যদি তুমি চাও পর্ব-০৫

0
416

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

৫.
অন্তির ফাইনাল পরীক্ষা শেষে সে ভার্সিটি প্রিপারেশন নিতে শুরু করে। এতোটা সময়ের মাঝে নিহাল এসেছে, তার সামনে দাঁড়িয়েছে তবে সে শুধু দেখেও না দেখান ভান করে চলে গেছে। এতকিছুর পরেও নিহাল তার পিছু ছাড়েনি। সে তার মতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে যেনো একবারের জন্য হলেও অন্তি কিছু বলে। এরই মাঝে একদিন কোচিং ক্লাসের পরে অন্তি বেরিয়ে আসার সময় খেয়াল করে নিহাল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আর কতো? আর কতো ইগনোর করবে সে! একবার না একবার তো নিহালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে বলতেই হবে যেনো সে আর পিছু না করে। এসব আর অন্তির সহ্য হচ্ছে না। সে নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে এখন যদি নিহাল এইভাবেই সামনে আসতে থাকে তবে সে তো আরও দূর্বল হয়ে পড়বে।

অন্তি একবার নিহালকে দেখে তারপর ছায়াকে বলে,
-তুই একটুখানি অপেক্ষা কর আমি আসছি।
-কোথায় যাবি?
-একটা কাজ আছে।
-আমিও আসি তোর সাথে।
-না, তার প্রয়োজন নেই তুই শুধু এখানটায় অপেক্ষা কর।
-আচ্ছা।
অন্তি ছায়া’কে অপেক্ষা করতে বলে নিহালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারপর বলে,
-কী সমস্যা আপনার, আমার পিছু নিচ্ছেন কেনো?
-তোমায় ভালোবাসি বলেই তো পিছু নিই।
-এটা ভালোবাসা নয় নিহাল। এ শুধু মাত্র পাগলামী। আর আমি কারো পাগলামীকে প্রশ্রয় দিতে পারবো না।
-পারবে না, নাকি চাও না?
-এই প্রশ্নের মানে কী?
-তোমার সমস্যাটা কী?
-সমস্যা, আমার সমস্যা… হ্যা, সমস্যাই তো। আমারই সমস্যা। আপনি এইভাবে আমার পিছু নিচ্ছেন আমার আশেপাশের মানুষগুলো কী ভাবছে জানেন? তারা ভাবছে অন্তরা মেয়েটা ছেলে ঘোরাচ্ছে। কথা গুলো কেমন শোনায় বলুন তো! হ্যা, মানছি তারা কখনো আমার সামনে এসে কিছু বলে না কিন্তু আমার পেছনে ঠিকই বলে যা আমার কানে কোনো না কোনো ভাবে পৌঁছেই যায়। কখনো কখনো তো আমার মায়ের কানেও যায় এসব।
-বুঝেছি, তোমার মেইন সমস্যা এখানেই। তোমার মায়ের কাছে তোমাকে বাধ্য মেয়ে হয়ে থাকতে হবে তাই তো। আচ্ছা যাও আজকের পর থেকে তোমায় আমি কখনো ডিস্টার্ব করবো না শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিয়ে যাও।
-কী প্রশ্ন!
-তুমি আমায় ভালোবাসো না?
অন্তি কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। সত্যি সে বলতে পারবে না কারণ সত্যি বললে নিহাল ঠিকই ওকে রেখে যাবে না, ওর পিছুও ছাড়বে। এতোদিন দূরে দাঁড়িয়ে থাকতো আর সত্যিটা বললে এরপর থেকে পাশাপাশি হাঁটতে চাইবে।

অন্তির উত্তর না পেয়ে নিহাল বললো,
-তুমি নিরব মানে তোমার মন চায় আমাকে কিন্তু পরিবারের কথা বিশেষ করে তোমার মায়ের কথা ভেবে আমায় দূরে ঠেলে দিতে চাইছো। আমি বুঝতে পারছি তোমার সিচুয়েশনটা তবে একটা কথা কী জানো অন্তরা আমরা দু’জনে মিলে চেষ্টা করলে একটা সময় ঠিকই পরিবারকে মানিয়ে নিতে পারবো। তুমি তো সেই চেষ্টাটাও করতে চাও না। তুমি এখন ভাবছো তোমার মা জানলে রেগে যাবেন, রেগে যাক না। রাগের বশে বকবেন খুব জোর মারলেন এর বেশি তো কিছু করবে না তাই না। এখন তোমার মনে হতে পারে আমি তোমায় ভালোবাসি তাহলে তোমার আঘাত পাওয়ার বিষয়টা এতো সহজে বলতে পারছি কী করে? আসলে কী বলতো অন্তরা, ভালোবাসার মানুষটিকে সারাটি জীবনের জন্য পেতে হলে একটু তো কষ্ট সহ্য করতেই হবে। এর মানে এই নয় যে আমি চাই শুধু তোমার উপর দিয়েই সব কষ্টের রেশ যাক বা এমন নয় যে এই মুহুর্তে শুধু তুমিই কষ্ট পাচ্ছো, তোমার মনে আছে অন্তরা আমি মাঝখানে দু’টোদিন আসিনি? মনে থাকারই কথা কেনো না আমায় দেখতে না পেলে তোমার চোখদুটো চঞ্চল হয়ে ওঠে তারপর দেখতে পেলেই সেটা শান্ত হয়। সে কথা না হয় পরে হবে। অন্তরা তোমার মা তোমায় খুব ভালোবাসেন তাই না! বুঝতে পারি। উনি তোমার গায়ে হাত তোলেননি একবারও তবে তার অফিসে দু’চারজন কর্মচারী পাঠিয়ে আমায় পিটিয়ে এসেছেন। হা হা হা। তাতে কী ভালোবাসা বাঁধ মানে বলো? মানে না, মানবেও না। সে তুমি আমায় চাও বা না চাও আমি তোমায় সবসময় চেয়ে যাবো। খুব বেশি হলে আরও দু’দিন বেডরেস্টের প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যাব। যতবার উনি চাইবেন আমি ততবার মার খাবো তবুও তোমার পিছু নেওয়া ছাড়বো না। কথা দিলাম।
অন্তি এতোটা সময় ধরে শুধু নিহালের কথা শুনে গেল। তার মানে তার মা তাকে শাস্তি না দিয়ে সবটা নিহালের উপর দিয়ে শোধ নিয়েছে।
-অন্তরা, কিছু বলবে না?
অন্তি চুপ। ওর কাছে বলার মতো কিছুই নেই এই মুহুর্তে।
-আমি অপেক্ষা করবো অন্তরা। তোমার উত্তরের অপেক্ষা। তোমার মা’কে মানিয়ে নেওয়ার দ্বায়িত্ব আমার শুধু তুমি একবার হ্যা বললেই হবে। আর কিছু করতে হবে না তোমায়। শোনো অন্তরা আমার কথা একবার ভেবে দেখো তারপর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তুমি নাও তবে না ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। একবার সবকিছু মন থেকে চিন্তা করে দেখো।
অন্তি নিহালের কথাগুলো শুনলো কিন্তু নিজে কোনো কথাই বললো না। নিরব থেকে সেই নিরবতার সাথেই সরে এলো সেখান থেকে। তারপর বাড়ি ফিরলো।

নিহালের সাথে সেইদিনই ছিল শেষ দেখা। সেইদিনের পর আর নিহালকে দেখা যায়নি তার আশেপাশে তবে সে বুঝতে পারতো নিহাল তাকে দেখছে, ঠিক দেখছে তবে সামনে আসছে না। হয়তো আসবেও না আর কখনো কেনো না অন্তি কখনোই তাকে ডাকবে না, বলবে না ‘নিহাল আপনি কোথায়? একবার সামনে আসুন না। আপনাকে না দেখতে পেয়ে আমি যে শেষ হয়ে যাচ্ছি।’ অন্তির ভাবনাটার উপর তার মনের ইচ্ছেগুলো চড়াও হতে থাকলো সে তার পরিকল্পনায় টিকে থাকতে পারলো না। একদিন মাবাইলটা ব্যাগ থেকে বের করে সোজা ব্লক লিস্টে গিয়ে নিহালের নম্বরটা আনব্লক করে সাথে সাথে তাকে কল দিয়ে বসলো আর আশ্চর্যজনক ভাবে নিহালও সাথে সাথেই রিসিভ করলো। হয়তো সে অপেক্ষা করছিল এমনই একটা কিছু ঘটার। অন্তি ফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই সামনে নিহালকে দেখতে পেলো। চোখদুটোর তৃষ্ণা মিটলো এবার। এখান থেকেই শুরু হয় এক যাত্রা যাতে শুধুই ছিল ভালোবাসা।

দিনটি অন্তির জন্মদিন। আজ সে পুরোপুরি ঊনিশ বছর পূর্ণ করলো তার জীবনের। ঘুম ভাঙতে দেরি হলেও মোবাইল হাতে নিতে দেরি হয়নি তার। মোবাইল হাতে নিয়েই আগে কল লিস্ট চেক করেছে। ভেবেছিল নিহালের কল এসেছে হয়তো তবে সে ঘুমের কারণে মিস করে গেছে কিন্তু না, কোনো মিসড কল নেই সেখানে। মোবাইল পাশে রেখে উঠে বসে সে। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে হবে তারপর নিচে যেতে হবে কিন্তু কোনো কিছুরই ইচ্ছে হচ্ছে না তার। গত এক সপ্তাহ ধরে নিহালের ব্যবহারে কেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করছে অন্তি এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না সে। এখন নিজের প্রেমিকের এমন পাল্টে যাওয়ার কারণে পরিবারের মানুষগুলোর আশায় জল তো ঢেলে দিতে পারবে না সে, তাই নিজের উপর জোর খাটিয়েই ওয়াশরুমে ঠেলে নিয়ে যায় নিজেকে।

অন্তির গাল ফোলা, মন খারাপ অবস্থা সেইভাবেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে সে। হেলে দুলে আলসেমি নিয়ে নেমে আসার সময় হঠাৎ খুশিতে চোখদুটো জ্বল জ্বল করে ওঠে তার। সামনে সিঙ্গেল সোফাতে নিহাল বসে আছে কিন্তু তার সামনে বসে থাকা নিজের মায়ের দিকে চোখ যেতেই অন্তির মনে ভয় ঢুকে যায়। অন্তির মা কিছু বলছেন নিহালকে আর নিহালও শুধু মাথা নাড়াচ্ছে। ঠিক কী হচ্ছে সেটা বোঝার জন্য একেবারেই নিচে নেমে আসে তারপর বোঝার চেষ্টা করে ঠিক তখনই হাসে নিহাল। ও হাসছে তার মানে ভয়ের কোনো কারণ নেই।

রুবির সাথে কথা বলার একটা পর্যায়ে নিহাল খেয়াল করে অন্তি দাঁড়িয়ে আছে। ও যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে তা টেরই পায়নি সে। ওকে দেখে এগিয়ে যায় নিহাল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে,
-হ্যাপি বার্থডে অন্তু।
-তুমি এখানে!
-ও তোমার জন্মদিনের উপহার, আমার তরফ থেকে। পছন্দ হয়েছে?
অন্তির অবাক ভঙ্গিতে জানতে চাওয়া প্রশ্নের উত্তরটা তার মা’ই দিয়ে দেন। অন্তি তার মায়ের প্রশ্নের উত্তর কী দেবে সে তো অবাকের শীর্ষ সীমানায় পৌঁছে গেছে এতক্ষণে। ওর এই অবস্থা দেখে হাসে নিহাল সাথে রুবিও। রুবি মেয়ের উত্তর না পেয়ে আবারও প্রশ্ন করেন,
-উপহার পছন্দ না হলে বলতে পারো আমি বাড়ির বাইরে রেখে আসবো।
-না না তার প্রয়োজন নেই আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
অন্তি নিজের বলা কথায় নিজেই লজ্জা পেয়ে যায় তারপর এসে মা’কে জড়িয়ে ধরে। রুবি বলেন,
-শোনো অন্তি, আমি তোমায় আজকের সারাটা দিন দিচ্ছি উপহার এনজয় করো সন্ধ্যে বেলা ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে কিন্তু। আমার ইচ্ছে ছিল সন্ধ্যে বেলায় সেই অনুষ্ঠানেই তোমার গিফট তোমায় দেওয়ার কিন্তু নিহালের সাথে কথা বলে জানলাম ওকে শহরের বাইরে যেতে হবে কিছু দিনের জন্য তাই এখনই… যাই হোক অনেক সময় আছে ঘুরো দু’জনে একসাথে। আমি আসি।
অন্তির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিহালকে বলে,
-আসি বাবা, ওর খেয়াল রেখো।
-আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন আন্টি আমি ওর খেয়াল রাখবো।

রুবি আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে যান তারপর অন্তি এগিয়ে এসে নিহালের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে সোফাতে বসিয়ে দিয়ে তার পাশে নিজে বসে প্রশ্ন করে,
-মা কী করে রাজি হলো?
-এজ ইউজুয়াল এক মেয়ের বাবা-মা যা করে আন্টিও তাই করেছেন। আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছেন তারপর যখন গ্রীন সিগনাল পেয়েছেন তখনই আমাকে এপ্রুভাল দিয়েছেন। বুঝেছ?
-হুম।
-এবার যাও তৈরি হয়ে এসো।
-তুমি অপেক্ষা করো আমি আসছি।

কথায় বলে না সুখের দিনগুলো বেশি দিন স্থায়ী হয় না ঠিক সেটাই ঘটলো অন্তির সাথে। একটা ঝড় এলো তার জীবনে যার নাম ‘বখতিয়ারুজ্জামান খান’। আর এই ঝড়েই সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেল অন্তির থেকে।

চলবে……