মেঘভেলায় প্রেমচিঠি পর্ব-০৩

0
607

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি”

৩.

‘তুমি তো সেই মেয়েটা না? যে এইচএসসি তে ঢাকা বোর্ডে টপ করলে? ‘

মাথা তুলে একবার তাকালো রোদসী। খুব একটা ভাবান্তর দেখা গেলো না তাঁর মাঝে। তাই ধীরস্থির ভাবে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। মুখে নুন্যতম পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু আশেপাশের অনেকের ভাবমূর্তিতে তখন অবাক হওয়ার রেশ। কেউ কেউ হা করে দেখছে। যেন কোনো চিড়িয়াখানার প্রাণী সে। রোদসীর কিঞ্চিৎ অস্বস্তি হওয়ায় সে মাথা নিচু করে বসে থাকলো। সাধারণত ভালো স্টুডেন্টদের টিচাররা বেশি গুরুত্ব দেয় তাই স্যার একটু পরপরই পড়ার মধ্যে তাঁর খোঁজ নিচ্ছে। এতে একটু বিরক্তই হচ্ছে রোদসী। সে চায়নি কেউ অতিরিক্ত কিছু করুক তাঁর জন্য। তা-ই কারোও সাথে কোনো রকম কথা বলেনি। কিন্তু না চাইতেও তাই হলো। ঘুরে ফিরে সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাঁর দিকেই আবদ্ধ হলো। সাংঘাতিক রকমের মেজাজ গরম হলো তাঁর। বাসায় থাকলে এই মুহূর্তে হাতের কাছে কিছু পেলে হয়তো আস্ত থাকতো না। নীরসতা নিয়ে কলম কামড়ে পড়াগুলো দেখে নিলো।

হালকা হরিদ্রাভ মেঘ পেঁজা তুলোর মতো নেচে-কুঁদে
সুরেলা করছে ঝলমলে আকাশ। বাতাসে হেমন্ত হেমন্ত ঘ্রাণ। শরতের শারদীয় কাশফুলের সময় প্রায় শেষ। কাশফুল শেষ! ভাবতেই মনের অতল গহ্বরে মন খারাপের তামাটে বর্ণ ঝরে পড়ে। এক সময় রোদসী দু চোখ ভরে স্বপ্ন দেখতো কাশফুলের নবরূপে সে মেতে উঠেছে। কিন্তু সেগুলোতেও এখন মাটি চাপা দিয়ে যান্ত্রিক হয়ে গেছে। ফুটপাত ধরে ছন্দ মিলিয়ে হাঁটছে রোদসী। আকাশের অনিন্দ্য রহস্যময় রূপে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। নাকের ডগায় এঁটে থাকা নীল ফ্রেমের চশমাটা খুলে ব্যাগ থেকে বক্সটা বের করে রেখে দিলো। ব্যাগটা আবারও কাঁধে তুলে ফুটপাত থেকে নিচে নামলো। বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে। এটা মাঠ, কিছুটা সামনেই দুটো বাড়ি। কিন্তু মাঠের উপর দিয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতেই চোখজোড়া বড় বড় হয়ে যায় তাঁর। দুই কদম সচল হয়ে যেতেই দেখে দশ পনেরো জন বাচ্চা জড়ো হয়ে কোনো একটা খেলা খেলছে। হতবাক হয়ে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে যায় রোদসী। কী হচ্ছে কী বুঝতে পারছে না। কিন্তু খুব কৌতূহল হচ্ছে জানার। শহরে এরকম করে খেলার সুযোগ না পাওয়ায় নামটাও জানেনা। হাতে হাত রেখে মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। ভ্রুকুটি করেও যখন ওর কিছুই বোধগম্য হলো না তখন মুখটা অসহায় হয়ে এলো। সামান্য একটা জিনিস সম্পর্কে সে জানেনা, ব্যাপারটা ক্লাস টপার রোদসী কিছুতেই মানতে পারে না। এখন আর উনিশ থেকে বিশ হলেই রাগে ফসফস করে ওঠে। “হেরে যাওয়া ” শব্দটা ঘষে ঘষে উঠিয়ে দিয়েছে পুরোপুরি। সেটার মুখ দেখতেও নারাজ ও। হেরে মুখ উল্টো করার অভ্যাসটা বিয়োজন করেছে জীবনের হালখাতা থেকে। এখন পুরোটা জায়গা জুড়েই শুধু জিত আর জিত। নিজের কাছে কতটুকু জিতেছে সেই উত্তরটা বারংবারই এড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে আনে। মাথা বাকিয়ে খেলার জায়গাটায় মনোযোগী হলো। হঠাৎ করেই ওড়নায় টান অনুভব হয়। নিচে তাকিয়ে দেখলো একটা ছোট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদসী হাত দিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?

মেয়েটা ডিলিক দিয়ে মাটি থেকে খানিকটা উঁচু হয়ে বলল,

‘তুমি খেলবে আমাদের সাথে? ‘

রোদসী সামনে একবার তাকিয়ে বলল,

‘কী খেলছো তোমরা? ‘

ছোট মেয়েটা যেনো আমোদ খুঁজে পেলো কথাটায়। খিলখিল করে হেঁসে বলল,

‘তুমি এতো বড় হয়েও জানো না! আমরা গোল্লাছুট খেলছি। ‘

কথায় কিছুটা নাক ফুলিয়ে নিলো রোদসী। রোদের তীর্যক প্রলেপ। লাল হয়ে যাওয়া মাঝারি নাকে ছোট একটা নাকফুল। চকচক করছে রোদে। সে মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘নাহ। আমি যাবো না। ‘

‘কিন্তু তোমাকে তো ভাইয়া ডেকেছে! ‘

‘কোন ভাইয়া? ‘

‘ঐ যে, কিউট ভাইয়াটা! ‘

রোদসী বুঝতে পারলো মেয়েটা শহরের কথা বলছে। ও আগেই খেয়াল করেছে শহর আজ ক্রিকেট না খেলে বাচ্চাদের সঙ্গে অন্য কিছু খেলছে। রোদসী মনে মনে ভাবে, ছেলেটার নাকি সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা! তাহলে এমন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে কেনো! আনমনেই বিরবির করে বলে, কাজকর্ম না হলে যা হয় আরকি! ফেল করবে যখন, তখন ঝাড়ুদার হয়ে সাধ মিটবে। আসুক একবার ঝেড়ে দেবো একদম।

বলতে বলতেই শহর এসে হাজির। রোদসীকে তোয়াক্কা না করে হাতের মুঠোয় থাকা পানির বোতলটা উপুড় করে নিজের মাথায় ঢেলে দেয়। খেলতে খেলতে মাথার তালু গরম হয়ে গেছে। ভেজা জবজবে শরীর আর ঘেমে যাওয়া গলা দেখে দু কদম ছিটকে দূরে সরে রোদসী। মুখে হাত চেপে চেঁচিয়ে বলে,

‘অভদ্র বেয়াদব ছেলে! আচ্ছা আপনার কী নুন্যতম কমনসেন্সটুকুও নেই? উহহু! গা থেকে গন্ধ আসছে আপনার! ‘

শহর হাসি একখানা দিয়ে বলল,

‘এখানে কমনসেন্স না থাকার কী হলো! আর আমার গা থেকে গন্ধ আসছে তা এতো দূরে দাঁড়িয়ে বুঝলে কী করে তুমি! ব্যাপার কী বলো তো? ‘

রোদসী কথায় থতমত খেয়ে নাক ছিটকে বলল,

‘যত্তসব ফালতু কথা! ‘

‘আচ্ছা, আমি তো ফালতুই বলি। তুমি দাঁড়িয়ে এখানে কী দেখছিলে? শুনেছি তুমি তো নাকি আবার বইপোকা। সারাদিন ধরে বসে বসে নাকি শুধু একদিকে তাকিয়ে থাকো! চশমাটা দেখি। ‘

বলেই টান দিয়ে চশমাটা নিয়ে গেলো শহর। রোদসী কিড়মিড় করে চিল্লিয়ে বলল,

‘এই এই! চশমা দিন আমার। ‘

শহর চশমা পড়ে স্টাইল করে ছবির পোজ করলো। যেনো চলচ্চিত্রের নায়ক সে। রোদসী জোর করে টেনে নিলো চশমা। চোখে পড়ে নিয়ে ভেঙচি কেটে বলল,

‘যেই না চেহারা, তাঁর নাম আবার পেয়ারা! ‘

শহর হাসি থামিয়ে চট করে বলল,

‘কী বললে তুমি? ‘

‘আয়নায় দেখে নিয়েন একবার। চেঙ্গিস খানকেও ছাড়াবেন কয়দিন পর। আমার থেকেও কম ওজন হবে আপনার। ছি ছি! ছেলেরা এতো চিকন হয় নাকি! ‘

রোদসী বুঝতে পারলো শহর কিছুটা রেগে গেছে। ভেবে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করলো। তারমানে চিকন ব্যাপারটা নিয়েই একমাত্র রাগানো যায় বেয়ারা ছেলেটাকে। রোদসী মনে মনে শয়তানি হেঁসে বলল,

‘এবার বুঝবে তুমি চান্দু! কথায় কথায় মুখে হাসি ভেটকানো বের করবো তোমার। ‘

রোদসী এরকম চিকন নিয়ে আরও কয়েকটা বাক্য ছুঁড়ে দিয়ে জিহ্বা দেখিয়ে গেট খুলে বিল্ডিং-এ ঢুকে গেলো। কেয়া হোসেন দরজা খুলে দিলেন৷ রোদসী ভেতরে ঢুকেও মিটমিট করে হাসতে লাগলো। অনেকটা বেশি অবাক হলেন৷ কতদিন পর মেয়েটা এভাবে হাসলো! নিজের পরিবর্তনটা টের পায়নি মেয়েটা হয়ত।

শহর গমগমে মুখে কলিং বেল বাজালো। দিলারা চটে রোজকার মতো করে বললেন,

‘ওরে আমার সোনা বাবারে! আসেন, আপনার জন্যই তো ফুলের মালা সাজিয়ে রেখেছি। ‘

শহর মুখ কালো করে জুতো খুললো। প্রতিউত্তর না করায় দিলারা ছেলের কপাল ছুঁয়ে বললেন,

‘কীরে! এতো ভদ্রলোক হলি কবে? কথা মাটিতে পড়ার আগেই খই ফুটাস। জ্বর ট্বর হলো নাকি বাপ? ‘

শহর কিছুটা মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। প্রথম দিন যখন শুনলো তাদের বাড়িতে যে নতুন মেয়েটা এসেছে, সে বেশ বুদ্ধিমান। সারাদিন নাকি বইয়ের সাথে লেগে থাকে। শহরের এদিকে আবার অনেক এলার্জি। সে সারাদিন ঘুরবে ফিরবে তারপর টইটই করে ইধার উধার করে দুনিয়া কাঁপাবে। সন্ধ্যার পর বাসায় মায়ের বকুনি খেয়ে অলস হয়ে বিছানায় শুয়ে রবে। কিন্তু কী এমন আছে, ওই মেয়েটার মধ্যে যার জন্য মায়ের টিটকারি সহ্য করতে হচ্ছে। তা দেখতেই তাঁর যত কৌতূহল। গতকাল তো চাচাতো বোন, তাঁকে ইরামিও পঁচিয়ে দিলো। সে যখন খেতে বসলে তখনই দিলারা রসিয়ে চাচীকে বললেন,

‘জানিস রুমা,আমাদের দোতলায় যে ভাড়াটিয়া এসেছে, তাদের মেয়েটা পড়ায় কত ভালো! আমার একটা অকর্মা হয়েছে। হ্যারে! আমি বেয়ারাটা হওয়ার সময় কী খেয়েছিলাম? শহরকে ওই মেয়েটার পা ধোয়া পানি এনে খাওয়ালে কী ছেলেটা সুস্থ হবে আমার! ‘

তখন চাচী রুমানা, ছোট ভাই শিশির আর থ্রিতে পড়া ছোট ইরামিও একচোট হেঁসে নিলো। ইরামি ফোকলা দাঁতের হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘আমার স্কুলের স্যার বলে, শয়তানে ধরলে পানিপড়া এনে খাওয়ালে ভালো হয়ে যায়। বড় আম্মু,ভাইয়াকে তুমি ওই আপুটার কাছ থেকে পানিপড়া এনে খাওয়াও।’

শহরের মেজাজটাই তিরিক্ষি হয়ে গেলো। কোন এক মেয়ের জন্য তাঁকে এভাবে অপমান হতে হচ্ছে !

শহর এসেই পায়ের মোজা নিয়ে সোফায় বসে পড়ে।
মেয়েটাকে রোজ জ্বালাতে ভালোই এন্টারটেইন হয়। আর আজ কিনা ওই মেয়েটাও তাঁকে চিকন বলে অপমান করলো! সে উঠে দাঁড়িয়ে চিল্লিয়ে মাকে বলল,

‘আম্মা! চারটা ডিম সিদ্ধ করো। পরোটা বানাও। ঘি দিয়ে যেনো হয়। বেশি বেশি করে দিবে! মোটা হতে চাই আমি। ‘

দিলারা, রুমা দুজন দুজনকে বড় বড় চোখ করে দেখছে। যে ছেলেকে গুঁতিয়ে একবেলা বেশি খাওয়ানো যায় না সে নিজে খাওয়ার কথা বলল! তাও আবার সবচেয়ে অপছন্দের ডিম!

দিলারা মাথায় হাত দিয়ে বললেন,

‘হায় হায়! এ আমার কী সর্বনাশ হলো গো! আগে থেকেই ছেলেটা বান্দরে,তা নাহয় মেনে নিলাম। এখন পাগলও হয়ে গেলোরে! সব শেষ আমার সব শেষ! ‘

শহর সেদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,

‘কোনো কথা শুনতে চাইনা! মোটা হবো। তারপর আমার মোটা পেট দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওই চশমা ওয়ালিকে উড়িয়ে দেবো! আমি চেঙ্গিস খান নই, ওই মেয়েটাকে বুঝিয়ে দেবো। ‘

চলবে –
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী