#মৃণালিনী
#পর্ব ১৭
সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো, সৌম্য আজ বাড়ি যাবে, এখানে ফিরবে না। তাই অনেকদিন পরে আজ বাবা মেয়েতে সেই আগের মতো জমাটি গল্পের আসর বসেছিলো। বিয়ের আগের সেই দিনগুলো তে যেন কিছুক্ষনের জন্যে ফিরে গিয়েছিলো মৃণালিনী।
আরও পড়তে চাও তুমি, এটা আমার কাছে খুব আনন্দের। আর সৌম্য কে আমি যতদূর চিনি তুমি পড়তে চাইলে তোমার কিছু আটকাবে না। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে! শুধু ডিগ্রী বাড়ানোই যদি তোমার উদ্যেশ্য হয়, তাহলে কিন্তু এতো কষ্ট করে পড়াশুনা চালানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না! ভবিষ্যতে এই পড়াশুনার উপযুক্ত ব্যবহার কি কিছু ভেবেছো তুমি?
বাবার প্রশ্নে একটু অন্য মনস্ক হলো মৃণাল, ভেবেছে তো ও অনেক কিছু! কিন্তু সেসব যে খুব মসৃন ভাবে হবে না, সেটা ও কি ভাবেই বা বোঝাবে বাবা কে।
তুমি সম্ভবত দিশাহীন! তোমার নিশ্চুপ থাকা অনেকটা তাই বোঝাচ্ছে!
এবার সত্যিই লজ্জিত হলো মৃণাল, আস্তে ঘাড় নাড়লো,
না বাবা! দিশাহীন নই! আমি ওখানে একটা মেয়েদের স্কুল করার কথা ভেবেছিলাম। ওখানে কোনো মেয়ে এখনও পর্যন্ত স্কুলে যায়নি! সরমাও নয়! ভাবতে পারো বাবা!
সেতো খুব ভালো ভাবনা! এরকম কিছু করতে পারলে তবেই তো শিক্ষার সার্থকতা!
বাবার কথার পরেও খুব বেশি উচ্ছসিত হতে পারলো না মৃণালিনী, তার চোখের সামনে শুধুই শ্বশুর মশাই আর বড়ো মার মুখ ভেসে উঠতে লাগলো। মেয়ের মুখের মলিনতা রমণী বাবুর নজর এড়ালো না,
তুমি কোনো ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে আছো মনে হচ্ছে!
আসলে বড়ো মা বা আমার শ্বশুর মশাই বোধহয় আমার স্কুল তৈরির ইচ্ছে মেনে নেবেন না!
একটু অসহায় গলায় বললো মৃণালিনী, রমণী বাবু তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন।
বেয়াই মশাই যথেষ্টই বিচক্ষণ মানুষ, আজ না হলেও কাল তিনি গ্রামে মেয়েদের স্কুলের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই অনুধাবন করবেন। সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই নেই। আর তোমার বড়ো মার কথা যদি বলো, তাহলে আমারও ধারণা হয়ত উনি মত দেবেন না। সেক্ষেত্রে চেষ্টা তোমাকেই করতে হবে ! ওনার আপত্তির পেছনে যদি কোনো যুক্তি থাকে তাহলে সে যুক্তি খন্ডন করার মতো যুক্তিও তোমাকে প্রস্তুত করে রাখতে হবে। তবে তিনি অপমানিত হন, এমন কিছু নিশ্চয়ই করো না!
বাবার কথায় আবারও অন্য মনস্ক হলো মৃণালিনী,
বড়ো মা অপমানিত হন, এরকম কিছু তো ও কখনই করে না! তবে কেনো বড়ো মা ওকে পছন্দ করেন না! কেনো কথায় কথায় খুঁজে বের করেন ওর খুঁত! শুধু তো ওর ওপরেই নয়, বড়ো মা সবার ওপরেই রাগ দেখান! রাগ, চিৎকার ছাড়া বড়ো মা কে ও কখনও দেখেনি আজ পর্যন্ত! কিন্তু সবার ওপরে কেনো এতো রাগ তাঁর! অথচ নিজে তাকে অজস্র কড়া কথা শোনালেও কোনো দিনও তো বাইরের লোককে তাকে নিয়ে সমালোচনা করতে দেন নি আজ পর্যন্ত! যখনই বাড়ির বাইরের কেউ ওকে নিয়ে কিছু সমালোচনার চেষ্টা করেছে উনিই তো ওর ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন সব সময়।তাহলে কি কোথাও তাঁর এই কড়া ব্যবহারের পেছনেও লুকিয়ে রয়েছে একটা নরম মন! সেই মনের হদিস কি ও পাবে কখনও!! বুঝতে পারবে বড়ো মা কে!!
স্টেশনে যখন ট্রেন থেকে নামলো সৌম্য তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, এই প্রথম বার তার জন্যে গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো না। স্টেশন থেকে তাদের গ্রামে যাবার একটাই উপায়, হাঁটা, এত বছরেও অন্য কোনো উপায় এখনও নেই এখানে।
সৌম্যদের গ্রামের অবস্থা খুব খারাপ, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামে একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, আর নিজেদের গ্রামে একটা ছেলেদের প্রাথমিক স্কুল ছাড়া পরিষেবা বলতে কিছুই নেই। তাই গ্রামের উচবিত্তরা প্রাথমিক শিক্ষার পরে ছেলেদের কলকাতায় পড়তে পাঠালেও, বেশির ভাগ ছেলেই প্রাথমিকের পরেই পড়াশুনা শেষ করে। আর মেয়েদের জন্যে তো প্রাথমিক শিক্ষারও কোনো ব্যবস্থা নেই এখানে। বিদ্যুতহীন গ্রাম সন্ধ্যার পরে জনশূন্য হয়ে পড়ে একদম।
কি ভাই কেমন আছো? আজ গাড়ি কোথায় তোমার?
প্রশ্ন শুনে চমকে পেছনে তাকিয়ে সুরেশ কে দেখতে পেলো সৌম্য, সুরেশ প্রাইমারি স্কুলে ওর সহপাঠী ছিলো, বর্তমানে সেই স্কুলেরই হেড মাস্টার।
আজ না বলে হঠাৎই এসে পড়েছি ভাই, তাই হন্টনই ভরসা,
হেসে বললো সৌম্য,
আরে! তা কেনো! আমার সাইকেল আছে কি করতে! চলো উঠে পড়,
খানিকটা হলেও স্বস্তি পেলো সৌম্য, এই অন্ধকারে হাঁটতে হলে, কখন বাড়ি পৌঁছাতো কে জানে! সাইকেলে বসে দুজনের কথপোকথন চলতে লাগলো, প্রাথমিক স্কুলটাকে ম্যাট্রিকে উন্নীত করার জন্যেই যে তার আজকের সদরে যাওয়া সেটা কথায় কথায় জানালো সুরেশ। কিন্তু তার জন্যে আরও বেশি জায়গার প্রয়োজন, এইটুকু জায়গায় অতোগুলো ক্লাস ধরানো সম্ভব নয়।
সৌম্য একটু ভাবলো, তাদের জমির অভাব নেই, স্কুলের জন্য খানিকটা জমি তারা দিতেই পারে। কিন্তু বাবা যে বিনা পয়সায় সেটা দিতে রাজি হবেন না, সেটা সে জানে, তাই অন্য কিছু ভাবতে হবে! কথা বলতে বলতে গ্রাম এসে গিয়েছিলো, এবার দুজনের বাড়ি দু দিকে, ওখানেই সাইকেল থেকে নেমে পড়লো সৌম্য।
ভাই আসি তাহলে! তুমি চেষ্টা কর, জমি আমি বাবাকে বলে ব্যবস্থা করে দেবো,
সুরেশ কে বিদায় জানানোর আগে বললো সৌম্য, সুরেশ উৎফুল্ল হলো,
খুব উপকার করলে ভাই, যদি দিতে পারো, তাহলে গ্রামের ছেলেগুলো আরও কিছুটা পড়তে পারবে,
উপকার নয় এটা তো আমাদের নিজেদের জন্যেই করা, তুমি চিন্তা করোনা, আমি কিছু ব্যবস্থা করছি,
সুরেশ চলে গেলো, সৌম্য হাঁটতে হাঁটতে নিজের বাড়ির দরজায় পৌঁছে কড়া নাড়ল। কড়া নাড়ার আওয়াজে ভেতরে একটা শোরগোল পড়ে গেলো, এতো রাতে কে এসেছে দেখার জন্যে মোটামুটি সবাই বাড়ির দরজায় উপস্থিত হলো। গত পরশুই কলকাতা থেকে খারাপ খবর এসেছিলো, তাই আজ রাতে আবার অসময়ে দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজে কুমুদ মাথায় দু হাত ঠেকিয়ে বেয়াই মশাইয়ের সুস্থতার কামনা করতে লাগলেন।
বড়ো পাঁচ সেলের টর্চ নিয়ে এসে দরজা খুললো আলোক, এই বাড়িতে এই মুহূর্তে শক্ত সমর্থ পুরুষ বলতে একমাত্র সেই। দরজা খুলেই সৌম্য কে দেখে আলোক অবাক হলো, বাড়ির সবাই কোনো খারাপ খবরের আশঙ্কায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
বড়ো মা যাওয়ার আগে বলছিলেন হাঁটুর ব্যথাটা খুব বেড়েছে, তাই মৃণাল যখন বললো বাবা তার করে দিতে বলেছেন, তখন আমি ভাবলাম গিয়েই দিয়ে আসি খবরটা,
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো সৌম্য, কুমুদ কিছু বলার আগেই পারুল বালা খুশি মুখে এগিয়ে এলেন।
আর আমার হাঁটু! এই করেই চলে যাবে! তা বেয়াই মশাই ভালো আছেন তো?
বড়ো মার খুশি মুখ সৌম্যর নজর এড়ালো না,
এবার তোমাকে কলকাতায় নিয়ে যাবো বড়ো মা, ওখানে অনেক বড়ো বড়ো ডাক্তার বাবু আছেন,
সৌম্যকে থামিয়ে দিয়ে খুশি মুখে বললেন পারুল বালা,
ওসব একন থাক বাছা! সারাদিন পরে বাড়ি এলে, একন ঘরে চলো দিকি,
আলোক কে দরজা বন্ধ করে দিতে বলে বাড়ি ঢুকে এলেন পারুল বালা, পিছু পিছু সবাই। বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেলো, বউ কলকাতায় থাকা সত্বেও সৌম্য তাঁর জন্যে চিন্তা করেই বাড়ি চলে এসেছে, এই ভাবনাটুকুই সন্তানহীনা পারুল বালার জন্যে অনেক ছিলো, তিনি বাস্তবিকই খুশি হলেন। সৌম্য দোতলায় নিজের ঘরে উঠে যাবার পরে তিনি বামুন মেয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার জন্যে ভালো মন্দ কিছু করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ছেলে কে নিজের ঘরে চলে যেতে দেখে, আস্তে আস্তে কুমুদও পেছনে পেছনে উঠে এলেন। বড়ো মা যে তাকে দেখে বিরক্ত হন নি এটা বুঝে সৌম্যও শান্তি পেলো। অন্য সবার ক্ষেত্রে কড়া হলেও বড়ো মা যে তাকে সত্যিই খুব ভালো বাসেন এটা সৌম্য জানে। বড়ো মায়ের হাঁটুর জন্যে ফিরে গিয়েই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সত্যি কিছু করতে হবে মনে মনে ভাবনা চিন্তা করতে লাগলো সে।
বউমা কেমন আছে? বাবার সেবা যত্ন করছে তো সে?
মায়ের গলার আওয়াজে অন্য মনস্ক ভাব থেকে বেরিয়ে এসে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো সৌম্য, এগিয়ে গিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরলো,
খুব মন খারাপ করছিলে শুনলাম! স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়েছিলে নাকি!
চোখে জল এসে গেল কুমুদ এর, মায়ের চোখে জল দেখেই থমকে গেলো সৌম্য, আস্তে করে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো,
আচ্ছা বলো তো, কতো টাকার তেল খরচ হলো বাবার? হিসেব দিয়েছেন কিছু! এবার কতো দিন আমাকে হেঁটে আসতে হবে সে ব্যাপারে তোমাকে বলে দিয়েছেন তো?
চোখের জল মুছে ছেলের রসিকতায় হেসে ফেললেন কুমুদ, হিসেবী স্বামী কে নিয়ে তাঁকে মাঝে মাঝেই ছেলের কাছে এরকম শুনতে হয়। একটু পরেই নিচ থেকে পারুল বালার হাঁক ডাক শোনা গেলো, খাবার জোগাড় হয়েছে, কুমুদ তড়িঘড়ি নিচে নেমে গেলেন। ছেলে কে নিয়ে খেতে বসলেন শ্যাম সুন্দর, স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর বার বার ছেলের বলা কথাগুলো মনে পড়ছিলো, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করছিলেন তিনি।
বেয়াই মশাইয়ের সুস্থ হতে কিরকম সময় লাগবে? ডাক্তার বাবু কি বললেন?
বাবার প্রশ্নে মুখ নিচু রেখে খেতে খেতেই হিসেব কোষলো সৌম্য, মৃণালের পরীক্ষা শেষ হতে মাস দেড়েক তো লাগবেই।
কিছুদিন সময় লাগবে বাবা, ডাক্তার বাবু ওনাকে মাস খানেক অন্তত বিশ্রাম নিতে বলেছেন।
শ্যাম সুন্দর মাথা নাড়লেন,
তাড়াহুড়োর কিছু নেই, বউমা কে এখন বাবার কাছেই থাকতে বলো। উনি সম্পূর্ন সুস্থ হলেই তবে এনো তাকে,
কোনো উত্তর না দিয়েই মুখ নিচু করে খেয়ে যেতে লাগলো সৌম্য। বড়ো মা আর মা দুজনেই তার খাবার তদারকি করে যেতে লাগলেন, বাড়ির সুন্দর শান্তিপূর্ন পরিবেশ গত পরশু রাতের অশান্তি কে ভুলিয়ে দিতে লাগলো।
দাদা আপনার চা, বড়ো মা পাঠিয়ে দিলেন,
ঘুম থেকে উঠেই করুণা কে চায়ের কাপ হাতে দেখেই মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলো না সৌম্য। বড়ো মা যে কাল তাকে দেখে খুশি হয়েছেন সেটা বুঝেই আর অন্য কোনো বিতর্ক তৈরি করতে চাইলো না এই মুহূর্তে। চা শেষ করে বাবার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো সে, শ্যাম সুন্দর তখন তাঁর লাইসেন্স প্রাপ্ত বন্দুক পরিষ্কার করছিলেন, প্রতি সপ্তাহেই এই কাজটি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করে থাকেন। যদিও সেই বন্দুক ব্যবহারের দরকার কোনো দিনও পড়েনি আজ পর্যন্ত, সেটা শুধু তাঁর জমিদারী অহংকারের একটি অঙ্গ হয়েই থেকে গিয়েছে। ছেলেকে ঘরে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকালেন তিনি,
কিছু বলবে?
কাল স্টেশনে নেমে সুরেশের সঙ্গে দেখা হলো, ওর সাইকেলেই এলাম কাল। ভাগ্যিস ওকে দেখতে পেলাম, না হলে হেঁটে আসা যথেষ্ট সমস্যার ছিলো, ভীষণ অন্ধকার।
ছেলের কথা খুব সত্যি, শ্যাম সুন্দর সহমত হলেন, সত্যি বিদ্যুৎ যে কবে পৌঁছবে এখানে! বেশ কয়েকবার তদ্বির করেছেন বিভিন্ন জায়গায় কিন্তু মাত্র কয়েক ঘর ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তির বাড়ির জন্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে সরকার সম্মত নয়। কিন্তু গ্রামের বাকিদের সে ক্ষমতা কই! তাই যে পরিমাণ খুঁটি পুঁতে বিদ্যুৎ আনতে হবে এখানে, তাতে খরচে পোষানো মুশকিল। অগত্যা এতো বছর পরেও বিদ্যুৎ হীন হয়েই রয়ে গিয়েছে তাঁদের গ্রাম।
সুরেশ বলছিলো ও চেষ্টা করছে আলো আনার, সেই জন্যেই নাকি সদরে গিয়েছিলো!
তাই নাকি! তা হলো কিছু?
ছেলের কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে পড়লেন শ্যাম সুন্দর, যদি সত্যিই আসে বিদ্যুৎ, তাহলে মন্দ হয়না!
কিছুটা এগিয়েছে, কিন্তু কিছু শর্ত আছে ওদের,
কিসের শর্ত?
বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি,
প্রাইমারি স্কুল কে হাই স্কুল করতে হবে আগে, তাহলে ওনারাই স্কুল পর্যন্ত ইলেক্ট্রিকের পোল বসিয়ে দেবেন,
তা সে আর এমন কি ব্যাপার, করে দিলেই হয়। ওই অবধি আলো এসে গেলে তো খুঁটি পুঁতে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসার খরচও অনেক কম হবে, তাই না?
হিসাবী শ্যাম সুন্দর হিসাব কষা শুরু করলেন
কতো টা কম খরচে বিদ্যুৎ আনা যেতে পারে তার হিসেব। এইটুকু খুঁটি পুঁতে বিদ্যুৎ বাড়ি পর্যন্ত আনতে যে খুব বেশি খরচ হবে না সেটা তিনি বুঝতেই পারছেন। এই সুযোগ একদম হাত ছাড়া করা যাবে না।
সুরেশ রাজি হয়েছে তো শর্তে?
ছেলেকে প্রশ্ন করলেন তিনি, সৌম্য ঘাড় নাড়লো,
না বাবা, অতো জমি কোথায়, স্কুল বাড়াতে গেলে তো ঘরও বাড়াতে হবে! ও অবশ্য আমাকে বলছিলো জমির কথা, এটাও বলছিলো যে স্কুলের নাম তুমি চাইলে ঠাকুরদাদা র নামে রাখা যেতে পারে, কিন্তু আমি সম্মত হইনি। এসব ওদের চালাকির কথা, এই সুযোগে জমি ফ্রী তে নিয়ে নেবার চেষ্টা…
আহ! তুমি বড্ড বোকা সৌম্য! আমার সঙ্গে কথা না বলে তুমি কেনো মতামত জানাও বলতো!
বিরক্ত হয়ে ছেলেকে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন শ্যাম সুন্দর, তাঁর ছেলেটার পড়াশুনা ছাড়া বাস্তব জ্ঞানের খুব অভাব! সস্তায় বিদ্যুৎ আর বাবার নামে স্কুল, দুটোই তাঁর পক্ষে যাচ্ছে, এমনিতেও কি বা জমির দাম এখানে! বিদ্যুত এলে, স্কুল হলে তবে তো জমির দামও বাড়বে, তিনি বিষয়ী লোক অথচ তাঁর ছেলে হয়েও যে সৌম্য এতো বোকা কেনো কে জানে!
তুমি সুরেশ কে বলো আজই গিয়ে, জমি আমি দেবো, স্কুল বাবার নামে হবে, ও যেনো ওদের শর্তে রাজি হয়ে যায়। দরকার পড়লে আজই না হয় আর একবার সদরে চলে যাক!
মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলো সৌম্য, দ্রুত পায়ে রওনা দিলো সুরেশের বাড়ির দিকে। ওখানে আলোক দা ছিলেন, উনি যথেষ্টই চালাক চতুর, তাই বাবার মত আবার পাল্টে যাওয়ার আগেই জমি টা স্কুলের নামে দান পত্র করে নিতে হবে। সুরেশ প্রস্তাব পেয়ে খুবই আনন্দিত হলো, জমি যদি এমনই পাওয়া যায়, তাহলে যিনি দিচ্ছেন তাঁর পছন্দের নামেই যে স্কুলের নাম হবে, এতে কারোর একটুও আপত্তি থাকার কথা নয়।
কিন্তু বিদ্যুতের কি হবে! দুজনেই হেসে উঠলো, আস্তে আস্তে বিদ্যুৎ আজ না হোক আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এমনিই আসবে, সেটা নিয়ে এই মুহূর্তে অতো মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আগে স্কুল টা তো হয়ে যাক! সুরেশ সৌম্য কে জড়িয়ে ধরলো, বাবার কাছে ঠিক কি বলে জমি চেয়েছে সে, সেটা বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলো বন্ধু কে। কোনো গোলমাল যেনো না হয়, তাহলে কিন্তু জমি হাত ছাড়া হবার সুযোগ আছে বিলক্ষণ, পই পই করে বন্ধু কে মনে করিয়ে দিলো সে।
রাতে বাবার সঙ্গে একসঙ্গে খেতে বসেছিলো সৌম্য, আজ সকাল থেকেই ভালো মন্দ খাওয়া দাওয়া চলছে। অনেকদিন পরে ছেলে বাড়ি এসেছে, তাই বড়ো মা এবং মা দুজনেই আমিষ নিরামিষ মিলিয়ে নানা রকম পদ রেঁধেছেন। কুমুদ ভীষণ খুশি হয়েছেন, পারুল বালাও কোনো কথা বলেন নি, সব মিলিয়ে বাড়িতে একটা আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
মায়ের মুখের উজ্জ্বলতা সৌম্যর নজর এড়ায়নি, বড়ো মার দাপটে চুপ চাপ থাকা মায়ের ওপরে আলাদা সহানুভূতি আছে তার ছোটো থেকেই, তারা দুজনেই দুজনের মনের কথা বোঝে। খেতে খেতে মনে মনেই মৃণাল কে ধন্যবাদ জানালো সৌম্য, ভাগ্যিস সে তাকে এখানে এসে খবর দেওয়ার কথা বলেছিলো! এসব ভাবতে ভাবতেই একটু অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিলো সৌম্য, বড়ো মার তীক্ষ্ণ গলায় চমকে তাকালো,
তোমার বউ যাবার আগে কি কয়ে গিয়েচেন সে কথা কি তুমি জানো বাছা! এ কেমন মেয়ে আনলে বাছা তোমরা বাপ বেটায়, শিককিত হয়ে তিনি ধরা কে সরা জ্ঞান করচেন যে!
এতো দিন পরে ছেলেটা বাড়ি এসেছে, ওকে একটু শান্তি তে খেতে দাও দিদি, এখন এসব কথা আর নতুন করে তুলো না!
ছেলে কিছু বলার আগেই বলে উঠলেন কুমুদ, তাতে পারুল বালা কতটা অবাক হলেন সেটা বোঝা না গেলেও সৌম্য একদম অবাক হয়ে গেলো। মা যে কোনোদিনও বড়ো মা র মুখের ওপরে কথা বলতে পারেন এটা তার ধারণার মধ্যেও ছিলো না। সে মাথা নিচু করে খেয়ে যেতে লাগলো।
ছেলে বা বাপ দুজনের কেউই যখন ছোটো জায়ের কথার প্রতিবাদ করলেন না তখন নিতান্তই বাধ্য হয়েই আর এই প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন না পারুল বালা, ফলে রাতের মতো আর কোনো গন্ডগোলের সৃষ্টি হলো না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে কলকাতা যাবার জন্যে তৈরী হয়ে নিচে এসে সবাই কে প্রণাম করছিলো সৌম্য, মা কে প্রণাম করে উঠতেই কুমুদ তাকে জড়িয়ে ধরলেন,
এবার থেকে শনিবার করে বাড়ি আসবি বাবা, আমার মাথার দিব্যি রইলো!
কান্না ভেজা গলায় বললেন কুমুদ, নিজের অধিকার বুঝে নেবার চেষ্টায় ইদানিং তিনি সচেষ্ট হয়ে উঠেছেন। সৌম্য চমকে উঠে বড়মার দিকে তাকালো। মায়ের দিব্যি না বড়ো মার আদেশ, কোনটা সে মান্য করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসবে আসবে, এখন তাকে যেতে যাও, আর দেরি করলে ট্রেন ফেল করবে এবার,
পাশ থেকে বলে উঠলেন শ্যাম সুন্দর, সেদিন বৌদির বউ আর বউমা কে বাড়ি থেকে বার করে দেবার কথায় প্রতিবাদ মুখে না করলেও মনে মনে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। পারুল বালা কে তিনিই গিন্নির আসনে বসিয়েছেন, তাই তাঁর বেশি প্রতাপ তিনি সহ্য করবেন না কখনই। কুমুদ যে সেই থেকেই অভিমান করে আছেন সেটা তিনি মনে মনে জানেন। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাড়ির কর্তা হিসেবে তাঁর কথাই যে শেষ কথা সেটা শ্যাম সুন্দরের একটি বাক্যেই প্রকাশ পেলো। পারুল বালা নিজেও জানেন, যে তিনি যতই নিজেকে কর্ত্রী ভাবুন না কেনো, দেওরের কথার ওপরে কথা বলার ক্ষমতা তাঁর আদপেও নেই।
স্বামীর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকালেন কুমুদ, তাঁর অভিমান এক নিমেষেই চলে গেলো। এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন শ্যাম সুন্দর। স্ত্রী এবং বৌদি দুজনকেই নিজের প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে যেভাবে চালিয়ে এসেছেন এতকাল, আজও তার অন্যথা হলো না। পারুল বালা দেওরের কথার ওপর আর কোনো কথা বললেন না, বলতে যাওয়া মানে যে নিজেরই অসম্মান সেটা বুঝেই চুপ করে রইলেন। তাই সৌম্যর আবার শনিবার করে বাড়ি আসায় তিনি আর কোনো আপত্তি জানালেন না, খুব সাধারণভাবেই এ পর্ব মিটে গেলো। গাড়ি সৌম্য কে নিয়ে স্টেশনের উদ্যেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পর কপালে হাত ঠেকিয়ে নিজের কাজে গেলেন পারুল বালা।
ক্রমশ
#মৃণালিনী
#পর্ব ১৮
একমাস ধরে পরীক্ষা পর্ব চললো, যেটুকু ক্ষতি শ্বশুরবাড়িতে থাকাকালীন তার পড়াশুনায় হয়েছিল, এখানে এসে নিজের প্রবল পরিশ্রমে এবং বাবা ও স্বামীর যৌথ সহায়তায় নিজের আয়ত্তে এনে ফেললো মৃণালিনী। একসময় তার পরীক্ষা শেষ হলো, ইতিমধ্যেই প্রায় মাস দেড়েক হয়ে গিয়েছিলো তার কলকাতা আসার, বারবার করে সৌম্য বাড়ি গেলেই মৃণালিনী কে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন পারুল বালা।
তাই এবার সব কিছু মিটে যেতেই বউ কে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য শ্বশুরের কাছে অনুমতি চাইলো সৌম্য। রমণী বাবু অনুমতি দিলেন, ফল বেরোলে সৌম্যর কাছ থেকে এমনই জানতে পারবে মৃণাল, তাই আর তাকে এখানে আটকে রাখার কোনো প্রয়োজন তিনিও মনে করলেন না। পরবর্তী তে বি এ তে ভর্তি হতে গেলে কি কি করতে হবে সবটা বাবার কাছ থেকে জেনে নিয়ে মৃণালিনী শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাওয়ার গোছ গাছ করতে লাগলো।
নির্দিষ্ট দিনে স্টেশনে গাড়ি ছিলো, রাস্তায় আসতে আসতে নতুন দোতলা স্কুলের নির্মীয়মান বাড়ি বউ কে দেখালো সৌম্য,
ইস, এখানে যদি মেয়েরাও পড়তে পারতো! কি ভালো হতো তাই না!
বউয়ের কথাতে একটু হাসলো সৌম্য, ছেলেদের স্কুল তৈরি করতেই তাকে কম মাথা খাটাতে হয়নি! সেখানে আবার মেয়েদের পড়ার ব্যবস্থা! আর হলেও তাতে পড়বে কে! এখানের মানুষজন এতোই গোঁড়া,তারা ছেলেদের স্কুলে মেয়েদের পড়তে কোনো মতেই পাঠাবেন না। তাদের জন্যে আলাদা স্কুল লাগবে তাহলে!
তাকে পৌঁছে দিয়ে পরের দিন সৌম্য চলে গেলো, আবার সেই নতুন করে অন্ধকারে লণ্ঠনের আলোয় রাত কাটানো জীবন শুরু হলো মৃণালের। সরমা কে বইয়ের মধ্যে আনা বিমলের চিঠি পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সৌম্যর কাছে বদলাতে পাঠানো বইয়ের মাঝে সরমার চিঠি ঢুকিয়ে দিলো মৃণাল। সরমার হাতের লেখার উন্নতি হয়েছে যথেষ্টই, এমনকি লাইব্রেরী থেকে আনা বইগুলোও এখন পড়ে সরমা, নিজের কৃতিত্বে নিজেই খুশি হলো মৃণালিনী।
দুপুরের ছাদের মজলিশে অনেকদিন পরে যোগ দিলো মৃণাল, সেখানে বিভাও বসেছিলো। তাকে দেখেই খুব কৌতুহল হলো মৃণালের, যাবার আগের দিন তাকে দেখতে কলকাতা থেকে পাত্র এসেছিলো, সেই সাজাতে গিয়েই তো কতো কথা শুনতে হয়েছিলো তাকে আর তার শাশুড়ি কে! কি হলো সেই পাত্রের! চুপি চুপি সরমার কাছে জানতে চাইলো মৃণালিনী।
সে বিয়ে তো হয় নে গো বউ দিদি, সে ছেলে পড়াশুনা জানা মেয়ে চায়!
ফিসফিস করে বললো সরমা, একটু মনটা খারাপ হয়ে গেলো মৃণালিনীর। কলকাতার মেয়েদের মতো করে সাজিয়ে দিয়ে যে আসলে কিছুই লাভ হয়নি বিভার, এটা সে বুঝতে পারলো। আজকাল শুধু সাজলেই হয়না পেটে বিদ্যেও থাকতে হয়! সেটা এখানকার লোকেদের কে বোঝাবে!
বিকেল হয়ে আসছিল, ছাদের মজলিশ ভেঙে যাওয়ার পর সবাই নিচে বারান্দায় এসে বসেছিল। নিজের কাজের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তুলসী তলায় আগের মতোই সন্ধ্যে দেখিয়ে এসে চাটাইয়ের এক পাশে বসেছিলো মৃণালিনী।
সকালের দিকে নিচেই থেকো বাছা আগের মতোই, বেশি ওপর নিচ করার দরকার নেই তোমার,
পারুল বালার কথায় ঘাড় নাড়লো মৃণাল, এখন আবার সৌম্যর শনিবার করে বাড়ি আসা শুরু হয়েছে তাই বড়ো মা যে তাকে দোতলায় উঠতে দিতে চাননা, সেটা সে বোঝে। সে এখন যথেষ্টই পুরনো হয়ে গিয়েছে, এ বাড়ির সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকি বহাল। ফিরে এসেই তাই আর বড়ো মার সঙ্গে খুব বেশি তর্কে সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই যেতে চাইলো না। শুধুই নিজের স্বামীর বলা কথা গুলো মনে পড়ছিলো মৃণালের। বড়ো মার বিরাগ ভাজন না হয়ে কি ভাবে তার পড়াশুনা নির্বিঘ্নে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, সেটুকুই ভাবার চেষ্টা করছিলো সে।
পরের দিন ভোরবেলায় ঝগড়ার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো মৃণালের, নিচে প্রবল গন্ডগোল চলছে, বিভার বাবার সঙ্গে পাশের বাড়ির কমল জ্যেঠুর চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে, সেখানে শ্বশুর মশাইও দাঁড়িয়ে আছেন। নিচে অতো বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে, সরমা পাশে এসে দাঁড়ালো। গন্ডগোলের কারণ যে পুকুরের পাশের সেই শরিকি জমি, সেটা সরমার কাছ থেকেই জানতে পারলো। জমির দখল নিয়ে প্রায়ই গন্ডগোল হয়, এখানে এসে থেকেই সে দেখে আসছে, তবে এতটা সাংঘাতিক বাড়াবাড়ি তার চোখে পড়েনি আগে।
সকালের গন্ডগোলের পরে কোনো মতে খাওয়া দাওয়া সেরে শ্যাম সুন্দর গাড়ি নিয়ে সদরে বেরিয়ে গেলেন, আজ তাঁর জরুরী কেস আছে কোর্টে। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে নিজের স্নান সেরে, পুজো দিয়ে ঘরে এলো মৃণাল। ঘর বেশ অগোছালো হয়ে আছে, কলকাতা থেকে আনা তোরঙ্গ সেই ভাবেই খাটের তলায় পড়ে আছে, সেটা টেনে নিয়ে কাপড় চোপড় বার করে ঘর জোড়া সেগুন কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে রেখে জিনিসপত্র গোছ গাছ করতে লাগলো সে।
দুপুর ক্রমশ নিস্তব্ধ হয়ে আসছিলো, গোয়াল থেকে গরুর হাম্বা হাম্বা ডাক ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো আওয়াজ নেই, হারু সম্ভবত গোয়াল পরিষ্কার করছে। ঘরের জানলা দিয়ে পুকুর ঘাট থেকে বামুন দিদি আর করুণা কে স্নান করে গায়ে গামছা জড়িয়ে ফিরতে দেখলো মৃণাল।
করুণা হেঁটে যাচ্ছিলো, সে পিসির সঙ্গে কথায় মত্ত ছিলো, কোনো দিকেই তার খেয়াল নেই। গোয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হারুর চোখ যে তার ওপরেই নিবদ্ধ সেটা সে খেয়াল না করলেও দোতলার নিজের ঘরের জানলা দিয়ে সে দৃশ্য মৃণালিনীর চোখে ধরা পড়ছিলো, নিজের মনেই মুচকি হাসলো একটু।
দুপুরের খাওয়ার সময়ও প্রায় হয়ে এসেছে, এরপরেই করুণা খাবার আসন পেতে, জলের গ্লাস রাখবে, বামুন দিদি ভাত বাড়তে বসবেন, আবার নতুন করে চৌধুরী বাড়ির নিচের তলা, ঠাকুর, চাকর, পারুল বালার আওয়াজে সরগরম হয়ে উঠবে। এসব প্রাত্যহিক ঘটনা এখন আর মৃণালের অজানা নয়, সেও ধীরে ধীরে এ সংসারের একজন হয়ে উঠেছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই একটু অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিলো মৃণালিনী, পারুল বালার তীক্ষ্ণ চিৎকারে চমকে উঠে ছুটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর সে যা বুঝতে পারলো, তার সারমর্ম এই যে, সকালের তাড়াহুড়োয় শ্বশুর মশাই তাঁর কেস সংক্রান্ত কিছু জরুরী কাগজ পত্র বাড়িতেই ফেলে গেছেন এবং এখন ড্রাইভার কে সেগুলি নিয়ে যাবার জন্যে পাঠিয়েছেন। কিন্তু এ বাড়ির এক মাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি এই মুহূর্তে আলোক, কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড়ো মার হাজার চিৎকারেও যখন আলোক কে খুঁজে পাওয়া গেলো না তখন, অত্যন্ত ধীর পায়ে নিচে নেমে এলো মৃণালিনী।
আমি খুঁজে দিতে পারি বড়ো মা, যদি আপনি অনুমতি দেন,
মৃদু স্বরে পারুল বালার দিকে তাকিয়ে বললো সে, অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকলেন পারুল বালা, পর পুরুষ ড্রাইভারের সামনে বউ এর নেমে আসা নিয়েও এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছেন না তিনি। সময় বয়ে যাচ্ছে, আলোকের দেখা নেই, দেওর বিরক্ত হবেন, সবটা বুঝেই অগত্যা মাথা নাড়লেন তিনি,
দেখো দিকিনি বাছা! খুঁজে পাও নাকি! অলাউঠো আলোক আসুক আজ, তাকে কি মুখ দেকার জন্যে রেকেচি! কাজের সময় তার টিকিটিও দেখা যায়নি কো!
বড়ো মার প্রবল চিৎকারের মধ্যেই হাসি মুখে স্বশুর মশাইয়ের ঘর থেকে কার্য সমাধা করে ফিরে এলো মৃণাল। কাগজ যে পাওয়া গেছে তাতে শান্তি পেলেও বউ এর এসব বিষয়ে মাথা ঘামানোর অনুমতি দিতে বাধ্য হওয়ায়, সব রাগ তাঁর আলোকের ওপর গিয়েই পড়লো!
কিছুক্ষণ পরেই খাবার সময়ে বাড়ি ফিরে এলো আলোক। স্নান সেরে আসনে বসে, হাতে জল নিয়ে থালার পাশে গোল করে ছিটিয়ে সবে প্রথম গ্রাস মুখে তুলতে যাচ্ছিলো, পারুল বালা সামনে এসে দাঁড়ালেন।
তোমাকে কি এখানে পাড়া বেড়াতে নিয়ে এইচি গো বাছা? কাজের সময় তোমার টিকিটিও দেকা যায় নে কো! খাওয়ার সময় তো বাড়ি আসতে একটুও ভোলোনে! ডেকে ডেকে গলায় আমার ব্যতা হয়ে গেলো, ডাক শুনে অন্য গেরামের লোকজনও বাড়ি এসে গেলো তবু তুমি শুনতে পেলে নে বাছা!
নিজের অপরাধ কি সেটা কিছুতেই বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে পারুল বালার দিকে তাকিয়ে থাকলো আলোক, পিসির করা অপমানে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। এ বাড়িতে নিতান্তই বাধ্য হয়েই থাকে সে, মাঝে মাঝেই তাকে শ্যাম সুন্দর এবং পারুল বালা অপমান করেন। মনের ভেতরে যে ক্ষোভের আগুন ইতিমধ্যেই ধিকি ধিকি করে জ্বলছিলো, পিসির আজকের বাক্যবাণ তাতে আরো বেশি করে ইন্ধন যোগালো। চৌধুরী পরিবারের যে সর্বনাশ এতদিন ধরে সে একটু একটু করে, করে আসছিলো তা আরও বেশি করে করার জন্য মনস্থ করলো।
শেষ পর্যন্ত কুমুদ এগিয়ে এলেন,
খাওয়ার সময়ে একটু ছেলেটা কে শান্তি করে খেতে দাও দিদি, এসব কথা এখনই কি বলতে হবে! আর বউমা তো খুঁজে দিয়েছে কাগজ, সমস্যা যখন মিটে গেচে, তখন আবার একই কথা নিয়ে টানাটানি কেনো!
একটু বেশি করে ঘি আলোকের পাতে ঢেলে দিলেন কুমুদ, ছেলেটা ঘি খেতে বড্ড ভালো বাসে! মুখ নিচু করে খেয়ে যাচ্ছিলো আলোক, বড়ো মা এখান থেকে চলে গেছেন, শাশুড়ি পাশে বসে আলোক কে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পাখার বাতাস করছেন, ওনার মন টা বড্ড নরম, বড়ো জার আলোক কে করা অপমান, একটু একটু করে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো মৃণালিনী, আগের বার কলকাতা যাওয়ার আগে থেকেই আলোকের করা হিসাবে কিছু কিছু গরমিল লক্ষ্য করেছিলো সে, আজকের আলোকের মুষ্টিবদ্ধ বাম হাত, আরও বেশি করে তার চিন্তা বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।
ক্রমশ