যদি তুমি চাও পর্ব-২৪

0
299

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

২৪.
আসার পর থেকেই অন্তি ঘরের দরজা আটকে রয়েছে এদিকে আবির বাইরে থেকে অনেকবার ডেকে যখন সাড়া পায়নি তখন দরজার পাশেই বসে গেছে। ভেতর থেকে একটা শব্দও পাওয়া যায় না। চিন্তা হয় আবিরের। অন্তি আবার কিছু করে না বসে। এখন তার রাগ হচ্ছে মেঘের উপর মনে মনে মেঘকে দোষারোপ করে বলছে সে, “স্যার না বলেছিলেন সিএনজি পাঠাবেন হঠাৎ এমনভাবে গাড়ি পাঠালেন কেনো? অন্তরা জানে আমার সাথে স্যারের আর কোনো যোগাযোগ নেই এমনকি এতোদিন ওর খেয়াল রেখে ওর প্রতি কেয়ার দেখিয়ে ওকে অনেকটা হাত করে নিতে পেরেছিলাম আর আজ এই একটা গাড়ি পাঠিয়ে উনি আমার মেহনতে পানি ফেলে দিতে পারলেন কী করে!”

অন্তি ঘরে খাটের পায়ের দিকে পিঠের ভর দিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে মেঝেতে বসে রয়েছে। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আবির তাকে এইভাবে ঠকাবে ভাবতেও পারেনি। সে মায়ের কথা না শুনে ভুল করে ফেলেছে। বড্ড বেশীই ভুল করে ফেলেছে। এখন তো ফিরে যেতেও পারবে না। কী ভাববেন মা, মেয়ে তার অপমান করে আবারও মুখ উঠিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মা’কি আর তাকে মেনে নেবেন! উহু, হয়তো নেবেন তবে আগের মতো সহজভাবে চলতে পারবেন না। সম্পর্কে পরিবর্তন এসে যাবে হয়তো। অন্তির আর ফেরার পথ নেই বললেই চলে। সে নিজেই এই জায়গাটা বেছে নিয়েছে, বেছে নিয়েছে আবিরকে। যে কিনা তাকে ঠকিয়েছে। এখন এখানেই পড়ে থেকে নিজের পরিণতির অপেক্ষা করতে হবে তাকে।

ছায়া এই মুহুর্তে সেই কন্সট্রাকশন সাইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তবে তার চোখ রয়েছে সামনের পার্কের দিকে। মেঘ তাকে এখানেই আসতে বলেছে। ও জানে না কীসের প্রয়োজনে এতো তাড়া দিয়ে ডেকেছে মেঘ তাকে তবে এইটুকু বুঝতে পেরেছে যে খুব জরুরি কিছুই হবে। খুব বেশী জরুরি না হলে মেঘ কখনোই ছায়াকে এইভাবে ডেকে আনে না তবে ছায়ার ইচ্ছে হলে তাকে জানালে সে ঠিক ছুঁটে আসে। ছোট থেকে ছোট বিষয়ে ছায়া যদি আবদার করে বসে যে মেঘকে তার পাশে থাকতে হবে তবে সাথে সাথে ছুঁটে আসবে সে। এটাই তার মেঘ। তার জন্য শত কাজ ফেলে আসতে পারে সে আর তার প্রয়োজনে ছায়া এগিয়ে আসতে পারবে না ত কী করে হয়!

মেঘ নামলো রিক্সা থেকে। ছায়া অবাক হলো, সে মেঘকে কখনো রিক্সা করে আসতে দেখেনি। মেঘ সবসময় নিজের গাড়িতে আসতো। বিষয়টা ছায়ার মাথায় ঢুকলো না তাই তো সে প্রশ্নটা করেই বসলো,
-আজ জনাবের গাড়ি দেখছি না যে, কোথায় আপনার বাহন?
ছায়ার প্রশ্নের ধরনটাতে মেঘের হাসার কথা ছিল। এমনভাবে কথা বললে যে কোনো সময় মেঘ হেসে ফেলে তার হাসিটাও মিষ্টি হাসি। ছায়া যখন বলে, “এমন মিষ্টি হাসি কোথায় পেলে মেঘ?” তখন মেঘ একটাই উত্তর দেয়, “আমার মায়ের হাসিটা নাকি আমি পেয়েছি। দাদী বলতেন এমন।” এই কথাটা বলার পরে আবারও সেই হাসি হাসে মেঘ। আজ হঠাৎ সেই হাসিখুশি চেহারায় মলিনতার ছাপ দেখে ঘাবড়ে যায় ছায়া। এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,
-কী হয়েছে মেঘ? এমন দেখাচ্ছে কেনো তোমায়?
মেঘ ছায়ার হাত ধরে বলে,
-ভেতরে কোথাও গিয়ে বসি প্লিজ?
মেঘের কণ্ঠে কেমন একটা কষ্ট মেশানো। ছায়ার বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে তবে সে জানে মেঘের কিছু বলার হলে সে ঠিকই বলবে আবার না বলার হলে শত চেষ্টা করেও তাকে দিয়ে বলানো যাবে না। তাই আর প্রশ্ন না করে ওর সাথে ভেতরের দিকে অগ্রসর হলো।

মেঘ-ছায়া বসে আছে পার্কের এক নিরিবিলি জায়গায় তবে কোনো কথা নেই দু’জনের মাঝে, আছে শুধু কিছুটা দূরত্ব যা মেঘ সবসময় বজায় রাখে। ও বলে, “কাছে আসলে তোমায় ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করবে তার’চে এই ভালো। ঢেড় ভালো, বুঝলে?” ছায়া মিষ্টি হাসে বিনিময়ে। ওর ভালো লাগে এইসব বিষয়গুলো। আর হয়তো এই কিছু কিছু ভালো দিক দেখেই তার মনটা মেঘকে চেয়েছে। যে চাওয়ার কোনো অন্ত নেই আর সে চায়ও না এর কোনো অন্ত আসুক। তার মেঘ সারা জীবন তার থাকুক, তার পাশে হাঁটুক তাকে একটু ভালোবাসুক এর থেকে একটা মেয়ের চাওয়ার আর কীই বা বাকি থাকতে পারে? এইটুকু হলেই তো জীবন পরিপূর্ণ। তবে আজ যেনো সেই মেঘটাকে খুঁজে পেতে অনেক মেহনত করতে হচ্ছে তাকে আর এতোকিছুর পরে পাচ্ছে না খুঁজে।

-এই মেঘ।
ছায়া এবার একটুখানি এগিয়ে আসে হাত রাখে মেঘের হাতে। বলে,
-কী হয়েছে তোমার?
মেঘ একবার ছায়ার মুখের দিকে চেয়ে থাকা আবার দৃষ্টি সরিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে সেখানেই দৃষ্টি স্থির রাখে। ছায়া যেনো ভেবেও উত্তর পায় না সেই দৃষ্টির অর্থ কী হতে পারে। মেঘ এবার মুখ খোলে তবে তার কণ্ঠজুড়ে কান্নার ভাব বিরাজ করে।
-ছায়া?
ছায়া আরেকটু এগিয়ে আসে তারপর বলে,
-বলো আমি শুনছি।
-তোমার মেঘ কখনো কোনো ভুল করে বসলে তাকে ক্ষমা করতে পারবে তো?
ছায়ার চোখে বিষ্ময়ের ছাপ। সে বুঝতে পারেনি মেঘ আসলে কী বলতে চাইছে তাকে তাই প্রশ্ন করে মেঘের কাছে,
-এমন কেনো বলছো মেঘ?
-এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না, ছায়া।
-মেঘ।
ছায়া মেঘের হাতটা নিজের দুই হাতে আবদ্ধ করে নেয় তারপর বলে,
-আমি জানি তোমায়, তুমি কখনো ভুল কিছু করবে না।
-এতোটা বিশ্বাস করো কী করে তুমি?
-যে ছেলে একটা মেয়েকে এতোটা কাছে পেয়েও তার সুযোগ নেয় না তাকে অন্তত অবিশ্বাস করা যায় না।
-এই ধরো আমি কোনো লম্বা দান চালার জন্য সেই মেয়ের বিশ্বাস অর্জন করছি তখনও না?
মেঘের এমন কথায় ছায়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তবে পরোক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-আমার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে?
-উহু, সত্য বলছি।
-মেঘ প্লিজ, এমন মজা করো না। এসব আমার একেবারেই ভালো লাগছে না।
-আচ্ছা করবো না।
ছায়া মুখ ফিরিয়ে থাকলেও আড়চোখে খেয়াল করে মেঘকে। সে তার চোখের কোনা মুছে নিলো। তবে মেঘ কান্না লুকোচ্ছে? মেঘও কী সবার মতো মানে যে ছেলেদের কাঁদতে নেই!
-মেঘ।
-হুম।
-তুমি কাঁদছো?
-কই না তো।
-লুকিয়ে যাচ্ছো আমার কাছে, কিন্তু কেনো মেঘ?
-বিয়েটা করে ফেলি তারপর সব বুঝতে পারবে।
-উহু মেঘ। আমি তোমায় আগেও বলেছি বিয়ে এখন নয়।
-তোমাকে বিয়ে করতে চাইছে কে?
ছায়া চোখ গরম করে তাকায় তারপর মেঘের পিঠে কিল বসাতে থাকে। আর বলে,
-তুমি বড্ড পাজি সেইটা জানো? সব কথাতেই মজা করতে হয় বুঝি!
-এমনভাবে বিশ্বাসের চাদরে জড়িয়ে নিও না আমায় পরে তুমিই কষ্ট পাবে।
-বয়েই গেছে আমার কষ্ট পেতে।
-বিশ্বাস হয় না? এই যে বললে তুমি আমায় বিশ্বাস করো!
ছায়া শান্ত হয়ে বসে মেঘের কাঁধে মাথা রেখে বলে,
-আমি তোমায় বিশ্বাস করি মেঘ। আমি বিশ্বাস করি তুমি আমায় কখনো ঠকাবে না, আমায় কখনো ছেড়ে যাবে না, মাঝরাস্তায় আমায় একা ফেলে পালাবে না। আমি বিশ্বাস করি তুমি আমায় ভালোবাসো আমার জন্য সব করতে পারো তবে আমায় কষ্ট দিতে পারো না। কখনোই পারো না।
ছায়ার কথা শুনে মেঘ হাসে। শব্দহীন হাসে। যা ছায়া বুঝতে পারে না, সে যে অন্য এক জগতে বাস করছে। মেঘের প্রতি বিশ্বাসে ভরপুর তার সেই জগতটা।

চলবে………