মেঘবৃত্ত পর্ব-১০

0
467

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_১০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

রাত পেরিয়ে গেছে। আকাশের ঘুটঘুটে কালো রঙ মুছে সেখানটায় এক ফালি সোনালী রঙ দেখা দিয়েছে। আকাশের পূর্ব কোণে দেখা দিয়েছে টগবগে এক লাল সূর্য। সে কি তেজ সূর্যের! মেঘা ঘুম থেকে উঠে গেছে। কটা বাজে এখন? সাতটা কি আটটা? মেঘা ঘুমঘুম চোখ হাই তুললো। রাতে ভালোই ঘুম হয়েছে। এখন ওর উঠতে হবে। যতই হোক। এ বাড়ির বউ সে। একদিনের জন্যেই হোক। তার কিছু দায়িত্ব আছে। সেগুলো অবহেলা করা উচিৎ নয়। সাতপাঁচ ভেবে, মেঘা বিছানা থেকে নামতেই পায়ে ঠেকলো কারো হাত। মেঘা চকিতে নিচে তাকালো। এ কি? বৃত্ত! মাথার নিচে এক হাত রেখে, অপরহাত ডান দিকে ছড়িয়ে রেখেছে। আর সেই হাতে মেঘার পা লেগেছে। মেঘা একটু সরে সাবধানে মাটিতে পা রাখলো। যেনো বৃত্তের গায়ে লাগে না। বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে বাথরুমে যেতে উদ্যত হলো। তবে, কি একটা মনে করে আবারও ফিরে এলো। ঘুমন্ত বৃত্তের পাশে পা মুড়িয়ে বসলো। নির্নিমেষ চেয়ে রইলো বৃত্তের পানে। কি সুন্দর মুখখানা! মন চায় সারাদিন, সারাক্ষণ, সর্বাবস্থায় দেখতেই থাকি। মুখের মধ্যে কোনো দাগ নেই। শুধু থুতনির দিকে একটা গর্ত।সেই খুঁতটাও কি মিষ্টি। বৃত্তের মুখের সৌন্দর্য্য জেনি শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এদিকে মেঘাকে দেখো? মুখে কতশত ব্রণের দাগ, রোদে পোড়ার ছাপ। না আছে কোনো টোল, না আছে বৃত্তের মতন মিষ্টি কোনো গর্ত! কিছুই নেই তার। গায়ের রঙটাও ময়লা। কোনো ছেলে এক দেখায় পছন্দ করে ফেলবে, মেঘার চেহারা মোটেও এমন নয়। বরং, অনেকবার মানুষের কাছে শুনেছে, সে কুৎসিত। মা’কে অনেকেই বলেছে, দেখো ভাবি, তোমার এই মেয়েকে বিয়ে দিতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে তোমার। কিন্তু ভাগ্য দেখো? নিজের প্রিয় বন্ধুর স্ত্রী হিসেবে সে তার ঘরে বসে আছে। তারই বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে। এ কি ভাগ্যের লীলাখেলা বলে না? অবশ্যই বলে। ভাগ্যের জল কোথা থেকে কোথা গড়ায়, কেউ জানে না। তেমনই মেঘা আর বৃত্তও জানতে পারেনি। মেঘা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বৃত্তের কপালে পড়ে থাকা কতক চুল হাত দিয়ে ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো। বৃত্তের দিকে এক পলক চেয়ে বাথরুমে চলে গেলো।
______________________
রান্নাঘরে বৃত্তের মা কাজ করছেন। ভুনা খিচুড়ি ঘ্রাণ নাকে আসলো মেঘার। রান্নাঘরের বাইরে মেঘা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বৃত্তের মায়ের সামনে যেতে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। কালকে বৃত্তের ঘরে ঘুমানো বৃত্তের মা নিশ্চয়ই ভালো ভাবে নেন নি। কত কিছুই না মনে করে ফেলেছেন। ইশ! মেঘার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কি করে মুখ দেখাবে এখন? মন চাচ্ছে, এক দৌঁড়ে ছুটে চলে যায়।কিন্তু, তা তো সম্ভব না। বৃত্তের মা কি মনে করবেন। যাজ্ঞে! যা হবার তাই হবে। মেঘা গায়ের ওড়নাটা ভালো করে মাথায় তুলে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো।

— আসসলামুআলাইকুম, আন্টি।
মেঘার কণ্ঠ শুনে বৃত্তের মা খুন্তি হাতে আড়চোখে মেঘার দিকে তাকালেন। মেঘার উনার এমন চাওনি দেখে এক ঢোক গিললো। অস্ফুট সুরে বললো,
— আপনি রেস্ট নিন। আমি রান্না করছি।
বৃত্তের মা চোখ সরালেন। অযথাই হাড়িতে খুন্তি নাড়িয়ে কড়া সুরে বললেন,
— আমার গায়ে এখনো জোর আছে। বুড়ো হইনি। তোমার সাহায্য লাগবে না আমার।
মেঘা চুপ হয়ে গেলো। চুপচাপ বৃত্তের মায়ের পাশটায় দাঁড়িয়ে রইলো। বৃত্তের মায়ের একেকটা গতিবিধি খুব মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলো। তিনি মেঘার রাগ হাড়ির উপর ঝাড়তে লাগলেন। অযথাই শক্ত হাতে খুন্তি নাড়িয়ে তিনি মেঘাকে বুঝাতে লাগলেন, মেঘার প্রতি তার কত ক্ষোভ!

এরইমধ্যে বৃত্তের বাবা ঘুম থেকে উঠে গেছেন। তিনি ফ্রেশ হয়ে বসার ঘরে এসে সোফায় আস্তানা ঘারলেন। টিভিতে নিউজ চালিয়ে হাতে পত্রিকা ধরলেন। মনযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়তে পড়তে হাক ছাড়লেন,
— বৃত্তের মা? এক কাপ চা দিও আমাকে।
বৃত্তের মা স্বামীর আদেশ শুনে তৎপর হয়ে উঠলেন। খুন্তি একপাশে রেখে চুলোয় চা বসালেন। পাতিলে আগুন দিয়ে অন্যহাতে দুটো কাপে দুধ, চিনি দিলেন। মেঘা পাশে দাঁড়িয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো এসব। বৃত্তের মা চায়ের কাপ রেডি করতে করতে মেঘাকে প্রশ্ন করলেন,
— চা খাবে?
মেঘা ছোট্ট করে বললো,
— আপনারা খেয়ে নিন আগে। আমি পরে খেয়ে নিবো নে।
বৃত্তের মা কিছু বললেন না। তাক থেকে আরেকটা কাপ এনে তাতে এক চামচ দুধ, দু চামচ চিনি দিলেন। চিনির পরিমাপ দেখে মেঘা বুঝে গেলো, তাকেও এখন চা দেওয়া হবে। মেঘা মনে মনে হাসলো। বৃত্তের মা মেঘার প্রতি রেগে থাকলেও এখনো ভিতরে ভিতরে মেঘার সমস্ত কিছুর খেয়াল তার আছে। ব্যাপারটা মেঘাকে স্বস্থি দিলো। বৃত্তের মা চা কাপে ঢেলে দু কাপ চা ট্রেতে নিয়ে বসার ঘরে চলে গেলেন। মেঘার জন্যে করা চা রান্নাঘরেই রাখা। মেঘা চাটা চুপচাপ খেয়ে নিলো।

সকাল দশটা বাজে। বৃত্ত মাত্রই ঘুম থেকে উঠলো। মাটি থেকে মাদুর তুলতে গিয়ে একবার বিছানায় তাকালো। মেঘা নেই। তার মানে, মেঘা এই মুহূর্তে মায়ের কাছে আছে। মা কি কোনো প্রশ্ন করেছেন মেঘাকে? কি জানি! জানতে হচ্ছে বিষয়টা। বৃত্ত ঘর গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে বসার ঘরে চলে গেল।

বৃত্তকে দেখে তার বাবা গম্ভীর সুরে বললেন,
— মেঘাকে এখন ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসো। মেঘার বাবা বারবার ফোন করছেন।
বৃত্ত ছোট্ট করে বললো,
— জ্বি, আচ্ছা।
বৃত্ত সিঙ্গেল সোফায় বসলো। মায়ের দিকে চেয়ে বললো,
— মা, কফি হবে?
বৃত্তের মা চুপচাপ ট্রে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। বৃত্ত মায়ের এমন নীরবতার কারণ বেশ বুঝতে পারলো। কালকে রাতের ঘটনা নিয়ে মা যে ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে আছেন, সেটা বৃত্তের বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না। সেসব ভাবা ছেড়ে, বৃত্ত ফোন নিয়ে মগ্ন হয়ে গেলো।

— বৃত্ত কফি চাইছে। তুমি বানাবে নাকি আমি?
বৃত্তের মায়ের কথা শুনে মেঘা তাড়াহুড়ো করে চুলোয় গরম পানি বসালো। বললো,
— না, না। আমিই বানাচ্ছি।
বৃত্তের মা চলে গেলেন। মেঘা এক কাপ কফি বানিয়ে বসার ঘরে এলো। বৃত্তের দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে বললো,
— তোর কফি।
বৃত্ত কাপ হাতে নিতে নিতে মেঘাকে ইশারায় প্রশ্ন করলো,
‘ সব ঠিক আছে কি না? ‘ মেঘা চোখের ইশারায় বৃত্তকে আশ্বস্থ করলো। বৃত্ত যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ছোট্ট করে এক স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— রেডি হ। তোকে বাসায় নিয়ে যাবো।
মেঘা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বৃত্তের ঘরে চলে এলো।
মেঘা যেতেই বৃত্তের বাবা প্রশ্ন করলেন,
— বৃত্ত? আমাদের শিক্ষা কি সব ভুলে গেছো?
বৃত্ত বাবার এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল। সে আবার কি করলো? বৃত্ত অবাক হয়ে বললো,
— কোন শিক্ষা?
— মেঘা তোমার স্ত্রী। নিজের স্ত্রীকে কেউ তুই করে বলে? এটা কি ধরনের ব্যবহার?
বাবার এমন যুক্তিহীন কথায় বৃত্ত রেগে গেলো। তবে, সেই রাগ হৃদয় নিংড়ে বাইরে বের হতে পারলো না। শান্ত সুরে বললো,
— মেঘ আমার স্ত্রী হওয়ার আগে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বাবা। আর আমি মেঘকে তুই করে বলেই অভ্যস্ত।
— আগের অভ্যাসের কথা ভুলে যাও। এখন তুমি বিবাহিত। অনেক অভ্যাসই তোমাকে ছাড়তে হবে। নেক্সট টাইম যেনো আমি তোমার মুখে তুই শব্দটা না শুনি। মনে থাকে যেন।
বৃত্তের বাবা কথাটা বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। বৃত্ত সেখানেই, সেই সোফায় ঠায় বসে ভাবলো, ‘ বিয়ে হয়েছে বলে কি নিজের এতদিনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে? কিন্তু, কেনো? নিজের স্বাধীনতার কি কোনো দাম নেই? ‘

#চলবে।