যদি তুমি চাও পর্ব-৩১+৩২ এবং শেষ পর্ব

0
1139

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

৩১.
-আমি তোমার কাছে এমন কিছু আশা করিনি মা।
রুবি চোখ বুঁজে কপালে হাত রেখে শুয়ে ছিলেন এমন সময় রাফিদের আওয়াজ শুনে হাত সরিয়ে চোখ মেলে দেখেন। রাফিদ রেগে আছে মনে হচ্ছে। রুবি বললেন,
-কী হয়েছে রাফিদ? কিছু বলবে?
-কী হয়েছে, সত্যিই মা! তুমি কিছুই জানো না!
-এমন হেয়ালি না করে যা বলবে ক্লিয়ার করে বলো।
রাফিদের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে পারে না কিছু একটা করে ফেলে। মা-বাবা হলো সন্তানের প্রথম শিক্ষক সেখানে তার মায়ের কাছে কী শিখবে সে? প্রতারণা নাকি লোভী হওয়া। রাফিদ এগিয়ে গিয়ে বলে,
-মা আমি বিশ্বাস করি তুমি আমাকে আর অন্তিকে খুব ভালোবাসো এবং আমাদের জন্যই সারাদিন পরিশ্রম করে কাটিয়ে দাও। আমি মানছি তুমি চাও না তোমার পরিশ্রমের ফল অন্যকেউ ভোগ করুক তাই বলে এতোটা নিচে নেমে যাবে তুমি! জাস্ট ফর্টি পার্সেন্টই তো ছিল তার কাছে বাকি সিক্সটি পার্সেন্টের পুরোটাই তো আমাদের ছিল এরপরেও তুমি সন্তষ্ট নও। কেনো মা? তুমি তুমি যদি টাকার পেছনে না ছুঁটে, আমাদের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বর্তমানটাকে সুন্দর করার চেষ্টা করতে তবে আমরা কতোটা হ্যাপি থাকতাম বলো তো। বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় তুমি তার সাথে কাজ করতে তখন একটু হলেও আমাদের সময় দিতে কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পরে তুমি তো পুরোপুরিই কাজের মাঝে ডুবে গেলে এমনকি আমাদের সময় দেওয়ার কথাটাও মাথায় রাখলে না। হ্যা, মানছি জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য টাকার প্রয়োজন পড়ে কিন্তু সেটারও সীমিত একটা রেখা থাকে। তোমার কী মনে হয় তুমি আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দিচ্ছো? না মা। এমনটা নয়। উল্টো তুমি আমাদের কুড়ে বানিয়ে ফেলছো। তুমি জানো তোমার এই ছেলেটা কতটা নীচে নেমে গিয়েছিল….
রাফিদ নিজের অতীতে ডুব দিতেই মাথা নেড়ে সেটা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে বলে,
-উফফফ, ভাবতেই কেমন লাগছে আমার। ক’দিন বাদে হয়তো ড্রাগস নেওয়া শুরু করে দিতাম।
-রাফিদ।
চিৎকার করে উঠেন রুবি। রাফিদ বলে,
-রিল্যাক্স মা, এমন কিছুই হয়নি। তবে হতে পারতো যদি তোমার সেই শত্রু অবশ্যই তোমার ভাষ্যমতে শত্রু কিন্তু আমি তার মাঝে বড়ো ভাইয়ের ছায়া দেখেছি। আজ উনি আমার জন্য যা করেছেন না সেটা একমাত্র বাবাই করতেন অন্য কেউ নয়। মা ওই লোকটা তোমার কাছে অন্তিকে ছাড়ার শর্ত রেখেছিল আমাদের প্রপার্টি তার নামে করে দেওয়ার, সেটাতে তুমি রাজি হলে না এরপর উনি যখন বললেন তোমার টা তোমারই থাকবে উল্টো তার অংশটুকুও তোমার নামে করে দেবে তখন তুমি রাজি হয়ে গেলে! ওয়াও, গ্রেইট মা। তুমি মহান। মেয়েকে একজন স্ট্রেঞ্জারের হাতে তুলে দিতে তুমি রাজি হয়ে গেলে।
রুবি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কথা নেই তার মুখে। রাফিদ বলে,
-অন্তি তোমার মেয়ে মা, তার সাথে এমনটা করার জন্য তুমি ফট করে রাজি হয়ে গেলে! কেনো মা?
-তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য। আর অন্তি দু’দিন বাদে ওকেও ওইখান থেকে বের করে আনার কথা ছিল আমার এমনকি আমি এনেওছিলাম। দেরি হয়েছিল মানছি আমি তারপরেও এনেছিলাম, সে নিজেই নিজের পায়ে কুড়োল বসালে আমার কী করার?
-ওসব কথা এখনও আসেনি মা। এখন বলো তো তুমি আমাকে বা অন্তিকে সত্যটা না বলে আরও একটা নাটক কেনো সাজালে?
মায়ের কাছে রাফিদ কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও বললো,
-অন্তির বদলে তোমার হাতে প্রপার্টির বাকি শেয়ারটুকুও এসে যাবে সেটা না বলে তুমি বললে লোকটা নিহালকে কিডন্যাপ করে রেখেছে যেখানে সত্য তো এটাই যে নিহালকে তুমি সরিয়েছিলে। একদিক দিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে, অন্তি নিহাল নামক সেই জানোয়ারটার সাথে বাঁধা না পড়ে আবিরের মতো ভালো মনের একজনকে পেয়েছে। এরজন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
রুবির মাথায় এই মুহুর্তে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তবে মুখ ফুটে বলতে পারছে না। বিষয়টা রাফিদ বুঝলো এবং বললো,
-কী ভাবছো, আমি এসব জানতে পারলাম কী করে সেইটা? তুমি যেই ডিলটা করেছিলে সেটার রেকর্ডিং দেখেছি আমি। লোকটা আমায় বলেছিল, “চল তোকে মুভি দেখাই।” তার কথা শুনে বিরক্ত হয়েছিলাম বটে কিন্তু সেই মুভিটা দেখে আমার মায়ের এই রূপটা জানার সুযোগ হয়ে গিয়েছিল বলে কৃতজ্ঞও ছিলাম ইভেন এখনও আছি।
রাফিদ চুপ করে যায়। তার চোখ এই মুহুর্তে সামনের টি টেবিলের উপর ঢেকে রাখা জুসের গ্লাসের দিকে। জুসটা অনেক আগেই আনা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে কারণ গায়ে বিন্দু মাত্র পানি নেই। রুবি সবসময় বরফ দিয়ে জুস পান করেন তাই রাফিদ সিওর হলো যেহেতু গ্লাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি লেগে নেই সেহেতু জুসটা গরম গয়ে গেছে। এটা তার মা আর খাবেন না এদিকে তারও গলাটা ভেজানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তাই কিছু না বলেই জুসটা শেষ করে আবারও মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো সে।
-মা, তুমি তো নিহাল সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছিলে তাই না? তাহলে তোমার ইনফরমেশনে এতোটা ভুল হলো কী করে বলো তো?
-তুমি কী আমায় সন্দেহ করছো রাফিদ?
-না না, তা কেনো করবো! ইভেন অন্তিও তোমায় সন্দেহ না করে মনে করছে তোমার কাছে ইনফরমেশন ভুল দেওয়া হয়েছিল। আমারও তাই মনে হয় আর যাই হয়ে যাক না তুমি অন্তির এতো বড়ো ক্ষতি করার কথা ভাবতেও পারো না।
রুবি এইটুকু ভেবে স্বস্তি পেলেন যে এই বিষয়টাতে তার ছেলে তাকে অবিশ্বাস করেনি।
-এতোটাও খুশি হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি মা। অন্তি এখন আবিরের সাথে থাকলেও সেই সময়ের পরিস্থিতিটা ভুলে যায়নি সে। এখন যদি তুমি এসব বিষয়ে আর নাক গলাও বা ভাইয়ার কাছে তার অংশ চাও তবে সেটা খুব খারাপ হয়ে যাবে, আমি গিয়ে অন্তিকে সবকিছু জানিয়ে দেবো।
-ভাইয়া কাকে বললে?
-মিস্টার খানকে। উনিই বলেছেন উনি আমাদের ভাই।
-আর কী বলেছে?
-আমাদের পরিবারের অতীত নিয়ে বলেছেন।
-কী বলেছে?
-এই যে বাবা আর উনার বাবা দুইজন কাজিন ছিলেন আর দু’জনে মিলেই এই বিসনেসটা শুরু করেন। বিজনেসে লাভ হতে শুরু করলে তুমি মাঝখানে ঢুকে বাবা আর তার বাবার মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করো এরপর উনি বিজনেস ছাড়তে বাধ্য হোন। তবে বাবার মাঝে সবসময় একটা গিল্ট কাজ করতো চাচ্চু আর চাচির মৃত্যুর পর থেকে আর তাই উনি ভাইয়ার নামে ফর্টি পার্সেন্ট শেয়ার লিখে দেন। যেটা তোমার হজম হয়নি। এখন বুঝতে পারছি কেনো হয়নি, উনি তো অন্যের ছেলে ছিলেন। যেখানে প্রপাটির কথা ভেবে তুমি তোমার নিজের মেয়েকেই ছাড় দাওনি সেখানে তাকে কী করে ছাড় দিতে? তোমার আর তার মাঝে পার্থক্য কী জানো মা? তুমি নিজের মা হয়ে ছেলে-মেয়ের কথা ভাবোনি সেখানে উনি বদলা নিতে এসেও আমাকে আর অন্তিকে ভাই বোন ভেবে সেখান থেকে সরে গেছেন। প্লিজ মা, এইবার অন্তত তুমি বিজনেস ওম্যান এর পরদ ছেড়ে আমাদের মা’কে বের করে আনো।
রুবি চুপ করেই রইলেন তা দেখে রাফিদের আর সেখানে থাকার ইচ্ছে হলো না। সে চলে গেল।

ছায়া এই মুহুর্তে বসে আছে মেঘের ঘরে তারই খাটের উপর। বিয়েটা হয়ে গেছে ঠিকই তবে ওই নামটা দেখার পর থেকে ছায়ার মাঝে অস্তিরতা কাজ করছে অনেক বেশি। সে ভেবে পাচ্ছে না আসলে কী হচ্ছে তার সাথে! এই সেই ব্যক্তি যাকে প্রেমের জালে ফাঁসানোর প্ল্যান করেছিল ছায়া আর উল্টো তারই প্রেমে পড়ে গেল সে! অন্তি জানলে কী হবে? হয়তো বন্ধুত্ব শেষ করে দেবে কিন্তু অন্তির তো জানাটা প্রয়োজন। দরজা লাগানোর আওয়াজে ছায়া নড়েচড়ে বসে। মেঘ এগিয়ে আসছে তার দিকে। এই দৃশ্য কতবার কল্পনা করেছে তার হিসাব নেই তবে আজ যখন বাস্তবে ঘটছে তখন তার চেহারায় কল্পনার মতো লজ্জা ভাব নেই আছে রাগী ভাব। মেঘ সেটা খেয়া না করেই এসে বসে ছায়ার পাশে আর বলে,
-আসার সময় একটাও কথা বললে না আবার এখনও চুপচাপ বসে আছো, ব্যপারটা কী?
ছায়া কিছু না বলে মেঘকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার গলা চেপে ধরে বলে,
-তোমাকে আমি মেরেই ফেলবো। তুমি আমায় আগে কেনো বলোনি তুমি সেই ব্যক্তি যে আমার বেস্টফ্রেন্ডকে এতোটা কষ্ট দিয়েছে।
মেঘ কাশতে কাশতে বলে,
-আগে ছাড়ো তারপর বলছি।
ছায়া ছেড়ে দিয়ে পাশে সরে বসে কিন্তু মেঘ শুয়েই থাকে। মেঘ ছায়ার কাছে প্রশ্ন করে,
-তুমি কী অন্তরাকে বলেছো এই বিষয়ে?
-বলতাম কিন্তু আমার মোবাইল তো বাবা নিয়ে রেখেছিল আজ আর নেওয়া হয়নি।
-যাক বাঁচা গেল।
-কেনো অন্তিকে তো জানাতে হবে।
-উহু, প্রয়োজন নেই।
-কিন্তু….
মেঘ ছায়াকে টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় আর তারপর বলে,
-আমি চাই না ওর চিন্তায় এখন আমার যেই ইমেজ তৈরি রয়েছে সেটা পাল্টে যাক।
-কেনো?
-রাফিদ না এসেছিল তোমার বিদায়ের সময়, সে নিশ্চয়ই তোমায় অনেক কিছুই বলেছে।
-হুম।
-এখন বলো অন্তি যদি আমার সম্পর্কে জানতে পারে তবে সেই সাথে এটাও জানবে যে ওর মা…..
-বুঝেছি।
মেঘকে বলতে না দিয়ে ছায়া বলে কথাটা। মেঘ বলে,
-গুড এবার ঘুমোও কাল গিয়ে একবার অন্তির সাথে দেখা করে আসবে কেমন, নেক্সট উইক আমাদের ফ্লাইট।
ছায়া মেঘের বুক থেকে মাথা তুলে বলে,
-না গেলে হয় না?
-উহু। আমি চাই না ওদের লাইফে আমার কারণে কোনোপ্রকার সমস্যা হোক।
-এই ভালোমানুষটাকে কিনা ওরা ভিলেন হিসেবে চেনে। ইশ, আমার ইচ্ছে করছে এখনই গিয়ে বলি….
-নো, নট অ্যাট অল। চলো ঘুমোও এখন।
ছায়াকে শুতে বলে নিজে গিয়ে চেঞ্জ করে নিলো মেঘ। যেহেতু বিয়েটা হুট করেই হয়েছে তাই ছায়াকে তেমনভাবে সাজানো হয়নি জাস্ট একটা নতুন শাড়ী পরেই বাবার বাড়ি ত্যাগ করেছে মেয়েটা। মেঘ কাল গিয়ে ওর জন্য শপিং করবে তবে আজ ওকে ওই শাড়ি পরেই কাঁটাতে হবে। শাড়ীটা ভারী নয় বলেই হয়তো মেঘের তেমন চিন্তা নেই সেটা নিয়ে।

মেঘ-ছায়া পাশাপাশি শুয়ে আছে কিন্তু মেঘের ঘুম আসছে না কারণটা ছায়া-ই। মেয়েটা একবার এপাশ ফিরছে তো আরেকবার ওপাশ ফিরছে, স্থির হয়ে শুয়ে থাকতে পারছে না। মেঘ বললো,
-কী হলো ছায়া?
-কিছু না।
-ঘুমোতে অসুবিধে হচ্ছে?
-ঘুম তো আসছেই কিন্তু মাথার ভেতর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যা ঘুমটাকে বারবার বিকর্ষণ করছে।
-কোন প্রশ্নের এতো সাহস যে আমার বউয়ের ঘুমকে ভাগিয়ে দিচ্ছে!
মেঘের কথা শুনে ছায়া হাসে তারপর বলে,
-তোমার কাছে কিছু জানতে চাইবো মেঘ? সত্যি করে বলবে আমায়?
-প্লিজ।
-আমি জানি বলার হলে তুমি আমায় বলতেই, হয়তো এখন বলতে চাও না কিন্তু আমার মাথায় জ্যাম লেগে যাচ্ছে তাই প্রশ্ন না করে পারছি না।
-আহা, বলো না কী জানতে চাও?
ছায়া এবার সমস্ত সংশয় কাটিয়ে বলে,
-আমি যা চোখে দেখেছি এবং যা কানে শুনেছি তার মাঝে আকাশ পাতাল তফাত রয়েছে। এই বিষয়টা ক্লিয়ার করবে প্লিজ?

চলবে…..

#অন্তিম_পর্ব (প্রথম খন্ড)

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা
#অন্তিম_পর্ব (দ্বিতীয় খন্ড)

৩২.
-আমি যা চোখে দেখেছি এবং যা কানে শুনেছি তার মাঝে আকাশ পাতাল তফাত রয়েছে। এই বিষয়টা ক্লিয়ার করবে প্লিজ?
ছায়ার প্রশ্নটা শুনে মেঘ অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে হেসে বলে,
-ওসব পরে হবে এখন আমার গল্প পাচ্ছে। তোমায় একটা গল্প শোনাই চলো।
মেঘ ছায়াকে উঠিয়ে নিজে উঠে তারপর তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বারান্দায়। এখান থেকে আকাশটা দেখা যায় খুব ভালোভাবেই। খোলামেলা জায়গা তার উপর আজকের আকাশটাও স্বচ্ছ তাঁরা গুলো মিটিমিটি করছে পাশেই আছে অর্ধ চাঁদ। চাঁদটা খয়ে আসছে ধীরে ধীরে, কাল যদি আবারও এমনই স্বচ্ছ আকাশ থাকে তবে চাঁদটা আরেকটু ছোট দেখাবে। এই তো চাঁদের নিয়ম শূন্য থেকে পূর্ণ আবার সেই পূর্ণ থেকে শূন্য। মেঘ বলে,
-জানো ছায়া এই চাঁদ যেমন একটা সময় পূর্ণতা পায় আবার খয়ে গিয়ে অস্তিত্ব হারায় আমার জীবনটাও তেমনই তবে সবসময় উল্টোটা ঘটেছে আমার সাথে। একসময় আমার একটা পরিবার ছিল মা-বাবা, দাদু-দাদী আর এই আমি; হ্যাপি ফ্যামিলি।
এইটুকু বলেই হাসলো মেঘ তারপর নিজের হাতের সাথে লেগে থাকা ছায়ার হাতটা ধরে বললো,
-চলো বসি।
ছায়া কথা বাড়ালো না বা কোনো কিছু জানতেই চাইলো না শুধু মেঘকে অনুসরণ করে তার পাশে বসে পড়লো। মেঘ আবারও আকাশের দিকে চেয়ে বলতে থাকলো,
-আজকের চাঁদটা দেখছো, অর্ধ তাই না। পূর্ণ হলেই বেশী মানাতো তাকে। আমাও মনে হয়েছিল আমাদের পরিবারটা এখনও বাকি তাই সেই ছোট্ট আমি..
মেঘ কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর বললো,
-আমার বয়স তখন পাঁচ কী ছয় হবে। উমমম হ্যা তাই হবে, সেই সময় আমি মায়ের কাছে বায়না ধরলাম আমার একটা পুচকে চায়। মা মজা করে জানতে চেয়েছিল, “কেমন পুচকে? ছোট নাকি খুব ছোট?” আমি বলেছিলাম, “আমি তো এখন ছোট তাই অন্নেক ছোট্ট লাগবে।” মা আবারও প্রশ্ন করে, “গার্ল নাকি বয়?” আমি বলি, “গার্ল।” মা হেসে বলেছিল দেবে কিন্তু দেয়নি। আমি তো রেগে আগুন, কথা দিয়ে কথা রাখে না এ কেমন মা? মা’কে বলে দিলাম, “তুমি ব্যাড মা।”
ছায়া স্পষ্ট শুনতে পেলো মেঘের গলার কাঁপুনি যুক্ত শব্দ তবুও কিছু বললো না। এদিকে মেঘ তার নিজের মতন করে বলতেই থাকলো।
-আমি তখন নয় বছর পূর্ণ করে সবেই দশে পা রেখেছি এমন সময় একদিন স্কুল থেকে ফিরতেই দাদী আমায় কোলে বসিয়ে বললেন, “দাদুভাই তোমার আদরে তো এবার ভাগ বসবে।” আমি কিছু না বুঝে ঠিক সেই রকই একটা এক্সপ্রেশন দিলাম আর তখনই দাদীর কাছে জানতে পারি আমার ইচ্ছেটা পূরণ হতে যাচ্ছে। মা তার কথা রেখেছে। কত্তটা খুশি ছিলাম বলে বোঝানো সম্ভব নয়। দাদী আমায় ওইভাবে লাফাতে দেখে বললেন, “এই প্রথম কারো আদরে ভাগ বসাতে তাকে এতোটা খুশি দেখলা!” আমার সেই কথায় কান ছিল না আমি তখন অন্য ভাবনায় ডুবে ছিলাম।
মেঘ হাসলো একটুখানি তারপর আবারও বললো,
-মায়ের প্রেগন্যান্সির সময় আমি স্কুলের বাইরে আর কোথাও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম এমনকি পাড়ার মাঝে খেলতেও যেতাম না। সারাক্ষণ মায়ের সাথে চিপকে থাকতাম। খুব ভালোই কাটছিল দিনগুলো এরপর একদিন হঠাৎ খুব ভোরে কিছুর আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল আমার, বাইরে এসে দেখলাম দাদী কাঁদছেন। মা পাশেই বসা সেও কাঁদছে। আমি খুঁজছিলাম বাবাকে, না বাবা ছিলেন না আশেপাশে। এসব দেখে নিরবে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি মা ও দাদীর পাশে। দাদী আমায় দেখে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে আরও বেশীই করেই কাঁদতে শুরু করেন। কারণটা আমি বুঝলাম তখন যখন বাবা বাড়িতে ফিরলেন তারই পেছনে ছিল দু’জন লোক। ওদের পোশাক দেখে বুঝেছিলাম ওরা হাসপাতাল থেকে এসেছে। সেদিন ওরা দাদুর মৃত দেহটা নিয়ে ঢুকেছিল এই বাড়িতে। দাদু, আমার দাদু….
মেঘ কাঁদছে, ছায়া ওর হাতে হাত রেখে ডাকে,
-মেঘ!
-আই এম ফাইন।
বলেই আবারও শুরু করে বলতে,
-আমার কাছে আমার পরিবারের সদস্যদের মাঝে সব’চে প্রিয় ছিলেন দাদু। তুমি জানো আমার নামটা ‘বখতিয়ারুজ্জামান খান’ আসলে এটা আমার দাদুরই নাম। যখন আমার নাম ঠিক করা হয় তখন দাদু বলেন তার নামেই আমার নামকরণ হবে। বাবা অবশ্য এর বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু দাদু তাকে এক ধমকে চুপ করে দিয়েছিলেন। দাদীর কাছে শুনেছি ওইদিন দাদু নাকি বাবা ধমকে বলেছিলেন, “দেখ আমার নাতির মুখের দিকে, কোনো অংশে তোর ধারেকাছে নেই। তুই একটা গাধা আর আমার নাতি কখনোই তোর মতো হবে না। বড় হয়ে সে আমার মতো হবে, দাপটের সাথে চলবে সে আর তুই… তোকে তো কখনো সোজা হয়ে হাঁটতেও দেখলাম না আমি।” হা হা হা, দাদুও ছিলেন একজনই তার মতো আর কেউ হয়ই না। সেদিন আর ক্যাচার হয়নি দাদুর নামটাই আমার নাম হলো সাথে জুড়ে দেওয়া হলো আমার মায়ের দেওয়া নাম, ‘মেঘ।’

সেইদিন দাদুর যাওয়ার পরে সারাক্ষণ দাদীর সাথে থাকা শুরু করি আমি আর এইদিকে বাবা ব্যবসা সামলান আর মা সামলান নিজেকে তার সাথে আমাকে আর দাদীকেও। দেখতে দেখতে সময় কেঁটে যায় আমার মা জন্ম দিলেন এক কন্যা সন্তানের। সবার আগে দাদীই তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন তারপর আদর দিয়ে আফসোস করে বলেছিলেন, “তোর দাদুর খুব ইচ্ছে ছিল তার একটা নাতনি হবে। এই দেখ তুই এলি কিন্তু সেই মানুষটা আর নেই তোকে দেখার জন্য।” কথাটা বলার পরে দাদী কেঁদেছিলেন খুব।
-তোমার বোন….
-অন্তরা।
মেঘ থামলো তারপর বললো,
-তোমার প্রশ্ন শুনেই বুঝেছিলাম তুমি কাবিননামায় শুধু আমার নামটাই দেখোনি তার সাথে সাথে বাবার নামটাও দেখেছ। সেটা না দেখলে তুমি আমায় বিয়েই করতে না এটাও জানি।
-হুম আমি তোমার নামটা দেখে প্রথমে রেগে গিয়েছিলাম কিন্তু পরেই যখন তোমার বাবার নামের জায়গায় আশাদ আংকেলের নাম দেখলাম তখন চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম ভাবলাম তোমায় তখনই প্রশ্ন করি তারপরে আবার কাজী সাহেব তাড়া দিলেন তখন আর কিছু করার সময় পাইনি। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম আসার সময়ই তোমায় প্রশ্ন করবো কিন্তু তার আগেই রাফিদ এসে আমায় অন্য কাহিনী শুনিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি পড়লাম এক গোলক ধাঁধার মাঝে। অন্তরা এবং রাফিদের বাবা যদি তোমারও বাবা হয়ে থাকেন তবে তুমি ওদের কাজিন হও কী করে? আর একটা বিষয় অন্তি যেইভাবে বর্ননা দিয়েছিল তাতে মনে হচ্ছিল কোনো আশিক তার পেছনে লাগছে যেখানে তুমি ওর নিজের ভাই। গোলমালটা কোথায় খুলে বলবে প্লিজ। আমার মাথা ফেটে যাবে।
মেঘ শান্ত কণ্ঠে বললো,
-রিল্যাক্স। বলছি তো।
ছায়া শান্ত হয়ে বসে রইলো। মেঘ আবারও বললো,
-অন্তরার জন্মের পর সবাই খুশি ছিল খুব খুশি। দাদু যাওয়ায় চাঁদের যেই অংশটুকু খয়ে গিয়েছিল তার আসায় সেইটুকুও যেনো পূর্ণতা পেয়েছিল। কিন্তু সেই সুখটা মাত্র দুই সপ্তাহ টিকে থাকলো। তার জন্মের তেরো দিন পেরোতেই মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বিষয়টা মায়ের মৃত্যুর পরে বুঝেছিলাম, আসলে গর্ভাবস্থায় মা নিজের দিক না দেখে শোকে ডুবে থাকা পরিবারের সদস্যদের সামলেছেন আর তাতেই হয়েছে ক্ষতিটা। আমরা কেউ তার দিকে গুরুত্ব দেইনি এমনি বাবাও না। আমাদের গাফিলতির জন্য মা সেদিন চলে যায় আমাদের ছেড়ে। অন্তরা ছোট এইদিকে বাবা নিজেকে একঘরে করে নিয়েছিলেন, আমিও তেমন কিছু বুঝতাম না আর দাদী তিনি সবকিছু সামলাতে সামলাতে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। এইভাবে দেড় মাস যাওয়ার পরে বাবার কোনো রকম পরিবর্তন না দেখে দাদী ঠিক করলেন বাবা’কে বিয়ে করানো হবে আবারও। আমাকে বোঝালেন উনি এই সময় অন্তরার একজন মায়ের প্রয়োজন আর আমার বাবার প্রয়োজন একজন সঙ্গীর। আমি কিছুই বুঝিনি শুধু বুঝেছিলাম আমার বোন ভালো থাকবে। ব্যস।

এরপর রুবি খান এলেন এই বাড়িতে তার আসার পরেও অন্তরার খেয়াল দাদীকেই রাখতে হতো, শুধুমাত্র বাবা বাড়িতে থাকা কালীন সে অন্তরাকে নিজের কাছে রেখে যত্ন নেওয়ার ভান করতো। দাদী দেখেও কিছু বলতেন না, সংসারে অশান্তি হবে যে! হে হে। তবে এইটুকু পরিষ্কার ছিল বাবা তাকে বিয়ে করলেও মায়ের জায়গাটা তখনও তাকে দেওয়া হয়নি বলেই তিনি বাবাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করতেন। এরপর একটা সময় সফলও হয়েছিলেন সেটা বোঝা গিয়েছিল তার প্রেগন্যান্সির খবরে। অন্তরার বয়স তখন সাত মাস সে তো ছোট্ট বাচ্চা তার বোঝার ক্ষমতাই ছিল না আর আমি, আমার বোঝার ক্ষমতা ছিল এবং সেই বুঝ থেকেই বিষয়টা আমি মানতে পারিনি। বাবার উপর অভিমান জমেছিল আমার। বাবা পারলেন কী করে এতোটা সহজে আমার মা’কে ভুলে যেতে। আমার সেই অভিমানটা বাবা বুঝতে পারেননি বলেই হয়তো একটা সময় সেটা রাগ রূপেই বেরিয়ে আসা শুরু করেছিল আর সেই সুযোগটাই নিয়েছিলো ওই মহিলা। পরপর দু’বার আমার উপরে অভিযোগ আনা হলো আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি, তার সন্তানকে মারার চেষ্টা করেছি। প্রথমবার বাবা আমায় সাবধান করে ছেড়ে দিলেও সেবার ছাড়েননি। ঠিক যেই মুহুর্তে বাবা আমায় অবিশ্বাস করেছিলেন সেই মুহুর্তেই আমি রিয়েলাইজ করি যে দাদু কতটা ভুল ছিলেন আমার বিষয়ে। আসলে আমার বাবা যে গাধা সেটা আমি ওনার সাথে এগ্রী করি বাট আমি সেই সময় গাধা বা গাধার ছেলের পরিচয় দেইনি। আমি পরিচয় দিয়েছিলাম গাধাদের রাজার পরিচয়। দাদু ভুল বলেছিলেন, হী ওয়াজ সো রং ইয়া। আমি তার মতো হলে প্রথমবার ওই মহিলার জালে ফাঁসার পরে দ্বিতীয়বার তো আর পা দিতাম না তাই না। আমি সেই সময় চরম স্টুপিডিটির পরিচয় দিয়েছিলাম। চরম বোকামি করেছিলাম আমি। চরম বোকামি।
বিড়বিড় করতে করতেই মেঘ নিজের একটা হাত দিয়ে দেওয়ালে কয়েকটা ঘুষি মারে। ছায়ার হাতে মেঘের একটা হাত তো আগে থেকেই ছিল এবার সে অন্য হাতটাও নিজের হাতে বন্দি করে ফেলে বলে,
-পাগল হয়ে গেছ মেঘ! নিজেকে আঘাত করলেই কী সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে?
-হয়তো আমি অলটাইম পাগলই ছিলাম নইলে আজ অন্তরার এমন অবস্থা হতো না। তুমি জানো ওই মহিলা কতোটা নীচে নেমে গিয়েছিল। আয়ায়ায়াহ.. রাগে আমার মাথা ফেঁটে যাবে মনে হচ্ছে।
মেঘ ছায়ার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করে যদি একটু রাগটা কমে এই ভেবে। ছায়া তখনও বসে আছে। তার কষ্ট হচ্ছে হচ্ছে মেঘকে ওইভাবে দেখে। সে দুই হাত বাড়িয়ে মেঘকে ডাকে,
-মেঘ।
মেঘ তার দিকে ফিরতেই সেই ইশারা করে কাছে আসতে। মেঘ কাছে আসে জড়িয়ে ধরে তাকে। ছায়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

কেটে যায় অনেকটা সময়, মেঘ ছায়া’কে ছেড়ে দিয়ে আবারও আগের মতোই বসে পড়ে আর বলে,
-সেদিন বাবা ঠিক করেছিলেন আমাকে হোস্টেলে সিফট করিয়ে দেবেন। রুবি যা খুশি হয়েছিল না মনে হচ্ছিলো পুরো শহর জুড়ে মিস্টির বৃষ্টি করাবে কিন্তু তার সেই খুশিতে দাদীর নজর লেগে যায়। দাদী বাবা’কে জানিয়ে দেন, “এই বাড়িটা ‘মেঘকুঞ্জ’ তোর বাবা শুধুমাত্র মেঘের জন্যই বানিয়েছিল আর তাকে সাজিয়েছি আমি নিজে হাতে। এ কখনো হতে পারে না যে ‘মেঘকুঞ্জ’এ মেঘ থাকবে না। যদি কাউকে যেতেই হয় তবে তোরা যাবি।” দাদীর কথাটা সেইদিন রুবি খানে গায়ে বিষের মতো লেগেছিল বুঝলে। রাগ করে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। যাওয়ার সময় বাবা’কে বলে গিয়েছিল যদি তাকে ফেরাতে হয় তবে নতুন একটা বাড়ির ব্যবস্থা করে তবেই যেনো নিতে যায়। ওই কথা শোনার পরে দাদী আমায় নিজের ঘরে নিয়ে যান আমি তার কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। যখন আমার ঘুম ভাঙে তখন জানতে পারি মহিলা নিজে তো গেছেই সাথে আমার বোনটাকেও নিয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করি অন্তরাকে ফিরিয়ে আনার কিন্তু তার কাছে প্লাস পয়েন্ট ছিল বাবা। বাবার কারণেই অন্তরাকে আর দেখার সুযোগ হয়নি আমার। তার পরের চারটে বছর ভালোই কাটলো তবে বিপত্তি হলো এর পরেই। আবার আমার আকাশের চাঁদটা খয়ে পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিলো আমার জীবনটা। দাদী চলে গেলেন আমায় ছেড়ে। আমি কী করবো কোথায় যাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না সেই সময়টাতে বাবার হঠাৎ দয়া হলো আমার উপর। আমাকে পাঠিয়ে দিলেন দেশের বাইরে।

আমার পড়াশোনা শেষ হয় তারপরেও আমি সেখানেই আরো কিছু মাস থেকে যাই এক্সপেরিয়েন্স এর জন্য। এরপর যখন ফিরে আসি তখন জানতে পারি আমার বাবা আর নেই। আমি ফিরে না আসলে হয়তো জানতেও পারতাম না। কী অদ্ভুত মানুষ এরা একটা খবরও দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। আমিও আর অন্যদিকে ধ্যান না দিয়ে নিজের বাড়ির মাঝেই পড়ে রইলাম এমন সময় আমার কাছে একটা খবর এলো। মামারা ডেকে পাঠিয়েছেন। মায়ের মৃত্যুর দিনই তাদের শেষ দেখেছিলাম এরপর খোঁজও নেয়নি তারা আমার। যাই হোক গেলাম আমি তবে মনে প্রশ্ন রয়ে গেল হঠাৎ করে আমার কথা কেনো মনে হলো তাদের। গিয়ে যা বুঝলাম সবই নিজ নিজ স্বার্থের ফল। নানার যে জমি জায়গা ছিল তার ঠিক মাঝে আমার মায়ের অংশ পড়ে এরপর দুই সাইডে দুই ভাইয়ে। মাঝখানে মায়ের জায়টুকু তাদের পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অফার দেয় আমায় জমিটা তাদের নামে যেনো লিখে দিই। আমি করি কী ফোন লাগাই আমার পরিচিত একজনকে। জানতে চাই এই সময় ওই জায়গাটুকু বেঁচলে টাকার অংকটা ঠিক কতো বড় হতে পারে? সে আমায় বললো। এরপর ফোন স্পিকারে রেখে আবারও তাকে বলতে বলে মামাদের অফার দিলাম, তিন ভাগের দুই ভাগ টাকা দুই ভাইয়ে মিলে দিয়ে দাও তাহলেই আমি আর বাইরে কাউকে জানাবো না। কথা বলে তাদের ভাবার জন্য সময় আর আমায় ডাকার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আসলাম। যাক এইবার আর কারো আন্ডারে চাকরি করার প্রয়োজন নেই, টাকার পরিমাণটা এতোটা বেশি যে আমি আরামসে নিজের বিজনেস শুরু করতে পারবো।

মেঘ থামলো আর সেই সুযোগে ছায়া প্রশ্ন করলো,
-এর মাঝে অন্তির সাথে কখনো দেখা হয়নি তোমার?
মেঘ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ববলো,
-উহু, চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। মিসেস খান ব্যবস্থা খুব ভালো ভাবেই করেছিলেন। আমি তারপরেও চেষ্টা চালিয়ে যাই। একটা সময় হঠাৎ আমার মাথায় আসে আমি অন্তরা’কে না খুঁজে মিসেস খানের ছেলেকে খুঁজলেই পারি। নাম জানতাম না তার তবে সে যে ছেলে সেটা বাবা দাদীকে জানিয়েছিলেন সেই সূত্রেই জানা। আমি তাকে খুঁজি এইদিকে আমার বিজনেস অগ্রগতির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। একদিকে কাজ অন্যদিকে সেই ছেলেকে খোঁজা। দু’টোই চলতে থাকে পুরো দমে। পেয়েও যাই আমি তাকে। এরপর পাই অন্তি’কে। নজর রাখি তার উপর, কিছু জায়গায় তার সাথে মিসেস খানকেও দেখি। দেখে মনে হলো আমার বোনটাকে খুব ভালোবাসেন উনি। ভালোই লাগছিল আমি না পাই আমার বোনটা অন্তত মায়ের ভালোবাসা পেয়েছে এই অনেক আমার কাছে। সিদ্ধান্ত নিলাম এবার পিছু নেওয়া ছেড়ে দেব আর ঠিক সেই সময়টাতে নিহাল আসে ওর লাইফে। শুরুতে তো মিসেস খানই অন্তরাকে নিহালের কাছ থেকে দূরে রাখে তাই আমি ভাবি যে আমাকে আর কিছু করতে হবে না কিন্তু এরপরেই যখন দেখি তিনিও রাজি এরপর ছেলেটার খোঁজ নিই তখন তার সত্যটা জানতে পারি আমি। আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেছিল। প্রথমে অন্তরার কাছেই যাই আমি, সে আমায় চেনে না। তার ভাইকে চেনে না! অবাক হওয়ার কথা ছিল আমার তাই না? কিন্তু আমি মনে মনে বাবাকে সাবাসী দিচ্ছিলাম, “বাহ বাবা বাহ, কী করেছ তুমি! একেবারে সোনায় সোহাগা।”
ছায়া ভ্রু-কুঁচকে বললো,
-মেঘ।
মেঘ বিরক্ত হয়ে বললো,
-ধ্যাত শোনো তো আগে। সামনে আরও অনেক কিছু আছে। আমার বাপের কীর্তি কলাপ শুনলে তুমিও তালি দেবে অস্কার প্রাপ্য ছিল তার এইসবের জন্য।
-আর ইউ ম্যাড অর হোয়াট? এইভাবে কে বলে?
-উফফ ছায়া। আমায় বলতে দাও।
-আচ্ছা বলো।
মেঘ আবারও অতীতে ফিরে গেল,
-আমি লোক লাগিয়ে জানতে পারি নিহাল আজ পর্যন্ত যতগুলো মেয়ের সাথে মিশেছে তাদের ৮০% ই সুইসাইড এটেম্পট করেছে আর প্রায় ৯৫% কেসে মেয়েগুলো মারা গেছে। আমি ভাবলাম হয়তো মিসেস খান সবটা জানে না তাই গেলাম তারই কাছে এরপর দেখলাম তিনি আমায় দেখে অবাক হলেন না বরং শান্ত মনে বসতে দিলেন। বুঝলাম অন্তরা বলেছে আমার বিষয়ে। আমি তাকে নিহালের বিষয়ে বলাতে তার উত্তর ছিল, “জানি।” দ্যাট টাইম আই ওয়াজ টোটালি শকড! আমি বললাম আমি গিয়ে অন্তরাকে সবকিছু বলে দেব। উনি প্রশ্নে করলেন, “কী বলবে?” আমি আবারও বললাম যা আপনি করছেন সেইসব। “সে তোমার কথায় বিশ্বাস করবে তো?” “আমি ওর ভাই আর ও আমারই কথা বিশ্বাস করবে না।” “তুমি যে ওর ভাই তার কোনো প্রমাণ আছে?” প্রশ্ন শুনেই বুঝেছিলাম কিছু একটা ঘাপলা আছে। আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে উনিই বললেন, “তোমার বাবা বুঝলে, সে তার মেয়েকে খুব ভালোবাসতো। আমি তাকে বললাম, শোনো মেয়ে তো বড় হচ্ছে ও যদি জানে আমি ওর সৎ মা তবে তো খুব কষ্ট পাবে। তা শুনে তোমার বাবা বললেন, তুমি তোকে কম ভালোবাসোনা। আমি তাকে বললাম, তার পরেও।” এরপর উনি একটু থেমে উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোমার বাবা আমার বলার অপেক্ষাই করলেন না আর তিনি তো আমার গোমড়া মুখখানা দেখেই ছুঁটলেন। এরপর কিছু টাকা আর তার বদলে অন্তরার বার্থ সার্টিফিকেট থেকে ‘মুমতাহিনা খান’ নামটা উঠে গিয়ে বসে যায় ‘রুবি খান’ বুঝলে মাই বয়? পুওর বয়, তুমি অন্তি’কে যাই বলো না কেনো ও কিছুতেই বিশ্বাস করবে না।”
“কেনো করছেন এসব?”
“দোষটা আমার নয়, দোষ তোমার বাবার। মরার আগে তার বড় ছেলের প্রতি দরদ উতলে উঠেছিল তাই প্রপার্টির ফর্টি পার্সেন্ট তোমার নামে করে দিয়েছে আর বাকি সিক্সটি পার্সেন্ট এর অর্ধেক অন্তির এখানে আমার ছেলে কী দোষ করেছিল যে তাকে শুধুমাত্র থার্টি পার্সেন্ট ওনার করা হলো?” উনি হঠাৎই চেঁচিয়ে ওঠেন। বুঝলাম তার রাগ শুধু আমার বাবার উপর সেই সাথে আমাদের দুই ভাই-বোনের উপরেও। সেই সাথে এটাও বুঝলাম যে অন্তি’কে সরাসরি বলে কিছু হবে না যা করার আমাকেই করতে হবে। তবুও আমি বললাম অন্তরার ক্ষতি না করতে তখন উনি শর্ত রাখলেন আমার অংশটা তার নামে লিখে দিতে হবে। আমি তখনও সিওর ছিলাম না যে উনি শর্ত পূরণের পরেও অন্তরার কোনো ক্ষতি করতে পারেন কি-না। তাই সেইদিন বেরিয়ে আসি সেখান থেকে। আমার চিন্তা জুড়ে একটাই কথা ঘুরছিল আর তা হলো অন্তরাকে বাঁচাবো কী করে? এতোকিছুর মাঝে একদিন আবিরের সাথে দেখা হয়ে যায় আমার। প্রথম দেখায় ভালো লাগে ছেলেটাকে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সে রহমান সাহেবের ছেলে। রহমান সাহেব আমার কম্পানির জন্মথেকেই আমাদের সাথে কাজ করছেন তাই সেই সূত্রেই তাকে চিনি। এরপর বাপ ছেলের খোঁজ নিলাম ভালো মতোই। আবির, তার মাঝে একটা স্ট্রং পার্সনালিটি আছে তবে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম তার কমজোরিটা। তাকে চাকরি দিলাম এরপর অপেক্ষা করছিলাম সঠিক সময়ের আর সেই সময়টা এলো কিডন্যাপ করলাম অন্তরাকে। কষ্ট হয়েছিল ওকে ওইভাবে কষ্ট দিতে কিন্তু প্রয়োজন ছিল। ওকে কিডন্যাপ করে রাখার পরে আমার কাজ ছিল আবিরের সামনে শর্ত রাখার তার আগেই ওর বাবা এসে হাজির হলো আমার কাছে লোনের কথা বলতেই ব্যস সুযোগটা লুফে নিলাম। যেটা আবিরের সামনে রাখার কথা ছিল সেই অফার তার বাবার সামনে রাখলাম। বললাম, আপনার ছেলেকে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে তারপর একটা সময় নিজের লাইফ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। উনি রাজি না হয়ে উল্টো রিজাইন করে দিলেন। বাপ তো বাপ ছেলেও সেই একই রকম কথা বললো তারপর তার সামনে তার মায়ের অসুস্থতার কথা রাখলাম যা তার বাবা তাকে জানায়নি। ব্যস এতেই কাজ হলো। আমি জানতাম ছেলেটার নেচার, সে কাউকে কষ্ট দিতে পারে না। যেটুকু দিয়েছে আমার চাপে পড়েই দিয়েছে। আবিরের মতো অন্যকেউ আমার বোনের জন্য পারফেক্ট হতেই পারে না সেটা ভেবেই ওকে বেঁছেছি আমি আর বিয়েটাও দিয়েছি তাও আবার রুবি খানের উপস্থিতিতে তার সম্মতিতে।

এই জায়গায় এসে ছায়া প্রশ্ন করলো,
-আবির জানে তুমি কে?
-উহু।
-কেনো?
-আমি চাইনি যে তাই। আসলে আবিরকে আগে থেকেই বলে রাখলে ও সাহসই করতো না অন্তরার কাছাকাছি যাওয়ার। আমি যখন ওর মায়ের চিকিৎসা সফল হওয়ার পরে ওকে বললাম এইবার আমার কাজটাও করে দাও। অন্তরা খান’কে ছুঁড়ে ফেলে দাও রাস্তায় তখন ও রেগে গিয়ে আমার কলার ধরে বলেছিল, “আমার বউকে আমি রাখবো নাকি ছেড়ে দেব সেটা কী আপনি ঠিক করে দেবেন!” আমি শুনে খুশি হলেও প্রকাশ না করেই বলি, আমাদের মাঝে ডিল তো সেটাই হয়েছিল তাই নয়কি?
এরপর ও বললো, “ডিল? ও একটা মানুষ কোনো বস্তু নয়।”
“কোথাও ওর প্রতি মায়া জন্মে যায়নি তো! আচ্ছা ঠিক আছে দুদিন নিজের কাছে রেখে তারপর পাঠিয়ে দাও, ছাড় দিলাম তোমায়। ইউ নো হোয়াট আই মিন?”
কথাটা বলা আমার জন্য একটা বিশার বড় লড়াই ছিল, নিজের বিবেকের সাথে। কিন্তু ওই যে জরুরি ছিল বলা। আবির রেগে গিয়ে বলে আমার দেওয়া সমস্ত কিছু ফিরিয়ে দেবে এতে যত সময় লাগার লাগুক আর যদি আমি অন্তরার ক্ষতি করার চেষ্টা করি তবে আমার উপরেও হাত উঠাতে একবারের জন্যও ভাববে না সে।
ছায়া অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। এমন একটা মোমেন্টও এসেছিলো মেঘের জীবনে যেখানে নিজের বোনকে নিয়ে…. সো এমব্যারেসিং। মেঘ বললো,
-এর পরেও কী আমার গিয়ে বলা উচিৎ আমি ওর ভাই? কোনো অংশেই আমি আমার কথাতে কাউকেই বোঝার সুযোগ দেইনি আমি আসলে কে। এর পেছনে একটা কারণ আছে আর সেটা হলেন আমার বাবা, উনি যা করে গেছেন এরপর আমার সামনে যাওয়াতে অন্তির বিশ্বাস ভাঙবে। যেই মানুষটা এই পৃথিবীতেই নেই তাকে নিয়ে অন্তি অন্য কোনো ধারণা রাখুক সেইটা আমি চাই না।
-এখন কী করবে তাহলে?
-তোমায় নিয়ে সোজা যাব ইউএস।
-আর অন্তি, তার খেয়াল রাখবে কে শুনি? আবারও যদি আন্টি ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করেব তখন!
-পারবে না।
-তুমি এতোটা সিওর কী করে হচ্ছো মেঘ।
-আমি এক গাধার পুত্র গাধা হলেও তার আরেক পুত্র ঠিক আমার দাদুর মতোই। মাঝখান দিয়ে একটু ঢিলে চলছিল তবে আমি টাইট দিয়ে দিয়েছি। তার মায়ের আসল রূপটা তাকে বড় স্ক্রিনে দেখিয়েছি।
-মেঘ!
-আরে শোনো না, অন্তরা’কে যখন আমি কিডন্যাপ করলাম তখন না উনি এসেছিলেন দেখা করতে। আমিই ডেকেছিলাম অবশ্য। উনি কিছুতেই আমার কথাতে রাজিই হচ্ছিলেন না উলটো হুমকি দিলেন অন্তি’কে খুঁজে বের করেই ছাড়বেন আর উনি জানতেন আমি খুব বেশিদিন আমার বোনটাকে কষ্ট দিতে পারবো না তাই তো নিজের কথায় অটল রইলেন। আমি অফার রাখলাম সামনে, আমার পছন্দের ছেলের সাথে অন্তির বিয়ে দিয়ে তারপর তাদের মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরী হলেই আমার অংশ মিসেস খানের নামে লিখে দেব। বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না অবশ্য তখন বলি, “ট্রাস্ট মি, আমি বখতিয়ারুজ্জামান খানের নাতি বখতিয়ারুজ্জামান খান। আমার কথার নড়চড় হবে না। দাদুর হিস্ট্রি নিশ্চয়ই বাবার কাছে শুনে থাকবেন।”
ব্যস আর কিছু বলতে হয়নি। এই রেকর্ডিংটাই আমি রাফিদকে দেখাই।
-তাহলে তো রাফিদ জানে তুমি ওর ভাই তবে ও কেনো বললো যে তুমি ওর কাজিন।
-ভিডিওটা একটু কাটছাট করে প্রেজেন্ট করেছিলাম। শুধুমাত্র রাফিদকে প্রমাণ দেখানোর জন্য। আর ওকে ওই ফ্যামিলি ড্রামার গল্পটা আমিই বানিয়ে বলেছিলাম। কথা ওসব নয়, রাফিদ এখন বুঝে গেছে ওর মা ঠিক কতটা নিচে নামতে পারে তাই ওইদিক থেকে সামলানোর কাজটা ও করে নিতে পারবে আর অন্তি এখন আবিরের সাথে সেইফ থাকবে তাই সেইদিকেরও কোনো ভয় নেই।

ছায়া চুপ করে বসে রইলো। মেঘ একবার ওর হাবভাব দেখে নিয়ে বললো,
-আরো একটা কথা আছে, তোমায় ডেকেছিলাম মনে আছে সম্ভবত সেইদিনই রুবি খান তোমার বাড়িতে গিয়ে আমার নামে যা তা রটিয়ে এসেছিল।
-হু।
-তোমায় সেইদিন কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছিলাম আমি।
-যা বললে এইসবই তো নাকি?
-না।
ছায়া হয়তো আঁচ করতে পারছিল কেনো না হঠাৎই তার সেইদিনের কথা মনে পড়ে গেল যেইদিন মেঘ ওকে আর্জেন্ট ডেকে নিয়ে পার্কে বসে কিছু কথা বলেছিল।
মেঘ বললো,
-আমি রাফিদকে দুইবার কিডন্যাপ করেছিলাম একবার পুলিশ দিয়ে আরেকবার নিজের লোক লাগিয়ে। প্রথমবার অন্তরার আশেপাশে থাকার জন্য তার প্রতি মুহুর্তের খবর জানার জন্য কাউকে প্রয়োজন ছিল বলে তখন ওকে প্রশ্ন করায় ও তোমার নামটা নিয়েছিল। তুমি ওর সব খবর জানতে এমন। আমি ভেবেছিলাম তোমায় ইউজ করে অন্তরার কাছাকাছি থাকা যাবে আর তাই আমার লোক লাগিয়ে দিই পেছনে জানতে পারি অন্তরার সেই বেস্ট ফ্রেন্ড মানে তোমার অলরেডি একটা বয়ফ্রেন্ড আছে।
ছায়া মেঘের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা লুক দিলো। মেঘ থামলো না সে বলেই চললো,
-ততদিনে তোমার সাথে আমার দেখাটা হয়েই গেছে এমনকি আমি ভাবিওনি যে তুমি সেই ছায়া। একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে আমাদের মাঝে। কারণে অকারণে দেখা হতে থাকে। তোমায় ভালোলাগতে শুরু করে একটা সময় আর সেই থেকে ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলি। তুমি যেইদিন তোমার আপু-দুলাভাইয়ের সাথে পার্কে এসেছিলে সেইদিন আমি রাফিদকে কিডন্যাপ করেছিলাম সেকেন্ড টাইম। ওকেই দেখতে গিয়েছিলাম হঠাৎ তোমায় দেখে এগিয়ে গেলাম। কথা হলো আমাদের। তুমি চলে গেলে তারপর আমিও বিল্ডিং এ ফিরে যাই। রাফিদ সেখান থেকে আমায় তোমার সাথে দেখে এবং সেই বলে যে তুমিই সেই ছায়া মানে অন্তরার বেস্ট ফ্রেন্ড। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম ছায়া ভেবে অন্য কারো পিছু নিয়েছিল আমার লোক।
-কার?
-তোমাদের আরেকটা ফ্রেন্ড আছে না সে।
-রিধি।
-হুম। পরে আমি যখন জানলাম আসলে সে অন্যকেউ তাই তার পিছু নেওয়া বন্ধ করে দিতে বলি। আমার মনে হয় তার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল এটলিস্ট লোকগুলোর একটাকে ওর পেছনেই লাগিয়ে রাখা উচিৎ ছিল। মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড ছিল জানতাম পরে আজই জানলাম যে সে আসলে তার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিখোঁজ ছিল ছেলেটা। আর একটু ভাবলেই রিলেট করতে পারতাম বিষয়টা। আজ মেয়েটা সুইসাইড এটেম্পট করেছে জানো, আমি আর একটু খোঁজ নিলেই এমনটা হতো না।
-হেয়ালী করো না মেঘ।
-রিধি বয়ফ্রেন্ডটা আসলে নিহাল ছিল যাকে রুবি খান কিডন্যাপ করে রেখেছিল পরে আমি সরিয়ে নিয়েছিলাম তাকে। এরপর নিহাল পালিয়ে গিয়ে ওদের বাড়িতেই উঠেছিল, সুযোগটা ছিল তার কারণ মেয়েটার ভাইয়ের বন্ধু সে। এখন যদি আমার লোকেরা রিধির পিছু না ছাড়তো তাহলে নিহাল পালিয়ে যাওয়ার পরে ওদের বাড়িতে ওঠা মাত্রই আমি খবর পেতাম সবটা আরও সহজ হতো মাঝখান থেকে মেয়েটার লাইফ নষ্ট হতো না। এই জিনিসটা সারা জীবন আমায় জ্বালাবে ছায়া, একটা গিলট রয়ে যাবে ভেতরে। আমি আর একটু ভাবলেই এমন কিছু হতো না।
ছায়া মেঘের গালে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে,
-এতে তোমার দোষ নেই মেঘ। প্লিজ নিজেকে দোষী করো না।

রাতটা কেটে যায় বারান্দায় বসে থেকে একে অপরকে জড়িয়ে রেখে। সকালের আলো ফুটে ওঠে চারিদিকে। জেগে যায়, ছায়া তখনও ঘুমন্ত। উঠে ছায়াকে কোলে নিয়ে ঘরে এসে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায় নিজে। সে কখনোই ভাবেনি তার জীবনটাতেও কেউ আসবে, সবসময় ভেবে এসেছে এতোগুলো বছর যেমন একা কেটেছে তেমই কাটবে বাকি জীবনটা কিন্তু না। ছায়া এলো তার জীবনে আর এসেই তার সবটা দখল করে বসলো সে। এখন এই মেয়েটাকে ছাড়া সে কিছু ভাবতেই পারে না। জীবনে আর কিছু না থাকুক ছায়া তার পাশে থাকলেই ব্যস আর কিছু চায় না। নিজের বোনটাকে ফিরে পেতে পারতো কিন্তু এতে সে কষ্ট পেতো অনেক বেশি এর চেয়ে ভালো বোনকে কোনো সেফ হাতে তুলে দিয়ে নিজে নিশ্চিত হওয়া আর সেইটাই করেছে মেঘ। এবার সে নিশ্চিন্তে যে কোনো জায়গায় যেতে পারে।

ছায়ার পাসপোর্ট রেডি হতে সময় লেগে যায় একমাস এরপর ভিসা পাওয়ার পরেই ওরা পাড়ি জমায় আকাশ পথে অন্য এক জগতে। এদিকে অন্তি আছে বেশ তার শ্বশুর বাড়িতে। আবিরের মা’কে বলা হয়নি অন্তির আর ওর বিয়ের কথা তবে তার সামনে অন্তিকে প্রথমে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল আবিরের পছন্দের মেয়ে হিসেবে এরপরই কথা এগোয়। রুবির মত না থাকাতেও তাকে হাসি মুখে সবটা করতে হয় কারণটা ছিল রাফিদ। এরপর আবারও বিয়ে হয় আবির-অন্তরার এবার এই বিয়েতে বর-কনে আর দুই পরিবারের সম্মতিও থাকে। বেশ ধুমধাম করেই অন্তি যায় তার শ্বশুর বাড়িতে।

মেঘ যাওয়ার আগে নিজের অংশটুকু দুই ভাই-বোনের মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দিয়ে যায় তবে এমন গোপনীয়তার সাথে কাজটা সম্পন্ন করে যে কেউ টেরই পায় না। গোপনীয়তা বজায় রাখার একটা কারণ ছিল মেঘের পরিচয়। যেটা সে অন্তি বা রাফিদ কারো সামনেই আনতে চায়নি। সবকিছু যাওয়ার পরেও মেঘের কাছে রয়ে যায় একমাত্র তার দাদুর বাড়িটা যার নাম ‘মেঘকুঞ্জ’। জীবন এইভাবেই চলতে থাকে। মেঘ হয়তো ফিরবে তবে দূর থেকেই তাদের দেখে চলে যাবে আবার হয়তো ফিরবে না। জানা নেই। এই বিষয়ে এক মাত্র মেঘই জানে। থাক না কিছু কথা গোপনে এতে যদি কারো ক্ষতি না হয় তবে গোপন থাকাই শ্রেয়।

ছায়া রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মাংস কষিয়ে রেখে এবার রান্নার প্রিপারেশন নিচ্ছে ওই সময় মেঘ আসে বাড়িতে আর এসেই কষা মাংসের গন্ধ পেয়ে চলে যায় সেখানে। ছায়া তখন পেঁয়াজ কাঁটতে ব্যস্ত সেই সুযোগে এক পিস তুলে নিয়ে মুখে পুরে নেয় সে। চিবোতে গিয়ে আওয়াজ হয় আর সেই আওয়াজেই ছায়ার হাত থেমে যায়। মেঘ হাত বাড়ায় আবারও আর তখনই তার হাতে খুন্তি দিয়ে মারে ছায়া। মেঘ হাত ঝেড়ে বলে,
-এ কেমন বউ সব সময় বরকে মারে! উফফফ।
-তোমায় কতবার বোঝাতে হবে বাড়িতে ঢুকে আগে ফ্রেশ হবে এটলিস্ট হাত ধুয়ে এসে খাবে তা না করে তুমি ওই ময়লা হাতেই.. এই যাও তো এখান থেকে নইলে পিটিয়ে লাল করে দেব তোমায়।
-সেটাই বা আমার ভাগ্যে কখন জোটে? তুমি তো মুখেই বলো পিটিয়ে লাল করবে তবে ওই কথা অবধিই আটকে যায় তোমার জোর। অন্যদের বউয়েরা দেখো কীভাবে আদর দিয়ে লাল করে…
মেঘ আর কিছু বলতেই পারলো না, ছায়া তেড়ে আসলো তার দিকে। মেঘ এক ছুঁটে ঘরে ভেতরে গিয়ে আটকে রইলো। উফফফ, মানুষের বউ হয় লজ্জাবতী আর তার বউ….. সবসময় রাগে ডুবে থাকে, দু’টো ভালোবাসার কথাও বলে না। এমন সময় ছায়ার আওয়াজ ভেসে আছে,
-ফ্রেশ হয়ে এসে তাড়াতাড়ি আর এসে আমায় রান্নায় হেল্প করো।
মেঘ আর উপায় না দেখে চলে গেল ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে। ওদিকে ছায়া হাসে মেঘের সাথে এমন করতে তার বেশ ভালোই লাগে। ছায়া সবসময় চেষ্টা করে মেঘকে ব্যস্ত রাখার নইলে অতীতের একাকী জীবনটা মেঘের মনে পড়ে যায় আর মেঘকে তারা জ্বালায়, খুব কষ্ট পায় মেঘ। মুখে বলে না তবে ছায়া বুঝতে পারে আর তাই তো তাকে সবসময় ব্যস্ততার মাঝে রাখে।

ফ্রেশ হয়ে এসে মেঘ বললো,
-ছায়া শোনো।
-কী বলবে বলো আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।
-দুলাভাই ফোন করেছিলেন।
-কেনো?
-তোমার বোনের সেকেন্ড বেবি আসছে যে তাই।
মেঘ রাগের সাথে কথাটা বললো,
-এই কথাতে রাগের কী আছে মেঘ!
-আমাদের বিয়ের পর ওইদিকে দু দুটো সাপ্লাই দেওয়া হয়ে গেল আর আমরা…
-আমরা কী?
-তোমার মনে হয় না এবার তোমারও তৈরি হওয়া উচিত, বাচ্চা সামলানোর জন্য।
-শাশুড়ী মায়ের বাচ্চাটা আগে প্রপারলি সামলে নিতে শিখে যাই তারপর নিজের বাচ্চার কথা ভাববো।
মেঘ উঠে ছায়ার দিকে তেড়ে এসে বলে,
-কী বললে তুমি? আমি বাচ্চা?
-তা নয় তো কী! এখনও তো তোমায় হাতে তুলিয়ে খাওয়াতে হয়।
-সে তো আমার তোমার হাতে খেতে ভালো লাগে তাই।
-হয়েছে হয়েছে, আগে যেটা আসছে তাকে আসতে দাও সামলে উঠতে পারলে আরেকবার আজকের কথাটা মনে করে বিবেচনা করে দেখবো।
বলতে বলতে ছায়া রান্নাঘরে ঢুকে। মেঘ ছায়ার কথাটা আওড়াতে থাকে। একটা সময় পরে চোখদুটো বড় বড় করে রান্নাঘরের দিকে তাকায় সে তারপর হাসে। ছুঁটে যায় ছায়ার কাছে।
-আসছে মানে? সত্যিই ছায়া?
ছায়া জবাব দেয়,
-হুম।
মেঘ আবারও জানতে চায়,
-সত্যিইই সত্যিইই?
-মেঘ এবার কিন্তু আমি রেগে যাবো।
-রাগো যা পারবে তাই করো আজ তোমার জন্য সব এলাউড।
ছায়া হাসে মেঘের কথা শুনে, মেঘও হেসে ছায়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

___________________“সমাপ্ত”_________________