মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-০৪

0
667

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৪]

৭,
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মৌ দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে থাকা ব্যাক্তিকে দেখে তার চোখ-মুখে হাসির ঝলক ফুটে উঠে। মৃদু হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে মৌ। আগন্তুক ব্যাক্তি মৌ-য়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ওর কপালে চুমু খায়। মৌ তাকে ছেড়ে দিয়ে উৎসুক নিয়ে বলতে থাকে,

– তুমি কখন আসলে আন্টি আর তুমি আসছো আমাদের জানাওনি কেন? তোমার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো।

সৈয়দা মাহবুবা মৌয়ের দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর তার ব্যাগ হাতে নিয়ে মৌকে সাইড করে ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বললেন,

– মেহুর সাথে থেকে তোর স্বভাবটাও মেহুর মতোই হয়েছে। ভিতরে আসতে দিবি তো, নাকি বাহিরে দাঁড়িয়ে তোর সব প্রশ্নের জবাব দিবো।

– হ্যাঁ হ্যাঁ আসোনা সৈয়দা মাহবুবার হাতের ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে নিলো মৌ। ভিতরে এসে সৈয়দা মাহবুবা একটা চেয়ারে বসে পরেন। মৌ ব্যাগটা রেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

– আন্টি পানি খাবে তুমি। তোমাকে পানি দিবো?

– এক গ্লাস লেবুর শরবত করে দে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে। মেহু কোথায়? ওকে দেখতে পাচ্ছি না যে।

– তোমার মেয়ে কখন কোথায় যায় সেটা কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করে নাকি। সকাল সকাল কোথায় যেন বেড়িয়ে গেলো। দেখো আজ আবার কার সাথে ঝগড়া করে ফিরে।

– এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না। চসমা খুলে সেটা শাড়ির আচল দিয়ে মুছে আবার পরে নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে মেহেরের নাম্বারে ডায়াল করলেন। রিং হয়ে যাওয়ার পরেও মেহের কল রিসিভ করলো না। সৈয়দা মাহবুবা দুই বার কল দিলেন কিন্তু মেহের একবারও কল রিসিভ করে নি।

৮,
এক বছর পর মাধ্যমিক স্কুলে পা রাখলো মেহের। বছর খানেক আগে নববর্ষ উৎযাপনে এই স্কুলে এসেছিলো মেহের। তারপর আর এখানে আসা হয়নি তার। কাল রাতে স্কুলের হেড মাস্টার কল না করলে হয়তো আজও এখানে আসা হতো না তার। এক বছরে স্কুলের অনেক কিছুই বদলে গেছে। স্কুলের সামনে বড়ই গাছটা আর নেই। যেখানে রোজ স্কুলে আসার পথে বড়ই গাছটাই সকলের চোখে পড়তো। শীতের মৌসুমে অনেক বড়ই দেখে যেতো এই গাছটায়। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে সবই বড়ই ছিঁড়ে খেতো। তাই বড়ই গাছের মালিক গাছে একটা সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখতেন, বড়ই গাছে ঢিল দেওয়া নিষেধ। কে শুনে কার কথা। সবাই ঢিল মেরে আগে সাইনবোর্ডটাই নষ্ট করে দিতো। মেহের গিয়ে হেড স্যারের সাথে দেখা করে। হেড স্যার তাকে দেখে খুব খুশি হয়।

– আরে মেহের তুমি এসেছো তাহলে। আমরা তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।

তারপর দারোয়ান গিয়ে চারজন ছেলেমেয়েকে হেড স্যারের রুমে নিয়ে আসে। এখানে কি হচ্ছে আর তাকে কেন ডেকেছে এর কিছুই জানেনা মেহের। আর এই ছেলেমেয়েদের ই বা কেন ডেকেছে। মেহের হেড স্যারকে কিছু বলবে তার আগেই তিনি বলে উঠেন,

– মেহের, তুমি চলে যাওয়ার পর ডিবেটে আমাদের স্কুল একদম পিছিয়ে গেছে। তোমার মতো করে কেও বক্তব্য রাখতে পারেনা। একসময় জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগীতায় আমাদের স্কুল প্রথম ছিলো। ক্রমে ক্রমে আমরা সেই পদটা হাড়িয়ে ফেলছি। প্রতিবারের ন্যায় এবারও আমাদের স্কুল থেকে চারজন প্রতিযোগী জাতীয় স্কুল প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করবে। আমি চাই এদের সকলকে তুমি সাহায্য করো। তুমিই এদের বক্তব্য লিখে দাও।

– এবারের প্রতিযোগীতা কোন বিষয়ের উপর।

– সামনে আসছে আট-ই মার্চ। বিশ্ব নারী দিবস। আট-ই মার্চ নিয়ে হবে এবারের বিতর্ক প্রতিযোগীতা। আমাদের স্কুল নারীর অধীকার আর সম্মান নিয়ে লড়বে। আচ্ছা মেহের তুমি আট-ই মার্চ সম্পর্কে কি কি জানো?

– আট-ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের প্রতিটা দেশে নানা রুপে এই দিবসটি পালিত হয়। সভা সমিতি ধর্মঘটও হয়। এসব সভায় নারী-পুরুষের বেতন-ভাতায় অসাম্য, নারী নির্যাতন, মেয়ে শিশু নির্যাতন এবং গর্ভপাত ইত্যাদি বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। কোন কোন দেশে নারীরা ধর্মঘট পালন করেছে। তবে কোথাও কোথও নারীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি অনুষ্ঠানকে ম্লান করে দিয়েছে।

– বাহ। আমি জানতাম তোমার থেকে ভালো এই বিষয়ে আর কেও লেখতে পারবে না। তুমি ওদের সাথে যাও আর ওদেরকে সব বুঝিয়ে দাও।

৮,
হেলেদুলে হেটে যাচ্ছে মেহের। স্কুল থেকে ফিরতে দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়েগেছে। তাই ভাবলো এলমাদের বাসায় গিয়ে ওকে পড়িয়ে একেবারে বাসায় ফিরবে সে। এখন এলমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যেই হাটছে মেহের আর গুনগুনিয়ে গান গাইছে। এমনি সময় একটা বড় গাড়ি দ্রুত স্পিডে ওকে পাস করে গেলো। গাড়িটা এত দ্রুত যাচ্ছে যে রাস্তার থাকা কিছু ময়লা এসে পরে মেহেরের শরীরে। রাগে মেহের চিৎকার করে বলে উঠে,

– গাড়ি কিনে কি পুরো রাস্তাটাই কিনে নিয়েছেন নাকি? রাস্তার আশেপাশে লোক চলাচল করে এগুলো দেখতে পাননা নাকি। চোখ পকেটে নিয়ে গাড়ি চালান নাকি।

গাড়িটা কিছুদূর যেতেই থেমে যায় তারপর গাড়ি থেকে একটা মেয়ে নেমে আসে। মেয়েটাকে দেখেই মেহেরের রাগ মাথা চাপা দিয়ে উঠে। এই তো সেই মেয়ে। সেদিন যে মেহেরকে অডিটোরিয়ামে নিয়ে গেছিলো। আজ আবার মেয়েটা এখানে! কি চাইছে কি এই মেয়েটা? উহঃ বিরক্তিকর।

– এই মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে চিৎকার কেন করছো?

মেহের রাহির কথার জবাব দিলোনা। দাঁত কটমট করে তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। মেহেরকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখুনি রাহিকে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থেকে এক মাধ্যবয়স্ক মহিলা বের হয়ে আসলেন। এই মহিলাকে দেখে মেহেরের মনে হচ্ছে তাকে আগে কোথাও দেখেছে? কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে পড়ছে না মেহেরের। মহিলাটি ওদের কাছে এসে জিগ্যেস করে,

– কি হচ্ছে এখানে! আর রাহি তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও গিয়ে গাড়িতে বসো।

– দেখনা এই বেয়াদব মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিভাবে চিৎকার করছে। সেদিন এই মেয়েটাই রাহনাফকে ধাক্কা দিয়েছিলো।

– ভদ্রভাবে কথা বলো। অপরিচিতদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তোমাকে কেও শেখায়নি! আর কাকে বেয়াদব মেয়ে বলে সম্বোধন করছো! তোমারকি কি নিজের সম্পর্কে কোন ধারনা নেই নাকি।

– তোমার সাহস করে কি করে আমার সাথে এভাবে কথা বলার। রাহি হাত উঠায় মেহেরকে মারার জন্যে কিন্তু তার আগেই সেই মহিলাটি রাহির হাত ধরে বলে,

-এটা তুমি কি করছো রাহি।

– এখানে কি হচ্ছে এসব? পুরুষালির কন্ঠস্বর পেয়ে সবাই পিছনে তাকায়। পিছনে তাকিয়ে যাকে দেখতে পায় তা দেখেই প্রচুর রাগ হয় মেহেরের। এই লোকটা এখানে কেন? যত বলি আমি এই লোকটার মুখ দর্শন করবো না ততই এই লোকটা আমার চোখের সামনে এসে হাজির হয়। লোকটাকে দেখেই দু-পা পিছিয়ে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় মেহের তখন সে বলে উঠে,

– মেহের,

সৈয়দ নওশাদ আহমেদের কথা শুনে রাহি ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকায়। তারপর বলে,

– বাবা তুৃমি ওই ষ্টুপিড মেয়টাকে,,, রাহি আর কিছু বলার আগেই সৈয়দ নওশাদ আহমেদ তার হাত উঁচু করে রাহিকে থামিয়ে দেন। নওশাদ আহমেদ এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিলো। রাহি যখন মেহেরে উপর হাত উঠায় তখন তিনি এগিয়ে আসেন। এদিকে মেহের রাহির মুখে বাবা ডাক শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। রাহি সৈয়দ নওশাদ আহমেদকে বাবা বলে কেন ডাকলো তাহলে কি এই রাহি! পিছনের দিকে ঘুরে তাকায় মেহের। রাহির দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে করুন চোখে নওশাদের দিকে তাকায়। নওশাদ মেহেরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। তখন নওশাদে চোখে ছিলো অনুতাপের ছোয়া। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় মেহের। তারপর সেখান থেকে ছুটে চলে আসে।

কিছুদূর এসে একটা তেতুল গাছের নিচের বসে পরে মেহের। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে বড় বড় করে কয়েকটা শ্বাস নিয় সে। ভালোই তো আছেন মিস্টার নওশাদ ওরফো আমার জন্মদাতা। নিজের স্ত্রী সন্তান নিয়ে কত সুখে দিন কাটাচ্ছেন আপনি। আপনার মেয়ে আজ বড় গাড়ি করে ঘুরে। সমাজে আপনার উঁচু স্থান রয়েছে। সবাই আপনাদরে কত সম্মান করে। তাহলে কেন বারবার আমার সামনে আসন আপনি? আমাদের লাঞ্ছনা মানুষের অপমান আর কটু কথা ছাড়া আর কি দিয়েছেন আপনি। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না আমার মা মানুষের কতটা অপমান সহ্য করেছে। এখনো করে। সবাই যখন আমার জন্মপরিচয় জানতে চায় তখন আমি বলি আমার মা সিঙ্গেল মাদার। তখন লোকে আমার মায়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলে। আচ্ছা আমি ভুল কি বলি বলুন তো। জম্ম থেকে মা আমাকে একা বড় করে তুলেছে তাহলে আমার মা তো সিঙ্গেল মাদারই তাইনা। তাহলে লোকে কেন আমার মায়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলে। আর সেখানে আপনি আপনার পরিবার নিয়ে কতটা সুখে আছেন। সত্যি স্বার্থপররা সবমসময়ই ভালো থাকে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।