যদি তুমি চাও পর্ব-০৮

0
414

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

৮.
রুবি গাড়ি থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যান তারপর দেখেন রাফিদ বাক্সটা দেখতে ব্যস্ত। রুবি চেঁচিয়ে ওঠেন,
-রাফিদ।
-মা, তুমি এসেছো দেখো না……
রাফিদকে বলতে না দিয়ে রুবি বলেন,
-এখন কথা বলে সময় নষ্ট করিস না বাক্সটা খোল বাবা। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে খুলিসনি কেনো?
-মা তুমিই তো বললে বাক্সটা ভেতরে রাখতে আমি কী করতাম!
-এখন কথা না বাড়িয়ে আগে খোল।
রুবির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে থাকে। রাফিদ আগে উপরের গিফট পেপারটা সরিয়ে ফেললো তারপর ছুরি দিয়ে বাক্সে আঘাত করতে যাবে তখনই রুবি আটকে দিয়ে বলে,
-সাবধানে খোল।
-হুম।
রাফিদ ছুরিটা আলতো করে বাক্সের উপর বসিয়ে সেটা কাটতে শুরু করলো। রুবির কপালের কয়েক বিন্দু ঘাম একসাথে হয়ে ভ্রু বেয়ে নেমে এসেছে। ভয় পাচ্ছেন রুবি। রাফিদ বাক্স খুলে দেখতেই ছুরিটা পড়ে যায় তার হাত থেকে। রুবি এগিয়ে গিয়ে বাক্সের মাঝে উঁকি দেন। মেয়েকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন তিনি।
-রাফিদ ওকে দেখ ও ঠিক আছে কি-না।
-হ্যা, মা। দেখছি আমি।
রাফিদ বাক্সের মাঝে হাত বাড়িয়ে অন্তির হাত ধরে তার পালস চেক করলো। ঠিক চলছে।

অন্তি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। সামনে তার মা’কে বসে থাকতে দেখে মনে করে হয়তো স্বপ্ন দেখছে তাই আবারও চোখ বুঁজে খোলে সে। এখনও তার মা’কেই দেখতে পাচ্ছে সে। মা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন, চোখ দু’টো বন্ধ তার। অন্তি একবার চারিদিকটা ভালো করে দেখে নেয়। এটা তারই ঘর। এর মানে সে বাড়িতে আছে তবে কী করে মুক্তি পেলো সে? অন্তি ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু উঠতে পারে না। কয়েকবার চেষ্টার পরে যখন অসফল হলো তখন সে তার মা’কে ডাকলো।
-মা।
মেয়ের ডাক রুবির কানে যেতেই উনি উঠে এসে অন্তির পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বলেন,
-তুই ঠিক আছিস তো মা?
-উমম।
-উঠে বসবি?
অন্তি মাথা নাড়ায় যার অর্থ দাঁড়ায় যে সে বসতে চায়। রুবি মেয়েকে তুলে পেছনে বালিশগুলো উঁচু করে দেন অন্তিও তাতে পিঠের ভর ছেড়ে দেয়। বসার পরেই তার প্রথম প্রশ্ন,
-মা, নিহাল কোথায়? ওর কিছু হয়নি তো?
-নিহাল ঠিক আছে কিন্তু….
-কিন্তু কী মা! বলো আমায়।
রুবি যেনো কিছু একটা লুকোনোর চেষ্টা করছেন। যথাসম্ভব চেষ্টা করলেন নিজেকে ঢেকে রাখার কিন্তু অন্তি ঠিকই বুঝলো। সে প্রশ্ন করলো,
-মা কী হয়েছে বলো।
-এসবের পেছনে ওই বখতিয়ার খানের হাত রয়েছে সেই নিহালকে বন্দি বানিয়ে রেখেছে। ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল হসপিটালে আর সেখান থেকেই তুলে নিয়ে গেছে তাকে।
-মা তুমি পুলিশে খবর দাও ওই লোককে না আটকালে আমার নিহাল শেষ হয়ে যাবে মা।
-শান্ত হো কাঁদিস না। মা আমার কথা শোন, কাঁদিস না। আমি চেষ্টা করেছিলাম পারিনি।
-কেনো পারোনি? তোমার কী নেই মা, তুমি চাইলে তো সব করতে পারো?
-প্রমাণ। হ্যা, তার বিরুদ্ধে প্রমাণ নেই আমার কাছে।
-এখন কী হবে! নিহালকে কী করে বাঁচাবো আমরা?
-আমাকে ডেকেছিল সে, গিয়েওছিলাম। তারপর আমাকে নিহালের একটা ভিডিও দেখিয়ে বললো ওকে বাঁচাতে চাইলে তার কথা মতো কাজ করতে হবে। নিহাল অনেক চোট পেয়েছে অন্তি, ওর চিকিৎসার প্রয়োজন কিন্তু ওকে আটকে রাখা হয়েছে এক অন্ধকার ঘরে।
-মা নিহালকে ফিরিয়ে আনো না প্লিজ।
-আমি পারবো না।
-কেনো, কেনো পারবে না তুমি? তোমার মেয়ের জন্য এইটুকু করতে পারবে না তুমি! কী শর্ত দিয়েছে আমায় বলো আমি করবো যা করার।
-তুই ই পারবি শর্ত পূরণ করতে।
-কী বলতে চাইছো তুমি!
রুবি একটি ছবি এগিয়ে দিয়ে বলেন,
-এর নাম আবির। আবির রহমান। তোকে এই ছেলেকে বিয়ে করতে হবে তবেই নিহালকে বাঁচানো সম্ভব।
-মা…
আহত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় অন্তি তার মায়ের দিকে। রুবি মাথা নিচু করে বলেন,
-আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি ওকে উদ্ধার করতে। শেষ এই একটাই পথ বেঁচে আছে। সে শর্ত দিয়েছে এর সাথে তোর বিয়ে হলে তবেই নিহালকে হসপিটালে সিফট করা হবে নয়তো ও চিকিৎসার অভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে।
অন্তি কাঁদে খুব কাঁদে। যাকে এতোটা ভালোবাসে তাকে বাঁচাতে আজ তাকে ছেড়ে অন্যকারো হতে হবে! এটা কী করে মেনে নেবে অন্তি? রুবি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন,
-আজ তোর মায়ের নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে, খুব অসহায় মনে হচ্ছে। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস মা।
রুবি বেরিয়ে যেতে নিলেন তখন অন্তি তার হাত ধরে আটকে নেয়। সে বলে,
-আমি বিয়ে করবো মা। আমার বিয়ে যদি নিহালের মুক্তির পথ হয় তবে আমি সেটাই করবো।
রুবি মেয়েকে আবারও জড়িয়ে ধরেন। অন্তি কাঁদছে, রুবি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।
-কখন?
-উউ?
-কখন বিয়ে করতে হবে বলো।
-ছেলেটা আর কাজি সাহেব নিচেই অপেক্ষা করছেন। আমি অনেকবার বলেছি চলে যেতে তারা যাবেই না। সাথে চারজন গার্ড আছে তাদের হাতে গান দেখে আর কিছু বলার সাহস পাইনি আমি।
-ওদের গিয়ে বলো বিয়ের কাজ শুরু করতে আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
অন্তি বিছানা থেকে নামলো তারপর ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো সে। যাওয়ার সময় তার চোখ পড়লো ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলের উপর রাখা লাল টুকটুকে বেনারসি আর কিছু গয়নার দিকে। অন্তি শান্ত চোখে সেগুলো দেখে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। রুবিও দেখলেন সেগুলো, এসব অন্তির সাথে ওই বাক্সেই এসেছে। রুবি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। উনি কী পারতেন না আরও চেষ্টা করে নিহালকে উদ্ধার করতে! হয়তো পারতেন কিন্তু সময় যে নেই। নিহালের চিকিৎসা প্রয়োজন।

অন্তি শাড়ী পরে বধূ বেশে বসে আছে খাটের উপর কাজি সাহেব একটু পরেই এই ঘরে এসে তার সম্মতি চাইবেন আর এই প্রথমবার হয়তো তার মনে থাকা অসম্মতিকে মুখে সম্মতির নাম দিতে হবে। এমন কঠিন পরিস্থি কখনো তার জীবনে আসেনি আর আজ… অন্তি পাথরের মতো বসে আছে কিছু সময় পরপর চোখের পলক না পড়লস হয়তো যে কেউ দেখে বলতো ও একটা পুতুল। রুবি মেয়েকে তৈরি দেখে নিচে নেমে যান। সেখানে গিয়ে অবাক হোন যখন দেখেন তার অফিসের কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারী আর তার চেনা জানা বন্ধুমহলের কয়েকজন উপস্থিত আছেন। রুবির বুঝতে অসুবিধে হয় না এদের কে খবর দিয়েছে। হয়তো রুবির হয়ে ওদের দাওয়াত দিয়ে বসেছে। তবে এতো মানুষের খাবারও তো একটা ব্যপার আছে এই অবস্থায় এসব কী করে এরেঞ্জ করবেন তিনি! রুবির ফোনে একটা মেসেজ আছে,
“কী ব্যপার মিসেস খান, মেহমান ডেকেছেন তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেননি? কোনো ব্যপার না আমার মন অনেক বড় বুঝলেন আপনার মেয়ের বিয়ে অথচ খরচ সব আমার। উহু উহু, চিন্তা নেই আমি খুশি মনে এসব আপনাকে দান করলাম।”
রুবির মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তবুও তিনি চুপ থেকে দেখে যান সবকিছু।

বিয়েটা হয়ে যায় অন্তরা খান ও আবির রহমানের। অন্তরা মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় অচেনা এক মানুষের সাথে অচেনা কোনো বাড়ির উদ্দেশ্যে যেখানে সবকিছুই তার অচেনা হবে এমনকি সে নিজেও। কারণ সে তো নিজেকে নিহালের বউ হিসেবেই চিনে এসেছে আজ হঠাৎ কোনো আবিরের বউকে সে চিনতে পারছে না। মেনেও নিতে পারছে না। পারবে কি-না জানে না। এতোকিছুর মাঝেও অন্তির চোখে খুশি দেখা গেল। মা মেসেজ পাঠিয়েছেন, নিহালকে হসপিটালের বেডে দেওয়া হয়েছে। স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে তাকে। বেস্ট ডাক্তার দিয়ে তার চিকিৎসা করানো হচ্ছে।

চলবে….