মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-০৫

0
143

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-৫

ভীষণ ব্যস্ত একটা দিন পার করছি। সকালে ঘুম ভেঙেছে এক সিভিয়ার পেসেন্টের অপারেশন কল পেয়ে। পনেরো মিনিটে তৈরি হয়ে চলে আসতে হয়েছে হাসপাতালে। ক্রিটিক্যাল প্রেগনেন্সি কেস। রাত থেকে বাচ্চার মুভমেন্ট কম। আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে বুঝলাম পেটের ভেতর বাচ্চার গলায় নাড়ি পেচিয়ে গেছে। দ্রুত সিজারিয়ান অপারেশন কল করি। রোগীর স্বামী কিছুতেই অপারেশন করাবে না। বাচ্চা নাকি নরমালে হওয়াবে। এসব ক্ষেত্রে ভীষন রাগ লাগে আমার। তবে রাগ হলেও কিছুই করার উপায় নেই বোঝানো ছাড়া। সবচেয়ে হতাশ হই যখন দেখি শিক্ষিত মানুষও যখন বুঝতে চায় না যেমন আজ। সকাল সকাল এমন সিন দেখে আমার চান্দি গরম হয়ে গেলো। রোগীর পেট ওপেন করে তার স্বামীকে ডেকে পাঠালাম। বাচ্চার কন্ডিশন দেখালাম। সেই লোক তো ঘেমেটেমে একাকার। বাইরে যতটা ফটফট করছিলো বাচ্চাকে নাড়ি পেচিয়ে থাকা অবস্থায় দেখার পর ততটাই নার্ভাস। আমাকে বারবার তাড়া দেয়-‘ম্যাডাম তাড়াতাড়ি বের করেন আমার বাচ্চাকে। ওর কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ ম্যাডাম।’
লোকটাকে বাইরে পাঠিয়ে অপারেশন শেষ করেছি।
ভাগ্য ভালো শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেছে। অপারেশন শেষ করে যখন নিজের চেম্বারে ফিরেছি তার কিছুক্ষণ পর লোকটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। নিজের ব্যবহারে সে ভীষণ লজ্জিত।

আমি সাধারণত সকালে অপারেশন করা প্রেফার করি না। সকালের সময়টা মেয়ের সাথে সময় কাটিয়ে বের হলে আমার পুরোটা দিন ভালো যায়। আজ দিন শুরু হলো অপারেশন দিয়ে। মেয়েটার সাথেও দেখা করে আসতে পারিনি। তার উপর আজ আবার ওর দাদী আছে বাসায়। মহিলা কি করছে কে জানে। মহিলার কথা মনে আসতেই ফোন করলাম মোমেনা খালাকে-“খালা, তিতুন উঠেছে?”
“হ্যা খালামনি, উঠেছে।”
“কি করছে? খেয়েছে কিছু?”
“খাইছে। ওর দাদী খাওয়াইছে।”
“উনি খেয়েছেন?”
“হ্যা। খাইছে।”
“আচ্ছা। তিতুন কোথায় দাওতো ওকে। বলো মাম্মা কথা বলতে চায়।”
মোমেনা খালা থমকালেন। ওপাশ থেকে আওয়াজ না পেয়ে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম-“খালা, কি হয়েছে? তিতুন কোথায়?”
“খালা, আমি কিন্তু অনেকবার নিষেধ করছি উনি শোনে নাই।”
আমি খুব ঘাবড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম-“কি হয়েছে বলবে? কি করেছে উনি? তিতুন কোথায় বলো?”
“উনি তিতুনকে নিয়ে নিচে হাঁটতে গেছে। আমি মানা করছি খালা উনি শোনে না।”
মোমেনা খালার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। হাত পা কাঁপছে আমার। আমি ভয়ার্ত গলায় জানতে চাইলাম-“তুমি আমাকে জানাও নাই কেন খালা? কখন গেছেন উনি?”
“তোমাকে জানাইতে মানা করছে। গেছে তাও একঘন্টার বেশি।”
আমি রাগে চেচিয়ে উঠে বললাম-“কালকের আসা মানুষের কথা শুনে তুমি আমাকে ফোন দাও নাই? তুমি কি বলো তো খালা? এতো ইরেসপসিবল কাজ কেউ করে? আমার তিতুনের কিছু হলে তোমাকে ছাড়বো না খালা। রাখো ফোন। আমি আসতেছি।”
ফোন কেটে দিয়ে টেবিলে ছুঁড়ে দিলাম। ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের উপর। তিতুনকে নিয়ে যদি পালিয়ে যায় উনি তাহলে কি করবো আমি? কিভাবে মেয়েকে ফিরে পাবো? দাদী হওয়ার অধিকার দেখিয়ে আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিতে চাইছে মহিলা? চিন্তাটা মাথায় আসা মাত্রই আমার শরীর কাঁপতে শুরু করলো। ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে বারোটা বাজতে চলেছে। তিতুন দশটা সাড়ে দশটায় ঘুম থেকে ওঠে। খাওয়ে দাইয়ে বের হয়েছে তার মানে ও যেন বিরক্ত না করে এই চিন্তা করেছে। আমি উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াই। কোথায় খুঁজবো ওনাকে? কোথায় নিয়ে গেছে আমার তিতুনকে? আমার হাসফাস লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। ফোনটা আবার হাতে নিলাম। ওনাকে একটা ফোন করে দেখা যায়। পরক্ষণেই মনে পড়লো ওনার নাম্বার জানি না আমি। আমার সিম নতুন কাজেই পুরনো নাম্বারও সেভ নেই। নিজের বোকামিতে নিজেকে চড় মারতে মন চাইলো। আমার উচিত ছিলো ওনার নাম্বারটা নেওয়া। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াই। এসিস্ট্যান্ট জান্নাত উঁকি দিলো-“ম্যাম, রোগী পাঠাব?”
“নাহ জান্নাত, আমি একটু বেরোচ্ছি।”
জান্নাত অবাক হয়ে এগিয়ে এলো-“ম্যাম, কালকের রোগীরা আসছে, আজকের রোগী আছে। কি বলবো ওদের?”
আমি চন্চল হয়ে উত্তর দিলাম-“জরুরি কাজ পড়ে গেছে জান্নাত। কাজ শেষ হলেই চলে আসবো আমি। প্লিজ একটু ম্যানেজ করো।”
মেয়েটা কিছু বলতে চাইছিল আমি সুযোগ দিলাম না। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলাম।

হাসপাতাল থেকে আমার বাসার দূরত্ব বেশি নয়, গাড়িতে পনেরো মিনিট লাগে। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিকে বাসা। হাসপাতালও আগ্রাবাদে, হ্যাভেন হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সিঙ্গেল মাদার আমি, মেয়ের কথা ভেবে সবসময় কর্মস্থলের কাছাকাছি বাসায় থেকেছি যাতে যখন তখন মেয়েকে দেখতে আসতে পারি। অথচ আজ এই পনেরো মিনিট দূরত্ব মনেহচ্ছে পনেরো ঘন্টা। ড্রাইভারকে অযথাই বারকয়েক তাড়া দিলাম। বুকের মাঝে হাতুড়ির ঘা পড়ছে। আমার মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলবো নাতো?

গাড়ি বাসার কাছে আসতেই ড্রাইভারের অবাক দৃষ্টি পেছনে ফেলে পড়িমরি করে ছুটলাম। দরজায় কয়েকবার করে বেল দিচ্ছি খালা গেট খুলছে না দেখে আরও ঘাবড়ে গেলাম। আমি অস্থির হয়ে সমানে বেল দিয়েই যাচ্ছি। মন চাইছে দরজা ভেঙে ফেলতে। দরজায় লাথি মারবো এমন সময় মোমেনা খালা দরজা খুলে দিলো। আমি চেচিয়ে উঠে ঘরে ঢুকলাম-“এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে? কি করছিলে কি? ওরা কয়টার দিকে ঘর থেকে বেরিয়েছে? সময় দেখেছিলে ঘড়িতে?”
ড্রইংরুমে নজর যেতেই থমকে গেলাম। অবাক চেয়ে দেখলাম তিতুন সাদা একটা ফ্রক পরে গোলগোল ঘুরছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। ওকে দেখতে পুরো একটা ডলের মতো লাগছে। উনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। আমি ওনার সামনে যেয়ে দাঁড়াতেই উনি আমায় দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলো-“তুমি! এইসময়! আমি তো শুনেছি তুমি একেবারে রাতে বাসায় ফেরো।”
“আপনি আমাকে না জানিয়ে তিতুনকে কোথায় নিয়ে গেছিলেন?”
আমার কঠোর স্বর শুনে উনি থতমত খেয়ে বললো-“এই তো সামনেই হাঁটতে গেছিলাম। বাচ্চাদের পোশাকের একটা দোকান পেলাম। সেখানে এই জামাটা ডলের গায়ে দেখে ভালো লাগলো তাই কিনে নিয়ে এলাম।”
আমার অস্থিরতা কমলো না। তবুও ওনাকে বুঝতে না দিয়ে শান্ত গলায় বলালাম-“আর কখনো আমাকে না বলে ওকে বাইরে নেবেন না।”
আমি ডাইনিং এসে একগ্লাস পানি খেলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ছিলো বলেই হয়তো পিপাসা মিটলো না। আরেকগ্লাস খাবো তখনই উনি সামনে এসে দাঁড়ালো-“তুমি কি ভেবেছ আমি তিতুনকে নিয়ে পালিয়ে গেছি? তাই ছুটে এসেছ?”
আমি জবাব দিলাম না। উনি হাসলো-“আচ্ছা, আমার যদি পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকতো তাহলে কি তুমি কিছু করতে পারতে? ধরো আমি যদি এখন তিতুনকে নিয়ে যেতে চাই আমার সাথে আইনগত ভাবে তবুও কি ঠেকাতে পারবে তুমি?”
আমি কিছু বলতে চাইলাম উনি হাত উঠিয়ে বাঁধা দিলেন-“তুমি সারাদিন রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকো। তিতুন একা মোমেনার কাছে। ওর দেখভাল ঠিকমতো হচ্ছে না এই কারণ যথেষ্ট তোমার থেকে ওকে দূরে নেওয়ার জন্য। এটা আমি আইনগত ভাবেই করতে পারবো। কিন্তু এরকম কিছু করা আমার অভিপ্রায় নয়। মনে রেখো আমি ওর দাদী কোন বাচ্চা চোর না।”
উনি দাঁড়ালেন না। আমি খানিকক্ষণ নত মস্তকে বসে থেকে ব্যাগ উঠিয়ে চলে এলাম। হাসপাতালে আসতে আসতে ভাবছিলাম, আমি কি সত্যি সত্যি বেশি বেশি ভাবছি ওনাকে নিয়ে। উনি কি সত্যিই এতোটা খারাপ? কেন বিশ্বাস করতে পারছি না ওনাকে? আনমনা হয়ে চলতে যেয়ে জোর ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। ব্যাগ আর মোবাইল ছিটকে পড়লো হাত থেকে। আমি সরি বলছি আর সামনের মানুষটা নিঃশব্দে ব্যাগ আর মোবাইল তুলে আমার হাতে দিলো-“দুপুর! এতো আনমনা হয়ে কি ভাবছিস বলতো? আর এই সময় কোথা থেকে এলি? এই সময়টা তুই না ওটিতে থাকিস?”
পরিচিত কন্ঠ পেয়ে তাকাতেই দেখলাম রঙ্গনকে। হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকদিন পরে রঙ্গনকে দেখে আমার আনন্দিত হওয়ার কথা কিন্তু চাপা কষ্ট আমার আনন্দ প্রকাশে বাঁধা দিলো। আমি শুকনো গলায় বললাম-“রঙ্গন, তোর সাথে জরুরি কথা আছে। চল আমার চেম্বারে।”
রঙ্গনের ভ্রু কুঁচকে গেলো-“একমিনিট একমিনিট দুপুর। কি হয়েছে? প্রায় একমাস পরে দেখা অথচ একবারও জানতে চাইছিস না আমি কবে এলাম, কেমন ছিলাম। সরাসরি টেনশন দিতে চাইছিস? কি হয়েছে বলতো?”
আমি এবার লজ্জা পেলাম। সত্যিই তো? কেমন আচরণ করছি আমি? লাজুক হেসে বললাম-“সরি। কখন এসেছিস?”
রঙ্গন হেসে দিলো-“থাক থাক, এখন আর অতো ভদ্রতা দেখাতে হবে না।”
“আহা, সরি বললাম তো। বলনা কবে এসেছিস?”
রঙ্গন এবার মুচকি হাসলো-“কাল রাতে। তোর খবর বল। টেনশন কি নিয়ে?”
আমি আশপাশ দেখে নিলাম। হাসপাতালের রিসিপশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। লোকে যাওয়া আসার সময় আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে আমাদের। রঙ্গন এই হাসপাতালের একজন ফাউন্ডিং মেম্বার এবং নিজেও একজন ডাক্তার। এখানে দাঁড়িয়ে পারসোনাল আলাপ করা মোটেও সুখকর হবে না। আমি চাপা গলায় বললাম-“তুই উপরে চল। চেম্বারে বসে আলাপ করলো।”
রঙ্গন ঘরি দেখে মাথা নাড়লো-“এখন সম্ভব হবে নারে। আজ বোর্ড মিটিং আছে। আমার কয়েকটা স্পেশাল রোগীও আছে।”
আমি অনুনয় করলাম-“প্লিজ চল। খুব জরুরি।”
রঙ্গন বিস্মিত হলো-“পরে শুনলে হবে না?”
আমি মাথা নাড়লাম-“আমি জানি না।”
রঙ্গন দুপা এগিয়ে আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। কোমল গলায় বললো-“কি হয়েছে? মাশরাফি কি আবার বিরক্ত করছে তোকে?”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম-“না। এসব সমস্যা না।”
“তাহলে?”
“তোর খালা আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে।”
রঙ্গনের চোখ ছোট ছোট হলো। বুঝতে পারতেই তার চোখ বড় হলো। চমকে উঠে বিমুঢ় কন্ঠে জানতে চাইলো-“মনো খালা!’

★গল্প পড়ে ভালো লাগলে রিয়্যাক্ট ও শেয়ার দিতে ভুলবেন না। আর আমার লেখা ভালো লাগলে আমার প্রকাশিতব্য তৃতীয় বই এবং প্রথম পলিটিকাল থ্রিলার অন্ধকারে জলের কোলাহল এর প্রি অর্ডার চলছে। অর্ডার করতে পারেন।★
চলবে—
© Farhana_Yesmin