মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-০৬

0
125

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-৬

আমি মাথা নেড়ে তাকিয়ে আছি রঙ্গনের দিকে তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। সে ফোন কেটে দিয়ে আমার দিকে তাকালো-“আমাকে যেতে হবে দুপুর। মনো খালাকে বলিস আমি দেখা করতে আসবো।”
অনেক কথা বলার ছিলো কিন্তু সু্যোগ পেলাম না। রঙ্গন চলে গেলো। আমিও চেম্বারে ফিরি এলাম। আমাকে দেখে জান্নাত যেন জান ফিরে পেল-“ম্যাডাম, রোগীরা অস্থির হয়ে গেছে।”
“আমি রুমে বসছি। পাঁচ মিনিট পরে রোগী পাঠাও।”
একের পর এক রোগী দেখে যাচ্ছি। মাঝে দু’বার উঠে হাসপাতালে রাউন্ড দিয়ে এসেছি। বিকেলে একঘন্টার ব্রেক নিলাম। আজ আর কোন ওটি নেই বলে এই সময়টা পেলাম। ক্যান্টিনে এসে একটা স্যান্ডুইচ আর কফি নিয়ে এক কোনায় বসলাম। ক্যান্টিনের এই অংশটা ডাক্তারদের জন্য সংরক্ষিত বলে হইচই কম। আমি খেতে খেতে মোবাইল ক্রল করছি। হঠাৎ মনে হলো সারোয়ার কি সত্যি আমার মতো হারিয়ে গেছে? কেন যেন মনটা মানতে চাইছে না। ও কেন হারিয়ে যাবে? আমি ছিলাম ওর পথের কাঁটা। কাঁটা সরে গেছে সেজন্য ওর খুশি হওয়ার কথা ছিলো। হঠাৎ মনে হলো একটু যাচাই করে দেখি সারোয়ারের মায়ের কথা ঠিক কিনা। আমি সরোয়ারের ফেসবুক একাউন্ট খুঁজি। খুব সহজেই পেয়ে গেলাম ওকে। লাস্ট আপডেট পাঁচ বছর আগের তারিখ। অদ্ভুত ব্যাপার, প্রোফাইল পিকচার হিসেবে আমাদের দু’জনার হাস্যোজ্জল ছবি ঝুলছে সেখানে। একটা শিহরণ বয়ে গেলো শরীরে। ছবিটা নষ্টালজিক করে দিচ্ছে আমাকে। এই ছবিটা তোলা হয়েছিল বিয়ের বছর দুয়েক পর। ওর এক বন্ধুর বিয়েতে। কি আনন্দময় দিন ছিলো সেগুলো। একে অপরের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা আর সুখের চাদরে মুড়ে ছিলো আমাদের জীবন। বুকটা হুহু করে উঠলো। কোথাও কি ভুল হয়ে গেলো আমার? সারোয়ারকে কি ভুল বুঝেছিলাম? হঠাৎ করে মনটা সারোয়ারের জন্য ব্যাকুল হলো। দীর্ঘ পাঁচ বছর সারোয়ারকে না দেখার মনে না করার যে সংযম দেখিয়েছি তা যেন এক লহমায় ভেঙে গেলো। আমি একের পর এক সারোয়ারের ছবি ক্রল করে যাই।

“দুপুর।”
আমি চমকে মোবাইল বন্ধ করে সামনে তাকিয়ে দেখলাম রঙ্গন দাঁড়িয়ে আছে। আমি ব্যাকুল গলায় বলি-“তুই এসেছিস রঙ্গন।”
রঙ্গন আমার সামনে বসলো-“এমন একটা খবর দিয়েছিস না এসে পারি? মনটা ছটফট করছিল তাই একটা ব্রেক নিয়ে চলে এলাম। তুই কি করছিলি?”
“তুই কি জানতিস সারোয়ার আমার মতোই নিখোঁজ?”
রঙ্গন মাথা দুলায়-“তোকে অনেকবার বলতে চেয়েছিলাম দুপুর। তুই তখন সারোয়ারের কোন খবর শুনবি না বলে পণ করেছিলিস। তাই জানাতে পারিনি।”
“মাথা নষ্ট তোর? কেন বলিসনি আমাকে? আমি না হয় ওর উপর অভিমান করে ছিলাম কিন্তু তুই তো বলবি আমাকে? হাজার হোক ও আমার বাচ্চার বাবা রঙ্গন।”
“আর তোর?”
আমি চমকে যাই। আমার! আমার কি হয় সারোয়ার? যার বাস হৃদয়জুড়ে তার কি আলাদা পরিচয়ের দরকার আছে? কিন্তু সে কথা শুধু আমার মন জানে। দুনিয়ায় চোখে সারোয়ার আমার কাছে ঘৃণিত মানুষ। আমি রঙ্গনকে বলি-“তুই জানিস তোর খালা ভেবেছে আমি তার ছেলেকে সাথে নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”
রঙ্গন অবাক হলো-“এমন কথা কেন বলছে?”
“কারণ সারোয়ার আমার সাথেই নিখোঁজ হয়েছিল।”
রঙ্গন বিস্ময় নিয়ে বললো-“এটা কিভাবে সম্ভব দুপুর? সারোয়ার কেন সেদিনই নিখোঁজ হবে? এটা কি ইচ্ছাকৃত?”
আমি বিরক্ত হয়ে বলি-“তা আমি কিভাবে বলবো রঙ্গন। আমি তো সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছিলাম। সারোয়ার কেন ঘর ছাড়বে সেটাই মাথায় আসছে না আমার। তুই কবে জেনেছিস ওর ঘটনা?”
“তুই চিটাগং আসার ছয়মাস পরে। আমি তখন লন্ডনে ছিলাম মনে আছে?”
“মনে আছে। খুব মনে আছে। সেই দিনগুলো ভোলার কোন উপায় নেই। আজীবন মনে থাকবে। ভাবনার ব্যাপার হলো সারোয়ারের ফেসবুক একাউন্টে কোন আপডেট নেই। সেই পাঁচবছর আগে যে আপডেট ছিল আরকি৷”
রঙ্গনের ফোন বেজে যাচ্ছে। ও বিরক্ত হয়ে ফোন কাটলো-“তুই এরইমধ্যে চেক করে ফেলেছিস? আচ্ছা শোন, আমি যাচ্ছি। পরে কথা হবে।”

আমি ফিরে এসে চেম্বার শেষ করি। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত। উনি দেখলাম শুয়ে গেছে। মনে মনে স্বস্তি পেলাম। এই মানুষটার মুখোমুখি হতে ভালো লাগে না একদমই। শাওয়ার নিয়ে আরাম করে খেতে বসে চমকে গেলাম। ভাজা ভাজা করে মুরগী আর কাটা ছাড়া ইলিশ মাছের দোপেয়াজা। এই রান্নাটা উনি চমৎকার রাঁধতেন। সারোয়ার খুব পছন্দ করতো এই রান্নাটা। একাই দুই তিন পিস মাছ খেয়ে নিতো। আমাকে কতবার বলেছে, মায়ের হাতের এই রান্নাটা শিখে নাও দুপুর। আমাকে মাঝে মাঝে করে খাওয়াবে। আমি বলতাম, তা কেন? মা আছে মাই করবে। মায়ের হাতের স্বাদের কি কোন তুলনা হয়? সেসব মনে করে আজ খেতে বসে চোখ ভিজে উঠেছে আমার। অনেকদিন পরে পুরো এক প্লেট ভাত খেলাম তৃপ্তি করে। বেডরুমে ফিরে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অনেকগুলো আদর দিলাম। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকটা সময়। মেয়েটা বড় হচ্ছে, ইদানীং বাবাকে খুব খোঁজে। সামনে স্কুলে দেবে তখন কি করবে ভেবে মাঝে মাঝেই চিত্ত চন্চল হয়ে যায় আমার।

আচ্ছা, তিতুনের খবর জানলে কি সারোয়ার পাল্টে যেত? কিন্তু জানাবে কি করে? আমি নিজেই তো জানতাম না তিতুনের খবর। পালিয়ে আসার মাস দুয়েক পরে টের পেলাম আমার ভেতর আরেকজনের বাস। খবরটা জানার পরই সারোয়ারের কাছে ছুটে যেতে মন চেয়েছে। কিন্তু পর মুহূর্তে তীব্র অভিমান আর আত্মসম্মান ঘিরে ধরেছে আমাকে। একদিন ভালোবেসে সবার অমতে যার হাত ধরেছিলাম সে আমাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবে এটা কি মেনে নেওয়া সম্ভব হবে কখনো? আজও ভাবলে অবাক হয়ে যাই, সারোয়ার কেন অমন করেছিল আমার সাথে? ও কি আদৌও কখনো ভালোবেসেছিল আমাকে?

রঙ্গন এলো শুক্রবার সন্ধ্যায়। তিতুনের জন্য একগাদা খেলনা কিনে নিয়ে। তিতুন ভীষণ খুশি হয়ে ছুটে রঙ্গনের কোলে উঠলো-“তাত্তু, তিতুনকে ভুলে গেস।”
রঙ্গন ওকে কোলে তুলে নিল-“তিতুন তো এখানে থাকে সবসময়। তিতুনকে কি ভোলা যায়?”
রঙ্গন বুকের উপর ইশারা করতেই মেয়ে হেসে কুটিকুটি। রঙ্গন কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তিতুনকে বুকে জড়িয়ে ধরে-“চাচ্চু তিতুনকে অনেক মিস করেছে।”
তিতুন রঙ্গনের বুকের সাথে মিশে থাকে-“আমিও তাত্তুকে মিস করেছি।”
তারপর হইচই চললো কিছুক্ষণ। তিতুনের কাছে এলে রঙ্গন একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। দুই বাচ্চা মিলে তখন পুরো ঘর দাপিয়ে বেড়ায়। ওদের হুটোপুটিতে কান পাতা দায়। আমার অবশ্য খুব ভালো লাগে ওদের দেখতে। আমি মুগ্ধ চোখে ওদের খুনসুটি দেখি। মাঝে মাঝে অজান্তেই চোখ ভিজে ওঠে, সারোয়ারকে মিস করি তখন।

উনি আজ সারাদিন চুপচাপ ছিলেন। দুপুরে খাওয়ার পর তিতুনের সাথে খেলে বিকেলে ঘরের দুয়ার দিয়েছিলেন। ওনাকে দেখে দিনদিন বিস্ময়ের পরিমাণ বাড়ছে আমার। ওর মধ্যে ফিরে যাওয়ার কোন তাড়া নেই। এই কদিনে একবারও ফোন ব্যবহার করতে দেখিনি। আমি ভেবেছি ফোন নেই বুঝি। পরে নাম্বার চাইতেই ওনার এন্ড্রয়েড ফোন বের করে দিলেন। আমি নিজের নাম্বারে ডায়াল করে নাম্বারটা নিয়ে নিলাম। জানতে চেয়েছিলাম-“এসেছেন কয়েকদিন হয়ে গেছে। কেউ খোঁজ নিচ্ছে না কেন?”
উনি জবাব দেয়নি। এখন ওদের আওয়াজ পেয়ে উঁকি দিলেন। রঙ্গনকে দেখে তার চেহারা গম্ভীর হলো। ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়িয়ে রঙ্গনকে ডাকলো-“রঙ্গন, তুই!”
রঙ্গন ওনার দিকে তাকিয়ে হাসলো-“মনো খালা, কেমন আছো?”
উনি ভ্রু কুঁচকে তাকালো-“তুই খুব ভালো আছিস দেখতে পাচ্ছি।”
রঙ্গন তিতুনের কানে কানে কিছু বলতেই তিতুন খেলনা নিয়ে ভেতরে চলে গেল। তিতুন চলে যাওয়ার পর রঙ্গন ওনার দিকে তাকিয়ে বললো-“কেন? আমার ভালো থাকা বারন বুঝি?”
উনি বিরক্ত মুখে বসলো রঙ্গনের সামনে-“কারো ক্ষতি করে ভালো থাকা বারন বইকি।”
রঙ্গন হতবাক-“কার ক্ষতি করলাম আমি? তোমাদের জীবন থেকে দূরে সরে গেছি সেই কবে তবুও এমন অভিযোগ? অথচ এই অভিযোগ আমার করার কথা ছিলো।”
উনি নির্বিকার থেকে বললো-“তোর কি ক্ষতি করেছি আমরা? সারাজীবন তোকে আর তোর মাকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করে গেছি। তার বিনিময়ে তুই..”
রঙ্গনের মুখের ভাব পরিবর্তন হলো দ্রুত-“বাস মনো খালা, আর বলো না। এইসব বলে আর কতোদিন ব্লাকমেল করবে আমাকে? তোমাদের সাহায্যের ঋণশোধ করেছি নিজের জীবনের উপর দিয়ে। তবুও মন ভরেনি? তোমাদের জীবন থেকে চলে এসেছে আজ নয় বছর। এখনো এসব বলছো কি করে?”
উনি হিসহিসিয়ে তেড়ে আসলো-” বলবো একশোবার বলবো। তুই সারোয়ারের জীবন বিষিয়ে দিসনি? দুপুরকে সারোয়ার বিয়ে করেছিল বলে তুই মনে মনে সারোয়াের উপর ক্ষেপে থাকিসনি?”
রঙ্গন একবার আমার দেখে নিলো তাকিয়ে। তাকে হতবিহ্বল লাগে। সে রাগান্বিত হয়ে বললো-“কি বলছো এসব উল্টো পাল্টা? আমি কবে সারোয়ারের উপর ক্ষেপেছি?”
মনোয়ারা বেগম আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠলো-“তুই সারোয়ারকে বলিসনি, দুপুরকে বিয়ে না করতে? বলিসনি সারোয়ার দুপুরকে ডিজার্ভ করে না?”
আমি অবাক হয়ে দু’জনার বাক্যালাপ শুনছি। নিজে কিছু বলবো সে কথা মাথায়ই আসছে না। রঙ্গনকে অসহায় দেখালো-“সেসব কতো আগের কথা খালা? এতো বছর পর সেসব কথা উঠছে কেন?”
উনি যেন হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় ছটফট করছে। রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো-“কেন উঠবে না। সারোয়ার তোর জন্য নিজ থেকে হারিয়ে গেছে। আমার ছেলেকে হারিয়ে ফেলেছি আমি তোর জন্য।”
“আশ্চর্য! আমি কি করেছি? যেখানে ওর সাথে কোন যোগাযোগ নেই আমার।”
“সব তুই করেছিস আমি জানি। তুই চাসনি সারোয়ারের সাথে দুপুরের বিয়ে হোক। এখন প্রতিশোধ হিসেবে ওদের দু’জনকে আলাদা করেছিস।”
রঙ্গন হতাশ হয়ে অসহায় চাহুনি দিয়ে বললো-“আর এসব আমি কেন করবো?”
“কারন তুই ওকে ভালোবাসতি। ওকে নিজের করে পেতে চেয়েছিস তুই।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin