মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-০৩

0
732

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৩]

এলমাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে সামনে কিছুদূর এগোতেই একটা দোকান পরে। দোকানটা খুব বেশী বড় না হলেও সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়। বিকাল বেলা দোকানের পাশে পিয়াজু ভাজা হয়। আশেপাশের প্রায় লোকেরা এখানে প্রতিদিন ভীড় জমায় গরম গরম পিয়াজু খাওয়ার জন্যে। শীতের মৌসুমে এখানে ভাঁপা পিঠা ও চিতই পিঠা বানানো হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দোকানের পাশে বানানো হচ্ছে ভাঁপা পিঠা চিতই পিঠা আরেক পাশে ভাজা হচ্ছে পিয়াজু। চারিদিকে ঘন কুয়াশা আর বেলা ডুবে যাওয়ার কারনে অন্ধকার নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে সন্ধা নেমে আসছে। কুলায় ফেরা পাখির মতো ঘরে ফিরে যেতে হবে। মেহেরের ও ইচ্ছে হলো আজ ভাঁপা পিঠা ও চিতই পিঠা কিনে নিয়ে যাবে। অনেকদিন ভাঁপা পিঠা খাওয়া হয়না। আর এগুলো দিয়ে রাতের খাবার ও হয়ে যাবে। মেহেরের মা বাসায় থাকলে কত বার তাকে পিঠা বানিয়ে খাওয়াতো। মেহের তার ইচ্ছে অনুযায়ী দোকানের পাশটাতে যায়। ভীড় ঠেলে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– চাচা, আমাকে পাঁচটা ভাঁপা পিঠা ও এক পোয়া পেয়াজু দেনতো।

মেহেরের কথা মতো দোকানদার একটা পলিথিনে পাঁচটা ভাঁপা পিঠা আর অন্যটাতে এক পোয়া পিয়াজু দেয়। দোকানদার মেহেরের দিকে ওগুলা বাড়াতেই কেউ এসে সেগুলা দোকানদারের হাত থেকে নিয়ে নেয়। কে নিলো তার জিনিস! লোকটাকে দেখার জন্যে পাশে তাকাতেই মেহের কপাল কুচকে ফেলে। পাশে থাকা লোকটাকে দেখে যে বিরক্ত মেহের এটা চার চাহনি দেখেই বুঝা যাচ্ছে। মেহেরের এমন চাহনি দেখে ভুবন ভুলানো হাসি দেয় লোকটা। তারপর বলে,

– এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? খাবার কিনলেন বিল দিবেন না।

মেহের কোন কথা না বলে ভাঁপা পিঠা আর পিয়াজুর দাম দিয়ে দেয়। অতঃপর সে লোকটাকে বলে, আপনি আমার পিঠা আর পিঁয়াজু কেন নিলেন? ওগুলা আমার, দিন। মেহেরের কথা মনেহয় লোকটার কান অব্ধি পৌঁছালো না। সে সেখান থেকে একটা পিঁয়াজু তার মুখে পুরে দিলো। এটা দেখে মেহেরের চোখ কপালে উঠে যায়। মেহের তাকে কিছু বলবে তখন খেয়াল করে সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই মেহের সেখান থেকে চলে আসে। লোকটা ওর পিছনে যায়।। কিছুদূর যেতেই কোমড়ে হাত রেখে থমকে দাঁড়ায় মেহের। পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,

– আপনি আমাকে ফলো কেন করছেন? আর আমার পিঁয়াজু!!

– আপনি আমার বল দিন, আমি আপনার পিয়াজু পিঠা সব দিয়ে দিবো। মজা করে পিঁয়াজু খেতে খেতে বলল রাহনাফ।

– নিজেই গপগপ করে পিঁয়াজু খেয়ে সাবার করে দিচ্ছে সে নাকি আমার পিয়াজু ফিরিয়ে দিবে। রাক্ষস একটা। পিঁয়াজু খেতে মন চাইলে নিজে কিনে খা। আমারটা কেন নিয়েছিস, রাক্ষস কোথাকার। বিড়বিড় করে বলল মেহের।

– কিছু বললেন? আরেকটা পিয়াজু মুখে পুরে দিয়ে বলল রাহনাফ।

– না। আপনি আমার পিছু আসবেন না।

– আমার বল।

– আগে সরি বলুন। উহঃ আমার মাথাটা এখনো ব্যাথা করছে। মাথায় হাত দিয়ে বলল মেহের।

– দেখুন মিছ আমি ইচ্ছে করে আপনার মাথায় বল লাগাইনি সো সরি বলার কোন প্রশ্নই আসে না। আপনি আমাকে বলটা দিন। সবাই অপেক্ষা করছে।

– আমি এই বল দিবো না। আপনি যান না দোকান থেকে একটা বল কিনে নিয়ে ওদের দিন।

– বাচ্চারা সেটা নিবে না। ওদের এই বলটাই চাই। আবারও একটা পিয়াজু মুখে পুরে দিলো রাহনাফ। এদিকে রাহনাফের পিঁয়াজু খাওয়া দেখে রাগে শরীর কাঁপছে মেহেরের। সে দাত কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রাহনাফের দিকে। কত শখ করে পিঠা আর পিয়াজু কিনেছিলো সে খন সবটা এই রাক্ষস রাহনাফের পেটে যাচ্ছে। নিমিষেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো তার। ভেবেছিলো আজ রাতটা পিঠা খেয়েই দুজনে পার করে দিবে সেটা আর হলো না। এখন বাসায় গিয়ে আবার রান্না করতে হবে। মেহের ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। বিনিময়ে রাহনাফ কেবলাকান্তের মতো হাসি হাসে। যা মেহেরের রাগকে দ্বিগুণ বাড়িতে তুলে। একেবারে আগুনে ঘি ঢালার মতো।

৫,
রাতের খাওয়া শেষ করে মাত্র বই নিয়ে বিছানায় বসেছে মেহের। মৌ ওর পাশে বসে ড্রয়িং করছে। ড্রয়িং এ মৌয়ের হাত বেশ পাকা। সে একবার যেটা দেখে সেটাই আঁকতে পারে। অনেক আগের কথা, মৌ তখন ওদের সাথে থাকতো না। তারা পুরো পরিবার সিঙ্গাপুরে থাকতো। কয়েকদিনের জন্যে এই শহরে বেড়াতে এসেছিলো মৌ আর তার মা-বাবা। আর তখনি মেহেরদের সাথে মৌ এর পরিচয় হয়। পার্কে প্রথম দেখা হয়েছিলো ওদের। সেদিন মেহেরের মন খুব খারাপ ছিলো। ছয় বছরের একটা বাচ্চার মন খারাপ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এই মন খারাপটা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে সেটা অস্বাভাবিক। ছয় বছরের একটা বাচ্চার এত গভীর ভাবে মন খারাপ হয় না। কিন্তু মেহেরের হয়েছিলো। সেদিন মেহেরের খুব মন খারাপ হয়েছিলো। কারন সে স্কুলে তার সহপাঠীদের দেখে তারা তাদের বাবার সাথে স্কুলে যেত। শুধু মেহেরের বাবাই যেত না। এমনকি মেহের জানেও না তার বাবা কে! মেহের ওর মায়ের কাছে বাবার কথা জানতে চাইতো। ওর বাবা ওদের সাথে কেন থাকে না সেটা জানতে চাইতো। কিন্তু মেহেরের মা ওকে ওর বাবার সম্পর্কে কোন কিছুই বলতো না। এমনি সেদিন স্কুলের প্যারেডস মিটিং এ মেহেরের বাবা উপস্থিত ছিলো না। এটা নিয়েই বেশ মন খারাপ ছিলো মেহের। সে বাসায় ফিরে তার মায়ের সাথে কথা বলতো না। গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো সারাক্ষণ। এদিকে মেহের মা সৈয়দা মাহবুবা কিছুদিন যাবৎ বেশ চিন্তায় আছেন। মেহেরের দুই বছর বয়সে তিনি তার বাবার বাড়ি ছেড়ে একটা বাসা বাড়িতে ভাড়া থাকেন। পাশেই একটা দোকানে শেলাইয়ের কাজ করেন তিনি। সারাদিন শেলাই করে যা উপার্জন করেন সেটা দিয়েই তাদের মা আর মেয়ের খরচ বহন করেন। বেশ কিছুদিন যাবৎ সে শুনে আসছে তাদের এই শেলাইয়ের দোকটা বন্ধ করে দিবে। শেলাইয়ের দোকান বন্ধ মানে সৈয়দা মাহবুবার উপার্জনের পথও বন্ধ। এই টুকু একটা মেয়ে নিয়ে কোথায় যাবেন তিনি। কি করে তাদের এই ছোট্ট সংসার চালাবেন তিনি। নানান চিন্তা বেকে বসে সৈয়দা মাহবুবার মাথায়। এদিকে মেহেরও গাল ফুলিয়ে বসে আছেন। তাই সৈয়দা মাহবুবা তাদের নিজেদের মন ভালো করার জন্যে ওকে নিয়ে একটা পার্কে যায় আর সেখানেই মৌ এর সাথে পরিচয় হয় মেহেরের। পার্কে গিয়েও গাল ফুলিয়ে বসে ছিলো মেহের আর এই অবস্থায় ওর একটা ছবি আঁকে মৌ। অবশ্য ছবিটা দেখতে বেশ হাস্যকর হয়েছিলো। বড় বড় চোখ, এবড়োখেবড়ো নাক। মাথার চুল ছিলো না। বেশ হাস্যকর ছিলো ছবিটা। সেদিনের সেই ছবিটা বেশ যত্নকরে রেখেছে মেহের। তারপর থেকে মৌ এর সাথে বন্ধুত্ব হয় মেহেরের। মৌ এর জেদের কাছে হেরে এই শহর ছেড়ে আর যাওয়া হয় না মৌ এর বাবা মার। একই বাড়িতে থাকতে শুরু করে তারা সবাই মিলে। মৌ এর বাবা সৈয়দা মাহবুবাকে প্রাইমারী স্কুলে চাকরির ব্যাবস্থা করে দেন। বেশ ভালোও কাটছিলো তাদের দিন। এর মধ্যে হঠাৎ করে একদিন মৌ এর বাবার বুকে তীব্র উঠে। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। স্বামির মৃত্যর শোক সহ্যকরতে না পেরে মৌ এর মা-ও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকে মৌ ওদের সাথেই থাকে।

– এত যত্নকরে কার ছবি আঁকছিস আমিও দেখি। মৌয়ের আঁকা ছবিটা হাতে নিয়ে বলল মেহের।

– নাহ মেহু, একদম না। ওটা আমাকে দে বলছি, নাহলে খুব খরাপ হবে বলে দিলাম।

– আচ্ছা তাই। তাহলে ছবিটা আমার দেখতেই হয়। মেহের ছিটা দেখার জন্যে সামনে ধরতেই মৌ সেটা ওর হাত থেকে নিয়ে নেয়। আর বলে,

– সময় হলে আমি নিজে তোকো দেখাবো? মৌয়ের কথায় ভ্রু কুচকিয়ে ফেলে মেহের। সে মৌ-কে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে বলে উঠে,

– কার ছবি আঁকছিস তুই?

– আমার ড্রিম বয়।

আর কোন কথা বাড়ায় না মেহের। এই ড্রিম বয় ক্রাশ বয় প্রেম ভালোবাসা এসবের কিছুই বিশ্বাস করে না সে। তার কাছে ভালোবাসা মানেই প্রয়োজনীয় চাহিদা। প্রয়োজন শেষে সবাই ছেড়ে চলে যায়। কিংবা ভালোবাসা মানে মানুষের বাহিরের সৌন্দর্য দেখে তাকে নিজের করে পাওয়ার একটা লোভ, আকাঙ্ক্ষা । তাছাড়া আর কি আছে এই প্রেম ভালোবাসায়। সত্যি যদি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলে কিছু থাকতো তাহলে দুই বছর এক ছাদের নিচে থেকেও ওর বাবা মায়ের বিচ্ছেদ কেন হলো। মেহের পৃথিবীতে আসবে জেনেও তারব বাবা দ্বিতীয় বিয়ে কেন করলো। কেন সে জন্মের আগেই তার বাবার আদর স্নেহ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হলো। ভালোবাস বলে কিছু নেই। সবই সৌন্দর্যের খেলা। বই পড়ায় মনোযোগ দেয় মেহের। কিছুক্ষণ পর ওর মোবাইলটা বেজে উঠে।

৬,
বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন সৈয়দা মাহবুবা। তিন মাস পর আজ বাড়ি ফিরছেন তিনি। মেয়েগুলোকে জানানো হয়নি এখনো।মিষ্টি কালারের শাড়ি পরে কালো শাল জড়িয়ে রেখেছেন গায়ে।মাথায় চুলগুলা খোপা করা। সামনের কিছু চুলে পাক ধরেছে তার। চুলে পাক ধরাকে অনেকেই বয়সের ছাপ হিসেবে ধরে নেয়। বয়স বাড়লে চুল পাকবে এটাই স্বাভাবিক। আজকাল চোখেও ঝাপসা দেখেন তিনি। তাই পাওয়ারওয়ালা চসমা পরেছেন। বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখদুটি বন্ধ করে নেন সৈয়দা মাহবুবা। মনে পরে তার সে কালো অতীতের কথা। মেহেরের দুই বছর বয়সে তিনি যখন তার বাবার বাড়ি ছেড়ে এই বাসা বাড়িতে উঠেন তখন লোকে তাকে কত কথাই না শুনিয়েছে। সবার সব অপমান মুখ বুঝে সহ্যকরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিলতিল করে বড় করেছেন তিনি মেহেরকে। আর মেহেরকে বুঝিয়েছেন এক দিন এই সমাজও তাদের সম্মান দিবে। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে সৈয়দা মাহবুবা। আজ তার সব কষ্ট সার্থক। তিনি এখন গর্ব করে বলতে পারবেন,

– আমি স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতন্ত্র একজন নারী। একজন সিঙ্গেল মাদার। একটা সুন্দরী কন্যার মা আমি। এবং একজন ছত্রিশ বছরের মহিলা যে এই বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক। হ্যাঁ আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমি তাকালপ্রাপ্ত একজন মেয়ে। আমার জিবন এবং শরীরের ত্রুটি রয়েছে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।