মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-০৭

0
130

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-৭

আমি চমকে উঠে রঙ্গনকে দেখলাম। ওর চেহারা ফ্যাকাশে রক্তশুন্য৷ ভীষণ বিব্রত দৃষ্টিতে আমায় দেখলো বারকয়েক। তারপর ওনার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় জবাব দিলো-“তুমি কিভাবে জানো? তোমার বলেছি কখনো? দুপুরকে জিজ্ঞেস করো তো, আজ পর্যন্ত ওকে এমন কিছু বুঝিয়েছি কিনা? না জেনে বুঝে কাউকে ব্লেম দেওয়া ঠিক না খালা।”
উনি একটুকুও না দমে পাল্টা জবাব দিলো-“ওকে কি জিজ্ঞেস করবো? ওর মতন বোকা মেয়ের কাছে কিছু জানতে চাওয়া বোকামী। যে মেয়ে নিজের স্বামীর মন বোঝে না সে আর যাইহোক চালাক তো না। তোর মনের অভিসন্ধি সে বুঝবে কি করে?”
রঙ্গন চেচিয়ে উঠলো-“ব্যাস খালা, আর বোলো না। তুমি এমনভাবে বলছো যেন আমি মানুষ খুন করেছি। আর দুপুর বোকা বলেই তো তোমরা ওকে ঠকিয়েছ। তোমার ছেলে ওকে বাদ দিয়ে জীবন গোছাতে চেয়েছিল। সেই কষ্টে ও পালিয়ে এসে অপরাধ করেছে। আর নিজেদের সাধু প্রমান করতে এখন আমার উপর দোষ চাপাচ্ছ? হাউ রেডিকুলাস!”
উনি কিছু না বলে অগ্নি দৃষ্টিতে রঙ্গনকে ধ্বংস করে দিতে চাইছেন। রঙ্গন বললো-“আর আমি যদি দুপুরকে ভালোবেসেও থাকি তাতে তোমার কি ক্ষতি হচ্ছে? বরং তোমার ছেলের বদলে দুপুর আমার সাথে থাকলে এতো কষ্ট পেতে হতো না ওকে। নিজের পরিচিত গন্ডি ফেলে পালিয়ে এতোদূর আসতে হতো না।”
এবার আমার মনে হলো দু’জনকে থামানো দরকার। নিজেকে গিল্টি মনেহচ্ছে। আমার কারনে ওরা ঝগড়া করছে। নিজেকে খুব খারাপ মানুষ মনেহচ্ছে।
“রঙ্গন, প্লিজ স্টপ।”
রঙ্গন রেগে গেলো-“কেন আমি কেন থামবো দুপুর? আমাকে না বলে ওনাকে বল। কিভাবে আমাকে অপমান করছে দেখছিস তো?”
“আমি কোথায় অপমান করলাম তোকে? সত্য বললে সেটা গায়ে লাগবেই।”
উনি অবাক হয়ে বলতেই রঙ্গন খেঁকিয়ে উঠলো-“সত্য! তাহলে আমি কি মুখ খুলে সত্যটা বলবো? তোমার কারণে আমার মা মারা গেছে। মায়ের শোকে বাবাকে হারিয়েছি। আমাদের সাজানো গোছানো সংসার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। বাবা মা হারিয়ে আমি আর ত্রপা হলাম বিবাগী। আর সেই তুমি কিনা আমায় দোষী বানাতে চাইছো?”
“আমার কারণে? আমি কি করেছিলাম?”
রঙ্গন মুখের উপর হাত ঝাড়লো-“কি করেছ সেটা তুমি খুব ভালো মতোই জানো। আমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছ কেন? আর নিজের ছেলেকে তো সামলে রাখতে পারোনি। সবসময় পরের জিনিস কেঁড়ে নেওয়ার স্বভাব বানিয়েছ। তারপর সেটা পাওয়া হয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন জিনিস খুঁজবে। তুমি চেয়েছিলে সারোয়ার দুপুরকে বিয়ে না করুক। কিন্তু যখন দেখলে সারোয়ার জেদ করছে তখন বাধ্য হয়ে মেনে নিলে কিন্তু মনে মনে ভাবলে, এই জেদও পাওয়া হয়ে গেলে নিশ্চয়ই দুপুরকে ছুঁড়ে ফেলবে। হয়েছিলও তাই। তবে তোমার ভাবনার থেকে খানিকটা সরে গেছিল সারোয়ার। তুমি ভেবেছিলে রেবাতে আঁটকে যাবে সারোয়ার কিন্তু সারোয়ার সে পথে না হেঁটে উল্টো পথে হেঁটেছিল। নিজের অফিসের পিএসের সাথে সম্পর্ক শুরু করেছিল। বিয়ে পর্যন্ত করার প্ল্যান ছিলো ওদের। সেই দুঃখে দুপুর ওকে ছেড়ে এলো। এখন এতোদূর এসেও মেয়েটা শান্তি পাচ্ছে না। ওকে হ্যারাস করতে তুমি চলে এসেছ।”
রঙ্গন থেমে দম নিলো-“তুমি সবসময় স্বার্থপরই থেকে গেলে খালা। অল্প বয়সে স্বামী হারিয়েছিলে বলে মা বাবা সবসময় তোমাকে আগলে রাখতে চেয়েছে। আমার আর ত্রপার চাইতে সারোয়ার, সোমা, স্বাতীকে গুরুত্ব দিয়েছে। আর তুমি মা বাবার এই ভালোবাসার অপব্যবহার করেছ।”
উনি চেচিয়ে উঠলেন-“সব তোর বাবা মা করেছে আমি তোদের জন্য কিছু করিনি? তোর ডাক্তারি পড়ার খরচ বেয়ার করিনি আমি? ত্রপার বিয়েতে খরচ করিনি?”
রঙ্গন হেসে দিলো-“খালুজানের ব্যবসার হালও বাবা ধরেছিল। নিজের চাকরির পাশাপাশি বিনাস্বার্থে খালুর ব্যবসায় খেটেছে বাবা। তারপর ধীরে ধীরে তোমাকে সেই ব্যবসা বুঝিয়েছে। একসময় যোগ্য হয়ে ব্যবসার হাল ধরেছ। তুমি মনেহয় এসব কথা ভুলে গেছে খালা। ভুলে গেছ সেই সময় বাবা মা তোমার পাশে না দাঁড়ালে সারোয়ারের ফুফু আর চাচা মিলে সেই ব্যবসা দখল করে নিত। এতো কিছুর পরেও তুমি আমাদের টানাটানির সংসারে মাঝে মাঝে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে। তার বিনিময়ে কি কি করিয়ে নিতে মনে আছে খালা? সবচেয়ে ভালো খাবার, ভালো খেলনা, ভালো পোশাক সব তোমার সারোয়ারের জন্য। তারপর যা বাঁচতো তা আমাকে নিতে হতো। সারাটা জীবন এইতো করেছ। কতবার কেঁদেছি আমি, মা স্বান্তনা দিয়েছে থাক বাবা তুই মেনে নে। ওর বাবা নেই ওকে কষ্ট দিস না আল্লাহ তোকে দেবেন। আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু মেনে নেওয়ার এতো বড় শাস্তি পেতে হবে তা জানতাম না। আজ তুমি আমাদের পেছনে অর্থ ব্যায়ের কথা বলে বাবা মায়ের সব ঋণ তুচ্ছ করে দিলে। নিজেকে এতোটা নিচে নামালে যে তোমাকে খালা বলে সম্বোধন করতে ইচ্ছে করছে না। মায়ের পরে নাকি খালার স্থান। তুমি সেই স্থানের অপমান করলে।”
রঙ্গনের কথা শুনতে শুনতে উনার চোখ ভিজে উঠেছে। ঠোঁট দু’টো চেপে ধরছেন বারেবারে। কাঁপা কাঁপা ভেজা কন্ঠে বললেন-“এভাবে বলতে পারলি রঙ্গন? তোদের কি একটুও ভালোবাসিনি আমি? বাবা হারা সারোয়ারের প্রতি আমি দূর্বল ছিলাম তাই বলে এতোটা খারাপ কি করেছি? আমার সারোয়ার কি ভাই হিসেবে তোকে ভালোবাসা দেখায়নি? আমরা তোদের এতোটা অপচ্ছন্দের ছিলাম? তুই তুই আর সারোয়ার তোদের আমি কখনোই আআলাদা…চো..খে…”
থেমে থেমে বলতে যেয়ে উনি হাত পা ছড়িয়ে সোফার গড়িয়ে পড়লেন। আমি ভয় পেয়ে ‘মা’ বলে চেচিয়ে উঠলাম। রঙ্গন থেমে গেছে। ওর চোখ দুটো কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। আমি ছুটে গিয়ে ওনার পালস চেক করলাম। পালস ড্রপ করছে। রঙ্গন এগিয়ে এসেছে। ওকে হতবিহ্বল দেখায়। ও ওনার চোখ দেখলো। ঘোলাটে চোখে রেসপন্স নেই। আমি দ্রুত ওনার গায়ের কাপড় হালকা করে দিলাম। কয়েকবার ডাকলাম তবুও সারা নেই। রঙ্গন ওনার পা দু’টো সামান্য উঁচু করে দিলো। আমি বুকে সিপিআর দিলাম। ক্ষীন গতিতে শ্বাস নিচ্ছেন। হুট করে নাক দিয়ে কিছু তরল রক্ত বেরুতে দেখে আমি চিন্তিত হয়ে রঙ্গনের দিকে তাকালাম-“কি করবি?”
“এম্বুলেন্স ডাকছি।”

*****

তিতুনকে মোমেনা খালার কাছে রেখে আমরা দু’জনই হাসপাতালে ছুটে এসেছি। রঙ্গন তার খালাকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে। আইসিইউ তে ঢুকিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করে বেরিয়ে এলো রঙ্গন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। রঙ্গনের চেহারা গম্ভীর। আমাকে বললো-“চল ক্যান্টিনে যাই।”
আমি মাথা দুলিয়ে ওর পিছু নিলাম। দুইকাপ কফি নিয়ে আমরা কোনার দিকের টেবিলে এসে বসলাম। রঙ্গনের চেহারায় চিন্তার ছাপ। আমি চুপচাপ কফিতে চুমুক দিচ্ছি। রঙ্গন হঠাৎ নিরবতা ভাঙলো-“আধাঘন্টা পর ব্লাড টেস্টের রিপোর্টগুলো পাওয়া যাবে। তবুও আমি ডাক্তার মইনকে খবর দিয়েছি।”
আমি চমকে উঠলাম-“ডাক্তার মইন? তুই কি অনুমান করছিস? ব্রেনস্ট্রোক?”
“উহু, সামথিং মোর সিভিয়ার। মনেহচ্ছে পুরনো কেস। তুই খেয়াল করিসনি খালা অনেক শুকিয়ে গেছে।”
আমি চুপ করে রইলাম। সত্যি বলতে ওনাকে সেভাবে খেয়াল করিনি। স্বাভাবিক রাগ থেকেই দেখিনি ওনাকে। তবে ক’দিন থেকে আমার সাথে খুব কম কথা বলছিলেন। আমি যখন বাসায় ফিরি উনি ঘুমিয়ে যান। সকালে যখন বেরিয়ে আসি তখনও ঘুমিয়ে থাকেন। আজকে সকালে অবশ্য ঘুম থেকে উঠেছিলেন। খেয়ে আবার ঘুমিয়েছেন। তবে এই মুহূর্তে ওনার থেকে রঙ্গনের ভাবনা বেশি ঘুরছে আমার মাথায়। আমি হঠাৎ ডাকালাম-“রঙ্গন, তুই কি সত্যি আমায়…”
কথা শেষ করতে বাধোবাধো ঠেকলো। রঙ্গন কিছুক্ষণ আমায় তাকিয়ে দেখলো। ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করলো-“তোকে মেডিকেলের প্রথমদিন থেকে ভালোবাসি দুপুর। জেনে গেছিস যখন লুকোছাপা করে লাভ নেই।”
আমি বিস্মিত হয়ে বলি-“কখনো বলিসনি কেন?”
রঙ্গন অসহায় হাসলো-“বলার সুযোগ কোথায় পেলাম? তার আগেই তুই হাইজ্যাক হয়ে গেলি।”
আমি মন খারাপ করে বলি-“তুই আগে বলে দিলেই তো হাইজ্যাক হতাম না।”
রঙ্গন উদাস হলো-“সারোয়ারের কাছে বরাবর হেরে যেতে হয়েছে আমাকে। তোর বেলায় লড়াই করতে চেয়েছিলাম। মা শর্ত দিয়েছিল, তুই যদি মনে মনে আমাকে পছন্দ করে থাকিস তাহলে তো সারোয়ারকে ফিরিয়ে দিবি। কিন্তু তুই যদি সারোয়ারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাস তাহলে আমি আমার মনের কথা কোনদিন জানাব না তোকে। খুব আশা ছিলো তুই হয়তো সারোয়ারকে ফিরিয়ে দিবি। কিন্তু তুই আমাকে ভুল প্রমান করে দিয়েছিলিস। আমি তোর কারণে হেরে গেছিলাম দুপুর। কেন আমার ভালোবাসা দেখতে পাসনি তুই? কেন তোর এতো কাছে থেকেও শেষমেষ দূরে সরে আসতে হলো আমাকে?”

চলবে—
©Farhana_Yesmin