মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-০৬

0
595

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৬]

১১,
স্কুল থেকে ফিরার সময় বাজারে যায় সৈয়দা মাহবুবা। অনেকদিন বাসায় ভালোকিছু রান্না হয়না। এতদিন মেয়েদুটো কোন রকমে সিদ্ধ ভাত আর নুডলুস সিদ্ধ খেয়েই দিন পার করেছে। এই মেয়েদুটোকে নিয়ে না পারা গেল না। কতবার বলেছি রান্নটা অন্ততপক্ষে শিখে নাও। আমার কথা কেও কানেই তুলে না। একজন আছে সারাক্ষণ খাতা কলম নিয়ে আর অন্যজনের কথা নাই বললাম। গায়ে জড়ানো শালটা একটু টেনে নিয়ে কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করে নিলেন। কাচা বাজারের কাছে আসতেই তার চোখ পড়লো এক জোড়া কবুতরের বাচ্চার উপর। মেহেরের খুব পছন্দ কবুতরের মাংস। তবে মৌ-টা কবুতরের মাংস একদমই খেতে পারেনা। মৌয়ের জন্যে অন্যকিছুর ব্যাবস্থা করতে হবে। দুইশত চল্লিশ টাকা দিয়ে কবুতরের বাচ্চাদুটো নিয়ে নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। এবার আলু নিতে হবে। মাংতে আলু না দিলে জমে নাকি। আলু দেওয়ার কারন শুধু খাবারকে সুস্বাদু করার জন্যে না। এতে খাবারের পরিমাণও বেড়ে যায়। মৌ-য়ের জন্যে আলাদা করে মুরগীর মাংস কিনে নিলেন তিনি। তারপর কিছু টুকটাক কেনাকাটা করে বাজার থেকে চলেই যাচ্ছিলেন তখন তার চোখ আটকে যায় একটা ফার্মেসির দোকানে। সেখানে সৈয়দ নওশাদ ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে ডক্টরের সাথে কথা বলছে। প্রাক্তন স্বামিকে দেখে কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন সৈয়দা মাহবুবা। নওশাদ দোকানে কেন? কার কি হয়েছে? আচ্ছা ওর মায়ের তো বয়স হয়েছে হয়তো তার জন্যে ঔষুদ কিনতে এনেছে। অধোর কামড়িয়ে সামনে তাকালেন সৈয়দা মাহবুবা।

বিয়ের তিনমাস পর হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পরেন সৈয়দা মাহবুবা। শরীরে জ্বরের পরিমানটা একটু বেশীই ছিলো। কিছু খেতে পারতোনা মাথা ঘুরাতো। কিছু খেলেই বমি বমি ভাব হতো। সবাই ভেবেই নিয়েছিলো মাহবুবা মা হতে চলেছে। তাই জ্বর কমানোর জন্যে কোন রকমের ঔষুদ খেতে দিতো না তাকে। কিন্তু সৈয়দা মাহবুবা তো জানতো সে মা হচ্ছে না। কেননা বিয়ের পর এই তিনমাসে সৈয়দ নওশাদ কখনোও তার সংস্পর্শে আসেন নি। বেশীর ভাগ রাতই তিনি বাড়ির বাহিরে কাটিয়েছেন। বাবার ভয়ে কখনো কখনো বাড়িতে থেকেছেন তিনি কিন্তু মাহবুবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে।কারন এমন কয়লার মতো কালো বউ নিয়ে তিনি সংসার করতে চাননা। সৈয়দ নওশাদ ঠিক করেই নিয়েছেন, এবার তার বাবাকে সবটা বলা উচিৎ। সেদিন রাতে প্রচণ্ড জ্বর ছিলো সৈয়দা মাহবুবার গায়ে। তাই সারাদিন নওশাদ আহমেদকে বাড়িতে থাকতে হয়েছে। সৈয়দ নওশাদের বাবা সেদিন তাকে ডেকে বলেন, বৌমার জ্বর তো কমার বদলে বাড়ছে, ওকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যায়। ডক্টরের পরামর্শ মোতাবেক ঔষুদ খেলে মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ থাকবে। বাবার কথা শুনে সৈয়দ নওশা মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। কারন তিনি তার বাবার সম্মুখে বলতে পারছিলেন না, যে মধ্যে এখনো স্বামি স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠে নি তাহলে বাচ্চা আসবে কোথা থেকেন। বাবার সামনে কিছু না বললেও রুমে এসে সৈয়দা মাহবুবাকে অনেক অপমান করেছেন তিনি। এমন কয়টার মতো বউ নিয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হবেন না। তার মতো এমন ফুটফুটে যুবকের পাশে এমন কয়লার ড্রাম দেখলে সকলে হাসাহাসি করবে। আর তিনি লোক হাসাতে চান না এটাই বলেছিলেন। সৈয়দা মাহবুবা সেদিন নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন। তার গায়ের রং করলো এতে তার দোষটা কোথায়। কেন তাকে গায়ের রং নিয়ে এত কথা শুনতে হয়। আর কেঁদেকেঁদে বলছিলেন তাকেই কেন কালো বানানো হলো। সেদিন রাতে যখন জ্বরে কাপাকাপি করছিলো সৈয়দা মাহবুবা তখন হয়তো সৈয়দ নওশাদের মনে সৈয়দা মাহবুবার জন্যে একটু মায়া জন্মাচ্ছিলো। তাইতো তিনি সৈয়দা মাহবুবার কাছে যান। তিনি সৈয়দা মাহবুবার এতটাই কাছে গিয়েছিলেন যেন নিজের পুরুষত্বটাকে দমিয়ে রাখতে পারেন নি।

শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। হ্যাঁ ভুল ছিলো সব। সব কিছু ভুল ছিলো। তবে তার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিলো না। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। তাইতো আজ তিনি একজন সিঙ্গেল মাদার হলেও সুখী জিবন যাবন করছেন, তবে একটু কঠিন । তার এই জিবন যাপনের পথটা এতটা সহজ ছিলো না। মানুষের লাঞ্ছনা অপমান আর কটু কথা শুনে আজ তিনি এখানে এসেছেন। তবে এটা নিয়ে তার গর্ভ হয়। তারপর লম্বা পা ফেলে সেখান থেকে চলে আসলেন। যে অতীতকে তিনি পিছলে ফেলে এসেছেন তাকে আবার বর্তমানে নিয়ে আসতে চাননা তিনি। কোন পিছুটান নেই। এখন সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। মেয়েদুটোকে মানুষের মানুষ করে একজন বিশ্বাসী মানুষের হাতে তুলে দিতে চান। যারা তার মেয়েদুটোকে সারাজীবন আগলে রাখবে।

১২,
একা মনে বকবক করতে করতে বাড়ি ফিরছে মেহের। রাগ তার এখন সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেছে। কিছুক্ষণ আগে তার দেখা হয়েছিলো সৈয়দ নওশাদ আহমেদের সাথে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও সে মেহেরের সাথে কথা বলতে আসে। কিন্তু মেহের সে এবারও সৈয়দ নওশাদকে উপেক্ষা করে। আর সেখান থেকে চলে আসে। মেহের চলে আসার পর সৈয়দ নওশাদ তার হাতে থাকা মোবাইলের স্কিনে তাকিয়ে মৃদু হাসে। এ যেন প্রাপ্তির হাসি। নিচের দিকে তাকিয়ে বকবক করতে করতে হাটছে মেহের। তখন হঠাৎ করে কারো সাথে ধাক্কা লাগে তার। ঘটনাক্রমে কিছুটা পিছিয়ে যায় মেহের। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই কপাল কুঁচকে ফেলে সে। সাথে রাগও হয় বেশ। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে বুকের উপর হাত ভাজ করে নেয় সে। তার সামনে মূর্তিমানের মতো দাঁড়িয়ে আছে রাহি আর তার মা। মেহেরের এমন চাহনি দেখে রাহি ওর মাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,

– আম্মু এই মেয়েটা আমাকে আজ কলেজে অপমান করেছে। সে নাকি আমার অবস্থা খারাপ করে দিবে।

রাহির কথা শুনে ওর মা এগিয়ে আসে মেহেরের দিকে। তারপর বলে,

– আমাকে চিনো?

– না। কাটকাট জবাব মেহেরের।

– ওই যে সেদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিলো।

– এই শহরে থাকি বেশ কয়েকবছর যাবৎ। ভোর হলে বাসা থেকে বের হই আর সন্ধাবেলা ঘরে ফিয়ে যায়। চলার পথে রোজ কত রকমের মানুষের সাথে দেখা হয়। কেও মুখোশের আড়ালে কেও বাহিরে। কেও আবার পাগল সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। আর কিছু বড়লোক যারা সভ্যতার আড়ালে অসভ্য বর্বর লোক। সবাইকে তো আর মনে রাখা সম্ভব নয়।

– এই মেয়ে কি বলতে চাইছো তুমি?

– আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন। আর রাহি বড়লোক হলেই মানুষ কিন্তু বড় মানুষ হয় না। তোমার আচরনে প্রকাশ পায় তুমি কেমন। তুমি কেমন পরিবারে বড় হয়েছো আর কেমন শিক্ষা পেয়েছো। আমি তোমার সিনিয়র তাই তাই যথার্থ সম্মান ডির্জাব করি তোমার থেকে। আমার উপর তোমার কিসের এত রাগ বলো। কেন আমার পিছনে পরে আছো।

– এই মেয়ে তোমার সাহস হয় কি করে এভাবে কথা বলার। জানো কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো তুমি? রাহির মায়ের কথা শুনে মৃদু হাসলো মেহের। অতঃপর বলল,

– আপনি যেই হোননা কেন তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। আমার মা কি বলে জানেন, মানুষকে অপমান করা যেমন পাপ তেমনি নিজের অপমানও সহ্য করাটাও পাপ। তাই আমি নিজের অপমান মুখ বুজে সহ্যকরি না। কারন এটা আমার মায়ের শিক্ষা।

– কোন মহান ব্যাক্তি তোমার মা?

– অবশ্যই আমার মা মহান। নাহলে সিঙ্গেল মাদার হয়ে আমাদের দুইবোনকে মানুষ করতে পারতো না।

মেহেরের কথা শুনে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো রাহি ও তার মা। রাহির মা তো হাসি থামিয়ে বলে উঠলো, তোমার বাবা মায়ের বিয়ে হয়েছিলো তো? কিন্তু এই কথা গায়ে মাখলো না মেহের। এটা তার সয়ে গেছে। অনেক শুনেছে সে এমন কথা। মৃদু হাসলো মেহের। তারপর বলল,

– যে আমাকে পৃথিবীতে এনেছে তার পরিচয়টা না হয় অজানাই থাক। কারন সেটা জানলে আপনাদের পায়ে তলায় মাটি সরে যাবে। আসি এখন, ভালো থাকবেন।আশাকি আর কোন দিন আপনারা আমার সামনে আসবেন না। চলে যায় মেহের। মেহেরের চলে যাওয়ার পর রাহি রেগে বলে,

– দেখলে তো আম্মু এই মেয়েটা কত বড় বেয়াদব। কিভাবে তোমার সাথে কথা বলল। রাহির কথার কোন জবাব দেয়না তার মা। সে ডুব দিয়েছে তার ভাবনায়।

চলতে চলতে মেহের ভাবে একটা নারীর কথা। এমন একটা নারী যে কিনা সমাজের কাছে পরিত্যাজ্য। রাষ্ট্র যাকে মূল্যা দেয় না। হ্যাঁ এরাইলো সিঙ্গেল মাদার। তাদের সিঙ্গেল মাদার হওয়ার পিছনের কাহিনীটা কেও শুনে না সকলে শুধু মজা নিতে জানে। একজন মা যে কতটা ত্যাগ স্বীকার করে সেটা কেও জানে না। সন্তানের জন্য বাবা-মা দুজনের সাহচর্যই প্রয়োজন। কিন্তু দুজনের সেই কাজটাই একজন সিঙ্গেল মাদার একাই করে চলেছেন হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, সাহসে বুক বেঁধে। তিনি একাই সন্তানের কাছে হয়ে উঠেছেন বাবা-মা দুই-ই। কাজটা ঠিক সার্কাসে দেখা সরু দড়ির ওপর দিয়ে চলার মতোই কঠিন। তাকে একাই কখনো বাবার মতো কঠোর হয়ে শাসন করতে হয়, আবার মায়ের মতো স্নেহ দিয়ে সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিতে হয়। বাবার মতো সন্তানকে চেনাতে হয় বাইরের দুনিয়া। আবার মায়ের মতো পরিবারের ভেতরকার প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হয়, যাতে সন্তানের মধ্যে তৈরি হয় দায়িত্ববোধ। সিঙ্গেল মাদারদের পদে পদে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। সিঙ্গেল মাদারদের প্রতিকূল পথচলা * সন্তানের পিতৃপরিচয় বিব্রত করে সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। কেননা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়, সবখানেই সন্তানের পিতৃপরিচয় তুলে ধরতে হয়। যে মানুষটা কোনো দায়-দায়িত্ব নিলো না, সন্তান মরে গেল নাকি বেঁচে রইল সে নিয়ে যার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তবু তার পরিচয়েই মানুষ করতে হবে সন্তানকে- নির্মম বাস্তবতা! জন্মনিবন্ধনে বাবার নাম চাই, স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় বাবার নাম দাও, ভোটার আইডি কার্ডে বাবার নাম লেখো, চাকরির জন্য তৈরি করা বায়োডাটায়, এমনকি সন্তানের বিয়ের কাবিননামায় অপরিহার্য বাবার নামের সেই মানুষটির পরিচয়। এই নামসর্বস্ব বাবার পরিচয় চিরদিন বহন করে চলতে হয় এমন মায়েদের। এতো কিছুর পরেও আইনি স্বীকৃতি নেই সিঙ্গেল মায়ের। কখনোই তিনি সন্তানের লিগ্যাল অভিভাবক হতে পারবেন না, থাকবেন কেবলেই তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে। একা থাকার পথে বাধা একাকী মায়েরা যখন বাসা ভাড়া নিতে যান, তখন বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই ভাড়া দিতে চান না। এমনকি কেউ কেউ অবমাননাকর মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেন না। হ্যাঁ এটাই হলো আমাদের সমাজ।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।