মেঘ বলেছে তুমি আমার পর্ব-০৭

0
206

#মেঘ_বলেছে_তুমি_আমার❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ০৭
_______________

ব্রেকফাস্ট সেরে বাড়ির বাহিরে মোবাইল হাতে উঠানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীলয়। বাড়ির মধ্যে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না সাথে কারেন্ট নেই। নীলয় বেশ বিরক্ত বিষয়টায় একই তো প্রচুর গরম তার ওপর মোবাইলের নেটওয়ার্কের এমন সমস্যা সাথে আবার কারেন্ট নেই। নীলয় তার কপালের ঘামটা হাত দিয়ে মুছে অগ্রসর হলো বাড়ির বাহিরের দিকে। বাহিরে বের হয়ে বাম দিকে যাওয়ার জন্য পা রাখতেই এমন সময় সামনের রাস্তা দিয়ে মাথার ঘোমটা টা ঠিক করতে করতে ওই রাস্তা দিয়েই আসছিল অহনা। নীলয়ের দৃষ্টি যায় সেদিকে অহনাও তাকায় চোখাচোখি হয় দুজনের মাঝে অহনা দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে নীলয় তখনও তাকিয়ে রয়। অহনা সামনে এগিয়ে এসে বলে,

‘ কোথায় যাচ্ছেন নীলয় সাহেব?’

‘ কোথায় আর যাবো রমনী তোমাদের যে বাড়ি না থাকে কারেন্ট না থাকে নেটওয়ার্ক। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা বাজে।’

অহনা দাঁড়িয়ে পড়ে বেশ অবাক স্বরে বলে,

‘ বাড়িতে কারেন্ট নেই?’

মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলে নীলয়। অহনা কিছুক্ষন আশেপাশে তাকিয়ে বলে,

‘ আপনার কি খুব বেশি গরম লাগছে নীলয় সাহেব?’

‘ আমায় দেখে তোমার কি মনে হচ্ছে গা বেয়ে কিভাবে ঘাম পড়ছে দেখছো না?’

অহনা এবার তাকায় নীলয়ের মুখের দিকে কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে তার, নীলয়ের চোখ দুটো বেশ সুন্দর পাপড়িগুলোও বেশ ঘন অহনা না চাইতেও কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো নীলয়ের চোখের দিকে। অহনা জড়সড় হয়ে বলে,

‘ একটা জায়গায় যাবেন সেখানে আপনার একটুও গরম লাগবে না।’

নীলয় বেশি সময় নিলো না দ্রুত বললো,

‘ হুম যাবো একটু ঠান্ডা হওয়ার জন্য মনটা বড্ড আনচান করছে রমনী। চলো যাই।’

অহনা হাসে। বলে,

‘ ঠিক আছে চলুন।’

অহনা আর নীলয় হাঁটা শুরু করলো। অহনা তার মাথার কাপড়টা আরেকবার ঠিক করে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলো নীলয়কে নিয়ে। হঠাৎই নীলয় প্রশ্ন করলো,

‘ কোথায় গেছিলে?’

স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব অহনার,

‘ ওই জহির আর নীলাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গেছিলাম।’

‘ ওহ রোজই যাও ওদের পৌঁছে দিতে।’

‘ হুম।’

নীলয় আর কিছু বলে না। এবার অহনা প্রশ্ন করে,

‘ আমাদের গ্রামটা আপনায় খুব বিরক্ত করছে তাই না নীলয় সাহেব?’

‘ খানিকটা তো করছেই, আবার ভালোও লাগছে।’

‘ আমেরিকার দেশটা খুব সুন্দর তাই না।’

‘ হা একটু সুন্দর তবে এখানের প্রকৃতির থেকে বেশি নয়।’

মুচকি হাসে অহনা। নীলয় অহনার হাসি দেখে বিড়বিড় করে বলে,

‘ এভাবে হেঁসো না রমনী আমার কেন যেন তোমার হাসিটা কেমন কেমন লাগে।’

‘ আপনি কি কিছু বললেন?’

অহনার প্রশ্নে খানিকটা চমকে উঠে বললো নীলয়,

‘ না কি বলবো।’

‘ ওহ আচ্ছা কেন যেন মনে হলো আপনি কিছু বললেন।’

‘ না কিছু বলি নি।’

‘ ওহ ঠিক আছে।’

গ্রামের প্রকৃতিতে পুরো পঞ্চমুখ চারপাশ। বড় বড় গাছপালা, ঝোপঝাড়, মাটির রাস্তা, পুকুর, খাল বিল সবকিছু পেরিয়ে হাঁটছে নীলয় আর অহনা। মাঝে একবার মাছরাঙা পাখিও দেখলো নীলয় এছাড়াও নানা পদের পানির দেখা মিলিছে তার। সামনে যত এগোচ্ছে প্রকৃতি জুড়ে থাকা হিম শীতল বাতাস গুলো খুব গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে নীলয়কে। নীলয়ের ধীরে ধীরে গরম গরম লাগা ভাবটা ঘুচে যাচ্ছে। বেশ লাগছে এভাবে কখনো বাতাসের খোঁজে বাহিরে হাঁটা হয়নি তার। হঠাৎই অহনা খুশি মাখা মুখ নিয়ে বললো,

‘ নৌকায় উঠবেন নীলয় সাহেব?’

‘ নৌকা,

‘ হুম চলুন যাই আপনার ভালো লাগবে।’

নীলয় শুনলো আর পাল্টা কোনো প্রশ্ন না করে বললো,

‘ ঠিক আছে চলো।’

অহনা দ্রুত এগিয়ে গেল। সামনেই খাল বেয়ে নৌকা যাচ্ছে একটা। নৌকা চালাচ্ছে অহনাদের বাড়ির তিন বাড়ি ছাড়িয়ে থাকা আলতাফ দাদু। অহনা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মিষ্টি হেঁসে বললো,

‘ দাদু কোথায় যাচ্ছো?’

আলতাফ দাদু ঘুরে তাকালেন মাত্রই একটা সিগারেট মুখে দিয়েছিলেন তিনি। আলতাফ হকচকিয়ে উঠে পিছন ঘুরে তাকালো অহনাকে দেখেই হাল্কা হেঁসে বললো,

‘ ওহ অহনা দাদুভাই কেমন আছিস কোথায় যাচ্ছিস?’

‘ আমি ভালো আছি আমাদের একটু তোমার নৌকায় চড়াবে দাদু আমরা একটু ওই সামনে যাবো।’

দাদু এইবার তাকালো নীলয়ের দিকে। তিনি ভেবে বসলেন এ হয়তো অহনার হবুু জামাই। হাল্কা হেঁসে বললো,

‘ কে ও নাতজামাই বুঝি?’

সঙ্গে সঙ্গে অহনা নীলয় দুজনেই বিষম খেলো অহনা কিছু বলতে নিবে এরই মাঝে আলতাফ দাদু আরো বললেন,

‘ বেশ দেখতে কিন্তু নাতজামাইকে তোর সাথে বেশ মানাইছে কিন্তু দাদুভাই।’

এবার অহনা আরো বিপাকে পড়লো সে থরথর করে বললো,

‘ আরে দাদুভাই তুমি ভুল ভাবছো তুমি যাকে ভাবছো সে উনি নয়। উনি তো বাবার বন্ধু আফজাল হোসেনের ছেলে নীলয়। আর তাছাড়া আমার কিন্তু এখনো বিয়ে হয় নি তাই এখনই জামাই জামাই করো না।’

আলতাফ দাদু বেশ লজ্জা ফিল করলেন কিছু না জেনেই কি ভুলভাল বলে দিলেন। কিঞ্চিৎ হেঁসে বললেন তিনি,

‘ আরে ভুল হইয়া গেলো গা তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠ বাকি কথা নৌকায় বসে হবে।’

অহনা এবার নীলয়ের দিকে তাকালো সে কি এখন উঠবে নৌকায়, এই দাদুটাও না কেমন যেন কিছু না জেনেই ভুলভাল বলে ফেলে। নীলয়ের দৃষ্টি ছিল তখন শান্ত তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে কি বিরক্ত ফিল করলো, রাগ হলো নাকি অন্যকিছু হলো দাদুর কথা শুনে। অহনা খুব লজ্জিত ভাবে বলতে নিলো,

‘ আপনি কি?’

পুরোপুরি কথাটা শেষ করতে পারলো না অহনা তার কথার মাঝেই নীলয় বলে উঠল,

‘ আমি কিছু মনে করি নি অহনা। চলো নৌকায় উঠি।’

এই প্রথম যেন নিজের নামটা নীলয়ের মুখে শুনলো অহনা। কিছুক্ষণ নীলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো অহনা,

‘ জি চলুন।’

অহনা নিজেই আগে উঠে বসলো নৌকায় এবার নীলয় কিভাবে উঠবে বুঝতে পারছে না যা দেখে হাল্কা হেঁসে বললো অহনা,

‘ আমার হাত ধরে উঠে আসুন নীলয় সাহেব?’

কিন্তু নীলয় ধরলো না অহনার হাত সে নিজে নিজেই খানিকটা সময় নিয়ে উঠে বসলো নৌকায়। বিষয়টায় অহনার খারাপ লাগলো কি না বোঝা গেল। সে হাত সরিয়ে ফেললো, অতঃপর অহনা নীলয় দু’জনেই পাশাপাশি বসলো নৌকার এ মাথায় আর ও মাথায় মাঝি দাদু। মাঝখানে কিছু শুঁকনো ধান। অহনা বসেই আলতাফ দাদুকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘ চলো দাদু আমরা উঠেছি।’

আলতাফ দাদুও শুনলেন ধীরে ধীরে নৌকা চালাতে শুরু করলো। খালে জোয়ার ছিল না বিদায় পানি ছিল অল্প। অহনা অন্যদিক ঘুরে তাকিয়ে আছে নীলয় দেখলো সেটা মেয়েটা কি তার ব্যবহারে রাগ করলো। নীলয় সামনের মাঝির দিকে তাকালো উনি তখন উল্টোদিক ঘুরে নৌকা চালাতে ব্যস্ত ছিল। নীলয় হুট করেই অহনার কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে খুব স্বল্প আওয়াজে বললো,

‘ খুব কি আমার ব্যবহারের রাগ করেছো অহনা আসলে কি বলো তো কোনো মেয়ের হাত ধরাটা আমার জন্য একটুও আনিজিকর বিষয় নয় কিন্তু তারপরও তোমার হাতটা কেন যেন ধরতে আমার কাছে সংকোচ ফিল হচ্ছিল তাই ধরি নি।’

অহনা খানিকটা কেঁপে উঠল পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

‘ না আমি কিছু মনে করি নি।’

অহনার কথা শুনে নীলয়ও হাল্কা হেঁসে বলে,

‘ আমি জানতাম তুমি কিছু মনে করবে না।’

প্রতি উত্তরে কোনো জবাব দেয় না অহনা। নীলয়ও আর কিছু বলে না।’

প্রকৃতিরা তখন কড়া রোদ্দুরে আচ্ছন্ন। রাখাল ভাইয়া গরু নিয়ে বসে আছে মাঠে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুল ড্রেস পরে ফিরছিল বাড়ি। কেউ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে দূরে, কেউ মাথায় ভাড়ি বস্তা চাপিয়ে ছুটছিল বাড়ি, কেউ জাল ফেলে মাছ ধরে কাঁদা মাখা শরীর নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল দূরে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে কাঁচি হাতে যাচ্ছিল যেন কোথায়। নীলয় সবাইকে খেয়াল করলো। প্রকৃতির শীতল ছোঁয়ায় ততক্ষণে সে ছিল ফুড়ফুড়ে। হাতে থাকা ফোনটায় কিছু কিছু ছবি করছিল ক্যাপচার। নীলয়রা আসতে আসতে এসে পৌঁছালো বিপুল টগর আর টগরের ফুল ভরা একটা নদীর পাড়ে। অহনা একটা বড়সড় তালগাছ আর পাড় দেখিয়ে বললো মাঝি দাদুকে,

‘ ওখানেই নামিয়ে দেও দাদুভাই?’

মাঝি দাদু শুনলেন। দ্রুত নামিয়ে দিলেন অহনা আর নীলয়কে। পুরো রাস্তায় সিগারেট খাওয়া শেষ হতেই অহনা আর নীলয়ের সাথে বেশ হেঁসেখেলে কথা বলেছেন তিনি। নীলয়ের বাবাকেও চিনেন উনি। একসময় নীলয়ের দাদুর সাথে বেশ ভাব ছিল তার। নীলয়ের দাদু যে একজন ভালো মানুষ ছিলেন তাও বলেছেন তিনি। নীলয় শুধু শুনে গেছে আর হাল্কা হেঁসেছে।’

নৌকা থামতেই নীলয় আগে নেমে পড়লো নৌকা থেকে। অহনাও নেমে পড়লো। ওরা নামতেই মাঝি দাদু চলে গেলেন নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

অল্প সরু রাস্তা যার দুই কিনারায় রয়েছে ইয়া বড় বড় তালগাছ তাল ধরেছে তাতে। রাস্তার দু’পাশেই পানি থইথই করছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে খেলছে তারা। জায়গাটা খুব সুন্দর বসার জন্য একপাশে বেঞ্চও আছে। অহনা নীলয় কিছুক্ষণ বসে বসে গল্প করলো সেখানে। মুহূর্তটা বেশ সুন্দরই ছিল তাদের জন্য। নীলয় মনে মনে আওড়ালো আবার,

‘ মাথার উপর মস্ত বড় সাদা আকাশ
দুই ধারে নদী আর মাঝখানে রাস্তা,
আকাশ ভর্তি পাখি, প্রকৃতি জুড়ে হিমশীতল বাতাস সঙ্গে পাশে এক সুন্দরী রমনী বিষয়টা মন্দ না।’

হেঁসে ফেলে নীলয়। যা দেখে অহনা বলে,

‘ আপনি হাসছেন কেন?’

নীলয় হাসি থামায় বেশ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,

‘ বললে হয়তো তুমি বিশ্বাস করবে না রমনী আমি এতক্ষণ কি আবোলতাবোল জিনিসপত্র ভেবেছি।’

অহনা বেশ অবাক হয়ে বললো,

‘ মানে,

‘ সবকিছুর মানে যে খুঁজতে নেই মিস অহনা কিছু কিছু কথার মানেকে আপনাআপনি ছেড়ে দিতে হয় সময়ের তালিকায়। নয়তো ভুলে যেতে হয় তৎক্ষণাৎ। বুঝলেন কিছু?’

#চলবে….