মৃণালিনী পর্ব-২৪+২৫

0
408

#মৃণালিনী
#পর্ব ২৪
বাপের বাড়ি তে দিন পাঁচেক খুবই আনন্দের সঙ্গে কাটলো, শনিবারে বাড়ি ফেরার সময় সৌম্যর সঙ্গেই কলকাতা থেকে ফিরলো মৃণালিনী। বাড়ি থেকে ফিরে আসার পরে মন মেজাজ যথেষ্টই ভালো ছিলো মৃণালের। বিমলের সঙ্গে হওয়া কথোপকথন সরমা কে বলার জন্যে মন ছটফট করছিলো তার। কিন্তু সৌম্য তাকে পই পই করে বারণ করেছিলো এখনই সরমার সামনে কিছু প্রকাশ না করতে, তাই বাধ্য হয়েই মুখ বন্ধ রেখেছিলো সে।

দুপুরে আজকের ছাদের মজলিশে বিভার মায়ের অস্বাভাবিক নীরবতা সবারই নজর কাড়ছিলো। এই আসর কে তিনিই মাতিয়ে রাখেন সাধারণত, তাই সবাই একটু অবাক হচ্ছিলো। কিছুক্ষন লক্ষ্য করার পর আরেক পড়শী গিন্নি যিনি সব বিষয়েই একটু বেশি কৌতূহলী সেই মনোরমা আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না,

আজ বিভার মার কি হলো গো? মুখে কোনো কতা নেই কেনো?

বিভার মা মুখ তুললেন, তাঁর মুখে দুঃখের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো,

মন মেজাজ ভালো নেই গো দিদি, মেয়েটার একটা পাত্তরও ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না গো। আই বুড়ো মেয়ে ঘরে থাকার যে কি জ্বালা, সে আর তুমি কি বুঝবে!

বিভার নিচু করে রাখা মুখ মৃণালিনী কেও ব্যথিত করলো। মনোরমা মনে মনে গর্বিত হলেন, তাঁর মেয়ে নেই! মুখে সমব্যথী হয়ে সুঁচ ফোঁটাতে ছাড়লেন না,

সেই তো! লেকা পড়া টা তো সেকাও নি বিভার মা! এই আমার ছেলেকেই দেকো না! দুটো পাস দিয়ে এসেছে কলকেতা থেকে, তা তার বাপ তাকে বিয়ের কতা কইতেই সে এক কতা কইলো! মেয়ে তার লেকা পড়া জানা চাই! ছেলের বাপ তো রেগে আগুন, কিন্তু আমিই কইলুম, বিবাদে গিয়ে লাভ কি! তারও তো বন্দুরা আছে তো নাকি! তারা সবাই যদি তাই করে, তাহলে তাদের কাছে তারই মান থাকে কোথায়!

আরও কিছু কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবার মতো কথা তিনি বলতে যাচ্ছিলেন, পারুল বালার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ তাঁকে থামিয়ে দিলো। এই কথাটা যে শুধুই বিভার মা নয়, তাঁকেও আঘাত করছে সেটা বুঝেই আর এই প্রসঙ্গ তিনি টানতে দিলেন না।

চুপ করো মনোরমা! তোমার ছেলে না হয় নেকা পড়া জানা ছাড়া বিয়ে করবে নে, তাবলে সবাই কি তাই! বিভার বাপের পয়সার অভাব নেই কো! তোমার ছেলের মতো দুটো কেনো চারটে পাস দেওয়া ছেলেও ওই টাকার কাছে হার মেনে যাবে গো!

কোনোদিনই মুখরা পারুল বালা কে পছন্দ না করা বিভার মা আজ বিপদে পড়েই পারুল বালার কাছে কৃতজ্ঞ হলেন। চোখের জল মুছে চৌধুরী বাড়ির বড়ো গিন্নীর হাত ধরে ফেললেন তিনি,

তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক দিদি, তাই যেনো হয়! ভগবান যে কবে মুখ তুলে চাইবেন!

মনোরমা এতো সহজে থেমে যাবার পাত্রী নন, বিশেষ করে তাকে বিভার বাপের টাকার গরম দেখিয়েছেন পারুল বালা! তাই তিনি এবার মুখ হাত নেড়ে বলে উঠলেন,

টাকার কতাই যদি বলো দিদি, তাহলে সেও কি কম আছে আমাদের! কতো মেয়ের বাপ তো ওই টাকা দেখিয়েই হাতে পায়ে ধরলো! কিন্তু ছেলের এক রা! টাকা তার অনেক আছে সে ওসব চায় নে, শুধু পড়তে জানলেই হলো!

ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এবার গল্প তাল ঠোকাঠুকি তে বদলে যাচ্ছে দেখে কুমুদ প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলেন, পারুল বালা ভেতরে ভেতরে গুমরালেও মনোরমা কে দেবার মতো কিছু যুতসই জবাব তৈরি করতে পারছিলেন না। এতো তর্কাতর্কির মধ্যে বসে থাকা বিভার চোখ জলে ভরে আসছিলো, এতো আলোচনার বিষয় বস্তু যে একমাত্র তার নিরক্ষরতা সেটা বুঝে তার নিজের বাপ মায়ের ওপর ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল।

বিভাকে আমার কাছে পড়তে পাঠিয়ে দেবেন কাকিমা, আমি শিখিয়ে দেবো,

আনন্দে প্রায় মৃণালের হাত জড়িয়ে ধরলেন বিভার মা,

খুব ভালো কতা কয়েছ মা গো! একটু শিখিয়ে দিও তো!

সরমা মুখ টিপে হাসলো, তার সঙ্গে যে বৌদির ছাত্রী সংখ্যা আর একজন বাড়তে চলেছে এটা ভেবেই সে পুলকিত হচ্ছিলো। পারুল বালা কিছু বলতে যাবার আগেই ওখানে উপস্থিত মনোরমা পড়াশুনার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এতটাই জ্ঞান বিতরণ করতে থাকলেন যে তাঁর আপত্তি ধোপে টিকবে না ভেবেই আপাতত চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। এমনিতেও তাঁর মনে শিবু ঘটকের বলা কথাগুলো ভেসে উঠছিলো, মুখে প্রকাশ না করলেও সরমা র পাত্র জোগাড় কি ভাবে হবে সে চিন্তা ক্রমশই তাঁকে উদ্বিগ্ন করতে লাগলো।

পরের বাড়ির মেয়ের কতা শুধু না ভেবে নিজের ননদের জন্যেও একটু ভাবো মা গো!

রাতে খেতে বসে মৃণাল কে উদ্যেশ্য করে বললেন পারুল বালা, ছোট জা দুপুরের মজলিশে কোনো কথা বলেনি। তার নিজের মেয়েকে ছেড়ে বিভা কে পড়ানোর কথায় তিনি নিশ্চয়ই মনে মনে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যাতে কুমুদ বউয়ের ওপর ক্ষুব্ধ না হন, তাই মৃনালকে বাঁচাতে চেষ্টা করছিলেন পারুল বালা। কিন্তু তাঁর জানা ছিল না কুমুদ এর প্রশ্রয়েই ইতিমধ্যেই সরমা তার বৌদির কাছে যথেষ্ট শিক্ষা পেয়ে গিয়েছিলো। বড়ো মার তাকে বাঁচানোর চেষ্টা দেখে মনে মনে খুশি হচ্ছিলো মৃণালিনী।

আমি পড়তে চাই না বড় মা!!

মা কিছু বলার আগেই তড়িঘড়ি বলে উঠলো সরমা, পাছে সে শিক্ষিত এটা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় শিবু ঘটক তার জন্যে পাত্র জোগাড় করে ফেলে সেই ভয় তাকে ভীত করে তুললো। মেয়ে কে মাথা নাড়তে দেখে কুমুদ নিজেকে সামলে নিলেন,

যে নিজে পড়তে চায় না, তার জন্য অন্য কে দোষ নাই বা দিলে দিদি! আর একটা মেয়ের যদি উপকারে আসে তাহলে না হয় শিকুক না! ক্ষতি কি!

মৃণাল মুখ নিচু করে খেয়ে যেতে লাগলো, শাশুড়ি আর ননদের কথোপকথনে তার হাসি চেপে রাখা কষ্টকর হচ্ছিলো। সরমা যদি জানতো তার দাদা তার জন্যে বিমলের সঙ্গে কথা বলেছে ইতি মধ্যেই তাহলে তার খুশির সীমা থাকতো না। কিন্তু পারুল বালা থামলেন না, বাস্তবিকই তিনি মনে মনে ভীত হচ্ছিলেন, সরমা র শিক্ষার ব্যবস্থা করা যে খুবই দরকার সেটা এই মুহূর্তের পরিস্থিতি দেখেই আন্দাজ করতে পারছিলেন।

কেনো মা? সারাদিন তো বউ দিদির সঙ্গে গুজুর গুজুর করে চলেছ! দু দণ্ড বই নিয়ে বসতে কি হয় তোমার! কাল থেকেই বসবে তুমি,

কড়া গলায় সরমা র দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি, উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলো। এইসব কথোপকথনের মধ্যেই দ্রুত করুণা কে দোতলার সিঁড়ির দিকে যেতে দেখলো মৃণালিনী, তার হাঁটাচলার মধ্যেই কোনো কিছু গোপন করার চেষ্টা ছিলো যেনো। বেশ কিছুক্ষন চলে যাবার পরেও সে নিচে নেমে এলো না যখন, তখন মৃণালিনী একটু চিন্তিত হয়ে পড়লো। সাধারণত রাতের খাবার পর হেঁসেল তোলার জন্যে করুণা এখানেই উপস্থিত থাকে তার আজ ওপরে কিসের দরকার মৃণাল বুঝতে চেষ্টা করছিলো।

আমি একটু ওপর থেকে আসছি মা, এসে বাকিটা করছি,

বলেই হাত ধুয়ে দ্রুত ওপরে উঠে এলো মৃণালিনী। ওপরে এসে কোথাও করুণা কে দেখতে পেলো না মৃণাল, সে যেনো বাতাসের মতো উবে গিয়েছে। ছাদে ওঠার দরজাটা খোলা, এতো রাতে করুণা কি ছাদে গেলো, ভাবতে ভাবতেই ছাদের দরজা দিয়ে হারু কে নেমে আসতে দেখলো মৃণালিনী। তার কাঁধে এক খানা বড়ো চটের বস্তা, মৃণাল কে দেখেই একটু থতমত খেলো,

তুই এতো রাতে ছাদে কি করছিলি?

বৌ দিদির প্রশ্নের উত্তরে কাঁধের বস্তার দিকে ইশারা করে দেখালো হারু,

ছাদে ঘুঁটে গুলো শোকাতে দিয়েছিলাম বউ দিদি, তুলতে ভুলে গেছিলাম তাই!

করুণা কে দেখেছিস!

হারু মাথা নাড়লো, পাশ কাটিয়ে ও নেমে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষন ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো মৃণাল। ছাদের দরজা হারু নামার সময় বন্ধ করে গেছে, তাই করুণার ওখানে থাকার সম্ভাবনা নেই আর, সেটা বুঝে একটু পরে ছাদের সিঁড়ি থেকে নেমে এলো ও। নিচের থেকে বড়মার করুণা কে ডাকাডাকির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলো, একটু পরেই করুণার গলা শুনতে পেলো, একদম অবাক হয়ে গেলো মৃণালিনী। করুণা কে ও উঠতে দেখলেও নামতে দেখেনি, তার মানে করুণা নিশ্চয়ই দোতলার মেথর ঢোকার ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছে নিচে, মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি নিয়েই নিচে নেমে এলো মৃণালিনী।

তুই দোতলা থেকে কি পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিস?

করুণা কে একটু একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলো মৃণাল, বড়ো মা যদি এ ব্যাপারে কিছু মাত্র জানতে পারেন তাহলেই এক্ষুনি বাড়ি চিৎকার করে মাথায় তুলবেন। করুণা তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো,

না তো বউ দিদি, আমি তো ওপরে যাই নি, নিচেই ছিলাম!

মৃণাল চমকে উঠলো, এতো ভুল দেখলো ও! কিন্তু এই মুহূর্তে প্রমাণ করার মতো কোনো উপায় ওর কাছে ছিলো না, তাই বাধ্য হয়েই আস্তে করে বললো,

তুই মিথ্যে বলছিস করুণা, আমি তোকে ওপরে যেতে দেখেছি!

মৃণাল এর আস্তে বলা কথা করুণা কে সাহসী করে তুললো। বউ দিদির কাছে নিজের কথার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই এটা বুঝেই সে হটাৎ করেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো,

তুমি আমাকে এরকম বললে বউ দিদি! আমি মিছে কতা কই! গরীব মানুষ, তোমাদের বাড়ি পড়ে আছি বলেই কি যা খুশি বলবে!

বাড়ির মধ্যে একটা হৈ চৈ পড়ে গেলো, তার আকস্মিক কান্নার আওয়াজে সবাই দালানে এসে উপস্থিত হলো। এমনকি শ্যাম সুন্দরও ওপর থেকে নেমে এলেন। তাঁকে দেখেই করুণার কান্না আরও বেড়ে গেলো, সে প্রায় কর্তা বাবুর পা জড়িয়ে ধরলো,

বাবু, আমি মিছে কথা কই না!

শ্যাম সুন্দর বিব্রত হলেন, তাড়াতাড়ি পা ছাড়িয়ে নিয়ে পারুল বালার দিকে ফিরলেন,

বৌদি! রাতের বেলা কি হচ্ছে এসব! বন্ধ করো এসব হৈ চৈ! তোমাদের জন্যে তো আমার কাজ কম্ম লাটে উঠবে এইবার!

তুমি যাও ঠাকুর পো! আমি দেকচি!

দেওর চলে যাবার পর সামনে এলেন পারুল বালা,

মাজ রাতে এসব মরাকান্না বন্দ করো মা গো, কে তোমারে কি কয়েছে শুনি!

কড়া গলায় ধমকে উঠলেন তিনি, বড়মা র ধমক আরও বেশি করে জল নিয়ে এলো করুণার চোখে, নিজের দোষ লুকিয়ে রাখার মোক্ষম অস্ত্র যে কান্নাই সেটা বুঝেই প্রায় হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো সে। এবার রীতিমত অপ্রস্তুতে পড়লো মৃণালিনী তার সামান্য জিজ্ঞাসার উত্তরে যে করুণা এমন কিছু করতে পারে, সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি একদম।

আমিই বলেছিলাম বড়ো মা, আমার মনে হয়েছিলো ও দোতলায় উঠেছে, কিন্তু ওকে আমি নামতে দেখিনি!

শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো মৃণালিনী, কুমুদ একদম অবাক হয়ে গালে হাত দিলেন,

ওমা! তা এ আর এমন কি কথা! তার জন্যে তুই কেঁদে পাড়া মাথায় করছিস!

বড়ো জা কিছু বলার আগেই বললেন তিনি, করুণা তাড়াতাড়ি কর্তা মার দিকে চাইলো। কুমুদ এর কথা যে খুব বেশি গুরুত্ব কখনোই পায়নি জানা থাকায় সে মনে মনেই আশা করছিলো, বড়ো মা তাঁকে থামিয়ে দেবেন। কিন্তু পারুল বালাও যথেষ্টই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, এই সামান্য কারণে করুণার বাড়াবাড়ি দেখে তাঁর নিজেরও বিরক্তি লাগছিলো। তাই এবার করুণার দিকেই ঘুরলেন তিনি,

দেখো মা গো, একানে তোমায় কেউ জোর করে আটকে রাখে নে! না পোষালে অন্য কোথাও কাজ দেখে নাও বরং!

এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিলো করুণার কান্না বন্ধের জন্যে, সে মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে রইলো। বামুন দিদি আরও একটু চালাক, তার ভাই ঝির এখানে থেকেই বিয়ের পরিকল্পনা সামান্য মূর্খামি র জন্যে প্রায় ভেস্তে যায় দেখেই তিনি কর্তা মায়ের কাছে হাত জোড় করে ফেললেন,

ও ছেলে মানুষ কর্তা মা, কি বলতে কি বলে ফেলে! তোমরা ছাড়া ওর আর কেই বা নিজের আছে বলো! দরকার হলে দু এক ঘা মারো কিন্তু বাড়ি থেকে বের করে দিও নে!

পারুল বালা কোনো উত্তর না দিয়েই গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দেখেই, ভাই ঝির দিকে ফিরলেন বামুন দিদি,

যত বড়ো মুক নয় ততো বড়ো কতা! শিগগির ক্ষমা চা বউ দিদির কাছে!

পিসির কথাতে সম্বিত ফিরলো করুণার, তাড়াতাড়ি মৃণালের পা ধরতে এগিয়ে এলো সে, মৃণাল এতো টা বাড়াবাড়ি একদমই আশা করেনি, সে চমকে উঠে দু পা পিছিয়ে গেলো। এতো কিছুর পরেও পারুল বালা নীরব থাকলেন, তাঁর বিচার কোন পক্ষে গেলো সেটা মনে মনে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো করুণা। তার আশা ছিলো একটু হলেও বউ কে কিছু বলবেন কর্তা মা, সে আশা পূরণ না হওয়ায় মনে মনেই একটু চিন্তিত হলো করুণা।
ক্রমশ

#মৃণালিনী
#পর্ব ২৫
সকাল বেলায় ফুল তুলতে তুলতেই খামার থেকে ভেসে আসা মুরগির ডাক শুনতে পাচ্ছিলো মৃণালিনী, সাধারণত এতো জোরে ডাক শোনা যায় না কখনো, তাই খানিকটা হলেও কৌতূহলী হলো সে। বড়ো মার ঘরে সাজি রেখে এসে খামারের কাছে পৌঁছে দেখলো আজ খামার খোলা হয়নি। মুরগিগুলো ভেতর থেকে বেরোবার জন্যে ছটফট করছিলো, কিন্তু আশেপাশে কোথাও হারু কে দেখতে পাওয়া গেলনা।

কি করবে ভাবতে ভাবতেই কুমুদ সেখানে উপস্থিত হলেন, দোতলা থেকেই তিনিও ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। হারুকে ডাকতে ডাকতেই তিনি নিচে নেমে এসেছেন। এতো ডাকাডাকির পরেও হারুর কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না, কিন্তু গোবর জলের ছড়া দিতে দিতে হারুর মা সেখানে উপস্থিত হলো। তাকে দেখেই বিরক্ত হলেন কুমুদ,

তোমার ছেলে কোথায় হারুর মা? মুরগিগুলো যে ডেকে ডেকে সারা হলো গো! সকাল বেলায় এতো আওয়াজ ভালো লাগে! উনি সারাদিন কাজে থাকেন, সকালে একটু নিচ্ছিন্তে ঘুমোবেন, তার জো নেই গো!

হারুর মা এদিক ওদিক চাইলো, তারপর হতাশ মুখে ছোটো গিন্নির দিকে তাকিয়ে বললো,

সে তো সকালে আমার সঙ্গেই ঘুম থেকে উঠলো গো! আমি ন্যাতা নে গোবর জল দিতে গেলুম, সে ওই গোয়ালের দিক গেলো! তারপর তো তারে আমি দেখিনি!

সাত সকালেই তিনি তার কাজ সেরে পাড়া বেড়াতে গেছেন বুজি! এই হিমে এতো ভোরে কেউ গরু বার করে! এতদিন কাজ করার পরেও কি তাকে শেখাতে হবে হারুর মা!

বিরক্ত গলায় বললেন কুমুদ, হারুর মা কিছু উত্তর দেবার আগেই কোথা থেকে করুণা হাঁফাতে হাঁফাতে সেখানে উপস্থিত হলো,

আমি মুরগি ছেড়ে দিচ্ছি ছোটো মা, হারু দা আমাকে বলে গেছে,

মৃণাল একটু অবাক হয়ে গেলো, মুহূর্তে তার কালকে দেখা রাতে হারুর বস্তা নিয়ে নিচে নেমে আসার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। হটাৎ করে হারু মুরগি ছাড়ার দায়িত্ব করুণা কে দিয়ে এমন কোন কাজে সকাল বেলায় গেলো মনে মনেই ভাবতে লাগলো সে। কিন্তু কালকের করুণার কান্নার কথা মনে পড়ায় এই প্রশ্ন করা আদৌ উচিত হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই খিড়কি দরজা দিয়ে স্নান করে পারুল বালা প্রবেশ করলেন। পুকুরঘাট থেকেই তাঁর কানেও মুরগির আওয়াজ গিয়েছিলো,

কি এমন কাজ তার এই ভোরে, যে নিজের কাজ তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে সে পাড়া বেড়াতে বেরোলো মা গো!

কড়া গলায় করুণার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি, করুণার মুখ শুকিয়ে আমশি হয়ে গেলো।

ওই সাধন আচাজ্জিদের বাড়ি ঘুঁটে চেয়েছিলো বড়ো মা, তাই আমাকে মুরগি বার করে দিতে বলে গেলো হারু দা,

তড়িঘড়ি জবাব দিলো করুণা, পারুলবালা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।

এই সাত সকালে সে সাধনের বাড়ি ঘুঁটে দিতে গেছে! কেনো তাদের বাড়ি কি ঘুঁটে না হলে হাঁড়ি চড়বে নে!! আর সাধন তো আমায় ঘুঁটের কতা কয়নি!

ভয়ে করুণার মুখ প্রায় শুকিয়ে গেলো, মৃণালিনী তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করছিলো, পারুল বালা প্রায় তাকে কোন ঠাসা করেই ফেলেছিলেন এমন সময় শ্যাম সুন্দর দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন,

তোমাদের জ্বালায় তো বাড়িতে তিষ্ঠনো যাবে না দেখছি! সেই কাল রাত থেকে শুরু হয়েছে! কেউ যদি দরকারের সময় কোনো কাজেই না আসে তাহলে সবাই কেই দূর করে দাও এবার! নতুন লোক খোঁজো! বেশিদিন পুরনো হলেই ধরা কে সরা দেখে সবাই!

সকাল বেলায় দেওরের অগ্নিমূর্তি দেখে চুপ করে গেলেন পারুল বালা, করুণা একবার মৃণালের দিকে তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তার চোখের দৃষ্টিতে রাগ ঝরে পড়ছিলো, পিসির কথাতেই সে বৌ দিদির কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছে কাল,সে অপমান সে ভোলেনি। মৃণাল চিন্তিত হচ্ছিলো, কথাগুলো ধামাচাপা পড়ে যাওয়ায় যে করুণার সুবিধা হলো সেটা বুঝে সে মনে মনে অন্য পরিকল্পনা করতে লাগলো।

শ্যাম সুন্দরের রাগের পরেই জায়গা আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেলো, খামার খুলে মুরগি বার করে দিয়ে করুণা চলে যাওয়ার পরে মৃণালিনী চিন্তিত মুখেই নিজের ঘরে ফিরে এলো। চা জলখাবার পর্ব মিটে যাওয়ার পরে আলোক কে নিয়ে শ্যাম সুন্দর সদরে গেলেন, ক্রমশই বামুন দিদির রান্নার আওয়াজের সঙ্গে করুণার মসলা বাটার আওয়াজে চৌধুরী বাড়ি সরগরম হয়ে উঠলো।

প্রায় বেলার দিকে হারু বাড়িতে ঢুকলো, দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েই তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলো মৃণালিনী। সাধন আচাজ্জিদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে যে তার এতক্ষন লাগার কথা নয় সেটা মনে মনেই ভাবছিলো সে, এমন সময় করুণা হারুর সামনে এসে দাঁড়ালো। করুণার হাতে কলাইকরা থালায় ঢালা একথালা মুড়ি, আলু সেদ্ধ আর পেঁয়াজ, সেটা সে হারুর হাতে তুলে দিয়ে নিঃশব্দে হাসলো, প্রত্যুত্তরে হারুর মুখেও হাসির রেখা দেখা গেলো, সবটাই ওপরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো মৃণাল।

করুণা বোধ হয় আলাদা করে হারুর জলখাবারের থালা তৈরি রেখেছিলো আগেই, সেটা হারুর হাতে তুলে দিয়েই সে দ্রুত পায়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো। হারু সবে মাত্র মাটিতে বসে এক গ্রাস মুখে তুলেছিলো, এমন সময় হারুর মা ছেলের সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো।

কোতা ছিলি ভোর থেকে! মিছে কতা বলিস তুই আবার! ঘুঁটে দিতে গেছিলি তুই! ও মেয়ে তোকে ডোবাবে, এই কয়ে দিলুম!

চাপা গলায় তার ধমক কানে এলো মৃণালিনীর, ছেলে কে ধমক দিতে দিতেই সে ওপর দিকে তাকালো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মৃণালিনী কে দেখেই তার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেলো! এতক্ষন মুখ নিচু করে খেতে থাকা হারু বোধহয় আচমকাই মায়ের ধমক বন্ধ হয়ে যাবার উৎস খুঁজতেই ওপর দিকে চোখ তুললো,

হারু, খাওয়া হলে একটু ওপরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করিস!

হারু চোখ তুলে তাকাতেই ঠান্ডা গলায় বললো মৃণালিনী, হারু মাথা নাড়লো শুকনো মুখে। ঘরে এসে সবে মাত্র বসেছিলো মৃণাল, হারুর মা ছেলে কে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো।

এতো তাড়াতাড়ি তোর খাওয়া হয়ে গেলো! না খেয়েই চলে এলি নাকি!

অবাক মুখে বললো মৃণালিনী, হারু মাথা নাড়লো,

খাওয়া হয়ে গেছে বউ দিদি, বলো কি বলবে,

সাধন আচাজ্জির বাড়ি ঘুঁটে দিয়ে এলি? কতো হয়েছে? টাকাটা আমাকে দে,

শান্ত গলায় বললো মৃণালিনী, হারু চমকে উঠে তাকালো, ছেলে কোনো কিছু বলার আগেই অবস্থা বেগতিক দেখেই হারুর মা মৃণালের হাত ধরে ফেললো,

কত্তা মা কে কিছু বলো নি বউমা! উনি শুনলে আমার হারু রে ঘর তে তাইরে দেবেন! ওই মেয়ে সব্বনাশী গো!

আমি জানি তুই ভালো ছেলে, সবটা খুলে বল আমাকে! আমি কাউকে কিছু বলবো না,

হারুর মা কে থামিয়ে দিয়ে হারুর দিকে তাকিয়ে বললো মৃণাল, হারু তাও চুপ করেই থাকলো। হারু কিছু বলতে চাইছে কিন্তু সে যে মায়ের সামনে মুখ খুলবেনা এটা বুঝেই ওর মায়ের দিকে ঘুরলো ও,

তুমি যাও বউ, নিজের কাজ করো, আমি বড়ো মা কে কিছু বলবো না। হারুর কোনো বিপদ হবে না আমি কথা দিলাম!

হারুর মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বেরিয়ে গেলো। মা বেরিয়ে যেতেই নিজে থেকেই বলে উঠলো হারু,

বউ দিদি, করুণা কিছু করে নি, মা ওকে মিছেই দুষছে! কাল রাতে আলোক দাদাবাবু ওকে কটা কাগজ দিয়ে ছিলো গো রাখার জন্যে। ও কোথায় রাখতো বলো! তাই আমি ঘুঁটের বস্তা করে সেগুলো আমার বাড়িতে রেখে এসেছিলাম।

তুই করুণা কে ভালবাসিস! ওকে বাঁচাতে চাইছিস!

নিজের অজান্তেই গলা থেকে হাসির আওয়াজ বেরিয়ে এলো মৃণালিনীর, বউ দিদির হাসি বোধ হয় কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত করলো হারু কে,

আমি কি তোমাকে কাগজ গুলো দিয়ে যাবো বউ দিদি? কিন্তু করুণার কতা বড়ো মা কে বলো নি!

বউ দিদির ইশারায় আবার দৌড়ে বাড়ির দিকে বেরিয়ে গেলো হারু, অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়ে। হারু আর হারুর মা দুজনেই এখানে থাকে, তাদের বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য বাড়ি যে গোপন কাগজ রাখার উপযুক্ত জায়গাই বটে, সেটা ও বুঝতে পারলো। করুণা কি ইচ্ছাকৃত ভাবে হারু কে ব্যবহার করছে না কি হারু ভালোবেসে করুণা কে বাঁচাতে চাইছে এটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো মৃণাল। চুপ করে ঘরে বসে রইলো ও, এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে গভীর জলের মাছ আলোকের দিকে নজর রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

করুণা বা হারু যে শুধু মাত্রই দাবার চালের বোড়ে, সেটা বুঝেই আপাতত চুপ করে থাকার সিদ্ধান্তই নিলো সে। বড়ো মা কে কিছু জানানো মানেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করবেন উনি, হয়ত হারু এবং করুণা দুজনকেই বার করে দেবেন বাড়ি থেকে কিন্তু তাতে আলোকের টিকিটিও ছোঁয়া যাবে না, নতুন হারু বা নতুন করুণা সে ঠিকই খুঁজে নেবে আবার।
ক্রমশ