#মিহুর_সংসার
#পর্বঃ৪
এদিকে তুলি আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে রুমে ঢুকে বলছে,
– এই নেন আপনার চা।
আমি বিরক্তির সুরে বললাম,
” এসব চা-টা আমার পাকস্থলী দিয়ে নামবে না।তুমি বরং কিছু কাঁঠাল পাতা আর ঘাস নিয়ে আসো। বসে বসে সেগুলো চাবাই।
আমিতো ছাগল।”
তুলি কোনো কথা না বলে চায়ের কাপটা পাশে থাকা টেবিলে রেখে তার রুমে চলে গেল।
তুলি রুম থেকে যাওয়ার পর তুহিন আমাকে বলল,
-তারপর কি হলো দুলাভাই?
গল্পটা শেষ করেন।
– তারপর আর কি হবে! ছাগলটা রাজকন্যার ভাইয়ের সাথে রাতে ঘুমিয়ে পরলো।বাকি গল্প আরেকদিন বলবো।
– না দুলাভাই, আজকেই বলুন।
– তারপরে কি হবে সেটা তো আমি নিজেও জানি না।চোখ বন্ধ করে এখন ঘুমানোর চেষ্টা করো।
শুক্রবার দিনটা শ্বশুর বাড়িতে থেকে শনিবার বিকালে নিজের বাসায় চলে আসলাম তুলিকে নিয়ে।
রবিবার সকালে অফিসে যাওয়ার আগে নাস্তা করতে টেবিলে বসেছি।টেবিলে বসে দেখি আজকের রুটি গুলো খুব সুন্দর গোল হয়েছে।একেবারে পূর্ণিমা চাঁদ যেটাকে বলে।
তুলিকে বললাম,
-আজকের রুটি গুলো তো খুব সুন্দর।খেতেও বেশ সুস্বাদু। ইচ্ছে করলে তো সব কিছুই পারা যায়।
খুশীমনে তুলি জবাব দিল,
-ধন্যবাদ আপনাকে।
কথাগুলো বলে তুলির দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম, সে একটা বিশেষ মেশিনে রুটি গুলো মোটা করে ফেলে দিচ্ছে তারপর সেখানে একটা ভালোভাবে চাপ দিচ্ছে।অতঃপর সেখান থেকে চাঁদ আকৃতির চ্যাপ্টা রুটি বের হয়ে যাচ্ছে।তুলি সেগুলো হাসিমুখে কড়াইয়ে ছেড়ে দিচ্ছে।
বিষয়টা বুঝতে পেরে তুলিকে বললাম,
– এতো দেখছি সব মেশিনের কারসাজি।তোমাকে প্রশংসা করা ঠিক হয়নি।
আমার কথায় সে বিশেষ কোনো গুরুত্ব না দিয়ে মনের সুখে রুটি বানিয়েই চলেছে।
আমি বললাম,
– আরো দুইটা রুটি নিয়ে আসো তো আমার কাছে।
-এখান থেকে নিয়ে যান।
-বাহ! কি সহজ জবাব।পাশের বাসার আনিছ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে ঐদিন দেখলাম,
আনিছ ভাই নাস্তা করছে আর ভাবি পাশে বসে আনিছ ভাইকে পাখা দিয়ে বাতাস করছে।
আহা! সে কি দৃশ্য, দেখে এতো ভালো লেগেছিল।
– ঢং কত! পাখা দিয়ে বাতাস করার কি দরকার?
বাসায় কি সিলিং ফ্যান নেই?
– সিলিং ফ্যান তো আছেই।কিন্তু পাশে বসে বাতাস করা হচ্ছে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।সেটা যদি তুমি বুঝতে তাহলে আমাকে রুটি রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসতে বলতে না।
– ভালোবাসা কি দেখানোর জিনিস নাকি?
যত্তসব ন্যাকামো। আমারও পরিচিত একজন ভাইয়া আর ভাবি ছিল।বাহির থেকে দেখে সবাই ভাবতাম তাদের মধ্যে অনেক মিল।এই ধরেন, ভাইয়া যখন অফিসে যেত ভাবি তখন গলায় টাই পরিয়ে দিত, খাওয়ার সময় বাতাস করতো, আরো কত কি!
দুই বছর পরে জানেন কি হলো?
আমি বললাম,
– কি আর হবে, বাচ্চাকাচ্চা-ই তো হওয়ার কথা।এত সুখি পরিবার আমার যদি থাকতো।তোমার কথাগুলো শুনে মনটা ভরে গেল।
– ঘোড়ার ডিমের সুখি পরিবার ছিল।দুইবছর পর তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়।এমনকি এটাও শুনেছিলাম, ভাবি নাকি সিলিং ফ্যানে ঝুলে পরার চেষ্টাও করেছিলো।চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের বাসা থেকে মানুষ এসে পরেছিল যে কারনে আর ঝুলতে পারেনি।
তুলির মুখে এই কথা শুনে হাত থেকে রুটি টা মাটিতে পরে গেলো সেই সাথে রুটি গলায় আটকে গিয়ে প্রচুর কাশি আসা শুরু করলো।
আমার কাশির শব্দ শুনে তুলি বলল,
– আর হ্যা, ভাইয়ার যখন কাশি আসতো ভাবি তখন ভাইয়াকে আদর করে পানি পান করিয়ে দিতো।
এখন বলো, আমি কি আপনার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসবো?
– না থাক, পানি কীভাবে পান করতে হয় সেটা আমি ভালোভাবেই জানি।এত ভালোবাসা দেখাতে হবে না।
– হুম, সেকারনে-ই তো বললাম ভালোবাসা দেখানোর জিনিস না।এটা আগে বুঝতে হবে এরপর অনুভব করতে হবে।
বিকাল তিনটা বাজে। অফিসের কাজকর্ম নিয়ে খুব ব্যস্ত আমি।অফিসের খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হচ্ছে যেটার দায়িত্ব পুরোপুরি আমার উপর।
তখন দেখলাম তুলি ফোন দিয়েছে।প্রথম বার ধরলাম না, দ্বিতীয় বার কেটে দিলাম।
সেই সাথে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম,
” এখন মিটিং এ খুব ব্যস্ত। একটু পর ফোন দিচ্ছি।”
কিন্তু আমার কথা না শুনে সে আবার ফোন দিতে লাগলো।
আমি মিটিং এ উপস্থিত সবার কাছে এক মিনিট সময় নিয়ে পাশের রুমে গিয়ে ফোনটা ধরে বললাম,
– কি হয়েছে?
বারবার ফোন দিচ্ছো কেন?
তুলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলল,
-আপনি তাড়াতাড়ি একটু চলে আসুন।ওরা আমাকে মেরে ফেলবে?
– কি বলছো এগুলো!
ওরা কারা?
আমি আসার পর দরজা লক করোনি?
তুলি ভয়ে ভয়ে বলল,
– করেছিলাম তো।কিন্তু ওরা আগে থেকেই বাসাতে ছিল।
– বলো কি!
ওরা কয়জন?
– দুইজন।
– ওদের কাউকে আগে থেকে চিনতে তুমি?
– হ্যা,চিনবো না কেন!
একজন তেলাপোকা আর আরেকজন হচ্ছে মাকড়সা।মাথার উপর সারাক্ষণ ঘুরাঘুরি করছে।আমার ভীষণ ভয় ভয় লাগছে।
তুলির কথা শুনে প্রথমে স্বস্তি বোধ করলেও তার বোকামির জন্য কিছুটা রাগও হচ্ছে।
বললাম,
-চোখ বন্ধ করে রাখো,এগুলো দেখার প্রয়োজন নেই।তারচেয়ে ভালো হয় তুমি ঘুমিয়ে পরো।আমি মিটিংটা শেষ করে দ্রুতই চলে আসবো।
– এতক্ষনে এগুলো আমাকে কামড়ে মেরে ফেলবে।
– তেলাপোকা আর মাকড়সা দুটোই খুব নিরীহ প্রাণী। দুশ্চিন্তা করার কোনো কারন নেই।
– আমি কিন্তু এখনই জানালা থেকে লাফ দিব।সাথে আবার দুইটা তেলাপোকাও জড়ো হয়েছে।
এই মেয়ের বিশ্বাস নেই।দেখা গেল সত্যি সত্যিই লাফ দিয়ে দিতে পারে।
মিটিং রেখে আমি অফিসে বসের রুমে গিয়ে বললাম,
-স্যার, আমাকে একটু বাসায় যেতে হবে এখনই।
– মিটিং কি শেষ হয়ে গেছে?
-জ্বি না, স্যার।অন্য কাউকে দিয়ে বাকিটা চালিয়ে দিন।বাসায় একটু সমস্যা হয়েছে।
আমার অবস্থা দেখে স্যার বললেন,
– তুমি এভাবে ঘামছো কেন?
কি সমস্যা আমাকে বলো?
– স্যার, বিষয়টি খুবই সাধারণ তবে অবহেলা করলে অনেক খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।
– বুঝিয়ে বলো।
– স্যার আমার স্ত্রীর রুমে একটা তেলাপোকা আর একটা মাকড়সা আক্রমন করেছে।সে এগুলোকে প্রচন্ড রকমের ভয় পায়।ফোন দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।আমাকে যত দ্রুত
সম্ভব বাসায় যেতে হবে।
স্যার আমাকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
– এই মিটিংয়ের এর চেয়ে তুমি তুচ্ছ বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছো,মিহু।
– বিষয়টি মনে হচ্ছে তুচ্ছ কিন্তু আমাকে ফোন দিয়ে বলল, বেশি দেরি হলে জানালা দিয়ে লাফ মারবে।আমার বাসা দু’তলাতে,স্যার।যেকোনো বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।আমার স্ত্রী খুব ভীতু স্যার।
– তোমার স্ত্রীর চেয়ে তুমি যে আরো বেশি ভীতু সেটা কি তুমি জানো?
-জ্বি না,স্যার।
– বিয়ে করেছো কতদিন হবে?
– দুই মাসের উপরে হবে।
– এই সময়ের মধ্যে নিজের স্ত্রীকে যে নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছে না, সে আমার অফিসের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রনে আনবে কি করে?
-স্যার, বেশি সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।অন্য কোনোদিন বেশি সময় নিয়ে অফিসের কাজ করে দিবো।আজকের মিটিংটা আপাতত অন্য কাউকে দিয়ে চালিয়ে দিন।
– ঠিক আছে।কিন্তু এরকম ছোট বিষয়ে আর কখনও ছুটি চাইতে আসবে না।অন্য কেউ বললে ছুটি দিতাম না কিন্তু তোমাকে দিচ্ছি কারণ তুমি সততার সাথে অফিসের কাজকর্ম করো এবং তা মনোযোগ দিয়ে।এখন যাও,
যত দ্রুত সম্ভব স্ত্রীর মায়া কাটিয়ে আবার অফিসে মনোযোগী হও।
– ধন্যবাদ,স্যার।
বসের সাথে কথা বলা শেষ করে একটা সিএনজি নিয়ে বাসায় এসে পরলাম।সিএনজিতে বসে কয়েকবার ফোন দিয়েও তুলির কোনো সাড়া পেলাম না।
অবশেষে বাসায় এসে নিজের পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।
ভিতরে ঢুকে দেখি তুলি বিছানায় ঘুমিয়ে পরেছে।হাত আর নাকের নিশ্বাস দেখে বুঝলাম,
সে ঘুমিয়ে পরেনি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পরেছে।দুই হাত দুইদিকে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় খুবই শক্ত।চোখ-মুখে দুই-চার ফোঁটা পানি ছিটাতেই সে সাড়া দিতে লাগলো।তবুও জ্ঞান ভালো ভাবে ফিরছে না।এরপর বালতি দিয়ে পানি এনে মাথায় দেওয়ার কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো।
জ্ঞান ফিরার পর শুয়া অবস্থা থেকে বালিস সোজা করে বিছানায় বসিয়ে বললাম,
– এভাবে ভয় পেলে চলে বোকা মেয়ে।আজকাল তো ছোট বাচ্চারাও তেলাপোকা, মাকড়সা নিয়ে খেলাধুলা করে।
তুলি কোনো কথা বলছে না।চুপচাপ অবুঝ বাচ্চাদের মতো বসে রয়েছে।
– কি হলো, কথা বলছো না কেন?
এবার মুখ থেকে কথা বের হলো।কিন্তু তা একেবারে আস্তে।
– আমার চোখের সামনে দুইটা টিকটিকি এসে মাকড়সাটাকে খেয়ে ফেলেছে।
কি ভয়ানক দৃশ্য!
কল্পনা করতে পারেন?
আর তেলাপোকাটা পুরো ঘর জুড়ে উড়াউড়ি শুরু করে দিয়েছিল।
চোখের সামনে এতগুলো দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে কি হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না।
– আচ্ছা, এসব কল্পনা বাদ দিয়ে ভালো করে চোখ মুখ ধুয়ে আসো।
তুলি ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে গেলে আমি ভাবতে লাগলাম এরকম আচারণ কি কোনো রোগ হতে পারে?
আমার বন্ধু হাসান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।তাকে ফোন দিয়ে বললাম সময় করে একদিন যেন তুলিকে দেখতে আসে।
দুইদিন পর বন্ধু হাসান আমাদের বাসায় আসলো।অফিস শেষে তাকে নিয়ে বাসায় ঢুকলাম।তাকে আলাদা ভাবে বুঝিয়ে সব কিছু বললাম সাথে এটাও বলে দিলাম তুলি যেন বুঝতে না পারে এই ব্যাপারগুলো।তুই আমার বন্ধু হিসেবে বাসায় আসবি।
এক দেড় ঘণ্টার মতো তুলিকে বিভিন্ন প্রশ্ন করলো হাসান।তুলিও নিজের মতো করে সব জবাব দিলো।
এরপর রাত আট’টার দিকে হাসানকে নিয়ে আমি বাসার বাইরে চলে আসলাম।
বাইরে বের হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– কেমন দেখলি?
কোনো সমস্যা মনে হয়েছে কি?
– না, তেমন কোনো সমস্যা মনে হয়নি।আমি যেটা বুঝলাম ছোট বেলা থেকে একদম পরিবার আর স্কুল কলেজের বাইরে কারও সাথে তুলি তেমন মিশেনি।এখনও ম্যাচুরিটি আসে নি মনের মধ্যে।এগুলো তেমন সমস্যা না, আস্তে আস্তে সব বুঝতে পারবে।
– তাহলে কি অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই?
– এক কাজ করতে পারিস।মাঝে মধ্যে অবসর সময় পেলে দুজনে একসাথে ঘুরতে বের হতে পারিস।সমাজের বিভিন্ন ধরনের মানুষদের খুব কাছ থেকে দেখলে খুব দ্রুত মনের মধ্যে পরিবর্তন এসে যাবে।বিয়ের পর দুজন একসাথে কখনও ঘুরতে গিয়েছিলি?
– না, সময় বের করা যাচ্ছে না।ভাবছি সামনে এক সপ্তাহের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিব।বসকে বললে না করবেন না।উনি আমাকে যথেষ্ঠ ভালোবাসেন।
– তাহলে ঘুরে আয় দূরে কোথাও প্রাকৃতিক পরিবেশে।
হাসানের কথা মতো অফিসের বসকে বুঝিয়ে শুনিয়ে এক সপ্তাহের জন্য ছুটি নিলাম।
স্যার তেমন কিছু বলেন নি।শুধু বলেছেন,
” ঘুরাঘুরি শেষ করে কাজে যেন ভালোভাবে মন দেই।”
শেষমেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এক সপ্তাহের জন্য আমরা ঘুরতে যাবো।প্রথম তিনদিন কক্সবাজার আর শেষের তিনদিন সাজেক।আর একদিন আসা-যাওয়াই লেগে যাবে।
সব পরিকল্পনা তুলি নিজে থেকেই করেছে।
সাথে এটাও বলেছে সেখানে যাওয়ার পর নাকি আমাকে বিশেষ সারপ্রাইজ দিবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কক্সবাজার যে হোটেল বুক করেছিলাম সেখানে পা রাখতেই আমি সত্যিই চমকে গেলাম।
তুলির পাঁচ-ছয় জন বান্ধবীও চলে এসেছে এখানে তাদের বর নিয়ে। সবার সাথে সেই মাস খানেক আগে তাদের স্কুল প্রোগ্রামে দেখা হয়েছিল।
মেয়েরা একজন আরেকজন কে দেখে মনের আনন্দে জড়িয়ে ধরলেও আমরা স্বামীরা তা করতে পারছি না।
কারণ আমরা জানি এই সাতটা দিন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আমাদের উপর দিয়ে সুনামি বেয়ে যাবে সেই সাথে সবাইকে নয় নম্বর মহা বিপদ সংকেত মোকাবেলা করে চলতে হবে।
(চলবে…)
© খাদেমুল আলম মিঠুন