহানদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। বাইরে এসে জোরে জোরে কাদতে লাগল৷ অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরল। বাড়িতে এসেই নিজের রুমে প্রবেশ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। এখন কিছুক্ষণ একা থেকে মাথা ঠান্ডা করতে চায় সে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

#মিষ্টিমধুর_প্রতিশোধ
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ইভানা আজ দেখা করল ফারজানা বেগমের সাথে। মূলত ইশরাত খাতুনের থেকে তার ফোন নম্বর জোগাড় করে বাইরে একটি কফিশপে ডেকে পাঠালেন ওনাকে। ইভানা ও ফারজানা বেগম মুখোমুখি বসে আছে। ইভানা কফিতে চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে বললো,
‘বিয়েটা যাতে একটু উৎসব অনুষ্ঠান করে হয়, সেই আর্জি জানাতেই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি। আসলে আমার দাদাজানের অনেক ইচ্ছা মহাসমারোহে আমার বিয়ে দেবেন।’

ফারজানা বেগম চিন্তিত মুখে বললেন,
‘আমিও তো চাই আমার ছেলের বিয়েটা বড় অনুষ্ঠান করে দিতে। কিন্তু ওই তো মানা করল।’

‘ছেলেরা তো জেদ করবেই। কিন্তু আন্টি আপনি ভেবে দেখুন না, এরকম ভাবে কারো বিয়ে হয়? আপনি আপনার ছেলেক্ষমা বুঝিয়ে বলুন। দেখবেন তিনি এমনিই রাজি হবেন।’

‘আচ্ছা চেষ্টা করে দেখব।’

অতঃপর তারা আরো কিছু সময় কথা বার্তা বলে। ফারজানা বেগমের সাথে বেশ ভাব হয়ে যায় ইভানার। ফারজানা বেগম ভাবতে থাকেন, এইরকম একটা মিষ্টি মেয়েকে তার ছেলের বউ হিসেবে পেলে তিনি ধন্য হবেন। আর তার ছেলে কিনা বিয়েটা করতে অমত করেছিল।

ফারজানা বেগম গ্রামেই নিজের জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন। তাই তার চিন্তাধারা শহুরে মানুষদের মতো এত প্যাচানো নয়। বেশ সহজ সরল চিন্তা ভাবনা তার। শহুরে কোন মানুষ হলে হয়তো ইভানাকে কখনো নিজের ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করতেন না। কিন্তু গ্রামে থাকায় তার কাছে পড়াশোনা ওতোটা মূল্যবান নয়। তার মতে, নিজের ছেলেকে তো শিক্ষিত করেছেনই, এখন তার বউ নাহয় একটু কমশিক্ষিত হলো তাতে তো কোন অসুবিধা নেই। তাছাড়া ফারজানা বেগম নিজেও পড়াশোনা করেন নি।

ফারজানা বেগম তাই মনে করেন বাড়ির বউ হওয়ার জন্য সুন্দরী, গুণবতী হওয়াই যথেষ্ট। এই কারণেই ইভানাকে এক দেখায় তার পছন্দ হয়ে গেছে। এখন ইভানাকে বাড়ির বউ করে ঘরে তুললেই তার শান্তি। এখন দেখা যাক, ভাগ্যে কি লেখা আছে!

৯.
সময়ের স্রোতে এগিয়ে গেছে কয়েকটা দিন। ইভানা ও ফারহানের বিয়ের দিন তারিখও প্রায় চলে এসেছে। আর মাত্র দুই দিন পরেই তাদের বিয়ে হওয়ার কথা।

ইতিমধ্যেই বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের ভীড় লেগেছে। ইভানার কথা শুনে ফারজানা বেগম ফারহানকে বুঝিয়ে বড় অনুষ্ঠান করে বিয়ের কথা বলেছিলেন। ফারহান তো একদম রাজি হতে চায়নি। তবে ফারজানা বেগম অনেক বোঝানোর পর ফারহান কিছুটা শান্ত হয়।

এখন বিয়েটা খুব সাদামাটাভাবেও হচ্ছে না আবার বড় অনুষ্ঠান করেও না। কাছের আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে অনুষ্ঠান করেই বিয়েটা হবে।

ইভানা এখন প্রতিশোধের নেশায় রয়েছে। তার উদ্দ্যেশ্য ফারহানকে বিয়ে করে সব অপমান এবং অবহেলার প্রতিশোধ নেবে। এখন দেখা যাক তার এই প্রতিশোধের ইচ্ছা কখনো পূর্ণ হয় কিনা। তবে ইভানার প্রতিশোধটা হবে অন্যরকম। যাকে বলা যায় মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ!

______________________
আজকে ইভানা গায়ে হলুদ। গায়ে হলুদ উপলক্ষে হলুদ রঙের লেহেঙা পড়েছে ইভানা। অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে। তোহাসহ ইভানার কিছু কাজিন তাকে ঘিরে বসেছে। একটু পরেই গায়ে হলুদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। তার আগে কাজিনরা সবাই মিলে গল্পগুজবে মেতেছে। সবার মাঝে রিয়া নামে ইভানার এক চাচাতো বোন বলে ওঠে,
‘তোর ভাগ্য কত ভালো তাইনা? মেট্রিক ফেল করে ম্যাজিস্ট্রেটের বউ হবি।’

কথাটা শুনে সবার মাঝে হাসির রোল উঠে যায়। ইভানার ভীষণ লজ্জা লাগে। সবার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। তোহা ব্যাপারটা সামলানোর জন্য বলে,
‘এখন এসব কথা থাক। বিয়ে খেতে এসেছিস সবাই, বিয়েতে আনন্দ মজা কর। এসব নিয়ে কথা বলার তো দরকার নেই।’

রিয়া অপমানিত বোধ করে। তাই সে তোহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘সত্য কথা বললে রেগে যাওয়াই স্বাভাবিক। তুমি বড় বোন হয়ে এখনো কুমারী আছ, এদিকে তোমার ছোট বোনের বিয়ে হতে যাচ্ছে। এর কারণ তো কারো অজানা নয়। কারণ ইভানা একটা ফেলটুস ছাত্রী।’

ইভানা চোখ ছলছল করছিল। এইজন্য সে এই একবছর বাড়ির বাইরে কোথাও যায়নি। এই তিক্ত কথাগুলো যে তার সহ্য হতো না। কেউ পরীক্ষায় অকৃতকার্য করলে তাকে কথা শোনানো যেন সমাজের লোকের স্বভাব হয়ে দাড়িয়েছে। একবারো তারা নিজেদেরকে তাদের যায়গায় বসিয়ে ভাবে না যে, কাউকে অপমান করলে কত কষ্ট লাগে।

এরমধ্যেই গায়ে হলুদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়৷ সবাই একের পর এক ইভানার গায়ে হলুদ দিতে থাকে। তোহা ইভানার গায়ে হলুদ লাগিয়ে বলে,
‘আমি তোকে আগেও বলেছি, এখন বিয়ে না করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা কর, কিন্তু তুই শুনলি না আমার কথা। বিয়ের পর কিন্তু তোকে এরকম অপমান আরো অনেক সহ্য করতে হবে।’

‘আমি জানি। আমি নিজেকে সবকিছুর জন্য প্রস্তুতও করে নিয়েছি।’

ইভানার এমন জবাব শুনে তোহা আর বলার মতো কিছু খুজে পায় না। যে বোঝে না তাকে হয়তো বোঝানো যায়, কিন্তু যে বুঝেও বুঝতে চায়না তাকে বোঝানোর সাধ্য এই দুনিয়ার কারোরই নেয়।

তবুও তোহা শেষ দিন অব্দি নিজের বোনকে হাজারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে। নিজের বড় বোনের দায়িত্ব যথাযথ ভাবেই পালন করেছে সে।

১০.
আকাশে আজ চাঁদ তার পূর্ণ রূপেই আবির্ভাব ঘটিয়েছে। কারণ আজ পূর্ণিমা। এই আলোকিত রাতে ইভানাদের বাড়ি আজ আরো অনেক বেশি আলোকিত।

চারিদিকে সাজসজ্জা। জোরে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে গান বাজানো হচ্ছে। সেই গানের তালে অনেকে নাচছে। বর্তমানে বাজছে, ❝মেহেন্দি লাগাকে রাকনা❞ গানটা। সাথে চলছে ইভানার হাতে মেহেদী লাগানোর আয়োজন।

তোহা অনেক সুন্দর মেহেদী লাগাতে পারে। তাই নিজের বোনের হাতে সেই মেহেদী পড়িয়ে দিলো। ইভানার হাতে ফারহানের নামের প্রথম অক্ষরও লিখে দিলো তোহা।

সব কিছু ভালো ভাবেই মিটে গেল। অতঃপর আগমন ঘটল আনহার। ইভানা আনহাকে দেখামাত্রই বললো,
‘তুই আসতে এত দেরি করে দিল কেন?’

‘আর বলিস না। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। যাইহোক একবার যখন এসে পড়েছি তখন তোর বিয়ের সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব। অনেক হই হুল্লোড় করব।’

অতঃপর দুই বান্ধবী গল্পগুজবে মেতে ওঠে। দুজনে গল্প করতে করতে ইভানার রুমে চলে যায়।

এই সময় আনহা ইভানার সামনে ফারহানের প্রসঙ্গ তুলে বলে,
‘তাহলে শেষ অব্দি ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর প্রতিশোধ নিতে বিয়েটা করেই ফেলছিস।’

ইভানা মৃদু হেসে বলে,
‘হুম। তা বটে। বিয়েটা শুধু হয়ে যেতে দে,তারপর দেখ আমি কিভাবে সবকিছুর প্রতিশোধ নেই।’

দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আনহা ও ইভানার সব কথোপকথন রেকর্ড করে নেয় রিয়া। ইশরাত খাতুনের কথামতো ইভানা ডাকতে এসেছিল সে। তখনই দরজার বাইরে থেকে তাদের কথোপকথন শুনতে পায় এবং রেকর্ড করে নেয়।

ছোটবেলা থেকেই ইভানা ও তোহাকে হিংসা করে রিয়া। তারিকুল ইসলামের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে রিয়া। তারিকুল ইসলাম অনেক ধনী, তাদের মেয়ে কত সুযোগ সুবিধা পায়। ইভানা ম্যাট্রিক ফেল করেও ম্যাজিস্ট্রেটকে বিয়ে করতে পাচ্ছে। অন্যদিকে রিয়া অনেক মেধাবী ছাত্রী। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সে বোর্ডের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিল। এবার এইচএসসি পরীক্ষাতেও ভালো করার আশা দেখছে। কিন্তু তার বাবা একজন সাধারণ চাকরিজীবী। তার জীবনে এত স্বচ্ছলতা নেই। তাই মূলত সে হিংসা করে তাদেরকে। বারবার তাদের অবস্থা নিয়ে আফসোস করে বলে, যদি তার জীবনও এমন হতো।

রিয়া এসমস্ত কথা রেকর্ড করে শ’য়তানী হাসি দিয়ে বলে,
‘জীবনে অনেক আনন্দ করে নিয়েছিস তুই। এবার একটু কষ্ট সহ্য করার প্রস্তুতি নে। আমি করবো তোর কষ্টের ব্যবস্থা।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨