মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-০৭

0
556

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৭]

১৩,
নিজের রুমে বসেই কাজ করছিলো মেহের। কিছুদিন পর একটা ডিবেট প্রতিযোগীতা আসতে চলেছে তার। তবে এবারের ডিবেটটা হবে একটু অন্যরকম, কৌতূহলী। আঞ্চলিক ভাষার ডিবেট প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ নিতে যাচ্ছে মেহের। যার নাম “আমারাই সেরা”। সেটার উপর ভিত্তি করেই লেখালেখি করে যাচ্ছে মেহের। রাত এখন এগারোটায় ছুঁই ছুঁই। সৈয়দা মাহবুবা ঘুৃমিয়ে গেছেন অনেক আগেই। সারাদিন কাজ করে বেশ ক্লান্ত তিনি। মৌ মেহেরের পাশেই বসে আছে। মৌ-য়ের চোখ মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। সে কিছুক্ষণ মেহেরের পাশে বসছে আবার কিছুক্ষণ পায়চারী করে যাচ্ছে।

– এত ছুটাছুটি কেন করছিস মৌ। যা বলার বলে ফেল। ডাইরি আর কলমটা রেখে মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে বলল মেহের।

মেহেরের কথাশুনে মৌ তার অধোরে হাসি ফুটিয়ে মেহেরের পাশে বসলো।তারপর সে মেহেরের হাত ধরে বলে,

– মেহু, আমার তোর সাহায্যের প্রয়োজন।

মৌ-য়ের কথা শুনে ভ্রুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহের।
– তুই নিজেই একের ভিতরে হাজার। আমি তোকে কিসের হেল্প করবো?

– কাল আমি আমার ড্রিম বয়ের সাথে দেখা করতে যাব। তোকেও আমার সাথে যেতে হবে।

পাগল নাকি। তুই যা-না, এর মধ্যে আমার কেন জড়াচ্ছিস। মৌ-য়ের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো মেহের। আমি এসব কিছুই করতে পারবো না। উঠে দাঁড়ায় মেহের। বিছানায় ফেলেরাখা শালটা নিয়ে চলে যায় বারান্দায়। দু-হাত দুইদিকে প্রসারিত করে উপভোগ করতে থাকে প্রকৃতিকে। মাঘের কুয়াশাচ্ছন্ন চন্দ্রালােকিত গভীর রাত্রি । সমগ্র বিশ্ব দ্রিামগ্ন । কোথাও কোনাে সাড়া নেই। দূর-দিগ্বলয় পানে তাকালে মনে হয় রুপালি জ্যোৎস্নায় কুয়াশার সাদা বসন পরে বৈধব্যবেশী কোনাে নারী দাঁড়িয়ে আছে! রাত্রির নিস্তব্ধতা চৌচির করে দূরে দু’একটি কুকুরের চিৎকার । পূর্ণ চাদের নিথর রাত্রির বুকে মেহের জেগে । একেবারে একা নিঃসঙ্গ অনিকেত । রজতধারায় ঝরনার মতাে চাঁদের রূপ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে। মেহেরের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে । মেহের ক্রমাগত গভীর উপলব্ধির অতলে ডুবে যাচ্ছে। মহাকালের অসীম কালচক্রে এই রাত, এই দুর্লভ সুন্দর মুহূর্ত আর তাে ফিরে আসবে না । আসবে অন্য চাদনি রাত কিন্তু এই রাত তাে চিরতরেই বিগত হবে। বাহিরের শীতল হাওয়া মেহেরের মনটাকেও শীতল করে দিয়েছে। শালটা টেনে ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলো মেহের। মৌ-য়ের কথা মনে পড়তেই রুমে চলে আসে সে। মৌ তখন বিছানায় বসে মোবাইলে স্কলিং করছিলো। মেহেরকে রুমে দেখে মৌ মোবাইলটা রেখে বলে উঠলো,

– এই তুই আমার বোন। বোনের দরকারে যদি নাই এগিয়ে আসিস তাহলে তুই আমার কিসের বোন।

– ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল বন্ধ কর। কখন যেতে হবে সেটা বল আগে।

– তারমানে কাল তুই আমার সাথে যাচ্ছিস?

– না গিয়ে উপায় আছে। সারাদিন তোর ওই গাল ফুলানো দেখার চেয়ে তোর সাথে যাওয়াটাই ভালো।

মেহেরের কথা শুনে মৌ খুশিতে মেহেরকে জড়িয়ে ধরে।

পরেরদিন সকালে মেহের মৌ আর তাদের মা একইসাথে বাসা থেকে বের হয়। সৈয়দা মাহবুবা ওদের সাথে আছেন বলে বেশ বিপত্তিতে পরেছে মৌ। মৌ ভালো করেই জানে সে ওদের কলেজে পৌঁছে দিয়ে তবেই তার স্কুলে যাবে।আর একবার কলেজে ডুকলে বের হওয়াটা মুশকিল। তবে যে করেই হোক মুশকিল আসান করতেই হবে। মৌ-কে আজ যে করেই হোক ওর ড্রিম বয়ের সাথে দেখা করতেই হবে। মৌ- য়ের ভাবনা জুরে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে সে কিকরে তার ড্রিম বয়ের সাথে দেখা করতে যাবে। মেহের হাত শক্তকরে ধরে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পরে মৌ। মেহের মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়। মৌ চোখের ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বলে। সৈয়দা মাহবুবা ওদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,

– রাস্তায় মধ্যে দাঁড়িয়ে পরলি কেন?

– আমি একটু লেডিশ শপে যাবো। তুমি যাও তোমার স্কুলে।তোমার তো লেট হয়ে যাচ্ছে।

– এখন আবার লেডিশ শপে যাবি কি করতে? কলেজ থেকে ফেরার সময় না হয় যাস।

– আমার এখনি দরকার আন্টি তুমি যাও আমরা আসছি। সৈয়দা মাহবুবা আর কোন কথা বাড়ায় না সে চলে যায় তার গন্তব্যে। সৈয়দা মাহবুবার চলে যাওয়ার পর মৌ তার বুকের উপর হাত রেখে বড়বড় করে শ্বাস নয়ে বার কয়েক। তারপর মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– বাঁচালাম। এবার চল।

– কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায় সেটা তো বল?

– সোর্ল পার্ক। সেখানেই আমার ড্রিম বয় আমার সাথে দেখা করবে।

১৪,
সোর্ল পার্কের পূর্ব দিগন্তে যে বড় গাছটা আছে সেই গাছের নিচে বসে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে রাহনাফ। মাথার উপরে থাকা বিশাল গাছটায় বসে আছে নানা রংয়ের পাখি। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে তার খুব একটা ভালো লাগছে না। তিক্ত মনে বসে বসে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে সে। তাতে যদি মনটা একটু ভালো হয়। তার জিবনটাই যে বিষাক্ত। এই বিষাক্ত জিবনে এক টুকরো সুখের আলো হলো মেহের। যাকে দেখলে হাজার বছর বাচতে ইচ্ছে করে রাহনাফের। যার সাথে কথা বলার সময় মনে হয় সময়টা যদি এখানেই থেমে যেতো। সিগারেটটা দুই ঠোঁটের মাঝ বরাবর নিয়ে তাতে দিলো এক টান। এখন একটু শান্তি লাগছে। ধুমপান যে শুধু শরীরের ক্ষতি করে সেটাও কিন্তু নয় অনেক সময় ধুমপান শরীরের অনেক উপকারও করে। বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা তাঁদের মতে, বেশ কিছু রোগে উপকারী ভূমিকা পালন করে ধূমপান। প্রথমেই বিজ্ঞানীরা বলেছেন আলসরেটিভ কোলাইটিসের কথা। এটা পেটের একটি রোগ, মূলত এই রোগে বৃহদন্ত্রে ক্ষত সৃষ্টি হয়। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি যে এই রোগে ধূমপানের রয়েছে ইতিবাচক ভূমিকা। ধুমপানের আরেকটি উপকারী দিক হলো এটা আলঝেইমারস প্রতিরোধক।

মৌ আর মেহের সোর্ল পার্কে প্রবেশ করেই সরাসরি পূর্ব দিগন্তের সেই গাছটার কাছে চলে আসে। গাছের নিচে রাহনাফকে বসা দেখে অবাক হয়ে যায় মেহের। সে রাহনাফকে পা থেকে মাথা অব্ধি অবলোকন করে নিয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৌ-য়ের দিকে। তারপর বলে,

– এটা তোর ড্রিম বয়।

মেহেরের কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই সামনে তাকায় রাহনাফ। তার সামনে মেহেরকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠে রাহনাফ। তৎক্ষণাৎ হাতে থাকে সিগারেট টা ফেলে সেটা পায়ের চাপা দিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ আগেই যেটা মুখে ছিলো এখন সেটাই পায়ের নিচে।

– মেহের আপনি এখানে?

– কেন? এই পার্কের কোথাও কি লেখা আছে “এখানে মেহেরের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

মেহেরের কথায় থতমত খেয়ে যায় রাহনাফ। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটা সব সময়ই রাগ নাকের ডগায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তবে যাই বলিনা না কেন, মেহেরের এই উল্টা স্বভাবের জন্যে রাহনাফের কাছে সে এত প্রিয়। রাহনাফ নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। তারপর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,

– আমি সেটা কখন বললাম।

মেহের কিছু বলবে তার আগেই মৌ বলে,

– দোহাই লাগি মেহু এখান কোন ঝামেলা করিস না।

– হ্যাঁ আপনার বোনকে বুঝান। সবসময় এত ঝগড়া করা ভালো না। একটু মিষ্টি করে কথা বললে কি এমন ক্ষতি হয় শুনি। মিষ্টি করে কথা বলতে পারেন না আপনি। মেহেরকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে মেহের ব্যাঙ্কত্বক হাসি দিয়ে বলল,

– ক্ষতি তো অবশ্যই হবে। আমার মিষ্টি কথা যে শুনবে তারই ডায়াবেটিস হয়ে যাবে।

মেহেরের কথা শুনে চক্ষুদ্বয় বড় বড় রসগোল্লার মতো হয়ে যায় রাহনাফের। রাহনাফের এমন চাহনি দেখে মৃদু হাসে মেহের। তখন ওদের কাছে আসে একজন সুদর্শন যুবক। বয়সতার ছাব্বিশ সাতাইশ হবে। মিষ্টি কালারের শার্টের উপর মেরুন কালারের কোট গায়ে। লম্বামুখ আকৃতির এই সুদর্শন ছেলেকে দেখে মৌ-য়ের মুখ আপনা আপনিই হা হয়ে যায়। ভ্রুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে তাকিয়ে থাকে এই সুদর্শন যুবকের দিকে। মেহের ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকিয়ে থাকে মৌ-য়ের দিকে। কিছুক্ষণ পর সে মৌ-কে একটু নাড়া দিয়ে বলে,

– মুখটা বন্ধকর মৌ। নাহলে শুধু মশা নয় মাছিও ডুকে পরবে।

মৌ তার মুখটা বন্ধকরে মেহেরের দিকে তাকায় একপলক। তারপর আবার সেই যুবকটার দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা হাসি হাসে। যা দেখে যুবকটা তার অধরোষ্ঠ চেপে মলিন হাসি দেয়। এদিকে মেহের আর রাহনাফ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। মেহের বুঝতে পারছেনা এই ছেলেটা কে? আর রাহনাফ বুঝতে পারছে এই ত্যাজি বিড়ালের বোনের সাথে তার বন্ধুর সম্পর্ক কি? কিছুসময় পর রাহনাফ গিয়ে সেই যুবকটার সামনে দাঁড়ায় আর বলে,

– আলিহান তুই ওদের চিনিস?

রাহনাফের কথা শুনে যুবকটা রাহনাফকে জড়িয়ে ধরে। কুশল বিনিময় শেষ হলে সে রাহনাফকে বলে,

– তোকে একটা মেয়ের কথা বলছিলাম মনে আছে। এই মৌ-ই হলো সেই মেয়েটা।

– দোস্ত দুনিয়াতে আর কোন মেয়ে পেলি না। শেষে এই ত্যাজি ইদুরের বোনকেই ভালোবাসতে হলো তোর।

রাহনাফের কথা কানে আসতেই মেহের তেরে আসে ওর দিকে কিন্তু তখনি মৌ মেহেরকে আটকে দেয়। যুবকটা রাহনাফের কাঁধে হাত রেখে মৃদু হাসে তারপর সে মেহেরের দিকে ঘুরে,

– তুমি নিশ্চয় মেহের। হাই আমি আলিহান। মৃদু হাসলো মেহের। তারপর যখন রাহনাফের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয় তখনি নিজের দৃষ্টি শক্ত করে ফেলে মেহের।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

[ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আসসালামু আলাইকুম[