মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-০২

0
877

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০২]

৩,
– মেহু, তোর মনে হয়না আজ একটু বেশীই করে ফেলেছিস। জানিস সবাই যখন আংকেলের আত্নার মাগফেরাত কামনা করছিলো তখন আংকেলের চোখে পানি দেখেছি আমি। মেহেরের পাশে মন মরা হয়ে বসে বলল মৌ।

– আমি কি করবো?

– আংকেল তোর বাবা হয় মেহু। মানছি সে অন্যায় করেছে তোদের সাথে তাই বলে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মৃত বানিয়ে দিবি।

– আমাদের কাছে উনি অনেক আগেই মারা গেছে এটা তুই ভালো করেই জানিস তাহলে এই কথাগুলো কেন বলছিস মৌ। আমার জন্যে যেমন আমার মা আছে তেমনি মায়ের জন্যে আছি আমি। আমাদের আর কারো প্রয়োজন নেই। ডাইরি আর কলমটা পাশে রেখে দিলো মেহের। দুপুরের পরে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হয়। বাড়ি ফিরে আজকের দিন নিয়ে একটা গল্প লেখছিলো সে। তখন মৌ আসে মেহেরের রুমে। মেহের মৌয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বড় করে শ্বাস নেয়। তারপর মৌকে প্রশ্ন করে,

-সৈয়দ নওশাদ আহমেদ দ্বিতীয় বিয়ে কেন করেছিলো জানিস?

– কেন আবার! আন্টিকে তার পছন্দ নয় তাই।

– সেটাই। আমার মা কালো তাই সে দ্বিতীয় বিয়ে করে। তাও আবার মায়ের গর্ভাবস্থায়। তার নতুন বিয়ের চৌদ্দ দিন পর আমার জন্ম হয়েছিলো। তখন কোথায় ছিলো তার পিতৃত্ব।তখন সে তার অনাগত সন্তানের কথা একবারও ভেবেছে। না ভাবে নি। সে নতুন আরেকটা বিয়ে করে নিয়েছে। আমার কি মনে হয় জানিস মৌ, আমি যদি আমার মায়ের মতো দেখতে হতাম তাহলে হয়তো সে আমাকে মেয়ে বলে স্বীকার করতো না। সে তো সুন্দরের পুজারী তাইনা। আমার গায়ের রং সুন্দর তাই সে আমাকে মেয়ের বলে দাবি করে। আমার মুখে বাবা ডাক শুনতে চায়। আমি কেন তাকে বাবা বলে ডাকবো বলতো। তার তো অন্য ছেলে মেয়েরা আছে তাকে বাবা বলে ডাকার মতো কেউ আছে। কিন্তু আমার! আমার তো একজনই বাবা। আমি তো কাউকে বাবা বলে ডেকে মনে স্বাধ পূরণ করে পারিনি। কিন্তু সে? সে বাবা ডাক ঠিকই শুনেছে। আমি কেন আমার মায়ের মতো দেখতে হলাম না রে মৌ। কেন ওই লোকটার মতো দেখতে হলাম। আমি ওই লোকটাকে যতটা ঘৃনা করি ঠিক ততটাই ঘৃনা করি আমার গায়ের রংকে। এক নাগারে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ায় মেহের। যাকে সে বাবার অধীকার দেয়নি তার পরিচয় দেওয়ার কোন মানেই হয়না। তাতে সে যতই কষ্ট পাক না। বাংলা সিনেমার মতো এসে কেঁদে কেঁদে বলবে, আমাকে একবার বাবা বলে ডাক না মা। আর মেহেরও সব ভুলে তাকে বাবা বলে ডাকবে এটা কোন দিনও হবে না। আমার জিবনটা দুই আড়াই ঘন্টার ওই সিনেমার মতো নয়। বাস্তবাতা কতটা কঠিন সেটা হারে হারে টের পাচ্ছি।
পাশেই দেয়ালে সাঁটানো ঘড়ির দিকে তাকালো মেহের। চারটা বাজতে চলল। টিউশনে যেতে হবে। এখন একা বাহিরে যেতে হবে ভাবতেই অস্বস্তি হচ্ছে মেহেরের। রাস্তায় বের হলেই সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এইতো কিছুদিন আগের একটা ঘটনা,

মেহের আর মৌ দুজনে গল্প করতে করতে কলেজে যাচ্ছিলো। যেহেতু মেহের দেখতে বেশ সুন্দরী তাই সে সকলের নজরে পরে। আর এটাই স্বাভাবিক। রাস্তাঘাটে সবাই তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। পরে তারাই বাড়িতে তার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মৌ আর মেহের যখন রাস্তাদিয়ে যাচ্ছিলো তখন দুজন মাধ্যবয়স্ক মহিলা এগিয়ে আসে তাদের দিকে। এবং তারা মেহেরের পরিচয় জানতে চায়। প্রতিবারের ন্যায় সে-বারও মেহের শুধু নিজের নাম আর তার মায়ের নাম বলে। একজন মহিলা মেহেরের বাবার নাম জিগ্যেস করে। প্রতিউত্তরে মেহের বলে,

– আমার বাবা নেই।

– তোমার বাবা নেই না। কত দিন আগে মারা গেছে তোমার বাবা। আচ্ছা বাবা মারা গেছে বলে তো আর তোমার পরিচয় মিথ্যে হয়ে যাবে না। তোমার মৃত বাবার নামটাই বলো।

মেহের কোন জবাব না দিয়ে করুন চোখে তাদের দিকে তাকায়। প্রতিটা মুহূর্ত ওকে মনে করিয়ে দেয় এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসা এক অদ্ভুত অভ্যাস এটি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমা দেশেও এই এক রীতি প্রচলিত। বিবাহের আগে বাবার আর বিবাহের পর একটি মেয়ে তাঁর স্বামীর নামে পরিচিত হয়। আর তাঁদের সন্তানেরা পরিচিত হয় বাবার নামে। সমাজ ও বিশ্বের পুরুষতান্ত্রিক প্রকৃতির বা বৈশিষ্টের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ এটি। ঠোঁট চেপে হাসার চেষ্টা করে মেহের। তখন অপর মহিলাটি বলে,

– কি এত ভাবছো তুমি। বাবার নাম বলতে এত সময় লাগে।

– আসলে আমার বাবা নেই। আমার মা একজন সিঙ্গেল মাদার। দু-চোখ বন্ধকরে বলে মেহের।

মেহেরের কথা শুনে মাহিলা দুজনে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর একজন অট্টহাসিতে ভেঙে পরে। মেহের বুঝতে পারেনা তার হাসির কারন। সে তো কোন জোকস্ বা কমিক্স বলে নি তাহলে মহিলাটি হাসছে কেন। অতঃপর মহিলাটি তার হাসি থামিয়ে বলে উঠলো,

– ও এই জন্যেই তুমি তোমার বাবার নাম বলতে পারোনা। আচ্ছা তোমার বাবা মায়ের বিয়ে হয়েছিলো তো?

উক্ত মহিলার কথা শুনে চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠলো মেহেরের। দুহাতে শক্ত করে উড়না চেপে ধরে চোখদুটি বন্ধকরে নিলো সে। তোমার বাবা মায়ের বিয়ে হয়েছিলো তো! একজন সন্তানের কাছে এর চেয়ে খারাপ কথা আর কি হতে পারে। সেদিন মেহেরের খুব আপসোস হয়েছিলো। কেন আর সবার মতো ওর বাবা ওদের সাথে থাকে না। হ্যাঁ তার মা তাকে বাবার অভাব পেতে দেয়না। কিন্তু আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যে ওকে প্রতি মুহুর্তে ওর বাবার প্রয়োজনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেদিনের পর থেকে রাস্তাঘাটে লোক এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আগে খারাপ লাগতো মেহেরের এখন এটা অভ্যাসে পরিণিত হয়েছেন।তাই কারো কথা গায়ে মাখে না মেহের।

৪,
মাথায় উড়না পেঁচিয়ে কাঁদে ব্যাগ ঝুলিয়ে হেলেদুলে যাচ্ছে মেহের। সোয়েটার পড়ার করানে একটু মোটা দেখাচ্ছে ওকে। প্রাইমারী স্কুলের পাশে এসে ফটাফট কয়েকটা সেলফি তুলে নিলো সে। তারপর সে মোবাইলে সদ্য তুলা ছবি গুলো দেখতে দেখতে যাচ্ছে। সেখান থেকে কিছু ছবি গুগলে সেইভ করে বাকিগুলা ডিলিট করে দিলো। মাঠের কাছে আসতেই একটা বল এসে লাগলো মেহেরের মাথায়। ঘটনার আকস্মিক মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে মেহের। আর মাথায় হাত বুলাতে থাকে।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মানুষ দেখে উঠে দাঁড়ায় মেহের। মাথা থেকে হাত নামিয়ে চোখ মুখ শক্তকরে তাদের কিছু বলতে যাবে তখন ওর চোখ আটকে যায় একটা যুবকের উপর। ব্যাট হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্যাবলা মার্কা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। মুহুর্তেই মুখের রিয়্যাকশন বদলে যায় মেহেরের। সে রাগে দাত কটমট করে যুবকটার দিকে তর্জনী তুলে বলে,

– আপনি? আপনি ইচ্ছে করেই আমার মাথায় বল লাগিয়েছেন তাইনা।

যুবকটার হাসি তার মুখের সাথে মিলিয়ে যায়। সে আমতা আমতা করে বলে,

– না আসলে, আমি ইচ্ছে,,,

– হ্যাঁ আপনি ইচ্ছে করেই লাগিয়েছন। আমি তো সরি বলছিলাম আপনাকে তাও আমার মাথায় বল লাগালেন।

– ভাই ইচ্ছে করে আপনার মাথায় বল লাগায় নি। আসলে ভাই একটা ছয় মারছিলো আর আপনি বলের সামনে এসে পরেন। আপনার জন্যে আমরা বল ধরতে পারিনি। নাহলে ভাই এবার আউট হতো। একটা কিশোর বয়সের বাচ্চা কথাগুলো বলল। মেহের তাকে পা থেকে মাথা অব্ধি অবলোকন করে নিলো। বয়স তার বারো তেরো হবে হয়তো। মেহের সবাইকে এক নজর দেখে নিলো। এখানে রাহনাফ ছাড়া বাকি সবাই ছোট। এই বাচ্চাদের আর কি বলবে। মেহের রাহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,

– সরি বলতে পারেন তো, নাকি শুধু হাসতেই পারেন!

– আমি কেন সরি বলতে যাব।

– আপনি আমার মাথায় বল লাগিয়েছন এখন সরি বলুন।

– আমি ইচ্ছে করে লাগাইনি। সো আমি সরি বলবো না।

এবার মেহের বেশ রাগ হলো। মাথায় বল লাগিয়েও জোর গলায় বলছে সরি বলবে না। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে রাহনাফের দিকে তাকালো মেহের। ততক্ষণে একটা বাচ্চা বল তুলে নিয়েছে। বাচ্চাটা বল নিয়ে রাহনাফের কাছে আসতেই মেহের বাচ্চাটার হাত থেকে বলটা নিয়ে নিলো।

– আপনি বল কেন নিলেন? বল দেন, আমরা খেলবো।

– আগে উনাকে সরি বলতে বলো তারপর বল দিবো। না হলে তোমরা বল পাবে না। সামনের দিকে হাটা শুরু করে মেহের।

মেহের এমন বাচ্চামো দেখে হেসে ফেলল রাহনাফ। নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকিয়ে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– শুধু বল দিয়ে তো খেলতে পারবেন না। ব্যাট টাও সাথে নিয়ে যান।

– আপনাদের খেলা বন্ধ হয়েছে এতেই যথেষ্ট। ব্যাট আপনার কাছেই রেখে দিন। গুণগুণিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে যায় মেহের। এদিকে বাচ্চারা রাহনাফের উপর রেগে যায়। সে কে মেহেরকে সরি বলল না। রাহনাফ সরি বলল মেহের ওদের বল নিতো না আর ওদের খেলাটাও বন্ধ হতো না। রাহনাফের কানে বাচ্চাদের কথা পৌছাচ্ছে না। সে নিঃপলক তাকিয়ে আছে মেহেরের চলে যাওয়ার দিকে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।