যদি তুমি চাও পর্ব-০২

0
768

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

২.
অতীতের পাতা গুলো অন্তির চোখের সামনে ভাসতে থাকে। প্রত্যেকটি পাতায় আছে এক একটি দিন আর সেই দিনগুলোতে রয়েছে একেকটি ভালোলাগার মুহুর্তে আবার কোনো কোনো দিন সেই মুহুর্তের সংখ্যা বেড়েছে। অন্তির কাছে তো সেই মুহুর্তই ভালো লাগার মুহুর্ত বলে গন্য হতো যেই মুহুর্তে নিহাল তার পাশে থাকতো। শুরুটা খুব ভালোভাবে না হলেও ধীরে ধীরে সবটা ঠিক হতে থাকে একটা সময় নিহাল অন্তির মনের বিষেশ জায়গাটা দখল করে নেয়।

সেদিন ছিল বৃষ্টির দিন। বৃষ্টির মাঝে কলেজে আসতে পারেনি ছায়া, অন্তির আসতে অসুবিধে হয়নি কারণ ওর বাড়িতে চার চারটে গাড়ি সাথে ড্রাইভার রয়েছে। ও যখন এসে দেখলো ছায়া আসেনি তখন একটু মন খারাপ হয়েছিল বটে তবে ওদেরই আরেকজন কমন ফ্রেন্ড রিধি সেইদিন উপস্থিত ছিল। রিধির সাথে ছায়া ও অন্তির সম্পর্কটা ভালো হলেও ওদের দুজনের একে অপরের সাথে বন্ডিংটা ছিল বেশ দৃঢ়। ফ্রেন্ডশীপ হলে এমনই হওয়া উচিত বলে ওদের ক্লাসের কিছু স্টুডেন্টদের বক্তব্য। সেদিন এমনিতেই ছায়া আসেনি তাই অন্তির মনটা খারাপ ছিল তবে রিধির মন ছিল আরও খারাপ। অন্তি খেয়াল করেছিল সেটা। সে প্রশ্ন করে,
-কীরে মন খারাপ করে রেখেছিস কেনো?
সে একবার অন্তির দিকে দেখে নিরাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
-দোস্ত আজকের তারিখটা কী কেউ দেখেনি?
-কেনো বল তো!
-আজকে ক’তারিখ সেটা বল আগে।
-আজ তো…..
এইটুকু বলেই অন্তি থেকে যায় তারপর রিধিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
-হ্যাপি বার্থডে দোস্ত।
রিধি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
-রাখ এখন আর এসব ঢং করতে হবে না।
-আহা দোস্ত রাগ করিস কেনো? এই দেখ..
বলে অন্তি নিজের কান ধরে ওকে সরি বলে। রিধি হেসে দেয় তারপর নিজের মুখভঙ্গি শক্ত করে বলে,
-সরি গ্রহণ করবো তবে আমার একটা শর্ত আছে।
-কী শর্ত?
-আজ তুই আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবি।
-কিন্তু …
-আরে কোনো পার্টি নেই আজ। মা-বাবা, ভাইয়া কারোরই মনে নেই আজকের কথা তাই তুই গিয়ে তাদের মনে করিয়ে দিবি। আসলে নিজের জন্মদিন নিজে গিয়ে মনে করালে কেমন দেখায় তো তাই তোর থেকে হেল্প চাইছি দোস্ত। দেখ আমার জন্য এইটুকু করে দে।
-হয়েছে হয়েছে আর কিছু বলতে হবে না। আমি যাবো তোর সাথে তবে বেশি সময় দিতে পারবো না। বাড়ি ফিরতে হবে আমায়। নয়তো মা রেগে যাবেন।
-ঠিক আছে বাবা। সে তুই আমার বাড়ি গিয়ে একবার তাদের মনে করিয়ে দিয়ে এসে পড়িস।
-আচ্ছা, এখন ক্লাসে মন দে।
ক্লাস তো চলছিল তবে ক্লাসের ফাঁকে একটু পর পরই রিধি অন্তিকে বলছিল ‘লাভ ইউ দোস্ত’। একই কথা বার বার শুনে অন্তির কান পেকে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল।

রিধি আর অন্তি বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র খেয়াল করে কিছু একটা অস্বাভাবিক রয়েছে এখানে। কেউ নেই আবার বাড়িটাও অন্ধকার। লোডশেডিং হলেও তো ক্যান্ডেল বা চার্জার ল্যাম্প কিছু একটা জ্বালানো হতো কিন্তু সেটাও নেই। বাড়িতে কেউ নেই নাকি! থাকলে তো এমন অন্ধকার হয়ে থাকতো না বাড়িটা। ভাবতে ভাবতে একটা শব্দ হয় আর সেই শব্দের সাথেই কিছু রঙ বেরঙের কাগজ উড়ে আসে। আলোও জ্বলে ওঠে। রিধির বাবা-মা, ভাই আরও কয়েকজন উপস্থিত সেখানে। তাদেরই মধ্যে একজন সকলকে পিছনে ফেলে এসে অন্তির সামনে দাঁড়ায় আর বলে,
-হেই বার্থডে গার্ল, সারপ্রাইজ কেমন হয়েছে?
রিধি পাশ থেকে বলে,
-এই যে ভাইয়া শুনুন।
ছেলেটি রিধির দিকে তাকায় এরপর রিধি বলে,
-বার্থডে গার্ল আমি ও নয়। ও আমার ফ্রেন্ড।
-ওহ সরি। আমার মিস্টেক।
তারপর রিধির দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
-শুভ জন্মদিন।
পেছন থেকে এগিয়ে আসে রিধির ভাই রুহান। সে এসে বলে,
-অন্তি কিছু মনে করো না। আসলে ও আমার চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড বুঝলে তো আমরা ফোর্থ ক্লাস অবধি একসাথে ছিলাম তারপর ওর বাবার ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ায় ওকে চলে যেতে হয়। কিছুদিন আগেই ফিরেছে, এসেই আমার সাথে যোগাযোগ করে। ইভেন রিধির এই সারপ্রাইজ পার্টির আইডিয়াটাও ওরই ছিল কিন্তু আফসোস মিস্টেকটাও ওই করলো। আসলে ও কখনো রিধি’কে দেখেনি তাই এমন হয়েছে।
ছেলেটি রুহানকে থামিয়ে বলে,
-ধুর ব্যাডা, মিস্টেক আমি করসি না? তো এক্সপ্লেইন আমারে করতে দে।
-হয়েছে পরে এক্সপ্লেইন করিস এখন আয় আগে রিধি কেক কাটবে।
এই কথা শুনে রিধি বলে,
-গিভ মি ফিফটীন মিনিটস ভাইয়া।
-কেনো?
-আমি সারাদিন এই পোশাকেই আছি এখন কেক কাটবো, ছবি ওঠানো হবে আর আমাকে কিনা এমন দেখাবে এইটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না ভাইয়া।
-আচ্ছা যা দিলাম তোকে ফিফটীন মিনিটস।
রিধি চেঞ্জ করতে সবার পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। অন্তি এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, ঘড়ি দেখছে সে। মা হয়তো চিন্তা করবে। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে সে। বন্ধ রেখেছিল ফোন। অন করতেই অনেকগুলো মিসডকল দেখতে পায়। মায়ের নম্বর থেকে এসেছে সবগুলো। মা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে খুব। কিন্তু এখানে এতো শোর তার উপর লাউডস্পিকারও চলছে তাই কল করলো না ও। একটা ছোট্ট টেক্সট করে দিলো আর তাতে সংক্ষেপে নিজের অবস্থান উল্লেখ করে দিলো। ফোন ব্যাগে রাখতেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো সেই ছেলেটি যে তাকে রিধি ভেবে উইশ করতে এসেছিল। ছেলেটি বললো,
-অন্তি রাইট?
-জি, সকলে সেই নামেই ডাকে।
ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-আমি নিহাল।
অন্তিও হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,
-আমি অন্তি, অন্তরা খান।
-অন্তরা… উমম… নাইস নেইম।
-থ্যাংকস।
-আমি আসলে সরি বলতে চাইছিলাম।
-ইট’স ওকে। রুহান ভাইয়া তো সবটা বললেন আমি বুঝেছি। আগে উইশ করতে এসে আপনি গর্তে পড়ে গেছেন।
-মজা নিচ্ছো?
-কোথায়?
-পরে দেখাবো মজা।
-কী করে?
-দেখা তো হবে তাই না, তখন।
-আপনি প্রথম পরিচয়েই পরবর্তী মিটিং ফিক্স করতে চাইছেন তাও আবার ইনডিরেক্টলি! নাইস এটেমপ্ট বাট আমি চাইবো আমাদের যেনো আর কখনো দেখা না হয়।
এই বলে অন্তি যখন এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন নিহাল বলে,
-ভয় পাচ্ছো?
-কীসের ভয়?
ফিরে দেখে প্রশ্ন করে অন্তি। নিহাল এগিয়ে এসে উত্তরে বলে,
-আমার মতো একজন গুডলুকিং হ্যান্ডসাম ছেলে তার সাথে বার বার দেখা করতে থাকলে যদি প্রেমে পড়ে যাও।
-কোনো সুযোগ নেই।
-কেনো, কেউ আছে বুঝি?
-না নেই। আসলে আমার প্রেমে পড়া বারন।
-প্রেমিক না থাকলে প্রেমে পড়া বারন হবে কেনো?
-প্রেমিক নেই তবে মা তো আছে। আমি মনে করে পরিবরের বিশ্বাসটা ওই একটা জায়গায় সব থেকে দৃঢ় হয়। একটা মেয়ে হয়ে জন্মানোটা ছেলে হয়ে জন্ম নেওয়ার থেকে কোনো অংশে কম নয়। ছোট থাকলে সবকিছু ঠিক থাকে তবে বড় হওয়ার সাথে সাথে দ্বায়িত্বও এসে জমা হয়।
-ওকে ওকে কুল। আমি জাস্ট একটু কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম আর আপনি তো…. যাই হোক আমিই চাইবো না আর কখনো আমাদের দেখা হোক।
-দেন এটা আপনার জন্যই বেটার।
-হুমকি দিচ্ছো?
-না, সে আমি পারি না।
-আচ্ছা, চলো যাই ওই তো রিধি এসে গেছে।
-চলুন।

আমরা চাইলেই কী আর সব সম্ভব হয়? না, হতে তো সেটাই যা হওয়ার আছে। চলতি পথে একদিন আবারও দেখা হয় নিহাল অন্তির। অন্তি দাঁড়িয়ে ছিল অটো নেবে বাড়ি ফিরবে বলে। মাঝপথে হঠাৎ তার ড্রাইভারের কাছে ফোন আসে যে উনার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। অন্তির পথ একদিকে আর ড্রাইভারের পথ অন্যদিকে তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় আগে অন্তিকে ছেড়ে আসবে তারপর বাড়ি ফিরবে কিন্তু রাস্তায় অন্তি খেয়াল করে ড্রাইভারের চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। সেই ফোন কল আসার আগে অবধি সবকিছু ঠিকই ছিল। অর্থাৎ যা ঘটার ওই ফোন কলের কারণেই ঘটেছে। সে বলে,
-দাদা।
-কিছু বলছেন ম্যাডাম?
-গাড়ি টা সাইড করে থামান।
ড্রাইভার গাড়ি থামায়। অন্তির কাছে এই ম্যাডাম ডাকটা অসহ্য লাগে। এই মানুষটা কম করে হলেও তার থেকে পনেরো বছরের বড় হবেন আর ইনি তাকে ম্যাডাম ডাকেন। তবুও অন্তির কিছু করার নেই, অন্তির মা রুবির অর্ডার কোনো স্টাফই যেনো তার ছেলে-মেয়েকে স্যার/ম্যাডাম ছাড়া সম্বোধন না করে। মায়ের কথার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলতে পারে না অন্তি তবুও খারাপ লাগাটা মনেই রয়ে যায়।

গাড়ি থামতেই অন্তি নিজের পাশে সীটে রাখা পানির বোতলটা ড্রাইভারকে দিয়ে বলে,
-এই নিন পানিটা খান।
ড্রাইভারের ওইসময় এই পানির খুব প্রয়োজন ছিল সে কথা না বাড়িয়ে পানি খেয়ে তারপর বলে,
-ম্যাডাম, এখানে কোনো কাজ আছে আপনার?
-না।
-তবে দেরি না করে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
-কিছু হয়েছে?
-তেমন কিছু হয়নি।
ড্রাইভার মিথ্যে বলছে তার মাথাটা নিচু করে রাখা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অন্তি বলে,
-দাদা আপনার কপালে চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে কী হয়েছে আমায় বলা যাবে?
-আমার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ ম্যাডাম।
-তবে আপনি আমায় এখানে নামিয়ে দিন আর গাড়ি নিয়ে যান তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে পারবেন।
ড্রাইভারের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অন্তি বলে,
-আপনি চিন্তা করবেন না। মা’কে আমি সামলে নেবো।
-কিন্তু…
-কোনো কিন্তু নয়। আমি এমনিতেও ড্রাইভিং জানি না তার উপর আমার সেই বয়স হয়নি যে লাইসেন্স পেয়ে যাব তাই শিখিওনি। এখন কী গাড়ি মাঝ রাস্তায় ফেলে রাখবো? এর চেয়ে ভালো নয় কী যে গাড়িটা কারো কাজে লাগলো।
ড্রাইভারকে কথা বাড়াতে না দিয়ে অন্তি নেমে যায় আর এরপর থেকেই অপেক্ষা করছে সে খালি অটো বা রিক্সা পেলেই উঠে পড়বে, তখনই নিহাল আসে সামনে। সে বাইকে বসে ছিল। অন্তির বুঝতে অসুবিধে হয় না এই ছেলে এই রাস্তা দিয়েই বাইকে করে যাচ্ছিলো ওকে দেখেই থেমেছে।

চলবে……..