মেঘবৃত্ত পর্ব-০৪

0
496

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— ” মা, আমি বিয়ে করতে চাই। ”
বৃত্তের এমন আকস্মিক বিস্ফোরণমূলক কথা শুনে বৃত্তের মা কিছুসময় থমকালেন। হাতের কাঁথা অর্ধেক ভাজকৃত অবস্থায় বৃত্তের দিকে তাকালেন। তার চোখের আকৃতি দেখা এটা স্পষ্ট, তিনি বিস্মিত! বৃত্ত মায়ের এমন চাওনি দেখে অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করে উঠলো। মুখখানা কাচুমাচু করে চেয়ে রইলো মায়ের পানে। বৃত্তের মা হঠাৎ’ই হাসলেন। পুনরায় কাঁথা ভাজে মন দিয়ে সুধালেন,
— ” পড়াশোনা শেষ করে, একটা চাকরি পেয়ে নে। তারপর আমরাই তোর জন্যে একটা ফুটফুটে বউ ঘরে নিয়ে আসবো। ঠিক আছে? ”
বৃত্ত ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। মা-বাবাকে নিজের বিয়ের কথা নিজেই বলা, এই ব্যাপারটা যে কত ঘোলাটে সেটা সে হারে হারে বুঝতে পারছে। বৃত্ত মায়ের কাছে এসে মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। বৃত্তের মা ছেলের এমন আদুরে আলিঙ্গনে হেসে বললেন,
— ” বললাম তো, সময় এলে এমনিই বিয়ে দিবো। এত চিন্তা কিসের? ”
বৃত্তের এখন লজ্জা লাগছে। মা নিশ্চয়ই এখন খারাপ কিছু ভাবছেন। ছিঃ! বৃত্তের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যেতে লাগলো। বিয়ের কথা আবারও বলার জন্যে সাহস রইলো না। লজ্জার আড়ালে সেই সাহস অত্যন্ত বাজে ভাবে ধামাচাপা পড়লো। বৃত্ত মাকে জিজ্ঞেস করলো,
— ” মা, তোমার মেঘাকে কেমন লাগে? ”
বৃত্তের মা প্রশ্নের ওতটা গভীরে গেলেন না। স্বভাবসুলভ হেসে জবাব দিলেন,
— ” মেঘা? ও তো দারুন একটা মেয়ে। ”
বৃত্ত স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক! মায়ের মেঘাকে ভালো লাগে, সেই অনেক। বৃত্ত সাতপাঁচ চিন্তা করে কাঁচুমাঁচু গলায় বললো,
— “মা! যদি আমি মেঘাকে আমার বউ হিসেবে…”
— ” বৃত্ত! ”
বৃত্তের কথাকে অসম্পূর্ণ রেখে বৃত্তের মা ধমকে উঠলেন। নিজেকে বৃত্তের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাগী চোখে তাকালেন বৃত্তের দিকে। বৃত্ত হতবাক হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে আছে। মায়ের আকস্মিক ধমকানো তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। বৃত্তের মা কঠিন চোখে চেয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
— ” তুই মেঘাকে ভালোবাসিস? ”
হঠাৎ প্রশ্নে বৃত্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কি বলবে এখন? কি উত্তর দিবে? সে মেঘাকে ফ্রেন্ড হিসেবে ভালোবাসে ঠিকই, তবে বউ হিসেবে না। মেঘা খুব ভালো একটা মেয়ে। ও বৃত্তের মত অগোছালো ছেলেকে ডিজার্ব করে না। বৃত্তের মা আরো একবার ধমকে উঠলেন,
— ” চুপ করে আছিস কেন? উত্তর দে! ”
বৃত্ত চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টানলো। না, তার মিথ্যে বলতে হবে। একটা মিথ্যেতে যদি মেঘার জীবন বেঁচে যায়, তবে সেই ভালো। বৃত্ত মায়ের চোখের দিকে চেয়ে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললো,
— ” হুম। ভালোবাসি। ”
বৃত্তের মা বিস্মিত চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। মেঘা একটা ভালো মেয়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, বৃত্তের বউ হিসেবে তিনি কখনোই মেঘাকে কল্পনা করেন নি। বৃত্তের মা অস্থির হয়ে বিছানায় বসে গেলেন। মাথায় হাত দিয়ে অস্থির কণ্ঠে বিড়বিড় করলেন,
— ” আমি, আমি আগেই বলেছিলাম একটা ছেলে, একটা মেয়ে কখনোই বন্ধু হতে পারে না। আমি আগেই বুঝেছিলাম। আমি আগেই…”
বৃত্তের মায়ের কথা আটকে গেলো।তিনি থমথমে চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।তার চোখের মণি অস্থির ভাবে ঘুরাফেরা করছে মাটির প্রতিটা অঞ্চল জুড়ে। বৃত্ত মায়ের এমন অস্থিরতা দেখে খুব একটা অবাক হলো না। চুপচাপ মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। আলতো গলায় বুঝালো,
— ” মা, মেঘা খুব ভালো একটা মেয়ে। দেখো, আমাদের সংসারটাকে অনেক ভালো রাখবে। বিশ্বাস করো আমায়। ”
বৃত্তের মা উত্তরে শুধু এটুকুই বললেন,
— ” বৃত্ত, তুই এখন থেকে মেঘার থেকে দূরে থাকবি। ”
বৃত্ত থমকে গেলো। মায়ের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। মেঘার জন্যে মায়ের এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। সে তো জানে, মা মেঘাকে খুব পছন্দ করেন। তাহলে, এখন এমন করছেন কেনো? তবে কি, মা মেঘাকে বৃত্তের বন্ধু হিসেবেই পছন্দ করেন? বউ হিসেবে না? বৃত্ত মাকে নরম গলায় প্রশ্ন করলো,
— ” মা, মেঘা আমার বউ হলে সমস্যা কি? তুমিই তো বললে, ও খুব ভালো একটা মেয়ে। তাহলে? প্রবলেম টা কোথায়? ”
বৃত্তের মা বললেন,
— ” মেঘা ভালো মেয়ে আমি জানি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমি তাকে আমার ছেলের বউ হিসেবে নিয়ে আসব।আমার ছেলে কত সুন্দর। আর মেঘা? গায়ের রং চাপা, চেহারা-সুরতেও খুব একটা ভালো না। তাকে কেনো আমার ছেলের বউ হিসেবে নিয়ে আসব? আমার কত আশা ছিল, ছেলের জন্য একটা সুন্দর বউ আনবো। না, না। আমার এক কথা, তুই মেঘার থেকে দুরে থাকবি।
বুঝেছিস? ”
বৃত্ত হতাশ হলো। মা এখনো আগেরকার যুগের মত সুন্দরের পূজারী! বিষয়টা আসলেই হতাশাজনক। বৃত্ত মাকে আরও দু কথা বলতে যাবে তার আগেই তার মা বিছানা ছাড়লেন। বৃত্তকে পাশ কাটিয়ে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। বৃত্ত সেদিকে তাকিয়ে শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। এর বেশি আর কিইবা করতে পারে সে?
_____________________________
মেঘা ও বৃত্ত চিরচেনা সেই পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে। সেই কখন থেকে তারা নিশ্চুপ। আজ পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় এসে থেমেছে যে, তারা দুজনই একে ওপরের কাছে কেমন যেনো অপরিচিত। আগে যেই দুজন সারাক্ষণ ক্যাম্পাস, পার্ক, বাসা মাতিয়ে রাখতো, এখন তারাই নিজেদের সঙ্গে কথা বলতে অব্দি অস্বস্থি বোধ করে। সবই পরিস্থিতির খেল। বৃত্ত একসময় বলে উঠলো,
— ” মেঘ, আমাদের একটা রিক্স নিতে হবে রে। ”
মেঘার উত্তরে নীরব থাকলো। আজ সকাল থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তার। সম্পূর্ণ শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। পেটের মধ্যেও হালকা চিনচিনে ব্যাথা। সকালে দুবার বমিও করেছে। এখন আবার বমি পাচ্ছে। মেঘা দাঁতে দাঁত চিপে বমি আটকানোর চেষ্টা করলো। তবে, লাভ বিশেষ হলো না। পেটে হাত চেপে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে গেলো। দৌঁড়ে পার্কের একপাশে গিয়ে হুরহুর করে বমি করলো। মেঘার বমি দেখে বৃত্ত কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। সে মেঘার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। বেশ কিছুসময় পর মেঘা ধীরে ধীরে শান্ত হলো। বৃত্ত মেঘার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিলো। মেঘা ক্লান্ত হয়ে কয়েক ঢোক পানি খেলো। বৃত্ত মেঘার হাত ধরে বেঞ্চে বসালো। মেঘার শরীর কাঁপছে, স্পষ্ট। এই নিয়ে তিনবার বমি করায় শরীরের সব শক্তি নিঃশেষে হয়ে গেছে। এ কদিনেই মেঘার মুখ চোখ শুকিয়ে গেছে। মেঘাকে দেখলে এখন আর চেনা যায় না। আগের মত মুখে সেই উজ্জ্বলতাতা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। মা হওয়ার লক্ষণ দেখে দিচ্ছে শরীরে। মেঘার এই করুন অবস্থা দেখে বৃত্তের ভারী কষ্ট হলো। সে মেঘাকে জিজ্ঞেস করলো,
— ” সকালে কিছু খেয়েছিলি? ”
মেঘা ওড়নার অগ্রভাগ দিয়ে মুখ, নাক মুছলো। বেঞ্চে সম্পূর্ণ শরীর এলিয়ে দিয়ে ক্লান্ত গলায় জবাব দিল,
— ” নাহ! ”
বৃত্ত এবার রাগ দেখালো। বললো,
— ” কিছু না খেয়েই এতবার বমি? এমন করলে তো দুদিনেই মরে যাবি। চল, আমার সাথে। কিছু খেয়ে তারপর কথা বলবো। ”
মেঘা বৃত্তের হাত ধরে মানা করলো,
— ” এখন না। বাসায় গিয়ে খেয়ে নিব। তুই কিছু বলতে চাইছিলি না? বলে ফেল। ”
বৃত্ত মানলো না। সে খুব ধীরে-সুস্থে মেঘার হাত ধরে ওকে উঠতে সাহায্য করলো। বেঞ্চ থেকে মেঘার ব্যাগটা নিজের কাঁধে নিয়ে আবারও মেঘাকে আগলে নিলো। বললো,
— ” কোনো কথা না। আগে খাওয়া। তারপর, অন্যকিছু। চল, এখন। ”

#চলবে।