মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-০৩

0
163

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-৩

আমি দূর্বল হয়ে মেঝেতে বসে পড়ি। উনি আসার পর থেকে একের পর এক বন্দুকের গুলি ছোড়বার মতো করে বাক্যবানে ঝাটকা দিয়ে যাচ্ছেন আমাকে কোন কিছু না জেনে বুঝে। আমি ঠিক মানতে পারছি না। এখন আবার আরেকটা টেনশন কাবু করে ফেলছে। সারোয়ার কি সত্যিই হারিয়ে গেছে? গেলেও কবে গেছে আর কোথায় গেছে? উনি কেন ভাবলেন সারোয়ার আমার কাছেই এসেছে? প্রশ্ন অনেক উত্তর জানা নেই। আমি মানুষটার দিকে তাকালাম। উনি কঠিন মুখ করে আমাকে দেখছেন। আমি ওনার চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলাম-“আপনি কি বলছেন এসব? আর যা বলছেন তা কি ভেবে বলছেন নাকি মুখ আছে বলার ইচ্ছে হয়েছে তাই বলছেন? মানে এ ধরনের দোষারোপ করার কোন যুক্তিসংগত কারণ আমি আসলে খুঁজে পাচ্ছি না।”
উনার চেহারায় কয়েকটা রেখা ফুটে উঠে মিলিয়ে গেলো-“কেন পাচ্ছ না? তোমার স্বামী নিখোঁজ। তুমি তার স্ত্রী। তোমাকে বলবো নাতো কাকে বলবো?”
আমি হেসে দেই-“আপনার যুক্তি ঠিক থাকতো যদি আমি আমার স্বামীর সাথে সংসার করতাম। আমি তো তাকে ছেড়ে এসেছি সেই পাঁচ বছর আগে।”
এবার উনি জুলজুলে দৃষ্টি মেলে আমাকে দেখলেন-“হ্যা, আমার ছেলেও বাড়ি ছেড়েছে পাঁচ বছর আগে। এখন কি বলবে বলো?”
এবার সত্যি সত্যি চমকে গেলাম। এটা কি করে সম্ভব? পাঁচ বছর আগের দিনটা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। মানসিক ভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত ছিলাম সেদিন। রাতে যখন ঘর ছেড়েছিলাম তখন সারোয়ার গভীর ঘুমে ছিলো। কেন যেন বিশ্বাস হলো না ওনার কথা। আমি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি-“আর এমন কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন? আমি যখন বাড়ি ছেড়েছি সারোয়ার ঘুমিয়ে ছিল। নিশ্চয়ই আমার সাথে কোন চালাকি করছেন আপনারা মা ছেলে মিলে। এসব কুটিল বুদ্ধি নির্ঘাত সারোয়ারের মাথা থেকে এসেছে। তাই না?”
“তোমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? মেয়ে তুমি কি বলো তো? এই বয়সে নিজের শরীর নিয়ে চলাফেরা করা কতোটা কঠিন তুমি জানো? আর সেই শরীর নিয়ে আমি ছেলেকে খুঁজতে দেশ চষে বেড়াচ্ছি।
আর তুমি পুরো ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিচ্ছ?”
ওনার কথায় এবার সত্যি সত্যি ভাবনায় পড়ে গেলাম। চেহারা দেখে মনেহচ্ছে সত্যি কথাই বলছে। আমি সিরিয়াস হয়ে জানতে চাইলাম-“আচ্ছা, পুরো ঘটনা খুলে বলুন তো? কি হয়েছে? সারোয়ার কবে থেকে গায়েব?”
“৪ঠা এপ্রিল ২০১৯, যেদিন তুমি স্বইচ্ছায় পালিয়েছ দাবি করছো। শুক্রবার ছিলো সেদিন। সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছিল তুমি সারোয়ার কেউ রুম থেকে বের হচ্ছ না দেখে রুবাকে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম।”
রুবা নামটা শুনে শরীর শক্ত হয়ে গেলো অটোমেটিক। উনি বলে চলেছে-“ও এক মিনিট পরে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে আমায় জানিয়েছিল, রুমে তুমি বা সারোয়ার কেউ নেই। আমি ব্যপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমরা দু’জন হয়তো সকালেই বেড়াতে বেরিয়েছ। ফোন দিলাম, দু’জনার নাম্বারই বন্ধ। টেনশন হলেও মনকে প্রবোধ দিলাম, হয়তো একা থাকতে চাও দু’জন তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছ। বিকেল গড়িয়ে রাত হলো তবুও খবর নেই। একে একে সব আত্মীয় বন্ধু কলিগ সবাইকে ফোন করা হলো। কোথাও কোন খবর পাওয়া গেলোনা। দু’দিন এভাবেই কাটলো, তারপর না পেরে থানায় নিখোঁজ রিপোর্ট করলাম। দিন যায় সপ্তাহ পেরিয়ে মাস গড়ায় আমরা নাওয়া খাওয়া ভুলে যাই। কি যে খারাপ দিন কেটেছে। কেউ বললো পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞাপন দিতে তাও দিলাম। কিন্তু কোথাও থেকে কোন খোঁজ পেলাম না। নানা মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে থাকলাম। কেউ কেউ ফোন করে বললো অমুক জায়গায় সারোয়ারের মতো একজনকে দেখেছি। আমি ছুটে গেছি কিন্তু সারোয়ারকে পাইনি। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে কিছুদিন আগে হঠাৎ তোমার খোঁজ পেলাম। এবার আগে সব খোঁজ খবর করলাম। সত্যিই তুমি কিনা শিওর হলাম। তারপর ছুটে এসেছি এখানে।
তোমার কাছে একটা কথা জানার আছে দুপুর। তোমরা কেন এভাবে পালিয়ে এলে? কি দরকার ছিলো দুপুর? নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছা মুখে বলতে পারতে একবার? বলতে পারতে একসাথে থাকতে চাও না। আমাদের অতো বড় বাড়ি, অতো নিশ্চিত জীবন ছেড়ে কেন পালালে তোমরা?”
উনি কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলো। ওনার কথা শুনতে শুনতে বিস্ময় ঘিরে ধরলো আমাকে। এ কিভাবে সম্ভব? সারোয়ার কেন পালাবে? আমাকে নিয়ে হাঁপিয়ে গেছিল বলেইনা আমি ওর জীবন থেকে সরে গেলাম। এখন নাকি ওও সেদিন পালিয়েছিল। কিন্তু ও কেনইবা পালাবে আর কোথায় যাবে? হিসেব মেলাতে পারছি না কিছুতেই। আমি নরম গলায় ওনাকে বলি-“শুনুন, প্রথম কথা হলো আমি সারোয়ারের ব্যাপারে কিছু জানি না। ও নিখোঁজ এই কথাটা আজ আপনার মুখ থেকে জানলাম। আমি ভেবেছি আমি চলে আসার পর ও আবার বিয়ে টিয়ে করে সুখে শান্তিতে ঘর করছে। সেরকমই স্বাভাবিক ছিলো। আর কি যেন জানতে চাইলেন? কেন পালিয়েছি তাই না? আপনি মনেহয় পাঁচ বছর আগের স্মৃতি ভুলে গেছেন। নিজে কি করেছেন, বাড়ির বাকীরা কি করেছে, সারোয়ার নিজে কি করেছিল। এসব মনে থাকলে প্রশ্নটা আমাকে করতেন না কিছুতেই। যে মেয়েটা স্বামী আর সংসার ভালোবেসে ক্যারিয়ারকে পেছনে ফেলে দেয় তাকে অন্তত এমন প্রশ্ন করা সমুচিত নয় কিছুতেই। এটা এক ধরনের অপমান। আপনার কোন রাইট নেই আমাকে আবার নতুন করে অপমান করার।”
উনি হুট করে হেসে দিলো-“আচ্ছা দুপুর, একটা কথা বলবে?”
ওনার সুন্দর সহজ সরল হাসি দেখে থমকে গেলাম। আমি চুপ করে থাকি। উনির মুখ খুললো-“আমি শাশুড়ী হিসেবে কেমন ছিলাম বলো তো?”
আমি ফট করে বলে ফেলি-“বরফ শীতল।”
“একটু ডিটেইলস বলো।” ওনার চেহারায় কৌতুহল।
“আপনি বরাবরই নির্লিপ্ত ছিলেন আমার ব্যাপারে। না ভালো বলতেন না মন্দ বলতেন। না কাছে টেনেছেন না দূরে ঠেলেছেন।”
“আচ্ছা! তাহলে তো মা বলে ডাকা যায় না। কিন্তু আন্টি বলে তো ডাকা যায়, নাকি?”
আমি থতমত খেয়ে গেলাম-“মানে?”
“মানে আসার পর থেকে তুমি ভাববাচ্যে কথা বলছো। না মা না আন্টি কিছু বলেই ডাকছো না। এইজন্য বললাম আর কি।”
ওনার চটুল কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না। উনি আমার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বললো-“পাঁচটা বছর ধরে ছুটতে ছুটতে হয়রান হয়ে গেছি দুপুর। আমার আদরের ছেলেটাকে দেখিনা, ওর গলার স্বর শুনি না। কোথায় আছে কেমন আছে জানি না। খুব ক্লান্ত লাগে দুপুর।”
আমি মৌন হয়ে যাই। কি বলবো? উনি থম ধরা গলায় বলে-“হুট করে তোমার খোঁজ পেয়ে খুব রাগ হয়েছিল জানো। মনে হয়েছে পুলিশ ডেকে তোমাকে ধরিয়ে দেই আমার ছেলের অপহরণকারী হিসেবে। তারপর তিতুনের খবর জানলাম। একই সাথে দুঃখ আর আনন্দ হলো। দুঃখ হলো সারোয়ারের খবর না পেয়ে আর আনন্দ হলো সারোয়ার সন্তানের খবর পেয়ে। সত্যি বলছি তিতুনের মা বলে আজ বেঁচে গেলে তুমি দুপুর। ছোট বাচ্চাটাকে মা হারা করতে চাই না বলে আজ তুমি আমার সামনে বসে আছ।”
খানিকটা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো-“সারোয়ারকে কি করে এতো সহজে ভুলে গেলে দুপুর? তোমাকে নিয়ে কি প্রচন্ড পাগলামি ছিলো সারোয়ারের। তোমার সামান্য অর্জনে যে অসামান্য খুশি হতো তাকে কি করে এতো সহজে পিছনে রেখে আসতে পারলে? এই তোমার ভালোবাসা ছিল দুপুর?”
আমি মুক হয়ে বসে আছি। সারোয়ারের জন্য দুঃখ হওয়ার কথা মনে কিন্তু হচ্ছে কি? সামান্য চিনচিনে ব্যাথা টের পেলাম। সারোয়ার, আমার স্যার। আড়ালে ওকে এই নামেই সম্বোধন করতাম আমি। সেই প্রথমদিনের আলাপে দুষ্টুমি করে ডেকেছিলাম। তারপর সেটাই সারোয়ারের নিক নেম হয়ে গেছিল। সারোয়ারও যেন আমার ডাকের মান রাখতে তৎপর ছিল। ধীরে ধীরে যখন সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম তখন থেকেই সে আমাকে নানাবিধ জ্ঞান বিতরণ করতো। আহা! কি দিন ছিলো সেইসব। সুখস্মৃতি মনে করে ঠোঁটের কোনে হাসি এলো।
“যাক, এখনো তবে সারোয়ারকে ভেবে তোমার মুখে হাসি ফোটে।”
আমি হতবাক। এই মানুষটা আবার কবে থেকে আমাকে এতো গম্ভীর ভাবে দেখতে শুরু করেছে। হাসি পেলো। আমার প্রতি সারোয়ারের ভালোবাসার গান গাইছিল। আর সেই ভালোবাসা দেখে উনি কি করতেন? মনে করে হাসি পেয়ে গেলো। মানুষটা ভ্রু কুঁচকে আমায় দেখেছে-“হাসছো কেন?”
“আপনার কথা ভেবে হাসি পেলো। আমাকে সারোয়ারের সাথে সহ্য হতো না আপনার। গাল ফুলিয়ে টনসিল বাঁধিয়ে ফেলতেন সেটা ভেবে হাসছি।”
“বাহ! স্বামী নিখোঁজ আর তোমার হাসি পাচ্ছে? তোমার মাথায় মনেহয় কথাটা এখনো ঠিকঠাক ঢোকেনি। শোন আবার বলছি, সারোয়ার তোমার স্বামী, তিতুনের বাবা নিঁখোজ।”
“বুঝেছি আমি। কিন্তু কি জানেন, যাকে খুব করে ভালোবাসবেন তাকে ঘৃনা করাটাও খুব সহজ।”
উনি হতবাক হয়ে বললো-“তুমি সারোয়ারকে ঘৃনা করো! কিন্তু কেন?”
“সেটা সারোয়ার খুব ভালো জানতো। সে হয়তো এ কারনেই গায়েব হয়েছে।”
“পাগল মেয়ে তুমি। নিজের স্বামীর নিখোঁজ সংবাদ তোমার কাছে কিছুই মনেহচ্ছে না। কেন বলো তো? আমি অন্তত তোমার সারোয়ারকে ঘৃণা করার মতো বড় কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।”
উনি চেচিয়ে উঠলে আমি ওনাকে থামিয়ে দিলাম-“মায়ের চোখে সন্তান সবসময় সেরা। তাও আবার সেই সন্তান যদি মায়ের মনের কথা বুঝে সেই মতো কাজ করে তাহলে আরও সেরা। এটাতে আমি দোষের কিছু দেখছি না।”
উনি ওনার ক্ষুরধার দৃষ্টি মেলে আমাকে মাপলেন-“তুমি কি নতুন করে কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছ দুপুর? এই অচেনা শহরে কার আশ্রয়ে আছো তুমি? এতো নিশ্চিত জীবন চলছে কার আদেশে?”
আমি তাচ্ছিল্য ভরে হাসলাম-“এর বেশি কেউই ভাবতে পারে না। কোন মেয়ে সামান্য উন্নতি করা মানেই কেউ তাকে সাহায্য করছে। যেন মেয়েটার কোন যোগ্যতা নেই। মেয়েদের যোগ্যতা থাকা উচিত না।”
উনি আমাকে থামালেন। তীব্র সন্দেহের দৃষ্টি মেলে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“একমিনিট দুপুর। বলো তো, সেদিন তুমি কার ভরসায় বাড়ি থেকে পালিয়েছিলে? কে সাহস দিয়েছিল তোমাকে? এই শহরে এসে কার আশ্রয়ে উঠেছ? তোমার জীবনে আশা নতুন মানুষটা রঙ্গন নয়তো?”
এন্ড দা থার্ড ওয়ান ইজ কিলিং। ওনার বন্দুক থেকে ছোড়া তৃতীয় গুলি বেরিয়ে গেছে। সেটা সরাসরি আমার বুকে আঘাত হানলো কি? পাঠক, কি মনেহয় আপনাদের?

★আমার তৃতীয় বই ও প্রথম মৌলিক পলিটিকাল মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার “অন্ধকারে জলের কোলাহল”
এর প্রি অর্ডার চলছে। প্রিয় পাঠক বইটির অর্ডার লিংক ১ম কমেন্টে দিলাম।

চলবে—
©Farhana_Yesmin