#মৃণালিনী
#পর্ব ৪২
পরের দিন সকালে সুরেশ এলো, গতকালের আলোকের ঘটনাও তার অজানা ছিলো না, গ্রামে কথা বাতাসের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়। তাকে দেখে মৃণালিনী এগিয়ে এলো, সে নিচেই বাগানে বড়ো মার পুজোর ফুল তুলছিলো।
বৌদি স্কুল করতে চলেছেন শুনলাম, খুব ভালো লাগলো। জমিটা কোনো ভালো কাজে লাগছে ভেবেই ভালো লাগছে। শুরু তো করুন তারপর আস্তে আস্তে সরকারি সাহায্যের জন্য চেষ্টা করা যাবে।
মৃণাল হাসলো,
হ্যাঁ, সুরেশ বাবু শুরু টুকুই করতে চাই। আসুন, ভেতরে আসুন,
হারু কে দিয়ে সৌম্য কে ডাকতে পাঠিয়ে সুরেশ কে বৈঠক খানা ঘরে নিয়ে বসালো মৃণালিনী। সুরেশ কথায় কথায় বিদ্যুতের কথা তুললো, গ্রামে বিদ্যুৎ আসতে আর খুব বেশি দিন লাগবে না জানালো। এই মুহূর্তে একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র আর মেয়েদের স্কুলটাই যে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ সেটা সে জানে বলেই ইস্কুলের জন্য সরকারি সাহায্য পেতে খুব বেশি অসুবিধা হবে না বলেই তার ধারণা। তার কথাগুলো মৃণালের মনেও আশা জাগিয়ে তুলছিলো।
এরপর সৌম্য কে আসতে দেখে সে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো, তার এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। বিছানা তুলে তাকে হেঁসেলে ঢুকতে হবে, বামুন দিদি ভাইঝির খবরে খানিক মন খারাপ করে আছেন, তাঁকেও হাতে হাতে এগিয়ে দিতে হবে কিছুটা। ওপরে বিছানা তুলতে এসে খাটের তলায় রাখা করুণার পুঁটলিটার কথা মনে পড়লো, সেই থেকে এখানেই রয়ে গেছে।
বেশ কিছু দলিল রয়েছে তাতে, সঙ্গে বেশ কিছু টাকাও, সেগুলো আলোক কোনো ভাবে সরিয়ে করুণার জিম্মায় রেখেছিলো, পরে নিয়ে নেবে এরকমই আশা ছিলো নিশ্চয়ই। সেগুলো আলাদা করে গুছিয়ে রাখলো মৃণাল, শ্বশুর মশাই কে ফেরত দিতে হবে। বড়ো মার গয়নাগুলো আলমারি তে রেখেছিলো সেদিন রাতেই, তার পাশেই দলিলগুলো তুলে রাখলো।
বউ দিদি! ভেতরে আসবো?
মৃণাল পেছন ঘুরে তাকালো, হারু তার ঘরের দরজায় ম্লান মুখে দাঁড়িয়েছিলো।
কিছু বলবি?
বউ দিদির প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় কাত করলো হারু,
হ্যাঁ, বউ দিদি! তোমরা কি করুণা রে কলকেতা পাইঠে দেবে?
মৃণাল অবাক হলো,
এখনও ঠিক হয়নি কিছু, কিন্তু তোকে কে বললো?
হারু মুখ নিচু করলো,
করুণা বলতে ছেলো! ওরে তুমি তোমার বাবার কাচে রেকে আসবে কলকেতায়!
হারুর জন্যে খারাপ লাগছিলো মৃণালের, একটু দুঃখের গলায় বললো,
জানি তুই ওকে ভালবাসিস! কিন্তু এখন কি করি বলতো! গ্রামের লোকজন কে তো জানিস! ওর পক্ষে এখানে টেকা মুশকিল!
বউ দিদি, আমি ওরে বে করতে চাই,
একটু কুণ্ঠিত গলায় বললো হারু, মৃণালের মুখ গম্ভীর হলো।
তুই ওকে কিছু বলেছিস নাকি!
খানিকটা বিরক্তির গলায় বললো মৃণালিনী, হারু সরাসরি বউ দিদির দিকে তাকালো না। মাথা নিচু রেখে সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়লো, মনে মনেই একটু বিরক্ত হলো মৃণাল।
হারু, তুই সব জানিস। জেনে শুনেও ওকে বিয়ে করতে চাইছিস!
হারু মুখ নামিয়ে নিলো।
বউ দিদি, ও একখান ভুল করি ফেলেছে! ও আলোক দাদাবাবু রে ঠিক চিনতি পারে নি,
এই কথাগুলো তোকে কে বললো? করুণা বুঝি?
একটু শ্লেষের গলায় বললো মৃণাল, এতো কিছুর পরেও করুণা আবার হারু কে ব্যবহার করছে ভেবে ওর বিরক্তি আসছিলো। হারু তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো,
না না বউ দিদি, সে কিছু কয় নি, আমিই বলতে ছেলেম! সে সুদু কলকেতা যাবার কথা বলতে ছেল!
মৃণাল একটু চুপ করে থাকলো, খানিকক্ষন ভেবে বললো,
ওকে কলকাতা পাঠাচ্ছি না, বড়ো মা ওর বিয়ের সম্বন্ধ করছেন। এতো কিছুর পরেও তুই ওকে বিয়ে করতে চাস যখন তখন বলি তোকে, এ ব্যাপারে সত্যিই আমার কিছু করার নেই!
হারু মুখ শুকনো করে চলে গেলো। মৃণাল নিচে নেমে এসে দেখলো বড়ো মা রান্না ঘরের দাওয়ায় এসে বসে আছেন। সে নামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হারুর মা শিবু ঘটক কে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। ঘটক মশাই কে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই বামুন দিদি খানিক উৎসাহ ভরে তাকালেন।
বলুন কত্তা মা! মেয়ের বিয়ে তো দিয়ে ফেলেছেন! তাহলে আবার শিবু কে ডাকাডাকি কেনো!
হারুর মায়ের এগিয়ে দেওয়া পিঁড়ি টেনে নিয়ে রান্না ঘরের দরজায় বসতে বসতে বললেন শিবু ঘটক,
পারুল বালা মাথা নাড়লেন,
এই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো একখান তুমিই তো আচো শিবু! তা তোমারে ছাড়া আর কারে খপর করি বলো! মে র আমার অভাব নেই কো! একখান গেচে বলেই কি শেষ? আর একখান এর ব্যবস্তাখান এট্টু করে দিতে হবে নে! করুণা রেও তো আমি মের মতনই দেকিচি!
শিবু ঘটক গম্ভীর হলেন, মুখে সামান্য বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
কত্তা মা! শিবু ঘটক এর একটা সম্মান আছে গাঁয়ে, যার তার সম্বন্ধ সে করে না!
পারুল বালা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, থমথমে মুখে বললেন,
কারে তুমি যার তার কও শিবু? তুমি কার দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আচো সে কতা নিচ্ছোই ভোল নি কো!
মুহূর্তে শিবু ঘটকের মুখ শুকিয়ে গেলো, নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি নরম গলায় বললেন,
সে কি কথা কত্তা মা! আপনাদের নুন খেয়ে বেঁচে আছি, সে কি ভুলতে পারি কখনও! তবে এ মেয়ের পাত্র পাওয়া সহজ নয়, তাই বলছিলাম আর কি! যতোই লোকের মুখ বন্ধ করুন মা, কিছু জানাজানি হতে আর বাকি নেই! কে এমন মেয়ে কে নিজের ঘরে তুলবে বলুন তো?
বামুন দিদি চোখে আঁচল চাপা দিলেন, পারুল বালা থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলেন। কুমুদ আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে শিবু ঘটকের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
কিচু একটা ব্যবস্তা করো শিবু, না হয় দুটো পয়সা বেশীই লাগুক! তবু মে টা পার হোক!
ঘটক মশাই মাথা নাড়লেন,
ওই খানেই তো গন্ডগোল ছোটো মা! যা হয়েছিলো সেটুকু না হয় টাকা পয়সা দিয়ে চাপা দেওয়া যেতো, কিন্তু মেয়ের মুখের কথা যে গাঁয়ে ছড়িয়ে গেছে মা ঠাকরুন! ছেলে কে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জানার পর ওই মুখরা মেয়ে কে কেও নিজের ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে চায়? আপনিই বলুন না!
এতক্ষন রান্না ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মৃণালিনী এগিয়ে এলো, শিবু ঘটকের দিকে তাকিয়ে বললো,
তাতে কি হয়েছে শিবু কাকা? ওই ছেলে কে বিয়ে করতে না চাওয়া তো দোষের নয়! ও তো নিজে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যেই ওকে বিয়ে করতে চাইছিলো!
শিবু মাথা নাড়লেন,
সোনার আংটি আবার বাঁকা! কি যে বলো বউ মা! পেটে একফোঁটা বিদ্যে নেই, বাপের টাকার জোর নেই, লোকের বাড়িতে পড়ে থেকে পেট চলে, তার আবার বড়ো বড়ো কথা!
পারুল বালা হাত তুললেন,
তাক! তোমারে আর কিচু কত্তে হবে নে! তুমি একন এসো বাছা!
আসি তবে কত্তা মা! পাত্র পেলে আমাকে জানাবেন নিশ্চয়ই,
একটু শ্লেষের গলায় কথাগুলো বলে গাত্রোত্থান করলেন শিবু ঘটক, পারুল বালা গম্ভীর হয়ে গেলেন। শিবু ঘটক বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই বাড়িতে নতুন করে থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হলো। এতো চেষ্টার পরেও যে করুণার ব্যাপারে কোনো কথাই গ্রামে জানাজানি হতে বাকি নেই, সেটা বোঝাই যাচ্ছিলো। চারিদিকে চরম নৈঃশব্দ্য বিরাজ করতে লাগলো, বামুন দিদির খুন্তির আওয়াজ আর গোয়াল থেকে ভেসে আসা গরুর ডাক ছাড়া কোথাও কোনো আওয়াজ নেই!
কই! দিদি কই গো! সব এতো চুপ চাপ কেনো!
বলতে বলতে মনোরমা সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন, তাকে দেখেই কুমুদ এর মুখ শুকিয়ে গেলো। অনেকটা জোর করেই মুখে হাসি টেনে এনে বললেন,
এসো দিদি এসো! কদ্দিন পরে এ বাড়িতে পা দিলে!
মনোরমা মাথা নাড়লেন,
আর আসা বললেই আসা! কাজের কি আর শেষ আচে গো দিদি! ওই বিভার মা তার মের বে র জোগাড় দিতে ডেকে পাটায়, তাই আর এদিক পানে আসা হয় নে কো!
মৃণাল একটু চমকে তাকালো। বিভার বিয়ের ঠিক হয়ে যাওয়ায় যে মনোরমা আবার বিভার মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করে ফেলেছেন সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। চৌধুরী বাড়ির দুই শরিক আবার নিজেদের মধ্যে হাত মিলিয়ে ফেলেছে সেটা মনোরমার কথায় পরিষ্কার হচ্ছিলো। ভাগ্যিস ইতিমধ্যেই জমি অবনী কাকার সম্মতি তে নেওয়া হয়ে গেছে! না হলে আবার নতুন কি বিপদ এসে উপস্থিত হতো কে জানে! মনে মনেই ভাবছিলো মৃণালিনী। তার ভাবনার মধ্যেই হটাৎ করেই বিভার মা উঠোনে এসে দাঁড়ালেন, দুজনের এতদিন পরে একসঙ্গে চৌধুরী বাড়িতে পা দেওয়া কে কেমন যেনো পূর্ব পরিকল্পিত বলে মনে হলো মৃণালের। তাকে দেখেই পারুল বালা মুখে বিরক্তির ভাব এনে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। একটু চমকে উঠে কুমুদ বললেন,
ওমা! আজ সূয্যি কোন দিকে উটেছে গো! দুই জা একসঙ্গে! এসো এসো বিভার মা!
বিভার মা পিঁড়ি টেনে বসলেন, হাতে ধরা নারকেল নাড়ুর কৌটো আর ছাঁচে গড়া সন্দেশের বাটি কুমুদ এর দিকে এগিয়ে দিলেন,
নাও গো, এট্টু মিষ্টি মুক করো! মে র বে ঠিক হবার পর তে নানান ঝামেলায় আর আসা হয় নে কো!!
কুমুদ হাসি মুখে বাটি নিলেন, গলায় উচ্ছ্বাস এনে বললেন,
সে কি আর জানিনে দিদি! আমার সৌম্যই তো সব করলো! ছেলে তো আমার বউমারই বন্ধু গো!!
বিভার মা কিছু বলে ওঠার আগেই মনোরমা মাথা নাড়লেন, সামান্য বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বললেন,
হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো শুনলুম গো! আমার ছেলে বলছিলো! কালে কালে কত যে দেকবো দিদি! ছেলেরাও নাকি বন্ধু!
কুমুদ এর মুখ কালো হয়ে গেলো। কিন্তু এক্ষেত্রে তির তার জামাইয়ের দিকেই যাচ্ছিলো, তাই অন্য কেউ কিছু বলার আগেই তড়িঘড়ি মুখ খুললেন বিভার মা,
তোমার যত আজেবাজে কতা দিদি! বন্ধু আবার কি! একসাথে পাস দিয়েচে, এই তো! সেতো কতো নোকেই দেয়!
তা বন্দু হলেই বা কি খেতি বিভার মা! সে তুমি বন্দুই কও আর সত্তুর, বে যে আমাদের বউমা ই ঠিক করেচে, সে কতাখান তো আর উড়িয়ে দিতে পারবে নে!
এতক্ষনে শ্লেষের গলায় বললেন পারুল বালা, মনোরমা এবং বিভার মা দুজনেই থতমত খেলো। এতক্ষন চুপ করে সবার কথোপকথন শুনছিল মৃণালিনী, বড়ো মা কে কথা বলতে দেখে সেও মুখ খুললো। হেসে বললো,
সে আপনি যতোই বলুন কাকিমা, সুভাষ কিন্তু বিয়ের পরেও আমার বন্ধুই থাকবে!! সে বিভাকে পড়াশুনা শেখাবে বলেছে, আমার ইস্কুলের কাজেই কিন্তু বিভাকেও আমার লাগবে এবার।
তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লেন বিভার মা,
হ্যাঁ হ্যাঁ, সে কতা কি বলতে হয় মা! তোমার যকন ইচ্ছে ডাকবে তারে!
মনোরমা অসন্তুষ্ট হলেন, বিরক্তির ভাব গোপন রেখে তির্যক সুরে বললেন,
তোমাদের ঘরে তো আবার বে লাগতে চলেচে শুনলুম গো দিদি! তোমার ভাইপো তো যাবার আগে বিভাস রে কয়ে গেচে গো! ও মেয়ে নাকি সব্বনাশি! তাই সে বে করবে নে! তা পাত্তর কি কিচু পাওয়া গেলো দিদি!
এতক্ষনে তাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য স্পষ্ট হচ্ছিলো। মৃণাল বিরক্ত হলো, আলোক যে চলে যাবার আগে এই ভাবে গোটা গ্রামে ভুল খবর ছড়িয়ে দিয়ে যাবে তা তার ধারণা ছিলো না।
এতো কিছু বলে গেছে আর সে যে চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছিলো শরিকি জমির দলিল সঙ্গে নিয়ে, এই কথাটা বিভাস দা কে বলে যায়নি কাকিমা?
মৃণাল এর কথায় মনোরমা একটু থমকালেন, বেশি কথা আর বাড়াতে গেলে পাছে আবার তাঁর ছেলের নামও এসে পড়ে, এই ভয়েই আর এগোলেন না। কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,
তা বটে দিদি! দুধ কলা দে কাল সাপ পুষে ছিলে গো! সেই কবে তে তোমার কাছে আচে, শেষে এই করে পিসির নাম ডোবালি!
আর বেশিক্ষন অপেক্ষা করলো না মৃণালিনী, মনোরমার বাক্যবাণ আরও বাড়ার আগেই পারুল বালার দিকে তাকালো সে,
বড়ো মা, আপনি ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। কাকিমারা অনেকদিন পরে এসেছেন, অনেক গল্প করবেন এখন, আপনার আর বসে থাকার দরকার নেই! শরীর খারাপ লাগবে এবার।
বউমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই পারুল বালা উঠে দাঁড়ালেন, তাঁকে উঠে দাঁড়াতে দেখেই বিভার মা এবং মনোরমা দুজনেই এখানে বসার উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। পারুল বালা কে অপমান করতেই এখানে তাঁদের আসা, সে উদ্যেশ্যই যদি বিফলে যায়, তাহলে এখানে আর অযথা সময় নষ্টের কোনো প্রয়োজন নেই! তাঁরাও তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালেন,
আমরাও আসি গো দিদি! রাজ্যের কাজ বাকি পড়ে আচে!
বলতে বলতেই চাবির গোছা বাঁধা আঁচল সশব্দে কাঁধে ফেলে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন বিভার মা, মনোরমাও তাঁর সঙ্গী হলেন। তাদের সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে দেখেই হেঁসেলের দেওয়ালে হেলান দিয়ে আবার বসে পড়লেন পারুল বালা, কপালে হাত দিয়ে স্বগতোক্তি করলেন,
হাতি যকন পাঁকে পড়ে, চামচিকেই নাতি মারে!
ক্রমশ
#মৃণালিনী
#পর্ব ৪৩
সেই যে দুপুরের খাওয়ার পরে পারুল বালা নিজের ঘরে ঢুকলেন, আর বেরোলেন না। চৌধুরী বাড়ির বড়ো গিন্নি সম্ভবত প্রথম বার এতটা অপমানিত হলেন। সন্ধ্যে বেলায় দালানে পাতা চাটাই এ বসে চা খেতে খেতে সৌম্য তাঁর খোঁজ করলো। কুমুদ ছেলের কাছে সবিস্তারে দুপুরের ঘটনার বর্ণনা দিলেন। কিছুক্ষন পরে সৌম্য বড়ো মার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো, স্বামীর পিছু পিছু মৃণালিনীও উপস্থিত হলো।
কি হয়েছে তোমার বড়ো মা? শরীর খারাপ?
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো সৌম্য, দুজনকে একসঙ্গে দেখেই পারুল বালা বিছানায় উঠে বসলেন।
এতদিনের উঁচু মাথাখান এক্কেরে নুয়ে গেলো বাছা! পারুল বালা রে ঘরে ঢুকে নোকে কতা শুনিয়ে গেলো! কি কুক্ষণে যে ওই হতভাগা ছেলে রে ঘরে নে এয়ে ছিলুম!
অসহায় গলায় বলা বড়ো মার কথাগুলো সৌম্য কে নাড়িয়ে দিলো। পাশে বসে আস্তে করে বড়ো মার পিঠে হাত রাখলো সৌম্য,
বড়ো মা! দোষ তোমার নয়, তুমি তো ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছিলে। দোষ তো তার যে ভালোবাসার যোগ্যই ছিলো না! মিছিমিছি মন খারাপ কোরো না, আমরা বরং করুণার একটা ভালো বিয়ে দেবার চেষ্টা করি।
পারুল বালা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
সে চেষ্টা কি আর করচি নে বাছা! কিন্তু সে গুড়েও যে বালি! এই তোমার বউরেই জিগিয়ে দ্যাকো! শিবুর মতো সেদিনের ছেলে! সেও কি আমায় কম কতা শুনিয়ে গেলো! কারে ছেড়ে কার কতা কই!! সবাই যেনো সব্বনাশ করতে উটে পড়ে নেগেচে গো!
বড়ো মা! দিন পাল্টাচ্ছে! শ্যাম সুন্দর চৌধুরীর কথাই যে আর শেষ কথা হবে না, এটা এবার মেনে নিতে হবে!
পারুল বালা ঘাড় নাড়লেন,
না, বাছা! আমি বেঁচে থাকতে এ মেনে নিতে পারবো নে কো!!
মৃণাল বড়ো মার হাতের ওপরে আলতো চাপ দিলো,
বড়ো মা! যুগ বদলায়, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও বদলে যেতে হয়। যে নিজেকে সময়ের সঙ্গে বদলাতে পারে না, সে পেছনে পড়ে থাকে। আপনিও তো নিজেকে কম বদলে নেননি বড় মা! যে আপনি একদিন সরমা কে পড়তে দেন নি সেই আপনিই তো মেয়েদের ইস্কুল করতে দিতে এগিয়ে এলেন!
সে আলাদা কতা! পড়াশুনা করা দরকার! তাই বলে শিবুর মতো ছেলে, চৌধুরী বাড়ির দাওয়ায় বসে আমারে কতা শুনিয়ে যাবে! যতোই বলো, এ তার হিংসের কতা। বিমলের মতো ভালো একখান পাত্তর যে আমার সরমার কপালে হবে, সে তো আর সে ভাবে নি কো! তাইতে তার যত জ্বালা!
মৃণাল হেসে ফেললো।
সে কথা যখন আপনি বুঝেই ফেলেছেন বড়ো মা, তাহলে আর মন খারাপ করছেন কেনো?
পারুল বালা স্মিত হাসলেন, তাঁর মুখ থেকে অপমানের ছাপ ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছিলো। শিবু ঘটক যে আসলে নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতেই করুণার পাত্র জোগাড়ে সম্মত হয়নি এই ধারণাই তাঁর মনের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছিলো। তিনি মুখে প্রশান্তির ছাপ নিয়ে শুয়ে পড়লেন। তাঁকে শুতে দেখে সৌম্য আর মৃণালিনী উঠে পড়লো। তারা দুজনে যখন বড়ো মার ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল, তখন তাদের হারুর সঙ্গে দেখা হলো। বউ দিদি কে দেখেই একটু অস্বস্তিতে পড়লো হারু।
তুই এই রাতে এখানে কি করছিস? বাইরের দোর বন্ধ করিস নি এখনো?
বউ দিদির প্রশ্নে ঘাড় কাত করলো হারু,
হ্যাঁ, বউ দিদি সে তো কখন করিচি! দোরে আজও তালা দেবো নাকি শুধতে এয়ে ছিলুম!
মৃণাল একটু অন্য মনস্ক হলো, সে কিছু ভাবার আগেই পাশ থেকে সৌম্য সম্মতি জানালো,
হ্যাঁ, তালা দিয়ে দে। এখন থেকে প্রতিদিনই দিবি, আর শুধু খিল দিলে হবে না। রাস্তা এখন পাকা হয়ে গেছে না, প্রায়ই বাইরের লোকজন ঢোকে দেখি গাঁয়ে।
হারু সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো, মৃণাল এবং সৌম্য নিজেদের ঘরে উঠে এলো। মনে মনেই মৃণালিনী একটু উদ্বিগ্ন হচ্ছিলো। বিয়ের পরে যখন সে এই বাড়িতে পা দিয়েছিলো, সেই সময়ের সেই গ্রাম্য পরিবেশে ক্রমশই বদলে যাচ্ছে। বাইরের লোকজনের যাতায়াত বাড়তে শুরু হয়েছিলো ছেলেদের ইস্কুল শুরু হবার পর থেকেই, এখন পিচ ঢালা রাস্তায় রিক্সার চলাচলও শুরু হয়েছে। ক্লাব তৈরির প্রচেষ্টা আপাতত থমকে গেলেও ভবিষ্যতে চেষ্টা যে আবার হবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। গ্রাম ক্রমশই তার কৌলীন্য হারিয়ে শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সৌম্য লণ্ঠনের আলোয় বই খুলে বসেছিলো, দ্বিতীয় লন্ঠন আর না থাকায়, মৃণাল বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েই হারু কে দরজায় তালা লাগিয়ে দালানের দিকে আসতে দেখলো সে। হারু দালানে উঠেই নিচের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো, করুণা না বড় মা কার ঘরে সে ঢুকলো, দোতলার বারান্দা থেকে বেশ কিছুটা ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করেও সফল হলো না মৃণালিনী।
খানিকক্ষন অপেক্ষার পরেও হারু যখন বেরোলো না তখন খানিকটা অধৈর্য্য হয়েই সে নিচে নেমে এলো। করুণার ঘরের দরজা খোলা ছিলো, ভেতর থেকে করুণা এবং হারুর কথোপকথন শুনেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো মৃণাল। করুণার ওপরে তার অসম্ভব রাগ হচ্ছিলো, সরল ছেলেটা কে একা পেয়েই যে সে তার মস্তক চর্বণ এর চেষ্টা করছে, এ বিশ্বাসই তার মনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিলো।
আমি বে করতেই চাইনি কাও রে! আমি কলকেতা চলি যাবো! বউ দিদি আমারে হোথায় থুয়ে আসবে কয়েছে,
ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা করুণার গলা শুনে চমকে গেলো মৃণালিনী। হারু তার উত্তরে প্রায় কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। মৃণালের অবাক লাগছিলো, করুণার এই পরিবর্তনে সে মনে মনে যথেষ্টই খুশি হলো। ধীরে ধীরে সে নিজের ঘরে ফিরে গেলো। তাকে ঘরে ঢুকে আসতে দেখে সৌম্য বই থেকে মুখ তুলে তাকালো,
কোথায় গিয়েছিলে?
দালানে। হারু কে করুণার ঘরে ঢুকতে দেখলাম মনে হলো তাই!
সৌম্যর মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হলো,
আবার! করুণা কে সত্যিই এখানে রাখা মুশকিল!
না না, এবার দোষ কিন্তু হারুরই! ওই বারবার যাচ্ছে! করুণা কিন্তু এবার কিছু করেনি। ও বরং বারবার আপত্তিই জানাচ্ছিল।
তাড়াতাড়ি বললো মৃণাল, সৌম্য মাথা নাড়লো,
যাক! তাও ভালো!
পরের দিন সকালেও সুরেশ এলো। ইদানিং সৌম্য এখানে থাকলেই সে উপস্থিত হয়। সকালের দিকটায় বৈঠকখানায় বসে চা জল খাবার সহযোগে তাদের আড্ডা চলে। বন্ধুর ডাকে সৌম্য নিচে চলে যাবার পরে, মৃণালিনী ঘর পরিষ্কার করতে লাগলো। হেঁসেল থেকে আজও বামুন দিদির টুকটাক বিলাপের শব্দ ভেসে আসছিলো, তার সাথে বড়ো মার বকুনির আওয়াজ। বড়মার গলার আওয়াজ শুনে নিচে নামার আগে আলমারি খুলে বড়ো মার গয়নার পুঁটলিটা হাতে নিলো মৃণালিনী, সেই থেকেই সেটা ওর কাছেই রয়ে গিয়েছে, বড়ো মা কে ফেরত দেওয়া হয়ে ওঠেনি আর!
সে যখন হেঁসেলে এলো তখন, সেখানে কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ করুণার অনুপস্থিতে হারুর মা মসলা বাটছে, আর বামুন দিদি কড়া তে রান্না চাপিয়ে বসে বসে সমানে চোখ মুছছেন। তাঁকে ভাইঝির জন্যে তাঁর দাদার কাছে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে, অনেক বড়ো মুখ করে তিনি এবাড়িতে এনে ছিলেন তাকে। তাকে চোখের জল মুছতে দেখেই বিরক্ত হচ্ছিলেন পারুল বালা,
থামো দিকি বাছা! সকাল বেলায় কেঁদে আর গেরোস্তের অমঙ্গল কোরোনে। তোমার ভাইঝি কি জলে পড়ে আছে! তার ব্যবস্তা না করে এ পারুল বালা মরবে নে!
কর্তা মার কথাতেও ভরসা করতে পারছিলেন না বামুন দিদি, আলোকের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া তাঁর কাছেও এক বিরাট ধাক্কা ছিলো। তার সঙ্গে গত কালের শিবু ঘটকের কথাও তিনি ভোলেন নি। হারুর মাও একই বাড়িতে বহুদিন থাকার সুবাদে বামুন দিদির প্রতি যথেষ্টই সংবেদনশীল, মসলা বাটা থামিয়ে রেখে সে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো,
আহা! কেঁদোনি দিদি! কিছু একটা ব্যবস্তা হবে ঠিক! কত্তা মা আচেন তো!
সব কতা তে তোর কতা! কাজের কাজ যদি কিচু হয়! পাত্তরের তো কোনো অভাব নেই কো! তা দরকারের সময় তারা কোতা গে বসে থাকেন কে জানে!
আর কোনো কথা না বলেই তাড়াতাড়ি মসলা বাটা শেষ করে ঝাঁটা হাতে তুলে নিল হারুর মা, পারুল বালার মুখ কে বড্ড ভয় তার! গয়নার পুঁটলি হাতে ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো মৃণালিনী, কথায় কথায় পাত্রের অভাব নেই বলার মতো সাহস বড়ো মা পাচ্ছেন কোথায় এটা জানার ইচ্ছে তার প্রবল হচ্ছিলো। ইতিমধ্যেই বড়ো মার গলা বৈঠকখানা অবধি পৌঁছে গিয়েছিলো, অসুস্থ বড়ো মা যাতে বেশি চেঁচামেচি না করেন সেটা বলতেই সৌম্য সুরেশ কে সঙ্গে নিয়েই উঠে এসেছিলো।
আহ! বড়ো মা! এতো উত্তেজিত হয়ো না। তোমার শরীর খারাপ। যাও ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।
অন্য কেউ হলে হয়ত ছাড়তেন না, কিন্তু এ নিয়ম তিনি সৌম্যর বেলায় খাটান না, মুখে হাসি এনে বললেন,
দাঁড়াও বাছা! মে টার একখান ব্যবস্তা করে যাই, তার পিসি যে কেঁদে ককিয়ে মরচে!
সবাই অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকালো, এই মুহূর্তে কোথা থেকে পাত্র পাওয়া যাবে এটা সবার কাছেই খুব কৌতূহলের বিষয় হওয়ার দাঁড়াচ্ছিল। চিৎকার করে হারু কে ডাকলেন পারুল বালা, সে এসে মুখ নিচু করে দাঁড়ালো।
এ পাত্তর কেমন! সারা দিন শুধু পেছন পেছন ঘুরে মরে, তা বে দে দিলেই তো হয়!
সবাই অবাক হয়ে হারুর দিকে তাকিয়ে ছিলো, মৃণালিনী বিস্মিত হলো, বড়ো মার চোখ কি কিছুই এড়ায় না! নাকি হারুই গিয়ে বলার সাহস করেছে বড়ো মা কে!
এতক্ষন বামুন দিদির সমব্যথী হারুর মা, করুণা কে শেষে তার ছেলের ঘাড়েই চাপানো হচ্ছে দেখেই তাড়াতাড়ি ঝাঁটা রেখে এগিয়ে এলো,
এ কি কতা কত্তা মা! হারু আমার ছোটো ছেলে, সে এসবের কি বোজে! সে কি বলতে কি বলে! তার কতা কেউ ধরে নাকি!
তাই নাকি! ছোটো ছেলে! কিচু বোজে নে! তা ভালো কতা! কিন্তু তুই তো সব বুজিস! ঘর খান তো সেই তে বাঁধা পড়ে আচে, ওটুকু ছাড়িয়ে নিতে হবে নে? আর এট্টু বাড়াতেও তো হবে নাকি? ছেলের বে দে তুলবি কোতা? দু কাটা জমি কি তোকে এমনি দেবো নাকি! ছেলের বউ নিয়ে ঘর তুলবি তবে তো!
হারুর মায়ের মুখ বন্ধ করার এর থেকে বেশী ভালো উপায় বোধহয় কেউ আবিষ্কার করতে পারতো না। হারু কে ডেকে কত্তা মার পায়ের ধুলো নিতে একটুও দেরি করলো না সে। বড়মা কিভাবে জানলেন সেটা ভেবেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলো সৌম্য, স্বামীর সঙ্গে চোখা চোখি হলো মৃণালিনীর, দুজনের দৃষ্টি বিনিময় নজর এড়ালো না পারুল বালার।
এদিক পানে এট্টু এগিয়ে এসো তো মা গো! তকন থেকে সেই এক ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আচে! কুটি ভেঙে তো দুটি করো নে! তুমি নাকি চালাবে ইস্কুল! ওই পোঁটলা থেকে মটর মালাখান বের করে দাও দিকি! আর করুণারে ডেকে নে এসো গে। ওটা তার ভারী পছন্দের, ওটা দিয়েই তারে আশিববাদ করি!
মৃণাল এর হাতে ধরা পুঁটলির দিকে ইশারা করলেন পারুল বালা, তাঁর মটর মালা যে করুণার খুব পছন্দ ছিলো, সেটা তিনি বিলক্ষণ জানেন। মৃণাল চমকে উঠলো, তবে কি বড়ো মা করুণার গয়নার পুঁটলি সরাবার কথা জানতেন!!
ক্রমশ