#মৃণালিনী
#পর্ব ৩৮
মনের ভেতরে এক অদ্ভুত খারাপ লাগা ঘিরে ছিলো মৃণালিনী কে। বড়ো মার বলা কথাগুলো মনকে ভারী করে রেখেছে সেই থেকে, নিজের ঘরে ফিরে এসে বিষণ্ণ মুখে জানলার গরাদে মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো মৃণাল।
বউ দিদি ভেতরে আসবো?
অন্য মনস্কতা কাটিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে ঘরের দরজায় হারু কে দেখতে পেলো মৃণালিনী।
কি রে হারু! কিছু বলবি? আয় ভেতরে আয়,
তাড়াতাড়ি বলে উঠলো মৃণাল, হারু আস্তে আস্তে ঘরের ভেতরে ঢুকে এলো।
করুণা আমাকে রেতের বেলা কাগজ গুলো এনে দিতে কোয়েছে বউ দিদি! তুমি ফেরত দে দেবে বলেছিলে,তাই ওগুলো নিতে এয়েলাম।
একটু দ্বিধা জড়ানো গলায় মাথা নিচু করে বললো হারু, মৃণাল মাথা হেলালো,
হ্যাঁ, বলে ছিলাম তো! দাঁড়া একটু দিয়ে দিচ্ছি, তুই যে এগুলো আমার কাছে রেখেছিলি করুণা কে বলিস না কিন্তু,
আলমারি থেকে একসাথে গোটানো কাগজগুলো বার করে হারুর হাতে তুলে দিলো মৃণালিনী। হারু একটু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিলো, বউ দিদি মুখে বললেও যে কোনোদিনও কাগজগুলো ওকে ফেরত দিতে পারে এই ধারণা ওর ছিলো না। কাগজগুলো হাতে পেয়ে কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো হারু তারপর আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
ও বেরিয়ে যাওয়ার পরেই মৃণাল অন্ধকারে দোতলার ঘর লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, উঠোনে দাঁড়ানো করুণার হাতে কাগজগুলো তুলে দিলো হারু, ওখানে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলো মৃণালিনী। করুণা গোটানো কাগজগুলো পেয়েই তার আঁচলের তলায় লুকিয়ে ফেললো, তার চোখে মুখে খুশি প্রকাশ পাচ্ছিলো। মনে মনেই একটু হাসলো মৃণালিনী, কাগজে কি লেখা আছে সেটা পড়ার সাধ্য করুণা বা হারু কারোরই নেই!
আলোক দাদাবাবু ভালো লোক নয় মোটে, তুমি একা এগুলো দিতে যেও নি কিন্তু! আমারে দিও, আমি তারে দে আসবোখনে,
হারুর মৃদু গলার মিনতি মাখা কণ্ঠস্বর, দোতলার বারান্দায় দাঁড়ানো মৃণালিনীর কানে পৌঁছলো, করুণা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো,
আমি যাবো নি গো, শুধু কাচে নে রাকলুম! এ বাড়িতে তো আর তার ঠাঁই হবে নি, তাই যদি নিজের জিনিসপত্তর ফেরত নে যেতে আসেন, তবে যার জিনিস তারে দে দেবো,
হারু যেনো নিশ্চিন্ত হলো, এই সরল সাদা ছেলেটির প্রতি মৃণালের মায়া হচ্ছিলো, কতো সহজেই ও করুণার কথা বিশ্বাস করে নিচ্ছিলো। এরপরেই করুণা দ্রুত নিজের ঘরের দিকে পা চালালো, তাকে যতক্ষন দেখা গেলো,হারু ওখানে দাঁড়িয়েই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
একটু পরেই নীচের থেকে খাবারের ডাক পড়লো, সৌম্য নামার আগেই মৃণাল নিচে নেমে এসেছিলো। করুণা যথেষ্টই মনোযোগের সঙ্গে নিজের কাজকর্ম করছিলো, তাকে দেখে একটুও বোঝার উপায় ছিলো না যে সে মাত্র একটু আগেই এতো বড়ো একটা অপরাধ ঘটিয়ে এসেছে।
রাতের খাবার খেতে বসে এবেলাও বাবা ছেলে তে কোনো কথা হলো না, সৌম্য এবং শ্যাম সুন্দর দুজনেই গম্ভীর হয়ে রইলেন। এই মুহূর্তে বাপ ছেলের মধ্যে জেদাজেদী চলছিলো, ছেলের কথায় সায় দিয়ে জমি স্কুল কে দেওয়ার প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে ছিলেন বটে কিন্তু সে তাঁর একান্তই কোনো উপায় ছিলো না বলেই। কিন্তু তিনি মনে মনে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলেন, এই প্রথম বার ছেলের সঙ্গে কোনো বিষয়ে তাঁর মনোমালিন্য হয়েছিলো প্রকাশ্যে। তাঁদের মনোমালিন্যের রেশ বাড়ির সবাই কেও প্রভাবিত করছিলো, আজ তাই সবার খাওয়া দাওয়াই নিঃশব্দে হলো। মৃণালও আজ চুপচাপই ছিলো, খেতে বসে বড়ো মার খালি জায়গাটার দিকেই চোখ চলে যাচ্ছিলো বার বার, আর কড়া কথা বলা মানুষটির ভেতরের অসহায়তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটে গেলো, বামুন দিদি, করুণা এবং হারুর মা মিলে এঁটো দালান পরিষ্কার করে ফেললো। করুণা পারুল বালার অসুস্থ হবার পর থেকেই তাঁর ঘরেই শোয়, আজও সে সেদিকে পা বাড়াচ্ছিলো মৃণালিনী তাকে পেছন থেকে ডাকলো।
বড়ো মার শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছে করুণা, রাতে প্রয়োজন হলে ডাকিস কিন্তু!
করুণা কোনো উত্তর দিলো না, সে বেশ কিছুদিন ধরেই মৃণালিনীর সঙ্গে উদ্ধত আচরণ করে, আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। তাকে কোনো উত্তর না দিয়েই দালান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে এবার কুমুদ বিরক্ত হলেন,
এ কি কতা করুণা! বউ দিদির কতার কোনো উত্তর না দে চলে যেতে লেগেছিস যে বড়ো! মানুষ কে মানুষ বলে গেরাজ্যি করিস নে নাকি!
করুণা মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো। হারুর মা এমনিতেই করুণা কে পছন্দ করে না, তার সঙ্গে তার জন্যেই কলকাতা যাওয়া তার বাতিল হয়ে যাওয়ায় সে আরো ক্ষুব্ধ হয়েছিলো, এই সুযোগে সেও নিজের ক্ষোভ কিছুটা মিটিয়ে নিতে চাইলো,
সেদিন তো এই কতাখানই কয়েছিলুম মা গো, মেয়ে বড়ো ঢ্যাটা! সুদু তার মুকে মুকে তক্ক! ছোট বড়ো জ্ঞান করে নি এট্টুও!
তুমার অতো সব কতায় কিসের কতা? আমার কি কাজ সে কি আমি জানিনি? লোকে আমারে শিইক্যে দেবে, তবে আমি করবো? গতরে খেটে খাই, কাজের অভাব হবে নি কো! অনেক সোজ্য করিচি, আর একানে থাকবুনি!
প্রায় তেড়ে উঠলো করুণা, হারুর মা কে কথাগুলো বলা হলেও তার লক্ষ্য যে আসলে মৃণালিনী, সেটা ওখানে উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলো। করুণার ধৃষ্টতা সীমা অতিক্রম করছিলো বামুন দিদি নিজেও এবার ভাইঝির ওপরে যথেষ্টই বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি চৌধুরী বাড়িতে অনেকদিন ধরে আছেন, এই ভাইঝির জন্যেই ইদানিং তাঁর এখানে বার বার সম্মানহানি হচ্ছিলো, তিনি এবার ক্রুদ্ধ মুখে এগিয়ে এলেন, সবে করুণা কে মারার জন্যে তাঁর হাত উঠেছিলো, মৃণালিনী তাড়াতাড়ি এসে ধরে ফেললো।
ছেড়ে দাও বামুন দিদি, ছোটো মেয়ে বলে ফেলেছে! এতো রাতে আর অশান্তি কোরো না, বড়ো মার শরীর খারাপ, ওনার ঘুম ভেঙে যাবে।
কথাগুলো বলেই আর ওখানে দাঁড়ালো না মৃণালিনী, সে দোতলার সিঁড়িতে পা দিতেই কুমুদও তার সঙ্গ ধরলেন। বামুন দিদি নিজের মনেই গজগজ করতে করতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন, করুণাও পারুল বালার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। হারুর মা সদর এবং খিড়কির দরজা বন্ধ করার জন্যে এগোচ্ছিল, করুণা চলে যেতেই মৃণাল তাকে ডাকলো।
বউ, আজ দরজাগুলো তে তালা দিয়ে দিও, শুধু খিল তুলে চলে এসোনা কিন্তু। চারদিকে যা গন্ডগোল চলছে, কি জানি রাতে আবার কিছু হয় নাকি!
হারুর মা মাথা নাড়লো,
হ্যাঁ গো বউমা, সেও ঠিক! ওই আলোক আর বিভাস, দুটোই শয়তান!! এতো সহজে তারা তোমারে ইস্কুল বানাতে দেবে নি গো!
হারুর মা দরজায় তালা লাগাতে গেলো, মৃণাল শাশুড়ির সঙ্গে দোতলায় উঠে এলো। কুমুদ নিজের ঘরে চলে গেলেন, মৃণালও তার ঘরে এসে ঢুকলো। করুণা কাগজপত্রগুলো কিভাবে আলোকের হাতে তুলে দিতে পারে সেই চিন্তাই তার মাথায় ঘুরতে লাগলো।
আজ তো তোমার সব থেকে আনন্দের দিন! কবে তুমি বলেছিলে মেয়েদের স্কুলের কথা! সেই ছেলেদের স্কুল তৈরি হতে দেখে! তবে আজ কেনো চুপ চাপ?
রাতে বিছানায় শুয়ে বললো সৌম্য, মৃণাল কোনো উত্তর দিলো না। এক সময় এই বিছানায় শুয়েই ও কতো চোখের জল ফেলেছে! আজ সেই দিনগুলো মনে পড়ছিলো, সেই দাপুটে বড়ো মার এই পরিবর্তন! মানুষ যা চায়, তাই নিয়ে কেনো খুশি হয় না! আজ কেনো যেনো ওর বড়ো মা কে সেই দাপুটে বড়ো মা হয়েই দেখতে ইচ্ছে করছে বার বার! যাঁর বউমা ডাক কানে গেলেই তটস্থ হত ও, আজ কেনো সেই ডাকটাই শুনতে ইচ্ছে করছে বারবার। এই ভেঙে যাওয়া বড়ো মা কে ও কোনোদিনও দেখতে চায় না। চোখ বন্ধ করলেই যে পারুল বালা ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তিনি দাপুটে পারুল বালা, যাঁর কথায় ওঠে বসে চৌধুরী বাড়ির লোকজন, সেই পারুল বালাই যেনো বড্ড প্রিয় ওর!
বড়ো মা কে আজ অন্য রকম ভাবে চিনলাম!
বউয়ের কথায় মৃদু হাসলো সৌম্য,
সবাই কে উনি শাসন করেছেন জানো তো! কিন্তু আমাকে কখনও বকেন নি। বড়ো মা নিজে এগিয়ে এসেছেন যখন এবার তোমার আর কিছুতেই আটকাবে না! তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও!
রাত বাড়ছিলো, সৌম্য ঘুমিয়ে পড়ার পরে আস্তে আস্তে ঘরের লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ালো মৃণালিনী। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে গোটা গ্রাম, চারিদিকে রুপোলি চাদরের মতো বিছিয়ে আছে চাঁদের আলো, পুকুরের জলে নারকেল গাছের ছায়া ওকে সেই প্রথম রাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, যেদিন ও এ বাড়িতে প্রথম পা দিয়েছিলো।
সেদিনের মৃণালিনী আর আজকের মৃণালিনী তে অনেক ফারাক! সেদিনের সংসার অনভিজ্ঞ তরুণীই আজকের সংসারী মৃণালিনী। নিজের নতুন স্কুলের দায়িত্ব তাকে চিন্তিত করছিল। একটু অন্যমনস্ক হয়েই সে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলো। হটাৎ করে একটা মৃদু খুট করে আওয়াজ তার সম্বিত ফেরালো, ঘরের দরজা খুলে উঠোন পেরিয়ে পুকুরের খিড়কি দরজার দিকে পা টিপে টিপে হেঁটে যাচ্ছে কেউ! সেটা যে কে, সেটুকু মৃণালের অজানা ছিলো না।
এখন মৃণালিনী যথেষ্টই সাহসী, ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় লন্ঠন নেবার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করলো না সে, সৌম্য কে ডাকার সময়টুকুও তার হাতে নেই! দ্রুত পায়ে নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে খিড়কি দরজার সামনে যখন সে এসে পৌঁছল, তখনও সেই ছায়ামূর্তি অর্ধেক রাস্তাও অতিক্রম করতে পারেনি। তার অতি সাবধানতাই তার গতি শ্লথ করেছে, এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হাতে একটি বড়ো কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে সে দরজার দিকেই হেঁটে আসছে। দরজার পাশেই পাত কুয়ো, ছায়া মূর্তি কে এগিয়ে আসতে দেখেই সেদিকে সরে দাঁড়ালো মৃণালিনী।
বুকের কাছে পুঁটলিটা জড়িয়ে ধরে খালি পায়ে কাঁপা কাঁপা বুকে দরজার দিকে এগিয়ে এসে দরজার খিলের গায়ে হাত দিয়েই থমকে গেলো করুণা, দরজার গায়ে ঝোলানো বড়ো তালা! আর তার সামনেই দু হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে রেখে সোজা তার দিকেই তাকিয়ে আছে বউ দিদি!
পালিয়ে যাচ্ছিস? আলোকদার সঙ্গে?
বউ দিদির কথা শেষ হবার আগেই আর এক মুহুর্তও দেরি না করে কেঁদে ফেলে মাটিতে বসে পড়লো করুণা, মৃণালিনীর আর কিছুই করার দরকার পড়লো না।
করুণার কান্নার আওয়াজে জেগে উঠে যখন গোটা চৌধুরী বাড়ি, বাড়ির খিড়কি দরজায় উপস্থিত হলো ততোক্ষনে করুণা সব কথাই কবুল করে ফেলেছে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আসল ব্যক্তি আলোক ততোক্ষনে পগার পার, তাকে খুঁজে আনতে লোক পাঠালেন শ্যাম সুন্দর, সকালের আগে কোথাও যাওয়ার ট্রেন নেই!
মাঝ রাতে আর খুব বেশি লোক জানাজানি হওয়ার আগেই পারুল বালার কথায় সদর দরজায় খিল আঁটলো চৌধুরী বাড়ি। শ্যাম সুন্দর ওপরে উঠে গেলেন, রাত এখনও অনেক বাকি ছিল। অসুস্থ পারুল বালা খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন, তাঁকে ঘিরে মাটিতে বসে আছে মহিলা মহল। করুণা মাথা নিচু করে কেঁদে চলেছে, হাজার ধমকও তার কান্না থামাতে পারেনি।
আমার কতা আর এ বাড়িতে কবেই বা গেরাজ্যি হয়েচে! তখনই পই পই করে বলেছিলুম, আই বুড়ো মে! ঘরে রেখনি দিদি! তা কেউ শুনলে তো!
আজ কুমুদ এর গলার জোর বেশ বেশি! তাঁর কথা সত্যি হওয়ায় বড়ো জাও যে কিছু বলতে পারবে না সেটা বুঝেই আজ বেশ রাগ দেখিয়ে বললেন তিনি। মৃণাল এতক্ষন বড়ো মার ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, শাশুড়ি কে রাগ করতে দেখে এগিয়ে এলো,
অনেক রাত হয়েছে মা! এসব কথা এখন থাক! কাল সকালে না হয় আলোচনা হবে! বড়ো মার শরীর খারাপ, এখন তাঁর বিশ্রাম দরকার।
বৌমার কথা শেষ হলো না শুয়ে পড়লেন পারুল বালা, সত্যিই তাঁর আর বেশিক্ষণ বসে থাকার মতো ক্ষমতা ছিল না। করুণার সঙ্গে থাকা পুঁটলিটা এতক্ষন মৃণালিনীর হাতে ধরা ছিলো, তাকে সেটা ঘরের মেঝেতে রাখতে দেখেই শুয়ে শুয়েই ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠলেন পারুল বালা,
খবরদার! ওই নোংরা পুঁটলি একদম আমার ঘরে নামাবে নে বউমা, ও ছুঁড়ে ফেলে দাও! আর ওকে ওর পিসির ঘরে পাঠিয়ে দাও। নিজের মে র মতন করে ঘরে ঠাঁই দিলুম, সে আমারে বোকা বানিয়ে পালিয়ে যেতে চায়!
করুণা চোখ মুছতে লাগলো। মৃণাল এর ইশারায় আস্তে আস্তে করুণার হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন বামুন দিদি, হারুর মা কে আজকের রাত টা বড়ো মার কাছে শুতে বলে উপরে গেলো মৃণালিনী। সৌম্য তখনও ঘরে এসে পৌঁছয় নি। গত দুদিন ধরে তার বাবার সঙ্গে চলা গন্ডগোল, করুণার এই ঘটনার পরে অনেকটাই মিটে গিয়েছিলো। এখন তাদের বাপ ছেলেতে পরবর্তি পদক্ষেপ কি হতে পারে সেই নিয়েই আলোচনা চলছিলো।
করুণার হাতের পুঁটুলি বড়ো মা তাঁর ঘরে রাখতে দিতে রাজি না হওয়ায়, সেটা কোথায় নামাবে বুঝতে না পেরে হাতে করে ওপরেই নিয়ে এসেছিলো মৃণালিনী, সেটা খাটের তলায় রাখতে গিয়েই ঝন ঝন করে আওয়াজ হলো। দ্রুত হাতে বার করে নিয়ে এসে পুঁটলি খুললো মৃণালিনী, তার হারুর হাতে দেওয়া কাগজগুলোর সঙ্গে সাদা কাপড়ে মোড়া বড়ো মার গয়নার পুঁটলি টা চিনতে তার একটুও অসুবিধা হলো না! মাঝে মাঝেই এখান থেকেই তো বার করে সবাই কে গয়না দেন বড়ো মা, সেও পেয়েছিলো, কদিন আগেই সরমাও পেয়েছে!
ক্রমশ
#মৃণালিনী
#পর্ব ৩৯
সকাল হতে না হতেই হৈ চৈ পড়ে গেলো, আলোক কে চণ্ডী পন্ডপে ধরে আনা হয়েছে। খবর পেয়েই শ্যাম সুন্দর হন্তদন্ত হয়েই বেরোচ্ছিলেন, অসুস্থ শরীরেই পারুল বালা বেরিয়ে এলেন,
দেকো ঠাকুর পো, করুণার নাম যেনো সামনে না আসে, আই বুড়ো মে, বে দিতে পারবো নে কিন্তু!
মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলেন শ্যাম সুন্দর, পেছন পেছন সৌম্য। বিচার পর্ব সমাধা হলো দ্রুতই, কারণ বিচার করার মতো খুব বেশি কিছুই ছিলো না। না সে করুণা কে সঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছিলো, না তার সঙ্গে থাকা পুঁটলির টাকা, গয়না, কাগজ তার হস্তগত হয়েছিলো। বিচার শেষ হবার পরে তাকে বাইরের বৈঠকখানা ঘরে এনে বসানো হলো, পারুল বালা তাকে বাড়িতে ঢুকতে দিলেন না,
খবরদার! ওই নোংরা ছেলে যেনো আমার বাড়ির চৌকাঠ না পেরোয়! ওর বাপ মা কে খপর দাও, তারাও এসে দেকুক তাদের গুণধর ছেলে কে!!
চৌধুরী বাড়ির বৈঠকখানায় ততোক্ষনে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছিলো, গৃহকর্ত্রী পারুল বালা তাঁর ভাইপোর কি শাস্তির ব্যবস্থা করেন তা দেখার জন্যে সকলেই উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।কিন্তু পারুল বালা অন্য ধাতের মানুষ, ব্যাক্তিগত ব্যাপার জনসমক্ষে প্রকাশ করার বান্দা তিনি নন। ভিড় লক্ষ্য করেই কৌতুহলী গ্রামবাসীদের দিকে ঘুরলেন তিনি,
এবার সব এসো দিকি বাছা! এখানে কোনো পালা হচ্ছে নে! এসব আমাদের নিজেদের সমিস্যে, তোমাদের এ কতায় থাকার মতো কিচু নেই কো!
মুহূর্তের মধ্যে খালি হয়ে গেলো বৈঠকখানা, এখনও তাঁর গলায় সে দাপট ফিরে আসে মাঝে মাঝে! আস্তে আস্তে বাড়ির সবাই জড়ো হয়েছিলো, মৃণালিনীও কৌতূহলী দৃষ্টিতে আলোকের মুখের দিকে তাকিয়েছিলো। এখানে আলোক কে নিয়ে আসার কারণ আসলে একটাই, গত রাত থেকেই বামুন দিদি পারুল বালার পায়ে পড়ে গিয়েছেন, আলোকের সঙ্গে তাঁর ভাইঝির বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। করুণা জানিয়েছে আলোক তাকে বিয়ে করবে কথা দিয়েছিলো, সেই জন্যেই সে পালিয়ে যাচ্ছিলো বাড়ি থেকে।
হারু ম্রিয়মাণ মুখে সদর দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তার বিষণ্ণ মুখ মৃণালিনীর নজর এড়িয়ে যাচ্ছিলো না। করুণার গতরাতের ঘটনার পর থেকেই সে একটাও কথা বলে নি। হারুর মাও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েছিলো, তার মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে ছিলো। এই গ্রামের যে কোনো মুখরোচক খবর তার নখদর্পণে থাকে, এই প্রথম বার এতো উত্তেজনাপূর্ন একটা খবর সে নিজের ছেলের জড়িত থাকার কারণেই খুব বেশি উপভোগ করে উঠতে পারছিলো না।
বউ বাইরের দরজাটা একটু বন্ধ করে দাও তো,
নিচু গলায় বললো মৃণালিনী, হারুর মা এই সুযোগ আর নষ্ট করলো না। দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে সে মৃণালের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো,
বউমা! আমার হারু রে এট্টু দেকো মা! ছেলেটা আমার বড্ড বোকা, কতোবার কয়েছি, এসব কতায় থাকিস নি! তা সে শুনলে তো! আজ কি বেপদে পড়লুম বলো দিকি!
মৃণাল মৃদু হাসলো,
হারুর কিচ্ছু হবে না বউ, ও সব কিছু আমাকে জানিয়েই করেছে, তুমি অতো চিন্তা কোরো না।
হারুর মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। শ্যাম সুন্দর পারুল বালার দিকে ফিরে নিচু গলায় বললেন,
নাও বৌদি কি বলার আছে তোমার তাড়াতাড়ি বলো। আমি সুরেশ কে সদরে পাঠিয়েছি, ওকে পুলিশে দেবো।
মৃণাল চমকে উঠলো, সৌম্যও অবাক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো,
পুলিশে দেবে! কোন অপরাধে? তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে বাবা? আলোক দার কাছে তো কিছুই পাওয়া যায় নি।
শ্যাম সুন্দর ঘাড় নাড়লেন,
কে বললো নেই? বউমার করা হিসেবের খাতা, আর ওর গরমিল করা হিসেব, সব আমি গুছিয়ে রেখেছি। আজকের কথা নাকি সেসব! ওকে জেলের ঘানি টানিয়েই ছাড়বো, উকিল শ্যাম সুন্দর কে ও চেনে না।
আলোক মাথা নিচু করে বসেছিলো, এসব কথা তার কান পর্যন্ত যাচ্ছিলো কিনা বোঝা মুশকিল। দেওরের কথা শুনে এবার ভাই পোর সামনে এগিয়ে এলেন পারুল বালা,
দেকো বাছা, ওসব থানা, পুলিশ আমি করতে চাই নে কো, হাজার হোক তুমি আমার বংশের ছেলে! তুমি যাকে বে করতে চেয়েছিলে তাকে নে এ বাড়ি তে দূর হয়ে যাও! তোমার বাপ মা কে আমি খপর দে ডেকিচি, তারা এলে ওই মায়ের মন্দিরে দাঁড়িয়ে আমি তোমাদের বে টুকু দে নিছিন্ত হবো! আর কোনোদিন এমুকো হয়ো নি কো।
আলোক মাথা নাড়লো, সে যে যথেষ্টই ধুরন্ধর সেটা এই মুহূর্তে স্পষ্ট হচ্ছিলো, সে আসলে করুণা কে ব্যবহার করেছে মাত্র। করুণার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া জমির কাগজ পত্র, টাকা আর পারুল বালার গয়নাই তার আসল লক্ষ্য ছিলো, সেগুলো পেয়ে গেলেই যে সে করুণা কে ছুঁড়ে ফেলে দিতো সেটা তার আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছিলো।
আমি ভদ্রলোকের ছেলে, কাজের মেয়ে কে বিয়ে করবো! ও বললেই হবে! আমি কখনো ওকে বিয়ের কথা বলিনি!
মৃণাল চমকে উঠলো, আলোক যে এতো নিচে নামতে পারে সেটা তার ধারণাও ছিলো না। ওখানে উপস্থিত সবাই অবাক দৃষ্টিতে আলোকের দিকে তাকালো। দরজার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা করুণা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পারুল বালা নিজেও থমকে গেলেন। বামুন দিদি দরজার পাশে ভাই ঝি কে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আলোকের এই কথার পরে আর নিজেকে সংযত রাখতে না পেরেই প্রায় তেড়ে এলেন,
কি কইলে তুমি? আমরা কাজের নোক! তা এতদিন এ কতাখান কি ভুইলে মেরেছিলে নাকি? কত্তা মা এর একখান বিচের কইরে দিতে হবেই কিন্তু,
শেষের কথাগুলো তাঁর পারুল বালার উদ্যেশ্যে ছিলো, পারুল বালা কোনো উত্তর না দিয়েই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের ভাই পোর এই অধঃপতন তিনি সম্ভবত কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
কুমুদ এতক্ষন একধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবার আলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর স্বভাবমতই আলোকের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে নিচু গলায় বললেন,
বাবা, মেয়েটা কে উদ্ধার করো! তুমি ওকে ফিরিয়ে দিলে ওর সম্মান যাবে বাবা! আর কেউ যে ওকে বে করবে না বাবা!
শাশুড়ির কথায় ক্ষিপ্ত হচ্ছিলো মৃণালিনী, এই বাজে মানসিকতার লোকটির কাছে তাঁর এই আবেদন অসহ্য লাগছিলো তার। আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে সে সবে মাত্র শাশুড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে দয়া ভিক্ষা করতে বারণ করতেই যাচ্ছিলো, পেছন থেকে আসা বড়ো মার কণ্ঠস্বর তাকে থামিয়ে দিলো।
ভদ্দর নোক! চোর আবার ভদ্দর নোক! বোকা মে টা কে দে সব কাজ করিয়ে তাকে গেরামের নোক এর সামনে ছোটো করে চলে যেতে চায় যে, তার আবার বড়ো বড়ো কতা! কাকে বলিস কাজের মে! তুই ও তো আমার ঘরেই পড়ে ছিলি এতদিন! ও মেও তাই! তাইলে তোর সঙ্গে ওর আর তফাৎ কি!
পিসিমা! তুমি আমাকে ওর সঙ্গে তুলনা করলে!
আলোকের গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ছিলো।
চোপ! কে তোর পিসিমা! তুই আমার ঘরের কাজের নোক। ঠাকুর পো র জমি দেকার জন্যে তোকে এনিচি। তোর বাপ তোকে খেতে পড়তে দিতে পারছিলো নে, তাই আমার পায়ে পড়েছিলো। নাইলে আমার আবার কিসের বাপের বাড়ি, আর কিসের ভাইপো! কোনো দিন টাকা ছাড়া আমার ভাইরা বুজেচে কিচু! যদ্দিন টাকা তদ্দিন বোন, আমি কিচু বুজি না ভাবিস! কে আর এই পারুল বালা কে দরকার ছাড়া মনে করেচে কখনো!
তাঁর বলা কথাগুলো যে শুধুই ভাইপো আলোকের উদ্যেশেই নয়, সেটা উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলো, বিশেষ করে শ্যাম সুন্দর। বৌদি কে তো তিনিও সারা জীবন ব্যবহার করে এসেছেন নিজের স্বার্থেই। দাদার সম্পত্তি নিজের দখলে রাখার জন্যেই যে তাঁর বৌদি কে গিন্নি সাজিয়ে রাখা, সেটা যে আসলে পারুল বালা বুঝতেন এবং জেনেও না বোঝার ভানই করে এসেছেন সারা জীবন, আজ তাঁর কথায় সেটা স্পষ্ট হচ্ছিলো, মাথা নিচু করে নিলেন শ্যাম সুন্দর।
এবার কুমুদের দিকে ঘুরলেন পারুল বালা,
আর কতো কাল নোকের পায়ে পড়ে থাকবি! তোর বউ তো তোকে কম সেকায় নে এতো দিন ধরে! তবে! আমার কিচু ছিলো নে, তাও তো শুধু এই মুকের জোরেই টিকে রয়েচি! নিজের কতা টুকু নিজেই বলবি তো! তা না, শুধুই নাকি কান্না! ঝাঁটা মেরে বিদেয় কর আবাগীর বেটা কে! ও ছাড়া কি দুনিয়ায় আর পাত্তর নেই!
অবাক হয়ে এই অশিক্ষিতা গ্রাম্য মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইলো মৃণালিনী, সে বড়ো মা কে যত দেখছিলো ততই আশ্চর্য্য হচ্ছিলো। তাঁর কড়া কড়া কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই অচেনা পারুল বালা ক্রমশই তাকে মুগ্ধ করছিলো। যে কড়া কথাগুলো একদিন তাকেও কম কষ্ট দেয়নি, সেগুলো যে আসলে নিজেকেই সংসারে দামী করে রাখার একটা প্রয়াস মাত্র, সেটা এতদিনে উপলব্ধি হচ্ছিলো তার। বড়ো মার জন্যে এক অজানা কষ্টে তার মনের মধ্যে ভাঙচুর হতে লাগলো।
ক্রমশ