অচেনা শহর পর্ব-০১

0
834

#গল্পের নাম-অচেনা শহর
#লেখনীতে-Alisha Rahman Fiza
পর্বঃ১

তোর সিদ্ধান্তটা কী আমি জানতে পারি?হেমন্তি মেয়েটি কিন্তু অনেক লক্ষ্মী আর দেখতেও কিন্তু বেশ ভালো।
হিয়া কথাটি শেষ করে সামনে দাড়িয়ে থাকা ভাবলেশহীন ইলহামের দিকে তাকালো।ইলহাম বারান্দার রেলিং ভেদ করে সেই অন্ধকারময় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।ইলহাম ভাবছে,রাতটা হয়তো বৃষ্টিময় কাটবে কারণ এই আকাশে মেঘ জমেছে।রাতের আকাশ হলেও বোঝা যাচ্ছে মেঘের আবরণ ইলহাম একধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
ইলহামের দিক থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে হিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
~ইলহাম,২ মাস পর আমি থাকবোনা তোর আর বাবার সাথে। ফারুক আর আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি এটা তুই জানিস তোদের আমি একা রেখে যেতে চাইছিনা।
ইলহাম আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে বোনের দিকে সরু চোখে তাকালো আর ভাবলো তার বোনটা খুব তাড়াতাড়ি তাকে ছেড়ে চলে যাবে।
বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়ার পরও হিয়া তার আর বাবার প্রতি কোনো অবহেলা করেনি বরং আরো আগলে রেখেছে।কিন্তু হিয়ার স্বামীর চাকরির কারণে হিয়াকে আর তার স্বামী ফারুককে আমেরিকা যেতে হবে।
ইলহামের চুপ থাকা দেখে হিয়া নাক ফুলিয়ে বললো,
~ইলহাম, মেজাজ গরম হচ্ছে তোর কথা ভেবে ভেবে বাবা কেমন হয়ে গেছে দেখেছিস।তোর মনের কষ্ট আমরা জানি কিন্তু এক অতীতকে আকড়ে ধরেতো আর সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারিস না।
ইলহাম মৃদু হেসে হিয়ার পাণে তাকিয়ে বললো,
~তোদের জীবনটা আমার জন্য পানসে হয়ে যাচ্ছে তাই না।
হিয়া চমকিয়ে উঠলো ভাইয়ের কথায় ইলহাম যে এমন কিছু বলে ফেলবে সে তো জানতো না।হিয়া ভাবছে,
হয়তো সে ইলহামকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে এভাবে অতীতটাকে হাতড়ে বের করাটা হয়তো ঠিক হয়নি।
হিয়া ব্যস্ততার সহিতে বললো,
~এমন কেন ভাবছিস?আমরা তোর ভালোর জন্যই করছি।
ইলহাম হো হো করে হেসে উঠলো তার হাসির শব্দে নিস্তব্ধ রাতটাকে জাগিয়ে তুললো হিয়া ভাইয়ের এমন আচরণ রেখে চোখ দিয়ে দুফোটা জল ফেলে দিলো।
ইলহাম হাসি বন্ধ করে বললো,
~সেই অতীতের জন্য সবাই কষ্ট পেয়েছে তোদের মনটা বহুবার ভেঙ্গেছে আমার জন্য এবার আর নয় শুধু আজকের রাতটা দে আমাকে।
হিয়া চোখ মুছে ইলহামের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বললো,
~বেশ তোর এই আবদারটা আমি মেনে নিলাম।সকালে তোর সিদ্ধান্তটা বাবার সামনেই বলিস আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো।
এতটুকু বলে হিয়া বারন্দা থেকে বের হয়ে নিজ রুমের দিকে পা বাড়ালো একবার পিছন ফিরে ইলহামের দিকে তাকালো।ইলহামের পিঠটাই দেখা যাচ্ছে অন্ধকারে হিয়া আর কিছু না ভেবে ধীর পেয়ে চলতে শুরু করলো রুমের উদ্দেশ্যে।

__________________♥____________________

বাবার সামনে মাথানিচু করে বসে আছে হেমন্তি তার অনেক লজ্জা লাগছে যার কারণে শ্যামবর্ণের মেয়েটারও গাল দুটো লাল হয়ে আছে।হেমন্তির বাবা আফজাল হোসেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ছেলে কী তোমার পছন্দ হয়েছে মা?আমি চাই তোমার জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত তোমার মতামত অনুযায়ী করা হোক।
হেমন্তি লজ্জায় নুয়ে পড়ছে হেমন্তির মা পারভীন বেগম আফজাল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
~আপনি এসব কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন?মেয়েটাকে একটু সময় দিন আজই তো তারা আসলো।
হেমন্তির ছোট বোন কেয়া পিছন থেকে ফোড়ন কেটে বললো,
~দেখো আপু আমার কিন্তু দুলাভাইকে জোস লেগেছে এখন তুমি যদি রাজী না থাকো তাহলে আমাকে দিয়েও ট্রাই করতে পারো।
কেয়ার কথায় আফজাল হোসেন হেসে উঠলেন পারভীন বেগম চোখ গরম করে বললেন,
~এক থাপ্পড় দিবো বাবার সামনে এসব বলিস যাহ পড়তে বস।
কেয়া গাল ফুলিয়ে বললো,
~রাত ১১টায় কে পড়ে? আমি ঘুমাবো এখন।
হেমন্তি চুপ করে শুধু শুনছে আফজাল হোসেন বললেন,
~আরে তুমি মেয়েকে বকছো কেন?আর কেয়া তোর আপুর বিয়ের পর তোরটাও সেরে ফেলবো চিন্তা করিস না।
কেয়া এক হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো,
~ডিল তো বাবা?
আফজাল হোসেন বললেন,
~ডিল।
পারভীন বেগম বাবা-মেয়ের কান্ডকারখানা দেখে বললেন,
~সব পাগল আমার ঘাড়ে এসেছে।
তারপর হেমন্তির দিকে তাকিয়ে বললেন,
~যা মা তুই রুমে যা। এদের সাথে থাকলে তোর মাথাটা যাবে।
হেমন্তি মুচকি হেসে উঠে দাড়ালো রুমের দিকে চলে গেলো কেয়াও বোনের পিছে পিছে হাঁটা ধরলো।আফজাল হোসেন চোখের চশমা খুলে টেবিলে রেখে বললেন,
~ছেলে ভালো পরিবারও ভালো আর্থিক দিক দিয়েও স্বচ্ছল তুমি কী বলো?
পারভীন বেগম স্বামীর পাশে বসে বললেন,
~আগে ওনারা কিছু বলুক এরপর না হলে সব ভাবা যাবে।
আফজাল হোসেন “হুম” বলে রকিং চেয়ার ছেড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলেন পারভীন বেগমও তার পাশে শুয়ে পরলেন।
হেমন্তি জানালার সামনে দাড়িয়ে রয়েছে বৃষ্টির ফোঁটার পানি তার শরীরকে ভিজিয়ে তুলছে ওড়নার আংশিক ভিজে জামার সাথে লেপ্টে আছে।কেয়া বেঘোরে ঘুমুচ্ছে তার নিজ রুম থাকা সত্যেও হেমন্তির ঘর ছাড়া তার ঘুম আসে না পা টিপে টিপে হেমন্তির পাশে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরবে।
হেমন্তির আজ ঘুম আসছেনা তার মনের মধ্যে অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে।ইলহামের সেই মায়াময় চেহারাটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে হেমন্তির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো সে মনে মনে ভাবলো,
~আজ পর্যন্ত কারো প্রতি এমন অনুভূতি তো হয়নি মানুষটার চোখে অজানা এক মায়া আছে। আচ্ছা সে কী আমায় পছন্দ করেছে?আমার মনে হয় সে আমাকে পছন্দ করেনি
এই একটি লাইন ভাবতেই হেমন্তির মন খারাপ হয়ে গেলো সে জানালার থেকে দূরে সরে দাড়ালো। জানালাটা আটকে দিয়ে স্টাডি টেবিলের সামনে এসে চেয়ার টেনে বসে পরলো।ড্রয়ার থেকে তার চিরচেনা ডায়রিটা বের করে টেবিলের উপর রেখে হাতে কলম তুলে নিলো।
হেমন্তি ডায়রিতে লিখতে লাগলো সে লিখলো,

” মনে আঙ্গিনায় আপনার পদচারণ
রাঙ্গিয়ে তুলেছে আমাকে অন্য এক রঙ্গে
আপনার অপেক্ষায় পথ চেয়ে রয়েছি আমি
এই দক্ষিণা জানালার ধারে “।

এতটুকু লিখে ডায়রিটা বন্ধ করে আবার সযত্নে ড্রয়ারে রেখে দিলো সে।হেমন্তি চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো কেয়ার পাশে কেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই কেয়া হেমন্তিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।হেমন্তি মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে ফেললো সকালের আশায় হয়তো সকালটা তার জীবনে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

__________________♥_____________________

ইলহামের ঘুম ভাঙ্গলো বিরিয়ানির সুভাসে চোখ পিট পিট করে খুলে দেখলো সে বিছানায় শুয়ে আছে।বিরিয়ানির ঘ্রানটা আবার নাকে আসতেই সে উঠে বসলো মনে মনে বললো,
~আজ অফিসের লাঞ্চ টাইমটা বেশ ভালো যাবে হিয়ার হাতের বিরিয়ানি খেয়ে।
দেরি না করে ইলহাম বিছানা ছেড়ে উঠে তড়িঘড়ি করে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে নিজেকে তৈরি করে সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো অলরেডি ৯.০০ টা বাজে।সে অফিসের ব্যাগ নিয়ে রুমের বাহিরে এসে সোজা ডাইনিং টেবিলের কাছে চলে আসলো ব্যাগটা পাশে রেখে চেয়ার টেনে বসে পরলো।
ব্যস্তার তার কারণে সামনে বসে থাকা দুজন মানুষকে সে খেয়াল করেনি।ফারুক আর ইলহামের বাবা আজাদ সাহেব ইলহামের দিকে তাকিয়ে আছে
আজাদ সাহেব গলা পরিষ্কার করে ইলহামকে প্রশ্ন করলে,
~তা তোমার সিদ্ধান্তটা কী জানাবেনা?
ইলহাম আজাদ সাহেবের কন্ঠ শুনে চোখ তুলে তাকালে তার দিকে ফারুক বাঁকা চোখে ইলহামের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো।হাতে নাস্তা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলো হিয়া।ফারুল চোখের ইশারায় হিয়াকে সব বুঝিয়ে দিলো হিয়া চেয়ার টেনে বসে পরলো।
ইলহাম স্পষ্ট কন্ঠে বললো,
~আমার কোনো আপত্তি নেই এই ব্যাপারে আপনারা এগিয়ে যেতে পারেন।
আজাদ সাহেব খুশি হলেন হিয়া আর ফারুক খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো হিয়া বললো,
~আজই আমি তাদের খবর পাঠাবো।
ফারুক বললো,
~শুভ কাজে দেরি করতে নেই।
আজাদ সাহেব ইলহামের পাশে দাড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
~তুমি তোমার এই সিদ্ধান্তে কোনোদিন আফসোস করবেনা ইলহাম।তোমার জীবনটা এখন বহু রঙ্গে রঙ্গিন হবে এটাই আমার বিশ্বাস।
বাবার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ইলহাম বললো,
~জীবনের এমন এক পর্যায় এসে পরেছি আমি যে এখানে শুধু রঙ্গহীন ভাবে সব সেজে আছে।
ইলহাম আর দেরি করলোনা ব্যাগটা নিয়ে গটগট করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আজাদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন এই দীর্ঘশ্বাসে রয়েছে ছেলের জন্য কষ্ট।

____________________♥_____________________

হিয়া ফোন করে আফজাল হোসেনকে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো আফজাল হোসেন “আলহামদুলিল্লাহ” বলে কিছু জরুরি কথা বলে নিলো।হিয়া বললো আগামী শুক্রবার তারা কাবিনটা সেরে ফেলতে চায় যদি হেমন্তি রাজি থাকে।আফজাল হোসেন প্রথমে না করলেও হিয়ার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনে সে বললেন যে,হেমন্তি রাজি হলে তার কোনো আপত্তি নেই।
আফজাল হোসেন ফোন রেখে হলরুমে চলে আসলেন সেখানে গিয়ে দেখলেন পারভীন বেগম হেমন্তির চুলগুলোতে খুব যত্ন সহকারে তেল দিচ্ছেন।আফজাল হোসেন সোফায় বসে পরলেন হেমন্তি বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
~কিছু বলবে বাবা?
আফজাল হোসেন মেয়ের কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ছেলেপক্ষ “হ্যাঁ” বলেছে মা এখন তোমার মতামত কী?
হেমন্তি নিচুস্বরে বললো,
~তোমাদের ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা আর আমি জানি তোমরা আমার জন্য ভালো কিছুই করবে বাকিটা আল্লাহ ভালো জানে।
বলেই সে রুমের ভিতরে চলে আসলো পারভীন বেগম বললেন,
~এখন তাহলে বাকি কথাটাও সেরে ফেলেন।
আফজাল হোসেন বললেন,
~আমি সব দেখছি তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।
হেমন্তি বিছানায় বসে আছে তার মনটা অনেক আনচান করছে এটা খুশির কারণে নাকি ভয়ের কারণে সে জানে না।হেমন্তি বিছানা ছেড়ে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ১১টা বেজে গেছে আজ ভার্সিটি যেতেই হবে কারণ ১টায় অনেক important class আছে। হেমন্তি দেরি না করে বোরখা পরে নিলো ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলো।
বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে সে ছুটলো ভার্সিটির পথে একবার হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে তো একবার রাস্তার দিকে।ঠিক সময় মতো সে ভার্সিটির গেইটে পৌছালো রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে সে যেই ভার্সিটির ভিতরে প্রবেশ করতে যাবে
তখনই কেউ পিছন থেকে “হেমন্তি” বলে ডাক দিলো। হেমন্তির পা থেমে গেলো সে পিছন ফিরে যে ব্যক্তিটি দেখলো তাকে দেখে হেমন্তির হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো।
সামনে থাকা মানুষটি ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়া এসে তার মুখোমুখি দাড়ালো হেমন্তির গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে পুরো সমুদ্রের পানি পান করলেও হয়তো তার পিপাসা মিটবেনা।তখনই সামনে থাকা ব্যক্তিটি গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

চলবে