মেঘভেলায় প্রেমচিঠি পর্ব-০২

0
669

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি”

২.

বিমুঢ় মুখে থম মেরে দুই মিনিট টানা টানা চোখে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে খুবই সাধারণ ভাবে হাতের কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে নিচে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেলো রোদসী। প্রেম ভালোবাসায় খুব একটা আগ্রহী নয় সে। উদাসীন চিত্তে ভাবতে লাগলো, সকালের বইটা কয় পৃষ্ঠা পর্যন্ত যেনো পড়া হয়েছিলো?

বরাবরের মতোই স্নান সেরে এসে ফ্যানের নিচে বসলো রোদসী। গোসল করার পরও গরম লাগছে। অথচ বাহিরে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। গরম লাগার কারণ অবশ্য তাঁর নিজের চুলই। ঘনত্ব বেশি হওয়ায় সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে উঠতে হয়। চোখ বন্ধ করে বসে ছিলো সে। এমন সময় ভেতরে এলো আরু। হাতে অঙ্কের খাতা।
হয়তোবা কঠিন অঙ্কগুলো সমাধান করতে সক্ষম হয়নি বলেই ছুটে এসেছে। খাতাটা নিয়ে নিঃশব্দে সমাধান বের করে লিখে বুঝিয়ে দিলো রোদসী। যতটা কম শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব ঠিক ততটুকু। আরু কিছুক্ষণ নতুন বাসা নিয়ে বক্তব্য দিলো তারপর নতুন বন্ধু নিয়ে, আজ এই হয়েছে, ওই হয়েছে। রোদসীর নির্বাকতা দেখে এক সময় বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো।
এ তো রোজকার ঘটনা!

শনিবার আজ,ভার্সিটিতে ক্লাস আছে। তৈরি হয়ে নিচে নামলো সে। কেয়া পরোটা ভাজি দিয়ে মাখিয়ে অল্প একটু মুখে পুড়ে দিতেই পানি দিয়ে গিলে নিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করলো পেট ভরে গেছে। তারপরই ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। কেয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পথের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘রোদির বাবা, কয়টা বছরে মেয়েটা কত বদলে গেছে না! কত কথা বলতো, অথচ এখন! ‘

মনিরুল হোসেন ব্যাথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুধু।
কেয়া ভারিক্কি শ্বাস ফেলতে ফেলতে কাজে মনোনিবেশ করলেন। প্রতিটি নিঃশ্বাসে হয়তো আত্মগ্লানি ও অপরাধবোধ মিলেমিশে একাকার।

‘এই যে এই,মিস ভাড়াটিয়া! ‘

ধুলোবালি দিয়ে ভরে আছে রাস্তাটা। মুখে মাস্ক চেপে দ্রুত পদে হেঁটে যাচ্ছিলো রোদসী। এলার্জি আছে এসব ধুলোয়। তা-ই যতসম্ভব গা বাঁচিয়ে চলতে পারলেই স্বস্তি পায়। এখানে থেকে পনেরো মিনিটের পথ ভার্সিটির। লেট হয়নি যদিও তবুও তাড়াহুড়ো করছে। সময়জ্ঞান একটু বেশিই কিনা!

নোটসগুলো কালেক্ট করে কিছু পড়ার বই কিনতে হবে। কত কাজ বাকি আছে! উফ। রুমাল বের করে কপালটা মুছে নিলো। তখনই পেছন থেকে ডাক এলো। এক পা বাড়াতে নিয়েও থেমে আছে। না দেখেই বুঝতে পেরেছে এটা কে। একবার ভাবলো, এড়িয়ে সামনে চলে যাবে। তারপর আবার মনে হলো, দেখি কী বলে বদ ছেলেটা!

একগুচ্ছ বিরক্তি ফুটিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো রোদসী। ইতিমধ্যে শহর দৌঁড়ে তাঁর দুই হাত দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। রোদসী কিঞ্চিৎ অবাকই হয় ভেতরে ভেতরে। এই যে, কালকে রাগের মাথায় কী জোরেই না ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলো। অথচ, ছেলেটা এমন করে এসে একগাল হেঁসে দাঁড়িয়েছে মনে হয় রোদসীর কত চেনা পরিচিত। শ্যামবর্ণের দেখতে ছেলেটা। মুখের সাথে চোখদুটোও যেনো দুষ্টুমি করে হাসে। রোদসী ভেবে পায় না, একটা ছেলে এতোটা দুষ্ট কী করে হয়! তাঁর মতে ছেলেরা হবে গম্ভীর, ব্যাক্তিত্বসম্পূর্ণ। কিন্তু এই ছেলেটা সম্পূর্ণ বিপরীত।
অবাক হওয়াটা প্রকাশ করে না সে। চোখ ছোট ছোট করে বলে,

‘বলুন, বাড়িওয়ালার ছেলে। ‘

শহর ভ্রু উঁচিয়ে হাসে। প্রতি দিনের মতোই ব্যাটটা হাতে। দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাদের পা ছড়িয়ে। ঠোঁটের উপরে ছোট একটা তিল। হাসির দমকে ঝুমঝুমিয়ে উঠছে। বাম হাতের বলটা হাওয়ায় ছুঁড়ে বলে,

‘বাড়িওয়ালার ছেলে আবার কেমন কথা? আমার নাম হচ্ছে শহর। শহর ইন্দেজার। ‘

‘বেশ। তাহলে মেয়েদেরও যে একটা নির্দিষ্ট নাম থাকে তা জানেন না আপনি?’

‘হ্যা, জানবো না কেনো?’

‘তবে, আমাকে মিস ভাড়াটিয়া, মিস ভাড়াটিয়া করছেন কেনো! নাকি বোঝাতে চাচ্ছেন, ভাড়া দিয়ে যারা থাকে তারা গরীব। গরীব বলতে চান আমাকে? ‘

শহর জিহ্বা কেটে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘ছি! তা কেনো বলবো! ‘

‘তাহলে কী বলতে চান?’

শহর উপর দিকে মাথা উঠিয়ে কিছু একটা ভাবে। ফিক করে হেঁসে বলে,

‘আপনি অনেক রাগী। ‘

স্পষ্ট কথায় থতমত খেয়ে যায় রোদসী। ছেলেটা তো বেশ ঠোঁটকাটা! রাগে খিটমিট করে তাকায় সে। সন্দিহান মুখে বলে,

‘বেয়াদব ছেলে! আমার সময় নষ্ট করার জন্য ডেকেছেন তাই না?’

‘না। আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে। ‘

‘একটু আগে তো তুমি করে বললেন, এখন আপনি বলছেন কেনো?’

‘আগে তো দূর থেকে একটা গলুমলু মেয়ে মনে হচ্ছিলো। যে রাগ দেখালেন, মুখ ভয়ে তুমি বলতে পারছে না। ‘

হা করে তাকিয়ে রইলো রোদসী। কী বলবে বুঝতে পারছেনা। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে হাতঘড়ি দেখে বলল,

‘আজাইরা কাজ করার সময় নেই আমার। আমি ভার্সিটি যাচ্ছি। ‘

সোজাসাপটা কথাটা বলে এগিয়ে গেলো রোদসী। পেছনে পেছনে দেহরক্ষীর মতো শহরও এগিয়ে আসলো। রোদসী মুখ খিঁচে মৃদু চেঁচিয়ে বলল,

‘আমার পিছে পিছে আসছেন কেনো বেয়ারা ছেলে! ‘

‘আপনার গায়ের সুগন্ধি আমার ভালো লেগেছে। এটা রজনীগন্ধার স্মেল। আপনার ঘ্রাণ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমার তো দোষ নেই। ‘

‘বাজে বকা বন্ধ করে চলে যান তো! ‘

‘পরিচিত হতে সমস্যা কী?’

‘আমার সাধ জাগেনি তো এতো রংঢং করার। কিছু বলবো না আমি!’

‘বেশ, আপনাকে বলতে হবে না। আমি বলছি। ‘

রোদসী খিঁচড়ে যাওয়া মনমেজাজে পা ফেলে চলেছে। পিছনে নিজের মন মতো করে বলেই যাচ্ছে শহর।

‘বুঝতে পারছেন, আমি হলাম আমার বাবা মায়ের দুইমাত্র ছেলে। আমি বড়,শহর ইন্দেজার। ছোট ভাইয়ের নাম শিশির। আমার মায়ের নাম তো জানোই তাইনা! বাবার নাম বলি, শওকত। আমার চাচী, আর একটা পুঁচকেও আছে। আমার পরিবারে কোনো মেয়ে নেই বুঝেছো। মাস্টার্সে পড়াশোনা করছি। ‘

কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম রোদসীর। সে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলল,

‘চুপ করুন! আমি কী জানতে চেয়েছি, আপনার ফ্যামিলি হিস্ট্রি আপনার কাছেই রাখুন। ‘

শহর তবুও হাসলো ৷ রোদসী বেখেয়ালি হয়ে রাস্তার সাইড দিয়ে যেতেই পাশ থেকে শাঁই করে একটা বাইক গেলো। আচমকা তাল হারিয়ে ফেললো সে। এই বুঝি পড়ে গেলো! কিন্তু দুটো হাত তাঁর পিঠ আঁকড়ে টান দিতেই ধাক্কা খেয়ে শহরের হাত শক্ত করে ধরে রাখলো। ভীত চোখে শহরের দিকে তাকালো। একটুর জন্য এক্সিডেন্ট হয়নি। উত্তপ্ত শ্বাস ফেলছে সে অনবরত। শহরের মুখে তখনও বিস্তর হাসি। সে
রোদসীর উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারার দিকে ঝুঁকে গিয়ে বলল,

‘ম্যাডাম, ভয় পেয়েছো? এখন আবার ছোট ছোট লাগছে তোমাকে।’

শুকনা ঢোক গিলে সরে গেলো রোদসী। বড় করে শ্বাস ফেলে ভার্সিটির ভেতর ঢুকে গেলো। পেছনে একবার তাকিয়ে দেখলো শহর এখনও দাঁড়ানো। হাঁটতে হাঁটতে বুকের বা পাশটা চেপে ধরে সে। এত জোরে ধুকপুক করছে কেনো! কী যেনো কিছু একটার পরশ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফু দিচ্ছে। মেঘের শতদল মনগহীনে কিছু একটার জায়গা তৈরির চেষ্টা করছে! কিন্তু কী হলো এটা!

মনের আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনা সেখানেই স্থগিত করে ক্লাস রুমে গিয়ে বসলো। চুপটি করে বইটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলো। আশেপাশের মেয়েরা গল্পগুজবে ব্যস্ত। সেসব দেখে কী একটা ভেবে হাসে রোদসী। এক সময় তাঁর জীবনটাও ছিলো সুন্দর, রঙিন, চঞ্চলে। জলন্ত ফানুসের ন্যায় চকচকে। কিন্তু ফানুস যেমন কিছুক্ষণ পরই অন্ধকারে মিশে যায়, ঠিক তেমনই তার শৈশবের রঙিন আলোটাও নিভে ম্লান হয়ে গেছে। কিছু একটার তীব্র জ্বলুনি ও আক্রোশপ্রসূত মনোভাব তৈরি হয় অন্তকরণে। চোখের কোণে অজান্তে জমা জলটুকু মুছে বইয়ের দিকে তাকায়। বইটাই এখন তাঁর একমাত্র বন্ধু। আগের বন্ধু, সম্পর্ক গুলো কী কুৎসিত ভাবেই না হারিয়েছে!

মিনিট দশেক পরেই ক্লাস টিচার এসে পড়েন। বিনয়ী মুখে বসে রোদসী। তাঁর পাশে কেউ বসেনি। বলতে গেলে সে নিজেই একা বসেছে। দুইটা মেয়ে তাঁর পাশে বসতে চাইলে সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু কোনো কথা বলেনি। কিন্তু অন্য মেয়েরা তো আর বোবা হয়ে বসে থাকবে না। যেখানে মনের সুখে আনাচে-কানাচের গল্প শুনতে পাওয়া যায় সেখানেই দৌড়ে গিয়ে বসেছে। তাই রোদসী একাই সবার প্রথম বেঞ্চে। সাধারণত ঐখানে বসতে কেউই আগ্রহ দেখায় না। কারণ, ওখানে বসলে কথা বলা যায় না। তেমন কারো নজরে পড়েনি তখনও সে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে যা হলো, তাতে সকলের নজরটা ঠিক সামনের বেঞ্চে বসা গুরুগম্ভীর মেয়েটার উপর গিয়েই ঠেকলো!

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী