মিহুর সংসার পর্ব-০৫

0
3146

#মিহুর_সংসার
#পর্বঃ৫

মেয়েরা একজন আরেকজন কে দেখে মনের আনন্দে জড়িয়ে ধরলেও আমরা স্বামীরা তা করতে পারছি না।

কারণ আমরা জানি এই সাতটা দিন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আমাদের উপর দিয়ে সুনামি বেয়ে যাবে সেই সাথে সবাইকে নয় নম্বর মহা বিপদ সংকেত মোকাবেলা করে চলতে হবে।

মেয়েরা এসে প্রথমেই হোটেল ম্যানেজমেন্ট এর কাছ থেকে যার যার রুমের চাবি নিয়ে চলে গেল।

যাওয়ার সময় আমাদের বলল,
– ব্যাগ-ট্যাগ আর লাগেজ গুলো যেন ঠিক ভাবে উপরে নিয়ে আসি।এই ব্যাগ গুলোতে তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র রয়েছে।

পাশে থাকা সব বরদের উদ্দেশ্যে বললাম,
– কেমন আছেন ভাই আপনারা সবাই?

একজন বলল,
– আগে ভালো ছিলাম না,ভাই।একটু শান্তির জন্য এখানে এসেছিলাম।এখন বোধহয় আগের চেয়ে খারাপ দিন পার করতে যাচ্ছি।

আরেক জন বলল,
– সবই কপাল ভাই।আমাকে কত সুন্দর সুন্দর কথা বলে এখানে নিয়ে আসলো।আমাকে বলেছিল,
কক্সবাজার গিয়ে আমরা অনেক মজা করবো।
সে ঠিকই বলেছিল কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি যে সেই আমরা কথাটার ভিতরে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।আমরা বলতে সে তার বান্ধবীদেরকে ইঙ্গিত করেছিল।

সবাই হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি।তবে সবচেয়ে বেশি হতাশ দেখা যাচ্ছে নিতুর জামাইকে।সে এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।কিন্তু এই ছেলেটিই সবচেয়ে চঞ্চল ছিল।প্রোগ্রামের দিন সে-ই অতি আবেগে গাছে উঠে পরেছিল শুধুমাত্র নিতুর নাচ দেখার জন্য। আবার আমাকে দেয়ালের উপরে উঠানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব তারই ছিল।

এখন এভাবে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে বললাম,
– ভাই, এভাবে বসে না থেকে চলুন হোটেলে যাই।

সে জবাব দিলো,
– মিহু ভাই, কত আশা নিয়ে এসেছিলাম!
এদিকে আমার চাকরিটা থাকবে কিনা জানি না।একমতো জোর করে নিয়ে আসলো নিতু আমাকে। শেষ-মেষ কোনো কিছু না ভেবে চলে আসলাম।এখন আসার পর এগুলো কি মেনে নেওয়া যায়?

– আমারও মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তবে মেনে তো নিতেই হবে।আমরা তো ওদের এখানে ফেলে রেখে এখন চলে যেতে পারি না।তারা তাদের মতো মজা করবে আর আমরা আমাদের মতো মজা-ফূর্তি করবো।

আমার কথায় সহমত পোষণ করে কয়েকজন বলল,
– সেটা না হয় মেনে নিলাম।কিন্তু আমাদের এভাবে বোকা বানিয়ে নিয়ে আসা কি ওদের ঠিক হয়েছে?

আমি বললাম,
– অবশ্যই ঠিক হয়নি।তবে এখন থেকে যাতে আমাদের আর বোকা বানাতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।ওরা আমাদের বোকা কেন বানাতে পেরেছে জানেন আপনারা?

নিতুর জামাই জবাব দিল,
– কারণ আমরা বোকা।বোকাদের সবাই বোকা বানাবে এটাই স্বাভাবিক।

– জ্বি না ভাই।ওরা বোকা বানাতে পেরেছে কারণ ওদের মধ্যে একতা আছে কিন্তু আমাদের মধ্যে তা বিন্দু পরিমানেও নেই।আমাদের সেই শেষবার দেখা হয়েছিল প্রোগ্রামের দিন। এরপর আর কথা হয়নি।কিন্তু ওরা সব সময় একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ রাখে।আজ যদি আমাদের মধ্যেও যোগাযোগ ভালো থাকতো তাহলে আমরা আগে থেকেই সব কিছু বুঝতে পারতাম। তাহলে এতো সহজেই বোকা বানাতে পারতো না।

– একদম ঠিক কথা বলেছেন।এবারই শেষ, এরপর থেকে তাহলে আমরা আর বোকা হচ্ছি না।এখন থেকে আমরাও তাদের মতো ঐক্যবদ্ধ ভাবে চলবো।

নিতুর জামাই বলল,
– সবচেয়ে ভালো হয়, আমরা যে বিবাহিত এই বিষয়টা এক সপ্তাহের জন্য ভুলে গেলে।এখন থেকে মনে রাখবেন,
” আমরা ছয় বন্ধু ঘুরতে এসেছি।আমাদের সাথে আর কেউ আসেনি।আসলেও ওদেরকে আমরা চিনি না, আমাদের কেউ নেই।”

– মনের কথা বলেছেন ভাই, এখন বেশ আরাম বোধ করছি।চলেন রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেওয়া যাক।

এই সব হোটেলের রুম বুক করার দায়িত্বও তুলি নিজেই খুশী মনে নিয়েছিল।না জানি কি আছে এখন কপালে!

ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে যেই রুমে ঢুকতে যাবো তখন-ই দেখি তুলি সহ বাকি মেয়েরা একটা ডাবল বেডের রুম দখল করে রেখেছে। এক-এক বেডে তিনজন করে ভালো ভাবেই শুয়ে পরা যাবে।দুই বেডে ছয়জন বসে আড্ডা জমিয়ে দিয়েছে।

আমি গিয়ে বললাম,
– তুলি, আমার তো খুব ক্লান্ত লাগছে।আমাদের রুম কোনটা?

– পাশেরটা।সেখানে গিয়ে শুয়ে পরেন।

– তুমি আসবে না?

– না, আমরা মেয়েরা এই রুমে থাকবো।আর আপনারা পুরুষরা সব ঐ রুমে থাকবেন।
আমি বললাম,
– এটা কোনো কথা?
একসাথে আড্ডা দাও ঠিক আছে। তাই বলে আমরা এক রুমে ঘুমাবো আর তোমরা অন্য রুমে এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়?
তাহলে তো আমাদের পুরুষদের আসার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।

তুলি আহ্লাদের স্বরে বলল,
– এ কেমন কথা বলছেন?
আপনি-ই তো প্রথমে এখানে আসার কথা বলেছিলেন।তাহলে আপনাকে ছাড়া আসি কি করে?
তাছাড়া হোটেলে বিবাহিতদের জন্য ত্রিশ পার্সেন্ট ছাড় চলছে।শুধু আমরা আসলে কি সেই ছাড় পাওয়া যেত?

– বাহ! তুমি তো বেশ সংসারী মেয়ে।কিন্তু কি লাভ এত সংসারী হয়ে যদি ঠিক ভাবে সংসারটাই করতে না জানো।

– আপনি কি সবার সামনে আমাকে অপমান করে কথাটা বললেন?
একটু ঘুরতে এসেও শান্তি নেই।সারাদিন বাসায় বসে থাকি তখন তো কোনো খবর নেন না, এখন একটু আড্ডা দিচ্ছি সেটা আপনার সহ্য হচ্ছে না।কথা গুলো বলার সাথে সাথেই তুলির চোখ দিয়ে জল পরা শুরু হয়ে গেল।

সাথে আরও বলল,
– আগে যদি জানতাম এখানে এসেও কাঁদতে হবে তাহলে সবার আগে টিস্যু নিয়ে আসতাম।ব্যাগে করে তো কোনো টিস্যুও আনিনি।

পাশে থাকা মেয়েগুলোর মধ্য নিতু নামের মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– আপনার এভাবে কথাগুলো বলা উচিৎ হয় নি মিহু,ভাই।ফরহাদ যদি আমাকে এই কথা গুলো বলতো তাহলে খবর করে ছাড়তাম।

আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিতুর জামাই ফরহাদ বলল,
– নিতু, কি দরকার এসব কথা সবার সামনে বলার। আমাদের মধ্যে যা হয় তা সবাইকে জানানোর তো কোনো দরকার নেই, তাই না?
আর মিহু ভাই তো খারাপ কিছু বলে নি।উনার কথায় তো ন্যায্য অধিকার ফুটে উঠেছে।

নিতু দাঁত কামড়ে বলল,
– বাসায় যাওয়ার পর তোমাকে ন্যায্য অধিকার শিখাতে হবে।
এরপর তুলির দিকে একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল,
– এই নে টিস্যু।চোখের জল মুছে নে।যে তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারে না তারজন্য তুই কেনো মন খারাপ করে বসে বসে কাঁদবি।সেই ব্যক্তির সাথে-ই মন খারাপ করে কাঁদা যায় যে তোর মন খারাপের কারন বুঝতে পারে।

আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম,
” কি নিঁখুতভাবে কথার প্যাচ দিয়ে আমাকে দোষী বানানো হচ্ছে।এদিকে তুলিও কাঁদছে।তাই কিছু বলারও সাহস পাচ্ছি না।এখন বুঝতে পারছি, শুধুমাত্র নারীজাতির চোখের পানি সহ্য করতে না পেরে যুগে যুগে অনেক পুরুষ অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের সংযত রেখেছেন। এখানে অবস্থানরত আমরা ছয়জন পুরুষও সেই দলে।

আমি বললাম,
– তর্ক করার কোনো দরকার নেই তো।কিছুদিনের জন্য সবাই মজা করতে এসেছি, মজা করেই চলে যাবো।তুলি তুমি চোখ মুছে ইচ্ছামতো আড্ডা দাও।আমরা চলে যাচ্ছি।আর বিরক্ত করবো না।

একে একে সবাই মেয়েদের রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

এরপর যে যার মতো হাত-মুখ ধুয়ে রাতের খাবার সেরে ফেললাম।

রাত দশটা বাজে।সবাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রয়েছি।কারো চোখেই ঘুম আসছে না।

সবার মনের অবস্থা উপলব্ধি করে আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম,
– এভাবে মন খারাপ করে শুয়ে না থেকে চলেন আমরাও আড্ডা দেই।
একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে আমার। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে খুব লজ্জা পাচ্ছি।

বাকি সবাই বলল,
– আরে লজ্জা কীসের ভাই?
আপনি কি মেয়ে নাকি?
আজকাল তো মেয়ে মানুষের মুখেও লজ্জা উঠে যাচ্ছে।আপনি পুরুষ হয়ে কেন লজ্জা পাচ্ছেন?

– না মানে, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে যে এখানে বিবাহিতদের মধ্যে কার কার লাভ মেরেজ ছিল?

আমার কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে রুমের সব পুরুষই লজ্জাই পরে গেছে শুধুমাত্র আমি ছাড়া।

সবার মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে বললাম,
– আপনাদের সবারই কি লাভ মেরেজ ছিল?

মুখ দিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না।নিতুর জামাই ফরহাদ ছাড়া সবাই হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।

আমি বললাম,
– ভাই, আপনারা জেনে শুনে কেন এদের গলায় ঝুলতে গেলেন?

কেউ কোনো কথা বলছে না।মনে মনে সবাই আফসোস করছে বোধহয়।

তবে আমি বেশ ভালোই মোটিভেশান পেলাম।
ওদের লাভ মেরেজ হয়ে যদি এই অবস্থা হতে পারে তাহলে আমার ক্ষেত্রে হওয়াটা তো স্বাভাবিক।আমার তো এরেঞ্জ মেরেজ।

ফরহাদকে বললাম,
– ভাই আপনার কি তাহলে এরেঞ্জ মেরেজ ছিল?

– কিছুটা।

– কিছুটা মানে?
খুলে বলেন,ভাই।

– নিতু যখন ক্লাস টেনে পড়তো তখন থেকে তাকে ভালোবাসতাম।তাকে দেখার জন্য গার্লস স্কুলে উকি মারতাম।এরপর সে যখন গার্লস স্কুল পাশ করে অন্য কলেজে ভর্তি হলো আমিও তখন সেই কলেজে ভর্তি হলাম।যেই ছেলে কোনোদিন স্কুলে যেতো না ঠিক মতো, সেই ছেলে শুধুমাত্র নিতুকে দেখার জন্য নিয়মিত কলেজে যাওয়া শুরু করে।একবার ভেবেছিলাম, নিতুকে বলবো ভালোবাসার কথা।

আমরা অতি আগ্রহ নিয়ে ফরহাদের প্রেমের কাহিনী শুনতে লাগলাম।
– তারপর বলেন ভাই।থেমে গেলেন কেন ভাই?

– কিন্তু আমার আগেই কলেজের একটা ছেলে তাকে ভালোবাসার কথা বলে দেয়।নিতু তার গালে এমন জোরে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল এই চড়টা আমারও প্রাপ্য ছিল।
ছেলেটিকে নিতু বলেছিল,
– যোগ্যতা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলার জন্য।তার কাছে এই সব আবেগের কোনো দাম নেই।
এরপর আমিও বুঝতে পারি আবেগ দিয়ে কাজ হবে না।ভালো করে পড়াশোনা শুরু করে দিলাম।
পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা জব নিয়ে সোজাসুজি নিতুর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম।নিতুর বাবা-মাও রাজি হয়ে গেলো।
তারপর বিয়ে করে ফেললাম।কিন্তু নিতুকে এখনও বলতে পারিনি যে তাকে আমি সেই ক্লাস টেন থেকে ভালোবাসতাম।অবশ্য বললেও বিশ্বাস করবে না।সে শুধু শুধু আমাকে সন্দেহ করে।অথচ আমি তাকে ছাড়া কিছুই বুঝি না।

বেচারা ফরহাদের মুখে কথা গুলো শুনে আমরা সবাই আপ্লূত হয়ে পরলাম।সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না।

হঠাৎ আমাদের অবাক করে দিয়ে ঘরের দরজা দিয়ে নিতু ফরহাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– আমাকে আগে বলোনি কেন, এই কথা গুলো?

ফরহাদ বলল,
– তুমি কীভাবে শুনলে এই কথা গুলো?

– আমি আবারও সন্দেহের বসে দরজায় উকি দিয়ে দেখছিলাম তুমি কি করছো!
সন্দেহ করতে এসে ভালোবাসাটা বেড়ে গেল।

পাশে থাকা আমরা আবারও আপ্লূত হয়ে পরলাম।

আমি ভাবলাম তুলিও বোধহয় দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথা গুলো শুনছে।এই সুযোগে আমিও কিছু বলে ফেলি।

তাই আমিও বললাম,
– আমি এরেঞ্জ মেরেজ করেছি ঠিকই। কিন্তু আমিও তুলিকে খুব ভালোবাসি।কিন্তু তুলি সেটা কোনো ভাবেই বুঝতে পারছে না।অফিস থেকে ফেরার সময় তুলির জন্য ভালোবেসে কত কিছু নিয়ে আসি কিন্তু সে কোনো পাত্তাই দেয় না আমাকে।এমনকি সে যখন ঘুমিয়ে পরে তখন আমি আধ শুয়া অবস্থায় তুলির গালের কালো তিলের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি।কিন্তু তাকে কখনও বুঝতেও দেই নি।

আমি ভাবলাম, তুলিও বোধহয় নিতুর মতো দরজার ওপাশ থেকে আমার কাছে ছুটে আসবে কথাগুলো শুনে।এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে এরপর আমি হাত বাড়াবো সে আমাকে জড়িয়ে ধরবে।
কিন্তু দুই মিনিট অপেক্ষা করার পরও এমন কিছুই ঘটলো না।

আমি নিতুকে বললাম,
– তুলি কোথায়?
– সে তো লুডু খেলছে।কিছুক্ষণবপর আমরা কুতকুত খেলবো।

– তাহলে আমি এতক্ষন এই কথাগুলো কা কে শুনালাম?

(চলবে…)

© খাদেমুল আলম মিঠুন