যদি তুমি চাও পর্ব-০৯

0
404

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

৯.
অন্তি এই মুহুর্তে বিশাল এক ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করছে সে। সবকিছুই নতুন এই ড্রইং রুমের এমনকি পায়ের নিচের কার্পেটটাও নতুন। সব জিনিসপত্রই দামি বলে মনে হচ্ছে। সবকিছু দেখার পরে অন্তি একবার নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার সদ্য বিয়ে করা স্বামী’কে দেখে তারপর সামনে রাখা বড়ো ফুলদানিকে হাতে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে,
-স্বামী নামক প্রাণী আপনার নাম কী যেনো?
আবির এতোক্ষণ অন্তির দিকেই তাকিয়ে ছিল, ওর প্রত্যেকটা কাজকে পর্যবেক্ষণ করছিল। তার ধারণাই হয়নি এই মেয়েটা এমনভাবে প্রশ্ন করতে পারে। ও ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
-আবির রহমান
-আমার নাম জানেন?
-জানি।
-গুড।
অন্তি ফুলদানি নামিয়ে রাখে আগের জায়গায় তারপর আবার এগিয়ে যায় ডাইনিং টেবিলটা বেশ বড়ো পুরোটা কাঁচের তৈরী। খুব দামী কাঁচের ব্যবহার করা হয়েছে সেই সাথে ডিজাইনটাও বেশ নজরকাড়া। অন্তি আবারও প্রশ্ন করে,
-আপনি কী করেন?
-জি?
-আপনি কী করেন মানে কী কাজ করেন সেটা জানতে চাইছি। আসলে কী হয়েছে বলুন তো, বিয়েটা এইভাবে হুট করেই হয়ে গেল আমি তো আপনাকে ঠিকভাবে চিনিই না তাই জেনে নিতে চাইছি।
-ওহ, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছি প্রায় আড়াই বছর কিন্তু চাকরির অভাবে এদিক সেদিক ছুঁটেছি এই সময়টুকু। কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউ ও দিয়েছিলাম বটে কিন্তু কোথাও থেকে রেসপন্স পাইনি। হঠাৎ করেই গত মাসেই একটা কল আসে আমায় ডাকে। ইন্টারভিউ দেই আমি তারপর চাকরিটাও হয়ে যায়।
-বাহ! তাহলে আমি বলতে পারি… আসলে বলতেই পারি এবং গর্বের সাথেই বলতে পারি আমি ইঞ্জিনিয়ারের বউ। কি বলেন?
কথাটা বলেই হাসে অন্তি তারপর দেয়ালের সাথে লেগে থাকা টিভির দিকে চোখ যায় তার। সে বলে,
-এখানে বসে মুভি দেখলে থিয়েটার থিয়েটার ফিল আসবে তাই না?
অন্তির চোখ আবিরের দিকে। ওর এইভাবে হঠাৎ হঠাৎ করা প্রশ্নে আবির ঘাবড়ে যায়। সে শুধু সম্মতি জানায়। এক সময় অন্তি বলে,
-আচ্ছা আপনার পরিবারের কাউকে দেখছি না যে! তারা কোথায়? কে কে আছে আপনার পরিবারে?
-কেউ নেই।
-কী?
-যা শুনেছেই সেটাই, আমার পরিবারে কেউ নেই। আমি একা।
-ওহ, শুনে খারাপ লাগলো।
অন্তি আবারও এগিয়ে যায় এবার সে একটা দরজা পেরিয়ে ভেতরে যায়। ওদিকটায় সম্ভবত রান্নাঘর আছে। আবিরের ঠিক জানা নেই তাই সেও এগোয়। হ্যা, ঠিকই ভেবেছিল রান্নঘরই। অন্তি বলে,
-আপনি দেখছি সৌখিন একজন মানুষ। বেশ সাজিয়েছেন তো বাড়িটা!
-ধন্যবাদ।
-একটা শেষ প্রশ্ন করবো?
-করুন।
-আমায় বিয়ে করলেন কেনো?
আবির এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না সে ইতস্তত করতে থাকে। অন্তি নিজেই বলে,
-বুঝেছি, আপনার সাথেও তেমন কিছুই ঘটেছে যা আমার সাথে ঘটেছে।
আবির অন্তির কথায় চমকিয়ে তাকায় তার দিকে। অন্তি হেসে বলে,
-কিন্তুউউউ আপনার তো কেউই নেই তবে কাকে কিডন্যাপ করে ব্ল্যাকমেইল করা হলো?
আবির চুপ অন্তি এবার মুখের হাসি হাসি ভাবটা সরিয়ে রাগী কণ্ঠে বলে,
-লোভ, খুব লোভ আপনার তাই না! এইসব বাড়ি, দামিদামি জিনিসপত্র নতুন গাড়ি এসবের লোভ সামলাতে না পেরে আমায় বিয়ে করেছেন তাই তো! কী হলো চুপ কেনো বলুন? আপনার কী মনে হয় একটা মেয়ে যে শোকে কাতর সে এখানে এসে এসব খেয়াল করবে না তো তাকে যা খুশি বলে ম্যানেজ করতে পারবেন? আসার সময় গাড়িটা দেখেছি আমি, চকচকে বডি সেই গাড়ির। প্রথমে বুঝি সেটা দেখেই ভুলেছিলেন?
-দেখুন আপনার যা মন চাবে তাই বলতে পারেন না আপনি। আমি যতদূর জানি বিয়ে আপনার ইচ্ছেতেই হয়েছে, আপনি আমায় পছন্দ করতেন বলেই তো বিয়ে করেছেন। আমার উপর জোর খাটানো হয়েছে এই বিয়ের জন্য।
-আমি আপনাকে পছন্দ করতাম কে বলেছে সেটা?
অন্তি যেনো আকাশ থেকে পড়লো এই কথা শুনে তারপরই সে এমন প্রশ্ন করে কিন্তু আবিরের কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে সে আবারও বলে,
-শুনুন আর প্লিজ কান খুলে ভালো করে শুনবেন। আমি আপনাকে বিয়ে করেছি কারণ আমি যেই মানুষটাকে ভালোবাসি যাকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম সেই মানুষটিকে কেউ আধমরা করে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখেছিল। তাকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে আপনাকে বিয়ে করেছি আমি। আর আপনাকে যে জোর করা হয়নি তা এই ফ্ল্যাট আর তার মাঝে সাজানো সব জিনিসপত্র দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কত টাকার বিনিময়ে নিজেকে বিক্রি করেছেন ওই মিস্টার খানের কাছে? বলুন। আপনিও মশাই বেশ আছেন, সুযোগ বুঝে কোপ মেরেছেন। একজন টাকা, বাড়ি গাড়ি অফার করলো আমায় বিয়ে করার জন্য আর অমনি রাজি হয়ে গেলেন। মানুষ কী পরিমাণ লোভী হলে এমনভাবে একটা মেয়েকে নিয়ে ডিল করতে পারে সেটা আপনাকে দেখলে বোঝা যায়।
আবির এবার কিছু না বলে থাকতে পারে না,
-আমি আপনাকে বিয়ে না করলে অন্য কাউকে আনা হতো আর তার সাথে আপনার বিয়ে দেওয়া হতো। দেখুন ম্যাডাম অনেক কষ্টে অনেক অপেক্ষার পরে একটা চাকরি পেয়েছিলাম আমি, সেটা হারাতে চাইনি বলেই আজ আমি আপনার সাথে। আর এইসবের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই না কখনো ছিল। আপনি বড় ঘরের মেয়ে আমার ছোট্ট বাড়িতে কী করে এডজাস্ট করবেন এই ভেবে এইসব নিতে রাজি হয়েছি। এখন বিয়ে আমি ইচ্ছাকৃত করি বা কারো চাপে পড়ে, বিয়ে তো বিয়েই আর সেই থেকে আপনি আমার স্ত্রী। আপনার দিকটাও দেখতে হতো আমাকে।
অন্তি তেড়ে আসে আবিরের দিকে। সে দাঁত পিষে বলে,
-স্বামী হতে এসেছেন এখন তাই না! নিজের লোভী মনের লোভ ঢাকতে আমার নামটা ব্যবহার করবেন না বলে দিচ্ছি নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। কথাটা মাথায় রাখবেন।
অন্তি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে শান্ত করে বলে,
-বেডরুম কোথায়?
আবির কিছু বলবে তার আগেই অন্তি বলে,
-থাক আমি নিজেই খুঁজে নেবো।
অন্তি এগিয়ে গিয়ে একটা দরজা খুলে দেখে আগে তারপর আবার সেটা লাগিয়ে দিয়ে সামনে এগোয়। এরপরেরটাই বেডরুম। অন্তি ভেতরে গিয়ে যা দেখলো তাতে তার রাগ আরও বেড়ে যায় সে চেঁচিয়ে ডাকে আবিরকে। আবির ছুঁটে যায় সেইদিকে। ঘরে ঢুকতেই অন্তির প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাকে,
-আপনাকে জোর করা হয়েছিল না!
আবির মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় অন্তি ঝাঝালো কণ্ঠে বলে,
-তাহলে এসব কী! এসব বুঝি ভুতে করে দিয়ে গেছে? আপনি কী ভেবেছেন বলুন তো, আপনি আমায় ইমোশনাল কিছু কাহিনী বানিয়ে শোনাবেন আর আমি সেগুলো বিশ্বাস করে আপনার সাথে সংসার জীবন শুরু করবো!
আবির বলে,
-বিশ্বাস করুন আমি এসবের কিছুই জানি না। আচ্ছা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে না আপনি শুধু গিয়ে চেঞ্জ করে নিন আমি এসব পরিষ্কার করে দিচ্ছি।
-সেটাই ভালো হবে আপনার জন্য।
আবির বিছানার উপরের চাদরটা চারিদিক থেকে কোণা টেনে ধরে যত ফুল বিছানো ছিল সবটা মাঝখানে জড়ো করে তারপর রুমের ভেতরে থাকা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। চাদরটা বিছাতে যাবে তখন অন্তি বলে,
-আর কোনো চাদর নেই?
-আছে হয়তো।
-হয়তো মানে কী? আর কোনো চাদর থাকলে সেটা বিছিয়ে দিন নয়তো আজ চাদর ছাড়াই শোবো আমি তবুও এই চাদরের উপর শোবো না। এতে এখনও ফুলের গন্ধ মিশে আছে।
আবির চাদরটা সরিয়ে রাখে তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। অন্তি বলে,
-কী হলো? নেই অন্য চাদর।
-আপনি কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে যান আমি দেখছি।
অন্তি অভ্যাসবশত আলমারি খোলে আর সাথে সাথে তার চোখ কপালে। সে ভুলেই গিয়েছিল এটা তার বাড়ি তার ঘর নয়। আলমারিতে নতুন কাপড়ে ভর্তি। শাড়ি আছে সাথে কামিসও আবার টপস, প্লাজো স্কার্টও। সবগুলোই তার পছন্দের কালারের। অন্তির এসব দেখে মুগ্ধ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সে তার প্রয়োজন বোধ করলো না। একটা কামিজ আর প্লাজো সাথে ওড়না নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। অবাক করা বিষয় হলো কাপড়ের ম্যাটেরিয়ালটাও তার পছন্দের, সে এই ম্যাটেরিয়ালের পোশাক পরতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

অন্তি চলে যেতেই আবির আলমারির কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর ভালো করে দেখে একটা চাদর বের করে খাটে বিছিয়ে দেয়।

চলবে……