মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-০৪

0
172

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-৪

রাতে ছাড়া ছাড়া ঘুম হয়েছে। কখনো সারোয়ারকে দেখছি কখনো শাশুড়ীকে। শেষ রাতে স্বপ্ন দেখলাম তিতুন ‘বাবা বাবা’ বলে কার কোলে চড়ে গেলো। ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলাম ঘেমে একাকার হয়ে গেছি। উঠে ডাইনিং এ এলাম। উদ্দেশ্য পানি খাওয়া। পানি খেয়ে ঘরে ঢুকবো এমন সময় ওপাশের টানা বারান্দায় নজর পড়তেই চমকে উঠলাম। পর্দা সরে আছে, বারান্দার স্লাইডিং ডোর খোলা। উঁকি দিলাম, মনোয়ারা আজিম বসে আছে চেয়ারে। দৃষ্টি আধেক চাঁদের আলোয় আলোকিত আকাশে নিবন্ধিত। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম-“ঘুমাননি?”
আমার ডাক শুনে উনি চমকে তাকালেন-“নতুন জায়গা তো ঘুম ভেঙে গেলো হঠাৎ। তারপর তাহাজ্জুদ পড়ে এখানে বসেছি। একেবারে ফজর নামাজ পড়ে ঘুমাবো। তোমার কি হলো হঠাৎ?”
আমি পাশের টুল টেনে বসলাম-“দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো।”
কিছুক্ষণ দু’জনই চুপচাপ। দীর্ঘ সময় পর হালকা হিমেল হাওয়ায় বসে থাকতে বেশ লাগছে। কতদিন পরে এরকম করে গভীর রাতে জেগে বারান্দায় বসে আছি মনে নেই। গত পাঁচটা বছর যেন আমার জন্য রোলার কোস্টার রাইডের মতো। এতে ব্যস্ততায় কিভাবে দিন কেটে গেছে টের পাইনি। আজ হঠাৎ গত হওয়া সময়ের সবকিছুকেই একটা দীর্ঘ রাতের মতো লাগছে। সকাল হলেই যেন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু জীবন তো শুধু একটা রাত নয় একটা দিনও না। হাজার হাজার রাত আর দিনের সমারোহে একটা জীবন জীবন হয়ে ওঠে। এখানে কোনকিছু একবার বেঠিক হয়ে গেলে সহজে ঠিক হয় না। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চোখ বুঁজে মুহূর্তটা উপলব্ধি করতে চাই। এভাবে অবসর কাটালো হয় না বললেই চলে। আমার পালিয়ে ছুটে চলা জীবন থেকে কখন অবসর পালিয়ে গেছে আমি নিজেই টের পাইনি। হঠাৎ ওনার কন্ঠ শুনি। উনি বললো-“তখন আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিলে না কেন দুপুর? সব প্রশ্ন থেকে পালিয়ে বেরালে কি মুক্তি মিলবে?”
কথাগুলো ভীষণ বিরক্ত লাগলো। এই মুহুর্তে কথা বলতে মন চাইছে না একদমই। এই নিস্তব্ধ মাতাল করা পরিবেশটা উপভোগ করতে চাইছি। অনিচ্ছায় আনমনা হয়ে জানতে চাইলাম-“কোন প্রশ্ন?”
“এখানে এসেছিলে কার সাহসে? এই অচেনা শহরে কে তোমার আশ্রয় হলো?”
আমি আঁধারে তাকিয়ে থেকে জবাব দিলাম-“আপনার অনুমান ঠিক আছে। রঙ্গন আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।”
উনি চাপা গলায় হিসহিসিয়ে উঠলো-“জানতাম আমি। জানতাম রঙ্গন ছাড়া আর কারো কাজ নয় এটা। তা না হলে একা মেয়ের এতো সাহস হয় ঘর ছাড়ার?”
আমি চট করে ওনাকে দেখে নেই। জমাট আঁধার তবুও মনেহলো ওনার চোখ দুটো জ্বলছে ধিকধিক করে। আমি হুট করে বলি-“আপনি সবসময় চাইতেন রুবার সাথে সারোয়ারের বিয়ে হোক। তাই না?”
উনি হাসলো-“আলোচনা ঘুরিয়ে নিতে চাইছো?”
“না, আপনার সাথে গল্প করার সু্যোগ পেয়েছি তাই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছি। বলুন তো সত্যিটা কি? খুব জানতে ইচ্ছে করছে।”
উনি লম্বা শ্বাস টেনে নেন-“এখানে লুকোছাপার কিছু নেই। আমি রুবাকে পছন্দ করতাম। সারোয়ারের সাথে ওকে বিয়ে দেওয়ার কথা অনেক আগে থেকে ভাবা ছিলো। সারোয়ারও জানতো।”
আমি হতবাক হয়ে বলি-“সারোয়ার জানতো! তবুও ও কেন আমাকে বিয়ে করলো? আপনার সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করলো কেন?”
উনি মাথা নাড়েন-“আমি জানি না। সারোয়ারের এমন কান্ডে আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। কখনো ভাবিনি ও এরকম কিছু করবে।”
“তাই সারোয়ারের সেই রাগটা আমার উপর দেখিয়েছিলেন। বলবেন আমার অপরাধ কি ছিলো?”
উনি উদাস দৃষ্টি মেলে অন্ধকারে তাকিয়ে থেকে বললো-“অভিযোগটা ঠিক কোন অর্থে করলে বলো তো? আমি তো কখনো তোমার সাথে দূর্ব্যবহার করিনি।”
“হেসেও তো কথা বলেননি। আপনার ওই বড় বাড়ির কোথায় আমি ছিলাম একটু বলবেন? আমার সব আছে অথচ কিছুই নেই অবস্থা। আপনি জানতেন আপনার এই নির্লিপ্ত আচরণের প্রভাব পড়বে সারোয়ারের উপর। আমাদের সম্পর্কে ঝড় উঠবে। তবুও আপনি নিজের ব্যাপারে অটল ছিলেন। কারো কিছু বলার উপায় নেই কারন আপনি তো আমাকে বকাঝকা করছেন না। অতএব সমাধান কি? স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে দূরত্ব। আপনি যা চেয়েছিলেন তাই হয়েছে। আপনার মনোবাসনা পূরণ হয়েছে। সে হিসেবে খুশি হওয়ার কথা আপনার।”
উনি মৃদুস্বরে হাসলো-“খুশি হতাম হয়তো যদি না সারোয়ার নিখোঁজ হতো। আর এটা জানতাম না যে চুপ থাকাও অপরাধ হবে। আমি তোমার ব্যাপারে মৌন ছিলাম তারমানে কি এই যে আমি তোমাকে অপছন্দ করেছি? কখনো মুখ ফুটে বলেছি সে কথা? তুমি বেশি বুঝে ফেললে তো মুশকিল? তুমি জানো না কিছু ভুল সিদ্ধান্ত মানুষের কতটা ক্ষতি করতে পারে। একটা পরিবারের প্রতিটা মানুষ কতটা জরুরি সেটা বোঝো? তুমি কিছু ভাবলে তারপর সেই অনুযায়ী কাজ করলে। তার ফলাফল ভেবেছিলে কখনো? মেয়ে, আমার পুরো জীবন এলোমেলো করে দিয়েছ তুমি। আমার সাজানো গোছানো পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছ। তোমার কারণে আমার সন্তান হারিয়ে গেছে। আমি নাতনি সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এই যে ছোট্ট তিতুন একা একা বড় হচ্ছে পুরো পরিবার থাকা সত্বেও সেটা কার দোষ? তিতুন বড় হয়ে যখন তোমার দিকে আঙুল তুলবে তখন কি বলবে ওকে? বলবে, তোর বাবার উপর অভিমান করে তাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম। তার অপরাধ ছিলো সে আমাকে ঠিকঠাক বোঝেনি। তার সাথে সম্পর্কে দূরত্ব এসেছিল।”
আমার অনুশোচনা হয় আবার হয় না। কয়েকটা বছর অমানুষের মতো খেটেছি বলেই হয়তো অনুভূতি সব ভোতা হয়ে গেছে। যখন যেটা ফিল করা দরকার তখন সেটা ফিল করছি না। আমি কিন্তু এমন ছিলাম না মোটেও। হাসিখুশি চুলবুলি মেয়ে আমি। জীবন চলার পথে স্ট্রাগল করেছি ঠিক কিন্তু ঠোঁট থেকে হাসি গায়েব হয়নি কখনো। বন্ধুদের প্রান ছিলাম আমি। যে কোন আড্ডা জমিয়ে ফেলতে সেকেন্ড সময় লাগতো। আমার হাসিখুশি স্বভাবের জন্যই না সারোয়ার পাগল হলো। এমনই পাগল হলো যে আমাকেও পাগল হতে বাধ্য করলো। তা নয়তো এই ডাক্তার আমি কি করে এমবিএ গ্রাজুয়েট সারোয়ারের প্রেমে হাবুডুবু খেলাম? চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে পুরনো স্মৃতি হামলে পড়ালো। চোখ বুঁজে সেসব দূরে সরিয়ে ভাবি সেই আমি ঠিক কবে থেকে এতোটা পাল্টে গেলাম? সারোয়ারের প্রায়োরিটি লিস্ট থেকে যখন ছিটকে পড়েছি ঠিক তখন থেকে নয়তো? সামনে বসে থাকা মানুষটা এসব বুঝবে না। আমি চাইলে ওনার প্রতিটা কথা খন্ডাতে পারি কিন্তু অবুঝকে বুঝদান আমার কর্ম নয়।

কাছের মসজিদে আজান শোনা গেলো। আমি নিশ্চুপ উঠে দাঁড়াই। উনি ডাকলেন-“দুপুর, রঙ্গনকে বলবে আমার কথা। ওর সাথে দেখা করতে চাই আমি। এক সময় আমার সারোয়ারের খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলো সে। সারোয়ারের ব্যাপারে সে কি জানে সেটা জানতে চাই আমি। আমি আমার সন্তান ফিরে পেতে চাই দুপুর।”
শেষবাক্যে আকুতি মায়ের আকুতি ছিলো। আমি দ্রুত হেঁটে নিজের রুমে ফিরে এলাম। দীর্ঘ দিন পরে নামাজে দাঁড়ালাম। নামাজ শেষে তিতুনের পাশে শুয়ে পড়লাম। তিতুন দেখতে অনেকটা সারোয়ারের আদল। নিঃসঙ্গ যে রাতগুলোতে আমার সারোয়ারকে বেশি মনে পড়তো সেই রাতগুলো তিতুনকে দেখে পাড় করেছি। তবুও সারোয়ার ছবি দেখিনি। তীব্র বিতৃষ্ণা মানুষ কিভাবে প্রকাশ করে জানি না। আমার সর্বোচ্চ প্রকাশ ছিলো ওকে ওর হালে ছেড়ে চলে আসা। আমি কখনো ওর কোন কাজে কৈফিয়ত চাইনি। না বাঁধা দিয়েছি। শুধু নিঃশব্দে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। আচ্ছা, সারোয়ার মেয়ের খবর জানলে কি করতো? খুশি হতো কি? ভাবনায় ফুল স্টপ দিয়ে মেয়ের কপালে আলতো ভালোবাসা দিয়ে চোখ বুঁজি। কাল আমার অনেক কাজ। আজকের রোগীগুলোকে কাল দেখতে হবে। আবার ওটি আছে তিনটে। রঙ্গনের ফেরার কথা কাল। ওকে জানাতে হবে, আমার পালিয়ে থাকা জীবনের ইতি হয়েছে। শহরে ওর খালামনি এসেছে। ওর সবচেয়ে আদরের খালামনি, যে হয়তো গোপনে রঙ্গনকে আমার প্রেমিক ভাবছে!

চলবে—
© Farhana_Yesmin