যদি তুমি চাও পর্ব-০৪

0
466

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

৪.
সেদিনের সেই ফোন কল থেকে শুরু হয় এক যাত্রা। দু’জনের কথা হতে থাকে মাঝেমধ্যেই। বেশ ভালো বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে তাদের। পরীক্ষার আগে রুবি অন্তির ফোন নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলে নিহাল অন্তির কলেজে গিয়ে দেখা করে। অন্তিকে দেখা মাত্রই তাকে জড়িয়ে ধরেছিল যে। প্রথমবার কেউ এইভাবে তাকে জড়িয়ে ধরায় ঘাবড়ে যায় অন্তি ঠিক তার পরের মুহুর্তেই নিজেকে শান্ত করে নিহালকে প্রশ্ন করে,
-আপনি এখানে এইভাবে?
-কোথায় ছিলে অন্তু? কোথায় ছিলে এতোদিন? তোমার মোবাইলটাও বন্ধ করে রেখেছ, কেনো অন্তু?
নিহালের কথাগুলো অন্যরকম শোনাচ্ছিল তখন অন্তির খেয়াল হয় আজ নিহাল তাকে ‘অন্তরা’ নয় বরং ‘অন্তু’ বলে ডাকছে। অন্তির কাছে ডাকটা ভালো লাগে তবে প্রকাশ করে না। নিজেকে নিহালের কাছে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্তি বলে,
-আমার পরীক্ষা সামনে তাই মা মোবাইল নিয়ে নিয়েছে। এইচএস তো তাই ভালোভাবে পড়াশোনা করাটা জরুরী আর আমার কাছে মোবাইল থাকলে আমি অনেকটা সময় গেইম এর পেছনে ব্যয় করি তাই মা সেটা নিয়ে নিয়েছে।
-ওহ! তবে আমি তোমার সাথে কন্ট্যাক্ট করবো কী করে?
-আমার পরীক্ষার পরে যখন আমি আবারও মোবাইলটা হাতে পেয়ে যাব তখন।
-তোমার কাছে বিষয়টা যতটা সহজ বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে ততটা সহজ নয়, অন্তরা।
-কেনো বলুন তো? শুধু কয়েকটা মাস তারপরই তো…
অন্তি’কে আর কথা বলতে দিলো না নিহাল সে নিজেই বললো,
-আচ্ছা ঠিকআছে তবে আমি তোমার কলেজের সামনে প্রতিদিন অপেক্ষা করবো তুমি আসবে, আমাদের দেখা হবে সাথে কথাও হবে আবার যখন পরীক্ষা শুরু হবে তখন তোমার সেন্টার যেখানে হবে আমি সেইখানে অপেক্ষা করবো।
-অপেক্ষা করারই বা কী প্রয়োজন নিহাল! আপনার কাছে আমার সাথে কথা বলাটা এতোটা জরুরী কেনো বলবেন আমায়?
-আমার কাছে তোমার সাথে কথা বলা তারপর তোমায় এক নজর দেখতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অন্তরা। কেনো গুরুত্বপূর্ণ সেটা তুমি বোঝো না? কেনো বোঝো না? তুমি তো বাচ্চা নও অন্তরা। কিছুদিন বাদে আঠেরো হবে তোমার বয়স।
-আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বুঝিয়ে বলবেন প্লিজ, আপনার বলা প্রত্যেকটা কথা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
-আই লাভ ইউ অন্তরা।
অন্তরা নিহালের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে তারপর তার সামনে থেকে সরে গিয়ে হাঁটতে শুরু করে। নিহালও ওর পেছনে আসে, ওকে ডাকতে থাকতে আর ও নিজের হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিতে থাকে। এইভাবেই এক সময় অন্তি নিজের গাড়িতে উঠে বসে তারপর গাড়ি চলতে শুরু করে।

ফিজিক্স বইটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পরে ছুড়ে বিছানায় রেখে পড়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় অন্তি তারপর সেখান থেকে জ্যামিতি বক্স, নোটবুক আর ম্যাথ বইটা নিয়ে এসে বসে। অনেকক্ষণ থেকে চেষ্টা করেও ম্যাথের সঠিক সমাধান বের করতে পারলো না অন্তি তাই কিছু চিত্র আঁকার চেষ্টা করলো কিন্তু আফসোস সেটাও হলো না। আরও একবার উঠে দাঁড়ালো অন্তি, গেল সে পড়ার টেবিলের কাছে। এবার আর বই নিয়ে এলো না শুধু সামনের চেয়ারটা টেনে সেখানেই বসে পড়লো তারপর কিছু গ্রামাটিক্যাল কোয়েশ্চিন সলভ করতে থাকলো। নাহ, এগুলোও সঠিক ভাবে হচ্ছে না। সব দোষ ওই নিহালের। ওর কী প্রয়োজন ছিল এইভাবে বলার! ওকে তো আগেই বলে দিয়েছিল যে সে কখনো প্রেম বা ভালোবাসা যাই হোক এর নাম, সেই সম্পর্কে জড়াতে পারবে না অন্তি। তার মা তাকে খুব বিশ্বাস করে এইভাবে সে মায়ের বিশ্বাস ভাঙতে পারে না। কখনোই পারে না।

রুবি খান সন্ধ্যের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসেন এটা তার নিয়ম তবে আজ দশটা পেরিয়েও তার দেখা নেই। রাফিদ ঘুমোচ্ছে কিন্তু অন্তির চোখে ঘুম নেই। কী যে হলো তার মায়ের, এমনটা আগে কখনো করেননি উনি। অন্তি যে ফোন করে জানতে চাইবে তার ফোন তো মায়ের কাছে আছে তাই পারছে না। বাড়ির ল্যান্ডফোন ইউজ করবে? উহু মা সেটা রিসিভ করবেন বলে মনে হয় না। মা জানেন ওই ফোন একমাত্র বাড়ির স্টাফরা ইউজ করে তাই কোনো চান্স নেই সেই ফোন থেকে কোনো কল করে রেসপন্স পাওয়ার।

চিন্তিত অন্তি একবার বিছানায় বসে তো একবার উঠে গিয়ে সোফাতে বসে আবার গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে এই হয়তো মায়ের গাড়ি ঢুকলো বাড়িতে। কিন্তু না, রুবির কোনো খোঁজ নেই। অপেক্ষার এক পর্যায়ে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ে অন্তি। ঘুম যখন ভাঙে তখন সকাল আটটা বাজে। ঘাড়ে প্রচুর ব্যথা তার হয়তো এইভাবে শুয়ে পড়ায় এই ব্যথার আবির্ভাব ঘটেছে। এসব ভাবার সময় নেই এখন। সকাল হয়েছে অনেক আগেই। অন্তির একবার গিয়ে দেখা উচিত তার মা কী করছে। আদৌ তিনি ফিরেছিলেন কি-না জানা নেই অন্তির। তাই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে মায়ের ঘরে যায় সে। সেখানে খুঁজলে তার মা’কে অনুপস্থিত দেখে চিন্তাটা আবারও চাড়া দিয়ে ওঠে। ঘরের ভেতরে অপেক্ষা না করে সে হল রুমে আসে। রাফিদের আওয়াজ শোনা যায়। এগিয়ে যায় সেও। গিয়ে দেখে খাবার টেবিলে বসে আছেন মা কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই তার। অন্তি এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,
-মা, কাল রাতে কখন ফিরেছিলে তুমি?
রুবি চুপচাপ খেতে থাকেন অন্তি যে প্রশ্ন করছে সেইদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। অন্তির খারাপ লাগে বিষয়টা তবুও নিজেকে সামলে নেয় সে।
-মা।
-কিছু বলবে?
-মা তুমি কাল রাতে কোথায় গিয়েছিলে?
-কাজ ছিল একটা, জরুরী কাজ।
-আমাদের তো জানাওনি!
-আমার সব কাজের কৈফিয়ত দিতে হবে এখন?
-না মা, আমি সেইভাবে বলতে চাইনি। আসলে রাতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য। এমনিতেও তুমি তো কখনো এতোটা দেরিতে ফেরো না তাই…
-তাই তুমি এখন আমার কাছে জবাব চাইছো তাই তো?
-তুমি এমন বিহেভ কেনো করছো মা?
-আজকাল আমায় না জানিয়ে যে কেউ যা খুশি তাই করতে পারবে আর আমি একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজে ব্যস্ত থাকতে পারবো না! আমায় এখন আমার মেয়ের কাছে জবাবদিহি করতে হবে!
-মা তুমি ভুল বুঝছ।
-ভুল আমি এখন নই অন্তি তবে এতোদিন ছিলাম। তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আজ লোকের কাছে কথা শুনতে হচ্ছে যে আমার মেয়ে নিজের কলেজ ক্যাম্পাসে এক অচেনা ছেলেকে জড়িয়ে…. ছিঃ আমার বলতেও লজ্জা করছে অন্তি। তুমি আমার কথা ভাবলে না আমি মেনে নিলাম তোমার বাবার কথা ভাববে না একবারও। মানছি উনি আমাদের মাঝে আর নেই তবুও তার একটা সম্মান এখনও আছে এই সমাজে। তুমি তো সেটারও পরোয়া করলে না অন্তি। ইচ্ছে করছে চড়িয়ে গাল লাল করে দিই তোমার কিন্তু পরে আবার ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যে তোমায় কী দোষ দেবো আমি, দোষ তো আমার। আমার দেওয়া শিক্ষার মাঝেই ঘাটতি রয়েছে নয়তো আমার মেয়েটা এইভাবে আমার সাথে সাথে তার বাবার নাম ডুবিয়ে আসতে পারতো না।
রুবি আর সেইখানে অপেক্ষা করেন না এমনকি তিনি অন্তির কোনো কথাও শুনতে চাইলেন না। অন্তি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো, চোখে তার অশ্রু। সে যে কেনো নিহালের সাথে কথা এগোতে গেল এখন তার নিজের উপরেই রাগ হয়। রাফিদ তার কাঁধে হাত রাখে কিন্তু শান্তনা যে এখন কোনো কাজে আসবে না সেটাও সে জানে।

পুরো একটা মাস কেটে যায়। এই এক মাসে অন্তি যথা সম্ভব নিহালকে ইগনোর করার চেষ্টা করেছে। সে সামনে এসে দাঁড়ালে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে, কথা বলতে চাইলে কথা না বলে চলে গেছে, প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়নি। পুরোপুরি এভয়েড করেছে নিহালকে তবে এটাও বুঝে গেছে তার মনে নিহাল অনেক বড়ো একটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। ভালোবাসে সে নিহালকে তবে মায়ের কথাও ভাবতে হবে তাকে। একজন মা সন্তান জন্ম দিতে যেই পরিমাণ কষ্ট সহ্য করে এই কষ্ট তো সেই কষ্টের কাছে তুচ্ছ। অন্তি এইটুকু করতে পারবে না তা কী করে হয়! অন্তি পারবে, ঠিক পারবে।

চলবে….