মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
563

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_23

নিকষ রাতের আধারে চারদিক নিস্তব্ধ।সামনের কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।এই রাতের আধারে শুভ আর আরজু ঘুরে বেড়াচ্ছে গহীন জঙ্গলে।দূরের খেক শেয়ালের ডাকে আরজু শিউরে উঠে শুভর বাহু চেপে ধরছে।শুভ পরম যত্নে আরজুকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।কিছুদূর যেতেই সামনে একঝাঁক জোনাকি পোকার দেখা পেলো তারা।আরজুর চোখ চকচক করে উঠলো।উল্লাসে মেতে উঠেছে আরজু।হঠাৎ শুভর বাহু ছেড়ে সেদিকেই ছুটে গেলো আরজু।উদ্দেশ্য একটাই জোনাকি পোকা ধরা।শুভ পেছন থেকে ডেকেই চলছে আরজুকে।কিন্তু আরজু যেনো নিজের মধ্যে নেই।সে ছুটে চলছে জোনাকির দিকে।একসময় আরজু নিকষ আঁধারে তলিয়ে গেলো।শুভ ছুটোছুটি করেও আর আরজুকে খুজে পেলো না।শুভ চিৎকার করে ডাকছে আরজুকে।কিন্তু আরজু বহু দূরে হারিয়ে গেছে।একদম শুভর ধরা ছোঁয়ার বাইরে।শুভ আঁতকে উঠল।সাথে সাথেই তার ঘুম ভেংগে গেল।শুভ আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে বেডরুমেই আবিষ্কার করলো।সকাল সকাল এমন একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর থেকেই শুভ ভীষণ অস্থিরতার ভুগছে।

কোনো মতে নাস্তা শেষ করলো সে।আজ ভার্সিটি অফ।তাই বাসায় বসেই অলস দিন কাটছে তার।একটু আগে মা একটা বড়ো বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে।সেই বাজার করতে করতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো।হাজারো ব্যাস্ততার মধ্যেও একটা দুশ্চিন্তা তার মনে গেঁথে রয়েছে। তাই চিন্তা করল বিকেলে একবার আরজুর বাসায় যাবে।

বিকেলে আরজুর বাসার ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল তারা। শুভকে দেখে তার মুখে একরাশ বিরক্তির ছেয়ে গেল।শুভ মিষ্টি হেসে বললো

-“তারা বিবি তোমার বড়ো আপা কই?”

তারা ভালো করেই জানে আরজু কোথায়।কিন্তু শুভকে সে কিছুতেই বলবে না।পড়ে দেখা গেলো মজনুর মতো কেঁদে কেটে জান দিতে চলে গেলো।তারা শুভকে দেখতে না পারলে কি হবে?তাই বলে মানুষটাকে মরতে দিতে পারে না। দয়ার শরীর ওর।তাই বললো

-“আপা শপিংয়ে গেছে।”

শুভ কপাল কুচকালো।নরমালি আরজু বের হলে তাকে বলে বের হয়।তাহলে আজ কল করলনা কেনো?তারপর বললো
-“অবনি কোথায়?”

-“ছোট আপা মরার মতো ঘুমায়।আজ তার ঘুম দিবস।সকালের নাস্তা দুপুরে খাইছে।আর বড়ো আপা বের হওয়ার পর আবার ঘুম দিছে।সামনে নাকি তার জীবন থাইকা ঘুম উঠিয়া যাইবো।তাই এহনি সব ঘুম ঘুমাইতেছে।”

শুভ মনে মনে বললো
-“ফাঁকিবাজ নাম্বার ওয়ান।আসলে আজ ম্যাথ কোচিং এ এক্সাম আছে সেই ভয়ে ঘুমাচ্ছে।”

শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরজুদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো। মনের ভেতর কেমন যেন খচখচানি হচ্ছে। নিজেকে স্থির করতে ফুয়াদকে কল করলো।ফুয়াদ বললো

-“একটা দিন বিকেলে ঘুমাইছি তোর সহ্য হলো না।”

-“রাখ তোর ঘুম।এই দিকে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে।”

-“ঝেড়ে কাশ তো।”

-“আজ সকালে আরজুকে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখেছি।তার পর থেকেই ভীষণ অস্থির লাগছে।”

-“ফাও পেছাল কম পার।মুখ ফুটে কিছু বলতে তোর ফেটে যায় আর অন্য দিকে স্বপ্ন দেখে ছেলে অস্থির হয়ে যায়।ফালতু একটা।”

-“চেতিস কেন?আমি চিন্তা করেছি আরজুকে সব বলে দিবো।কিন্তু কি ভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।”

-“কাল ভার্সিটিতে আয়, মিলে প্ল্যান করবো।”

-“ওকে ফাইন।”

কল কেটে শুভ মুচকি হাসলো।আরজু ম্যাডাম তার ভালোবাসার কথা শুনার পর কেমন রিয়েকশন দেবে এবার সেটাই দেখার পালা। আর ভয় পেলে চলবে না ভয় কে জয় করে আরজুর মুখোমুখি হতেই হবে।

*************

এয়ারকন্ডিশনে ঘেরা পরিবেশে দাড়িয়ে ও আরজুর ঘাম ছুটে গেলো।নাহিদের দাড়ানোর স্টাইল সোজা তার বুকে এসে বিধছে।এই হ্যান্ডসাম নেতার তীক্ষ্ণ চাহুনি সব এলোমেলো করে দিচ্ছে।আরজুর ভেতরে তোলপাড় হতে লাগলো।মুহূর্তেই আরজুর প্রচন্ড রাগ হলো।এই অসভ্য লোক বলে কিনা তার আর রওশনের হানিমুন প্যাকেজ গিফট করবে? হানিমুন মাই ফুট!!আরজু নিজেকে শক্ত করে জোর গলায় বললো

-“আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেনো?”

নাহিদ স্বাভাবিক ভাবে বললো
-“আমি কেনো পালিয়ে বেড়াবো?”

-“কেনো সেটা জানেননা? নাকি জেনেও না জানার ভান করছেন।”

-“আমি এমন কিছুই করছি না মিস আরজু।”

-“মিথ্যা বলছেন আপনি। আমি আপনার প্রতি প্রচন্ড রকমের দুর্বল সেটা আপনি অনেক আগে থেকেই জানতেন।আমার অনুভূতি গুলো সম্পর্কে আপনি অনেক আগে থেকেই অবগত।তার পরও এমন না জানার নাটক করছেন।আর আমার বিশ্বাস কোথাও না কোথাও আপনিও আমার প্রতি দুর্বল।”

নাহিদ বাঁকা হেসে বললো
-“এটা আপনার ভুল ধারণা।”

আরজু প্রচন্ড রেগে গেলো।নাকের পাটা বার বার ফুলে উটছে।আরজুর ফর্সা মুখ রক্তিম আকার ধারণ করলো।সে রেগে নাহিদের পাঞ্জাবির কলার ধরে বললো

-“আপনি একটা মিথ্যাবাদী। মিথ্যাবাদী আপনি।”

আরজুর এই কাজে নাহিদের মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। কাচের দেয়ালের বাইরে গার্ড এই দৃশ্য দেখে এই দিকে আসতে নিলে নাহিদ হাত উঠিয়ে তাদের থামিয়ে দিলো।নাহিদের দৃষ্টি তখনও আরজুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
নাহিদ আরজুর দিকে কিছুটা ঝুঁকে শান্ত গলায় বললো

-“কি মিথ্যা বলেছি আমি?”

আরজু ঘনঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো। দু চোখে অশ্রু জমা হয়ে টলমল করতে লাগলো। আরজু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল

-“যদি আপনি আমার প্রতি দুর্বল না হয়ে থাকেন তাহলে সেদিন রাতে সাজেকে আমাকে চুমু কেন খেয়েছিলেন?বলুন কেনো ?”

নাহিদ আলতো করে আরজুর হাতে হাত রেখে কলার থেকে আরজুর হাত ছড়িয়ে নিলো।আরজুর দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললো

-“শুরুটা কিন্তু আপনি করেছিলেন।আফটারল আমিও একজন পুরুষ।কেউ সিডিউস করার চেষ্টা করলে আমি কি করতে পারি।”

আরজু হা করে তাকিয়ে রইল।সে নাহিদ কে সিডিউস করার চেষ্টা করেছে? ভন্ড নেতা একটা।সে জাস্ট ঠোঁটে হালকা চুমু খেয়েছিলো।কিন্তু এই লোক তো গভীর চুমু খেয়েছে।যাকে বলে প্যাশনেট কিস।

আরজু ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে বললো
-“সেদিন আমি সজ্ঞানে ছিলাম না কিন্তু আপনি তো ছিলেন। আমার সুযোগ নিয়ে আপনি চুমু খেয়েছিলেন। আর ঠিক তারপর দিন সাজেক ছেড়ে পালিয়েছেন।”

-“আমি মোটেও পালাইনি।তাছাড়া সেদিন যেটা হয়েছিল সেটা জাস্ট অ্যাকসিডেন্ট।”

রাগে আরজুর মাথা ফেটে যাচ্ছে।সামনের মানুষটিকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।আরজু ফুপিয়ে উঠলো।নাহিদের প্রশস্ত বুকে একের পর এক মারতে লাগলো।আর কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো

-“জাস্ট এক্সিডেন্ট!! কয়জন মেয়েকে এমন অ্যাক্সিডেন্টলি কিস করেছেন বলুন?”

আরজুর নরম হাতের ছোঁয়ায় নাহিদের কিছুই হলো বলে মনে হয় না।নাহিদ স্থির দৃষ্টিতে আরজুকে দেখতে লাগলো।একসময় নাহিদ আরজুর দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্ধি করে নরম সুরে বললো

-“আপনিই প্রথম মিস আরজু।”

আরজু তখনও ফুপিয়ে যাচ্ছে।নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-“আচ্ছা!!!আমার ভুলের জন্য যেই শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো।”

আরজু ফোপাতে ফোপাতে বললো
-“আপনার ভুলের জন্য একটাই শাস্তি।সারা জীবন আমার পাশে থাকতে হবে।বিয়ে করতে হবে।”

নাহিদ কপাল চুলকে বললো
-“আপনি পাগলামি করছেন।রওশান কিন্তু খুব ভালো ছেলে।ওকে বিয়ে করে নিন।আমি এমন কিছুই করছি না।”

আরজু ক্ষিপ্ত চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।বললো
-“আপনার কাছে সব কিছু ফান মনে হচ্ছে?আপনি জানেন আমি কি করতে পারি?”

নাহিদ ব্রু কুচকে বললো
-“কি করতে পারেন শুনি?”

-“আপনার পার্টি অফিসে যেয়ে সবাইকে জানাবো আপনি আমার সাথে কি করেছেন।পুলিশ কমপ্লেইন করে আপনার নামে মামলা ঠুকে দিবো।আপনার মান সম্মান এক মুহূর্তেই ধুলিস্যাৎ করে দিব। তখন দেখবেন আপনার রেপুটেশন কোথায় যায়?”

নাহিদ আরজুর দিকে ঝুঁকে শক্ত গলায় বললো
-“আমাকে ব্লাকমেইল করছেন?”

আরজু ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো।কিন্তু নিজেকে আজ দুর্বল প্রকাশ করা যাবে না।সে তোতলাতে তোতলাতে বলল
-“হে ক….ককরছি।”

নাহিদ সোজা হয়ে দাড়িয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আরজুর দিকে বাড়িয়ে দিলো।আর বললো

-“বসে পানি খেয়ে নিন।কান্নার জন্য কথা বলতে পারছেন না।”

আরজু নাক টেনে নিজেকে সামলে অভিমানী গলাতেই বললো
-“লাগবে না।”

নাহিদ জোর করে আরজুকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো।হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় খেতে বললো।আরজু মুহূর্তেই গ্লাস ফাঁকা করে ফেললো।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ছিলো।নাহিদ স্থির দৃষ্টিতে আরজুকে দেখে বললো

-“বাস্তবতা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই আরজু।আবেগে ভাসছেন আপনি।”

-“মোটেও না।আমার ভালোবাসাকে আপনি অপমান করছেন।”

-“আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন আপনি?”

-“আপনাকে চাই শুধু এইটুকু জানি।”

-“আপনি কি জানেন আমার পাশে থাকলে আপনি কখনোই একটা নরমাল সংসার পাবেন না?আপনি ভীষণ ইমোশনাল।কিন্তু আমি হয়তো আপনার এই ইমোশন দেখার সময় ও পাবো না।আর না তার সঠিক মূল্য দিতে পারবো।আপনি আমার চাইতে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন।আমার নাইন টু ফাইভ জব না।এমন অনেক দিন যায় আমি বাসায় আসতে পারি না।মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাই। এমনও হতে পারে মাসে পর মাস আমার হদিস পাচ্ছেন না। আট দশ জনের মতো বেলায় বেলায় কল করতে পারবো না।যখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় আপনার কল কাটবো তখন আপনার এই আবেগ ,অনুভূতি সবটাই ফিকে পড়ে যাবে।আমার সাথে থাকলে আপনি স্বাভাবিক লাইফ লিড করতে পারবেন না।

আমার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই আরজু।যে কোনো মুহূর্তেই যে কারো বুলেটে শেষ হয়ে যেতে পারি।আমার সাথে আপনার জীবন জুড়ে গেলে আপনার লাইফ রিস্ক হতে পারে।আপনি বুঝতে পারছেন বিষয়টি?”

আরজু আজ শক্ত গলায় বললো
-“আমার কোনো সমস্যা নেই।”

-“আপনার ফ্যামিলির কথা ভাবুন?”

-“আমার খুশিতেই তারা খুশি।”

নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এই জেদী মেয়ে কিছুই বুঝতে চাইছে না।বাস্তবতা কতটা কঠিন সেটা এখনো জানে না এই মেয়ে।নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে দু হাত বুলিয়ে নিলো।আরজু নাহিদকেই পর্যবেক্ষণ করছিলো।মানুষটিকে কেমন এলোমেলো লাগছে।আরজুর ইচ্ছে করছে নাহিদের সিল্কি চুলে হাত বুলাতে।কিন্তু সাহস পেলো না।লোকটা এমনিতেই তার কাজে ভেবাচেকা খেয়ে গেছে।

নাহিদ আরজুর দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো
-“আমার কিছু শর্ত আছে।”

আরজু চমকে নাহিদের দিকে তাকালো।একটা সম্পর্ক গড়তে কিসের শর্ত?আরজু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই নাহিদ বললো
-“আপনার আমার সম্পর্কের বিষয়ে কেউ জানবে না।অন্তত আমি না চাওয়া অব্দি।আমরা পাবলিক প্লেসে একজন অন্যজনকে চিনবো না।রাজি?”

আরজু হেবলার মতো তাকিয়ে মাথা নেড়ে হে জানালো।আর মনে মনে ভাবলো আপনাকে পাবার জন্য আমি সব শর্তে রাজি নেতা সাহেব।আরজু নিজেকে বাহ! বাহ! জানালো।শেষ পর্যন্ত নেতা সাহেব তার কাছে ধরা দিতে যাচ্ছে।
নাহিদ একটু দূরে যেয়ে কাউকে কল করে ফিরে আসলো।আরজুর সামনে এসে বললো

-“চলুন মিস আরজু।”

আরজু চমকে বললো
-“কোথায়?”

-“চলুন দেখতে পারবেন।”

আরজু ভয়ে ভয়ে নাহিদের পিছু পিছু যেতে লাগলো।এই লোক তাকে ব্ল্যাকমেল করার অপরাধে গুম করে দিবে নাতো?

রেস্টুরেন্টের বাইরে বের হতেই আরজু দেখলো নাহিদের সব গার্ড তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে।আরজু ভীষণ ভয় পেলো।একটু আগে সে এই সিটির মেয়রকে মেরেছে ভাবতেই গা শিউরে উঠলো।কি কেলেঙ্কারি কান্ড ঘটিয়েছে।নাহিদ তার গাড়ির দরজা খুলে আরজুর উদ্দেশে বললো

-“উঠে বসুন আরজু।”

আরজু দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল।তবুও গাড়িতে উঠে বসলো।আরজু দেখলো নাহিদ গার্ডদের কিছু বলে তাদের বিদায় করে দিলো।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে।আরজু মাঝে মাঝে নাহিদের দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে।নাহিদের শরীরের মাতাল করা গ্রান আরজুকে বেসামাল করে দিচ্ছে।কিছুক্ষণ পর একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামলো।আরজু আশেপাশে তাকাতেই দেখলো একটা পরিচিত মুখ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।মানুষটি আরজুর পাশের দরজা হাসি মুখে বললো

-“ভালো আছেন আরজু?”

আরজু অবাক হয়ে বললো
-“আসফি ভাইয়া?”

আসফি মুচকি হেসে বললো
-“আসুন।”

আরজু গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো।তার আকাশী রঙের শাড়িটা অনেকটা এব্রো থেবড়ো হয়ে পড়েছে।নাহিদ এগিয়ে আসে আরজুর সামনে বসে আরজুর শাড়ির কুচি গুছিয়ে দিতে লাগলো।আরজু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এই নেতার এক দিনেই এতো পরিবর্তন।সত্যি আশ্চর্যজনক।

***********
আরজু সোফায় বসে আছে।আসে পাশে বার বার তাকাচ্ছে।বাড়িটা বেশ সুন্দর,গুছানো।এতক্ষনে জেনেছে এটা আসফির বাড়ি। আসফি নাহিদ আর আরজুর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।নাহিদ যখন কল করে বললো “আরজু তাকে ব্লাকমেইল করে বিয়ে করতে চাইছে “কথাটা শুনে আসফি হা হয়ে ছিলো।নাহিদকে কেউ ব্লাকমেইল করবে সেটা সে ভাবতেই পারেনি। আসফি হেসে বললো

-“এই অসাধ্য সাধন হলো কি করে?”

-“জানিনা।”

-“তাহলে কি করবি?”

-“তোর বাসায় কাজী ডাক।বিয়ে করবো।”

আসফি অবাক হয়ে বললো
-“আর ইউ সিওর?বুঝে বলছিস তো?”

-“হুম।”

********
আসফির হাসিতে নাহিদ বিরক্ত হয়ে আসফি কে উদ্দেশ্য করে বললো

-“উনি কোথায়?”

-“পাঁচ মিনিট লাগবে আসতে।”

আরজু কিছুই বুঝতে পারছে না।কে আসবে।পাঁচ মিনিট পর একজন লোক ভেতরে প্রবেশ করলো।লোকটিকে দেখে হুজুর বলে মনে হলো।তিনি আসতেই খাতায় কিছু লেখা শুরু করলো।আরজুর টনক নড়ল।সামনে কি হতে যাচ্ছে ভেবেই আরজুর সারা শরীর মৃদু কেপে উঠলো।সে ভেবেছে নাহিদ হয়তো বিয়ের জন্য কিছুদিন সময় নিবে।পড়ে হয়তো আরজুকে মানা করে দিবে।কিন্তু আরজু ভাবতে পারেনি সে আজই বিয়ে করবে।আরজুর অদ্ভুত অনুভূতি হলো।মানুষটি কতটা সৎ তার প্রমাণ সে আজ পেলো।নাহিদ নামক মানুষটির কথার মূল্য রাখতে জানে।আরজু আবার মানুষটির প্রেমে পরে গেলো।এই মানুষটিকে একান্তে নিজের করে পাবার খুশিতে আরজুর চোখ ভিজে উঠলো।নাহিদ তখন আরজুর কানে ফিসফিসিয়ে বললো

-“আপনি ঠিক আছেন।”

-“হুম।”

-“আমাকে ব্লাকমেইল করে বিয়ে করছেন।যেখানে আমার কান্না করার কথা সেখানে আপনি কাদছেন?বিয়ে ক্যান্সেল করে দিবো।”

আরজু চমকে উঠে বললো
-“একদম না।”

নাহিদ গম্ভীর সুরে বললো
-“তাহলে চোখের পানি মুছে নিন।সামনে কাজে দিবে।নিজ হাতে নিজের লাইফ নিয়ে খেলছেন। এখনো সময় আছে ভেবে নিন।পড়ে কিন্তু পস্তাতে হবে।”

আরজু চোখের পানি মুছে বললো
-“আমি পস্তাতে প্রস্তুত।”

-“ভেবে বলুন।একবার আমার হলে পড়ে কিন্তু আমার কাছ থেকে আপনার নিস্তার নেই।শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সব কষ্ট সহ্য করে আমার সাথেই থাকতে হবে।আমার মতো গম্ভীর মানুষকে টলারেট করতে হবে।”

-“আপনাকে সামলানো আমার দায়িত্ব।”

নাহিদ আর কিছুই বললো না।আরজুর মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।খালামণি কি খুব কষ্ট পাবে?না নিশ্চই না।খালামণি আমার সুখের জন্য হলেও সব মেনে নিবে। ইসস!আজ এই দিনে শুভ টা পাশে থাকলে ভালো হতো।ওর কাঁধে মাথা রেখে একটু ভরসা পাওয়া যেত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আরজু আর নাহিদ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর আর পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হলো।আরজুর ভাবতে অবাক লাগছে তার ভালোবাসার মানুষটি আজ থেকে তার স্বামী।সেই কাঙ্খিত পুরুষ যাকে একটা নজর দেখার জন্য আরজু ব্যাকুল হয়ে থাকতো সেই মানুষটি আজ তার স্বামী।আরজুর চোখ আবার ভিজে উঠলো। শেষ পর্যন্ত সে মানুষটিকে জয় করতে পারলো।আরজুর মনে হচ্ছে এই সুখে বোধয় তার মরণ হবে।

আসফি তাদের দুজনকেই মিষ্টি মুখ করালো।আর আরজুকে বললো

-“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি আমার বন্ধুকে ব্লাকমেইল করে বিয়ে করে ফেলেছ।”

আরজু থতমত খেয়ে গেল।ভীষণ লজ্জা লাগছে।জীবনে প্রথম আজ সে এতো বড় কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। আসফি আবার বললো

-“ভালই করেছ।নাহলে এই নিরামিষ ব্যাটা জীবনেও বিয়ে করত না।হ্যাটস অফ ইউ।”

আরজু শাড়ি অংগুলে পেচাতে লাগলো।আড়চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ আপন মনে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে।আরজুর রাগ হলো।পাশে সদ্য বিয়ে করা সুন্দরী বউ থাকতে এই লোক ফোনে কি দেখছে। ফোনটা আছার মেরে ভেঙে দিতে পারলে শান্তি লাগতো।

নাহিদ আরজুকে নিয়ে আসফির বাসা থেকে বেরিয়ে আসার আগে বললো

-“বিয়ের কথা যেনো আমাদের তিনজনের মধ্যেই থাকে।”

আসফি হেসে বললো
-“চিন্তা করিস না। বাই দ্যা ওয়ে তোর বাসায় কি বাসর ঘরের ব্যবস্থা করব?”

নাহিদ কড়া চোখে আসফির দিকে তাকালো। আসফি হেসে ফিসফিসিয়ে বললো

-“ভাবীকে বাসায় পৌঁছে এখানে চলে আসিস। সেলিব্রেশানের ব্যবস্থা করব।”

নাহিদ কিছু না বলেই আরজুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।সারা রাস্তা নাহিদ একবারও আরজুর দিকে তাকালো না। মুখমণ্ডলে গাম্ভীর্যতা বিদ্যমান। আরজু ভাবছে একবার কি নাহিদকে চুমু খেয়ে নিবে কিনা?পড়ে ভাবলো না। এমনি এই লোকের মাথা সে আউলে দিয়েছে। এখন কিছু করলে তুলে আছার মারবে।

নাহিদ আরজুর বাসার সামনে গাড়ি থামালো।আরজু ভাবছে নাহিদ একবার বলুক আরজু আপনি যাবেন না প্লিজ।কিন্তু নাহিদ তেমন কিছুই বললো না।শুধু বললো

-“ভালো থেকো আরজু।আসি।”

আরজু স্তব্ধ হয়ে গেল। বুক ধুকপুক ধুক পুক করতে লাগলো। এই প্রথম মানুষটা তাকে তুমি বলে ডেকেছে।আরজু গাড়ি থেকে নামতেই নাহিদ গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।আরজু মনে হাজারো অস্থিরতা আর ভালোলাগা নিয়ে বাসায় চলে গেলো।আজ কেমন করে মুহূর্তেই তার জীবনটা পুরোপুরি বদলে গেলো।ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে পেলে বুজি এমন সুখ অনুভব হয়?বাসায় পৌঁছাতেই দরজা খুলে দিলো সাবা খানম।আরজুর মনে হঠাৎ ভয় বাসা বাঁধলো।খালামণি সব জানলে কি হবে?সাবা খানম গম্ভীর মুখে আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।আরজু শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো।যা কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে এসেছেন।তখন ভয় না লাগলেও এখন ভীষণ ভয় পাচ্ছে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_24

রাত তখন প্রায় নয়টা বাজে।নির্জন রাস্তায় আজ মশার উপদ্রব অনেক বেড়েছে। রামিমের হাত পা মশার কামড়ে জায়গায় জায়গায় লাল হয়ে গেছে।রামিমের মনে হচ্ছে দুই একটা মশা তার প্যান্টের ভেতরে ঢুকে পড়েছে।এমন সব জায়গায় চুলকাচ্ছে কি বলবে?দুই একটা তো তার গালেও চুমু একেছে।সেখানে ভীষণ চুলকাচ্ছে।রামিম হাত চুলকাতে চুলকাতে সামনের অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় তাকালো।বারান্দার দোলনাটা ফাঁকা।এই সময়টায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটি প্রায়শ স্থানে বসে সময় পার করে। ঘন্টা খানেক আগে রামিম টিউশন শেষ করে এসেছে।বাসায় যাবার আগে একবার প্রিয়সীর মুখটা দেখার ইচ্ছে জাগলো।মেয়েটা মন খারাপ করে তার বাসা থেকে বেরিয়েছে।তখন অনেক কথা বললেও সাবিহার চাইতে নিজেরই বেশি কষ্ট হচ্ছিলো।

রামিম ভাবছে তাদের ভালোবাসা একতরফা হলেই ভালো হতো।সাবিহাকে শুধু সে সারা জীবন ভালোবেসে যেতো।কেউ বুঝতে না পারতো তবে ভালো হতো। আবার সাবিহা কখনোই জানতে না পারতো তবে বেশ হতো।কতই না ভালো হতো।মাঝে মাঝে একতরফা ভালোবাসা আশীর্বাদ সরুপ।

কিন্তু না।তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে।আর সেটা দুজনই উপলব্ধি করতে পারে।সাবিহা নিজের আবেগ কখনোই লুকাতে পারেনা।এই মেয়ের চোখ দেখেই মনে কথা বলে দেওয়া যায়।যেমন বন্ধুমহলের সকলেই জানে সাবিহার মনের কথা।রামিম বহু কষ্টে নিজের অনুভূতি আড়াল করে রাখে।তবুও বন্ধুমহল ঠিকই সেটা আন্দাজ করতে পারে।আসলে ভালোবাসার অনুভূতিকে লুকিয়ে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য।

হাজারো ভাবনার মাঝেই রামিমের চোখ আটকে গেলো বেলকনিতে।কালো টিশার্ট আর প্লাজো পড়ে সাবিহা বারান্দার দোলনায় এসে বসেছে।হাতে কফির মগ।রামিম হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল।এই সময় কে কফি খায়?এই মেয়ের বোধশক্তি একদম কম। হে কমই তো!নাহলে রামিম দের বাড়ির অবস্থা দেখার পরও এই মেয়ের পাগলামি কমেনা কেনো? রামিমের শক্ত বিছানায় এই মেয়ে ঘুমানোর কথা চিন্তা করে কি করে?রং উঠা স্টিলের আলমারির ভাঙ্গা দর্পণে নিজের মুখশ্রী দেখার কথা ভাবে কি করে এই মেয়ে?সাবিহার বাসার ব্যালকনি পর্যন্ত রামিমের রুম থেকে বড়। এত সব কিছু নিজ চোখে দেখেও এ মেয়ের আবেগে কোনো পরিবর্তন কেন আসে না?রামিম কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সাবিহার মলিন মুখশ্রীতে। এই মলিনতার কারণ রামিম নিজে।সাবিহা নিশ্চই অনেক কষ্ট পেয়েছে তার কথায়।কিন্তু কি করবে রামিম?সাবিহাকে এই অবাস্তবিক আবেগ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।কারণ তাদের কোনো ফিউচার নেই।এই রাজকুমারীকে জয় করার সাধ্য রামিমের নেই।

********
রাতের খাবার টেবিলে বসেছে আরজু।আজ খাবার কিছুতেই তার গলা দিয়ে নামছে না।অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।আজকের কথা মনে পড়লেই বুক কেপে উঠছে।জুবায়ের আহমেদ বিষয়টি লক্ষ্য করে সাবার দিকে তাকালেন।সাবা খানম স্বামীকে ইশারায় কিছু বললেন।অবনি খাবার চিবুচ্ছে আর বাবা মায়ের কান্ড দেখছে।তার দেখা পারফেক্ট কাপল এরা।অন্য সময় হলে সে বিষয়টি নিয়ে অনেক মজা করতো।কিন্তু আজ কিছুই বললো না।কারণ সে আজ কোচিং ফাঁকি দিয়েছে। হায়ার ম্যাথের কিছুই তার মাথায় ঢুকছেনা। অথচ আজ কিনা টেস্ট পরীক্ষা ছিলো? খাতায় শুধুমাত্র নিজের নাম লেখা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।ওই নিশান নামক রোবট মানকে অকারনেই মনে পড়ছে।পড়তে বসলেই সেদিনের কথা মনে পড়ে।এতো বেহায়া কি করে হলো সে?তার চাইতে এতো সিনিয়র লোককে কিনা কিস করে এসেছে?তার কিশোরী মন অদ্ভুত সব অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে।পড়ায় কিছুতেই মন বসছে না। তাইতো আজ ফাকি মারলো। কিন্তু কথা হচ্ছে মা কোনভাবে এই বিষয়টা জানলে তার ক্লাস নিয়ে ছাড়বে। তাইতো বিকেল থেকে সে অতি ভদ্র মেয়ের মত আচরণ করছেন।
জুবায়ের আহমেদ আরজুর উদ্দেশ্যে বললেন

-“কি ব্যাপার আরজু? খাচ্ছিস না কেনো, খাবার ভালো হয়নি?”

আরজু মুচকি হেসে বললো
-“না ভালো হয়েছে খাচ্ছি তো।”

-“ওই ডক্টর কে কেমন দেখলি? কথাবার্তা কিছু বলেছে নাকি তোকে তার সার্জারি এক্সপেরিয়েন্স বলে বোর করেছে?”

আরজুর বুকটা ধক ধক করছে।আজকের ঘটনা সম্পর্কে সে সবাইকে কি বলবে বুঝতে পারছে না।আরজু নিজের চিন্তাকে মিষ্টি হাসির আড়ালে রেখে জবাব দিলো

-“ডক্টর আমাকে মোটেও বোর করেনি।তবে সমস্যা হচ্ছে এই ডক্টর মোটেও সাস্থ্য সচেতন না।এক কাপ কফিতে সে তিনটা সুগার কিউব ইউজ করেছে।চিন্তা করা যায়?”

সাবা খানম আরজু কথায় মুচকি হাসলেন। কোন কারনে নার্ভাস হলেই রওশানের সুগার লেভেল কমে যায় এই কথাটা তিনি আগেই জানেন। তার মানে আরজুকে দেখে রওশন নার্ভাস হয়েছে। তিনি হানডেট পারসেন শিওর ছিল আরজুকে দেখার পর রওশান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে। কারণ আরজুর ছবি দেখে এই ছেলেটা অস্থির হয়ে পড়েছিল। তাহলে শাড়ি পরিহিত রূপবতী আরজুকে দেখে রওশানের নার্ভাস হওয়াটাই স্বাভাবিক।আরজুর সম্মতি পেলেই তিনি আর দেরি করবেন না।মেয়েটাকে একটা ভরসাযোগ্য হাতে সঁপে দিতে পারলেই মন শান্ত হবে।তার বিশ্বাস রওশান পারবে আরজুর মাথা থেকে নাহিদের ভুত নামাতে।নাহিদের কাছথেকে আরজু যত দূরে থাকবে ততই ভালো।নাহিদ নামক ছায়া তিনি তার পরিবারে কিছুতেই পড়তে দিবে না।

আরজুর কথা শুনে জুবায়ের আহমেদ হো হো করে হেসে উঠলেন।আর বললেন
-“বেচারা আমার মেয়েকে দেখে ভরকে গেছে।তাই হয়তো সুগার লেভেল কমে গেছিলো।”

অবনি মুচকি হেসে বললো
-“পাপা তুমি হাসছো?যেই ডক্টরের আপুকে দেখেই হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে যায় সেই ডক্টরের সাথে আপুর বিয়ে দিবো না।আপুর জন্য প্রয়োজন রাফ অ্যান্ড টাফ কাউকে।যাকে দেখলে উল্টো আপুর হাত পা কাপবে।”

আরজু রক্তিম চোখে অবনির দিকে তাকালো।অবনি যে ইনডাইরেক্ট নাহিদের কথা বলছে সেটা বুঝতে আরজুর বুঝতে সময় লাগলো না।অবনি মেকি হেসে বললো

-“না মানে তোমার সেফটির একটা বিষয় আছে না?এই ডক্টর তো শুধু ওটি তে মানুষ কাটতে পারে বাস্তবিক লাইফে তো আর কাটতে পারবে না।দেখা গেলো বিপদ দেখে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে তোমাকে রেখেই পালালো।”

সাবা খানম অবনীকে ধমক দিয়ে বললেন
-“ফালতু কথা বলা বন্ধ কর। আর তুই আজকে কোচিংয়ে কেন যাসনি?”

এই যা! অবনী যেই ভয় পাচ্ছিল সেটাই হলো।নিশ্চই ওই তারা মায়ের কানে এই কথা পাচার করেছে। কেন যে সে মুখ বন্ধ করে রাখতে পারে না। এবার মায়ের একগাদা বকা শুনতে হবে।অবনি দ্রুত খাওয়া শেষ করে টেবিল ছেড়ে পালালো। সাবা খানম দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার সরাসরি আরজুকে জিজ্ঞাসা করলেন

-“রওশন কে কেমন লাগলো তোর? ভালো না লাগলে সরাসরি বলতে পারিস।”

আরজু কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রওশন মানুষটাকে তার ভীষণ ভালো লেগেছে। মানুষটাকে নিয়ে নেগেটিভ বলার মত সাহস আরজু পেল না। তাই মেকি হেসে বললো

-“তার মধ্যে ভালো না লাগার মত কিছু নেই। তোমার পছন্দে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই খালামণি। তবে এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারছি না।”

সাবা খানম জানে খুব সহজে আরজু সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারে না।আরজুর সময়ের প্রয়োজন। তিনিও এতে দ্বিমত করলেন না। জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত হুট করে নেওয়া যায় না। তিনি আরজুর উপর কোন রকম প্রেসার ক্রিয়েট করতে চান না। ধীরে সুস্থে নিজের লাইফের ডিসিশন নিক। তবে মনের কোনে একটা ভয় ঠিকই রয়েই গেলো।

**********
বিছানায় শুয়ে এপাস ওপাশ ঘুরছে আরজু।কোনো ভাবেই ঘুম আসছে না।আজকের ঘটনার পর নাহিদ নিশ্চই তাকে চরম বেহায়া মেয়ে ভাবছে।ভীষণ খারাপ মেয়ে ভাবছে।আরজু নিজেও জানেনা তখন তার কি হয়েছিল।নাহিদকে নিজের করে পাবার অদম্য ইচ্ছা তাকে ঝেকে ধরেছিল।মনে হয়েছে আজ তাকে না পেলে আর কোনদিনই পাওয়া হবে না।

আরজুর হঠাৎ মুচকি হাসলো।নাহিদ তার স্বামী ভাবতেই আরজুর সারা শরীর শিউরে উঠলো।নিঃশ্বাস ঘন হতে লাগলো।হঠাৎ আরজুর মনে পড়লো সে তো নাহিদের নাম্বার নিতেই ভুলে গেছে।একবার নাহিদ যেই নম্বর থেকে কল করেছিলো সেটা তো বন্ধ।আরজুর নিজের উপর ভীষণ রাগ হলো।এমন বোকামির মানে হয়?সে কিনা একমাত্র বউ যে তার বরের নম্বর অব্ধি জানেনা?কিন্তু নেতা সাহেব তো জানেন।তবে তিনি কেনো একটাবার তাকে কল করছে না?আরজু কি মানুষটার মনের বিরুদ্ধে এই বিয়ে করতে বাধ্য করলো? একরাশ বিষণ্ণতা আরজুর মনকে ঘিরে ধরলো।এই মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছে না।

ফোনের রিংটোন বেজে উঠলে আরজু ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।দ্রুত স্ক্রিনে তাকায়।ভেবেছিল তার নেতা সাহেব হয়তো কল করেছে।কিন্তু না।দেখে শুভ কল করেছে। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে শুভ বলে উঠলো

-“থাপড়িয়ে না তোর গাল লাল করে ফেলবো।”

আরজুর মন নিমিষেই ভালো হয়ে উঠলো।শুভর উপস্থিতি বরাবর তাকে উচ্ছ্বাসিত করে তুলে।এই মানুষটিকে কিছু না বললেও আরজুর মনের খবর পেয়ে যায়।আরজু খিল খিল করে হেসে উঠলো।আরজুর হাসির শব্দ শুভর অস্থির হৃদয়কে শান্ত করে তুললো।রাতের বাজে স্বপ্নটার পর থেকেই আরজুকে নিয়ে ভীষণ চিন্তা হচ্ছিলো।আরজুকে হারাবার ভয় বাড়তে লাগলো।

আরজু বললো
-“কেনো?আমি আবার কি করলাম?”

-“এই বাঁদর সারাদিন কই থাকিস?কল করলে ধরিস না। বিকেলে বাসায় গেলে শুনি শপিংয়ে বেরিয়েছিস?মাসে কয়বার শপিং করা লাগে তোর?আংকেল আন্টির কষ্টের টাকা না উড়ালে শান্তি লাগে না?বিয়ের পর যত খুশি জামাইর টাকা উড়াস? কিছু বলবো না।”

-“আমার জামাইর টাকা উড়ালে উড়াব তোর কি?”

শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
বিরবির করে বললো “আমারই তো সব।”

-“যা খুশি করিস।পড়ে জামাইয়ের বকা খেয়ে আমার সামনে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে আসিস না। না হলে কান বরাবর চারটা লাগাবো।”

আরজু মুচকি হেসে বেলকনিতে গেলো।যা ভেবেছে তাই।শুভ তার বাসার সামনে।বাইকে বসে কথা বলছে। আরজু বললো
-“পাঁচ মিনিট দারা আমি নামছি। আইসক্রিম খাব।”

শুভ বেলকনিতে তাকিয়ে দেখলো আরজু দাড়িয়ে আছে।মৃদু চাঁদের আলোয় আরজুর মায়াবী মুখটা দেখে শুভর অস্থির ,তপ্ত হৃদয় মোমের মতো গলতে শুরু করল।আরজুর মিষ্টি হাসি তার মনে সকল ক্লান্তি নিমিষেই দুর করে দেয়।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আরজু নেমে আসলো। ব্ল্যাক টিশার্ট আর জিন্স প্যান্ট পরা আরজুকে দেখে শুভ শুকনো ঢোক গিললো।আর কতবার ঘায়েল করবে এই মেয়ে।শুভ বাইক থেকে নেমে আরজুর সরু নাক টেনে বললো

-“এতো রাতে নিচে নামলি কেনো?এই রাতে আমি আইসক্রিম পাবো কোথায়?”

আরজু কপাল কুঁচকে নাক ঘষে বললো
-“ফালতু কথা কম বল।আজ প্রথম রাতে বের হয়েছি নাকি?”

-“আন্টি তোকে লাই দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছে।কি বলে এসেছিস?”

-“বলেছি এক বাঁদর আমাকে সারাদিন না দেখে পাগল হয়ে গেছে।ওই বাঁদরের চুল ছিঁড়ে আসি।”

শুভ হেসে বললো
-“চিন্তা করছি তোকে বিয়ে করে ঘর জামাই হয়ে যাবো।আর তারা বিবির নাগিন রূপ দেখবো।দিন রাত আমাকে দেখে ফোঁস ফোঁস করবে।আর ফানা তুলে আমাকে কামড়াতে আসবে।”

আরজু মুচকি হেসে বাইকে উঠে বির বির করে বললো
-“বিয়ে তো করেই আসলাম।কিন্তু বরের কোনো আতাপাতা নেই।নেতা সাহেব ঘর জামাই হলে মন্দ হতো না।ঘরে ঢুকেই দেখতাম নেতা সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছে।যখন তখন চুমু খেয়ে তার গম্ভিরতার রফাদফা করে ফেলতাম।তখন তারার জায়গায় খালামণি চলে আসবে নাগিন হতে।দুজনের মদ্যকার ক্লেস দেখতে ভয়ানক হবে।”

শুভ যত্ন সহকারে আরজুর মাথায় হেলমেট পরিয়ে বাইক বসলো।শুভর বাইক চলতে শুরু করল।আরজু মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে।আর মন ভালো করার মেডিসিন শুভ।তাই তো এই রাতে শুভর সাথে বেরিয়েছে।ছোটবেলা থেকেই আরজুর মন খারাপ করলেই শুভ ছুটে আসতো আরজুর মুখের হাসি ফুটিয়ে তুলতে।আরজুর ফোলা ফোলা গাল টেনে নানা বাহানায় তাকে হাসাতো শুভ।

**************
আইসক্রিম পার্লারের সামনে দাড়িয়ে দুজন আইসক্রিম খাচ্ছে।আরজুর ফেভরেট স্ট্রবেরি আর ম্যাংগো ফ্লেভার। আর শুভর বাটারস্কচ।শুভ আরজুর দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর বললো

-“আরজু কিছু হয়েছে?মন খারাপ?”

আরজু চমকে শুভর দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিল।চঞ্চলচিত্তে বললো
-“কই না তো?”

-“কিছু লুকাচ্ছিস আমার কাছ থেকে?”

আরজু মনে মনে ভাবছে “তোকেই আমি সবার আগে বলতে চেয়েছিলাম শুভ।আজ বিয়ের সময়টায় মনে মনে তোকেই আমার পাশে চেয়েছি।যেমনটা সব সময় থাকিস।কিন্তু নেতা সাহেব আমাকে শর্ত দিয়েছে।তাইতো কিচুই বলতে পারছে না।” আরজু হেসে বললো

-“কি লুকাবো?তুই বেশি ভাবছিস।”

শুভ আরজুর কাছে এসে গালে স্পর্শ করে নরম সুরে বললো
-“জীবনে যদি কোনোদিন সামান্যতম সমস্যায় পড়িস তবে এই বন্ধুটিকে একবার মনে করিস।তোর সব সমস্যা,দুঃখ কষ্টের ভার এই শুভ নিজের কাধে নিবে।তোর বিষণ্ণ মুখ কিন্তু আমি সহ্য করতে পারিনা।এই মায়াবী চোখে নোনাপানি একদম মানায় না।জীবনেই যে কোনো ক্রিটিক্যাল মুহূর্তে আমাকে তোর পাশে পাবি।”

আরজুর দুচোখ ভিজে উঠলো।জীবনে এমন একজন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।এই বন্ধুত্ব আরজু কোনোদিন হারাতে চায়না।আরজু ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো।বললো

-“ইসস!!আমাকে একদম ইমোশনাল করে দিলি।আমার পাশে এই ভাবে তো তোকে থাকতেই হবে।নাহলে তোর মাথায় কোনো চুল আস্ত থাকবে না।তোর ফিউচার বউকে আগেই বলে দিবি আমাকে নিয়ে যেনো হিংসা না করে।”

শুভ হেসে বললো
-“আমার বউ কি তোর মতো বলদি হবে নাকি?”

আরজু হাতের আইসক্রিম শুভর মুখে মাখিয়ে দিলো।আর বললো
-“এখন তোকে বাঁদর লাগছে।একদম লেজ কাটা বাঁদর।”

শুভ আরজুর চুল টেনে বললো
-“দারা তোকে আজ এই মাঝ রাস্তায় ফেলে যাবো।”

-“কচু করবি।”

দুজনে মধ্যে খুনসুটি শুরু হয়ে গেলো।
কিছুটা দুর থেকে আড়ালে কেউ একজন আরজু আর শুভর কিছু ছবি তুলে নিলো।সে ছবি গুলো দ্রুত কারো কাছে সেন্ড করে দিলো।ফোনের স্ক্রিনে এই ছবি দেখে একজনের মুখে অদ্ভুত হাসি দেখা গেলো।যে হাসিতে হাজারো রহস্য লুকিয়ে আছে।

*************
আসফির বাসার ছাদে বসে আছে নাহিদ।এক হাতে একটা বেয়ারের ক্যান।আর অন্য হাতে সিগারেট।কিছুটা নেশা চরে গেছে তার। সচরাচর নাহিদ তেমন একটা ড্রিংক করে না।মাঝে মাঝে বন্ধুদের আড্ডায় পড়লে করা হয়।তবে সিগারেট তার নিত্য দিনের সঙ্গী। আসফি বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে এই বেবস্থা করেছে।তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ফাইনালি একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে।সেলিব্রেশন তো হবেই। আসফি বেয়ারে চুমক দিয়ে নাহিদের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।নাহিদের চোখে মুখে গুরুগম্ভীর ভাব বিদ্যমান। আসফি বললো

-“হঠাৎ এই বিয়ের ডিসিশন কেনো নিলি?তুই তো এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলি?”

নাহিদ সিগারেট ধোঁয়া ছাড়িয়ে বললো
-“জানিনা।তবে তার মধ্যে আমার জন্য এক অদৃশ্য অধিকারবোধ দেখেছি।যেটা অন্য কেউ কোনোদিন দেখানোর সাহস পায়নি।তাকে উপেক্ষা করা আমার সাধ্যের বাইরে ছিল।”

আসফি হঠাৎ হো হো করে হাসতে লাগলো।নাহিদ আসফির দিকে ব্রু কুচকে তাকিয়ে বললো
-“হাসছিস কেনো?”

-“ভাবী ভাবছে তোকে ব্লাকমেইল করে বিয়ে করেছে?লাইক সিরিয়াসলি?মেয়র নিবরাস নাহিদকে আদো ব্লাকমেইল করা সম্ভব?”

নাহিদ কিঞ্চিৎ ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো।যেই হাসি অন্য কেউ বুজবে না।বিড়বিড় করে বললো
-“রূপবতী মেয়েরা একটু বোকাই হয়।”

আসফি আবার হেসে বললো
-“কি কপাল তোর।এতো নাটকীয়তার পর বিয়ে করে যেখানে বাসর করবি তা না করে আমার সাথে মদ গিলছিস।আরজু ভাবির কপাল পুড়লো তোর মতো আনরোমান্টিক জামাই পেয়ে।আচ্ছা একবার কল করেছিস নাকি সেটাও করিস নি?”

-“আমার কাছ থেকে দূরে থাকাটাই ওর জন্য মঙ্গলজনক।”

আসফি এবার সিরিয়াস হয়ে বললো
-“যেহেতু সম্পর্কে জড়িয়েছি,সেটার যথাযথ মূল্যায়ন করিস।যেই ফুল তোর জীবনে নিজে থেকে এসেছে তাকে মূর্ছা যেতে দিস না।”

নাহিদ শান্ত চোখে আকাশের দিকে তাকালো।নাহিদের নিরবতায় আসফি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।নাহিদের ভাবাবেগ কিছুই ধরতে পারলো না।এই কঠিন হৃদয়ের মানুষটিকে আরজুর মত মায়াবিনী,কোমলমতি নারী কি পবিত্র সম্পর্কের জোরে গলাতে পারবে না?নাকি নাহিদ নিজেকে সব কিছু থেকে ঘুটিয়ে নিবে? এবার অন্তত ছেলেটা সেটেল হোক।জীবনের সকল জটিলতা আর অনিশ্চয়তা ভুলে সামনে এগিয়ে যাক।

চলবে……..

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_25

সকালের মিষ্টি দমকা হাওয়া উপভোগ করছে জারা।সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গার ফলে সে পার্কে চলে এসেছে হাঁটতে।এমনিতেও সকাল সকাল হাঁটার বেশ সুবিধা ও পাচ্ছে।রিসেন্ট একটা ফটোশুট আছে তার।জারা সবসময় ফিট থাকলেও পরীক্ষার ধকলে ওজন একটু বেড়েছে তার।পরীক্ষার সময়টায় অন্যদের টেনশনে ওজন কমে।কিন্তু জারার তেমন কিছুই হয়না।কারণ তার টেনশন শুরু হয় পরীক্ষার হলে পৌঁছানোর পর।পরীক্ষায় তার একমাত্র ভরসা রিমি আর রামিম।পড়ালেখা জিনিসটাই জারার অপছন্দ।তার উপর পরীক্ষার ঝামেলা তো আছেই।তবে টেনশনে থাকলে তার খাওয়ার ক্রিভিং বেড়ে যায়।যার ফলে ওজন কিছুটা বেড়েছে।ফটোশুটের আগে ওজন কমানো জরুরী।

জারা নিজের মনকে এইসব বলে সান্তনা দিলেও ঘটনা আসলে একটু ভিন্ন।মূলত প্রতিদিন সকালে একটা কল তার শান্তির ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।ব্যাক্তিটি কল করে কিছুই বলেনা।জারা ভীষণ বিরক্ত এই কলদাতার উপর।সে তো কাউকে তার এলার্ম হতে বলেনি?তবে এই বান্দা এতো কষ্ট করে দায়িত্ব নিয়ে তার ঘুমের রফাঁদফা করে ছারে।কল সাইলেন্ট করেও লাভ হয়না।তার বাসার ল্যান্ড ফোন কল করে সারা বাড়িকে জাগিয়ে তুলে।একবার এই লোককে পেলে সে নিমের ডাল দিয়ে পিটিয়ে সোজা করে ফেলবে।

জারা অনেকটা হেঁটে হাপিয়ে উঠেছে। পাশের বেঞ্চে বসে পড়লো সে।বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করলো। জোরে শ্বাস নিয়ে পাশে তাকাতেই চমকে গেলো।অসাবধানতায় কিছুটা পানি তার ফতুয়া তে পড়লো।জারা চোখ বুজে বক্ষস্থলে হাত চেপে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। পাশেই বসে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে জাহিদ।আকর্ষিক ভাবে সামনে জাহিদকে দেখে ভয় পেয়ে গেছিলো।জারা ছোট করে দম ফেলে বললো

-“বেয়াদব ছেলে!!এমন ভূতের মতো এসে পাশে কেউ বসে?একটু জন্য হার্টফেল করিনি।”

জাহিদ মুচকি হেসে বললো
-“আপনার হার্টফেল করানোর ইচ্ছা আমার নেই।আমি তো আপনার হার্ট ছিনতাই করবো।বুজলেন?”

জারা হা করে তাকিয়ে রইল।এই পিচ্ছি ছেলে সেই লেভেলের ফ্লার্ট করতে জানে।জারা ক্ষিপ্ত গলায় বললো

-“তোমাদের জেনারেশন টাই খারাপ।সিনিয়র দের সম্মান করতে জানোনা।উল্টো ফ্লার্ট করো।অথচ আমাদের সিনিয়র দের আমরা কত সম্মান করতাম।”

-“আপনাকে আমি অসম্মান কখন করলাম?আপনাকে অসম্মান করার প্রশ্নই আসেনা।আফটারোল বাচ্চাদের মা আপনি?”

জারা ব্রু জোড়া কুচকে বললো
-“কার বাচ্চার মা?”

-“আমাদের।”

জারা দাতে দাঁত চেপে নিজের রাগ দমনের চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।হাতের বোতলের সব পানি জাহিদের মুখে ছুড়ে করলো।জাহিদের মুখভঙ্গি ছিলো খুবই স্বাভাবিক।যেনো এমন কিছু হবে সেটা আগে থেকেই জানতো।হাত দিয়ে মুখের পানি মুছে নিলো।কপালে লেপটে থাকা চুল হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিলো।জারা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো

-“অসভ্য ছাগল একটা। ফারদার আমার সামনে এমন কথা বললে মাথায় ইট ছুড়ে মারবো।তখন মাথার ভুত ‘মাগো মাগো ‘বলে পালাবে।”

জাহিদ জারার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো
-“আপনি নামক ভুত আমার মাথা থেকে কোনো দিনই পালাবে না জারা।”

জারা হচকিয়ে গেলো।বুকের বা পাশে যেনো কেউ ঢোল পেটাচ্ছে।পুরুষালী সুগ্রান জারার মস্তিষ্ককে বিক্ষিপ্ত করে তুলছে।জারা ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেললো।এই অসভ্য ছেলেটা মাঝে কিছু একটা আছে যেটা ওকে দারুন ভাবে আকৃষ্ট করে।

*************
সকালে ঘুম ভাঙতেই আরজু আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো।এলোমেলো কেশ গুলো খোপা করে সামনে তাকালো।দেখলো অবনি বিছানার সাইডে বসে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।আরজু হাই তুলতে তুলতে বললো

-“সকাল সকাল আমার রুমে কি তোর?”

-“আপু আজ তুমি বেশ গ্লো করছো।একদম নতুন বউদের মত।আসল ঘটনা কি বলতো?বিয়ের ফুল ফুটলে নাকি মেয়েরা আরো রূপবতী হয়ে যায়।তুমি সাক্ষাৎ প্রমাণ।আচ্ছা!!! ওই হাতুড়ে ডাক্তারকে দেখে মেয়রকে ভুলে যাওনি তো?ওই ডক্টরের বউ হওয়ার পরিকল্পনা করছো নাতো?আমার কিন্তু ডক্টর দুলাভাই পছন্দ না।মেয়র দুলাভাই পছন্দ। আহা!!এলাকায় আমার দাপট থাকবে অন্যরকম।তখন এলাকার সবাই আমাকে দেখেই সালাম দিবে।নেতার শালীকা বিষয়টা ইন্টারেস্টিং হবে কিন্তু।”

আরজু এক নজরে অবনির দিকে তাকিয়ে রইলো।অবনি বেশি কথা বলে।তারচেয়েও বেশি।তবে খুব বলতে ইচ্ছে করলো

-“বোন তুই অলরেডি নেতার শালীকা হয়ে বসে আছিস।কিন্তু ওই ভন্ড নেতা আমাকে চুমু খেয়ে বিয়ে করে হাওয়া হয়ে গেছে।আর আমি বেকুব বরের নাম্বার অব্ধি জানিনা।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আরজু।সকালে ঘুম থেকে উঠে নেতা সাহেবের মুখদর্শন করতে পারলে বেশ হতো।আল্লাহ জানে ওই দিন কবে আসবে।অবনীকে বললো

-“তোর কলেজ নেই?খালামণি কই?”

-“আম্মু আজ স্পেশাল নাস্তা রেডি করছে।তার মন আজ বেশ ফুরফুরে।তোমাকে বিদায় করার খুশিতে সে সকাল সকাল পাপকে দুধ চা অব্দি এলাও করেছে।সকাল থেকেই সে তারা কে নিয়ে রান্নায় ব্যাস্ত।ভাবলাম নাস্তা করেই কলেজে যাবো।”

আরজু জানে খালামনির খুশির কারণ।কিন্তু যখন সত্যিটা জানবে তখন খালামণি কেমন রিয়্যাক্ট করবে কে জানে।নিশ্চই ভীষণ কষ্ট পাবে?রাজনীতিবিদদের খালামণি ভীষণ অপছন্দ করে।কারণটা আরজুর সঠিক জানা নেই।কিন্তু আরজু নিজের মনকে কিছুতেই নাহিদের কাছথেকে দূরে রাখতে পারেনি।মানুষটির দিকে অদ্ভুত ভাবে ঝুঁকে পড়েছে।নাহিদের ব্যাক্তিত্ব তাকে ঘায়েল করেছে ক্ষণে ক্ষণে।

***********
রিমি ভার্সিটির জন্য তৈরি হয়ে নিলো।রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো নিশান হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হচ্ছে।রিমি অবাক হলো।বলো

-“কি ব্যাপার ভাইয়া?এমন হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছো?”

-“অফিসে।আমি অলরেডি একঘন্টা লেট।”

রিমি বিস্মিত হয়ে গেলো।তার ভাই ভীষণ পানচুয়াল। কখনোই কোনো কাজে লেট করেনা।তবে লাস্ট কয়দিন যাবত তার ভাই রোজ লেট করে অফিসে যাচ্ছে।রিমি চিন্তিত হয়ে বললো

-“ভাইয়া কোনো সমস্যা?কয়দিন যাবত ঘুম থেকে উঠতে লেট করছো?চোখের নিচে কেমন ফুলে আছে।রাতে কি ঘুমাওনি?”

নিশান হতবম্ব হয়ে রিমির দিকে তাকালো।সে কি করে বলবে যে আজকাল তার রাতে ঠিক মত ঘুম হয়না।হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে তার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।নারীসঙ্গ থেকে দূরে থাকা নিশান সেই বাচ্চা মেয়েটির সংস্পর্শে এসে বরবাদ হয়ে গেছে।ওই বদমাশ,বাচাল মেয়েটা তাকে কিছুতেই ঘুমাতে দিচ্ছে না।কি সর্বনাশ করে গেলো সেই মেয়েটি?নিশান বেশ বিরক্ত হলো।মেয়েটাকে সামনে পেলে ঠাটিয়ে একটা চর মারবে।নির্বোধ মেয়ে একটা।সেদিন কি সাংঘাতিক কাজটা করে বসলো।

রিমি নিশানের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো
-“হ্যালো!! ভাইয়া কোথায় হারিয়ে গেলে?”

নিশান নিজেকে সামলে নিয়ে বললো
-” পড়ে কথা বলি।লেট হয়ে যাচ্ছে।”

কথাটি বলেই নিশান দ্রুত বেরিয়ে গেলো।রিমি ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

ক্যান্টিনে আসর জমিয়েছে বন্ধুমহল।আজ তাদের লাস্ট ইয়ারের প্রথম ক্লাস হবে।তাই প্রেসার অনেক কম।আরজু কোল্ড কফিতে চুমুক দিয়ে সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। গরমে তার ফর্সা মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে।শুভ হেসে বললো

-“কোল্ড কফিতে হবে নাকি এক্সট্রা বরফ আনব মাথায় ঢালার জন্য।”

-“ফাজলামি করিস না। গরমে জীবন শেষ আমার।”

জারা মিরোরে নিজের মুখ দেখে নিয়ে বললো
-“আমাদের প্লে বয় আসেনাই কেনো?আর রামিম কই?আচ্ছা ফুয়াদ কি আসলেই বর্তমানে সিঙ্গেল ঘুরতেছে?আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।নাকি শালা ফাঁপড় মারতেছে?ওর ওই নেকা জিএফ এর সাথে নাকি ব্রেকআপ হয়ে গেছে।নিশ্চই আরেকটা জোগাড় করে ফেলেছে।কুত্তাটা গফ ছাড়া সারভাইভ করতে পারে না।”

রিমি কফিতে চুমুক দিয়ে বললো
-“আই থিঙ্ক আমি ফুয়াদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখতে পারছি।”

জারা বললো
-“কি সেটা?”

-“দেখ!আগে ফুয়াদ সকাল সকাল ভার্সিটিতে বা গফ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতো।কিন্তু আজকাল ওর গফ নাই বলে দাবি করছে।সত্য মিথ্যা আল্লাহ মালুম!! আগে ভার্সিটিতে এসে ক্যান্টিনে নাস্তা করতো কিন্তু এখন বাসা থেকেই নাস্তা করে আসে। আই থিঙ্ক আন্টি আংকেলের সাথে ওর সম্পর্কটা সহজ হচ্ছে।”

আরজু মুচকি হেসে বললো
-“আই ডোন্ট থিঙ্ক সো।ফুয়াদের মধ্যকার পরিবর্তন আমিও দেখেছি।কিন্তু সেটার কারণ আংকেল আন্টি না।অন্য কিছু।”

শুভ হেসে বললো
-” গফ সংক্রান্ত ব্যাপার হলে আমাকে নিশ্চই বলতো।তাছাড়া আংকেল আন্টির সাথে এতদিনের দূরত্ব এতো সহজে দুর করা ফুয়াদের জন্য অসম্ভব।ফুয়াদ ভীষণ জেদী।”

জারা হেসে বললো
-“ওই শালা নিশ্চই কোনো মেয়ের পাল্লায় পড়েছে।”

জারার কথায় সবাই হেসে উঠলো।আরজু খেয়াল করলো সাবিহা চুপচাপ বসে আছে।আরজু সাবিহার কানে ফিসফিসিয়ে বললো

-“মন খারাপ কেনো তোর?তোর গাধা একটু পরই চলে আসবে।”

সাবিহা থমথমে ভাবে বললো
-“ওই গাধা আসুক না আসুক আমার কি?”

-“তাই!! নেকা!!!ওই গাধার জন্যই তো মরে যাস।”

সাবিহা ভেজা চোখে আরজুর দিকে তাকালো।আরজু সাবিহার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো।প্রিয় মানুষটির অবহেলা হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। সবাইকে একবার দেখে নিচু সরে সাবিহাকে বললো

-“রামিম যদি তোর ভাগ্যে থাকে তবে সব বাধা পেরিয়ে দিন শেষে তোর ভালোবাসার মানুষটি তোরই থাকবে।রামিম তোকে ভালবাসে সেটা তোকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।উপরওয়ালা মাঝে মাঝে আমদের পরীক্ষা নেন। ধৈর্য রাখ দেখবি সবটা তোরই থাকবে।কথাটা মিলিয়ে নিস।”

সাবিহা ভেজা চোখে মুচকি হেসে বললো
-“তুই ও তো একজনের মাঝে আটকে আছিস।আচ্ছা তুই কি আসলেই নাহিদের স্যারের ব্যাপারে সিরিয়াস?না মানে বিষয়টা একটু জটিল কিনা?”

আরজু মুচকি হেসে সাবিহার কানে ফিসফিসিয়ে বললো
-“আই অ্যাম ড্যাম সিরিয়াস।একদম তার বাচ্চা কাচ্চার মা হওয়ার মতো সিরিয়াস।”

সাবিহা ফিক করে হেসে দিলো।আরজু আসলেই একটা পাগলী।মেয়রের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে একদম বাচ্চা কাচ্চা অব্দি চলে গেছে।এই চঞ্চল মেয়েটা যেনো তার মতো মানসিক কষ্টে না ভোগে।এই মিষ্টি হাসিটা যেনো আরজুর অধরে আজীবন থাকে।কারণ ভালোবাসার মানুষটির অবহেলা একদম ভেতরটাকে গুড়িয়ে দেয়।আর আরজু তার চাইতেও বেশি ইমোশনাল।

তাদের আড্ডার মাঝেই রামিম সেখানে পৌঁছালো। রামিমের ঘামার্ত মুখখানা দেখে সাবিহার ইচ্ছে হলো গলার স্কার্ফ দিয়ে সেই ঘাম মুছে দিতে।কিন্তু সেই অধিকার তার নেই।রামিম আড়চোখে সাবিহাকে দেখে আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়লো।যেনো সাবিহা সেখানে ইনভিজিবল।সাবিহার সাথে কোনো কথাই বললো না।এমনকি সেদিনের ব্যাবহারের জন্য সরি অব্দি বললো না।সাবিহার অভিমানী মন পণ করলো সে রামিমের সাথে কোনো কথাই বলবে না।কখনোই না।

**********
ফুয়াদ জ্যামে আটকে আছে। আজ ঘুম থেকে উঠতে লেট করেছে।লামিয়া তার জন্য নাস্তা রেডি করে বেরিয়ে গেছে।ফুয়াদের কিছুটা মন খারাপ হয়েছে।মেয়েটা প্লেটে খাবার তুলে না দিলে সে খেয়ে তৃপ্তি পায়না।তাইতো আজ নাস্তা না করেই বেরিয়েছে।গাড়িতে বসে হঠাৎ ফুয়াদের চোখ যায় রাস্তার পাশে।সেখানে লামিয়া দাড়িয়ে আছে।তার সাথে ছোট একটা মেয়ে।সম্ভবত ক্লাস সিক্স সেভেনে পরে।মেয়েটা কেঁদে কেঁদে লামিয়াকে কিছু বলছে আর লামিয়া মেয়েটাকে কিছু বুঝাচ্ছে।ফুয়াদ কৌতুহলী হয়ে পাশেই গাড়ি পার্ক করলো।লামিয়ার পেছনে দাড়াতেই তাদের কথোপকোথন শুনতে পেলো।মেয়েটা বলছে

-“আপু এইসব পুরনো বই দিয়ে আমার পড়তে মন চায় না।মাঝে অনেক পেজ মিসিং থাকে।”

ফুয়াদ উকি দিয়ে দেখলো লামিয়ার দুই হাতে বেশ কয়েকটা পুরনো জীর্ণ শীর্ণ বই।লামিয়া এক হাতে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি হেসে বললো

-“যেই পেজ মিসিং থাকবে সেটা বন্ধুবিদের কাছ থেকে ফটোকপি করে নিবি।আরে পুরনো বইয়ের গ্রানই অন্য রকম।তাছাড়া নতুন বইয়ে যা লেখা আছে পুরনো বইয়ে তাই আছে।তফাৎ কি?”

মেয়েটি কিছুটা রেগে বললো
-“তফাৎ কি তুমি জানোনা?এই সব ছেরা বই আমি লজ্জায় বন্ধুদের সামনে বের করতে পারি না।নিজে ছেড়া বই পড়তে বলে আমাকেও ছেড়া বইই পরাবে?এসব আমি নিবো না।”
বলেই মেয়েটা সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো।লামিয়া জোরে ডেকে উঠলো

-“লামিসা !লামিসা!”

কিন্তু মেয়েটি ফিরে তাকালো না।মুহূর্তেই লামিয়ার আখিপল্লব ভিজে উঠলো।হাতের বই গুলো বুকে চেপে ধরে অন্য হাতে চোখের অশ্রুকণা মুছে নিলো।ফুয়াদ বুঝলো সেই মেয়েটি লামিয়ার ছোট বোন।ফুয়াদ পেছন থেকে লামিয়ার মাথায় টোকা মারলো।লামিয়া চমকে পিছন ফিরে তাকালো।ফুয়াদকে দেখে চমকে বললো

-“আপনি?”

-“হুম।তুমি এই সময় আমাদের বাসায় না থেকে এইখানে কি করো? হুম?”

-“আসলে স্যার একটা দরকার ছিলো তাই আজ একটু আগে বেরিয়ে গেছি।”

-“তোমার হাতে কি?”

লামিয়া বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো
-“বই।”

-“কিসের বই?”

-“আমার ছোট বোনরে বই।”

-“এতো পুরনো বই পড়তে পারবে ও?”

-“বিদ্যা অর্জনে নতুন আর পুরনো কি?বিদ্যা অর্জন করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।”

লামিয়ার সহজ উক্তি ফুয়াদের মন ছুঁয়ে গেলো।সে হেসে বললো
-“সামনে তো তোমার পরীক্ষা।গাইড বই কিনেছো?”

লামিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।গাইড বই তো দূরে থাক সে মেইন বইও কিনতে পারেনি।ইংরেজি সেকেন্ড পেপার বইটা সে লাইব্রেরী থেকে বরো করে পড়ে।লামিয়া মেকি হেসে বললো

-“গাইড বইয়ের প্রয়োজন নেই।ক্লাস করেই আমি অনেকটা কাভার আপ করে ফেলেছি।”

ফুয়াদ সবটাই বুঝলো।হঠাৎ বুকের কোথাও সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব হলো।এই বাচ্চা মেয়েটা কি কঠিন বাস্তবতা মধ্য দিয়ে জীবন পার করছে।হাজারো প্রতিকূলতার মাঝে নিজের বোনের প্রতি কতটা দায়িত্বশীল।এই নারী আর তার মায়ের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।মেয়েটার কাছ থেকে মায়ের অনেক কিছু শিখার আছে।মেয়েটা সম্পর্কের গুরুত্ব বোঝে আর তার যথাযথ সম্মান করে।পৃথিবী বড়ো অদ্ভুত। এখানে এক নারী নিজের আপনজনদের একটু ভালো রাখার জন্য অসীম চেষ্টা করে যাচ্ছে।ওপর দিকে আরেক নারী নিজের ক্যারিয়ারের উপরে অন্য কিছু কোনোদিন ভাবতেই পারেনি।

***********
নাহিদ আজ এসেছে নুর ম্যানশনে।দাদীকে অনেকদিন যাবত দেখা হয়না।প্রায়ই কল করে কান্নাকাটি করেন।তাই আজ সময় বের করে এসেছে।এই বাড়িটি তার দাদির নামে নামকরণ করা হয়।শৈশব কাল এই বাড়িতে কেটেছে নাহিদের।কিন্তু বর্তমানে এই বাড়িতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।বেশ কয়েক বছর আগেই সে এই বাড়ি ছেড়েছে।বর্তমানে সে যে বাড়িতে থাকে সেটা তার দাদাজান তাকে গিফট করে গেছেন।

নাহিদ অনেকক্ষণ যাবত দাদীর পাশে বসে আছে।তিনি নাতিকে দেখে এতক্ষণ ফ্যাচ ফ্যাচ্ করে কেদেছে।এতে নাহিদের বিরক্তির পরিমাণ বেড়েছে।কারণ তার শুভ্র পাঞ্জাবি দলেমুচড়ে দিয়েছে নুর জাহান।তিনি ফুপিয়ে বললেন

-“তুই একটা পাষাণ।তোর মনে কোনো মায়া নাই।এই বুড়িকে একটুও মনে পড়েনা তোর।একটাবার আমাকে দেখতে আসিস না।তোর দাদাজান থাকলে কি এমন করতে পারতি?ওই লোক নিজে চলে গেলো আর আমাকে এই পাষাণ দুনিয়ায় ফেলে গেলো।”

নাহিদ দাদির হাতে চুমু খেয়ে বললো
-“কে বলেছে তুমি বুড়ি? ইউ আর দা মোস্ট গর্জিয়াস উইমেন আই এভার সীন।”

নূরজাহান খানিকটা লজ্জা পেলেন।সচরাচর তার নাতি মানুষের প্রশংসা করে না।তিনি নাক টেনে বললেন
-“আমাকে পেম্পার করার কোনো দরকার নেই।তোকে কতদিন ধরে দেখি না।”

-“আমি ব্যাস্ত থাকি দাদী।”

-“এই রাজনীতি ছেড়ে দে নাহিদ। এখানে জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।এই রাজনীতির জন্যই তোর দাদাজানকে আমি হারিয়েছি।তোকে হারাতে চাইনা।”

নাহিদ মুচকি হেসে বললো
-“তুমি একজন দায়িত্ববান পলিটিশিয়ানের ওয়াইফ হয়ে এসব বলছো?মৃত্যুর ভয় করে কি জনসাধারণের সেবা করা সম্ভব।তোমার নাতি ভীতু ,কাপুরুষ না।যে কিনা মৃত্যুর ভয়ে হেরে যাবে।”

নূর জাহান আফসোসের সুরে বললেন
-“যখন বিয়ে করবি তখন বুঝতে পারবি কেউ একজন তোর অপেক্ষায় বসে থাকে।তোর সুস্থতার জন্য উপরওয়ালার কাছে ফরিয়াদ করে।তোর প্রতিটা নিঃশ্বাসে সে সস্তি খুঁজে পাবে।তোর ঘরে ফেরা অব্দি দরজায় দাড়িয়ে থাকে।”

নাহিদ পিটপিট চোখে দাদীর দিকে তাকালো।সেই অপেক্ষা করার মানুটি যে তার জীবনে এসে পড়েছে।সে জানে একজন রাজনীতিবিদের স্ত্রী হওয়া এতো সহজ বিষয় না।অনেক কিছু সেক্রিফাইস করতে হয়।নিজের ব্যাক্তি স্বাধীনতা হারাতে হয়।আরজুর মতো চঞ্চল মেয়ে কি পারবে তার জীবনে সাথে মানিয়ে নিতে? নাকি আরজুর আবেগ সময়ের সাথে সাথে ফিকে পড়ে যাবে?

ভাবনা থেকে বেরিয়ে বললো
-“দাদী তোমার ছেলের বুলি কেনো আওড়াচ্ছ?নাকি সে তোমাকে হায়ার করেছে আমার ব্রেইন ওয়াশ করার জন্য?”

-“আমার ছেলে তোর পাপা হয়।”

-“জানি।”

নূর জাহান এবার নাহিদের হাতে হাত রেখে বললেন

-“এবার সংসারী হো নাহিদ।তোর একটা সংসার দেখে মরতে চাই।জীবনে একটা স্থিরতা ভীষণ প্রয়োজন।তুই যে ভবঘুরের মতো চলছিস এতে সুখ নেই।নির্দিষ্ট একজনের আগমনে তোর জীবনটা দেখবি কেমন রঙিন হয়ে উঠে।করো মায়ায় আটকে পড়লে বুজবি ভালোবাসার মানে।ছন্নছাড়া জীবনে কোনো সুখ নেই।”

নাহিদ মায়াভর চোখে দাদীর দিকে তাকায়।এই মায়ায় সে না নিজে আটকাতে চায়।আর না কাউকে সেই মায়ায় বাঁধতে চায়।

নাহিদ হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললো
-“দাদী আই হ্যাভ টু গো নাও।একটা প্রোগ্রাম আছে।”

নূরজাহান নাতির কপালে চুমু খেলেন।এই ছেলেটি তার স্বামীর জান ছিলো।নাহিদকে সব সময় নিজের পাশে পাশে রাখতেন।মানুষটি চলে যাবার পর থেকে ছেলেটাও ধীরে ধীরে পরিবার থেকে দূরে চলে যেতে থাকে।কেমন ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে।নিজেকে সব সম্পর্ক থেকে গুটিয়ে নিয়েছে।তবে তার বিশ্বাস নাহিদের জীবনে এমন কেউ আসবে যে নাহিদকে এক আকাশ ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখবে।যেই মায়া ছেড়ে নাহিদ বের হতে পারবে না।সে মায়ার জোড়েই ছেলেটা আবার এই পরিবারে ফিরে আসবে।