ম্লান সন্ধ্যায় পর্ব-০৮

0
296

#ম্লান_সন্ধ্যায় (০৮)

*
অনিক রুবিনার সাহায্যে কোয়েলিয়াকে আধশোয়া হয়ে বসায়। তালেব ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে ফিরতে ফিরতে অনিকের নির্দেশ অনুযায়ী রুবিনা স্যুপ তৈরি করে এনেছিল।অনিক চেয়ার টেনে পাশেই বসে। কোয়েলিয়া চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে,শ্বাস প্রশ্বাস ধীরে ধীরে চলছে। রুবিনা বারকয়েক ডাকাডাকির পর ও পিটপিট করে তাকালো।অনিক বুঝলো জ্বরের কারণে ওর অস্বস্তি হচ্ছে। রুবিনা ওর মুখের সামনে চামচ ধরলে ও মাথা নাড়ায়। ঠিক তখনই অনিকের ধমক ওর কানে যেতেই পাশ ফিরে তাকালো।জ্বরের ঘোরেও কোয়েলিয়ার বিস্ময়ের শেষ থাকে না। অনিক কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
‘চুপচাপ খেয়ে নেবেন। এখানে বসে আছি, কোনোরূপ ঝামেলা চাচ্ছি না।’
কোয়েলিয়া এরপর আর আপত্তির সুযোগ পায়না।জ্বর মুখে যদিও ওর ভালো লাগছিল না, তবুও অনিকের ধমকে কোনোরকমে অর্ধেকটা খেল।অনিক আর কিছু বলেনি। কারণ বেশি জোরাজুরি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাছাড়া বেশি কথা বলতে ওর ভালোও লাগে না। রুবিনা ঔষধ খাইয়ে দিলে কোয়েলিয়া নিজেই কম্বল টেনে শুয়ে পড়লো।জ্বরের সাথে মাথাব্যথাটা ফ্রি আসে,এটাই সবথেকে অস্বস্তির কারণ। নয়তো জ্বর হলে মানুষ বরঞ্চ খুশিই হতো। কাঁথা কম্বল গায়ে দিয়ে যে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যেত।

কোয়েলিয়ার কাছে সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছিল।স্বপ্ন ছাড়া আর কি। রগচটা মানুষটা ওর কক্ষে এসেছে,এতো অবিশ্বাস্য।যে স্বেচ্ছায় কখনো ওর সাথে কথা বলে না তার উপস্থিতি বিস্ময়কর বটে।ও তাড়াতাড়ি চোখ মেলে তাকায়।অনিক চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রল করছে। তারমানে এটা স্বপ্ন নয়।ও বললো,
‘শুনছেন।’
অনিক মুখ তুলে তাকায়।বলে,
‘জ্বর কি একটু কমেছে? অনেক খারাপ লাগছে?’
কোয়েলিয়া মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,
‘চুলগুলো খুব বিরক্ত করছে। আপনি ড্রেসিং টেবিল থেকে রাবার ব্যান্ডটা এনে দিন।’
অনিক উঠে গিয়ে ব্যান্ড এনে ওর হাতে দিলো। কোয়েলিয়া শোয়া অবস্থায় নিজের চুল ঠিক করে বললো,
‘আপনি কি সত্যিই এখানে আছেন।নাকি এসব আমার স্বপ্ন।’
‘আপনার স্বপ্ন। এখন শুয়ে পড়ুন। আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন।’
‘ঘুম আসছে না।মাথার ভেতর চক্কর দিচ্ছে। একটু বসুন না, কথা বলি।’
‘এখন দয়া করে চোখ বন্ধ করে থাকুন। আমি বাতি নিভিয়ে দিচ্ছি। খারাপ লাগলে আমাকে ডাক দেবেন।’
অনিক ড্রিম লাইট জ্বেলে দিয়ে বাইরে যায়। ইতোমধ্যেই মাথা ধরা শুরু হয়ে গেছে।বুঝলো এখন ওর কি চাই। এমনিতেই সারাদিন আজ ও ছুঁয়েও দেখেনি। দুটো সিগারেট ধরিয়েছিল যা। তালেবকে কল করে ও ড্রয়িংরুমের সোফায় বসল।

শেষ রাতের দিকে কোয়েলিয়ার জ্বর কমলে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল।পাশ ফিরে তাকালে ও মৃদু আলোয় অনিককে চোখ বুজে থাকতে দেখতে পায়।কি সুন্দর ওই মুখখানা! এত সুন্দর লোকটা ওর স্বামী,ওর জন্য বৈধ পুরুষ, ভাবতেই মনজুড়ে রোমাঞ্চকর অনুভূতি খেলে গেল। কোয়েলিয়া উঠে বসলে বুঝলো,জ্বর কমলেও মাথাব্যথা বেশ ভালো ভাবেই লেপ্টে আছে। হাঁটুতে মাথা রেখে ও অপলক অনিকের দিকে তাকিয়ে রইল। সামান্য জ্বর, অথচো লোকটা এভাবে বসে থেকে রাত পার করছে।জ্বর ওর কাছে অতিথির মতো।আসে কয়েকদিন থেকে চলে যায়।তাই বলে ওর জন্য কখনো কেউ রাত জাগেনি, চিন্তিতও হয়নি।আর ও কখনো কাওকে নিজের অসুখবিসুখ সমন্ধে জানাতো না। খুব বেশি কষ্ট হলে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদত। সেখানে এই সামান্য খেয়ালটুকু ওর কাছে বিশাল মনে হলো।ও খুশি হলেও আবেগতাড়িত হয়না।এ লোকের মতিগতির ঠিক নেই।এই সহজ তো এই অভেদ্য।

‘জ্বর কি কমেছে?’
কোয়েলিয়ার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল।ও বললো,
‘আপনি ঘুমাননি।’
‘বোধহয় ঘুম এসেছিল। এখন কেমন লাগছে?’
‘ভালোই। শুধু মাথাব্যথাটা অসহ্য লাগছে।’
‘বিশ্রাম নিন ঠিক হয়ে যাবে।’
কোয়েলিয়ার ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করে, আপনি কি পুরোটা সময় এখানে ছিলেন। কিন্তু করলো না।দেখা গেল,অনিক বিব্রত হয়ে ওকে এড়িয়ে চলবে।ও বললো,
‘আপনি এখন ঘুমাতে যান,প্লিজ।’
‘আপনার কোন সমস্যা হলে, সাথে সাথে জানাবেন।’
‘আচ্ছা জানাবো।’
‘সকালে খাবার খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নেবেন। বাইরে বা ছাদে যাবার দরকার নেই।’
‘বুঝলাম। আপনি এবার নিজের রুমে যান। এমনিতেই কিছুক্ষণ পর ভোর হবে।’
অনিক বেরিয়ে যাবার আগে দরজাটা মিশিয়ে রাখে। সত্যি ওর আজ ঘুম ঘুম পেয়েছে। মেয়েটা মনে হয় আফিম।ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারেনি।

*
আফসার শিকদার বেশ রেগে আছেন। সকাল সকাল খবরটা পেয়ে দ্রুততার সাথে নাজমার নাম্বারে ডায়াল করলেন। অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পর কলটা ধরে, নাজমা সালাম দিলো। আফসার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
‘তুই আবার ও বাড়িতে গিয়েছিলি? আমার মতামতের কোনো মূল্য নেই!’
‘দাদাভাই রেগে যাচ্ছ কেন?শান্ত হও।’
‘এটা কি শান্ত হবার মতো ঘটনা।যেখানে তোর সম্মানহানি করার লোকের অভাব নেই, সেখানে কেন যাস। ওরা তোকে কিছু বলেছে নাকি?
‘না।’
‘সত্যি করে বল। কিছু গোপন করবি না।’
‘সত্যি বলছি। এখন আর মিথ্যে বলে সবকিছু লুকিয়ে রাখার অভ্যাস নেই। তাছাড়া ওরা এখন আমার কেউ না যে মিথ্যে বলে ওদেরকে বাঁচাবো।’
আফসার শিকদার এবার নরম হয়।এই ছোট বোনটি তার বড় আদরের।এখন ও ওর ভালো করে মনে আছে,ওর যখন জন্ম হলো,মেয়ে বলে ওর দাদী ফুফুরা মুখ বাঁকিয়ে ছিল।ঠিক তখনই ওর বাবা ওর কোলে ফুটফুটে নাজমাকে দিয়ে বলেছিলেন,’এটি তোমার ছোট বুবু। কখনো ওকে বকবে না।’
আফসার শিকদার সে কথা রেখেছিলেন।এমনকি নাজমা যখন শফিকুলের সাথে গোপনে বিয়ে করেছিল, তখনো ও কিছু বলেনি। বোনের মুখোমুখি হয়ে ম্লান হেসে বলেছিল,
‘তুই এটা করতে পারলি।’

‘দাদাভাই, তুমি আবার অতীতে ডুবে গেছ তাইনা।’
আফসার শিকদার কিছু বলেনা। নাজমা ফের বলে,
‘আমি স্বেচ্ছায় ওখানে যাইনি। কিন্তু যখন শুনলাম ওনার গুরুতর অবস্থা তখন গেলাম। তুমি রাগ করে থেকো না, শরীর খারাপ হয়ে যাবে।’
‘আমি রেগে নেই।’
‘মিথ্যে বলছো। তুমি এখনও রেগে আছো । দাদাভাই ওরা আগে যা করেছে এখন আর করতে পারবে না। তখন তোমাকে বাঁধা দিয়েছিলাম,তাই ওরা সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। তুমি আর রাগ করে থেকো না।’

আফসার শিকদার কল কেটে দিলো।বোনের পূর্বেকার কথাগুলো মনে পড়লে ওনার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।ওর আদরের বোনটা এতো কষ্টে ছিল, ওরা এতো যন্ত্রণা দিয়েছে ওকে। অথচো ওনার ক্ষমতা প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও, নাজমার মুখ চেয়ে কিছু বলেনি। নাজমার জেদ প্রবল। ভদ্রলোক জানে নাজমাকে কেউ কিছু বলার সাহস পাবে না। কিন্তু ও বাড়িতে নাজমা পা দিয়েছে শুনলেই মাথা গরম হয়ে যায়। ইচ্ছে করে শফিকুলের হাত পা কে’টে আজীবন পাপের শাস্তি ভোগ করাবে। কিন্তু নাজমার জন্য পারেনি।

ভদ্রলোক বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গেলেন। শহরজুড়ে হালকা কুয়াশার আস্তর পড়েছে। ইদানিং শীতটা বেশ ভালোই পড়ছে।একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে গতকাল বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে এসেছিলেন।আজ ফেরার কথা।
তুহিন ভেতরে প্রবেশ করলো। সালাম জানিয়ে বলে,
‘স্যার,৮টা বাজে।৯টার ভিতর বের হবার কথা ছিল‌।’
আফসার শিকদার নিশ্চুপ থাকলেন।বেশ অনেকক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘জীবন এতো জটিল কেন, তুহিন?’
‘জীবন সহজ, কিন্তু আমরা তাকে জটিল করে তুলি।স্যার কি অনিক স্যার কে নিয়ে চিন্তিত।’
‘ওই এক চিন্তাই তো ঘুরপাক খায়। এখন মনে হচ্ছে, অনিকের বিয়ে দেওয়াটা আমার ভুল হয়েছে।’
‘সবকিছুই ঠিকঠাক আছে,স্যার। আপনি শুধু ধৈর্য্য ধরতে পারছেন না। চার বছরের অভ্যাস তো চারদিনে ছেড়ে দেওয়া যায়না।’
‘কি বলতে চাচ্ছো?’
‘যেভাবে চলছে, চলতে দিন।কাল হোক বা পরশু অনিক স্যার কিছুটা হলেও নরম হবে। আপনি তাড়াহুড়ো করলে বরঞ্চ ওনি বিরক্ত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেবেন।’
‘তোমার কথায় আস্থা রাখাই যায়।’
তুহিন মাথা নিচু করে হাসে। আফসার শিকদারের সাথে ও প্রায় তিনবছরের মতো আছে। তুহিন কখনো বিশ্বাস ভাঙা তো দূরে থাক, একটা খারাপ পরামর্শও দেয়নি। এজন্য ভদ্রলোক ওকে স্নেহ করে। শুধু অনিকের বিয়ে নিয়ে যা মতবিরোধ হয়েছিল। তবে তিনি সবার মতামতকে সমান গুরুত্ব দেন। নয়তো তুহিনের সাথে সম্পর্ক মসৃণ হতো না। বললেন,
‘আগামীকাল ফিরবো।আজ চলো পাহাড় দর্শন করি।’

*
সকালবেলা কোয়েলিয়াকে দেখে মনেই হলোনা গতরাতে ওর এতো জ্বর এসেছিল। গায়ে জ্বর থাকা সত্ত্বেও শুয়ে থাকাটা ওর মনঃপুত হলো না। ছোট থেকেই ভোরে উঠে প্রথমেই ওর লাগানো গাছগুলোর তদারকি করার অভ্যাস। কিন্তু এখানে তো আর সে উপায় নেই,তাই প্রথমে ও রান্নাঘরে গেল। রুবিনা ওর জন্য রুটি সেকছিল।অনিক সাধারণত সকালে কফি ছাড়া আর কিছুই খায়না। কোয়েলিয়া এটা ভেবে পায়না,ব্রাশ না করে কফি খেয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়লে কফি খাওয়ার দরকারটা কি! মানুষতো নিজেকে চাঙ্গা করতে চা-কফি পান করে। কিন্তু এলোকের কাছে মনে হয় এটা ঘুমের ঔষধ।

অনিক ঘর অন্ধকার করে ঘুমায়। দরজার সামান্য আলোয় কোয়েলিয়া ভেতরে ঢুকে কফি রেখে অনিককে কয়েকবার ডাকার পর ওর ঘুম ভাঙলো। শোয়া থেকে উঠে বাতি জ্বালিয়ে কোয়েলিয়াকে বেশ কড়া কথা শোনাতে উদ্যত হলেও বললো না। গম্ভীর গলায় বললো,
‘আপনি এত সকালে উঠেছেন কেন?’
‘আমার বেলা করে ওঠার অভ্যাস নেই।’
‘কিন্তু আপনার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। গতরাতে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।’
‘আমার জ্বরের সাথে আপনার ভয়ের কি সম্পর্ক?’
‘আপনার কিছু হলে বাবা আমাকে ভালো রকমের কথা শোনাতো। এজন্যই তো গিয়েছিলাম, বেশি কিছু ভাবার দরকার নেই।’
‘বেশি কিছু ভাবছি আপনি কিভাবে জানলেন?’
অনিক বিব্রত বোধ করলো। কোয়েলিয়া মজার ছলে বললো,
‘আপনার মনে যা ছিল, আমি তাই ভাবছি।’
‘আমার যাওয়াই উচিত হয়নি। আপনি মরে গেলেও আমি আর যাবো না।’
কোয়েলিয়া বুঝলো অনিক রেগে গেছে।ও হাসলো ,বললো,
‘আমি অনেকদিন বাঁচতে চাই। ধরুন একশো বছর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৌয়ের আগে স্বামী মরে যায়। তারমানে আমার মৃত্যুতে আপনি উপস্থিত থাকতে পারবেন না ।’
‘আপনি এখান থেকে যান। আমার রাগ বেড়ে যাচ্ছে।’
‘রাগ বাড়িয়ে লাভ নেই।কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, ওদিকে মনোযোগ দিন।’
কোয়েলিয়া হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। কোন কারণ ছাড়াই ওর মনটা আজ ভালো।ডানা মেলে ওড়া প্রজাপতির মতো ওর মনটা ফুরফুরে।

*
আজ সারাদিন সূর্য্যিমামা নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল। বিকেলের দিকে কিছুক্ষণের জন্য দেখা দিয়ে আবার আড়াল হলো।অনিক বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন মূহুর্তে কোয়েলিয়া ওর কক্ষের সামনে এসে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইল।অনিক সম্মতি দিলে ও ভেতরে প্রবেশ করলো। বললো,
‘আপনি বাইরে যাচ্ছেন? আমি ভাবলাম বিকেলটা আপনার সাথে কথা বলে কাটাই।’
‘আমাকে যেতে হচ্ছে। দুঃখিত।’
‘যাওয়াটা কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।মানে কেউ অপেক্ষা করছে?’
‘সেরকম কিছু না।’
‘তাহলে আজ যাবেন না। চলুন ছাদে গিয়ে বসি।’

কোয়েলিয়া বেশ সাহস করেই কথাটা বলে ফেললো।তবে ও নিশ্চিত অনিক যাবে না। অন্ততঃ এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এ ধারণা সহজেই অনুমেয়। অনিকের দিক থেকে প্রত্যাখান বাণী আসলো না। বরঞ্চ বললো,
‘এই কথাটা কি বাবা বা মণির দেওয়া দায়িত্ব থেকে বলছেন?’
‘আমি নিজের থেকেই চাচ্ছি।একা একা সময় কাটছে না।’
অনিক অনেকক্ষণ চুপ থাকলো। কোয়েলিয়া ধরেই নিলো,অনিক প্রস্তাব নাকচ করবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে অনিক বললো,
‘চলুন বাইরে থেকেই বেড়িয়ে আসি। আপনি তৈরি হয়ে আসুন, আমি বাইরে আছি। তবে মাত্র দশ মিনিট।’

কোয়েলিয়া অবশ্য দশ মিনিটের বেশি সময় নিয়ে তৈরি হলো।হালকা সবুজ-সাদায় মেশানো শাড়ি পড়লো।কালো চোখযুগল কাজলে এঁকে,মাঝখানে সিঁথি কেটে চুলগুলো খোপা করে কাটা গুজলো। কপালের সামনে ছোট ছোট কয়েকটা চুল বেরিয়ে থাকায়, অনেকটা সাদা-কালো যুগের সূচিত্রা সেন মনে হচ্ছিল।যদিও সূচিত্রা সেন ওর মতো কালো ছিল না, এমনকি ভ্রুযুগল ও এতোটা পুরু ছিল না।

অনিকের কাছে অপেক্ষা করাটা বিরক্তের এবং কোয়েলিয়ার দেরি করাটা ওর কাছে ইচ্ছাকৃত মনে হলে বিরক্তির শেষ রইল না। তবে কোয়েলিয়াকে দেখা মাত্রই ওর সমস্ত রাগ কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। কিন্তু ও বেশিক্ষণ তাকালো না।নারী বড় ভয়ঙ্কর।এরা যেমন ভালোবাসে, তেমনি ভেঙেচুরে বিধ্বস্ত করে দেয়।

শহরজুড়ে বিকেল নেমেছে। কর্মব্যস্ত মানুষদের ঘরে ফেরার তাগাদায় রাস্তায় সীমিত আকারে যানজট লেগে আছে। অনিকের বিরক্ত হবার কথা ছিল। কিন্তু ও বিরক্ত হতে পারলো না। আজকে অসময়ে নিয়ম বিহীন সময় কাটাতে ওর ভালো লাগছে।গাড়ি চলতে শুরু করলে, কোয়েলিয়া প্রশ্ন করলো,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘সিওর জানি না। যেখানটায় ভালো লাগবে, ওখানে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটাবো।’
‘আর যদি কোথাও ভালো না লাগে।’
‘ড্রাইভ করতে থাকবো।যেখানে গিয়ে পৌঁছাই। তবে ভয় নেই, গাড়িতে লাগানো জিপিএস হারিয়ে যেতে দেবে না।’
‘হারিয়ে যাবার ভয় পাচ্ছি না। আপনার মেজাজ কতক্ষন ভালো থাকবে সেই চিন্তা করছি।’
‘একেবারে ভুল বলেননি। আমি নিজেও বুঝতে পারিনা,কেন হঠাৎ রেগে যাই।’
‘সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিতে পারেন।’
‘বেশি কথা বলা এবং শোনা কোনোটাই আমার পছন্দ না।’
‘তাহলে বোধহয় আমার চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়।’

অনিক কিছু বললো না।ওর মনোযোগ সামনে। কোয়েলিয়া হতাশ হয়ে বাইরে তাকালো।মৃদু হাওয়ায় ও রাস্তার আশপাশ দেখতে শুরু করলো। পার্কের সামনে বহু মানুষের আনাগোনা।অনিক এখানে কখনোই ঢুকবে না।বদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে ও নির্জনতাকেই ভালোবেসে ফেলেছে।

‘এভাবে চুপ করে থাকলে ঘুরতে বেরোনোর কি দরকার ছিল? আমি তখন সাইকোলজিস্টের বকবকানির কথা বলেছিলাম। আপনাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলিনি।’
কোয়েলিয়া চকিতেই অনিকের দিকে তাকায়। মুখখানা গম্ভীর হয়ে আছে।এই লোকটা ওকে বারবার কিছু একটা বলে বা করে চমকে দেয়। কোয়েলিয়া বললো,
‘ রবীন্দ্রনাথ যদি আপনাকে দেখতো, তাহলে লিখতো জগতে কিছু পুরুষদের মন বোঝার সাধ্য নারীর নেই।’
অনিকের মুখ স্বাভাবিক দেখালো।ও বললো,
‘কি বোঝাতে চাচ্ছেন?’
‘আপনার মনে কখন কি চলে , এখন অব্দি বুঝতে পারলাম না।’
‘আপনি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছেন?’
‘করলে ক্ষতি কি!’
‘একাজ করার চেষ্টাও করবেন না। দুঃখ পেতে হবে।’
‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় কষ্ট পেতে আমার আপত্তি নেই।’

অনিক কোয়েলিয়ার দিকে তাকালো। গাড়ির হাওয়ায় ওর কপালে চুলগুলো খেলা করছে।এ মেয়ে কি শেষমেশ ওকে ফাঁসিয়ে দেবে?নিজের কাঠিন্যের খোলস ফেটে যাবে জেনেও,জেনেশুনে তো নিজেই ওকে কাছে টেনে আনলো।এতো রীতিমতো স্বেচ্ছায় বি’ষ পান করা।ও কি তবে এই নারীর কাছে শেষমেশ হেরে যাবে?

চলবে..
®️ সুমি খানম